- বইয়ের নামঃ শিশু ভোলানাথ
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বিশ্বভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অন্য মা
আমার মা না হয়ে তুমি
আর – কারো মা হলে
ভাবছ তোমায় চিনতেম না ,
যেতেম না ঐ কোলে ?
মজা আরো হত ভারি ,
দুই জায়গায় থাকত বাড়ি ,
আমি থাকতেম এই গাঁয়েতে ,
তুমি পারের গাঁয়ে ।
এইখানেতেই দিনের বেলা
যা – কিছু সব হত খেলা
দিন ফুরোলেই তোমার কাছে
পেরিয়ে যেতেম নায়ে ।
হঠাৎ এসে পিছন দিকে
আমি বলতেম , ‘ বল্ দেখি কে ?’
তুমি ভাবতে , চেনার মতো
চিনি নে তো তবু ।
তখন কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে
আমি বলতেম গলা ধরে —
‘ আমায় তোমার চিনতে হবেই ,
আমি তোমার অবু !’
ঐ পারেতে যখন তুমি
আনতে যেতে জল ,
এই পারেতে তখন ঘাটে
বল্ দেখি কে বল্ ?
কাগজ – গড়া নৌকোটিকে
ভাসিয়ে দিতেম তোমার দিকে ,
যদি গিয়ে পৌঁছোত সে
বুঝতে কি , সে কার ?
সাঁতার আমি শিখিনি যে
নইলে আমি যেতেম নিজে ,
আমার পারের থেকে আমি
যেতেম তোমার পার ।
মায়ের পারে অবুর পারে
থাকত তফাত , কেউ তো কারে
ধরতে গিয়ে পেত নাকো ,
রইত না একসাথে ।
দিনের বেলায় ঘুরে ঘুরে
দেখা – দেখি দূরে দূরে —
সন্ধেবেলায় মিলে যেত
অবুতে আর মাতে ।
কিন্তু হঠাৎ কোনোদিনে
যদি বিপিন মাঝি
পার করতে তোমার পারে
নাই হত মা রাজি ।
ঘরে তোমার প্রদীপ জ্বেলে
ছাতের ‘পরে মাদুর মেলে
বসতে তুমি , পায়ের কাছে
বসত ক্ষান্তবুড়ি ,
উঠত তারা সাত ভায়েতে ,
ডাকত শেয়াল ধানের খেতে ,
উড়ো ছায়ার মতো বাদুড়
কোথায় যেত উড়ি ।
তখন কি মা , দেরি দেখে
ভয় হত না থেকে থেকে
পার হয়ে মা , আসতে হতই
অবু যেথায় আছে ।
তখন কি আর ছাড়া পেতে ?
দিতেম কি আর ফিরে যেতে ?
ধরা পড়ত মায়ের ওপার
অবুর পারের কাছে ।
ইচ্ছামতী
যখন যেমন মনে করি
তাই হতে পাই যদি
আমি তবে একখানি হই
ইচ্ছামতী নদী ।
রইবে আমার দখিন ধারে
সূর্য ওঠার পার ,
বাঁয়ের ধারে সন্ধেবেলায়
নামবে অন্ধকার ।
আমি কইব মনের কথা
দুই পারেরই সাথে ,
আধেক কথা দিনের বেলায় ,
আধেক কথা রাতে ।
যখন ঘুরে ঘুরে বেড়াই
আপন গাঁয়ের ঘাটে
ঠিক তখনি গান গেয়ে যাই
দূরের মাঠে মাঠে ।
গাঁয়ের মানুষ চিনি , যারা
নাইতে আসে জলে ,
গোরু মহিষ নিয়ে যারা
সাঁতরে ওপার চলে ।
দূরের মানুষ যারা তাদের
নতুনতরো বেশ ,
নাম জানি নে , গ্রাম জানি নে
অদ্ভুতের একশেষ ।
জলের উপর ঝলোমলো
টুকরো আলোর রাশি ।
ঢেউয়ে ঢেউয়ে পরীর নাচন ,
হাততালি আর হাসি ।
নিচের তলায় তলিয়ে যেথায়
গেছে ঘাটের ধাপ
সেইখানেতে কারা সবাই
রয়েছে চুপচাপ ।
কোণে কোণে আপন মনে
করছে তারা কী কে ।
আমারই ভয় করবে কেমন
তাকাতে সেই দিকে ।
গাঁয়ের লোকে চিনবে আমার
কেবল একটুখানি ।
বাকি কোথায় হারিয়ে যাবে
আমিই সে কি জানি ?
একধারেতে মাঠে ঘাটে
সবুজ বরন শুধু ,
আর – এক ধারে বালুর চরে
রৌদ্র করে ধূ ধূ ।
দিনের বেলায় যাওয়া আসা ,
রাত্তিরে থম্ থম্ !
ডাঙার পানে চেয়ে চেয়ে
করবে গা ছম্ ছম্ ।
খেলা-ভোলা
তুই কি ভাবিস , দিনরাত্তির
খেলতে আমার মন ?
কক্খনো তা সত্যি না মা —
আমার কথা শোন্ ।
সেদিন ভোরে দেখি উঠে
বৃষ্টিবাদল গেছে ছুটে ,
রোদ উঠেছে ঝিলমিলিয়ে
বাঁশের ডালে ডালে ;
ছুটির দিনে কেমন সুরে
পুজোর সানাই বাজছে দূরে ,
তিনটে শালিখ ঝগড়া করে
রান্নাঘরের চালে —
খেলনাগুলো সামনে মেলি
কী যে খেলি , কী যে খেলি ,
সেই কথাটাই সমস্তখন
ভাবনু আপন মনে ।
লাগল না ঠিক কোনো খেলাই ,
কেটে গেল সারাবেলাই ,
রেলিঙ ধরে রইনু বসে
বারান্দাটার কোণে ।
খেলা – ভোলার দিন মা , আমার
আসে মাঝে মাঝে ।
সেদিন আমার মনের ভিতর
কেমনতরো বাজে ।
শীতের বেলায় দুই পহরে
দূরে কাদের ছাদের ‘পরে
ছোট্ট মেয়ে রোদদুরে দেয়
বেগনি রঙের শাড়ি ।
চেয়ে চেয়ে চুপ করে রই ,
তেপান্তরের পার বুঝি ঐ ,
মনে ভাবি ঐখানেতেই
আছে রাজার বাড়ি ।
থাকত যদি মেঘে – ওড়া
পক্ষিরাজের বাচ্ছা ঘোড়া
তক্খুনি যে যেতেম তারে
লাগাম দিয়ে কষে ।
যেতে যেতে নদীর তীরে
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমীরে
পথ শুধিয়ে নিতেম আমি
গাছের তলায় বসে ।
এক – এক দিন যে দেখেছি , তুই
বাবার চিঠি হাতে
চুপ করে কী ভাবিস বসে
ঠেস দিয়ে জানলাতে
মনে হয় তোর মুখে চেয়ে
তুই যেন কোন্ দেশের মেয়ে ,
যেন আমার অনেক কালের
অনেক দূরের মা ।
কাছে গিয়ে হাতখানি ছুঁই
হারিয়ে – ফেলা মা যেন তুই ,
মাঠ – পারে কোন্ বটের তলার
বাঁশির সুরের মা ।
খেলার কথা যায় যে ভেসে ,
মনে ভাবি কোন্ কালে সে
কোন্ দেশে তোর বাড়ি ছিল
কোন্ সাগরের কূলে ।
ফিরে যেতে ইচ্ছে করে
অজানা সেই দ্বীপের ঘরে
তোমায় আমায় ভোরবেলাতে
নৌকোতে পাল তুলে ।
ঘুমের তত্ব
জাগার থেকে ঘুমোই , আবার
ঘুমের থেকে জাগি —
অনেক সময় ভাবি মনে
কেন , কিসের লাগি ?
