দূরে থাকে ঘর
লোকটা একলা হাঁটে ফুটপাতে, পার্কে
বসে কিছুক্ষণ গাছ গাছালির মাঝে, শোনে ‘এ জগতে কার কে’
ব’লে একজন বৃদ্ধ, হয়তো ছিটগ্রস্ত, গেলেন বেরিয়ে,
যেন কোন ব্যর্থ, নিঃস্ব অভিনেতা। লোকটা এড়িয়ে
কৌতূহলী দৃষ্টি বেঞ্চি ছেড়ে উঠে যায়,
এবং তাকায় আশপাশে, আত্মসুখে বুঁদ, দ্যাখে বসন্ত জাগ্রত
তরুণীর যৌবনের মতো।
লোকটা কখনো ঘাসে কখনো আকাশে
চোখ রাখে, কখনোবা নীল মসজিদের গম্বজের
অনেক ওপরে উড়ে যায়, মেঘে ভাসে;
ইচ্ছে হলে ফের
পাতালে প্রবেশ ক’রে, জলপুরী দেখে
কাটার প্রহর;
জলকিন্নরীর কথা বলে, গাঢ় চুমো এঁকে
ওদের অধর
কেমন রাঙিয়ে দেয়, কখনো বা বিরান উদ্যানে
জাগায় ফুলের গুচ্ছ শুকনো গাছে ফের গানে গানে।
বড় বেশি জনহীন পথে লোকটা একাকী হাঁটে
শিস্ দিতে দিতে, ভাবে পা রাখবে সোনালি চৌকাঠে
ঝেড়ে ফেলে ধুলোবালি শান্ত বেলাশেষে।
অকস্মাৎ কী-যে হয়, দূরে থাকে ঘর,
নিমেষে সে মেশে
অক্ষরের ভিড়ে, হয়ে যায় অলৌকিক কণ্ঠস্বর।
পাইথন
আসলে ব্যাপার হলো, এখন আমরা
একটা খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছি। ঘুরঘুট্রি
অন্ধকারে কেউ কারো মুখ
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না; অন্ধের মতো
এ ওকোঁ হাতড়ে বেড়াচ্ছি, খুঁজছি
ভালো ক’রে দাঁড়াবার মতো একটা জায়গা।
একটু পরেই হয়তো আলোর আবীর
ছড়িয়ে পড়বে, কিন্তু যতক্ষণ না পড়ে ততক্ষণ
আমাদের সর্তক থাকার পালা,
যাতে পা হড়কে অতল খাদে না পড়ে যাই।
আমার পিছনে ফেলে এসেছি
অনেক খানাখন্দ, চোরাবালি; বহু বালিয়াড়ি
পাড়ি দিয়েছি-আমাদের চামড়া
ঝলসে গেছে রোদের অত্যাচারী চুমোয়,
আমাদের পাগুলো এখন সীসার মতো ভারী;
দীর্ঘ অনাহারে শীর্ণ, কায়ক্লেশে
নিজেদের টেনে হিঁচড়ে কোনোমতে
নিয়ে এসেছি এই খাদের কিনারে।
এক পা একা পা ক’রে আরেকটু এগোলে
কী নজরে পড়বে, জানিনা।
হয়তো খুব কাছেই একটা পাইথন
ভীষণ কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে,
যে-কোনো মুহূর্তে নড়ে উঠতে পারে
আমাদের গিলে খাওয়ার জন্যে,
ভাবতেই ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ,
বুকের রক্ত হিম।
এই পাইথনের কথা অজানা নয় কারো;
কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে
চারদিকে রটানো হয়েছে ওর কীর্তিগাঁথা।
ইতোমধ্যে ঢের ছাগল,
ভেড়া,
হরিণ,
শুয়োর
এবং মানুষ
শিকার হয়েছে ওর। আমাদের আগে যারা এসেছিল
এই পথে, তারা কেউ গন্তব্যে পৌঁছতে পারেনি,
একে একে সবাই ফৌত হয়ে গেছে
পাইথনের স্বেচ্ছাচারে।
এই গিরিখাদ পেরুতে পারলেই
একটি নদীর রূপালি কল্লোল শুনতে পাবো
দৃষ্টি সবুজ করে দিয়ে
উচ্ছ্বসিত হবে শস্যের মাঠ, শত শত
শিশুর কণ্ঠস্বর পাখির গানের ঝংকৃত ছায়া
বুনে দেবে স্মৃতিতে।
ভয়ের গলায় পা রেখে,
পাইথনের বিখ্যাত ক্ষুধায় ধুলো দিয়ে
যত কষ্টই হোক, সামনের দিকে নজর রেখে
এখন একটু পা চালানো দরকার।
পাইথনের আড়মোড়া ভাঙার ধরনের আমাদের
পায়ের তলায় মাটি নড়ে উঠছে
ঘন ঘন। তবে কি এখন
শুরু হবে ভয়ংকর সেই ভূমিকম্প, যার ধমকে
টাল সামলাতে না পেরে
পাইথনটা নিজেই পড়ে যাবে অতল গিরিখাদে?
