- বইয়ের নামঃ শিশু
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ আশীর্বাদ প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অপযশ
বাছা রে, তোর চক্ষে কেন জল।
কে তোরে যে কী বলেছে
আমায় খুলে বল্।
লিখতে গিয়ে হাতে মুখে
মেখেছ সব কালি,
নোংরা ব ‘ লে তাই দিয়েছে গালি?
ছি ছি, উচিত এ কি।
পূর্ণশশী মাখে মসী—
নোংরা বলুক দেখি।
বাছা রে, তোর সবাই ধরে দোষ।
আমি দেখি সকল-তাতে
এদের অসন্তোষ।
খেলতে গিয়ে কাপড়খানা
ছিঁড়ে খুঁড়ে এলে
তাই কি বলে লক্ষ্মীছাড়া ছেলে।
ছি ছি, কেমন ধারা।
ছেঁড়া মেঘে প্রভাত হাসে,
সে কি লক্ষ্মীছাড়া।
কান দিয়ো না তোমায় কে কী বলে।
তোমার নামে অপবাদ যে
ক্রমেই বেড়ে চলে।
মিষ্টি তুমি ভালোবাস
তাই কি ঘরে পরে
লোভী বলে তোমার নিন্দে করে!
ছি ছি, হবে কী।
তোমায় যারা ভালোবাসে
তারা তবে কী।
অস্তসখী
রজনী একাদশী
পোহায় ধীরে ধীরে,
রঙিন মেঘমালা
উষারে বাঁধে ঘিরে।
আকাশে ক্ষীণ শশী
আড়ালে যেতে চায়,
দাঁড়ায়ে মাঝখানে
কিনারা নাহি পায়।
এ-হেন কালে যেন
মায়ের পানে মেয়ে
রয়েছে শুকতারা
চাঁদের মুখে চেয়ে।
কে তুমি মরি মরি
একটুখানি প্রাণ।
এনেছ কী না জানি
করিতে ওরে দান।
মহিমা যত ছিল
উদয়-বেলাকার
যতেক সুখসাথি
এখনি যাবে যার,
পুরানো সব গেল—
নূতন তুমি একা
বিদায়-কালে তারে
হাসিয়া দিলে দেখা।
ও চাঁদ যামিনীর
হাসির অবশেষ,
ও শুধু অতীতের
সুখের স্মৃতিলেশ।
তারারা দ্রুতপদে
কোথায় গেছে সরে—
পারে নি সাথে যেতে,
পিছিয়ে আছে পড়ে।
তাদেরই পানে ও যে
নয়ন ছিল মেলি,
তাদেরই পথে ও যে
চরণ ছিল ফেলি,
এমন সময়ে কে
ডাকিলে পিছু-পানে
একটি আলোকেরই
একটু মৃদু গানে।
গভীর রজনীর
রিক্ত ভিখারিকে
ভোরের বেলাকার
কী লিপি দিলে লিখে।
সোনার-আভা-মাখা
কী নব আশাখানি
শিশির-জলে ধুয়ে
তাহারে দিলে আনি।
অস্ত-উদয়ের
মাঝেতে তুমি এসে
প্রাচীন নবীনেরে
টানিছ ভালোবেসে—
বধূ ও বর-রূপে
করিলে এক-হিয়া
করুণ কিরণের
গ্রন্থি বাঁধি দিয়া।
আকুল আহ্বান
সন্ধে হল, গৃহ অন্ধকার—
মা গো, হেথায় প্রদীপ জ্বলে না।
একে একে সবাই ঘরে এল,
আমায় যে মা, ‘মা’ কেউ বলে না।
সময় হল, বেঁধে দেব চুল,
পরিয়ে দেব রাঙা কাপড়খানি।
সাঁঝের তারা সাঁঝের গগনে—
কোথায় গেল রানী আমার রানী।
রাত্রি হল, আঁধার করে আসে,
ঘরে ঘরে প্রদীপ নিবে যায়।
আমার ঘরে ঘুম নেইকো শুধু—
শূন্য শেজ শূন্য-পানে চায়।
কোথায় দুটি নয়ন ঘুমে-ভরা,
নেতিয়ে-পড়া ঘুমিয়ে-পড়া মেয়ে।
শ্রান্ত দেহ ঢুলে পড়ে, তবু
মায়ের তরে আছে বুঝি চেয়ে।
আঁধার রাতে চলে গেলি তুই,
আঁধার রাতে চুপি চুপি আয়।
কেউ তো তোরে দেখতে পাবে না,
তারা শুধু তারার পানে চায়।
এ জগৎ কঠিন— কঠিন—
কঠিন, শুধু মায়ের প্রাণ ছাড়া—
সেইখানে তুই আয় মা, ফিরে আয়—
এত ডাকি, দিবি নে কি সাড়া।
ফুলের দিনে সে যে চলে গেল,
ফুল-ফোটা সে দেখে গেল না,
ফুলে ফুলে ভরে গেল বন
একটি সে তো পরতে পেল না।
ফুল সে ফোটে ফুল যে ঝরে যায়—
ফুল নিয়ে যে আর-সকলে পরে,
ফিরে এসে সে যদি দাঁড়ায়,
একটিও যে রইবে না তার তরে।
খেলত যারা তারা খেলতে গেছে,
হাসত যারা তারা আজো হাসে,
তার তরে তো কেহই বসে নেই,
মা যে কেবল রয়েছে তার আশে।
হায় রে বিধি, সব কি ব্যর্থ হবে—
ব্যর্থ হবে মায়ের ভালোবাসা।
কত জনের কত আশা পূরে,
ব্যর্থ হবে মার প্রাণেরই আশা।
আশীর্বাদ
ইহাদের করো আশীর্বাদ।
ধরায় উঠেছে ফুটি শুভ্র প্রাণগুলি,
নন্দনের এনেছে সম্বাদ,
ইহাদের করো আশীর্বাদ।
ছোটো ছোটো হাসিমুখ জানে না ধরার দুখ,
হেসে আসে তোমাদের দ্বারে।
নবীন নয়ন তুলিকৌতুকেতে দুলি দুলি
চেয়ে চেয়ে দেখে চারি ধারে।
সোনার রবির আলো কত তার লাগে ভালো,
ভালো লাগে মায়ের বদন।
হেথায় এসেছে ভুলি, ধুলিরে জানে না ধূলি,
সবই তার আপনার ধন।
কোলে তুলে লও এরে— এ যেন কেঁদে না ফেরে,
হরষেতে না ঘটে বিষাদ।
বুকের মাঝারে নিয়ে পরিপূর্ণ প্রাণ দিয়ে
ইহাদের করো আশীর্বাদ।
নূতন প্রবাসে এসে সহস্র পথের দেশে
নীরবে চাহিছে চারি ভিতে।
এত শত লোক আছে, এসেছে তোমারি কাছে
সংসারের পথ শুধাইতে।
যেথা তুমি লয়ে যাবে কথাটি না কয়ে যাবে,
সাথে যাবে ছায়ার মতন,
তাই বলি, দেখো দেখো, এ বিশ্বাস রেখো রেখো,
পাথারে দিয়ো না বিসর্জন।
ক্ষুদ্র এ মাথার ‘পর রাখো গো করুণ কর,
ইহারে কোরো না অবহেলা।
এ ঘোর সংসার-মাঝে এসেছে কঠিন কাজে,
আসে নি করিতে শুধু খেলা।
দেখে মুখশতদল চোখে মোর আসে জল,
মনে হয় বাঁচিবে না বুঝি—
পাছে সুকুমার প্রাণ ছিঁড়ে হয় খান্-খান্
জীবনের পারাবারে বুঝি।
এই হাসিমুখগুলি হাসি পাছে যায় ভুলি,
পাছে ঘেরে আঁধার প্রমাদ!