আমাকে , মা , যখন তুমি
ঘুম পাড়িয়ে রাখ
তখন তুমি হারিয়ে গিয়ে
তবু হারাও নাকো ।
রাতে সূর্য , দিনে তারা
পাই নে , হাজার খুঁজি ।
তখন তা’রা ঘুমের সূর্য ,
ঘুমের তারা বুঝি ?
শীতের দিনে কনকচাঁপা
যায় না দেখা গাছে ,
ঘুমের মধ্যে নুকিয়ে থাকে
নেই তবুও আছে ।
রাজকন্যে থাকে , আমার
সিঁড়ির নিচের ঘরে ।
দাদা বলে , ‘ দেখিয়ে দে তো । ‘
বিশ্বাস না করে ।
কিন্তু , মা , তুই জানিস নে কি
আমার সে রাজকন্যে
ঘুমের তলায় তলিয়ে থাকে ,
দেখি নে সেইজন্যে ।
নেই তবুও আছে এমন
নেই কি কত জিনিস ?
আমি তাদের অনেক জানি ,
তুই কি তাদের চিনিস ?
যেদিন তাদের রাত পোয়াবে
উঠবে চক্ষু মেলি
সেদিন তোমার ঘরে হবে
বিষম ঠেলাঠেলি ।
নাপিত ভায়া , শেয়াল ভায়া ,
ব্যাঙ্গমা বেঙ্গুমী
ভিড় ক’রে সব আসবে যখন
কী যে করবে তুমি !
তখন তুমি ঘুমিয়ে পোড়ো
আমিই জেগে থেকে
নানারকম খেলায় তাদের
দেব ভুলিয়ে রেখে ।
তার পরে যেই জাগবে তুমি
লাগবে তাদের ঘুম ,
তখন কোথাও কিচ্ছুই নেই
সমস্ত নিজ্ঝুম ।
জ্যোতিষী
ওই যে রাতের তারা
জানিস কি , মা , কারা ?
সারাটিখন ঘুম না জানে
চেয়ে থাকে মাটির পানে
যেন কেমনধারা!
আমার যেমন নেইকো ডানা ,
আকাশ – পানে উড়তে মানা ,
মনটা কেমন করে ,
তেমনি ওদের পা নেই বলে
পারে না যে আসতে চলে
এই পৃথিবীর ‘পরে ।
সকালে যে নদীর বাঁকে
জল নিতে যাস কলসী কাঁখে
সজনেতলার ঘাটে ,
সেথায় ওদের আকাশ থেকে
আপন ছায়া দেখে দেখে
সারা পহর কাটে ।
ভাবে ওরা চেয়ে চেয়ে
‘ হতেম যদি গাঁয়ের মেয়ে
তবে সকাল – সাঁজে
কলসিখানি ধরে বুকে
সাঁতরে নিতেম মনের সুখে
ভরা নদীর মাঝে ‘ ।
আর আমাদের ছাতের কোণে
তাকায় , যেথা গভীর বনে
রাক্ষসদের ঘরে
রাজকন্যা ঘুমিয়ে থাকে ,
সোনার কাঠি ছুঁইয়ে তাকে
জাগাই শয্যা‘পরে ।
ভাবে ওরা , আকাশ ফেলে
হত যদি তোমার ছেলে ,
এইখানে এই ছাতে
দিন কাটাত খেলায় খেলায়
তার পরে সেই রাতের বেলায়
ঘুমোত তোর সাথে ।
যেদিন আমি নিষুত রাতে
হঠাৎ উঠি বিছানাতে
স্বপন থেকে জেগে
জানলা দিয়ে দেখি চেয়ে
তারাগুলি আকাশ ছেয়ে
ঝাপসা আছে মেঘে ।
বসে বসে ক্ষণে ক্ষণে
সেদিন আমার হয় যে মনে
ওদের স্বপ্ন বলে ।
অন্ধকারের ঘুম লাগে যেই
ওরা আসে সেই পহরেই ,
ভোরবেলা যায় চলে ।
আঁধার রাতি অন্ধ ও যে ,
দেখতে না পায় , আলো খোঁজে ,
সবই হারিয়ে ফেলে ।
তাই আকাশে মাদুর পেতে
সমস্তখন স্বপনেতে
দেখা – দেখা খেলে ।
তালগাছ
তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে ।
মনে সাধ , কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
একেবারে উড়ে যায় ;
কোথা পাবে পাখা সে ?
তাই তো সে ঠিক তার মাথাতে
গোল গোল পাতাতে
ইচ্ছাটি মেলে তার ,
মনে মনে ভাবে , বুঝি ডানা এই ,
উড়ে যেতে মানা নেই
বাসাখানি ফেলে তার ।
সারাদিন ঝরঝর থত্থর
কাঁপে পাতা – পত্তর ,
ওড়ে যেন ভাবে ও ,
মনে মনে আকাশেতে বেড়িয়ে
তারাদের এড়িয়ে
যেন কোথা যাবে ও ।
তার পরে হাওয়া যেই নেমে যায় ,
পাতা – কাঁপা থেমে যায় ,
ফেরে তার মনটি —
যেই ভাবে , মা যে হয় মাটি তার ,
ভালো লাগে আরবার
পৃথিবীর কোণটি ।
দুই আমি
বৃষ্টি কোথায় নুকিয়ে বেড়ায়
উড়ো মেঘের দল হয়ে ,
সেই দেখা দেয় আর – এক ধারায়
শ্রাবণ – ধারার জল হয়ে ।
আমি ভাবি চুপটি করে
মোর দশা হয় ওই যদি !
কেই বা জানে আমি আবার
আর – একজনও হই যদি !
একজনারেই তোমরা চেন
আর – এক আমি কারোই না ।
কেমনতরো ভাবখানা তার
মনে আনতে পারোই না ।
হয়তো বা ওই মেঘের মতোই
নতুন নতুন রূপ ধরে
কখন সে যে ডাক দিয়ে যায় ,
কখন থাকে চুপ করে ।
কখন বা সে পুবের কোণে
আলো – নদীর বাঁধ বাঁধে ,
কখন বা সে আধেক রাতে
চাঁদকে ধরার ফাঁদ ফাঁদে ।
শেষে তোমার ঘরের কথা
মনেতে তার যেই আসে ,
আমার মতন হয়ে আবার
তোমার কাছে সেই আসে ।
আমার ভিতর লুকিয়ে আছে
দুই রকমের দুই খেলা ,
একটা সে ওই আকাশ – ওড়া ,
আরেকটা এই ভুঁই – খেলা ।
দুষ্টু
তোমার কাছে আমিই দুষ্টু
ভালো যে আর সবাই ।
মিত্তিরদের কালু নিলু
ভারি ঠাণ্ডা ক – ভাই !
যতীশ ভালো , সতীশ ভালো ,
ন্যাড়া নবীন ভালো ,
তুমি বল ওরাই কেমন
ঘর করে রয় আলো ।
মাখন বাবুর দুটি ছেলে
দুষ্টু তো নয় কেউ —
গেটে তাদের কুকুর বাঁধা
করতেছে ঘেউ ঘেউ ।
পাঁচকড়ি ঘোষ লক্ষ্মী ছেলে ,
দত্তপাড়ার গবাই ,
তোমার কাছে আমিই দুষ্টু
ভালো যে আর সবাই ।
তোমার কথা আমি যেন
শুনি নে কক্খনোই ,
জামাকাপড় যেন আমার
সাফ থাকে না কোনোই !
খেলা করতে বেলা করি ,
বৃষ্টিতে যাই ভিজে ,
দুষ্টুপনা আরো আছে
অমনি কত কী যে !
বাবা আমার চেয়ে ভালো ?
সত্যি বলো তুমি ,
তোমার কাছে করেন নি কি
একটুও দুষ্টুমি ?
