যখন পেছনে ফিরে
যখন পেছনে ফিরে তাকাই সহসা, বিস্ময়ের
রূপালি চমক লাগে চোখে। সুদূর বালক এক,
নিঃসঙ্গ কিশোর, গানে-পাওয়া যুবা একজন,
যখন আমার প্রতি রুমালের ভালোবাসা নাড়ে
এই সান্দ্র গোধূলিতে, চেনা লাগে; আমিও ব্যাকুল
করি প্রিয় সম্ভাষণ। তাহলে কি সত্যি আমি সেই
দূর পাড়াতলীর শ্যামল পথ, আরো পথ ঘাট,
বেগার্ত নদীর বাঁক, বৃক্ষহীন মাঠ, দীর্ঘ সেতু
এবং শহুরে ঝিল পেরিয়ে এসেছি? ছিল যারা
আশেপাশে, একে একে ছিটকে পড়েছে কে কোথায়
আজ শিকারির গুলিবিদ্ধ পাখির ঝাঁকের মতো।
একজন বন্দ ঘরে রাত্রির টেবিল ঘেঁষে একা
পদ্য লেখে এবং হৃদয় তার আর্তনাদ করে
নিঃস্ব নির্বাসিত বাহাদুর শাহ জাফরের মতো।
এখন পেছনে ফিরে ব্যাকুল তাকাতে সাধ হয়
মাঝে মধ্যে, বিগত যা তাকে দামি আংটির মতন
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিই বারংবার আর ছাড়ি
দীর্ঘশ্বাস আমার নিজেরই অগোচরে। ফের কোন্
অজুহাতে পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ভালোবাসা জেগে
উঠবে শ্যাওলা নিয়ে সত্তাময়। অতিক্রান্ত কাল
নিঝুম প্রত্যক্ষ করি যেমন বিদেশ থেকে ফিরে
একান্ত আপন প্রিয় শহরকে দেখি পুনরায়,
দেখি ঘর গেরস্থালি, মানুষের আনাগোনা, স্মিত
বাসর ঘরের আলো, শোকাপ্লুত কালো শবযাত্রা।
আজ থানা পুলিশের মলিন প্যারেড থেকে দূরে
দেবদূতী চুক্তি ক’রে দ্যুতিময় কবিত্বের ঘোরে
সবখানে শব্দ-নখ প্রবল বসিয়ে দিতে চাই।
সকলেই গ্যাছে
সকলেই চলে গ্যাছে, বলা যায় পৌঁছে গেছে ঠিক
নির্দিষ্ট গন্তব্যে, শুধু আমি এই দম আটকানো
রুদ্ধ এলাকায়
দাঁড়ানো ভীষণ একা। কথা ছিল যাবো, নিশ্চয় আমিও
যাবো
সকলের সঙ্গে, কিন্তু আমি বড় বেশি দেরি করে
ফেলেছি নিশ্চিত।
ওরা কেউ পথে কোনো কিছু দেখে, মানে
রূপ-শোভা দেখে দাঁড়ায়নি
একদণ্ড থমকে কোথাও।
ওরা চলে গেছে, লক্ষ্য স্থির রেখে সময় মাফিক।
অথচ স্বভাবদোষে আমি
বস্তুত পথের মোড়ে থামিয়েছি গতি বারে বারে,
কাটিয়ে দিয়েছি বেলা ঘাসফুল আর হরিণের
কী স্নিগ্ধ বিশ্রাম দেখে এবং সত্তায় মেখে সূর্যোদয় আর
নিশ্বাসে গভীর টেনে বৃক্ষঘ্রাণ। কখন যে দলছুট হয়ে
পড়েছি পাইনি টের। এখন আমার
চৌদিকে দেয়াল শুধু নীরন্ধ্র দেয়াল, কোনো দিকে
পথ খোলা নেই এতটুকু। ইতস্তত
ছুটছি ভীষণ এলোমেলো, গলা ছেড়ে
ডাকছি, অথচ
কোথাও কারুর কোনো কণ্ঠস্বর নেই।
যখন মানুষ কোনো স্থির লক্ষ্যে দ্রুত