উহাদের কাছে ডেকে বুকে রেখে কোলে রেখে
তোমরা করো গো আশীর্বাদ।
বলো, ‘সুখে যাও চ ‘ লে ভবের তরঙ্গ দ’লে,
স্বর্গ হতে আসুক বাতাস।
সুখদুঃখ কোরো হেলা, সে কেবল ঢেউ-খেলা
নাচিবে তোদের চারি পাশ।
উপহার
স্নেহ-উপহার এনে দিতে চাই,
কী যে দেব তাই ভাবনা—
যত দিতে সাধ করি মনে মনে
খুঁজে – পেতে সে তো পাব না।
আমার যা ছিল ফাঁকি দিয়ে নিতে
সবাই করেছে একতা,
বাকি যে এখন আছে কত ধন
না তোলাই ভালো সে কথা।
সোনা রুপো আর হীরে জহরত
পোঁতা ছিল সব মাটিতে,
জহরি যে যত সন্ধান পেয়ে
নে গেছে যে যার বাটীতে।
টাকাকড়ি মেলা আছে টাকশালে,
নিতে গেলে পড়ি বিপদে।
বসনভূষণ আছে সিন্দুকে,
পাহারাও আছে ফি পদে।
এ যে সংসারে আছি মোরা সবে
এ বড়ো বিষম দেশ রে।
ফাঁকিফুঁকি দিয়ে দূরে চ ‘ লে গিয়ে
ভুলে গিয়ে সব শেষ রে।
ভয়ে ভয়ে তাই স্মরণচিহ্ন
যে যাহারে পারে দেয় যে।
তাও কত থাকে, কত ভেঙে যায়,
কত মিছে হয় ব্যয় যে।
স্নেহ যদি কাছে রেখে যাওয়া যেত,
চোখে যদি দেখা যেত রে,
কতগুলো তবে জিনিস-পত্র
বল্ দেখি দিত কে তোরে।
তাই ভাবি মনে কী ধন আমার
দিয়ে যাব তোরে নুকিয়ে,
খুশি হবি তুই, খুশি হব আমি,
বাস্, সব যাবে চুকিয়ে।
কিছু দিয়ে-থুয়ে চিরদিন-তরে
কিনে রেখে দেব মন তোর—
এমন আমার মন্ত্রণা নেই,
জানি নে ও হেন মন্তর।
নবীন জীবন, বহুদূর পথ
পড়ে আছে তোর সুমুখে;
স্নেহরস মোরা যেটুকু যা দিই
পিয়ে নিস এক চুমুকে।
সাথিদলে জুটে চলে যাস ছুটে
নব আশে নব পিয়াসে,
যদি ভুলে যাস, সময় না পাস,
কী যায় তাহাতে কী আসে।
মনে রাখিবার চির-অবকাশ
থাকে আমাদেরই বয়সে,
বাহিরেতে যার না পাই নাগাল
অন্তরে জেগে রয় সে।
পাষাণের বাধা ঠেলেঠুলে নদী
আপনার মনে সিধে সে
কলগান গেয়ে দুই তীর বেয়ে
যায় চলে দেশ-বিদেশে—
যার কোল হতে ঝরনার স্রোতে
এসেছে আদরে গলিয়া
তারে ছেড়ে দূরে যায় দিনে দিনে
অজানা সাগরে চলিয়া।
অচল শিখর ছোটো নদীটিরে
চিরদিন রাখে স্মরণে—
যতদূর যায় স্নেহধারা তার
সাথে যায় দ্রুতচরণে।
তেমনি তুমিও থাক না’ই থাক,
মনে কর মনে কর না,
পিছে পিছে তব চলিবে ঝরিয়া
আমার আশিস-ঝরনা।।
কাগজের নৌকা
ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে
কাগজ-নৌকাখানি।
লিখে রাখি তাতে আপনার নাম
লিখি আমাদের বাড়ি কোন্ গ্রাম
বড়ো বড়ো করে মোটা অক্ষরে,
যতনে লাইন টানি।
যদি সে নৌকা আর-কোনো দেশে
আর-কারো হাতে পড়ে গিয়ে শেষে
আমার লিখন পড়িয়া তখন
বুঝিবে সে অনুমানি
কার কাছ হতে ভেসে এল স্রোতে
কাগজ-নৌকাখানি।
আমার নৌকা সাজাই যতনে
শিউলি বকুলে ভরি।
বাড়ির বাগানে গাছের তলায়
ছেয়ে থাকে ফুল সকালবেলায়,
শিশিরের জল করে ঝলমল
প্রভাতের আলো পড়ি।
সেই কুসুমের অতি ছোটো বোঝা
কোন্ দিক-পানে চলে যায় সোজা,
বেলাশেষে যদি পার হয়ে নদী
ঠেকে কোনোখানে যেয়ে—
প্রভাতের ফুল সাঁঝে পাবে কূল
কাগজের তরী বেয়ে।
আমার নৌকা ভাসাইয়া জলে
চেয়ে থাকি বসি তীরে।
ছোটো ছোটো ঢেউ ওঠে আর পড়ে,
রবির কিরণে ঝিকিমিকি করে,
আকাশেতে পাখি চলে যায় ডাকি,
বায়ু বহে ধীরে ধীরে।
গগনের তলে মেঘ ভাসে কত
আমারি সে ছোটো নৌকার মতো—
কে ভাসালে তায়, কোথা ভেসে যায়,
কোন্ দেশে গিয়ে লাগে।
ওই মেঘ আর তরণী আমার
কে যাবে কাহার আগে।
বেলা হলে শেষে বাড়ি থেকে এসে
নিয়ে যায় মোরে টানি;
আমি ঘরে ফিরি, থাকি কোণে মিশি,
যেথা কাটে দিন সেথা কাটে নিশি—
কোথা কোন্ গাঁয় ভেসে চলে যায়
আমার নৌকাখানি।
কোন্ পথে যাবে কিছু নাই জানা,
কেহ তারে কভু নাহি করে মানা,
ধরে নাহি রাখে, ফিরে নাহি ডাকে—
ধায় নব নব দেশে।
কাগজের তরী, তারি ‘পরে চড়ি
মন যায় ভেসে ভেসে।
রাত হয়ে আসে, শুই বিছানায়,
মুখ ঢাকি দুই হাতে—
চোখ বুজে ভাবি— এমন আঁধার,
কালি দিয়ে ঢালা নদীর দু ধার
তারি মাঝখানে কোথায় কে জানে
নৌকা চলেছে রাতে।
আকাশের তারা মিটি-মিটি করে,
শিয়াল ডাকিছে প্রহরে প্রহরে,
তরীখানি বুঝি ঘর খুঁজি খুঁজি
তীরে তীরে ফিরে ভাসি।
ঘুম লয়ে সাথে চড়েছে তাহাতে
ঘুমপাড়ানিয়া মাসি।
কেন মধুর
রঙিন খেলেনা দিলে ও রাঙা হাতে
তখন বুঝি রে বাছা, কেন যে প্রাতে
এত রঙ খেলে মেঘে জলে রঙ ওঠে জেগে,
কেন এত রঙ লেগে ফুলের পাতে—
রাঙা খেলা দেখি যবে ও রাঙা হাতে।
গান গেয়ে তোরে আমি নাচাই যবে
আপন হৃদয়-মাঝে বুঝি রে তবে,
পাতায় পাতায় বনে ধ্বনি এত কী কারণে,
ঢেউ বহে নিজমনে তরল রবে,
বুঝি তা তোমারে গান শুনাই যবে।
যখন নবনী দিই লোলুপ করে
হাতে মুখে মেখেচুকে বেড়াও ঘরে,
তখন বুঝিতে পারি স্বাদু কেন নদীবারি,
ফল মধুরসে ভারী কিসের তরে,
যখন নবনী দিই লোলুপ করে।
যখন চুমিয়ে তোর বদনখানি
হাসিটি ফুটায়ে তুলি তখনি জানি
আকাশ কিসের সুখে আলো দেয় মোর মুখে,
বায়ু দিয়ে যায় বুকে অমৃত আনি—
বুঝি তা চুমিলে তোর বদনখানি।
খেলা
তোমার কটি – তটের ধটি
কে দিল রাঙিয়া ।
কোমল গায়ে দিল পরায়ে
রঙিন আঙিয়া ।
বিহানবেলা আঙিনাতলে
এসেছ তুমি কী খেলাছলে ,
চরণ দুটি চলিতে ছুটি
পড়িছে ভাঙিয়া ।
তোমার কটি – তটের ধটি
কে দিল রাঙিয়া ।
কিসের সুখে সহাস মুখে
নাচিছ বাছনি ,
দুয়ার – পাশে জননী হাসে
হেরিয়া নাচনি ।
তাথেই থেই তালির সাথে
কাঁকন বাজে মায়ের হাতে ,
রাখাল – বেশে ধরেছ হেসে
বেণুর পাঁচনি ।
কিসের সুখে সহাস মুখে
নাচিছ বাছনি ।
ভিখারি ওরে , অমন করে
শরম ভুলিয়া
মাগিস কী বা মায়ের গ্রীবা
আঁকড়ি ঝুলিয়া ।
ওরে রে লোভী , ভুবনখানি
গগন হতে উপাড়ি আনি
ভরিয়া দুটি ললিত মুঠি
দিব কি তুলিয়া ।
কী চাস ওরে অমন করে
শরম ভুলিয়া ।
নিখিল শোনে আকুল মনে
নূপুর – বাজনা ।
তপন শশী হেরিছে বসি
তোমার সাজনা।
ঘুমাও যবে মায়ের বুকে
আকাশ চেয়ে রহে ও মুখে ,
জাগিলে পরে প্রভাত করে
নয়ন – মাজনা ।
নিখিল শোনে আকুল মনে
নূপুর – বাজনা ।
ঘুমের বুড়ি আসিছে উড়ি
নয়ন – ঢুলানী ,
গায়ের ‘পরে কোমল করে
পরশ – বুলানী ।
মায়ের প্রাণে তোমারি লাগি
জগৎ – মাতা রয়েছে জাগি ,
ভুবন – মাঝে নিয়ত রাজে
ভুবন – ভুলানী ।
ঘুমের বুড়ি আসিছে উড়ি
নয়ন – ঢুলানী ।
খোকা
খোকার চোখে যে ঘুম আসে
সকল – তাপ – নাশা —
জান কি কেউ কোথা হতে যে
করে সে যাওয়া – আসা ।
শুনেছি রূপকথার গাঁয়ে
জোনাকি – জ্বলা বনের ছায়ে
দুলিছে দুটি পারুল – কুঁড়ি ,
তাহারি মাঝে বাসা —
সেখান থেকে খোকার চোখে
করে সে যাওয়া – আসা ।
খোকার ঠোঁটে যে হাসিখানি
চমকে ঘুমঘোরে —
কোন্ দেশে যে জনম তার
কে কবে তাহা মোরে ।
শুনেছি কোন্ শরৎ – মেঘে
শিশু – শশীর কিরণ লেগে
সে হাসিরুচি জনমি ছিল
শিশিরশুচি ভোরে —
খোকার ঠোঁটে যে হাসিখানি
চমকে ঘুমঘোরে ।
খোকার গায়ে মিলিয়ে আছে
যে কচি কোমলতা —
জান কি সে যে এতটা কাল
লুকিয়ে ছিল কোথা ।
মা যবে ছিল কিশোরী মেয়ে
করুণ তারি পরান ছেয়ে
মাধুরীরূপে মুরছি ছিল
কহে নি কোনো কথা —
খোকার গায়ে মিলিয়ে আছে
যে কচি কোমলতা ।
আশিস আসি পরশ করে
খোকারে ঘিরে ঘিরে —
জান কি কেহ কোথা হতে সে
বরষে তার শিরে ।
ফাগুনে নব মলয়শ্বাসে ,
