এক রাতে হযরত ওসমান
কে আমাকে এমন সতর্ক করে আজ বারংবার
ভয়ার্ত রাত্তিরে? ঘোড়াগুলি আস্তাবলে
করছে চিৎকার,
উটেরা উৎকর্ণ বড়। ওরা টের পায়,
ঘোর অমঙ্গল কাছে এলে ওরা টের পেয়ে যায়।
বেদনার্ত চোখ মেলে দেখি
আকাশে বিদ্যুচ্চমক ঘন ঘন,
অথচ বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই।
আমি কি ছিলাম অন্ধ অথবা বধির?
আমার বিরুদ্ধে কত হাত
মরুভূর জহরিলা সাপের মতন
তুলেছে ব্যাপক ফণা ক্রমাগত, দেখতে পাইনি। কেউ কেউ
বলেছে আমার চতুর্দিকে ভয়ংকর ফাঁদ পাতা,
অথচ দিইনি কান রটনায় কোনোদিন। ওরা
আমার রক্তের লোভে ঘোরে
রাত্রিদিন শ্বাপদের মতো অন্তরালে,
কখনো প্রকাশ্যে জনসভা ক’রে শাসায় আমাকে-
যেন আমি অপরাধী আপাদমস্তক, যেন আমি
প্রিয় স্বদেশের জন্যে ফেলিনি মাথার ঘাম পায়ে,
আরববাসীর ধুধু পানিকষ্ট দ্রুত
লাঘবের জন্যে যেন
করিনি খনন কূপ শহরে শহরে,
গ্রাম-গ্রামান্তরে।
একবার ভেবে দেখ হে নগরবাসী
কে আমি, কী কাজ আমি করেছি নিঃশব্দে এতকাল।
বাজাইনি ঢাক ঢোল, আত্মপ্রচারের
মোহে নগরকে
কখনো দিইনি মুড়ে রঙিন কাগজে।
নিজেই নিজের কথা বলা
সমীচীন নয় কোনোকালে, তবু কিছু কথা বলি,
কেননা অত্যন্ত ক্ষীণ জানি জনস্মৃতি।
জনগণ যাতে সুখী হয়,
সেজন্যে এ-আমি
করেছি নির্মাণ পথ, বাঁধ, সুস্নিগ্ধ সরাই;
করেছি সত্যের জন্যে রোকেয়ার সঙ্গে
ন’বছর নির্বাসিত জীবনযাপন;
শত বিপর্যয়ে
রেখেছি নিজেকে খাড়া মসজিদের মিনারের মতো।
মানব কল্যাণ আর প্রগতি সর্বদা
ছিল ধ্রুবতারা
আমার জীবনে, কিন্তু যারা নিত্য বিপক্ষে আমার
করে কানাঘুষা,
দেয় অপবাদ
স্বজনপ্রীতি আর আমার সকল কাজে ধরে
খুঁত সর্বক্ষণ তারা
কলঙ্ক লেপন করে আমার নামের অবয়বে,
যেমন অবুঝ শিশু দোয়াত উপুড় করে সফেদ কাগজে
খেলাচ্ছলে। আমার বিরুদ্ধে ওরা নানান ফিকিরে
নিয়ত খেপিয়ে তোলে অগণিত মানুষকে শুধু।
আমার সকল কীর্তি যেন উটের পায়ের ছাপ
মরুর বালিতে-বাতাসের ঝটকায় মুছে যায়
নিমেষেই; হত্যাকারীগণ
হচ্ছে তৈরি অন্ধকারে, শানাচ্ছে বিষাক্ত হাতিয়ার
এবং অপ্রতিরোধ্য ওরা আসবেই দলে দলে
জোট বেঁধে বর্বর নেশায় মেতে। কিন্তু তারা মূঢ় অর্বাচীন;
জানে না যে-রক্ত ধারা বইবে আজ আমার শরীর থেকে তার
গতি থামবে না কোনোকোলে।
এই রক্তস্রোত
অবিরল বয়ে যাবে দশকে দশকে আর শতকে শতকে।
একটি ফ্রিজ শটের জন্যে
এ কেমন চলে যাওয়া উড়িয়ে রুমাল কাকডাকা
দুপুরে একাকী দূরে, বিন্দু হয়ে যাওয়া? দুটি পাখি
ছিল ডালে; শাখাচারী পক্ষীদ্বয় দু’ ফোঁটা চোখের
পানি যেন। ভুরুর মতন ঝিল, শিকের আড়ালে
কতিপয় প্রাণী আর রঙিন চাঞ্চল্য আপাতত
ভাস্কর্য আমার মনে। দুপুরেই চৌরাহায় আজ
হঠাৎ গোধূলি আসে ব্যেপে। একটু আগেই ছিলে
আমার হাতকে সভ্যতার চারু কারুকাজ ক’রে।
এখনো কাটেনি ঘোর সান্নিধ্যের; মদ্যপের মতো
সম্মুখে তাকিয়ে আছি; আশপাশে ধুম বিলাবাট্টা
হয় হোক, নেই চোখ কান সেদিকে আমার। প্রাণ
গুণীর পুষ্পিত তান তোমার সৌরভে। এই পাখি,
পাতার টোপর-পরা গাছ, আমাদের প্রসারিত
ব্যগ্র হাত কেন ফ্রিজ শট হয়ে যায়না নিমেষে?
