কেন গান শুনাই
এসো সখি , এসো মোর কাছে ,
কথা এক শুধাবার আছে!
চেয়ে তব মুখপানে বসে এই ঠাঁই —
প্রতিদিন যত গান তোমারে শুনাই ,
বুঝিতে কি পার সখি কেন যে তা গাই ?
শুধু কি তা পশে কানে ? কথাগুলি তার
কোথা হতে উঠিতেছে ভাবো একবার ?
বুঝ না কি হৃদয়ের
কোন্খানে শেল ফুটে
তবে প্রতি কথাগুলি
আর্তনাদ করি উঠে!
যখন নয়নে উঠে বিন্দু অশ্রুজল ,
তখন কি তাই তুই দেখিস কেবল ?
দেখ না কি কী সমুদ্র হৃদয়েতে উথলিছে ,
শুধু কণামাত্র তার আঁখিপ্রান্তে বিগলিছে!
যখন একটি শুধু উঠে রে নিশ্বাস ,
তখন কি তাই শুধু শুনিবারে পাস ?
শুনিস না কী ঝটিকা হৃদয়ে বেড়ায় ছুটে
একটি উচ্ছ্বাস শুধু বাহিরেতে ফুটে!
যে কথাটি বলি আমি শোনো শুধু তাই ?
শোনো না কি যত কথা বলা হইল না ?
যত কথা বলিবারে চাই ?
আমি কি শুনাই গান
ভালো মন্দ করিতে বিচার ?
যবে এ নয়ন হতে বহে অশ্রুধার —
শুধু কি রে দেখিবি তখন
সে অশ্রু উজ্জ্বল কি না হীরার মতন ?
আমার এ গান তোরে যখন শুনাই
নিন্দা বা প্রশংসা আমি কিছু নাহি চাই —
যে হৃদি দিয়েছি তোরে
তাই তোরে দেখাবারে চাই ,
তারি ভাষা বুঝাবারে চাই ,
তারি ব্যথা জানাবারে চাই ,
আর কিবা চাই ?
সেই হৃদি দেখিলি যখন ,
তারি ভাষা বুঝিলি যখন ,
তারি ব্যথা জানিলি যখন
তখন একটি বিন্দু অশ্রুবারি চাই!
(আর কিবা চাই! )
আয় সখি কাছে মোর আয় ,
কথা এক শুধাব তোমায় —
এত গান শুনালেম এত অনুরাগে
কথা তার বুকে কি লো লাগে ?
একটি নিশ্বাস কি লো জাগে ?
কথা শুধু শুনিয়া কি যাস ?
ভালো মন্দ বুঝিস কেবল ?
প্রাণের ভিতর হতে
উঠে না একটি অশ্রুজল ?
গান আরম্ভ
চারি দিকে খেলিতেছে মেঘ ,
বায়ু আসি করিছে চুম্বন —
সীমাহারা নভস্তল দুই বাহু পসারিয়া
হৃদয়ে করিছে আলিঙ্গন ।
অনন্ত এ আকাশের কোলে
টলমল মেঘের মাঝার
এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর
তোর তরে কবিতা আমার !
যবে আমি আসিব হেথায়
মন্ত্র পড়ি ডাকিব তোমায় ।
বাতাসে উড়িবে তোর বাস ,
ছড়ায়ে পড়িবে কেশপাশ ,
ঈষৎ মেলিয়া আঁখি – পাতা
মৃদু হাসি পড়িবে ফুটিয়া —
হৃদয়ের মৃদুল কিরণ
অধরেতে পড়িবে লুটিয়া ।
এলো থেলো কেশপাশ লয়ে
বসে বসে , খেলিবি হেথায় ,
উষার অলক দুলাইয়া
সমীরণ যেমন খেলায় ।
চুমিয়া চুমিয়া ফুটাইব
আধোফোটা হাসির কুসুম ,
মুখ লয়ে বুকের মাঝারে
গান গেয়ে পাড়াইব ঘুম ।
কৌতুকে করিয়া কোলাকুলি
আসিবে মেঘের শিশুগুলি ,
ঘিরিয়া দাঁড়াবে তারা সবে
অবাক হইয়া চেয়ে রবে ।
মেঘ হতে নেমে ধীরে ধীরে
আয় লো কবিতা , মোর বামে —
চম্পক – অঙ্গুলি দুটি দিয়ে
অন্ধকার ধীরে সরাইয়ে
যেমন করিয়া উষা নামে ।
বায়ু হতে আয় লো কবিতা ,
আসিয়া বসিবি মোর পাশে —
কে জানে , বনের কোথা হতে
ভেসে ভেসে সমীরণস্রোতে
সৌরভ যেমন করে আসে ।
হৃদয়ের অন্তঃপুর হতে
বধূ মোর , ধীরে ধীরে আয় —
ভীরু প্রেম যেমন করিয়া
ধীরে উঠে হৃদয় ধরিয়া ,
বঁধুর পায়ের কাছে গিয়ে
অমনি মুরছি পড়ে যায় ।
অথবা শিথিল কলেবরে
এসো তুমি , বোসো মোর পাশে —
মরণ যেমন করে আসে ,
শিশির যেমন করে ঝরে ,
পশ্চিমের আঁধারসাগরে
তারাটি যেমন করে যায়
অতি ধীরে মৃদু হেসে সিঁদুর সীমান্তদেশে ?