পৌঁছে যেতে চায়
তখন পথের ধারে দোয়েলের শিস শুনে অথবা দিঘিতে
মাছের রূপালি ঘাই দেখে,
ঝরনা-ধ্বনি শুনে
থমকে দাঁড়ানো, এই মতো কালক্ষয়
সমীচীন নয়। পূর্ণিমার, মল্লিকার প্রেমে পড়া
কস্মিনকালেও নয় লক্ষ্যভেদী পথিকের যোগ্য আচরণ।
সেই গাছ
আমি আমার বাড়িতে প্রত্যহ আসা-যাওয়ার পথে
একটি গাছকে দেখি। অসামান্য কিছুই নয়,
ফুলটুলও তেমন ফোটে না
তার ডালে। সবুজ পাতাগুলি
ঝলমলিয়ে ওঠে রোদে,
পান করে জ্যোৎস্নাধারা।
সবুজ পাতাগুলি কখনো হলদে হয়,
তারপর পাতা
ঝরতে থাকে,
ঝরতে থাকে,
ঝরতে থাকে
গাছটিকে উলঙ্গ ক’রে।
আমি তার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমার মধ্যবয়সের
ক্লান্তি মুছে ফেলতে যাই না,
ওকে দেখি দূর থেকে, বাড়ি ফেরার পথে,
বাড়ি থেকে বেরুবার সময়। কখনো কখনো শুনি
কী একটা পাখি
ডাকতে থাকে,
ডাকতে থাকে
ডাকতে থাকে
গাছটিকে সঙ্গীতময় ক’রে।
একদিনের কথা,
কোত্থেকে এক ছন্নছাড়া উদ্ভ্রান্ত ফকির সেই
গাছতলায় আস্তানা গাড়লো
কদিনের জন্যে, তারপর বলা-কওয়া নেই
হঠাৎ নিরুদ্দেশ। মাঝে-মধ্যে
পাড়ার দু-একজন মাস্তান সময়ের তোয়াক্কা না করে আড্ডা দেয় সেখানে,
ওদের মধ্যে কেউ গাঁজেল, কেউ তাড়ি টানে,
কেউ নারীর আঁচল,
কেউবা পাকিয়েছে হাত
ছোরা খেলায়।
ছাপোষা মানুষ আমি, বেসরকারি
স্কুলের শিক্ষকের অক্ষম সন্তান। ইদানীং
বয়সের ভারে ভয়ানক নুয়ে পড়েছেন আমার পিতা,
অবসর তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে, জীবনের
হাতে মার খেতে খেতে তিনি ভীষণ অবনত।
যখন তিনি জায়নামাজ বিছিয়ে
নামাজ পড়েন, তখন তাঁকে শাদাসিধে
আলমগীরের মতো মনে হয় আমার নিজস্ব
স্বপ্নের খোয়ারিতে।
আমি এখনো মাথা নত করিনি।
যা আমার শিক্ষক জনক আমাকে শেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন
সেই উজ্জ্বল সবকটি আমি
শিখে নিয়েছি
শান-বাঁধানো পথের ধারের
সেই গাছ থেকে,
শিখে নিয়েছি তুমুল ঝড়-বাদলেও
কী করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
হাতেম তাই কিংবা শের আফগান
সন্ধ্যে হলেই লোকটা দাতা
হাতেম তাই। তখন তার মুখ থেকে লাগাতার
মণিরত্ন ঝরে, আবার যাতা
শব্দ বেরুতে থাকে, যা নিমেষে নর্দমার
প্রতিযোগী করে তোলে ওর
কণ্ঠনালীকে। লোকটা পকেট উজাড় ক’রে
মধ্যরাতে রিকশায় পায়ের ওপর
পা তুলে ফিরে আসে নিজস্ব গলির মোড়ে।
মেঘের ভেতর দিয়ে সে হেঁটে যায়