শ্রাবণে নব নীপের বাসে ,
আশিনে নব ধান্যদলে ,
আষাড়ে নব নীরে —
আশিস আসি পরশ করে
খোকারে ঘিরে ঘিরে ।
এই – যে খোকা তরুণতনু
নতুন মেলে আঁখি —
ইহার ভার কে লবে আজি
তোমরা জান তা কি ।
হিরণময় কিরণ – ঝোলা
যাঁহার এই ভুবন – দোলা
তপন – শশী – তারার কোলে
দেবেন এরে রাখি —
এই – যে খোকা তরুণতনু
নতুন মেলে আঁখি ।
খোকার রাজ্য
খোকার মনের ঠিক মাঝখানটিতে
আমি যদি পারি বাসা নিতে—
তবে আমি একবার
জগতের পানে তার
চেয়ে দেখি বসি সে নিভৃতে।
তার রবি শশী তারা
জানি নে কেমনধারা
সভা করে আকাশের তলে,
আমার খোকার সাথে
গোপনে দিবসে রাতে
শুনেছি তাদের কথা চলে।
শুনেছি আকাশ তারে
নামিয়া মাঠের পারে
লোভায় রঙিন ধনু হাতে,
আসি শালবন -‘ পরে
মেঘেরা মন্ত্রণা করে
খেলা করিবারে তার সাথে।
যারা আমাদের কাছে
নীরব গম্ভীর আছে,
আশার অতীত যারা সবে,
খোকারে তাহারা এসে
ধরা দিতে চায় হেসে
কত রঙে কত কলরবে।
খোকার মনের ঠিক মাঝখান ঘেঁষে
যে পথ গিয়েছে সৃষ্টিশেষে
সকল-উদ্দেশ-হারা
সকল-ভূগোল-ছাড়া
অপরূপ অসম্ভব দেশে—
যেথা আসে রাত্রিদিন
সর্ব-ইতিহাস-হীন
রাজার রাজত্ব হতে হাওয়া,
তারি যদি এক ধারে
পাই আমি বসিবারে
দেখি কারা করে আসা-যাওয়া।
তাহারা অদ্ভুত লোক,
নাই কারো দুঃখ শোক,
নেই তারা কোনো কর্মে কাজে,
চিন্তাহীন মৃত্যুহীন
চলিয়াছে চিরদিন
খোকাদের গল্পলোক-মাঝে।
সেথা ফুল গাছপালা
নাগকন্যা রাজবালা
যাহা খুশি তাই করে,
সত্যেরে কিছু না ডরে,
সংশয়েরে দিয়ে যায় ফাঁকি।
ঘুমচোরা
কে নিল খোকার ঘুম হরিয়া।
মা তখন জল নিতে ও পাড়ার দিঘিটিতে
গিয়াছিল ঘট কাঁখে করিয়া।—
তখন রোদের বেলা সবাই ছেড়েছে খেলা,
ও পারে নীরব চখা-চখীরা;
শালিক থেমেছে ঝোপে, শুধু পায়রার খোপে
বকাবকি করে সখা-সখীরা;
তখন রাখাল ছেলে পাঁচনি ধুলায় ফেলে
ঘুমিয়ে পড়েছে বটতলাতে;
বাঁশ-বাগানের ছায়ে এক-মনে এক পায়ে
খাড়া হয়ে আছে বক জলাতে।
সেই ফাঁকে ঘুমচোর ঘরেতে পশিয়া মোর
ঘুম নিয়ে উড়ে গেল গগনে,
মা এসে অবাক রয়, দেখে খোকা ঘর-ময়
হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে সঘনে।
আমার খোকার ঘুম নিল কে।
যেথা পাই সেই চোরে বাঁধিয়া আনিব ধরে,
সে লোক লুকাবে কোথা ত্রিলোকে।
যাব সে গুহার ছায়ে কালো পাথরের গায়ে
কুলু কুলু বহে যেথা ঝরনা।
যাব সে বকুলবনে নিরিবিলি সে বিজনে
ঘুঘুরা করিছে ঘর-করনা।
যেখানে সে-বুড়া বট নামায়ে দিয়েছে জট,
ঝিল্লি ডাকিছে দিনে দুপুরে,
যেখানে বনের কাছে বনদেবতারা নাচে
চাঁদিনিতে রুনুঝুনু নূপুরে,
যাব আমি ভরা সাঁঝে সেই বেণুবন – মাঝে
আলো যেথা রোজ জ্বালে জোনাকি—
শুধাব মিনতি করে, ‘আমাদের ঘুমচোরে
তোমাদের আছে জানাশোনা কি। ‘
কে নিল খোকার ঘুম চুরায়ে।
কোনোমতে দেখা তার পাই যদি একবার
লই তবে সাধ মোর পুরায়ে।
দেখি তার বাসা খুঁজি কোথা ঘুম করে পুঁজি,
চোরা ধন রাখে কোন্ আড়ালে।
সব লুঠি লব তার, ভাবিতে হবে না আর
খোকার চোখের ঘুম হারালে
ডানা দুটি বেঁধে তারে নিয়ে যাব নদীপারে
সেখানে সে বসে এক কোণেতে
জলে শরকাঠি ফেলে মিছে মাছ-ধরা খেলে
দিন কাটাইবে কাশবনেতে।
যখন সাঁঝের বেলা ভাঙিবে হাটের মেলা
ছেলেরা মায়ের কোল ভরিবে,
সারা রাত টিটি-পাখি টিটকারি দিবে ডাকি—
‘ঘুমচোরা কার ঘুম হরিবে।
চাতুরী
আমার খোকা করে গো যদি মনে
এখনি উড়ে পারে সে যেতে
পারিজাতের বনে ।
যায় না সে কি সাধে।
মায়ের বুকে মাথাটি থুয়ে
সে ভালোবাসে থাকিতে শুয়ে,
মায়ের মুখ না দেখে যদি
পরান তার কাঁদে।
আমার খোকা সকল কথা জানে।
কিন্তু তার এমন ভাষা,
কে বোঝে তার মানে।
মৌন থাকে সাধে ?
মায়ের মুখে মায়ের কথা
শিখিতে তার কী আকুলতা,
তাকায় তাই বোবার মতো
মায়ের মুখচাঁদে।
খোকার ছিল রতনমণি কত—
তবু সে এল কোলের ‘পরে
ভিখারীটির মতো।
এমন দশা সাধে ?
দীনের মতো করিয়া ভান
কাড়িতে চাহে মায়ের প্রাণ,
তাই সে এল বসনহীন
সন্ন্যাসীর ছাঁদে।
খোকা যে ছিল বাঁধন-বাধা-হারা—
যেখানে জাগে নূতন চাঁদ
ঘুমায় শুকতারা।
ধরা সে দিল সাধে?
অমিয়মাখা কোমল বুকে
হারাতে চাহে অসীম সুখে,
মুকতি চেয়ে বাঁধন মিঠা
মায়ের মায়া-ফাঁদে।
আমার খোকা কাঁদিতে জানিত না,
হাসির দেশে করিত শুধু
সুখের আলোচনা ।
কাঁদিতে চাহে সাধে?
মধুমুখের হাসিটি দিয়া
টানে সে বটে মায়ের হিয়া,
কান্না দিয়ে ব্যথার ফাঁসে
দ্বিগুণ বলে বাঁধে।
ছুটির দিনে
ওই দেখো মা, আকাশ ছেয়ে
মিলিয়ে এল আলো,
আজকে আমার ছুটোছুটি
লাগল না আর ভালো।
ঘণ্টা বেজে গেল কখন,
অনেক হল বেলা।
তোমায় মনে পড়ে গেল,
ফেলে এলেম খেলা।
আজকে আমার ছুটি, আমার
শনিবারের ছুটি।
কাজ যা আছে সব রেখে আয়
মা তোর পায়ে লুটি।
দ্বারের কাছে এইখানে বোস,
এই হেথা চোকাঠ—
বল্ আমারে কোথায় আছে
তেপান্তরের মাঠ।
ওই দেখো মা, বর্ষা এল
ঘনঘটায় ঘিরে,
বিজুলি ধায় এঁকেবেঁকে
আকাশ চিরে চিরে।
দেব্তা যখন ডেকে ওঠে
থর্থরিয়ে কেঁপে
ভয় করতেই ভালোবাসি
তোমায় বুকে চেপে।
ঝুপ্ঝুপিয়ে বৃষ্টি যখন
বাঁশের বনে পড়ে
কথা শুনতে ভালোবাসি
বসে কোণের ঘরে।
ওই দেখো মা, জানলা দিয়ে
আসে জলের ছাট—
বল্ গো আমায় কোথায় আছে
তেপান্তরের মাঠ।
কোন্ সাগরের তীরে মা গো,
কোন্ পাহাড়ের পারে,
কোন্ রাজাদের দেশে মা গো,
কোন্ নদীটির ধারে।
কোনোখানে আল বাঁধা তার
নাই ডাইনে বাঁয়ে?
পথ দিয়ে তার সন্ধেবেলায়
পৌঁছে না কেউ গাঁয়ে?
সারা দিন কি ধূ ধূ করে
শুকনো ঘাসের জমি?
একটি গাছে থাকে শুধু
ব্যাঙ্গমা – বেঙ্গমী?
সেখান দিয়ে কাঠকুড়ুনি
যায় না নিয়ে কাঠ?
বল্ গো আমায় কোথায় আছে
তেপান্তরের মাঠ।
এমনিতরো মেঘ করেছে
সারা আকাশ ব্যেপে,
রাজপুত্তুর যাচ্ছে মাঠে
একলা ঘোড়ায় চেপে।
গজমোতির মালাটি তার
বুকের ‘পরে নাচে—
রাজকন্যা কোথায় আছে
খোঁজ পেলে কার কাছে।
মেঘে যখন ঝিলিক মারে
আকাশের এক কোণে
দুয়োরানী – মায়ের কথা
পড়ে না তার মনে?
দুখিনা মা গোয়াল – ঘরে
দিচ্ছে এখন ঝাঁট,
রাজপুত্তুর চলে যে কোন্
তেপান্তরের মাঠ।
ওই দেখো মা, গাঁয়ের পথে
লোক নেইকো মোটে,
রাখাল – ছেলে সকাল করে
ফিরেছে আজ গোঠে।
আজকে দেখো রাত হয়েছে
দিস না যেতে যেতে,
কৃষাণেরা বসে আছে
দাওয়ায় মাদুর পেতে।
আজকে আমি নুকিয়েছি মা,
পুঁথিপত্তর যত—
পড়ার কথা আজ বোলো না।
যখন বাবার মতো।
বড়ো হব তখন আমি
পড়ব প্রথম পাঠ—
আজ বলো মা, কোথায় আছে
তেপান্তরের মাঠ।
ছোটোবড়ো
এখনো তো বড়ো হই নি আমি,
ছোটো আছি ছেলেমানুষ বলে।
দাদার চেয়ে অনেক মস্ত হব
বড়ো হয়ে বাবার মতো হলে।
দাদা তখন পড়তে যদি না চায়,
পাখির ছানা পোষে কেবল খাঁচায়,
তখন তারে এমনি বকে দেব!
বলব, ‘তুমি চুপটি করে পড়ো। ‘
বলব, ‘তুমি ভারি দুষ্টু ছেলে’—
যখন হব বাবার মতো বড়ো।
তখন নিয়ে দাদার খাঁচাখানা
ভালো ভালো পুষব পাখির ছানা।
সাড়ে দশটা যখন যাবে বেজে
নাবার জন্যে করব না তো তাড়া।
ছাতা একটা ঘাড়ে করে নিয়ে
চটি পায়ে বেড়িয়ে আসব পাড়া।
গুরুমশায় দাওয়ায় এলে পরে
চৌকি এনে দিতে বলব ঘরে,
তিনি যদি বলেন ‘সেলেট কোথা?