যা বল সব শোনেন তিনি ,
কিচ্ছু ভোলেন নাকো ?
খেলা ছেড়ে আসেন চলে
যেমনি তুমি ডাকো ?
দুয়োরানী
ইচ্ছে করে , মা , যদি তুই
হতিস দুয়োরানী !
ছেড়ে দিতে এমনি কি ভয়
তোমার এ ঘরখানি ।
ওইখানে ওই পুকুরপারে
জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে
ও যেন ঘোর বনের মধ্যে
কেউ কোত্থাও নেই ।
ওইখানে ঝাউতলা জুড়ে
বাঁধব তোমার ছোট্ট কুঁড়ে ,
শুকনো পাতা বিছিয়ে ঘরে
থাকব দুজনেই ।
বাঘ ভাল্লুক অনেক আছে ,
আসবে না কেউ তোমার কাছে ,
দিনরাত্তির কোমর বেঁধে
থাকব পাহারাতে ।
রাক্ষসেরা ঝোপে ঝাড়ে
মারবে উঁকি আড়ে আড়ে ,
দেখবে আমি দাঁড়িয়ে আছি
ধনুক নিয়ে হাতে ।
আঁচলেতে খই নিয়ে তুই
যেই দাঁড়াবি দ্বারে
অমনি যত বনের হরিণ
আসবে সারে সারে ।
শিঙগুলি সব আঁকাবাঁকা ,
গায়েতে দাগ চাকা চাকা ,
লুটিয়ে তারা পড়বে ভুঁয়ে
পায়ের কাছে এসে ।
ওরা সবাই আমায় বোঝে ,
করবে না ভয় একটুও যে ,
হাত বুলিয়ে দেব গায়ে ,
বসবে কাছে ঘেঁষে ।
ফলসা – বনে গাছে গাছে
ফল ধরে মেঘ করে আছে ,
ওইখানেতে ময়ূর এসে
নাচ দেখিয়ে যাবে ।
শালিখরা সব মিছিমিছি
লাগিয়ে দেবে কিচিমিচি ,
কাঠবেড়ালি লেজটি তুলে
হাত থেকে ধান খাবে ।
দিন ফুরোবে , সাঁঝের আঁধার
নামবে তালের গাছে ।
তখন এসে ঘরের কোণে
বসব কোলের কাছে ।
থাকবে না তোর কাজ কিছু তো ,
রইবে না তোর কোনো ছুতো ,
রূপকথা তোর বলতে হবে
রোজই নতুন করে ।
সীতার বনবাসের ছড়া
সবগুলি তোর আছে পড়া ;
সুর করে তাই আগাগোড়া
গাইতে হবে তোরে ।
তার পরে যেই অশথবনে
ডাকবে পেঁচা , আমার মনে
একটুখানি ভয় করবে
রাত্রি নিষুত হলে ।
তোমার বুকে মুখটি গুঁজে
ঘুমেতে চোখ আসবে বুজে —
তখন আবার বাবার কাছে
যাস নে যেন চলে !
দূর
পুজোর ছুটি আসে যখন
বকসারেতে যাবার পথে —
দূরের দেশে যাচ্ছি ভেবে
ঘুম হয় না কোনোমতে ।
সেখানে যেই নতুন বাসায়
হপ্তা দুয়েক খেলায় কাটে
দূর কি আবার পালিয়ে আসে
আমাদেরই বাড়ির ঘাটে !
দূরের সঙ্গে কাছের কেবল
কেনই যে এই লুকোচুরি ,
দূর কেন যে করে এমন
দিনরাত্তির ঘোরাঘুরি ।
আমরা যেমন ছুটি হলে
ঘরবাড়ি সব ফেলে রেখে
রেলে চড়ে পশ্চিমে যাই
বেরিয়ে পড়ি দেশের থেকে ,
তেমনিতরো সকালবেলা
ছুটিয়ে আলো আকাশেতে
রাতের থেকে দিন যে বেরোয়
দূরকে বুঝি খুঁজে পেতে ?
সে – ও তো যায় পশ্চিমেতেই ,
ঘুরে ঘুরে সন্ধে হলে ,
তখন দেখে রাতের মাঝেই
দূর সে আবার গেছে চলে ।
সবাই যেন পলাতকা
মন টেকে না কাছের বাসায় ।
দলে দলে পলে পলে
কেবল চলে দূরের আশায় ।
পাতায় পাতায় পায়ের ধ্বনি ,
ঢেউয়ে ঢেউয়ে ডাকাডাকি ,
হাওয়ায় হাওয়ায় যাওয়ার বাঁশি
কেবল বাজে থাকি থাকি ।
আমায় এরা যেতে বলে ,
যদি বা যাই , জানি তবে
দূরকে খুঁজে খুঁজে শেষে
মায়ের কাছেই ফিরতে হবে ।
পথহারা
আজকে আমি কতদূর যে
গিয়েছিলেম চলে !
যত তুমি ভাবতে পারো
তার চেয়ে সে অনেক আরো ,
শেষ করতে পারব না তা
তোমায় ব’লে ব’লে ।
অনেক দূর সে , আরো দূর সে ,
আরো অনেক দূর ।
মাঝখানেতে কত যে বেত ,
কত যে বাঁশ , কত যে খেত ,
ছাড়িয়ে ওদের ঠাকুরবাড়ি
ছাড়িয়ে তালিমপুর ।
পেরিয়ে গেলেম যেতে যেতে
সাত – কুশি সব গ্রাম ,
ধানের গোলা গুনব কত
জোদ্দারদের গোলার মতো ,
সেখানে যে মোড়ল কারা
জানি নে তার নাম ।
একে একে মাঠ পেরোলুম
কত মাঠের পরে ।
তার পরে , উঃ , বলি মা শোন্ ,
সামনে এল প্রকাণ্ড বন ,
ভিতরে তার ঢুকতে গেলে
গা ছ্ম্ছ্ম্ করে ।
জামতলাতে বুড়ি ছিল ,
বললে ‘ খবরদার ‘!
আমি বললেম বারণ শুনে
‘ ছ – পণ কড়ি এই নে গুনে ‘,
যতক্ষণ সে গুনতে থাকে
হয়ে গেলাম পার ।
কিছুরই শেষ নেই কোত্থাও
আকাশ পাতাল জুড়ি ।
যতই চলি যতই চলি
বেড়েই চলে বনের গলি ,
কালো মুখোশপরা আঁধার
সাজল জুজুবুড়ি ।
খেজুরগাছের মাথায় বসে
দেখছে কারা ঝুঁকি ।
কারা যে সব ঝোপের পাশে
একটুখানি মুচকে হাসে ,
বেঁটে বেঁটে মানুষগুলো
কেবল মারে উঁকি ।
আমায় যেন চোখ টিপছে
বুড়ো গাছের গুঁড়ি ।
লম্বা লম্বা কাদের পা যে
ঝুলছে ডালের মাঝে মাঝে ,
মনে হচ্ছে পিঠে আমার
কে দিল সুড়সুড়ি ।
ফিসফিসিয়ে কইছে কথা
দেখতে না পাই কে সে ।
অন্ধকারে দুদ্দাড়িয়ে
কে যে কারে যায় তাড়িয়ে ,
কী জানি কী গা চেটে যায়
হঠাৎ কাছ এসে ।
ফুরোয় না পথ ভাবছি আমি
ফিরব কেমন করে ।
সামনে দেখি কিসের ছায়া ,
ডেকে বলি , ‘ শেয়াল ভায়া ,
মায়ের গাঁয়ের পথ তোরা কেউ
দেখিয়ে দে – না মোরে । ‘
কয় না কিছুই , চুপটি করে
কেবল মাথা নাড়ে ।
সিঙ্গিমামা কোথা থেকে
হঠাৎ কখন এসে ডেকে
কে জানে মা , হালুম ক’রে
পড়ল যে কার ঘাড়ে ।
বল্ দেখি তুই , কেমন করে
ফিরে পেলেম মাকে ?
