টাইরেসিয়াসের মতো
দোরগোড়ায় রোজ বসে থাকতো
যে-লোকটা, আলো সম্পর্কে কোনো
ধারণাই ছিল না তার।
কারণ, সে ছিল জন্মান্ধ। ফলত
আরো অনেক কিছুর মতোই আলো নিয়ে
সে কোনোদিন ওর কাঁচাপাকা চুল-ভর্তি
মাথাটা ঘামায়নি।
দোরগোড়ায় হামেশা বসতো লোকটা,
কিন্তু কুঁড়েমি
ওর ধাতস্থ হয়নি কস্মিনকালেও।
ভোরবেলার আলো তার সত্তায় খেলা করতো,
ওর জানা ছিল না। ভিক্ষা-টিক্ষা
করার কথা আদৌ সে ভাবেনি, তাই
ওর দশটি আঙুলের শ্রমশোভন নাচে
বাঁশের কঞ্চিগুলো হয়ে উঠতো শিল্পসামগ্রী।
এবং এতেই
গরম থাকতো ওর উনুন।
একদিন সমুদ্র গর্জনের মতো
কী একটা ওর কানের ঘুলঘুলিতে
আছড়ে পড়ে। চারদিক থেকে রব ওঠে-
মিছিল, মিছিল।
হঠাৎ বাঁশের চুব্ড়ি থেকে হাত সরিয়ে
গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে লোকটা। কী যেন
ভাবে কিছুক্ষণ, তারপর লাঠি হাতে
এগোতে থাকে
সামনের দিকে জন্মন্ধ দৃষ্টি মেলে দিয়ে।
তেজী মিছিল ওকে টেনে নিলো,
যেমন সমুদ্র মিলনোম্মুখ নদীকে।
লোকটা আর ফিরে আসেনি
দোরগোড়ায়।
হয়তো সে টাইরেসিয়াসের মতো
একটা জ্যোতির্বলয় দেখতে পেয়েছিল সেই মিছিলে।
তুমি মিথ্যা বলেছিলে
আমার এই পুরোনো ঘরের ভেতরে আলো
চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে বাইরে।
পাখিটাখির ডাকও শোনা যাচ্ছে
আমি রোজকার মতো আজো
চোখ কচলাতে কচলাতে
জেগে উঠলাম।
তাকালাম চাদ্দিকে,
একটা প্রত্যাশা নিয়ে,
না আমি আমার সেই
আকাঙ্ক্ষিত সূর্যোদয় ধারে কাছে
কোথাও দেখতে পেলাম না।
আজ একথা আমার কাছে আমার
হাতের রেখার মতোই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে,
তুমি মিথ্যা বলেছিলে, জাভেদ
তুমি বলেছিলে-আমার মনে পড়ছে
এইতো আমি তোমার সেই
কণ্ঠস্বর শুনতে পাই;
ঝড়ে পড়া জাহাজের কাপ্তান যেমন তার
নাবিকদের উদ্দেশে বলেন-
তুমিও তেমনি বলেছিলে-
এই আবলুশ কাঠের মতো অন্ধকারই শেষ কথা নয়।
আমাদের সামনে এক নতুন সূর্যোদয়
যা ভবিষ্যৎ রাঙা পোস্টারের মতো টানিয়ে দেবে,
আমরা সবাই জোরে শোরে হাততালি দিয়েছিলাম সেদিন
তোমার সেই উচ্চারণে।
আমার শিথিল পেশীগুলি সেদিন
টান টান হয়ে গিয়েছিল-
আমার চোখে উড়ে এসে বসেছিল
স্বপ্নের অজস্র পাখি-
পোস্টম্যানের মতো হনহনিয়ে চলেছে
সময়।
পাড়ার ইয়াসিন দর্জি বয়সের ভারে বেঁকে
ঈদের চাঁদের মতো হয়ে গেছে,
নেয়ামত ওস্তাগার পুব দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
অন্ধ হয়ে গেল জাভেদ
রিকশাঅলা তার নুন আনতে পান্তা ফুরানো
সংসারটাকে বিরান ক’রে,
হাড়গুলোকে জুড়োতে চলে গেল কব্বরে
এই দ্যাখো জাভেদ আমার কালো চুল
দেখতে দেখতে কেমন শাদা হয়ে গেল,
