আমরা যা লিখি
আমরা যা লিখি তা’ নিয়ে হরহামেশা
চলছে এক হৈ হুল্লোড়
অবশ্য লেখকদের নিজ নিজ চক্রে।
এ ওর ঠ্যাং ধরে টানছে,
অমুক তমুকের চৌদ্দ গুষ্টির পিণ্ডি
চটকাচ্ছে, অশ্লীল কেচ্ছা রটানোর মতলবে
ছিটোচ্ছে বিস্তর কালি। থুতু ছুঁড়ে মারছে
আকাশে নিজে গিলে ফেলার জন্যে।
অথচ আমরা যা লিখি তা’
স্রোতের দীয়া বৈ তো নয়। ঢেউগুলি
ওদের মাথায় বয়ে নিয়ে চলেছে নিরুদ্দেশে।
কোনো কোনো দীয়া, বলা যায়, যাত্রারম্ভেই
যাবে উল্টে, হবে দম্ভের ভরাডুবি, মধ্যপথে নিভে যাবে অনেকে,
একটি কি দু’টি হয়ত
ভিড়বে অভীষ্ট তীরে। অতএর আমরা যা’ লিখি
তা’ নিয়ে মিছেমিছি এমন শোরগোল কেন? কী দরকার
লোমশ বুক চাপড়াবার? আখেরে
গুয়ে গড়াগড়ি যাওয়া এতই কি জরুরি?
আমার কাছ থেকে সরিয়ে দাও
প্রিয়তমা, আমার কাছ থেকে সরিয়ে নাও দৃষ্টি।
তোমার এই দৃষ্টপাত
কী তেলেসমাত ঘটাতে পারে
জানে না আমার ঘরের টিকটিকি,
ফ্যানের ব্লেডে বসে-থাকা চড়ুই,
বাবুই পাখি আর বাগানে দোল-খাওয়া বুলবুল।
তোমার পিতামাতা জানেন না কী গজ
লুকানো ঐ দৃষ্টিতে। তোমার ভাইবোন, পরিচালিকা,
যারা নিত্যদিন দেখছে তোমাকে, তারা কেউই বুঝতে পারে না
তোমার দৃষ্টিতে
কখন বয়ে যায় নক্ষত্রের স্রোত, কখন
তোমার চোখের বিদ্যুল্লতায় ঝলসে যায় একজন কবির হৃদয়।
এই যে এখন ধীমান সম্পাদক প্রেসে পাঠাবার আগে
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করছেন পায়রার বুকের মতো
আমার পাণ্ডুলিপি, তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব নয়
তোমার দু’চোখ শিরাজের হাফেজের মদিরা-উচ্ছ্বল
পানপাত্র; প্রিয়তমা, আমার কাছ থেকে
সরিয়ে নাও তোমার দৃষ্টি। সেই সুরা
প্রাণ ভরে পান করতে পারি,
কিন্তু আমার বুদ্ধি ঢলে পড়ুক অস্তাচলে,
আমি চাই না; প্রেমের শপথ, আমি তা চাই না।
প্রিয়তমা, আমার কাছ থেকে সরিয়ে নাও দৃষ্টি।
তোমার অতীত, তোমার বর্তমান,
শাদা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হওয়া তোমার স্বপ্ন
আর তোমার জাগরণের বোধাতীত সেই দৃষ্টি।
প্রিয়তমা, আমার কাছ থেকে তোমার
দু’চোখ সরিয়ে নাও, যেন আমার বুক
চুরমার না হয়ে যায় ঝড়-ধ্বস্ত পাখির বাসার মতো,
যেন এক ঝটকায় উড়ে না যায় আমার নিরাপত্তার তাঁবু।
আমার সময় চাই
পরিণামদর্শী ছিলাম না কোনোকালে,
তা বলে এমন সাজা পেতে হবে, ভাবি নি কখনো।
নিজকে তখনো এরকম অনাশ্রিত, অসহায়
আমার হয় নি মনে। অপরাধ করি নি, তবুও
অপরাধী বলে শক্রদল তর্জনী উঁচিয়ে খোলা
রাস্তায় আমাকে নিয়ে সার্কাস বানাবে।
শেষ অব্দি আমাকে নিয়েই যাবে, জানি।
তার আগে আত্মজের শিশু কন্যাটিকে
আরো কিছু কাল আদর করতে দাও; মায়ের মমতা,
আরো যারা হৃদয়ের খুব কাছে আছে
তাদের প্রীতির স্পর্শ পেতে দাও। প্রিয় স্মৃতিগুলিকে আবার
ডেকে আনতে চাই, আর না-লেখা কবিতাগুলি যেন
অভিমানে আমার মানস থেকে মুখ ঢেকে ফিরে
না যায় নিশ্চুপ, দাও, নির্বিঘ্ন, প্রস্তৃতি।
আমার ঘরের বই, চায়ের পেয়ালা, আসবাব
কী স্বপ্ন দেখছে আমি এখনো পারি নি জানতে, জেনে
নিতে চাই; সুন্দর আমাকে