দেরি হচ্ছে, বসে পড়া করো’
আমি বলব, ‘খোকা তো আর নেই,
হয়েছি যে বাবার মতো বড়ো। ‘
গুরুমশায় শুনে তখন কবে,
‘বাবুমশায়, আসি এখন তবে। ‘
খেলা করতে নিয়ে যেতে মাঠে
ভুলু যখন আসবে বিকেল বেলা,
আমি তাকে ধমক দিয়ে কব,
‘ কাজ করছি, গোল কোরো না মেলা। ‘
রথের দিনে খুব যদি ভিড় হয়
একলা যাব, করব না তো ভয়—
মামা যদি বলেন ছুটে এসে
‘ হারিয়ে যাবে, আমার কোলে চড়ো’
বলব আমি, ‘দেখছ না কি মামা,
হয়েছি যে বাবার মতো বড়ো। ‘
দেখে দেখে মামা বলবে, ‘তাই তো,
খোকা আমার সে খোকা আর নাই তো। ‘
আমি যেদিন প্রথম বড়ো হব
মা সেদিনে গঙ্গাস্নানের পরে
আসবে যখন খিড়কি – দুয়োর দিয়ে
ভাববে ‘কেন গোল শুনি নে ঘরে। ‘
তখন আমি চাবি খুলতে শিখে
যত ইচ্ছে টাকা দিচ্ছি ঝিকে,
মা দেখে তাই বলবে তাড়াতাড়ি,
‘ খোকা, তোমার খেলা কেমনতরো। ‘
আমি বলব, ‘মাইনে দিচ্ছি আমি,
হয়েছি যে বাবার মতো বড়ো।
ফুরোয় যদি টাকা, ফুরোয় খাবার,
যত চাই মা, এনে দেব আবার। ‘
আশ্বিনেতে পুজোর ছুটি হবে,
মেলা বসবে গাজনতলার হাটে,
বাবার নৌকো কত দূরের থেকে
লাগবে এসে বাবুগঞ্জের ঘাটে।
বাবা মনে ভাববে সোজাসুজি,
খোকা তেমনি খোকাই আছে বুঝি,
ছোটো ছোটো রঙিন জামা জুতো
কিনে এনে বলবে আমায় ‘পরো’।
আমি বলব, ‘দাদা পরুক এসে,
আমি এখন তোমার মতো বড়ো।
দেখছ না কি যে ছোটো মাপ জামার—
পরতে গেলে আঁট হবে যে আমার।
জন্মকথা
খোকা মাকে শুধায় ডেকে —
‘ এলেম আমি কোথা থেকে ,
কোন্খানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে । ‘
মা শুনে কয় হেসে কেঁদে
খোকারে তার বুকে বেঁধে —
‘ ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে ।
ছিলি আমার পুতুল – খেলায় ,
প্রভাতে শিবপূজার বেলায়
তোরে আমি ভেঙেছি আর গড়েছি ।
তুই আমার ঠাকুরের সনে
ছিলি পূজার সিংহাসনে ,
তাঁরি পূজায় তোমার পূজা করেছি ।
আমার চিরকালের আশায় ,
আমার সকল ভালোবাসায় ,
আমার মায়ের দিদিমায়ের পরানে —
পুরানো এই মোদের ঘরে
গৃহদেবীর কোলের ‘পরে
যে লুকিয়ে ছিলি কে জানে ।
যৌবনেতে যখন হিয়া
উঠেছিল প্রস্ফুটিয়া ,
তুই ছিলি সৌরভের মতো মিলায়ে ,
আমার তরুণ অঙ্গে অঙ্গে
জড়িয়ে ছিলি সঙ্গে সঙ্গে
তোর লাবণ্য কোমলতা বিলায়ে ।
সব দেবতার আদরের ধন
নিত্যকালের তুই পুরাতন ,
তুই প্রভাতের আলোর সমবয়সী —
তুই জগতের স্বপ্ন হতে
এসেছিস আনন্দ – স্রোতে
নূতন হয়ে আমার বুকে বিলসি ।
নির্নিমেষে তোমায় হেরে
তোর রহস্য বুঝি নে রে ,
সবার ছিলি আমার হলি কেমনে ।
ওই দেহে এই দেহ চুমি
মায়ের খোকা হয়ে তুমি
মধুর হেসে দেখা দিলে ভুবনে ।
হারাই হারাই ভয়ে গো তাই
বুকে চেপে রাখতে যে চাই ,
কেঁদে মরি একটু সরে দাঁড়ালে ।
জানি না কোন্ মায়ায় ফেঁদে
বিশ্বের ধন রাখব বেঁধে
আমার এ ক্ষীণ বাহু দুটির আড়ালে ।
জ্যোতিষ-শাস্ত্র
আমি শুধু বলেছিলেম—
‘কদম গাছের ডালে
পূর্ণিমা-চাঁদ আটকা পড়ে
যখন সন্ধেকালে
তখন কি কেউ তারে
ধরে আনতে পারে। ‘
শুনে দাদা হেসে কেন
বললে আমায়, ‘ খোকা,
তোর মতো আর দেখি নাইকো বোকা।
চাঁদ যে থাকে অনেক দূরে
কেমন করে ছুঁই;
আমি বলি, ‘দাদা, তুমি
জান না কিচ্ছুই।
মা আমাদের হাসে যখন
ওই জানলার ফাঁকে
তখন তুমি বলবে কি, মা
অনেক দূরে থাকে। ‘
তবু দাদা বলে আমায়, ‘খোকা,
তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা। ‘
দাদা বলে, ‘পাবি কোথায়
অত বড়ো ফাঁদ। ‘
আমি বলি, ‘কেন দাদা,
ওই তো ছোটো চাঁদ,
দুটি মুঠোয় ওরে
আনতে পারি ধরে। ‘
শুনে দাদা হেসে কেন
বললে আমায়, ‘খোকা,
তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা।
চাঁদ যদি এই কাছে আসত
দেখতে কত বড়ো। ‘
আমি বলি, ‘কী তুমি ছাই
ইস্কুলে যে পড়।
মা আমাদের চুমো খেতে
মাথা করে নিচু,
তখন কি আর মুখটি দেখায়
মস্ত বড়ো কিছু। ‘
তবু দাদা বলে আমায়, ‘খোকা,
তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা।
দুঃখহারী
মনে করো, তুমি থাকবে ঘরে,
আমি যেন যাব দেশান্তরে।
ঘাটে আমার বাঁধা আছে তরী,
জিনিসপত্র নিয়েছি সব ভরি—
ভালো করে দেখ্ তো মনে করি
কী এনে মা, দেব তোমার তরে।
চাস কি মা, তুই এত এত সোনা—
সোনার দেশে করব আনাগোনা।
সোনামতী নদীতীরের কাছে
সোনার ফসল মাঠে ফ’লে আছে,
সোনার চাঁপা ফোটে সেথায় গাছে—
না কুড়িয়ে আমি তো ফিরব না।
পরতে কি চাস মুক্তো গেঁথে হারে —
জাহাজ বেয়ে যাব সাগর-পারে।
সেখানে মা, সকালবেলা হলে
ফুলের ‘পরে মুক্তোগুলি দোলে,
টুপটুপিয়ে পড়ে ঘাসের কোলে—
যত পারি আনব ভারে ভারে।
দাদার জন্যে আনব মেঘে – ওড়া
পক্ষিরাজের বাচ্ছা দুটি ঘোড়া।
বাবার জন্যে আনব আমি তুলি
কনক-লতার চারা অনেকগুলি—
তোর তরে মা, দেব কৌটা খুলি
সাত-রাজার – ধন মানিক একটি জোড়া।
নবীন অতিথি
গান
ওহে নবীন অতিথি,
তুমি নূতন কি তুমি চিরন্তন।
যুগে যুগে কোথা তুমি ছিলে সংগোপন।
যতনে কত কী আনি বেঁধেছিনু গৃহখানি,
হেথা কে তোমারে বলো করেছিল নিমন্ত্রণ।
কত আশা ভালোবাসা গভীর হৃদয়তলে
ঢেকে রেখেছিনু বুকে, কত হাসি অশ্রুজলে!
একটি না কহি বাণী তুমি এলে মহারানী,
কেমনে গোপনে মনে করিলে হে পদার্পণ।
নির্লিপ্ত
বাছা রে মোর বাছা,
ধূলির ‘পরে হরষভরে
লইয়া তৃণগাছা
আপন মনে খেলিছ কোণে,
কাটিছে সারা বেলা।
হাসি গো দেখে এ ধূলি মেখে
এ তৃণ লয়ে খেলা।
আমি যে কাজে রত,
লইয়া খাতা ঘুরাই মাথা
হিসাব কষি কত,
আঁকের সারি হতেছে ভারী
কাটিয়া যায় বেলা—
ভাবিছ দেখি মিথ্যা একি
সময় নিয়ে খেলা।
বাছা রে মোর বাছা,
খেলিতে ধূলি গিয়েছি ভুলি
লইয়ে তৃণগাছা।
কোথায় গেলে খেলেনা মেলে
ভাবিয়া কাটে বেলা,
বেড়াই খুঁজি করিতে পুঁজি
সোনারূপার ঢেলা।
যা পাও চারি দিকে
তাহাই ধরি তুলিছ গড়ি
মনের সুখটিকে।
না পাই যারে চাহিয়া তারে
আমার কাটে বেলা,
আশাতীতেরই আশায় ফিরি
ভাসাই মোর ভেলা।
নৌকাযাত্রা
মধু মাঝির ওই যে নৌকোখানা
বাঁধা আছে রাজগঞ্জের ঘাটে ,
কারো কোনো কাজে লাগছে না তো ,
বোঝাই করা আছে কেবল পাটে ।
আমায় যদি দেয় তারা নৌকাটি
আমি তবে একশোটা দাঁড় আঁটি ,
পাল তুলে দিই চারটে পাঁচটা ছটা —
মিথ্যে ঘুরে বেড়াই নাকো হাটে ।
আমি কেবল যাই একটিবার
সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার ।
তখন তুমি কেঁদো না মা , যেন
বসে বসে একলা ঘরের কোণে —
আমি তো মা , যাচ্ছি নেকো চলে
রামের মতো চোদ্দ বছর বনে ।
আমি যাব রাজপুত্রু হয়ে
নৌকো – ভরা সোনামানিক বয়ে ,
আশুকে আর শ্যামকে নেব সাথে ,
আমরা শুধু যাব মা তিন জনে ।
আমি কেবল যাব একটিবার
সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার ।
ভোরের বেলা দেব নৌকো ছেড়ে ,
দেখতে দেখতে কোথায় যাব ভেসে ।
দুপুরবেলা তুমি পুকুর – ঘাটে ,
আমরা তখন নতুন রাজার দেশে ।
পেরিয়ে যাব তির্পুর্নির ঘাট ,
পেরিয়ে যাব তেপান্তরের মাঠ ,
ফিরে আসতে সন্ধে হয়ে যাবে ,
গল্প বলব তোমার কোলে এসে ।
আমি কেবল যাব একটিবার
সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার ।
পরিচয়
একটি মেয়ে আছে জানি,
পল্লীটি তার দখলে,
সবাই তারি পুজো জোগায়
লক্ষ্মী বলে সকলে।
আমি কিন্তু বলি তোমায়
কথায় যদি মন দেহ—
খুব যে উনি লক্ষ্মী মেয়ে
আছে আমার সন্দেহ।
ভোরের বেলা আঁধার থাকে,
ঘুম যে কোথা ছোটে ওর—
বিছানাতে হুলুস্থুলু
কলরবের চোটে ওর।
খিল্খিলিয়ে হাসে শুধু
পাড়াসুদ্ধ জাগিয়ে,
আড়ি করে পালাতে যায়
মায়ের কোলে না গিয়ে।
হাত বাড়িয়ে মুখে সে চায়,
আমি তখন নাচারই,
কাঁধের ‘পরে তুলে তারে
করে বেড়াই পাচারি।
মনের মতো বাহন পেয়ে
ভারি মনের খুশিতে
মারে আমায় মোটা মোটা
নরম নরম ঘুষিতে।
আমি ব্যস্ত হয়ে বলি—
‘একটু রোসো রোসো মা। ‘
মুঠো করে ধরতে আসে
আমার চোখের চশমা।
আমার সঙ্গে কলভাষায়
করে কতই কলহ।
তুমুল কাণ্ড! তোমরা তারে
শিষ্ট আচার বলহ?