কেউ জানে না কেমন করে ;
কানে কানে বলব তোরে ?
যেমনি স্বপন ভেঙে গেল
সিঙ্গিমামার ডাকে ।
পুতুল ভাঙা
সাত – আটটে সাতাশ ‘, আমি
বলেছিলাম বলে
গুরুমশায় আমার ‘পরে
উঠল রাগে জ্বলে ।
মা গো , তুমি পাঁচ পয়সায়
এবার রথের দিনে
সেই যে রঙিন পুতুলখানি
আপনি দিলে কিনে
খাতার নিচে ছিল ঢাকা ;
দেখালে এক ছেলে ,
গুরুমশায় রেগেমেগে
ভেঙে দিলেন ফেলে ।
বললেন , ‘ তোর দিনরাত্তির
কেবল যত খেলা ।
একটুও তোর মন বসে না
পড়াশুনার বেলা! ‘
মা গো , আমি জানাই কাকে ?
ওঁর কি গুরু আছে ?
আমি যদি নালিশ করি
এক্খনি তাঁর কাছে ?
কোনোরকম খেলার পুতুল
নেই কি , মা , ওঁর ঘরে
সত্যি কি ওঁর একটুও মন
নেই পুতুলের ‘পরে ?
সকাল – সাঁজে তাদের নিয়ে
করতে গিয়ে খেলা
কোনো পড়ায় করেন নি কি
কোনোরকম হেলা ?
ওঁর যদি সেই পুতুল নিয়ে
ভাঙেন কেহ রাগে ,
বল দেখি মা , ওঁর মনে তা
কেমনতরো লাগে ?
বাউল
দূরে অশথতলায়
পুঁতির কণ্ঠিখানি গলায়
বাউল দাঁড়িয়ে কেন আছ ?
সামনে আঙিনাতে
তোমার একতারাটি হাতে
তুমি সুর লাগিয়ে নাচো !
পথে করতে খেলা
আমার কখন হল বেলা
আমায় শাস্তি দিল তাই ।
ইচ্ছে হোথায় নাবি
কিন্তু ঘরে বন্ধ চাবি
আমার বেরোতে পথ নাই ।
বাড়ি ফেরার তরে
তোমায় কেউ না তাড়া করে
তোমার নাই কোনো পাঠশালা ।
সমস্ত দিন কাটে
তোমার পথে ঘাটে মাঠে
তোমার ঘরেতে নেই তালা ।
তাই তো তোমার নাচে
আমার প্রাণ যেন ভাই বাঁচে —
আমার মন যেন পায় ছুটি ।
ওগো তোমার নাচে
যেন ঢেউয়ের দোলা আছে ,
ঝড়ে গাছের লুটোপুটি ।
অনেক দূরের দেশ
আমার চোখে লাগায় রেশ ,
যখন তোমায় দেখি পথে ।
দেখতে পায় যে মন
যেন নাম – না – জানা বন
কোন্ পথহারা পর্বতে ।
হঠাৎ মনে লাগে ,
যেন অনেক দিনের আগে ,
আমি অমনি ছিলেম ছাড়া ।
সেদিন গেল ছেড়ে ,
আমার পথ নিল কে কেড়ে ,
আমার হারাল একতারা ।
কে নিল গো টেনে ,
আমায় পাঠশালাতে এনে ,
আমার এল গুরুমশায় ।
মন সদা যার চলে
যত ঘরছাড়াদের দলে
তারে ঘরে কেন বসায় ?
কও তো আমায় ভাই ,
তোমার গুরুমশায় নাই ?
আমি যখন দেখি ভেবে
বুঝতে পারি খাঁটি ,
তোমার বুকের একতারাটি ,
তোমায় ঐ তো পড়া দেবে ।
তোমার কানে কানে
ওরই গুনগুনানি গানে
তোমায় কোন্ কথা যে কয় !
সব কি তুমি বোঝ ?
তারই মানে যেন খোঁজ
কেবল ফিরে ভুবনময় ।
ওরই কাছে বুঝি
আছে তোমার নাচের পুঁজি ,
তোমার খেপা পায়ের ছুটি ?
ওরই সুরের বোলে
তোমার গলার মালা দোলে
তোমার দোলে মাথার ঝুঁটি ।
মন যে আমার পালায়
তোমার একতারা – পাঠশালায় ,
আমায় ভুলিয়ে দিতে পার ?
নেবে আমায় সাথে ?
এ – সব পণ্ডিতেরই হাতে
আমায় কেন সবাই মার ?
ভুলিয়ে দিয়ে পড়া
আমায় শেখাও সুরে – গড়া
তোমার তালা – ভাঙার পাঠ ।
আর কিছু না চাই ,
যেন আকাশখানা পাই ,
আর পালিয়ে যাবার মাঠ ।
দূরে কেন আছ ?
দ্বারের আগল ধরে নাচো ,
বাউল আমারই এইখানে ।
সমস্ত দিন ধ ‘ রে
যেন মাতন ওঠে ভ ‘ রে
তোমার ভাঙন – লাগা গানে ।
বাণী-বিনিময়
মা , যদি তুই আকাশ হতিস ,
আমি চাঁপার গাছ ,
তোর সাথে মোর বিনি – কথায়
হত কথার নাচ ।
তোর হাওয়া মোর ডালে ডালে
কেবল থেকে থেকে
কত রকম নাচন দিয়ে
আমায় যেত ডেকে ।
মা ব’লে তার সাড়া দেব
কথা কোথায় পাই ,
পাতায় পাতায় সাড়া আমার
নেচে উঠত তাই ।
তোর আলো মোর শিশির – ফোঁটায়
আমার কানে কানে
টলমলিয়ে কী বলত যে
ঝলমলানির গানে ।
আমি তখন ফুটিয়ে দিতেম
আমার যত কুঁড়ি ,
কথা কইতে গিয়ে তারা
নাচন দিত জুড়ি ।
উড়ো মেঘের ছায়াটি তোর
কোথায় থেকে এসে
আমার ছায়ায় ঘনিয়ে উঠে
কোথায় যেত ভেসে ।
সেই হত তোর বাদল – বেলার
রূপকথাটির মতো ;
রাজপুত্তুর ঘর ছেড়ে যায়
পেরিয়ে রাজ্য কত ;
সেই আমারে বলে যেত
কোথায় আলেখ – লতা ,
সাগরপারের দৈত্যপুরের
রাজকন্যার কথা ;
দেখতে পেতেম দুয়োরানীর
চক্ষু ভর – ভর ,
শিউরে উঠে পাতা আমার
কাঁপত থরোথরো ।
হঠাৎ কখন বৃষ্টি তোমার
হাওয়ার পাছে পাছে
নামত আমার পাতায় পাতায়
টাপুর – টুপুর নাচে ;
সেই হত তোর কাঁদন – সুরে
রামায়ণের পড়া ,
সেই হত তোর গুনগুনিয়ে
শ্রাবণ – দিনের ছড়া ।
মা , তুই হতিস নীলবরনী ,
আমি সবুজ কাঁচা ;
তোর হত , মা , আলোর হাসি ,
আমার পাতার নাচা ।
তোর হত , মা , উপর থেকে
নয়ন মেলে চাওয়া ,
আমার হত আঁকুবাঁকু
হাত তুলে গান গাওয়া ।
তোর হত , মা চিরকালের
তারার মণিমালা ,
আমার হত দিনে দিনে
ফুল – ফোটাবার পালা ।
বুড়ি
এক যে ছিল চাঁদের কোণায়
চরকা – কাটা বুড়ি
পুরাণে তার বয়স লেখে
সাতশো হাজার কুড়ি ।
সাদা সুতোয় জাল বোনে সে
হয় না বুনন সারা
পণ ছিল তার ধরবে জালে