কবির নির্বাসন
আমার চোখ কি আমার কাছ থেকে
নির্বাসিত হয়েছে
নইলে কেন আমি কোন কিছু
দেখতে পাচ্ছি না?
আমার কণ্ঠ কি আমার কাছে থেকে
নির্বাসিত হয়েছে?
নইলে কেন আমার কণ্ঠ থেকে সত্য কি মিথ্যা কিছুই
উচ্চারিত হচ্ছে না?
আমার পা দুটো কি আমার কাছ থেকে
নির্বাসিত হয়েছে?
নইলে কেন ওরা সামনের দিকে
এগোতে পারছে না?
আমার হাত দুটো কি আমার কাছ থেকে
নির্বাসিত হয়েছে?
নইলে কেন ওরা এত লঙ্কাকাণ্ডের পরেও
মুষ্টিবদ্ধ হচ্ছে না?
আমার কলম কি আমার কাছ থেকে
নির্বাসিত হয়েছে?
নইলে কেন আমি খাতার পাতায় উচ্চারণের স্তবক
ফোটাতে পারছি না?
কালঘুম
কথা ছিল না। আমরা যারা বুকের ভেতর ফুল, ধুলো আর আলকাতরার
গন্ধমাখা হাওয়া টেনে নিই, সিগারেট ধরাই, সিনেমায় ভিড় বাড়াই, আপিশ
করি আড্ডা দিই, বিছানায় যাই স্ত্রীর সঙ্গে, তাদের অনেকের বেঁচে থাকার কথা
ছিল না।
ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরলাম রাতে। রাস্তায় কুসংস্কারের মতো অন্ধকার।
বাড়িটার সামনে এসে চমকে উঠি। খুব অচেনা মনে হয়। এর দেয়াল, দরজা,
ছাদের কার্নিশ কিছুই যেন আগে দেখিনি। অথচ এই বাড়িতেই আমার
নিত্যদিনের আসা-যাওয়া; রৌদ্র আর জ্যোৎস্নাপায়ী এ-বাড়ি আমার মুখস্থ।
আর মুগ্ধাবেশে চেয়ে থাকি কখনো কড়িকাঠের দিকে, কখনো বা পুরানো
জানালার নির্জনতায়।
সারাদিন এক অস্বস্তি ছিল রোদে, হাওয়ায়। যেন রোদ আর হাওয়া থেকে
অনেক দূরে চলে যেতে হবে। চলে যেতে হবে জাহাজড়ুবির অসহায় যাত্রীর
মতো। এই অস্বস্তি প্লেগের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল সারা শহরে। একটা চাপা
উত্তেজনা পথচারীদের দখল করে রেখেছে। ওরা অপেক্ষমাণ কিছু একটার
জন্যে, যেমন নিদ্রামগ্ন চোখ স্বপ্নাচ্ছন্নতায় মেতে থাকে প্রত্যুষের প্রতীক্ষায়।
ব্যাকা-ট্যারা গলির মোড়ে, পথের ধারে অফিসের কামরায়, করিডোরে
ফিস্ফিসিয়ে কথা বলছে কয়েকজন। সেই মুহূর্তে কোনো ভাবোল্লাস তাদের
মধ্যে তরঙ্গিত হচ্ছিলো কিনা জানি না।
সারাদিনের পর স্টেডিয়ামের বইয়ের দোকানে সন্ধ্যা কাটিয়ে ক্লান্ত পায়ে বাড়ি
ফিরি। সচরাচর এত তাড়াতাড়ি বাড়িমুখো হই না। উৎকণ্ঠা নিয়ে রাতে খাবার
খেলাম, এলোমেলো কিছু ভাবলাম, তারপর যথারীতি গেলাম বিছানায়।
বালিশে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মরহুম পিতার কথা মনে পড়লো।
তাঁর উপস্থিতি টের পাই ঘরে। তাঁর পরনে সেই শাদা পাঞ্জাবি আর পা-জামা,
মাথায় কালো মখমলী টুপি, হাতে লাঠি। লাঠির মুণ্ডে লতাপাতার নক্শা।
হঠাৎ আমার ঘরে কেন তাঁর এই উপস্থিতি? তিনি কি আমাকে সতর্ক করে