তবু তো তার সঙ্গে আমার
বিবাদ করা সাজে না।
সে নইলে যে তেমন করে
ঘরের বাঁশি বাজে না।
সে না হলে সকালবেলায়
এত কুসুম ফুটবে কি।
সে না হলে সন্ধেবেলায়
সন্ধেতারা উঠবে কি।
একটি দণ্ড ঘরে আমার
না যদি রয় দুরন্ত
কোনোমতে হয় না তবে
বুকের শূন্য পূরণ তো।
দুষ্টুমি তার দখিন-হাওয়া
সুখের তুফান-জাগানে
দোলা দিয়ে যায় গো আমার
হৃদয়ের ফুল-বাগানে।
নাম যদি তার জিজ্ঞেস কর
সেই আছে এক ভাবনা,
কোন্ নামে যে দিই পরিচয়
সে তো ভেবেই পাব না।
নামের খবর কে রাখে ওর,
ডাকি ওরে যা-খুশি—
দুষ্টু বল, দস্যি বল,
পোড়ারমুখী, রাক্ষুসি।
বাপ-মায়ে যে নাম দিয়েছে
বাপ-মায়েরই থাক্ সে নয়।
ছিষ্টি খুঁজে মিষ্টি নামটি
তুলে রাখুন বাক্সে নয়।
একজনেতে নাম রাখবে
কখন অন্নপ্রাশনে,
বিশ্বসুদ্ধ সে নাম নেবে—
ভারি বিষম শাসন এ।
নিজের মনের মতো সবাই
করুন কেন নামকরণ—
বাবা ডাকুন চন্দ্রকুমার,
খুড়ো ডাকুন রামচরণ।
ঘরের মেয়ে তার কি সাজে
সঙস্কৃত নামটা ওই।
এতে কারো দাম বাড়ে না
অভিধানের দামটা বৈ।
আমি বাপু, ডেকেই বসি
যেটাই মুখে আসুক-না—
যারে ডাকি সেই তা বোঝে,
আর সকলে হাসুক-না—
একটি ছোটো মানুষ তাহার
একশো রকম রঙ্গ তো।
এমন লোককে একটি নামেই
ডাকা কি হয় সংগত।
পাখির পালক
খেলাধুলো সব রহিল পড়িয়া,
ছুটে চ ‘ লে আসে মেয়ে—
বলে তাড়াতাড়ি, ‘ওমা, দেখ্ দেখ্,
কী এনেছি দেখ্ চেয়ে। ‘
আঁখির পাতায় হাসি চমকায়,
ঠোঁটে নেচে ওঠে হাসি—
হয়ে যায় ভুল, বাঁধে নাকো চুল,
খুলে পড়ে কেশরাশি।
দুটি হাত তার ঘিরিয়া ঘিরিয়া
রাঙা চুড়ি কয়গাছি,
করতালি পেয়ে বেজে ওঠে তারা;
কেঁপে ওঠে তারা নাচি।
মায়ের গলায় বাহু দুটি বেঁধে
কোলে এসে বসে মেয়ে।
বলে তাড়াতাড়ি, ‘ওমা, দেখ্ দেখ্,
কী এনেছি দেখ্ চেয়ে। ‘
সোনালি রঙের পাখির পালক
ধোওয়া সে সোনার স্রোতে—
খসে এল যেন তরুণ আলোক
অরুণের পাখা হতে।
নয়ন-ঢুলানো কোমল পরশ
ঘুমের পরশ যথা—
মাখা যেন তায় মেঘের কাহিনী,
নীল আকাশের কথা।
ছোটোখাটো নীড়, শাবকের ভিড়,
কতমত কলরব,
প্রভাতের সুখ, উড়িবার আশা—
মনে পড়ে যেন সব।
লয়ে সে পালক কপোলে বুলায়,
আঁখিতে বুলায় মেয়ে,
বলে হেসে হেসে, ‘ওমা, দেখ্ দেখ্,
কী এনেছি দেখ্ চেয়ে। ‘
মা দেখিল চেয়ে, কহিল হাসিয়ে,
‘কিবা জিনিসের ছিরি!’
ভূমিতে ফেলিয়া গেল সে চলিয়া,
আর না চাহিল ফিরি।
মেয়েটির মুখে কথা না ফুটিল,
মাটিতে রহিল বসি।
শূন্য হতে যেন পাখির পালক
ভূতলে পড়িল খসি।
খেলাধুলো তার হল নাকো আর,
হাসি মিলাইল মুখে,
ধীরে ধীরে শেষে দুটি ফোঁটা জল
দেখা দিল দুটি চোখে।
পালকটি লয়ে রাখিল লুকায়ে
গোপনের ধন তার—
আপনি খেলিত, আপনি তুলিত,
দেখাত না কারে আর।
পুরোনো বট
লুটিয়ে পড়ে জটিল জটা,
ঘন পাতার গহন ঘটা,
হেথা হোথায় রবির ছটা,
পুকুর-ধারে বট।
দশ দিকেতে ছড়িয়ে শাখা
কঠিন বাহু আঁকাবাঁকা
স্তব্ধ যেন আছে আঁকা,
শিরে আকাশ-পট।
নেবে নেবে গেছে জলে
শিকড়গুলো দলে দলে,
সাপের মতো রসাতলে
আলয় খুঁজে মরে।
শতেক শাখা-বাহু তুলি
বায়ুর সাথে কোলাকুলি,
আনন্দেতে দোলাদুলি
গভীর প্রেমভরে।
ঝড়ের তালে নড়ে মাথা,
কাঁপে লক্ষকোটি পাতা,
আপন-মনে গায় সে গাথা,
দুলায় মহাকায়া।
তড়িৎ পাশে উঠে হেসে,
ঝড়ের মেঘ ঝটিৎ এসে
দাঁড়িয়ে থাকে এলোকেশে,
তলে গভীর ছায়া।
নিশিদিশি দাঁড়িয়ে আছ
মাথার লয়ে জট,
ছোটো ছেলেটি মনে কি পড়ে
ওগো প্রাচীন বট!
কতই পাখি তোমার শাখে
বসে যে চলে গেছে,
ছোটো ছেলেরে তাদেরই মতো
ভুলে কি যেতে আছে?
তোমার মাঝে হৃদয় তারি
বেঁধেছিল যে নীড়।
ডালেপালায় সাধগুলি তার
কত করেছে ভিড়।
মনে কি নেই সারাটা দিন
বসিয়ে বাতায়নে,
তোমার পানে রইত চেয়ে
অবাক দুনয়নে?
ভাঙা ঘাটে নাইত কারা,
তুলত কারা জল,
পুকুরেতে ছায়া তোমার
করত টলমল।
জলের উপর রোদ পড়েছে
সোনা-মাখা মায়া,
ভেসে বেড়ায় দুটি হাঁস
দুটি হাঁসের ছায়া।
ছোটো ছেলে রইত চেয়ে,
বাসনা অগাধ—
মনের মধ্যে খেলাত তার
কত খেলার সাধ।
বায়ুর মতো খেলত যদি
তোমার চারি ভিতে,
ছায়ার মতো শুত যদি
তোমার ছায়াটিতে,
পাখির মতো উড়ে যেত
উড়ে আসত ফিরে,
হাঁসের মতো ভেসে যেত
তোমার তীরে তীরে।
মনে হত, তোমার ছায়ে
কতই যে কী আছে,
কাদের যেন ঘুম পাড়াতে
ঘুঘু ডাকত গাছে।
মনে হত, তোমার মাঝে
কাদের যেন ঘর।
আমি যদি তাদের হতেম!
কেন হলেম পর।
ছায়ার মতো ছায়ায় তারা
থাকে পাতার ‘পরে,
গুন্গুনিয়ে সবাই মিলে
কতই যে গান করে।
দূর লাগে মূলতানে তান,
পড়ে আসে বেলা,
ঘাটে বসে দেখে জলে
আলোছায়ার খেলা।
সন্ধে হলে খোঁপা বাঁধে
তাদের মেয়েগুলি,
ছেলেরা সব দোলায় বসে
খেলায় দুলি দুলি।
তোমার পানে রইত চেয়ে
অবাক দুনয়নে?
