শান্তিগীত
ঘুমা দুঃখ হৃদয়ের ধন ,
ঘুমা তুই ঘুমা রে এমন ।
সুখে সারা দিনমান শোণিত করিয়া পান
এখন তো মিটেছে তিয়াষ ?
দুঃখ , তুই সুখেতে ঘুমাস ।
আজ জোছনার রাত্রে বসন্তপবনে ,
অতীতের পরলোক ত্যজি শূন্যমনে ,
বিগত দিবসগুলি শুধু একবার
পুরানো খেলার ঠাঁই দেখিতে এসেছে
এই হৃদয়ে আমার —
যবে বেঁচেছিল তারা এই এ শ্মশানে
দিন গেলে প্রতিদিন পুড়াত যেখানে
একেকটি আশা আর একেকটি সুখ ,
সেইখানে আসি তারা বসিয়া রয়েছে
অতি ম্লান মুখ ।
সেখানে বসিয়া তারা সকলে মিলিয়া
অতি মৃদু স্বরে
পুরানো কালের গীতি নয়ন মুদিয়া
ধীরে গান করে ।
দুঃখ , তুই ঘুমা ।
ধীরে উঠিতেছে গান ,
ক্রমে ছাইতেছে প্রাণ ,
নীরবতা ছায় যথা সন্ধ্যার গগন ।
গানের প্রাণের মাঝে তোর তীব্র কণ্ঠস্বর
ছুরির মতন ।
তুই থাম্ দুঃখ , থাম্ ।
তুই ঘুমা দুঃখ , ঘুমা ।
কাল উঠিস আবার ,
খেলিস দুরন্ত খেলা হৃদয়ে আমার ;
হৃদয়ের শিরাগুলি ছিঁড়ি ছিঁড়ি মোর
তাইতে রচিস তন্ত্রী বীণাটির তোর ,
সারাদিন বাজাস বসিয়া
ধ্বনিয়া হৃদয় ।
আজ রাত্রে রব শুধু চাহিয়া চাঁদের পানে ,
আর কিছু নয় ।
শিশির
শিশির কাঁদিয়া শুধু বলে ,
“ কেন মোর হেন ক্ষুদ্র প্রাণ —
শিশুটির কল্পনার মতো
জনমি অমনি অবসান ?
ঘুম – ভাঙা উষা – মেয়েটির
একটি সুখের অশ্রু হায় ,
হাসি তার ফুরাতে ফুরাতে
এ অশ্রুটি শুকাইয়া যায় ।
টুকটুকে মুখখানি নিয়ে
গোলাপ হাসিছে মুচকিয়ে ,
বকুল প্রাণের সুধা দিয়ে ,
বায়ুর মাতাল করি তুলে —
প্রজাপতি ভাবিয়া না পায়
কাহারে তাহার প্রাণ চায় ,
তুলিয়া অলস পাখা দুটি
ভ্রমিতেছে ফুল হতে ফুলে —
সেই হাসি – রাশির মাঝারে
আমি কেন থাকিতে না পাই !
যেমনি নয়ন মেলি , হায় ,
সুখের নিমেষটির প্রায় ,
অতৃপ্ত হাসিটি মুখে লয়ে
অমনি কেন গো মরে যাই । ”
শুয়ে শুয়ে অশোক – পাতায়
মুমূর্ষু শিশির বলে ,” হায় ,
কোনো সুখ ফুরায় নি যার
তার কেন জীবন ফুরায় ?”
“ আমি কেন হই নি শিশির ?”
কহে কবি নিশ্বাস ফেলিয়া ।
“ প্রভাতেই যেতেম শুকায়ে
প্রভাতেই নয়ন মেলিয়া ।
হে বিধাতা , শিশিরের মতো
গড়েছ আমার এই প্রাণ ,
শিশিরের মরণটি কেন
আমারে কর নি তবে দান ?”
সংগ্রাম-সংগীত
হৃদয়ের সাথে আজি
করিব রে করিব সংগ্রাম ।
এতদিন কিছু না করিনু
এতদিন বসে রহিলাম ,
আজি এই হৃদয়ের সাথে
একবার করিব সংগ্রাম ।
বিদ্রোহী এ হৃদয় আমার
জগৎ করিছে ছারখার ।
গ্রাসিছে চাঁদের কায়া ফেলিয়া আঁধার ছায়া
সুবিশাল রাহুর আকার ।
মেলিয়া আঁধার গ্রাস দিনেরে দিতেছে ত্রাস
মলিন করিছে মুখ তার ।
উষার মুখের হাসি লয়েছে কাড়িয়া ,
গভীর বিরামময় সন্ধ্যার প্রাণের মাঝে
দুরন্ত অশান্তি এক দিয়াছে ছাড়িয়া ।
প্রাণ হতে মুছিতেছে অরুণের রাগ ,
দিতেছে প্রাণের মাঝে কলঙ্কের দাগ ।
প্রাণের পাখির গান দিয়াছে থামায়ে ,
বেড়াত যে সাধগুলি মেঘের দোলায় দুলি
তাদের দিয়াছে হায় ভূতলে নামায়ে ।
ক্রমশই বিছাইছে অন্ধকার পাখা ,
আঁখি হতে সবকিছু পড়িতেছে ঢাকা ।
ফুল ফুটে , আমি আর দেখিতে না পাই ,
পাখী গাহে , মোর কাছে গাহে না সে আর ;
দিন হল , আলো হল , তবু দিন নাই ,
আমি শুধু নেহারি পাখার অন্ধকার ।
মিছা বসে রহিব না আর
চরাচর হারায় আমার ।
রাজ্যহারা ভিখারির সাজে
দগ্ধ ধ্বংস – ভস্ম – ‘ পরি ভ্রমিব কি হাহা করি
জগতের মরুভূমি – মাঝে ?