দিতে এসেছেন, যাতে কোনো খানা-খন্দে আমি মুখ থুবড়ে না পাড়ি? কিন্তু
তিনি কোনো সতর্কবাণী উচ্চারণ করেননি। শুধু আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন
পারলৌকিক উদাসীনতায়। ওল্ড টেস্টামেন্টের কোনে বর্ষীয়ান পয়গম্বরের
মতো মনে হচ্ছিল তাঁকে, বিশেষত তাঁর টিকালো নাক আর সফেদ দাড়ির
জন্য। এই দৃশ্যে এক ধরনের মহিমা ছিল। আমার পিতার কাছে অনেক কিছু
শিখেছি আমি। কিন্তু সেই মুহূর্তে কেবল মনে পড়ছিল, তাঁর শেখানো একটা
প্রবাদ-‘খোঁড়ার পা খালেই পড়ে। কেন মনে পড়ছিল, বলতে পারবো না।
আমার পিতার গানের গলা ছিল না। বরং তিনি ছিলেন প্রকৃতই সুরছুট। তাঁর
কণ্ঠে গাম্ভীর্য ছিল, ছিল না মাধুর্য। গান তিনি গাইতেন না। তবে কখনো
কখনো বিছানায় শুয়ে-শুয়ে গুন গুন করতেন। শুধু একটি গানের বেসুরো
গুঞ্জরণ শুনেছি তাঁর কণ্ঠে বারংবার ‘দিন ফুরালো, সমঝে চলো’-এই ক’টি শব্দ
ছাড়া সে গানের কোনো কথা আমার মনে পড়ে না।
আমার লেখার টেবিলের কাছে রাখা শূন্য চেয়ারটিতে তিনি বসে আছেন।
নিঃসাড়, নিশ্চুপ। আমি উঠে বসতে চাই। তাঁকে তাজিম দেখানোর উদ্দেশ্যে।
কিন্তু পারি না। আমাকে কেউ যেন গেঁথে দিয়েছে বিছানায়। আমি ছটফট
করছি শয্যাত্যাগের জন্যে, পিতার সঙ্গে কথা বলার জন্যে। শয্যাবন্দি আমি
বাক্ শক্তিরহিত। জনক তাঁর পুত্রের দিকে তাকিয়ে আছেন ভাবলেশহীন।
ঘরের ভেতর কয়েকটি শজারু আর উড়ুক্কু মাছ। তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ওদের প্রতি,
যেন তিনি ওদের নিয়ে এসেছেন সঙ্গে লাঠির সংকেতে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, টের পাইনি। শরীর ক্লান্ত, মন অবসন্ন। গাছের
গুঁড়ির মতো ঘুমোতে থাকি। ঘর কেঁপে ওঠে বারবার, ঘুমের ভেতরে টের
পাই। তখন ক’টা বাজে জানতে পারিনি। ঘড়ি দেখার মতো উৎসাহ ছিল না
এত ক্লান্ত ছিলাম সে-রাতে। গাঢ় ঘুমে চোখ বুঝে আসছিল। ভয়ংকর শব্দসমূহ
সেই ঘুমে সামান্য চিড় ধড়িয়ে ছিল মাত্র তার বেশি কিছু নয়।
মাতাল যেমন সাময়িক মতিচ্ছন্নতায় বোধের বাইরে পড়ে থাকে, তেমনি আমি
ছিলাম সে-রাতে। আমার সীমাহীন অবসাদ, নিষ্ক্রিয়তা আর পাথুরে ঘুম
আমার শয্যাসঙ্গিনীর মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল। মাঝে মাঝে ভয়ানক শব্দ শুনে
চমকে-ওঠা ছাড়া অন্য কোনো ভূমিকা ছিল না আমাদের। ঘুমন্ত আমরা টের
পাইনি কি ভয়াবহ এক সকাল অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
একটি সকাল কী ভীষণ বদলে দিলো সন্ত্রস্ত আমাকে আর ভিন-দেশী
জেনারেলদের বুটজুতোয় থেঁৎলে-যাওয়া, বুলেটের ঝড়ে ক্ষত-বিক্ষত আমার
আপন শহরকে।