- বইয়ের নামঃ অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অন্য কিছু
আমার তিনটি শার্ট চাই আপাতত, এক জোড়া
ট্রাউজার, দুটি গেঞ্জি আর তিন জোড়া জুতো।
আন্ডারওয়ার অবশ্যই, রবিন পাখির মতো কয়েকটি
রুমালও জরুরি। চাই কিছু গ্রন্থাবলি; চাই, চাই-
বীমার কিস্তির টাকা, চাই মাগ্যিভাতা, রেস্ত রোজ।
শুধু কি এসবই চাই? অন্য কিছু নয়?
খবর কাগজ ওড়ে হাওয়ায়, যেন ওরা
পরীর পোশাক মিহি ঝলমলে, কিঞ্চিৎ রহস্যময় বটে,
বহুরূপী মেঘের নানান স্তরে ভাসমান দেখি।
সেলুনে মুণ্ডিত হতে দেখি রোজ
কিছু মাথা, রকমারি ছাঁট কী বাহারি চুলে
দেখি মঞ্চে বিদূষক নায়কের কানে
কী যেন কী বলতে গিয়ে হেসে লুটোপুটি,
দুটি শালিখের দিকে একজন বুড়োসুড়ো লোক
ছুঁড়ে দেন বাসি রুটি, গলির ধুলোয়
বালক বানায় দূর্গ, জুয়াড়ী পয়সা গোঁজে ট্যাঁকে।
শুধু কি এসবই দেখি? অন্য কিছু নয়?
কখনো গলির মোড়ে অস্পষ্ট সংলাপ শুনি দু’টি
মানুষের, কখনোবা কর্কশ বচসা, চৌরাস্তায়
পুলিশের বাঁশি বাজে, মধ্যরাতে ক্ষিপ্র কুকুরের
পদশব্দ; ফেরি-অলা ডেকে যায় মধ্যবিত্ত কিশোরীকে আর
মহিলাকে সচকিত ক’রে; প্রায়শই গৃহিনীর
অসুস্থ বিলাপ শুনি, রেডিওতে শস্তা গান বাজে
একটানা, অকস্মাৎ মেঘের গর্জন শুনি চৈত্রের আকাশে।
শুধু কি এসবই শুনি? অন্য কিছু নয়?
অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই
কস্মিনকালেও অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই।
না ছোরা, না ভোজালি, না সড়কি না বল্লম
না তলোয়ার না বন্দুক-
কোনা কিছুরই প্রয়োজন নেই আমার।
আমি মারমুখো কোনো লোক নই।
বালক বয়সেও আমি কোনো ফড়িং-এর
পাখনা ছিঁড়িনি,
প্রজাপতিকে আলপিন দিয়ে
আটকে রাখিনি কাগজে।
কখনো উড়ন্ত কিংবা গাছের ডালে বসে-থাকা
কোনো পাখির প্রতি তাক করিনি
বন্দুকের চকচকে নল।
ছায়াময় আশ্রয়ে সময়-পোহানো
পাখি,
বিকেলের আবীর মেখে দাঁড়ানো তন্বীর মতো
গাছ,
পলায়নপর সূর্যের চুমো-খাওয়া
নদী,
ইতস্তত ছড়িয়ে-থাকা খুচরো সিকি আধুলির মতো
তারা,
প্রত্যেকেই নিজস্ব ভাষায়
গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে শান্তির পাঁচালিতে।
দুই আগুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে
আমি কান পাতি গোলাপ আর চন্দনের ব্রতকথায়।
যতদূর মনে করতে পারি,
কোনোদিন আমার ওষ্ঠ অস্ত্রবন্দনায়
স্ফুরিত হয়নি।
কিন্তু আমার ঘরে কেউ আগুন দিতে এলে,
আমার ভায়ের বুক কেউ বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিলে,
আমার বোনের রওশন চৌকি
কেউ তছনছ করে দিতে এলে,
নিরস্ত্র আমি নিমেষে হয়ে উঠি দুরন্ত লড়াকু।
আমার লড়াইয়ের রীতি
নদীর ফেরীর মতো; ফুল আর সুরের মতো
পবিত্র।
আমার কোমর কালো বেল্টে শোভিত হোক আর নাই হোক,
শেষ অব্দি লড়ে যাবো
অস্ত্রের প্রশ্রয়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন।
