নন্দনতত্ত্বের বই
বেলাশেষে পড়ছেন তিনি নন্দনতত্ত্বের বই
গভীর অভিনিবেশে। তিনি আইডিয়ার অথই
সমুদ্রে নাবিক সুপ্রাচীন। জানি দেশজোড়া খ্যাতি
তাঁর পাণ্ডিত্যের, মনীষার; আর বন্ধুবর্গ, জ্ঞাতি
সকলেই জানে তাঁর চক্ষুদ্বয় ঘোরে নিরিবিলি
বইয়ের পাতায়, তত্ত্ব ও তথ্যের খুব ঝিলিমিলি
দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে। কদাচিৎ তিনি চোখ তুলে
বই থেকে তাকান আকাশে আর দিব্যি ভুলে
থাকেন প্রায়শ নাওয়া খাওয়া। নিজেকে আড়ালে রেখে
ধুন্দুমার হট্ররোল থেকে প্রায় সব কিছু থেকে
নিভৃতে করেন ধ্যান-সুন্দরের। মানে তাঁর ডানে
বামে তাকাবার নেই মহলত। কোনো সুর কানে
ভেসে এলে দূর থেকে হন সচকিত, তারপর
আবার পড়েন ঝুঁকে অগণিত ছাপার অক্ষরে।
বইয়ের পাতায় তিনি সৌন্দর্য খোঁজেন রাত্রিদিন,
দ্যাখেন যাচাই ক’রে কী বলেন রসিক রাসকিন
অথবা কেনেথ ক্লার্ক। অথচ খেয়াল নেই কবে
আড়ালে আত্মঙ্গ তাঁর হলো তম্বী রূপের বৈভবে!
পরা বাক্ পেতে চায়
নাছোড় ভাদুরে বৃষ্টি ভোরবেলা আমাকে দেবে না
বারান্দায় যেতে আজ। এবং তুমিও, হে অচেনা,
আসো না ছাদে, আঁচ করি,
সঙ্গে নিয়ে সহচরী!
বেশ কিছুদিন থেকে তোমার অমন রমনীয় উপস্থিতি
বস্তুত পাচ্ছি না টের। প্রীতি
নিও অবচেতনায়, শুভেচ্ছাও বটে, দূর থেকে,
যখন উঠবে ডেকে
পাখি সেই গাছে, যা দাঁড়িয়ে আছে মাঝখানে, যার
পাতার আড়ালে তুমি আর
তোমার সঙ্গিনী হেঁটে বেড়াও প্রত্যহ, বলা যায়,
হাত ধরে, তোমাদের অশ্রুত কথায়
সাগ্রহে যে-কথা শুনি, তার
সঙ্গে মিশ আছে লতাপাতা, হ্রদের জলের আর নীলিমার।
এই তো সেদিন, মনে পড়ে, গোধূলিতে
তিনজন পুরুষ দাঁড়িয়ে ছিল, যেন-বা আদায় করে নিতে
যুক্তি তর্কে কিছু কথা তোমার নিকট থেকে, পাশে
দাঁড়ানো বিহবল সহচরী, তুমি হাতে মুখ ঢেকে হতাশ্বাসে,
মনে হলো,বসে ছিলে,
আবছা সিঁড়ির ধাপে, খোলা দীর্ঘ চুল, আকাশের নীলে
উড্ডীন পাখির ঝাঁক নীড়ে
ফেরার দুর্মর টানে। সেই দৃশ্য অন্তর্গত গহন তিমিরে
ঋত্বিকের স্মরণীয় শটের মতোই গেঁথে আছে,
বৃষ্টি ঝরে খোলা বারান্দায়, ছাদে, মধ্যবর্তী গাছে।
হৃদয়ের আলতামিরায়
অগ্নি জ্বলে, স্মরণাতীতের প্রতিচ্ছবি পরা বাক্ পেতে চায়।
পূর্বাপর
এ-কথা শিখেছি ঠেকে নিজের ‘মনকে চোখ ঠেরে
মেলে না ফায়দা কোনো। যখন দুঃস্বপ্ন আসে তেড়ে
জন্মান্ধ ষাঁড়ের মতো
ক্রমাগত,
মুছে যায় অপমৃত স্বপ্নের কুহক।
মেঘে-ঢাকা স্তব্ধ আকাশের বুকে বিদ্যুৎ-ঝলক
দেখা দিলে, অন্ধকার আরো বেশি লোভী
হয়, নানা অমঙ্গলময় প্রতিচ্ছবি
বারবার দেয় হানা
ভ্রষ্ট মনে। অলৌকিকে সমর্পিত অগ্রজেরা নিশ্চিন্ত ঠিকানা
সহজে ঠাউরে নিয়ে জীবন যাপন
করেছেন এবং আপন