লক্ষ কোটি তারা ।
হেনকালে কখন আঁখি
পড়ল ঘুমে ঢুলে ,
স্বপনে তার বয়সখানা
বেবাক গেল ভুলে ।
ঘুমের পথে পথ হারিয়ে ,
মায়ের কোলে এসে
পূর্ণ চাঁদের হাসিখানি
ছড়িয়ে দিল হেসে ।
সন্ধেবেলায় আকাশ চেয়ে
কী পড়ে তার মনে ।
চাঁদকে করে ডাকাডাকি ,
চাঁদ হাসে আর শোনে ।
যে – পথ দিয়ে এসেছিল
স্বপন – সাগর – তীরে
দু – হাত তুলে সে – পথ দিয়ে
চায় সে যেতে ফিরে ।
হেনকালে মায়ের মুখে
যেমনি আঁখি তোলে
চাঁদে ফেরার পথখানি যে
তক্খনি সে ভোলে ।
কেউ জানে না কোথায় বাসা ,
এল কী পথ বেয়ে ,
কেউ জানে না , এই মেয়ে সেই
আদ্যিকালের মেয়ে ।
বয়সখানার খ্যাতি তবু
রইল জগৎ জুড়ি —
পাড়ার লোকে যে দেখে সেই
ডাকে , ‘ বুড়ি বুড়ি ‘ ।
সব – চেয়ে যে পুরানো সে ,
কোন্ মন্ত্রের বলে
সব – চেয়ে আজ নতুন হয়ে
নামল ধরাতলে ।
বৃষ্টি রৌদ্র
ঝুঁটি – বাঁধা ডাকাত সেজে
দল বেঁধে মেঘ চলেছে যে
আজকে সারাবেলা ।
কালো ঝাঁপির মধ্যে ভরে
সুর্যিকে নেয় চুরি করে ,
ভয় – দেখাবার খেলা ।
বাতাস তাদের ধরতে মিছে
হাঁপিয়ে ছোটে পিছে পিছে ,
যায় না তাদের ধরা ।
আজ যেন ওই জড়োসড়ো
আকাশ জুড়ে মস্ত বড়ো
মন – কেমন – করা ।
বটের ডালে ডানা – ভিজে
কাক বসে ওই ভাবছে কী যে ,
চড়ুইগুলো চুপ ।
বৃষ্টি হয়ে গেছে ভোরে
শজনেপাতায় ঝরে ঝরে
জল পড়ে টুপটুপ ।
লেজের মধ্যে মাথা থুয়ে
খাঁদন কুকুর আছে শুয়ে
কেমন একরকম ।
দালানটাতে ঘুরে ঘুরে
পায়রাগুলো কাঁদন – সুরে
ডাকছে বকবকম ।
কার্তিকে ওই ধানের খেতে
ভিজে হাওয়া উঠল মেতে
সবুজ ঢেউয়ের ‘পরে ।
পরশ লেগে দিশে দিশে
হিহি করে ধানের শিষে
শীতের কাঁপন ধরে ।
ঘোষাল – পাড়ার লক্ষ্মী বুড়ি
ছেঁড়া কাঁথায় মুড়িসুড়ি
গেছে পুকুরপাড়ে ,
দেখতে ভালো পায় না চোখে
বিড়বিড়িয়ে বকে বকে
শাক তোলে , ঘাড় নাড়ে ।
ঐ ঝমাঝম বৃষ্টি নামে
মাঠের পারে দূরের গ্রামে
ঝাপসা বাঁশের বন ।
গোরুটা কার থেকে থেকে
খোঁটায় – বাঁধা উঠছে ডেকে
ভিজছে সারাক্ষণ ।
গদাই কুমোর অনেক ভোরে
সাজিয়ে নিয়ে উঁচু ক’রে
হাঁড়ির উপর হাঁড়ি
চলছে রবিবারের হাটে ,
গামছা মাথায় জলের ছাঁটে
হাঁকিয়ে গোরুর গাড়ি ।
বন্ধ আমার রইল খেলা ,
ছুটির দিনে সারাবেলা
কাটবে কেমন করে ?
মনে হচ্ছে এমনিতরো
ঝরবে বৃষ্টি ঝরোঝরো
দিনরাত্তির ধরে !
এমন সময় পুবের কোণে
কখন যেন অন্যমনে
ফাঁক ধরে ওই মেঘে ,
মুখের চাদর সরিয়ে ফেলে
হঠাৎ চোখের পাতা মেলে
আকাশ ওঠে জেগে ।
ছিঁড়ে – যাওয়া মেঘের থেকে
পুকুরে রোদ পড়ে বেঁকে ,
লাগায় ঝিলিমিলি ।
বাঁশবাগানের মাথায় মাথায়
তেঁতুলগাছের পাতায় পাতায়
হাসায় খিলিখিলি ।
হঠাৎ কিসের মন্ত্র এসে
ভুলিয়ে দিলে একনিমেষে
বাদলবেলার কথা ।
হারিয়ে – পাওয়া আলোটিরে
নাচায় ডালে ফিরে ফিরে
বেড়ার ঝুমকোলতা ।
উপর নিচে আকাশ ভরে
এমন বদল কেমন করে
হয় , সে – কথাই ভাবি ।
উলটপালট খেলাটি এই ,
সাজের তো তার সীমানা নেই ,
কার কাছে তার চাবি ?
এমন যে ঘোর মন – খারাপি
বুকের মধ্যে ছিল চাপি
সমস্ত খন আজি —
হঠাৎ দেখি সবই মিছে
নাই কিছু তার আগে পিছে
এ যেন কার বাজি ।
মনে পড়া
মাকে আমার পড়ে না মনে ।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে
হঠাৎ অকারণে
একটা কী সুর গুনগুনিয়ে
কানে আমার বাজে ,
মায়ের কথা মিলায় যেন
আমার খেলার মাঝে ।
মা বুঝি গান গাইত , আমার
দোলনা ঠেলে ঠেলে ;
মা গিয়েছে , যেতে যেতে
গানটি গেছে ফেলে ।
মাকে আমার পড়ে না মনে ।
শুধু যখন আশ্বিনেতে
ভোরে শিউলিবনে
শিশির – ভেজা হাওয়া বেয়ে
ফুলের গন্ধ আসে ,
তখন কেন মায়ের কথা
আমার মনে ভাসে ?
কবে বুঝি আনত মা সেই
ফুলের সাজি বয়ে ,
পুজোর গন্ধ আসে যে তাই
মায়ের গন্ধ হয়ে ।
মাকে আমার পড়ে না মনে ।
শুধু যখন বসি গিয়ে
শোবার ঘরের কোণে ;
জানলা থেকে তাকাই দূরে
নীল আকাশের দিকে ,
মনে হয় মা আমার পানে
চাইছে অনিমিখে ।
কোলের ‘পরে ধরে কবে
দেখত আমায় চেয়ে ,
সেই চাউনি রেখে গেছে
সারা আকাশ ছেয়ে ।
মর্তবাসী
কাকা বলেন , সময় হলে
সবাই চ ‘ লে
যায় কোথা সেই স্বর্গ – পারে ।
বল্ তো কাকী
সত্যি তা কি
একেবারে ?
তিনি বলেন , যাবার আগে
তন্দ্রা লাগে
ঘণ্টা কখন ওঠে বাজি ,
দ্বারের পাশে
তখন আসে
ঘাটের মাঝি ।
বাবা গেছেন এমনি করে
কখন ভোরে
তখন আমি বিছানাতে ।
তেমনি মাখন
গেল কখন
অনেক রাতে ।
কিন্তু আমি বলছি তোমায়
সকল সময়
তোমার কাছেই করব খেলা ,
রইব জোরে
গলা ধরে
রাতের বেলা ।
সময় হলে মানব না তো ,
জানব না তো ,
ঘণ্টা মাঝির বাজল কবে ।
তাই কি রাজা
দেবেন সাজা
আমায় তবে ?
