বিকল্প
যখন আমার কেউ থাকে না,
তখনও সে থাকে। সকল সময় ওর ঠোঁটে
শরতের রোদ্দুরের মতো
হাসি জড়ানো। ওর ঘন কালো চুলের বিন্যাস
কখনো বিপর্যস্ত; শরীরের ঢেউ
স্বপ্নের নক্শা আঁকে অবিরত সন্ধ্যার
আবছা স্বপ্নাভায়, রাত্রির স্তব্ধতায়।
তার কাছে যেন আমি প্রার্থনা করি
ভালোবাসবার অবসর এবং অমিতরায়ের ধরনে
তার কানে কানে বলি, আমার ভালোবাসা নয়
ঘড়ার জল, ওতে আছে দিঘির সাঁতার। আমাদের
ভালোবাসাবাসি শেষ অব্দি টিকবে কিনা
জানিনা, তবে এই মুহূর্তগুলি
সত্যের জ্যোর্তবলয়ে ঘূর্ণ্যমান।
ওকে নিয়ে পার্কে বেড়াই বিকেল বেলা,
ফুচকা, চটপটি খাই, মাঝে-মধ্যে রেঁস্তরার
কেবিনে বসি; পায়ে পা ঘষি, চুমু চুমু
খেলা খেলি, একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমীর
গ্রন্থমেলায় যাই, কখনো পাশাপাশি
হাঁটি মীনাবাজারে।
কোনো কোনো মধ্যরাতে দেয়াল থেকে
নামিয়ে আনি তাকে,
চোখে তুলে নিই, আলিঙ্গন করি বারবার।
তখন হঠাৎ আমার ভেতর
জেগে ওঠে পাগলা মেহের আলি।
বড় রাস্তায়
ব্যাপারটা কী
ভেবে দেখেছেন একবারও?
যতবার যাত্রা শুরু করি, ততবারই
পা এসে ঠেকে সর্প কুণ্ডলীর মতো
এক কানাগলিতে।
এমন হবার কথা নয়, তবু হচ্ছে
বারবার একই রকম। কখনো কখনো আমার মনে হয়,
বিসমিল্লাতেই গলদ নিশ্চয়; নইলে
কেন এই পুনরাবৃত্তির গোলক ধাঁধায়
ঘুরপাক খেয়ে মরছি?
সত্যি বলতে কি, এই কৃষ্ণপক্ষে
হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি প্রকৃত পদপ্রদর্শকের
অভাব। সে কবে থেকে সোনার পিঁড়ি শূন্য
পড়ে আছে, বসবার কেউ নেই। বিখ্যাত
পথ প্রদর্শকদের মধ্যে কেউ পর্যটন বিভাগের
সৌজন্য টিকিট নিয়ে গেছেন দীর্ঘমেয়াদী বিদেশ ভ্রমণে,
কেউ বাতে পঙ্গু হয়ে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি,
কেউ বা পোকার খেলছেন অষ্টপ্রহর এবং
মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছেন
আকাশটা ঘোলাজলের ডোবা নাকি স্ফটিকের সমুদ্র।
ঢের হয়েছে, আর নয়। সাফ কথা,
কারো বাহারি গুলপট্রিতে আর মজবোনা,
দৃষ্টি নিবদ্ধ করবো না কোনো ভুল সংকেতে,
পদপ্রদর্শক থাক আর নাই থাক
এবার পৌঁছুতে হবেই ভবিষ্যতের মতো বড় রাস্তায়।
ভালো থাকা না থাকা
বাইরে তাকিয়ে দেখি
রৌদ্রবিহীন সকাল,
আকাশ এঁটো পানিময় বাসন।
হঠাৎ বেজে উঠলো টেলিফোন, তোমার
কণ্ঠস্বর নিমেষে
আমার মনের ভেতর ছড়িয়ে দিলো
একরাশ রোদ। রিসিভার ক্রেডলে
রাখার আগে
তুমি বললে, ‘ভালো থেকো।
দিনকাল যা পড়েছে
ভালো থাকা দায়। তবু
‘ভালো থেকো’ এই শব্দযুগল আমার
চোখের সামনে মেলে দিলো
কিছু সুশ্রী ছবি। পালটে গেল একালবেলার
মুখ, আর সেই মুহূর্তে