মহিমার সীমা বাড়াবার ঘোরে ঘুরেছেন দেশ-
দেশান্তরে; আমার বিমূঢ় চেতনায় যৌথ স্মরণের রেশ
বাজে দিনরাত,
সর্বনাশে মাঝে-মাঝে মনে হয় শ্রেয় আত্মঘাত।
একদা যে-সব গাছ দিতো ছায়া, তারা সেই কবে
হয়েছে নির্মুল বাদ্যরবে
যেসব বসতবাড়ি সুরের জৌলুশ পেতো, তাদের মাটিতে
মেশানো হয়েছে, উপরন্ত জ্ঞনপীঠে
শেয়াল, বাদুড় আর গন্ধমুষিকেরা
পেয়েছে মৌরসীপাট্রা, এ শহর দুর্জনের ডেরা
ইদানীং। শূন্য ঘড়া বাজে
দশ দিকে প্রখর আওয়াজ তুলে; সেতারে এস্রাজে
মেকী বিগ্রহের জুড়ি ছাড়া
অন্য কোনো ধ্বনি নেই। পথে-ঘাটে শুধু কেন্দ্রচ্যুত, দিশেহারা
পথচারী কখনো পা বাড়ায়, কখনো পিছু হটে,
চেনা দৃশ্যপটে
ক্ষণে ক্ষণে বিভীষিকা
কী ব্যাপক লেপ্টে যায়, জেগে ওঠে উষর মধ্যহ্ন মরীচিকা।
অনেক আগেই ফুরিয়েছে পুঁজিপাটা, নির্দ্ধধায় বিনা দামে
বিকিয়ে দিয়েছি সবকিছু, নিজ নামে
রাখিনি কিছুই, শুধু
পূর্ব পুরুষের একখানি জরাগ্রস্ত নৌকা ছিল, তা-ও ধু-ধু
মাঝ দরিয়ায়
ঝড়ে খান খান হয়ে গেছে আর আমি অসহায়
সঙ্গীহীন পড়ে আছি ভগ্নকণ্ঠ, এমনকি এখন কারুকে
ডাকার শক্তিও লুপ্ত, বুকে
অতীতের নুপুরের ধ্বনি বাজে, কবেকার ঝাড় লণ্ঠনের দৃষ্টিকাড়া
বর্ণময়তায় চোখ খোঁজে আশ্রয়, পাই না সাড়া
কোনোখানে; আজ
কাদায় ডুবেছে গলা, একমাত্র কাজ
এখন আমার শুধু ব্যাঙাচির নকড়া ছকড়া সয়ে-যাওয়া
আর শূন্যে নৌকা বাওয়া।
বস্তুত তোমার সামনে ঘটা করে অর্ঘ সাজাবার
মতো কিছু নেই বাকি এখন আমার
অস্তিত্বের বিপন্ন চীৎকার ছাড়া। পৃথিবীতে জেনেছি কিছুই
পারে না বইতে স্থায়িত্বের বার; চামেলী কি জুঁই,
অট্রালিকা, বাজ্যপাট-সবই তো মিলায়
তঙ্কর হাওয়ায়
একদিন; ভালোবাসা, তা-ও
ধুলায় উধাও
কংকালের কণ্ঠে হাত জড়িয়ে ঘুমায় অকাতরে।
কোনো রক্ষাকবজের শক্তি কিংবা দেবতার বলে
আস্থা নেই; তবু আমি ব্যাকুল জানাই-
যতোদিন বেঁচে আছি, ততোদিন চাই, ভালোবাসা পেতে চাই।
বাসরের ফুল
হে নির্বোধ, কে তুই রঙিন পঞ্জিকা খুলে ব’সে
আছিস সে কবে থেকে? কেন ক্যালেন্ডারের তারিখে
নির্নিমেষ দৃষ্টি তোর খরাদগ্ধ, বর্ষণপ্রত্যাশী,
নিঃস্ব কৃষকের মতো? যার প্রতীক্ষায় তুই এই
অবেলায় রেখেছিস দোর খুলে, মানে না সে কোনো
পঞ্জিকার নির্দেশ কখনো, ক্যালেন্ডারের সংকেত
সর্বদা অগ্রাহ্য তার কাছে। আছে তার স্বরচিত
রীতিনীতি, যদি তাকে বাস্তবিক রীতি বলা যায়।
কখন পড়বে তার পদচ্ছাপ কোন সে চৌকাঠে,
সহজ নয় তা’বলা। কী খেয়ালে মেতে সে চকিতে
শ্রদ্ধাস্পদ, ধীর অধ্যাপকের বিরলকেশ, দামি
মাথায় কৌতুকী গাট্রা মেরে বিহ্বল, বিবরবাসী
যুবকের মগজের কোষে ছড়ায় অনল আর
তার শিকারির মতো হাতে দেয় বাসরের ফুল।