তোমরা বল , স্বর্গ ভালো
সেথায় আলো
রঙে রঙে আকাশ রাঙায় ,
সারা বেলা
ফুলের খেলা
পারুলডাঙায় !
হোক – না ভালো যত ইচ্ছে —
কেড়ে নিচ্ছে
কেই বা তাকে বলো , কাকী ?
যেমন আছি
তোমার কাছেই
তেমনি থাকি !
ওই আমাদের গোলাবাড়ি ,
গোরুর গাড়ি
পড়ে আছে চাকা – ভাঙা ,
গাবের ডালে
পাতার লালে
আকাশ রাঙা ।
সেথা বেড়ায় যক্ষীবুড়ি
গুড়িগুড়ি
আসশেওড়ার ঝোপে ঝাপে
ফুলের গাছে
দোয়েল নাচে
ছায়া কাঁপে ।
নুকিয়ে আমি সেথা পলাই ,
কানাই বলাই
দু – ভাই আসে পাড়ার থেকে ।
ভাঙা গাড়ি
দোলাই নাড়ি
ঝেঁকে ঝেঁকে ।
সন্ধেবেলায় গল্প বলে
রাখ কোলে ,
মিটমিটিয়ে জ্বলে বাতি ।
চালতা – শাখে
পেঁচা ডাকে ,
বাড়ে রাতি ।
স্বর্গে যাওয়া দেব ফাঁকি
বলছি , কাকী ,
দেখব আমায় কে কী করে ।
চিরকালই
রইব খালি
তোমার ঘরে ।
মুর্খু
নেই বা হলেম যেমন তোমার
অম্বিকে গোঁসাই ।
আমি তো , মা , চাই নে হতে
পণ্ডিতমশাই ।
নাই যদি হই ভালো ছেলে ,
কেবল যদি বেড়াই খেলে
তুঁতের ডালে খুঁজে বেড়াই
গুটিপোকার গুটি ,
মুর্খু হয়ে রইব তবে ?
আমার তাতে কীই বা হবে ,
মুর্খু যারা তাদেরই তো
সমস্তখন ছুটি ।
তারাই তো সব রাখাল ছেলে
গোরু চরায় মাঠে ।
নদীর ধারে বনে বনে
তাদের বেলা কাটে ।
ডিঙির ‘ পরে পাল তুলে দেয় ,
ঢেউয়ের মুখে নাও খুলে দেয় ,
ঝাউ কাটতে যায় চলে সব
নদীপারের চরে ।
তারাই মাঠে মাচা পেতে
পাখি তাড়ায় ফসল – খেতে ,
বাঁকে করে দই নিয়ে যায়
পাড়ার ঘরে ঘরে ।
কাস্তে হাতে চুবড়ি মাথায় ,
সন্ধে হলে পরে
ফেরে গাঁয়ে কৃষাণ ছেলে ,
মন যে কেমন করে ।
যখন গিয়ে পাঠশালাতে
দাগা বুলোই খাতার পাতে ,
গুরুমশাই দুপুরবেলায়
বসে বসে ঢোলে ,
হাঁকিয়ে গাড়ি কোন্ গাড়োয়ান
মাঠের পথে যায় গেয়ে গান ,
শুনে আমি পণ করি যে
মুর্খু হব বলে ।
দুপুরবেলায় চিল ডেকে যায় ;
হঠাৎ হাওয়া আসি
বাঁশ – বাগানে বাজায় যেন
সাপ – খেলাবার বাঁশি ।
পুবের দিকে বনের কোলে
বাদল – বেলার আঁচল দোলে ,
ডালে ডালে উছলে ওঠে
শিরীষফুলের ঢেউ ।
এরা যে পাঠ – ভোলার দলে
পাঠশালা সব ছাড়তে বলে ,
আমি জানি এরা তো , মা ,
পণ্ডিত নয় কেউ ।
যাঁরা অনেক পুঁথি পড়েন
তাঁদের অনেক মান ।
ঘরে ঘরে সবার কাছে
তাঁরা আদর পান ।
সঙ্গে তাঁদের ফেরে চেলা ,
ধুমধামে যায় সারা বেলা ,
আমি তো , মা , চাই নে আদর
তোমার আদর ছাড়া ।
তুমি যদি মুর্খু বলে
আমাকে মা না নাও কোলে
তবে আমি পালিয়ে যাব
বাদলা মেঘের পাড়া ।
সেখান থেকে বৃষ্টি হয়ে
ভিজিয়ে দেব চুল ।
ঘাটে যখন যাবে , আমি
করব হুলুস্থূল ।
রাত থাকতে অনেক ভোরে
আসব নেমে আঁধার করে ,
ঝড়ের হাওয়ায় ঢুকব ঘরে
দুয়ার ঠেলে ফেলে ,
তুমি বলবে মেলে আঁখি ,
‘ দুষ্টু দেয়া খেপল না কি ?’
আমি বলব , ‘ খেপেছে আজ
তোমার মুর্খু ছেলে ।
রবিবার
সোম মঙ্গল বুধ এরা সব
আসে তাড়াতাড়ি ,
এদের ঘরে আছে বুঝি
মস্ত হাওয়া – গাড়ি ?
রবিবার সে কেন , মা গো ,
এমন দেরি করে ?
ধীরে ধীরে পৌঁছয় সে
সকল বারের পরে ।
আকাশ – পারে তার বাড়িটি
দূর কি সবার চেয়ে ?
সে বুঝি মা তোমার মতো
গরিব – ঘরের মেয়ে ?
সোম মঙ্গল বুধের খেয়াল
থাকবারই জন্যেই ,
বাড়ি – ফেরার দিকে ওদের
একটুও মন নেই ।
রবিবারকে কে যে এমন
বিষম তাড়া করে ,
ঘণ্টাগুলো বাজায় যেন
আধ ঘণ্টার পরে ।
আকাশ – পারে বাড়িতে তার
কাজ আছে সব – চেয়ে ?
সে বুঝি , মা , তোমার মতো
গরিব – ঘরের মেয়ে ।
সোম মঙ্গল বুধের যেন
মুখগুলো সব হাঁড়ি
ছোটো ছেলের সঙ্গে তাদের
বিষম আড়াআড়ি ।
কিন্তু শনির রাতের শেষে
যেমনি উঠি জেগে ,
রবিবারের মুখে দেখি
হাসিই আছে লেগে ।
যাবার বেলায় যায় সে কেঁদে
মোদের মুখে চেয়ে ।
সে বুঝি , মা , তোমার মতো
গরিব ঘরের মেয়ে ?
রাজমিস্ত্রী
বয়স আমার হবে তিরিশ ,
দেখতে আমায় ছোটো ,
আমি নই মা , তোমার শিরিশ ,
আমি হচ্ছি নোটো ।
আমি যে রোজ সকাল হলে
যাই শহরের দিকে চলে
তমিজ মিঞার গোরুর গাড়ি চড়ে ।
সকাল থেকে সারা দুপর
ইঁট সাজিয়ে ইঁটের উপর
খেয়ালমতো দেয়াল তুলি গড়ে ।
ভাবছ তুমি নিয়ে ঢেলা
ঘর – গড়া সে আমার খেলা ,
কক্খনো না সত্যিকার সে কোঠা ।
ছোটো বাড়ি নয় তো মোটে ,
তিনতলা পর্যন্ত ওঠে ,
থামগুলো তার এমনি মোটা মোটা ।
কিন্তু যদি শুধাও আমায়
ওইখানেতেই কেন থামায় ?
