বাল্য দিয়ে যে-জীবনের
আরম্ভ হয় দিন
বাল্যে আবার হোক-না তাহা সারা।
জলে স্থলে সঙ্গ আবার
পাক-না বাঁধন-হীন,
ধুলায় ফিরে আসুক-না পথহারা।
সম্ভাবনার ডাঙা হতে
অসম্ভবের উতল স্রোতে
দিই-না পাড়ি স্বপন-তরী নিয়ে।
আবার মনে বুঝি না এই,
বস্তু বলে কিছুই তো নেই
বিশ্ব গড়া যা খুশি তাই দিয়ে।
প্রথম যেদিন এসেছিলেম
নবীন পৃথ্বীতলে
রবির আলোয় জীবন মেলে দিয়ে,
সে যেন কোন্ জগৎ-জোড়া
ছেলেখেলার ছলে,
কোথাত্থেকে কেই বা জানে কী এ!
শিশির যেমন রাতে রাতে,
কে যে তারে লুকিয়ে গাঁথে,
ঝিল্লি বাজায় গোপন ঝিনিঝিনি।
ভোরবেলা যেই চেয়ে দেখি,
আলোর সঙ্গে আলোর এ কী
ইশারাতে চলছে চেনাচিনি।
সেদিন মনে জেনেছিলেম
নীল আকাশের পথে
ছুটির হাওয়ায় ঘুর লাগাল বুঝি!
যা-কিছু সব চলেছে ওই
ছেলেখেলার রথে
যে-যার আপন দোসর খুঁজি খুঁজি।
গাছে খেলা ফুল-ভরানো
ফুলে খেলা ফল-ধরানো,
ফলের খেলা অঙ্কুরে অঙ্কুরে।
স্থলের খেলা জলের কোলে,
জলের খেলা হাওয়ার দোলে,
হাওয়ার খেলা আপন বাঁশির সুরে।
ছেলের সঙ্গে আছ তুমি
নিত্য ছেলেমানুষ,
নিয়ে তোমার মালমসলার ঝুলি।
আকাশেতে ওড়াও তোমার
কতরকম ফানুস
মেঘে বোলাও রঙ-বেরঙের তুলি।
সেদিন আমি আপন মনে
ফিরেছিলেম তোমার সনে,
খেলেছিলেম হাত মিলিয়ে হাতে।
ভাসিয়েছিলেম রাশি রাশি
কথায় গাঁথা কান্নাহাসি
তোমারই সব ভাসান-খেলার সাথে।
ঋতুর তরী বোঝাই কর
রঙিন ফুলে ফুলে,
কালের স্রোতে যায় তারা সব ভেসে।
আবার তারা ঘাটে লাগে
হাওয়ায় দুলে দুলে
এই ধরণীর কূলে কূলে এসে।
মিলিয়েছিলেম বিশ্ব-ডালায়
তোমার ফুলে আমার মালায়
সাজিয়েছিলেম ঋতুর তরণীতে,
আশা আমার আছে মনে
বকুল কেয়া শিউলি -সনে
ফিরে ফিরে আসবে ধরণীতে।
সেদিন যখন গান গেয়েছি
আপন মনে নিজে,
বিনা কাজে দিন গিয়েছে চলে,
তখন আমি চোখে তোমার
হাসি দেখেছি যে,
চিনেছিলে আমায় সাথি বলে।
তোমার ধুলো তোমার আলো
আমার মনে লাগত ভালো,
শুনেছিলেম উদাস-করা বাঁশি।
বুঝেছিলে সে-ফাল্গুনে
আমার সে-গান শুনে শুনে
তোমারও গান আমি ভালোবাসি।
দিন গেল ঐ মাঠে বাটে,
আঁধার নেমে প’ল;
এপার থেকে বিদায় মেলে যদি
তবে তোমার সন্ধেবেলার
খেয়াতে পাল তোলো,
পার হব এই হাটের ঘাটের নদী।
আবার ওগো শিশুর সাথি,
শিশুর ভুবন দাও তো পাতি,
করব খেলা তোমায় আমায় একা।
চেয়ে তোমার মুখের দিকে
তোমায়, তোমার জগৎটিকে
সহজ চোখে দেখব সহজ দেখা।
সংশয়ী
কোথায় যেতে ইচ্ছে করে
শুধাস কি মা , তাই ?