জাভেদ আজ আমি জেনে গেছি
তুমি একটা মিথ্যাকে সত্যের সাজ পরিয়ে
ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে নাচুনে
বানরের মতো ছেড়ে দিয়েছিলে আমাদের সামনে।
জাবেদ ভেবনা আমি তোমার নিন্দামন্দ
করার জন্যে কোমর বেঁধে লেগেছি; আমি জানি
অনেক মোটা মোটা বইয়ের সূক্ষ্ণ আলো
তোমার মনের ঘুলঘুলিতে খেলা করে অষ্টপ্রহর
বহুবার জেলখাটা তোমার শরীরে
মনীষার ভাস্বর ছায়া পড়ে
একথা আমার অজানা নয়;
তোমার কাছে ঋণের আমার অন্ত নেই জাভেদ
তুমিই প্রথম আমাকে একটা আশ্চর্য
সূর্যোদয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিলে।
আমার চির আকাঙ্ক্ষিত সেই সূর্যোদয়
এখনো নাই বা এল সেই স্বপ্নটা আছে তো
আর স্বপ্ন আছে বলেই তো।
দুপুর, একটি পাণ্ডুলিপি
সেদিন দুপুরে, নিরালায়, যা প্রান্তর, লীলায়িত সুনসান,
সহজে তোমাকে ছুঁতে পারতাম যে কোনো ছুঁতোয়।
তোমার আঙুলগুলো টেবিলের কাছে ফুটেছিল,
আমি সৌন্দর্যের ডাগরতা পারতাম ছুঁতে। তুমি
যে স্পন্দিত পাণ্ডুলিপি থেকে
জ্যোৎস্নাচর অক্ষরের পাখি, ঝাঁক-ঝাঁক,
কোমল দিচ্ছিলে ছেড়ে ক্রমাগত, আমি
তা পরখ করার ছলে
প্রথম তোমার করস্পর্শে শিহরিত
হতে পারতাম, হয়তো উঠতো ফুটে চকিতে আমার
নিজস্ব উদ্ভিন্ন অন্ধকারে
প্রথম কদম ফুল কিংবা বংশীধ্বনি হয়ে তোমার সত্তার
গহনে মিলিয়ে যেতে পারতাম, চোখে
চোখ রেখে করা যেতো হৃদয়ের আদি উচ্চারণ।
করিনি কিছুই। শুধু দেখেছি তোমাকে সে দুপুরে
হৃদয়ের মধ্যদিনে যতোটুকু দেখা যায়।
তুমিই যৌবন দেখি, দেখি
যৌবনে নদীর বাঁক আছে, আছে তরঙ্গ সকল
কূল-উপচানো, আর উড়ন্ত পাখির প্রিয় ডাক,
গহন আশ্বিন, অনাদৃত ফুলের বিস্ময়,
উদাসীন পথিকের দেশ-রাগাশ্রয়ী
গীত।
ভরদুপুরকে নিমেষেই সন্ধ্যা ক’রে
তুমি চলে গেলে।
মাংসের দেয়ালে বাজে শত শত অশ্ব-ক্ষুরধ্বনি,
মাংসের ভেতরে ফোটে অনিদ্রার রক্তিম কুসুম,
মাংসের ভেতরে তিনজন অন্ধ গায়কের দীপকের তান,
মাংসের ভেতরে তীব্র স্পন্দিত বৈষ্ণব পদাবলি,
মাংসের ভেতরে কী মোহন বিস্ফোরণ,
মাংসের ভেতরে অবলুপ্ত খৃষ্ট-পূর্ব সভ্যতার জাগরণ!
তুমিতো জানো না
যখন বিদায় নাও তুমি স্মিত হেসে,
ঔদাস্যে কখনো,
আমার ঘরের
যাবতীয় আসবাবপত্র
উড়ে চলে যায় দূরে। কেবল তোমার হস্তধৃত পাণ্ডুলিপি
গুণীর তানের মতো মধুর কাঁপতে থাকে ঘরে, বারে বারে
মনে হয়, সেই পাণ্ডুলিপি বিলি করবার লোভে
কে এক নাছোড়
স্মৃতিময় পোস্টম্যান বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে সকল সময়
বন্দ ঘরে ভীষণ একাকি
গুজব রটনাকারী মানুষের মতো কিছু গল্প নিয়ে আমি
বসে থাকি শূন্যতায়, যেন বা অজ্ঞাতবাসে আছি।