দোষ কী ছিল ষাট – সত্তর তলা ?
ইঁট সুরকি জুড়ে জুড়ে
একেবারে আকাশ ফুঁড়ে
হয় না কেন কেবল গেঁথে চলা ?
গাঁথতে গাঁথতে কোথায় শেষে
ছাত কেন না তারায় মেশে ?
আমিও তাই ভাবি নিজে নিজে ।
কোথাও গিয়ে কেন থামি
যখন শুধাও , তখন আমি
জানি নে তো তার উত্তর কী যে ।
যখন খুশি ছাতের মাথায়
উঠছি ভারা বেয়ে ।
সত্যি কথা বলি , তাতে
মজা খেলার চেয়ে ।
সমস্ত দিন ছাত – পিটুনি
গান গেয়ে ছাত পিটোয় শুনি ,
অনেক নিচে চলছে গাড়িঘোড়া ।
বাসনওআলা থালা বাজায় ;
সুর করে ওই হাঁক দিয়ে যায়
আতাওআলা নিয়ে ফলের ঝোড়া ।
সাড়ে চারটে বেজে ওঠে ,
ছেলেরা সব বাসায় ছোটে
হো হো করে উড়িয়ে দিয়ে ধুলো ।
রোদ্ দুর যেই আসে পড়ে
পুবের মুখে কোথায় ওড়ে
দলে দলে ডাক দিয়ে কাকগুলো ।
আমি তখন দিনের শেষে
ভারার থেকে নেমে এসে
আবার ফিরে আসি আপন গাঁয়ে ।
জান তো , মা , আমার পাড়া
যেখানে ওই খুঁটি গাড়া
পুকুরপাড়ে গাজনতলার বাঁয়ে ।
তোরা যদি শুধাস মোরে
খড়ের চালায় রই কী করে ?
কোঠা যখন গড়তে পারি নিজে ;
আমার ঘর যে কেন তবে
সব – চেয়ে না বড়ো হবে ?
জানি নে তো তার উত্তর কী যে !
রাজা ও রানী
এক যে ছিল রাজা
সেদিন আমায় দিল সাজা ।
ভোরের রাতে উঠে
আমি গিয়েছিলুম ছুটে ,
দেখতে ডালিম গাছে
বনের পিরভু কেমন নাচে ।
ডালে ছিলেম চড়ে ,
সেটা ভেঙেই গেল পড়ে ।
সেদিন হল মানা
আমার পেয়ারা পেড়ে আনা ,
রথ দেখতে যাওয়া ,
আমার চিঁড়ের পুলি খাওয়া ।
কে দিল সেই সাজা ,
জান কে ছিল সেই রাজা ?
এক যে ছিল রানী
আমি তার কথা সব মানি ।
সাজার খবর পেয়ে
আমায় দেখল কেবল চেয়ে ।
বললে না তো কিছু ,
কেবল মুখটি করে নিচু
আপন ঘরে গিয়ে
সেদিন রইল আগল দিয়ে ।
হল না তার খাওয়া ,
কিংবা রথ দেখতে যাওয়া ।
নিল আমায় কোলে
সাজার সময় সারা হলে ।
গলা ভাঙা – ভাঙা
তার চোখ – দুখানি রাঙা ।
কে ছিল সেই রানী
আমি জানি জানি জানি ।
শিশু ভোলানাথ
ওরে মোর শিশু ভোলানাথ ,
তুলি দুই হাত
যেখানে করিস পদপাত
বিষম তাণ্ডবে তোর লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সব ;
আপন বিভব
আপনি করিস নষ্ট হেলাভরে ;
প্রলয়ের ঘূর্ণচক্র -‘ পরে
চূর্ণ খেলেনার ধূলি উড়ে দিকে দিকে ;
আপন সৃষ্টিকে
ধ্বংস হতে ধ্বংসমাঝে মুক্তি দিস অনর্গল ,
খেলারে করিস রক্ষা ছিন্ন করি খেলেনা – শৃঙ্খল ।
অকিঞ্চন , তোর কাছে কিছুরই তো কোনো মূল্য নাই ,
রচিস যা তোর ইচ্ছা তাই
যাহা খুশি তাই দিয়ে ,
তার পর ভুলে যাস যাহা ইচ্ছা তাই নিয়ে ।
আবরণ তোরে নাহি পারে সম্বরিতে দিগম্বর ,
স্রস্ত ছিন্ন পড়ে ধূলি -‘ পর ।
লজ্জাহীন সজ্জাহীন বিত্তহীন আপনা – বিস্মৃত ,
অন্তরে ঐশ্বর্য তোর , অন্তরে অমৃত ।
দারিদ্র্য করে না দীন , ধূলি তোরে করে না অশুচি ,
নৃত্যের বিক্ষোভে তোর সব গ্লানি নিত্য যায় ঘুচি ।
ওরে শিশু ভোলানাথ , মোরে ভক্ত ব’লে
নে রে তোর তাণ্ডবের দলে ;
দে রে চিত্তে মোর
সকল – ভোলার ওই ঘোর ,
খেলেনা – ভাঙার খেলা দে আমারে বলি ।
আপন সৃষ্টির বন্ধ আপনি ছিঁড়িয়া যদি চলি
তবে তোর মত্ত নর্তনের চালে
আমার সকল গান ছন্দে ছন্দে মিলে যাবে তালে ।
শিশুর জীবন
ছোটো ছেলে হওয়ার সাহস
আছে কি এক ফোঁটা,
তাই তো এমন বুড়ো হয়েই মরি।
তিলে তিলে জমাই কেবল
জমাই এটা ওটা,
পলে পলে বাক্স বোঝাই করি।
কালকে-দিনের ভাবনা এসে
আজ-দিনেরে মারলে ঠেসে
কাল তুলি ফের পরদিনের বোঝা।
সাধের জিনিস ঘরে এনেই
দেখি, এনে ফল কিছু নেই
খোঁজের পরে আবার চলে খোঁজা।
ভবিষ্যতের ভয়ে ভীত
দেখতে না পাই পথ,
তাকিয়ে থাকি পরশু দিনের পানে,
ভবিষ্যৎ তো চিরকালই
থাকবে ভবিষ্যৎ ,
ছুটি তবে মিলবে বা কোন্খানে?
বুদ্ধি-দীপের আলো জ্বালি
হাওয়ায় শিখা কাঁপছে খালি,
হিসেব করে পা টিপে পথ হাঁটি।
মন্ত্রণা দেয় কতজনা,
সূক্ষ্ম বিচার-বিবেচনা,
পদে-পদে হাজার খুঁটিনাটি।
শিশু হবার ভরসা আবার
জাগুক আমার প্রাণে,
লাগুক হাওয়া নির্ভাবনার পালে,
ভবিষ্যতের মুখোশখানা
খসাব একটানে,
দেখব তারেই বর্তমানের কালে।
ছাদের কোণে পুকুরপারে
জানব নিত্য-অজানারে
মিশিয়ে রবে অচেনা আর চেনা;
জমিয়ে ধুলো সাজিয়ে ঢেলা
তৈরি হবে আমার খেলা,
সুখ রবে মোর বিনামূল্যেই কেনা।
বড়ো হবার দায় নিয়ে, এই
বড়োর হাটে এসে
নিত্য চলে ঠেলাঠেলির পালা।
যাবার বেলায় বিশ্ব আমার
বিকিয়ে দিয়ে শেষে
শুধুই নেব ফাঁকা কথার ডালা!