তোমার তলে মধুর ছায়া
তোমার তলে ছুটি,
তোমার তলে নাচত বসে
শালিখ পাখি দুটি।
গহিন রাতে দখিন বাতে
নিঝুম চারি ভিত,
চাঁদের আলোয় শুভ্র তনু,
ঝিমি ঝিমি গীত।
ওখানেতে পাঠশালা নেই,
পণ্ডিতমশাই—
বেত হাতে নাইকো বসে
মাধব গোসাঁই।
সারাটা দিন ছুটি কেবল,
সারাটা দিন খেলা—
পুকুর-ধারে আঁধার-করা
বটগাছের তলা।
আজকে কেন নাইকো তারা।
আছে আর-সকলে,
তারা তাদের বাসা ভেঙে
কোথায় গেছে চলে।
ছায়ার মধ্যে মায়া ছিল
ভেঙে দিল কে।
ছায়া কেবল রইল প’ড়ে,
কোথায় গেল সে।
ডালে বসে পাখিরা আজ
কোন্ প্রাণেতে ডাকে।
রবির আলো কাদের খোঁজে
পাতার ফাঁকে ফাঁকে।
গল্প কত ছিল যেন
তোমার খোপে-খাপে,
পাখির সঙ্গে মিলে-মিশে
ছিল চুপে-চাপে,
দুপুর বেলা নূপুর তাদের
বাজত অনুক্ষণ,
ছোটো দুটি ভাই-ভগিনীর
আকুল হত মন।
ছেলেবেলায় ছিল তারা,
কোথায় গেল শেষে।
গেছে বুঝি ঘুম-পাড়ানি
মাসিপিসির দেশে।
পূজার সাজ
আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি,
পূজার সময় এল কাছে।
মধু বিধু দুই ভাই ছুটাছুটি করে তাই,
আনন্দে দু-হাত তুলি নাচে।
পিতা বসি ছিল দ্বারে, দুজনে শুধালো তারে,
‘কী পোশাক আনিয়াছ কিনে। ‘
পিতা কহে, ‘আছে আছে তোদের মায়ের কাছে,
দেখিতে পাইবি ঠিক দিনে। ‘
সবুর সহে না আর— জননীরে বার বার
কহে, ‘মা গো, ধরি তোর পায়ে,
বাবা আমাদের তরে কী কিনে এনেছে ঘরে
একবার দে না মা, দেখায়ে। ‘
ব্যস্ত দেখি হাসিয়া মা দুখানি ছিটের জামা
দেখাইল করিয়া আদর।
মধু কহে, ‘আর নেই?’ মা কহিল, ‘আছে এই
একজোড়া ধুতি ও চাদর। ‘
রাগিয়া আগুন ছেলে, কাপড় ধুলায় ফেলে
কাঁদিয়া কহিল, ‘চাহি না মা,
রায়বাবুদের গুপি পেয়েছে জরির টুপি,
ফুলকাটা সাটিনের জামা। ‘
মা কহিল, ‘মধু, ছি ছি, কেন কাঁদ মিছামিছি,
গরিব যে তোমাদের বাপ।
এবার হয় নি ধান, কত গেছে লোকসান,
পেয়েছেন কত দুঃখতাপ।
তবু দেখো বহু ক্লেশে তোমাদের ভালোবেসে
সাধ্যমত এনেছেন কিনে।
সে জিনিস অনাদরে ফেলিলি ধূলির ‘পরে—
এই শিক্ষা হল এতদিনে। ‘
বিধু বলে, ‘এ কাপড় পছন্দ হয়েছে মোর,
এই জামা পরাস আমারে। ‘
মধু শুনে আরো রেগে ঘর ছেড়ে দ্রুতবেগে
গেল রায়বাবুদের দ্বারে।
সেথা মেলা লোক জড়ো, রায়বাবু ব্যস্ত বড়ো;
দালান সাজাতে গেছে রাত।
মধু যবে এক কোণে দাঁড়াইল ম্লান মনে
চোখে তাঁর পড়িল হঠাৎ।
কাছে ডাকি স্নেহভরে কহেন করুণ স্বরে
তারে দুই বাহুতে বাঁধিয়া,
‘কী রে মধু, হয়েছে কী। তোরে যে শুক্নো দেখি। ‘
শুনি মধু উঠিল কাঁদিয়া,
কহিল, ‘আমার তরে বাবা আনিয়াছে ঘরে
শুধু এক ছিটের কাপড়। ‘
শুনি রায়মহাশয় হাসিয়া মধুরে কয়,
‘সেজন্য ভাবনা কিবা তোর। ‘
ছেলেরে ডাকিয়া চুপি কহিলেন, ‘ওরে গুপি,
তোর জামা দে তুই মধুকে। ‘
গুপির সে জামা পেয়ে মধু ঘরে যায় ধেয়ে
হাসি আর নাহি ধরে মুখে।
বুক ফুলাইয়া চলে— সবারে ডাকিয়া বলে,
‘দেখো কাকা! দেখো চেয়ে মামা!
ওই আমাদের বিধু ছিট পরিয়াছে শুধু,
মোর গায়ে সাটিনের জামা। ‘
মা শুনি কহেন আসি লাজে অশ্রুজলে ভাসি
কপালে করিয়া করাঘাত,
‘হই দুঃখী হই দীন কাহারো রাখি না ঋণ,
কারো কাছে পাতি নাই হাত।
তুমি আমাদেরই ছেলে ভিক্ষা লয়ে অবহেলে
অহংকার কর ধেয়ে ধেয়ে!
ছেঁড়া ধুতি আপনার ঢের বেশি দাম তার
ভিক্ষা-করা সাটিনের চেয়ে।
আয় বিধু, আয় বুকে, চুমো খাই চাঁদমুখে,
তোর সাজ সব চেয়ে ভালো।
দরিদ্র ছেলের দেহে দরিদ্র বাপের স্নেহে
ছিটের জামাটি করে আলো।
প্রশ্ন
মা গো, আমায় ছুটি দিতে বল্,
সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা।
এখন আমি তোমার ঘরে বসে
করব শুধু পড়া-পড়া খেলা।
তুমি বলছ দুপুর এখন সবে,
নাহয় যেন সত্যি হল তাই,
একদিনও কি দুপুরবেলা হলে
বিকেল হল মনে করতে নাই?
আমি তো বেশ ভাবতে পারি মনে
সুয্যি ডুবে গেছে মাঠের শেষে,
বাগ্দি-বুড়ি চুবড়ি ভরে নিয়ে
শাক তুলেছে পুকুর-ধারে এসে।
আঁধার হল মাদার-গাছের তলা,
কালি হয়ে এল দিঘির জল,
হাটের থেকে সবাই এল ফিরে,
মাঠের থেকে এল চাষির দল।
মনে কর্-না উঠল সাঁঝের তারা,
মনে কর্-না সন্ধে হল যেন।
রাতের বেলা দুপুর যদি হয়
দুপুর বেলা রাত হবে না কেন।
ফুলের ইতিহাস
বসন্তপ্রভাতে এক মালতীর ফুল
প্রথম মেলিল আঁখি তার,
প্রথম হেরিল চারি ধার।
মধুকর গান গেয়ে বলে,
‘মধু কই, মধু দাও দাও। ‘
হরষে হৃদয় ফেটে গিয়ে
ফুল বলে, ‘এই লও লও। ‘
বায়ু আসি কহে কানে কানে,
‘ফুলবালা, পরিমল দাও। ‘
আনন্দে কাঁদিয়া কহে ফুল,
‘যাহা আছে সব লয়ে যাও। ‘
তরুতলে চ্যুতবৃন্ত মালতীর ফুল
মুদিয়া আসিছে আঁখি তার,
চাহিয়া দেখিল চারি ধার।
মধুকর কাছে এসে বলে,
‘মধু কই, মধু চাই চাই। ‘
ধীরে ধীরে নিশ্বাস ফেলিয়া
ফুল বলে, ‘কিছু নাই নাই। ‘
‘ফুলবালা, পরিমল দাও’
বায়ু আসি কহিতেছে কাছে।
মলিন বদন ফিরাইয়া
ফুল বলে, ‘আর কী বা আছে।
বনবাস
বাবা যদি রামের মতো
পাঠায় আমায় বনে
যেতে আমি পারি নে কি
তুমি ভাবছ মনে?