করুক নিভৃতে স্পর্শ বার বার, তাহ’লে সহজে
দুর্লঙ্ঘ দেয়াল পার হ’য়ে যেতে পারি। করজোড়ে বলে যাই-
আমার সময় চাই, সৃজনের আরো কিছু স্পন্দিত সময়।
ঈষৎ কম্পনে
নিদ্রার স্থাপত্যে ধীরে হাত রাখে স্বপ্ন, রেশমের
স্বরে কথা বলে, আমি পড়ার টেবিলে-
রাখা মধ্যযুগের কাব্যের ছন্দমিল
আর ব্যালাডের সঙ্গে কথা বলি, নিজের সঙ্গেও মাঝে-সাঝে।
আমি গুটি কয় তাজা রুটি, এক পাত্র মদ আর
বাগানের গোলাপকে সুখস্বপ্ন দেখাতে চেয়েছি
বার বার; হাতের দশটি আঙুলকে
নিভৃতে বানাই মরূদ্যান, পায়ের গোড়ালি হয় ঝর্ণাধারা।
সন্ধ্যাকে পেছনে রেখে শ্রান্ত মুসাফির চলে আসে
সরাইখানায়, দু’ভুরুর মাঝখানে চাঁদ ওঠে,
যেন ছদ্মবেশী ক্ষত। নিজেকে মানিয়ে নেয় পোকামাকড়ের
পছন্দের ডেরায়, পতঙ্গ পুড়ে যায় অগ্নিশিখা ভালোবেসে।
নির্বাসিত রাজপুরষের মতো একা-একটা ঘুরি,
কখনো-বা ভুল পড়ে চলে যাই। বিশ্বস্ততা কাঁটার মুকুট
পরে হাঁটে কায়ক্লেশে, শতাব্দী পেছনে পড়ে থাকে;
স্মৃতি যেন উটের পায়ের চিহ্ন মরুর বালিতে।
প্রতীক্ষার সময় ফুরায়; যার উপস্থিতি এখনো কুয়াশাবৃত,
তার কণ্ঠস্বর অতীতের শ্লোক আওড়ায়।
কিছুই পড়ে না মনে, জানি না চোখের পাতা কেন এই মূঢ়
বেঁচে-থাকা ধরে রাখে ঈষৎ কম্পনে?
উইলিয়াম কেরীর স্মৃতি
যেদিন শ্রীরামপুরে পা রেখেছিলাম, হাওয়া এসে
চৌদিকে রটিয়ে দিলো সগৌরবে আপনার নাম।
আমি সেই নাম চেতনায় বয়ে অতীতের দিকে
চলে যাই। দেখি, একজন প্রকৃত মানুষ হেঁটে
যাচ্ছেন একাকী কায়ক্লেশ তুচ্ছ করে লোকদের
শোনাতে সুসমাচার। কখনো অধিক রাত অব্দি
জেগে করছেন অনুবাদ বাইবেল বাংলা ভাষা
ভালোবেসে; বাংলা গদ্য করে যাত্রা আধুনিক পথে।
আপনার ছিল টান গাছপালা, ফুল ফল আর
ফসল-ফলানো উদ্যমের প্রতি, শেষ বয়সেও দিতেন
প্রসন্ন দৃষ্টি মেলে স্বরচিত প্রিয় সেই
উদ্যানের দিকে; জ্ঞান আর মানব প্রেমের বসে
আপনি স্বদেশ ছেড়ে এসেছিলেন বাংলায়, তাই
বাঙালি কবির মনে আপনার স্মৃতি দ্যুতিময়।
উপেক্ষার পর্দার আড়ালে
জমে নি আমার পুণ্য এক রত্তি ভেবে নিয়ে পাড়াপড়শিরা
জনান্তিকে আমাকে হাবিয়া দোজখের অগ্নিকুণ্ডে
নিক্ষেপ করেন দশবার। আল্লা-অলা একজন
আমাকে গাফেল আখ্যা দিয়ে মনে-মনে
এশার নামায শেষে কিছু নসিহতের আহত
সাগ্রহে ছিটিয়ে দেন আমার ওপর।
একজন বাউল ঘুঙুর পায়ে দোতারা বাজিয়ে
আমাকে মনের মানুষের নিগূঢ় সন্ধান দিতে
গান গেয়ে রহেস্যের টানেন। নিয়মিত
নিশীথে জিকির-করা মারফতী একজন জপেন আমার
কানে কানে, ‘আখেরাতে তোমার কী হাল
হবে বেখবর তুমি মুর্শিদ খোঁজো না’!
একজন প্রচণ্ড পণ্ডিত খুব আড়চোখে পর্বত প্রমাণ
আমার অজ্ঞতা দেখে অট্রহাসি হয়ে যান আমার কতিপয়
মেরুদণ্ডহীন লোক, ‘দেখি তোর শিরদাঁড়া কই’
বলে এক ঝটকায় বিকেল বেলায়
আমার চায়ের পেয়ালাটা কেড়ে নেয়,
তরল পানীয় আর নিষ্ঠীবন একাকার। আমি
সব কিছু উপেক্ষার পর্দার আড়ালে রেখে
দেখি হাঁটি হাঁটি পা পা আমার নাতনী
আমারই উদ্দেশে ছুতে আসে। কবিতার
খাতা আপাতত দূরে সরিয়ে ক্ষণিক
শিশুঘ্রাণ বুকে নিয়ে পেয়ারা গাছের নিচে পড়ন্ত বেলায়
পুণ্যস্নান করি।