- বইয়ের নামঃ অবিরল জলভ্রমি
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অনাথ আশ্রমে
আকাশে নিমগ্ন শারদ রোদ্দুর,
শস্যদানা খুঁটে তিনটি হাঁস খায়।
নামিয়ে মাঝপথে যাত্রী কতিপয়
দৃশ্য থেকে ফের দৃশ্যে বাস যায়!
অতীত-চেরা মৃদু আলোর ঝলকানি-
দাঁড়ানো ছিলে তুমি একলা গৃহকোণে।
বিবাগী মেঘ বুঝি গাছকে চায় ছুঁতে,
তোমার চোখ দুটি কুহক জাল বোনে।
শহরতলী দিলো বাড়িয়ে বাহু তার,
ছুটির দিন যেন গুণীর হাতে বীণ;
তোমার দৃষ্টিতে হৃদয় বিম্বিত,
সেদিকে তাকালেই আমার বাড়ে ঋণ।
তোমার ওষ্ঠের ব্যাকুল তট জুড়ে
স্তব্ধ ছিল কথা সেদিন প্রথমত,
এবং আমাকেও বন্দি করেছিল
কে এক মূক লোক দুপুরে মুখ্যত।
পথের ধুলো ধুয়ে দিঘির কালো জলে
চকিতে চেয়ে দেখি ভেসেছে ঘাটে ঘড়া।
আমার পাশে তুমি শরীরে নিয়ে ঢেউ
গহন নিসর্গে হলে স্বয়ম্বরা।
পড়ে না দৃষ্টিতে শরীরজোড়া শাড়ি,
বাকল গেছে এঁটে প্রখর যৌবনে।
শিরায় ছোটে কত যুগের হরিণেরা,
তৃষিত ঠোঁট রাখি তোমার যৌবনে।
নিমেষে খসে যায় মদির আদিমতা,
তোমার সত্তায় লজ্জা পুষ্পিত,
আমিও ভব্যতা আবার ফিরে পাই,
লোকের কথা ভেবে ঈষৎ হই ভীত।
সাজালে চৌকিতে পঞ্চ ব্যঞ্জন,
শরীরে চুমো খায় হাতপাখার হাওয়া।
রাখবে চোখে তুমি হাতের নড়া গেঁথে,
দেখবে গোধূলিতে আমার চলে-যাওয়া।
আমার অন্তরে তোমার অঞ্জলি
অর্ঘ দেয় মেলে, ঋদ্ধ হই আমি।
কখনো এ-অর্ঘ অসার হয়ে যাবে-
এ-কথা সরাসরি বলতে গিয়ে থামি।
শহরে ফিরে গিয়ে হয়তো ভুলে যাবো,
দগ্ধ মনে কত স্মৃতির ধোঁয়া জমে।
কখনো এটা আর কখনো ওটা ভুলি,
তোমার প্রেম বাঁচে অনাথ আশ্রমে।
অপদার্থের গান
কী চাও আমার কাছে বন্ধুরা এখন? ইতোমধ্যে
পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছি, চুলে পাক ধরেছে বেবাক
অনেক আগেই, কোনো কোনো দাঁত খুব নড়বড়ে,
চোখে কম দেখি ইদানীং, প্রায় অদৃশ্য পৃথিবী
চশমা ব্যতীত আর শিরায় শিরায়
মাঝে মাঝে রক্ত ফুঁসে ওঠে,
তখন দাঁড়ানো কিংবা বসে থাকা নয়,
বিছানায় শুয়ে থাকাটাই
সমীচীন মনে হয়। আইঢাই করে প্রাণ হর-
হামেশাই; মোট কথা, স্বাস্থ্যের আকাল
আমার অস্তিত্ব ঘিরে। তাই বলি, যখন আমার বাস্তবিক
এই হাল, তখন আমার কাছে কার কী পাওয়ার থাকে আর?