চোদ্দ বছর ক’ দিনে হয়
জানি নে মা ঠিক,
দণ্ডক বন আছে কোথায়
ওই মাঠে কোন্ দিক।
কিন্তু আমি পারি যেতে,
ভয় করি নে তাতে—
লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার
থাকত সাথে সাথে।
বনের মধ্যে গাছের ছায়ায়
বেঁধে নিতেম ঘর—
সামনে দিয়ে বইত নদী,
পড়ত বালির চর।
ছোটো একটি থাকত ডিঙি
পারে যেতেম বেয়ে—
হরিণ চ’রে বেড়ায় সেথা,
কাছে আসত ধেয়ে।
গাছের পাতা খাইয়ে দিতেম
আমি নিজের হাতে—
লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার
থাকত সাথে সাথে।
কত যে গাছ ছেয়ে থাকত
কত রকম ফুলে,
মালা গেঁথে পরে নিতেম
জড়িয়ে মাথার চুলে।
নানা রঙের ফলগুলি সব
ভুঁয়ে পড়ত পেকে,
ঝুড়ি ভরে ভরে এনে
ঘরে দিতেম রেখে;
খিদে পেলে দুই ভায়েতে
খেতেম পদ্মপাতে—
লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার
থাকত সাথে সাথে।
রোদের বেলায় অশথ – তলায়
ঘাসের ‘পরে আসি
রাখাল – ছেলের মতো কেবল
বাজাই বসে বাঁশি।
ডালের ‘পরে ময়ূর থাকে,
পেখম পড়ে ঝুলে—
কাঠবিড়ালি ছুটে বেড়ায়
ন্যাজটি পিঠে তুলে।
কখন আমি ঘুমিয়ে যেতেম
দুপুরবেলার তাতে—
লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার
থাকত সাথে সাথে।
সন্ধেবেলায় কুড়িয়ে আনি
শুকোনো ডালপালা,
বনের ধারে বসে থাকি
আগুন হলে জ্বালা।
পাখিরা সব বাসায় ফেরে,
দূরে শেয়াল ডাকে,
সন্ধেতারা দেখা যে যায়
ডালের ফাঁকে ফাঁকে।
মায়ের কথা মনে করি
বসে আঁধার রাতে—
লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার
থাকত সাথে সাথে।
ঠাকুরদাদার মতো বনে
আছেন ঋষি মুনি,
তাঁদের পায়ে প্রণাম করে
গল্প অনেক শুনি।
রাক্ষসেরে ভয় করি নে,
আছে গুহক মিতা—
রাবণ আমার কী করবে মা,
নেই তো আমার সীতা।
হনুমানকে যত্ন করে
খাওয়াই দুধে – ভাতে—
লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার
থাকত সাথে সাথে।
মা গো, আমায় দে – না কেন
একটি ছোটো ভাই—
দুইজনেতে মিলে আমরা
বনে চলে যাই।
আমাকে মা, শিখিয়ে দিবি
রাম – যাত্রার গান,
মাথায় বেঁধে দিবি চুড়ো,
হাতে ধনুক – বাণ।
চিত্রকূটের পাহাড়ে যাই
এম্নি বরষাতে—
লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার
থাকত সাথে সাথে।
বিচার
আমার খোকার কত যে দোষ
সে-সব আমি জানি,
লোকের কাছে মানি বা নাই মানি।
দুষ্টামি তার পারি কিম্বা
নারি থামাতে,
ভালোমন্দ বোঝাপড়া
তাতে আমাতে।
বাহির হতে তুমি তারে
যেমনি কর দুষী
যত তোমার খুশি,
সে বিচারে আমার কী বা হয়।
খোকা বলেই ভালোবাসি,
ভালো বলেই নয়।
খোকা আমার কতখানি
সে কি তোমরা বোঝ।
তোমরা শুধু দোষ গুণ তার খোঁজ।
আমি তারে শাসন করি
বুকেতে বেঁধে ,
আমি তারে কাঁদাই যে গো
আপনি কেঁদে।
বিচার করি, শাসন করি,
করি তারে দুষী
আমার যাহা খুশি।
তোমার শাসন আমরা মানি নে গো।
শাসন করা তারেই সাজে
সোহাগ করে যে গো।
বিচিত্র সাধ
আমি যখন পাঠশালাতে যাই
আমাদের এই বাড়ির গলি দিয়ে,
দশটা বেলায় রোজ দেখতে পাই
ফেরিওলা যাচ্ছে ফেরি নিয়ে।
‘চুড়ি চা— ই, চুড়ি চাই’ সে হাঁকে,
চীনের পুতুল ঝুড়িতে তার থাকে,
যায় সে চলে যে পথে তার খুশি,
যখন খুশি খায় সে বাড়ি গিয়ে।
দশটা বাজে, সাড়ে দশটা বাজে,
নাইকো তাড়া হয় বা পাছে দেরি।
ইচ্ছে করে সেলেট ফেলে দিয়ে
অম্নি করে বেড়াই নিয়ে ফেরি।
আমি যখন হাতে মেখে কালি
ঘরে ফিরি, সাড়ে চারটে বাজে,
কোদাল নিয়ে মাটি কোপায় মালী
বাবুদের ওই ফুল-বাগানের মাঝে।
কেউ তো তারে মানা নাহি করে
কোদাল পাছে পড়ে পায়ের ‘পরে।
গায়ে মাথায় লাগছে কত ধুলো,
কেউ তো এসে বকে না তার কাজে।
মা তারে তো পরায় না সাফ জামা,
ধুয়ে দিতে চায় না ধুলোবালি।
ইচ্ছে করে আমি হতেম যদি
বাবুদের ওই ফুল-বাগানের মালী।
একটু বেশি রাত না হতে হতে
মা আমারে ঘুম পাড়াতে চায়।
জানলা দিয়ে দেখি চেয়ে পথে
পাগড়ি পরে পাহারওলা যায়।
আঁধার গলি, লোক বেশি না চলে,
গ্যাসের আলো মিট্মিটিয়ে জ্বলে,
লণ্ঠনটি ঝুলিয়ে নিয়ে হাতে
দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির দরজায়।
রাত হয়ে যায় দশটা এগারোটা
কেউ তো কিছু বলে না তার লাগি।
ইচ্ছে করে পাহারওলা হয়ে
গলির ধারে আপন মনে জাগি।
বিচ্ছেদ
বাগানে ওই দুটো গাছে
ফুল ফুটেছে কত যে,
ফুলের গন্ধে মনে পড়ে
ছিল ফুলের মতো যে।
ফুল যে দিত ফুলের সঙ্গে
আপন সুধা মাখায়ে,
সকাল হত সকাল বেলায়
যাহার পানে তাকায়ে,
সেই আমাদের ঘরের মেয়ে
সে গেছে আজ প্রবাসে,
নিয়ে গেছে এখান থেকে
সকাল বেলার শোভা সে।
একটুখানি মেয়ে আমার
কত যুগের পুণ্য যে,
একটুখানি সরে গেছে
কতখানিই শূন্য যে।
বিষ্টি পড়ে টুপুর টুপুর,
মেঘ করেছে আকাশে,
উষার রাঙা মুখখানি আজ
কেমন যেন ফ্যাকাশে।
বাড়িতে যে কেউ কোথা নেই,
দুয়োরগুলো ভেজানো,
ঘরে ঘরে খুঁজে বেড়াই
ঘরে আছে কে যেন।
ময়নাটি ওই চুপটি করে
ঝিমোচ্ছে সেই খাঁচাতে,
ভুলে গেছে নেচে নেচে
পুচ্ছটি তার নাচাতে।
ঘরের-কোণে আপন-মনে
শূন্য প’ড়ে বিছানা,
কার তরে সে কেঁদে মরে—
সে কল্পনা মিছা না।
বইগুলো সব ছড়িয়ে আছে,
নাম লেখা তায় কার গো।
এম্নি তারা রবে কি হায়,
খুলবে না কেউ আর গো।
এটা আছে সেটা আছে
অভাব কিছু নেই তো—
স্মরণ করে দেয় রে যারে
থাকে নাকো সেই তো।
বিজ্ঞ
খুকি তোমার কিচ্ছু বোঝে না মা,
খুকি তোমার ভারি ছেলেমানুষ।
ও ভেবেছে তারা উঠছে বুঝি
আমরা যখন উড়েয়েছিলেম ফানুস।
আমি যখন খাওয়া – খাওয়া খেলি
খেলার থালে সাজিয়ে নিয়ে নুড়ি,
ও ভাবে বা সত্যি খেতে হবে
মুঠো করে মুখে দেয় মা, পুরি।
সামনেতে ওর শিশুশিক্ষা খুলে
যদি বলি, ‘খুকি, পড়া করো’
দু হাত দিয়ে পাতা ছিঁড়তে বসে—
তোমার খুকির পড়া কেমনতরো।
আমি যদি মুখে কাপড় দিয়ে
আস্তে আস্তে আসি গুড়িগুড়ি
তোমার খুকি অম্নি কেঁদে ওঠে,
ও ভাবে বা এল জুজুবুড়ি।
আমি যদি রাগ করে কখনো
মাথা নেড়ে চোখ রাঙিয়ে বকি—
তোমার খুকি খিল্খিলিয়ে হাসে।
খেলা করছি মনে করে ও কি।
সবাই জানে বাবা বিদেশ গেছে
তবু যদি বলি ‘আসছে বাবা’
তাড়াতাড়ি চার দিকেতে চায়—
তোমার খুকি এম্নি বোকা হাবা।
ধোবা এলে পড়াই যখন আমি
টেনে নিয়ে তাদের বাচ্ছা গাধা,
আমি বলি ‘আমি গুরুমশাই’,
ও আমাকে চেঁচিয়ে ডাকে ‘দাদা’।
তোমার খুকি চাঁদ ধরতে চায়,
গণেশকে ও বলে যে মা গানুশ।
তোমার খুকি কিচ্ছু বোঝে না মা,
তোমার খুকি ভারি ছেলেমানুষ।
বিদায়
তবে আমি যাই গো তবে যাই
ভোরের বেলা শূন্য কোলে
ডাকবি যখন খোকা বলে,
বলব আমি, ‘নাই সে খোকা নাই। ‘
মা গো, যাই।
হাওয়ার সঙ্গে হাওয়া হয়ে
যাব মা, তোর বুকে বয়ে,
ধরতে আমায় পারবি নে তো হাতে।
জলের মধ্যে হব মা, ঢেউ,
জানতে আমায় পারবে না কেউ—
স্নানের বেলা খেলব তোমার সাথে।
বাদলা যখন পড়বে ঝরে
রাতে শুয়ে ভাববি মোরে,
ঝর্ঝরানি গান গাব ওই বনে।
জানলা দিয়ে মেঘের থেকে
চমক মেরে যাব দেখে,
অমার হাসি পড়বে কি তোর মনে।
খোকার লাগি তুমি মা গো,
অনেক রাতে যদি জাগ
তারা হয়ে বলব তোমায়, ‘ঘুমো!’
তুই ঘুমিয়ে পড়লে পরে
জ্যোৎস্না হয়ে ঢুকব ঘরে,
চোখে তোমার খেয়ে যাব চুমো।
স্বপন হয়ে আঁখির ফাঁকে
দেখতে আমি আসব মাকে,
যাব তোমার ঘুমের মধ্যিখানে।
জেগে তুমি মিথ্যে আশে
হাত বুলিয়ে দেখবে পাশে—
মিলিয়ে যাব কোথায় কে তা জানে।
পুজোর সময় যত ছেলে
আঙিনায় বেড়াবে খেলে,
বলবে ‘খোকা নেই রে ঘরের মাঝে’।
আমি তখন বাঁশির সুরে
আকাশ বেয়ে ঘুরে ঘুরে
তোমার সাথে ফিরব সকল কাজে।
পুজোর কাপড় হাতে করে
মাসি যদি শুধায় তোরে,
‘খোকা তোমার কোথায় গেল চলে। ‘
বলিস ‘খোকা সে কি হারায়,
আছে আমার চোখের তারায়,
মিলিয়ে আছে আমার বুকে কোলে।
বীরপুরুষ
মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ‘পরে
টগ্বগিয়ে তোমার পাশে পাশে।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।
সন্ধে হল, সূর্য নামে পাটে,
এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে।
ধূধূ করে যে দিক – পানে চাই,
কোনোখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপন – মনে তাই
ভয় পেয়েছ— ভাবছ, ‘এলেম কোথা!’
আমি বলছি, ‘ভয় কোরো না মা গো,
ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা। ‘
চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে,
মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে।
গোরু বাছুর নেইকো কোনোখানে,
সন্ধে হতেই গেছে গাঁয়ের পানে,
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে,
অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
‘দিঘির ধারে ওই যে কিসের আলো!’
এমন সময় ‘হাঁরে রে রে রে রে,’
ওই যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে।
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর – দেবতা স্মরণ করছ মনে,
বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে
পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো।
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে,
‘আমি আছি, ভয় কেন মা কর। ‘
হাতে লাঠি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল,
কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল।
আমি বলি, ‘দাঁড়া, খবর্দার!
