বহুদিন দেখি নাই তারে ,
আসে নি এ হৃদয় – মাঝারে ।
মনে করি মনে আনি তার সেই মুখখানি ,
ভালো করে মনে পড়িছে না ।
হৃদয়ে যে ছবি ছিল ধুলায় মলিন হল ,
আর তাহা নাহি যায় চেনা ।
ভুলে গেছি কী খেলা খেলিত ,
ভুলে গেছি কী কথা বলিত ।
যে গান গাহিত সদা সুর তার মনে আছে ,
কথা তার নাহি পড়ে মনে ।
যে আশা হৃদয়ে লয়ে উড়িত সে মেঘ চেয়ে
আর তাহা পড়ে না স্মরণে ।
শুধু যবে হৃদি-মাঝে চাই
মনে পড়ে — কী ছিল , কী নাই ।
আশার নৈরাশ্য
ওরে আশা , কেন তোর হেন দীনবেশ !
নিরাশারই মতো যেন বিষণ্ন বদন কেন —
যেন অতি সংগোপনে
যেন অতি সন্তর্পণে
অতি ভয়ে ভয়ে প্রাণে করিস প্রবেশ ।
ফিরিবি কি প্রবেশিবি ভাবিয়া না পাস ,
কেন , আশা , কেন তোর কিসের তরাস ।
আজ আসিয়াছ দিতে যে সুখ – আশ্বাস ,
নিজে তাহা কর না বিশ্বাস ,
তাই হেন মৃদু গতি ,
তাই উঠিতেছে ধীরে দুখের নিশ্বাস ।
বসিয়া মরমস্থলে কহিছ চোখের জলে —
“ বুঝি হেন দিন রহিবে না ,
আজ যাবে , আসিবে তো কাল ,
দুঃখ যাবে , ঘুচিবে যাতনা । ”
কেন , আশা , মোরে কেন হেন প্রতারণা ।
দুঃখক্লেশে আমি কি ডরাই ,
আমি কি তাদেব চিনি নাই ।
তারা সবে আমারি কি নয় ।
তবে , আশা , কেন এত ভয় ।
তবে কেন বসি মোর পাশ
মোরে , আশা , দিতেছ আশ্বাস ।
বলো , আশা , বসি মোর চিতে ,
“ আরো দুঃখ হইবে বহিতে ,
হৃদয়ের যে প্রদেশ হয়েছিল ভস্মশেষ
আর যারে হত না সহিতে ,
আবার নূতন প্রাণ পেয়ে
সেও পুন থাকিবে দহিতে ।
করিয়ো না ভয় ,
দুঃখ – জ্বালা আমারি কি নয় ?
তবে কেন হেন ম্লান মুখ
তবে কেন হেন দীন বেশ ?
তবে কেন এত ভয়ে ভয়ে
এ হৃদয়ে করিস প্রবেশ ?
উপহার
ভুলে গেছি কবে তুমি ছেলেবেলা একদিন
মরমের কাছে এসেছিলে ,
স্নেহময় ছায়াময় সন্ধ্যাসম আঁখি মেলি
একবার বুঝি হেসেছিলে ।
বুঝি গো সন্ধ্যার কাছে শিখেছে সন্ধ্যার মায়া
ওই আঁখি দুটি —
চাহিলে হৃদয়পানে মরমেতে পড়ে ছায়া ,
তারা উঠে ফুটি ।
আগে কে জানিত বলো কত কী লুকানো ছিল
হৃদয়নিভৃতে ,
তোমার নয়ন দিয়া আমার নিজের হিয়া
পাইনু দেখিতে ।
কখনো গাও নি তুমি কেবল নীরবে রহি
শিখায়েছ গান —
স্ববপ্নময় শান্তিময় পূরবীরাগিনী – তানে
বাঁধিয়াছ প্রাণ ।
আকাশের পানে চাই , সেই সুরে গান গাই
একেলা বসিয়া ।
একে একে সুরগুলি , অনন্তে হারায়ে যায়
আঁধারে পশিয়া ।
বলো দেখি কতদিন
আস নি এ শূন্য প্রাণে ।
বলো দেখি কতদিন
চাও নি হৃদয়পানে ,
বলো দেখি কতদিন
শোনো নি এ মোর গান —
তবে সখী গান – গাওয়া
হল বুঝি অবসান ।
যে রাগ শিখায়েছিলে সে কি আমি গেছি ভুলে ?
তার সাথে মিলিছে না সুর ?
তাই কি আস না প্রাণে , তাই কি শোন না গান —
তাই সখী , রয়েছ কি দূর ?