আজ তবে হৃদয়ের সাথে
একবার করিব সংগ্রাম ।
ফিরে নেব , কেড়ে নেব আমি
জগতের একেকটি গ্রাম ।
ফিরে নেব রষিশশীতারা ,
ফিরে নেব সন্ধ্যা আর উষা
পৃথিবীর শ্যামল যৌবন ,
কাননের ফুলময় ভূষা ।
ফিরে নেব হারানো সংগীত ,
ফিরে নেব মৃতের জীবন ,
জগতের ললাট হইতে
আঁধার করিব প্রক্ষালন ।
আমি হব সংগ্রামে বিজয়ী ,
হৃদয়ের হবে পরাজয় ,
জগতের দূর হবে ভয় ।
হৃদয়েরে রেখে দেব বেঁধে ,
বিরলে মরিবে কেঁদে কেঁদে ।
দুঃখে বিঁধি কষ্টে বিঁধি জর্জর করিব হৃদি —
বন্দী হয়ে কাটাবে দিবস ,
অবশেষে হইবে সে বশ ,
জগতে রটিবে মোর যশ ।
বিশ্বচরাচরময় উচ্ছ্বসিবে জয় জয় ,
উল্লাসে পুরিবে চারি ধার ,
গাবে রবি , গাবে শশী , গাবে তারা শূন্যে বসি ,
গাবে বায়ু শত শত বার ।
চারি দিকে দিবে হুলুধ্বনি ,
বরষিবে কুসুম-আসার ,
বেঁধে দেব বিজয়ের মালা
শান্তিময় ললাটে আমার ।
সন্ধ্যা
অয়ি সন্ধ্যে ,
অনন্ত আকাশতলে বসি একাকিনী ,
কেশ এলাইয়া
মৃদু মৃদু ও কী কথা কহিস আপন মনে
গান গেয়ে গেয়ে ,
নিখিলের মুখপানে চেয়ে ।
প্রতিদিন শুনিয়াছি , আজও তোর কথা
নারিনু বুঝিতে ।
প্রতিদিন শুনিয়াছি , আজও তোর গান
নারিনু শিখিতে ।
চোখে লাগে ঘুমঘোর ,
প্রাণ শুধু ভাবে হয় ভোর ।
হৃদয়ের অতিদূর দূর দূরান্তরে
মিলাইয়া কণ্ঠস্বর তোর কন্ঠস্বরে
উদাসী প্রবাসী যেন
তোর সাথে তোরি গান করে ।
অয়ি সন্ধ্যা , তোরি যেন স্বদেশের প্রতিবেশী
তোরি যেন আপনার ভাই
প্রাণের প্রবাসে মোর দিশা হারাইয়া
বেড়ায় সদাই ।
শোনে যেন স্বদেশের গান ,
দূর হতে কার পায় সাড়া
খুলে দেয় প্রাণ ।
যেন কী পুরোনো স্মৃতি
জাগিয়া উঠে রে ওই গানে ।
ওই তারকার মাঝে যেন তার গৃহ ছিল ,
হাসিত কাঁদিত ওইখানে ।
আরবার ফিরে যেতে চায়
পথ তবু খুঁজিয়া না পায় ।
কত – না পুরানো কথা , কত – না হারানো গান ,
কত না প্রাণের দীর্ঘশ্বাস ,
শরমের আধো হাসি , সোহাগের আধো বাণী ,
প্রণয়ের আধো মৃদু ভাষ ,
সন্ধ্যা , তোর ওই অন্ধকারে
হারাইয়া গেছে একেবারে ।
পূর্ণ করি অন্ধকার তোর
তারা সবে ভাসিয়া বেড়ায়
যুগান্তের প্রশান্ত হৃদয়ে
ভাঙাচোরা জগতের প্রায় ।
যবে এই নদীতীরে বসি তোর পদতলে
তারা সবে দলে দলে আসে
প্রাণেরে ঘেরিয়া চারি পাশে ;
হয়তো একটি হাসি একটি আধেক হাসি
সমুখেতে ভাসিয়া বেড়ায় ,
কভু ফোটে কভু বা মিলায় ।
আজি আসিয়াছি সন্ধ্যা , বসি তোর অন্ধকারে
মুদিয়া নয়ন
সাধ গেছে গাহিবারে — মৃদু স্বরে শুনাবারে
দু – চারিটি গান ।
যেথায় পুরোনো গান যেথায় হারানো হাসি
যেথা আছে বিস্মৃত স্বপন
সেইখানে সযতনে রেখে দিস গানগুলি ,
রচে দিস সমাধিশয়ন ।
জানি সন্ধ্যা , জানি তোর স্নেহ ,
গোপনে ঢাকিবি তার দেহ
বসিয়া সমাধি – ‘ পরে নিষ্ঠুরকৌতুকভরে
দেখিস হাসে না যেন কেহ ।
ধীরে শুধু ঝরিবে শিশির ,
মৃদু শ্বাস ফেলিবে সমীর ।
স্তব্ধতা কপোলে হাত দিয়ে
একা সেথা রহিবে বসিয়া ,
মাঝে মাঝে দু – একটি তারা
সেথা আসি পড়িবে খসিয়া ।