তোমাদের জ্বলজ্বলে সারিতে দাঁড়ানো
সাজে না আমাকে। যতদূর মনে পড়ে
কখনো শৈশবে দস্যুতায় ভাঙিনি পাখির বাসা,
এবং খেলায় মেতে ছিঁড়িনি প্রজাপতির পাখা আর রঙ-
বেরঙের বেড়াল ছানাকে ডুবাইনি নর্দমার নোংরা জলে
অথবা যৌবনে বন্দুকের নল আমি
কখনো করিনি তাক কাজল বিলের ঝাঁক ঝাঁক
বালি হাঁস, সুন্দরবনের কোনো হরিণের দিকে।
এত অপদার্থ আমি যে সুযোগ পেয়েও একালে
কোনো অস্ত্র, এমনকি তীর ও ধনুক, হায়, চালাতে শিখিনি।
এই যে দেখছো যাকে সে নেহাত স্তিমিত পুরুষ,
গানে-পাওয়া, নানা ছদ্মবেশী নেকড়ের তাড়া-খাওয়া,
উদাসীন, শব্দের ধীবর,
একে দিয়ে কী এমন কাজ হবে তোমাদের? আজ
কেবল ক্ষমাই প্রাপ্য তার। যদি সে দাঁড়ায় পাশে,
মুগ্ধাবেশে দ্যাখে তোমাদের, তবে তাকে
করবে কি অবহেলা? যতই আসুক ব্যেপে নৈরাশ্যের কালো
পঙ্গপাল, অন্তত সে বাঁচার অভ্যাসে নয় বীতরাগ।
আমার অভদ্র পদ্য
আমার অভদ্র পদ্য পাৎলুন গোটানো, খালি পায়,
মধ্যবয়সের গাঢ় তামাটে রঙের
ছোপ নিয়ে গাঢ় শিস দিতে দিতে কুর্নিশ ছাড়াই
কুলীন ড্রইংরুমে ঢুকে পড়ে বলে,
‘আমাকে বসতে দিন চেয়ারে সোফায়। কঁচুমাচু, হাত জোড়
করে এক কোণে
দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি আয়ত্ত করিনি, সমাজের মধ্যমণি
আপনারা, জেনে
রাখুন, নাছোড় এই বান্দা। এখানে রয়েছে যারা
ধান্দাবাজ ফোঁপরদালাল সাধুবেশে
অসাধুর শিরোমণি, তাদের মুখোশ টেনে খুলে
ফেলবো নিমেষে আর আমার ঝাঁঝালো অট্রহাসি
ভীষণ কাঁপিয়ে দেবে মনোরম এ অট্রালিকার
ভিত আর হট্রগোলে
চকিতে করবো দাবি একান্ত আপনাদের শত
সুন্দরীর রঙিন চুম্বন, প্রাণে তরঙ্গ-জাগানো আলিঙ্গন।
ন্যাকা, মিল, ন্যালাক্ষ্যাপা অনৃপ্রাস থেকে সাত হাত
দূরে সরে, কাঁদুনির পাক
থেকে মুক্ত হয়ে
আমার বেয়াড়া পদ্য ঘোরে রহস্যের আঁকাবাঁকা
ঘুপচি গলিতে, সদ্য জেগে-ওঠা চরে,
গা এলিয়ে দেয় অপসৃত দেয়ালের ঘরে, বিদ্বেষবিহীন
উদাসীন নির্বিঘ্নে কাটাতে
চায় দিন, কিন্তু তার নৈঃশব্দ্যের এলাকায় হাতবোমা ছুড়ে
কারা যেন তার তীব্র বসন্ত দিনের
স্বপ্নকে ভীষণ খোঁড়া করে দেয় আদিম আক্রোশে।
ক্ষতিপূরণের দাবি না তুলেই আমার অত্যন্ত জেদী পদ্য
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে গুলিবিদ্ধ বীরের ধরনে।
বকধার্মিকের দল বারবার তেড়ে আসে লাঠি
উঁচিয়ে আমার
অশিষ্ট পদ্যের দিকে পুড়িয়ে মারতে চায় দূর মধ্যযুগী
মনের বিকারে আর নাছোড় শিকারে মাতে তাকে
বন্য পশু ঠাউরে, অথচ
এই পদ্য বিবর্ণ জীনস্-পরা ঋষ্যশৃঙ্গ, প্রখর খরায়
বৃষ্টি নামানোর ব্রত নিয়ে
আসে জনপদে
তপস্যার কী রুক্ষ নির্জন ঘেরাটোপ ছেড়েছুড়ে। বৃষ্টি এলে
ফিরে যায় বাজিয়ে উদাস কণ্ঠে প্রত্যাবর্তনের আর্ত সুর
আমার অন্বেষাপরায়ণ পদ্য চৌদিকে বুলায়
চোখ, তার দৃষ্টিতে মৃত্যুর
বিষয়ে তেমন কৌতূহল নেই আপাতত, কেউ
তার ট্রাউজার, শার্ট থেকে শ্রমিকের ঘেমো
গন্ধ পায়, কেউ কেউ বনশিউলির, চন্দনকাঠের ঘ্রাণ।
ত্রাণ শিবিরের এলেবেলে স্মৃতি নিয়ে
সূর্যাস্তের পরে
ঘরে ফেরে একা-একা ছটফট করে সারাক্ষণ, তারপর
বেরোয় রাত্রির পথে, হাঁটে,
সুদীর্ঘ আণ্ডারড্রেনে উজিয়ে বিষ্ঠার স্রোত মধুর বাজায়
পিতলের বাঁশি, যায়
কৃষ্ণাঙ্গ কবির সঙ্গে তাচ্ছিল্যে ফাঁসির মঞ্চে, চোখ
রাখে জল্লাদের চোখে। উত্তুরে হাওয়ায়, দোল-খাওয়া
কবির ছায়াকে ভালোবেসে
আমার এ ব্রাত পদ্য ছায়াপথে পর্যটক হয়। তার চোখে
তোমরা কখনো কেউ বইয়ে দিও না
সুদূর পারের অশ্রুনদী, কেননা নিশ্চিত জেনো,
এরপরেই তো জলে ধরবে আগুন।