শব্দশব
বসে, শুয়ে দাঁড়িয়ে,-কিছুতেই
না আমার সুখ, না স্বস্তি।
রেস্তোরাঁয় চিকেন কাটলেট অর্ডার দিয়ে অথবা বাসস্টপে
দাঁড়িয়ে, পার্কের বেঞ্চিতে বসে গাছ থেকে
পাতা খসে-যাওয়া কিংবা
ঝালমুড়িঅলার তৎপরতা দেখতে দেখতে
আমি ছটফট করি।
মনে আমার চরকি; চাদ্দিকে এই
ঘোরাঘুরি আমার সময়কে খায়, আমাকেও
খায়। সুতোহীন এক রঙিন ঘুড়ি
আকাশে দুলতে দুলতে যায় হাওয়ায় হাওয়ায়
আর তাকে ধরার জন্যে ছুটতে থাকি অবুঝ
বালকের মতো। সবুজ ঘাসে লুকানো পাথরে হোঁচট খেয়ে
আমার ঠোঁট থেকে ঝরে রক্ত। তবুও
হুঁশ নেই, চলে হাত বাড়িয়ে অবিরাম ছোটা।
না বিত্তের ঝলসানি, না রমনীয় ভালোবাসা,
শুধু এক শব্দ্তৃষ্ণা আমাকে অষ্টপ্রহর
তাড়িয়ে বেড়ায় এদিক থেকে ওদিক।
হাওয়া, গাছের পাতা, রোদের টুকরো
আর পাখির পালক থেকে শব্দ পাওয়ার
আশায় এই বয়সেও ভাষাহীন আমার তুমুল ছটফটানি।
হঠাৎ কিছু শব্দ পেয়েও যাই, অথচ শব্দগুলোকে
ঠিকমতো সাজাতে গিয়ে
পণ্ড করে ফেলি বিন্যাসের আলপনা আর
প্রিয়তমা শবের পাশে বসে উস্কো খুস্কো।
শান্তি কি হরিণ
শান্তি কি হরিণ হয়ে ঘুমাচ্ছিল এখানে কোথাও? ‘স্বপ্ন দাও’
বলে সে কি ঘুমের ভেতর অন্তরীণ
উঠেছিল নড়ে? তার শরীরে আঁচড়
পড়ে এলোমেলো, জেগে বিখ্যাত দু’চোখ
মেলে খোঁজে ঝিলের ঝলক ত্রস্ত তাকায় অদূরে,
দেখে নিতে চায় সন্ত্রাসের নেশায় মাতাল কোনো
ব্যাধের নিশানা তীক্ষ্ণ হয়ে আছে কি না।
অথচ বাজায় বীণা গাছ, প্রজাপতিদের নাচ
পাতায় পাতায়; তবু ভয় জেগে রয়
স্পন্দিত হৃদয় জুড়ে। কত ভালো হয়, যদি গুপ্ত
নিষাদের পায়ের তলার মাটি দ্রুত সরে যায়,
দেবতার হাত নেমে আসে অকস্মাৎ মেঘ থেকে।
শুদ্ধ হতে চাই
আহ্ কতকাল পর দেখা। এখন তোমার কোনো
খবর রাখি না বন্ধু, এ লজ্জা আমার। কী করে যে
তোমাকে ভুলেছিলাম এতদিন, অথচ দিন ছিল
আমরা দু’জন দিব্য একই বিছানায় ঘুমোতাম
গলাগলি, দাড়ি কামাতাম একই ব্লেডে। পরস্পর বলাবলি
করতাম নিজ নিজ স্বপ্ন কথা। আহ্ কী সুন্দর
স্বপ্নই না দেখতাম আমরা তখন।
সেসব স্মরণ করে বুকের ভেতর হু হু হাওয়া বয়ে যায়।
কী-যে হলো, সঙ্গের সংঘর্ষে বাচালের হুমকিতে,
সঙ্গীতের ভ্রষ্টাচারে তুমি দূরে, খুব বেশি দূরে
সরে গেলে; আমাকে গিলতে হলো নোংরা।
বার বার বিসমিষা পাক খায়, ভেদবমি হ’য়েও নিস্তার
নেই, দ্যাখো আজ আমি গুলি-খাওয়া বাঘের মতোই
আপন গুহায় শুয়ে ক্ষত চেটে নিরাময়
চাই আগোচরে, ভুলে যেতে চাই সেই আত্মঘাতী
তমসার সরীসৃপ-স্মৃতি। হা করি, কী নিঃস্ব আমি।
যাক গে, ভালোই হ’লো, হঠাৎ তোমার সঙ্গে দেখা
এই অবেলায়; হয়তো আমি
নিজেরই অজ্ঞাতসারে তোমাকে খুঁজেছি
অন্তরের বাহিরে সর্বক্ষণ। দ্রষ্টা তুমি, এ গরিব
ভিখিনীকে তোমার ভেতরে টেনে নাও,
হৃদয়ে রঙিন পাখি পোষার অবাধ অধিকার
দাও আর তোমার আশ্চর্য সব স্বপ্ন জাগাও আমার চোখে,
আমিও তোমারই মতো শুদ্ধ হতে চাই।
শ্বাসকষ্ট
হৈ হৈ হাটে কিছু কেনাকাটা কিংবা বেচা
ছিল না আমার মনে। তবু
ঘেঁষাঘেষি, পা মাড়ানো, গুঁতোগুঁতি আমাকে বিব্রত,
বিমর্ষ, বিপন্ন করে। কেউ কেউ রক্তের তিলক
কপালে পরিয়ে দেয়, কেউ বা পাঠায়
লাঠির অরণ্যে, হামেশাই গালি গালাজের বানে
ভাসি, আর কোমরবন্ধের নিচে খুশি
মেরে প্রতিপক্ষ সুখে পানসি ভাসায় নদীবক্ষে পাল তুলে।
খুব সাবধানে তাঁবু খাটিয়ে নিজেকে নিরালায়
লুকিয়ে রাখার সাধনায় মগ্ন হই, ভালো থাকি
সূর্যমুখী-ছাওয়া মাঠে, গাছপালা, পাখিদের জলসায়, দিঘির স্নেহের
স্পর্শ নিয়ে, মাঝে মাঝে সাঁঝে দেখি একটি তরুণী
খোঁপা থেকে ফুল খুলে ভাষায় দিঘির জলে, চলে
যায় দিগন্তের দিকে। অন্য কারো পদচ্ছাপ দেখি না কখনো।
অকস্মাৎ দুরন্ত ঝঞ্ঝায় এক ঝটকায় সুরক্ষিত
তাঁবু উড়ে যায়, খুঁটিগুলি শূন্যে ওড়ে,
দেবোপম উলঙ্গতা নিয়ে হি হি কাঁপি,
জলজ রাক্ষস তীক্ষ্ণ দাঁত দেখায়, কাচের মতো
ভাঙে প্রতিবোধ, চতুর্দিকে পুনরায়
হট্ররোল জেগে ওঠে; শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতে থাকে।