গৃহস্মৃতি
কিছুতে আসে না ঘুম। রাত,
কালো পাথরের মতো বুকে চেপে আছে
সারাক্ষণ; কান পেতে থাকি
কখন শুনবো তেজী মোরগের ডাক।
যদি ভোর ব্যালে নর্তকীর মতো আসে,
ছড়ায় শিল্পিত আভা আমার খাতায়,
তবে আমি শক্রকেও হেসে, হাত ধরে
নিয়ে যাবো আতিথ্যের ঘাটে, দ্বিগ্রহরে
তার সঙ্গে ভাগ করে খাবো
শাকান্ন এবং ফলমূল! ঘুম নেই
চোখে, বারবার শুধু সাততাড়াতাড়ি
ছেড়ে-আসা ঘরটির কথা মনে পড়ে।
সেসব সতেজ চারা গাছ,
যারা উঠেছিল বেড়ে আমার নিবিষ্ট
আদরের মধুর রোদ্দুরে,
সেসব গোলাপ-কুঁড়ি, যারা
আমার স্বপ্নের মতো ছিল স্ফুটোন্মুখ,
তারা কি এখনো বাঁচে
উঠোনের কোণে কোনো কল্যাণী স্পর্শের প্রত্যাশায়?
এখন বাসিন্দা যারা ওরা কি শেকড়ে ঢালে জল?
পাতা ছেঁটে দেয়? যত্ন নেয়
গোলাপ গাছের? ওরা ভোরে
অথবা বিকেলে
গম খেতে দেয় বুনো কবুতদের? মনে সুর্যোদয় নিয়ে
তিনটি তরুণী
এখনো কি সূর্যাস্তের দিকে
মুখ রেখে দাঁড়ায় প্রত্যহ ত্রিবন্দনা হয়ে খোলা
ছাদের হাওয়ায়? ওরা থাকুক শান্তিতে।
গেরোবাজ পায়রার মতো
বাসী বিছনায় আরো কিছুক্ষণ জাগরণে
কাটিয়ে সফেদ-কালো স্বপ্নগাঁথা মনে, বাথরুমে
দু’দিনের দাড়ি
কামিয়ে, বেসিনে মুখ ধুয়ে
ভোরবেলা আটটা বত্রিশে
(পুরনো টাইমপিস সাক্ষী) না-লেখা অস্পষ্ট গুঞ্জরণ
নিয়ে যাই খাবার টেবিলে,
টোস্ট, ডিম, মধু জিভে
ছড়ায় নিবিড় স্বাদ। প্লেট, কাপ এবং চামচ বেজে ওঠে
ঐকতানে, হঠাৎ তোমার
হাসির প্রপাত ছোঁয় আমাকে, অথচ
তুমি নেই কতদিন থেকে।
নীল ছবি, গহনতাময়, ফ্রেমে বাঁধা,
টেবিলে কুঁড়ের মতো পড়ে আছে ভোরের কাগজ
সেখানে কিছুই নেই বস্তুত বেহদা টাইপের
উতুঙ্গ বুকনি ছাড়া। অবচেতনের
ছায়াচ্ছন্ন গুহা থেকে পাখি উড়ে যায় মাঝে-সাঝে
নীল পাহাড়ের দিকে,
বাইরে রোদ্দুর নাওয়ায়ে স্নেহ ঢেলে
কনকচাঁপাকে। মনে পড়ে
ছেঁড়া শাদা ঘুড়ির মতন
মৃত সারসের ডানা গাঁথা
কাঁটাতারে, অমাবস্যালিপ্ত
উঠোনে লণ্ঠন হাতে দঁড়ানো আমার মাতামহী,
ছন্দিত লঞ্চের বাঁশি, ফিরে আসা, সাঁকোর গ্রামীণ
ভালোবাসা,দূরের কাশের বনে ভগবতী, রুলির ঝিলিক,
ভাঙা কলসের কাছে এক ঝাঁক কাক,
নৌকোর ভেতরে দোলে মেহগনি কাঠের কফিন।
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছি, হাতে
সন্তু অগাস্টাইনের আত্মকথা ভেসে
আসে কিয়দ্দূর থেকে
চায়ের সোনালি ঘ্রাণ, মুটে বয়ে নিয়ে
যায় সবজিভরা ঝাঁকা, ছাদে নুয়ে-পড়া ঝাঁকা ডালে
স্ততিগানে মাতে
কী একটি পাখি,
আচ্ছা আসি, বলতেই হবে কোনোদিন।
সবই থেকে চোখ
আসমানে যায়, হাত ধরাধরি ক’রে সীসে রঙ
দিগ্বলয়ে নাচে সাতজন, মরীচিকা
সুদূরে সীমানাহীন, গেরোবাজ পায়রার মতো
আমার কবিতা
ঝংকৃত উপরে যায়, মরীচিকা ঝালরকে খুব ঠোকরায়,
ফিরে আসে পুনরায়, সঙ্গে আনে তার
স্মৃতির মতোই কিছু। থাকবে তো? নাকি
ওড়া, শুধু ধু-ধু ওড়া?