পুরোনো দিনের টানে
পুরোনো দিনের টানে মাঝে-মধ্যে এখনো সকালে
অথবা বিকেলে কিংবা ভর সন্ধ্যেবেলা
তসলিম রশিদের কাছে যাই। আমার নিজের
বাসা থেকে ওর
বাসগৃহ বেশ দূরে আরশি নগর
বলা যায়, যদিও পড়শি নেই কোন তার প্রকৃতি প্রস্তাবে।
কখনো কখনো তার সঙ্গে হয় না আমার দেখা
মাসাধিক কাল।
কখনো বা দেখা পেয়ে যাই।
তসলিম রশিদের বয়স হয়েছে ইদানীং।
মানে তার চুলে চকখড়ি গাঢ় দিয়েছে বুলিয়ে
উদাসীন শিল্পী এক। এখন সে লেখে না কবিতা
রাত জেগে থাকে না তাকিয়ে
নাগাড়ে কয়েক ঘণ্টা আকাশের দিকে। আজকাল
সহজে আসে না ঘুম, নিয়মিত খায় সেডাকসান।
গায় না সে মিছিলের গান গলা ছেড়ে, পাখিটাখি
দেখে না ঝিলের ধারে, থাকে
নিজের ভেতর নিজেকেই লুকিয়ে চুরিয়ে রেখে।
তিন তাসে মজেছে সে, শোনা যায়, এবং আকণ্ঠ দিশি
মদ গিলে বেহুঁশ বাসায় ফেরে মধ্যরাতে,
নিজেরই ছায়ার মতো। কোনো কোনো রাতে
বাহিরকে করে ঘর বিলাবাজ ইয়ারের সঙ্গে। খিস্তি করে,
বমিতে ভাসায় ঘর মাঝে-সাঝে। যদি কেউ তাকে
কবিতার কথা বলে খেলাচ্ছলে, তবে
বেধড়ক ক্ষেপে ওঠে র্যাঁলবোর ধরনে।
কী এক জটিল জালে স্বেচ্ছাবন্দি, দলে দলে মাকড়সা তার
চোয়ালে, কপালে, গালে, গলায়, বুকের কাছে ঘোরে
দিনরাত, অথচ পায় না টের, যেন
হারিয়ে ফেলেছে বোধ, রোজ
হাঁটাচলা করে নিজের অনুকরণে,
লতাগুল্ম, পাখি থেকে দূরে,
ক্রমান্বয়ে কংক্রিটের অবয়বে নিঝুম আশ্রয় পেতে চায়।
কতদিন ভাবি তসলিম রশিদের কাছে যাবো না কখনো
আর দূরে সেই
আরশি নগরে,
নিজের অজান্তে তবু বার বার সেখানেই যাই, চলে যাই।
বন্ধ দরজার দিকে যায়
ভাবিনি কখনো আগে এরকম হবে।
এরকম ব’লে আমি ঠিক
কী বোঝাতে চাই, খুব সাবলীলভাবে
বলা মুশকিল।
দেখতো আমার মধ্যে আজ
আশ্চর্য কিছু কি পাও? মানে
এরকম কিছু যা দেখলে অকস্মাৎ
চমকে উঠতে হয়?
না, আমি আমার এই চেনা মুখমণ্ডলের কথা
বলছি না। আমার দু’চোখ
অক্ষিকোটরের ভেতরেই আছে, নাক
নাকের জায়গায় ঠিক। ঠোঁটেরও হয়নি স্থানান্তর।
বলা যায় খেয়ে দেয়ে নিত্য দাড়ি কামিয়ে এবং
স্বপ্ন দেখে দু’দিন আগেও যা ছিলাম, তা-ই আছি।
তবে কি স্বতন্ত্র কোনো প্রগাঢ় আবীর
দিয়েছে রাঙিয়ে আজ আমার গহন মর্মমূল?
নইলে কেন আমি
আমার ভিতরে বাদশাহী আমলের ঝাড় লণ্ঠনের শোভা
এবং ঝুলন্ত উদ্যানের অন্য বৈভব দেখে
নিজেই আটকে থাকি বিস্ময়ের ধু ধু রশ্মিজালে।
সরোদ বাজাতে আমি জানিনা, তবুও
সরোদের মতো বেজে ওঠে অস্তিত্ব আমার আর দেখি
আমার ভেতর থেকে বিশ বছরের যুবক বেরিয়ে এসে
জ্যোৎস্নার ঝালর ছিঁড়ে বন্ধ দরজার দিকে যায়।