দিবা সে যেমন করে আসে
মরিবারে স্বামীর চিতায়
পশ্চিমের জ্বলন্ত শিখায় ।
পরবাসী ক্ষীণ – আয়ু একটি মুমূর্ষু বায়ু
শেষ কথা বলিতে বলিতে
তখনি যেমন মরে যায়
তেমনি , তেমনি করে এসো —
কবিতা রে , বধূটি আমার ,
দুটি শুধু পড়িবে নিশ্বাস ,
দুটি শুধু বাহিরিবে বাণী ,
বাহু দুটি হৃদয়ে জড়ায়ে
মরমে রাখিব মুখখানি ।
গান-সমাপন
জনমিয়া এ সংসারে কিছুই শিখি নি আর ,
শুধু গাই গান ।
স্নেহময়ী মার কাছে শৈশবে শিখিয়াছিনু ।
দু – একটি তান ।
শুধু জানি তাই ,
দিবানিশি তাই শুধু গাই ।
শতছিদ্রময় এই হৃদয় – বাঁশিটি লয়ে ।
বাজাই সতত —
দূঃখের কঠোর স্বর রাগিনী হইয়া যায় ,
মৃদুূল নিশ্বাসে পরিণত ।
আঁধার জলদ যেন ইন্দ্রধনু হয়ে যায় ।
ভুলে যাই সকল যাতনা ।
ভালো যদি না লাগে সে গান
ভালো সখা , তাও গাহিব না ।
এমন পণ্ডিত কত রয়েছেন শত শত
এ সংসারতলে ,
আকাশের দৈত্যবালা উন্মাদিনী চপলারে
বেঁধে রাখে দাসত্বের লোহার শিকলে ।
আকাশ ধরিয়া হাতে নক্ষত্র – অক্ষর দেখি
গ্রন্থ পাঠ করিছেন তাঁরা ,
জ্ঞা নের বন্ধন যত ছিন্ন করে দিতেছেন
ভাঙি ফেলি অতীতের কারা ।
আমি তার কিছুই করি না ,
আমি তার কিছুই জানি না ।
এমন মহান্ এ সংসারে
জ্ঞা নরত্নরাশির মাঝারে
আমি দীন শুধু গান গাই ,
তোমাদের মুখপানে চাই ।
ভালো যদি না লাগে সে গান
ভালো সখা , তাও গাহিব না ।
বড়ো ভয় হয় , পাছে কেহই না দেখে তারে
যে জন কিছুই শেখে নাই ।
ওগো সখা , ভয়ে ভয়ে তাই
যাহা জানি সেই গান গাই ,
তোমাদের মুখপানে চাই ।
শ্রান্ত দেহ হীনবল , নয়নে পড়িছে জল ,
রক্ত ঝরে চরণে আমার ,
নিশ্বাস বহিছে বেগে , হৃদয় – বাঁশিটি মম
বাজে না বাজে না বুঝি আর ।
দিন গেল , সন্ধ্যা গেল , কেহ দেখিলে না চেয়ে ।
যত গান গাই ।
বুঝি কারো অবসর নাই ।
বুঝি কারো ভালো নাহি লাগে —
ভালো সখা , আর গাহিব না ।