জরুরি অন্তত
ব্যাপক সংকটে পথ কোথায়?
শক্রঘেরা ব্যুহে মিত্র খুঁজি।
ব্যর্থ সন্ধানে আমারও হায়
ফুরায় ক্রমাগত আয়ুর পুঁজি।
অগ্রজের কৃতকর্ম যত
প্রেতের মতো নাচে অবচেতনে।
অচিন সত্তায় প্রাচীন ক্ষত,
ঊর্ণনাভ ঘোরে বিবশ মনে।
যায় যে যৌবন অস্তাচলে,
জীবন হিমায়িত শুকনো ডাল;
অথচ সেখানেও হঠাৎ জ্বলে
বিরল উৎসবে শিমুল-লাল।
নিষেধ চারদিকে তুলছে ফণা,
শুকনো ডাল থেকে উধাও পাখি।
বিলাপে জমে আসে রক্তকণা,
হৃদয়ে হাহাকার, একাকী থাকি।
বজ্রপাতে পোড়া গাছের কাছে
সবুজ পাতা চাওয়া নিরর্থক।
সেখানে অঙ্গার, ভস্ম আছে
এবং স্বপ্নের দগ্ধ ত্বক।
স্বপ্ন আনে প্রাণে ক্ষণিক দ্যুতি,
লগ্ন তাই আজো প্রতীক্ষায়।
ভোগায় দিনরাত যে-বিচ্যুতি,
তাকেই শোধরাই তিরিক্ষায়।
কিন্তু থেকে যায় ক্রটির ছাপ
এখনো নন্দিত জল্পনায়।
কেবলি বেড়ে যায় মনস্তাপ,
তোমাকে খুঁজে ফিরি কল্পনায়।
বিস্ফোরণ আমি শুনবো বলে
সবার মতো আজ পেতেছি কান
শ্মশানে কিংশুক ফোটাতে হলে
জরুরি অন্তত আত্মদান।
তোমাকে পাঠাতে চাই
তোমাকে পাঠাতে চাই শহরের প্রতিটি রাস্তার মোড়ে, ভিড়ে
কেরানীর কলোনীতে, মতজুরের ঝুপড়িতে আর
মাছরাঙাময় বিলে; কৃষকের কুপিজ্বলা রাত্রির কুটিরে,
তোমাকে পাঠাতে চাই ফ্যাক্টরির চঞ্চল চাকার
খুব কাছে, হটে,
অন্তত জোনাকি-ঝলসিত ঝোপঝাড়ে,
কুমোর পাড়ায় অর জেলের ডিঙিতে পুকুরের স্তব্ধ ঘাটে,
চাঁদের সংকেতে চমকিত ছোট ঘরে, চুপিসারে
একে একে আসা
পার্টি কর্মীদের যুক্তিতর্কে আন্দোলিত
গোপন বৈঠকে; যদি যাও তুমি পাবে নব্য ভাষা
সেখানে, আশ্বাস দিতে পারি। কখনো হয়ো না ভীত
সালঙ্কারা হবার দরকার নেই। তোমার গলার
মনিহার
খুলে ফেলো; কঙ্কন কেয়ুর থাক, অবান্তর রুপালি নুপুর।
তোমার সত্তায় বাজে চরাচরে-মন্থিত গহন কত সুর।
শুধু চাই তোমার দু’চোখে যেন বিলে
জলপানরতা হরিণীর দৃষ্টি জেগে থাকে, আকাশের নীলে
যে-স্বপ্ন বেড়ায় ভেসে, তার
স্পর্শ পাক তোমার স্পন্দন, অন্ধকার
রাত্তিরে যখন একা বাড়ি ফেরে যুবা নান্দীপাঠ
সেরে বিপ্লবের তার যোগ্য উদ্দীপনা
আমিও তোমাতে চাই। আর নানা ঘাট
ঘুরে তুমি কুড়াবে অসীম ধৈর্যৈ অধরার কণা।
ভয় নেই হে, আমার গান,
কথা দিচ্ছি, কখনো তোমাকে করবো না অপমান।
ওথেলোর মতো
অন্ধ ক্রোধে তোমার সুন্দর গরা টিপে তোমাকে নিহত
করবো না কস্মিনকালেও। যেখানেই যাও, সভা
থমকে দাঁড়াবে জেনো; বলবে সবাই সম্মিলিত কণ্ঠস্বরে
‘কেমন সতেজ রক্তজবা
সাজহীন অপরূপ সাজে এলো আমাদের ঘরে’।