জানালার বাইরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে ভাবলাম,
নিজের জন্যে না হলেও
কারোর জন্যে আমার ভালো থাকা দরকার।
কিন্তু ব্যাপার হলো এই,
ভালো থাকতে গিয়ে অনেক বাধার দেয়াল গুঁড়িয়ে
আমি এখন বিশাল এক অগ্নিকুণ্ডে
কী প্রবল ঝাঁপিয়ে পড়েছি।
লো লাগে
কৈশোরে পৌঁছে
মাত্র দু’চার দিনের ফারাকে
একে একে বাপ-মা দু’জনকেই হারিয়ে ফেলে
মুতালিব আলি। প্রথমে
এক ব্যাপক অমাবস্যা কাফনের মতো এঁটে গেল
ওর সত্তায়। কিন্তু একদিন শরতের রোদ্দুর
ওর কৈশোরকে হাত ধরে পৌঁছে দিলো
যৌবনে।
মধ্য যৌবনে মুতালিব আলির
ঘরে এল এক-গা চমকিলা যৌবন নিয়ে
এক কনে। ওকে দেখলে অবশ্য
কু’চবরণ কন্যার মেঘবরণ চুলের কথা মনে পড়েনা।
কিন্তু একেবারে ফ্যালনাও নয়
সে মেয়ের রূপ। এক ধরনের মাধুর্য ওর
সারা মুখ জুড়ে
খেলা করে বিকেলবেলার আলোর মতো।
একদিন মুতালিব আলির খালি ঘরে
তার ঘরণীর কোলে মাণিকের
আভা ছড়িয়ে খোকা এল। দিন যায়, খোকা
মায়ের কোল ছেড়ে উঠোন পেরিয়ে
রাস্তায় যায়। মিছিলে আওয়াজ তোলে, সে আওয়াজে
দোলে সারি সারি কুর্শি,
চলে জোর কদম। গুলি খায়,
লুটিয়ে পড়ে ভবিষ্যতের দিকে মুখ রেখে।
বুকের একমাত্র মাণিককে হারিয়ে
মা বিলাপ করে। মুতালিব আলি কাঁচা-পাকা
চুলভর্তি মাথা নিয়ে
বসে থাকেন রঁদ্যার মূর্তির মতো। কাল, বিখ্যাত শুশ্রুষাকারী,
তাকে মাঝে মধ্যে রক্তকরবীর গুচ্ছ এবং
কোত্থেকে উড়ে-আসা
পাখির পুচ্ছ থেকে চোখ সরাতে দেয় না।
মুতালিব আলি অফিসে যান,
সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়
গুনগুনিয়ে সুর ভাঁজেন পুরানো গানের।
এক হেমন্তসন্ধ্যায় মুতালিব আলির
গৃহিনী, জয়তুন খাতুন,
বুকের বাঁদিকটা চেপে ধরে টলে পড়লেন, সারা দুনিয়া
দুলে উঠলো খোকার শৈশবের দোলনার মতো! তারপর
আর তিনি উঠে দাঁড়াননি
গা ঝাড়া দিয়ে।
মুতালিব আলি এখন একা, ভীষণ একা,
একেবারে একা। এখন
তার জীবন যেন খুব সান্নাটা এক গোরস্তান।
দিন যায়, চুলে আরো বেশি পাক ধরে, মুখের ভাঁজগুলি
হয় গাঢ়তর। দিন যায়, পূর্ণিমারাতে
বলক-দেওয়া দুধের ফেনার মতো জ্যোৎস্না
ছড়িয়ে পড়ে উঠোনে, জানলা গলে
লুটিয়ে পড়ে খাঁখাঁ বিছানায়। দক্ষিণ দিক থেকে
এক ঝাঁক স্বপ্নের মতো হাওয়া আসে, ভালো লাগে,
মুতালিব আলির ভালো লাগে।
ভালোবাসা
ভালোবাসি’, এই কথাটি বলতে গিয়ে
কণ্ঠে লাগে সংকোচের ফাঁসি?
এমনতো নয়, ভালোবাসা এবার প্রথম
হৃদয় জুড়ে হলো পুষ্পরাশি।
ইতোমধ্যে তোমার আগে বহুজনই
আমার কাছে শুনেছে এই বাঁশি।
একে আমার অপরাধের কালো ভেবে
করুক লোকে নিত্য হাসাহাসি,
তুমি ঘৃণায় ও-মুখ তোমার সরাও যদি,
বলবো তবু বলবো ‘ভালোবাসি।