একা-একা, ভাড়াটে বাড়িটাকে ওর মনে হয়
বাদশাহী আমলের আলিশান মহল, তার দোরগোড়ায়
রাতের রোগাটে কালোয়
দাঁড়ানো এক সপ্রতিভ উট।
ওর গলার ঘুণ্টি সাপের মাথার মণির মতো
জ্বলজ্বলে আর কার্নিশে এলিয়ে-থাকা অন্ধ জলপরীর মুখে চুরুট
অবিরত
জ্বলে আর নেভে। দরবারী ওস্তাদের গান
অমর্ত্য ফোয়ারা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে
সমস্ত চরাচরে
এবং লোকটা নিজেকে ঠাউরে নেয় শের আফগান।
দিনে যেমন তেমন, সন্ধ্যে হলেই কী এক যাদুকাঠির হেলনে
লোকটা কেমন যেন একটু অন্য রকম
হয়ে যায়। ক্ষণে ক্ষণে
তার রূপ পাল্টাতে থাকে। কখনো সে বাক বাকুম
পায়রা, কখনো বা পাথর। গোলাপী ছিটে-লাগা চোখ দুটো
জড়িয়ে আসে
ঘুমে, আবার কখনো কিসের আভাসে
জ্বলে ওঠে ধ্বক ক’রে। লোকটার বুকের মধ্যে একটা ফুটো
আছে যার উৎস থেকে ক্রমাগত
চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে রক্তের মতো
একটা কিছু। অবশ্য এজন্য সে কোনো
শোক পালন করে না কখনো।
আরো অনেক কিছুর মতোই এটাও দিব্যি তুড়ি মেরে
হেসে উড়িয়ে দেয় সে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোথায়
কী গণ্ডগোল পাকাচ্ছে, কোন চলে কখন কে হেরে
যাচ্ছে, কে-ইবা জিতছে; কার দায়
কে বইছে সিসিফসের বোঝার মতো তা নিয়ে
তিলার্ধ মাথা ব্যথা নেই তার।
অথবা জিহ্বা শানিয়ে
মেতে ওঠা তুমুল তর্কে, ঝাঁপিয়ে পড়া শানদার
ভালুকের লড়াইয়ে তা-ও ধাতে
নেই ওর। অবশ্য বেলা অবেলায়
কী এক জুয়োখেলায়
সেঁটে থাকে অথচ তুরূপের তাস রাখেনা হাতে।
দিনে দিনে রহিম করিম থেকে
আলাদা হয়ে যাচ্ছে, রাম আর শ্যামের ভেতরকার
সাঁকো গুঁড়িয়ে গেছে; একটা কর্কশ অন্ধকার
অনবরত ঢেকে
ফেলছে সবাইকে, রাম-শ্যাম-যদু-মধু রহিম-করিম
প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাছ থেকে কেবলি শত শত
ক্রোশ বিচ্ছিন্ন হয়ে চলেছে নিঃসীম
সমুদ্রের ধমক খাওয়া নৌকার মতো-
এ ভাবনার প্ররোচনা
তার মধ্যে করেনা কোনো বিস্ফোরণের সূচনা।
যেই শহরে সন্ধ্যা আসে ব্যেপে
অমনি লোকটা
চোখটা
এদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে ওঠে মোহন ক্ষেপে।
তখন ডাল-ভাত আর মুড়ি শশা আর চা-বিস্কুটের স্বাদ থেকে দূরে
স’রে এসে ডোবে ভিন্ন স্বাদে,
এবং ষড়জে নিখাদে
অস্তিত্ব তার অলৌকিক সুরে
গেয়ে ওঠে গান
আর নিমেষে হয়ে যায় সে হাতেম তাই কিংবা শের আফগান।