না ছোরা, না ভোজালি, সড়কি না বল্লম,
না তলোয়ার না বন্দুক-
কিছুই নেই আমার,
এই আমি নিজেই আমার অস্ত্র।
ঈগল কি কাঁদে
নীলিমা-মনস্ক ঈগল কি কাঁদে পাহাড় চূড়ায়
শ্বাসরোধকারী একাকিত্বে কোনোদিন? এখন তো
খাচ্ছে সে ছোবল বয়সের; বুকের ভিতরে ঝড়,
হুহু ঝড়, অবসাদ নেশার মতন সঞ্চারিত
সমস্ত অস্তিত্বে তার। মাঝে-মাঝে আশেপাশে খোঁজে
সঙ্গিনীকে ভ্রান্তিবশে। শ্রান্তি চোখে তন্দ্রা হয় আর
পাহাড় চূড়ায় বাজে শূন্যতার গূঢ় টিটকিরি,
পালক পাপড়ির মতো উম্মীলিত মেঘছোঁয়া দুরন্ত হাওয়ায়।
স্মৃতিকে ঠুকরে তার দিন যায় কখনো কখনো
তন্ময় তাকিয়ে শূন্যতায়; কখনো বা ভয় পায়
ভবিষ্যের কথা ভেবে দুঃস্বপ্নের জালে বন্দি হয়ে
ভাবে সে পর্বতে নেই আর। শত জয়চিহ্নময় ঊর্ধ্বগামী
পাখা তার দ্যুতিহীন, ভীষণ বিবশ পড়ে আছে বড়ো একা
গলির ধুলায় খাদ্যহীন, পিপাসার্ত, কী অক্ষম।
ভাবে সে গলির মোড়ে খর্বকায় কেউ তার প্রতি
ধারে-কেনা সিগারেট, আধপোড়া, দ্যায় ছুঁড়ে কিংবা
কেউ খেলাচ্ছলে নিচ্ছে তুলে নিজস্ব পালক তার
অত্যন্ত রক্তাক্ত ক’রে তাকে অথবা বালক কেউ
কৌতূহলী জং-ধরা খাঁচায় পুরতে চায় তাকে।
কেউ কেউ তুড়ি মারে কালক্লিষ্ট মুখচ্ছিরি দেখে।
তবু কী যে হয়, আকাশের দিকে মেঘ উড়ে
যেতে দেখলেই তার পাখায় চাঞ্চল্য তরঙ্গিত,
সুদূরের ঘ্রাণে তাজু ক’রে একবিংশ শতাব্দীর
দিকে অহংকারীর মুগ্ধ চোখ রেখে সে আবার তার
পালকের গুচ্ছ থেকে অবসাদ ঝেড়ে ফেলে দূর নীলিমায়
তুমুল তরঙ্গে ভেসে দ্যুতিময় প্রকৃত বিহঙ্গ হতে চায়।
এক দশক পরে
একটি দশক ছিল প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো,
কিছু বা কাটায় কীর্ণ, সেয়ানা কীটের
লোভ ছিল জেগে
সাপের মণির মতো, গণিকার প্রসাধন-চটা
বিশীর্ণ মুখের মতো ছিল রোগ শোক,
বিলাপে পড়েনি ভাটা, যদিও আনন্দ ধ্বনি প্রাণে
বুনেছে সৌন্দর্য, খৃষ্টপূর্ব শতকের
গোধুলি এসেছে নেমে সোনালি কুয়াশা হয়ে আর
হরিণের ছালে
ডোরাকাটা বাঘের মুখের লালা ঝরেছে নিয়ত।
একটি দশক আমি তার কথা জানতে পারিনি।
সে-কথা লুকোনো ছিল রোদপেড়ো পাতার আড়ালে,
লতাগুল্মে, পর্যটক মেঘে
দরবারী কানাড়ার পরতে পরতে,
সূর্যাস্তের অবসন্ন বিশদ মোটিফে,
ঈগল এবং রাগী সাপের বিবাদে।
একটি দশক আমি তার কথা জানতে পারিনি,
অথচ ছিল সে আশপাশে
বিকশিত রাগিনীর মতো। অকস্মাৎ
একটি গভীর রাত চন্দ্রমল্লিকার
সৌরভ বিলায় পোড়-খাওয়া অস্তিত্বের
অলিতে গলিতে,
নৈশ ঘ্রাণে ভরপুর স্বরের চুমোয়
প্লাস্টারের মতো খসে পড়ে দীর্ঘ দশটি বছর।
বয়সে গোলাপ ফোটে, সহসা যযাতি
পুরুরবা হয়ে যায়, ধাবমান পাঁচটি ঘোড়ার
ঘাম আর মুখের কবোষ্ণ ফেনা ঝরে
শিরায় শিরায়,
আমার প্রতিটি রোমকূপ
নিমেষেই ময়ূরের চোখ হয়। এক দশকের
দ্বিধা আর সংশয়ের সূর্যাস্তের পরে
বস্তুত সত্তার মৌন তটে
অপরূপ সখ্যে জেগে ওঠে দুলিয়ে চিত্রিত মাথা
মনসার গৌরবের মতো এক অনার্য সভ্যতা।