যেখান থেকে এসেছিলেম
সেথায় যেতে চাই ।
কিন্তু সে যে কোন্ জায়গা
ভাবি অনেকবার ।
মনে আমার পড়ে না তো
একটুখানি তার ।
ভাবনা আমার দেখে বাবা
বললে সেদিন হেসে ,
‘ সে – জায়গাটি মেঘের পারে
সন্ধ্যাতারার দেশে । ‘
তুমি বল , ‘ সে – দেশখানি
মাটির নিচে আছে ,
যেখান থেকে ছাড়া পেয়ে
ফুল ফোটে সব গাছে । ‘
মাসি বলে , ‘ সে – দেশ আমার
আছে সাগরতলে ,
যেখানেতে আঁধার ঘরে
লুকিয়ে মানিক জ্বলে । ‘
দাদা আমার চুল টেনে দেয় ,
বলে , ‘ বোকা ওরে ,
হাওয়ায় সে – দেশ মিলিয়ে আছে
দেখবি কেমন করে ?’
আমি শুনে ভাবি , আছে
সকল জায়গাতেই ।
সিধু মাস্টার বলে শুধু
‘ কোনোখানেই নেই । ‘
সময়হারা
যত ঘণ্টা , যত মিনিট , সময় আছে যত
শেষ যদি হয় চিরকালের মতো ,
তখন স্কুলে নেই বা গেলেম ; কেউ যদি কয় মন্দ ,
আমি বলব , ‘ দশটা বাজাই বন্ধ । ‘
তাধিন তাধিন তাধিন ।
শুই নে বলে রাগিস যদি , আমি বলব তোরে ,
‘ রাত না হলে রাত হবে কী করে ।
নটা বাজাই থামল যখন , কেমন করে শুই ?
দেরি বলে নেই তো মা কিচ্ছুই । ‘
তাধিন তাধিন তাধিন ।
যত জানিস রূপকথা , মা , সব যদি যাস বলে
রাত হবে না , রাত যাবে না চলে ;
সময় যদি ফুরোয় তবে ফুরোয় না তো খেলা ,
ফুরোয় না তো গল্প বলার বেলা ।
তাধিন তাধিন তাধিন ।
সাত সমুদ্র পারে
দেখছ না কি , নীল মেঘে আজ
আকাশ অন্ধকার ।
সাত সমুদ্র তেরো নদী
আজকে হব পার ।
নাই গোবিন্দ , নাই মুকুন্দ ,
নাইকো হরিশ খোঁড়া ।
তাই ভাবি যে কাকে আমি
করব আমার ঘোড়া ।
কাগজ ছিঁড়ে এনেছি এই
বাবার খাতা থেকে ,
নৌকো দে – না বানিয়ে , অমনি
দিস , মা , ছবি এঁকে ।
রাগ করবেন বাবা বুঝি
দিল্লি থেকে ফিরে ?
ততক্ষণ যে চলে যাব
সাত সমুদ্র তীরে ।
এমনি কি তোর কাজ আছে , মা ,
কাজ তো রোজই থাকে ।
বাবার চিঠি এক্খুনি কি
দিতেই হবে ডাকে ?
নাই বা চিঠি ডাকে দিলে
আমার কথা রাখো ,
আজকে না হয় বাবার চিঠি
মাসি লিখুন – নাকো !
আমার এ যে দরকারি কাজ
বুঝতে পার না কি ?
দেরি হলেই একেবারে
সব যে হবে ফাঁকি ।
মেঘ কেটে যেই রোদ উঠবে
বৃষ্টি বন্ধ হলে ,
সাত সমুদ্র তেরো নদী
কোথায় যাবে চলে !