ভালো সখী , আবার শিখাও ,
আরবার মুখপানে চাও ,
একবার ফেলো অশ্রুজল ,
আঁখিপানে দুটি আঁখি তুলি ।
তা হলে পুরানো সুর আবার পড়িবে মনে ,
আর কভু যাইব না ভুলি ।
সেই পুরাতন চোখে মাঝে মাঝে চেয়ো সখী ,
উজলিয়া স্মৃতির মন্দির ।
এই পুরাতন প্রাণে মাঝে মাঝে এসো সখী ,
শূন্য আছে প্রাণের কুটির ।
নহিলে আঁধার মেঘরাশি
হৃদয়ের আলোক নিবাবে ,
একে একে ভুলে যাব সুর ,
গান গাওয়া সাঙ্গ হয়ে যাবে ।
কেন গান গাই
গুরুভার মন লয়ে কত বা বেড়াবি বয়ে ?
এমন কি কেহ তোর নাই ,
যাহার হৃদয়- ‘ পরে মিলিবে মুহূর্ত তরে
হৃদয়টি রাখিবার ঠাঁই ?
‘ কেহ না , কেহ না! ‘
সংসারে যে দিকে ফিরে চাই
এমন কি কেহ তোর নাই —
তোর দিন শেষ হলে , স্মৃতিখানি লয়ে কোলে ,
শোয়াইয়া বিষাদের কোমল শয়নে ,
বিমল শিশির-মাখা প্রেম-ফুলে দিয়ে ঢাকা
চেয়ে রবে আনত নয়নে ?
হৃদয়েতে রেখে দিবে তুলে ,
প্রতিদিন ঢেকে দিবে ফুলে ,
মনোমাঝে প্রবেশিয়ে বিন্দু বিন্দু অশ্রু দিয়ে
বৃন্ত-ছিন্ন প্রেম-ফুলগুলি
রাখিবেক জিয়াইয়া তুলি ?
এমন কি কেহ তোর নাই ?
‘ কেহ না , কেহ না! ‘
প্রাণ তুই খুলে দিলি ভালোবাসা বিলাইলি
কেহ তাহা তুলে না লইল ,
ভূমিতলে পড়িয়া রহিল ;
ভালোবাসা কেন দিলি তবে
কেহ যদি কুড়ায়ে না লবে ?
কেন সখা কেন ?
‘ জানি না , জানি না! ‘
বিজনে বনের মাঝে ফুল এক আছে ফুটে
শুধাইতে গেনু তার কাছে ,
‘ ফুল , তুই এ আঁধারে পরিমল দিস কারে ,
এ কাননে কে বা তোর আছে!
যখন পড়িবি তুই ঝরে ,
শুকাইয়া দলগুলি ধূলিতে হইবে ধূলি ,
মনে কি করিবে কেহ তোরে!
তবে কেন পরিমল ঢেলে দিস অবিরল
ছোটো মনখানি ভ ‘ রে ভ ‘ রে ?
কেন , ফুল , কেন ?
সেও বলে , ‘ জানি না । জানি না! ‘
সখা , তুমি গান গাও কেন ?
কেহ যদি শুনিতে না চায় ?
ওই দেখো পথমাঝে যে যাহার নিজ কাজে
আপনার মনে চলে যায় ।
কেহ যদি শুনিতে না চায়
কেন তবে , কেন গাও গান ,
আকাশে ঢালিয়া দাও প্রাণ ?
গান তব ফুরাইবে যবে ,
রাগিণী কারো কি মনে রবে ?
বাতাসেতে স্বরধার খেলিয়াছে অনিবার ,
বাতাসে সমাধি তার হবে ।
কাহারো মনেও নাহি রবে ,
কেন সখা গান গাও তবে ?
কেন , সখা , কেন ?
‘জানি না , জানি না!’
বিজন তরুর শাখে একাকি পাখিটি ডাকে ,
শুধাইতে গেনু তার কাছে ,
‘ পাখি তুই এ আঁধারে গান শুনাইবি কারে ?
এ কাননে কে বা তোর আছে!
যখনি ফুরাবে তোর প্রাণ ,
যখনি থামিবে তোর গান ,
বন ছিল যেমন নীরবে ,
তেমনি নীরব পুন হবে ।
যেমনি থামিবে গীত , অমনি সে সচকিত
প্রতিধ্বনি আকাশে মিলাবে ,
তোর গান তোরি সাথে যাবে!
আকাশে ঢালিয়া দিয়া প্রাণ ,
তবে , পাখি , কেন গাস গান ?
কেন , পাখি , কেন ?
সেও বলে , ‘ জানি না , জানি না!