কোন্টা সস্তা, কোন্টা দামি
ওজন করতে গিয়ে আমি
বেলা আমার বইয়ে দেব দ্রুত,
সন্ধ্যা যখন আঁধার হবে
হঠাৎ মনে লাগবে তবে
কোনোটাই না হল মনঃপুত।
বাল্য দিয়ে যে-জীবনের
আরম্ভ হয় দিন
বাল্যে আবার হোক-না তাহা সারা।
জলে স্থলে সঙ্গ আবার
পাক-না বাঁধন-হীন,
ধুলায় ফিরে আসুক-না পথহারা।
সম্ভাবনার ডাঙা হতে
অসম্ভবের উতল স্রোতে
দিই-না পাড়ি স্বপন-তরী নিয়ে।
আবার মনে বুঝি না এই,
বস্তু বলে কিছুই তো নেই
বিশ্ব গড়া যা খুশি তাই দিয়ে।
প্রথম যেদিন এসেছিলেম
নবীন পৃথ্বীতলে
রবির আলোয় জীবন মেলে দিয়ে,
সে যেন কোন্ জগৎ-জোড়া
ছেলেখেলার ছলে,
কোথাত্থেকে কেই বা জানে কী এ!
শিশির যেমন রাতে রাতে,
কে যে তারে লুকিয়ে গাঁথে,
ঝিল্লি বাজায় গোপন ঝিনিঝিনি।
ভোরবেলা যেই চেয়ে দেখি,
আলোর সঙ্গে আলোর এ কী
ইশারাতে চলছে চেনাচিনি।
সেদিন মনে জেনেছিলেম
নীল আকাশের পথে
ছুটির হাওয়ায় ঘুর লাগাল বুঝি!
যা-কিছু সব চলেছে ওই
ছেলেখেলার রথে
যে-যার আপন দোসর খুঁজি খুঁজি।
গাছে খেলা ফুল-ভরানো
ফুলে খেলা ফল-ধরানো,
ফলের খেলা অঙ্কুরে অঙ্কুরে।
স্থলের খেলা জলের কোলে,
জলের খেলা হাওয়ার দোলে,
হাওয়ার খেলা আপন বাঁশির সুরে।
ছেলের সঙ্গে আছ তুমি
নিত্য ছেলেমানুষ,
নিয়ে তোমার মালমসলার ঝুলি।
আকাশেতে ওড়াও তোমার
কতরকম ফানুস
মেঘে বোলাও রঙ-বেরঙের তুলি।
সেদিন আমি আপন মনে
ফিরেছিলেম তোমার সনে,
খেলেছিলেম হাত মিলিয়ে হাতে।
ভাসিয়েছিলেম রাশি রাশি
কথায় গাঁথা কান্নাহাসি
তোমারই সব ভাসান-খেলার সাথে।
ঋতুর তরী বোঝাই কর
রঙিন ফুলে ফুলে,
কালের স্রোতে যায় তারা সব ভেসে।
আবার তারা ঘাটে লাগে
হাওয়ায় দুলে দুলে
এই ধরণীর কূলে কূলে এসে।
মিলিয়েছিলেম বিশ্ব-ডালায়
তোমার ফুলে আমার মালায়
সাজিয়েছিলেম ঋতুর তরণীতে,
আশা আমার আছে মনে
বকুল কেয়া শিউলি -সনে
ফিরে ফিরে আসবে ধরণীতে।
সেদিন যখন গান গেয়েছি
আপন মনে নিজে,
বিনা কাজে দিন গিয়েছে চলে,
তখন আমি চোখে তোমার
হাসি দেখেছি যে,
চিনেছিলে আমায় সাথি বলে।
তোমার ধুলো তোমার আলো
আমার মনে লাগত ভালো,
শুনেছিলেম উদাস-করা বাঁশি।
বুঝেছিলে সে-ফাল্গুনে
আমার সে-গান শুনে শুনে
তোমারও গান আমি ভালোবাসি।
দিন গেল ঐ মাঠে বাটে,
আঁধার নেমে প’ল;
এপার থেকে বিদায় মেলে যদি
তবে তোমার সন্ধেবেলার
খেয়াতে পাল তোলো,
পার হব এই হাটের ঘাটের নদী।
আবার ওগো শিশুর সাথি,
শিশুর ভুবন দাও তো পাতি,
করব খেলা তোমায় আমায় একা।
চেয়ে তোমার মুখের দিকে
তোমায়, তোমার জগৎটিকে
সহজ চোখে দেখব সহজ দেখা।
সংশয়ী
কোথায় যেতে ইচ্ছে করে
শুধাস কি মা , তাই ?
যেখান থেকে এসেছিলেম
সেথায় যেতে চাই ।
কিন্তু সে যে কোন্ জায়গা
ভাবি অনেকবার ।
মনে আমার পড়ে না তো
একটুখানি তার ।
ভাবনা আমার দেখে বাবা
বললে সেদিন হেসে ,
‘ সে – জায়গাটি মেঘের পারে
সন্ধ্যাতারার দেশে । ‘
তুমি বল , ‘ সে – দেশখানি
মাটির নিচে আছে ,
যেখান থেকে ছাড়া পেয়ে
ফুল ফোটে সব গাছে । ‘
মাসি বলে , ‘ সে – দেশ আমার
আছে সাগরতলে ,
যেখানেতে আঁধার ঘরে
লুকিয়ে মানিক জ্বলে । ‘
দাদা আমার চুল টেনে দেয় ,
বলে , ‘ বোকা ওরে ,
হাওয়ায় সে – দেশ মিলিয়ে আছে
দেখবি কেমন করে ?’
আমি শুনে ভাবি , আছে
সকল জায়গাতেই ।
সিধু মাস্টার বলে শুধু
‘ কোনোখানেই নেই । ‘
সময়হারা
যত ঘণ্টা , যত মিনিট , সময় আছে যত
শেষ যদি হয় চিরকালের মতো ,
তখন স্কুলে নেই বা গেলেম ; কেউ যদি কয় মন্দ ,
আমি বলব , ‘ দশটা বাজাই বন্ধ । ‘
তাধিন তাধিন তাধিন ।
শুই নে বলে রাগিস যদি , আমি বলব তোরে ,
‘ রাত না হলে রাত হবে কী করে ।
নটা বাজাই থামল যখন , কেমন করে শুই ?
দেরি বলে নেই তো মা কিচ্ছুই । ‘
তাধিন তাধিন তাধিন ।
যত জানিস রূপকথা , মা , সব যদি যাস বলে
রাত হবে না , রাত যাবে না চলে ;
সময় যদি ফুরোয় তবে ফুরোয় না তো খেলা ,
ফুরোয় না তো গল্প বলার বেলা ।
তাধিন তাধিন তাধিন ।
সাত সমুদ্র পারে
দেখছ না কি , নীল মেঘে আজ
আকাশ অন্ধকার ।
সাত সমুদ্র তেরো নদী
আজকে হব পার ।
নাই গোবিন্দ , নাই মুকুন্দ ,
নাইকো হরিশ খোঁড়া ।
তাই ভাবি যে কাকে আমি
করব আমার ঘোড়া ।
কাগজ ছিঁড়ে এনেছি এই
বাবার খাতা থেকে ,
নৌকো দে – না বানিয়ে , অমনি
দিস , মা , ছবি এঁকে ।
রাগ করবেন বাবা বুঝি
দিল্লি থেকে ফিরে ?
ততক্ষণ যে চলে যাব
সাত সমুদ্র তীরে ।
এমনি কি তোর কাজ আছে , মা ,
কাজ তো রোজই থাকে ।
বাবার চিঠি এক্খুনি কি
দিতেই হবে ডাকে ?
নাই বা চিঠি ডাকে দিলে
আমার কথা রাখো ,
আজকে না হয় বাবার চিঠি
মাসি লিখুন – নাকো !
আমার এ যে দরকারি কাজ
বুঝতে পার না কি ?
দেরি হলেই একেবারে
সব যে হবে ফাঁকি ।
মেঘ কেটে যেই রোদ উঠবে
বৃষ্টি বন্ধ হলে ,
সাত সমুদ্র তেরো নদী
কোথায় যাবে চলে !