এক পা কাছে আসিস যদি আর—
এই চেয়ে দেখ্ আমার তলোয়ার,
টুকরো করে দেব তোদের সেরে। ‘
শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে
চেঁচিয়ে উঠল, ‘হাঁরে রে রে রে রে। ‘
তুমি বললে, ‘যাস নে খোকা ওরে,’
আমি বলি, ‘দেখো না চুপ করে। ‘
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে,
ঢাল তলোয়ার ঝন্ঝনিয়ে বাজে,
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে,
শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে,
কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।
এত লোকের সঙ্গে লড়াই করে
ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে
বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে,’
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে—
বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল!
কী দুর্দশাই হত তা না হলে। ‘
রোজ কত কী ঘটে যাহা – তাহা—
এমন কেন সত্যি হয় না, আহা।
ঠিক যেন এক গল্প হত তবে,
শুনত যারা অবাক হত সবে,
দাদা বলত, ‘কেমন করে হবে,
খোকার গায়ে এত কি জোর আছে। ‘
পাড়ার লোকে সবাই বলত শুনে,
‘ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে।
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
দিনের আলো নিবে এল,
সুয্যি ডোবে – ডোবে।
আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে
চাঁদের লোভে লোভে।
মেঘের উপর মেঘ করেছে—
রঙের উপর রঙ,
মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা।
বাজল ঠঙ ঠঙ।
ও পারেতে বিষ্টি এল,
ঝাপসা গাছপালা।
এ পারেতে মেঘের মাথায়
একশো মানিক জ্বালা।
বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান—
‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান। ‘
আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা,
কোথায় বা সীমানা!
দেশে দেশে খেলে বেড়ায়,
কেউ করে না মানা।
কত নতুন ফুলের বনে
বিষ্টি দিয়ে যায়,
পলে পলে নতুন খেলা
কোথায় ভেবে পায়।
মেঘের খেলা দেখে কত
খেলা পড়ে মনে,
কত দিনের নুকোচুরি
কত ঘরের কোণে।
তারি সঙ্গে মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান—
‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান। ‘
মনে পড়ে ঘরটি আলো
মায়ের হাসিমুখ,
মনে পড়ে মেঘের ডাকে
গুরুগুরু বুক।
বিছানাটির একটি পাশে
ঘুমিয়ে আছে খোকা,
মায়ের ‘পরে দৌরাত্মি সে
না যায় লেখাজোখা।
ঘরেতে দুরন্ত ছেলে
করে দাপাদাপি,
বাইরেতে মেঘ ডেকে ওঠে—
সৃষ্টি ওঠে কাঁপি।
মনে পড়ে মায়ের মুখে
শুনেছিলেম গান—
‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান।
মনে পড়ে সুয়োরানী
দুয়োরানীর কথা,
মনে পড়ে অভিমানী
কঙ্কাবতীর ব্যথা।
মনে পড়ে ঘরের কোণে
মিটিমিটি আলো,
একটা দিকের দেয়ালেতে
ছায়া কালো কালো।
বাইরে কেবল জলের শব্দ
ঝুপ্ ঝুপ্ ঝুপ্—
দস্যি ছেলে গল্প শোনে
একেবারে চুপ।
তারি সঙ্গে মনে পড়ে
মেঘলা দিনের গান—
‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান। ‘
কবে বিষ্টি পড়েছিল,
বান এল সে কোথা।
শিবঠাকুরের বিয়ে হল,
কবেকার সে কথা।
সেদিনও কি এম্নিতরো
মেঘের ঘটাখানা।
থেকে থেকে বাজ বিজুলি
দিচ্ছিল কি হানা।
তিন কন্যে বিয়ে করে
কী হল তার শেষে।
না জানি কোন্ নদীর ধারে,
না জানি কোন্ দেশে,
কোন্ ছেলেরে ঘুম পাড়াতে
কে গাহিল গান—
‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান।
বৈজ্ঞানিক
যেম্নি মা গো গুরু গুরু
মেঘের পেলে সাড়া
যেম্নি এল আষাঢ় মাসে
বৃষ্টিজলের ধারা,
পুবে হাওয়া মাঠ পেরিয়ে
যেম্নি পড়ল আসি
বাঁশ-বাগানে সোঁ সোঁ করে
বাজিয়ে দিয়ে বাঁশি—
অম্নি দেখ্ মা, চেয়ে—
সকল মাটি ছেয়ে
কোথা থেকে উঠল যে ফুল
এত রাশি রাশি।
তুই যে ভাবিস ওরা কেবল
অম্নি যেন ফুল,
আমার মনে হয় মা, তোদের
সেটা ভারি ভুল।
ওরা সব ইস্কুলের ছেলে,
পুঁথি-পত্র কাঁখে
মাটির নীচে ওরা ওদের
পাঠশালাতে থাকে।
ওরা পড়া করে
দুয়োর-বন্ধ ঘরে,
খেলতে চাইলে গুরুমশায়
দাঁড় করিয়ে রাখে।
বোশেখ-জষ্টি মাসকে ওরা
দুপুর বেলা কয়,
আষাঢ় হলে আঁধার করে
বিকেল ওদের হয়।
ডালপালারা শব্দ করে
ঘনবনের মাঝে,
মেঘের ডাকে তখন ওদের
সাড়ে চারটে বাজে।
অমনি ছুটি পেয়ে
আসে সবাই ধেয়ে,
হলদে রাঙা সবুজ সাদা
কত রকম সাজে।
জানিস মা গো, ওদের যেন
আকাশেতেই বাড়ি,
রাত্রে যেথায় তারাগুলি
দাঁড়ায় সারি সারি।
দেখিস নে মা, বাগান ছেয়ে
ব্যস্ত ওরা কত!
বুঝতে পারিস কেন ওদের
তাড়াতাড়ি অত?
জানিস কি কার কাছে
হাত বাড়িয়ে আছে।
মা কি ওদের নেইকো ভাবিস
আমার মায়ের মতো?
ব্যাকুল
অমন করে আছিস কেন মা গো,
খোকারে তোর কোলে নিবি না গো?
পা ছড়িয়ে ঘরের কোণে
কী যে ভাবিস আপন মনে,
এখনো তোর হয় নি তো চুল বাঁধা।
বৃষ্টিতে যায় মাথা ভিজে,
জানলা খুলে দেখিস কী যে—
কাপড়ে যে লাগবে ধুলোকাদা।
ওই তো গেল চারটে বেজে,
ছুটি হল ইস্কুলে যে—
দাদা আসবে মনে নেইকো সিটি।
বেলা অম্নি গেল বয়ে,
কেন আছিস অমন হয়ে—
আজকে বুঝি পাস নি বাবার চিঠি।
পেয়াদাটা ঝুলির থেকে
সবার চিঠি গেল রেখে—
বাবার চিঠি রোজ কেন সে দেয় না?
পড়বে বলে আপনি রাখে,
যায় সে চলে ঝুলি – কাঁখে,
পেয়াদাটা ভারি দুষ্টু স্যায়না।
মা গো মা, তুই আমার কথা শোন্,
ভাবিস নে মা, অমন সারা ক্ষণ।
কালকে যখন হাটের বারে
বাজার করতে যাবে পারে
কাগজ কলম আনতে বলিস ঝিকে।
দেখো ভুল করব না কোনো—
ক খ থেকে মূর্ধন্য ণ
বাবার চিঠি আমিই দেব লিখে।
কেন মা, তুই হাসিস কেন।
বাবার মতো আমি যেন
অমন ভালো লিখতে পারি নেকো,
লাইন কেটে মোটা মোটা
বড়ো বড়ো গোটা গোটা
লিখব যখন তখন তুমি দেখো।
চিঠি লেখা হলে পরে
বাবার মতো বুদ্ধি করে
ভাবছ দেব ঝুলির মধ্যে ফেলে?
কক্খনো না, আপনি নিয়ে
যাব তোমায় পড়িয়ে দিয়ে,
ভালো চিঠি দেয় না ওরা পেলে।
ভিতরে ও বাহিরে
খোকা থাকে জগৎ-মায়ের
অন্তঃপুরে—
তাই সে শোনে কত যে গান
কতই সুরে।
নানান রঙে রাঙিয়ে দিয়ে
আকাশ পাতাল
মা রচেছেন খোকার খেলা-
ঘরের চাতাল।
তিনি হাসেন, যখন তরু-
লতার দলে
খোকার কাছে পাতা নেড়ে
প্রলাপ বলে।
সকল নিয়ম উড়িয়ে দিয়ে
সূর্য শশী
খোকার সাথে হাসে, যেন
এক-বয়সী।
সত্যবুড়ো নানা রঙের
মুখোশ পরে
শিশুর সনে শিশুর মতো
গল্প করে।
চরাচরের সকল কর্ম
করে হেলা
মা যে আসেন খোকার সঙ্গে
করতে খেলা।
খোকার জন্যে করেন সৃষ্টি
যা ইচ্ছে তাই—
কোনো নিয়ম কোনো বাধা-
বিপত্তি নাই।
বোবাদেরও কথা বলান
খোকার কানে,
অসাড়কেও জাগিয়ে তোলেন
চেতন প্রাণে।
খোকার তরে গল্প রচে
বর্ষা শরৎ,
খেলার গৃহ হয়ে ওঠে
বিশ্বজগৎ।
খোকা তারি মাঝখানেতে
বেড়ায় ঘুরে,
খোকা থাকে জগৎ-মায়ের
অন্তঃপুরে।
আমরা থাকি জগৎ-পিতার
বিদ্যালয়ে—
উঠেছে ঘর পাথর-গাঁথা
দেয়াল লয়ে।
জ্যোতিষশাস্ত্র-মতে চলে
সূর্য শশী,
নিয়ম থাকে বাগিয়ে ল’য়ে
রশারশি।
এম্নি ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে
বৃক্ষ লতা,
যেন তারা বোঝেই নাকো
কোনোই কথা।
চাঁপার ডালে চাঁপা ফোটে
এম্নি ভানে
যেন তারা সাত ভায়েরে
কেউ না জানে।
মেঘেরা চায় এম্নিতরো
অবোধ ভাবে,
যেন তারা জানেই নাকো
কোথায় যাবে।
ভাঙা পুতুল গড়ায় ভুঁয়ে
সকল বেলা,
যেন তারা কেবল শুধু
মাটির ঢেলা।
দিঘি থাকে নীরব হয়ে
দিবারাত্র,
নাগকন্যের কথা যেন
গল্পমাত্র।
সুখদুঃখ এম্নি বুকে
চেপে রহে,
যেন তারা কিছুমাত্র
গল্প নহে।
যেমন আছে তেম্নি থাকে
যে যাহা তাই—
আর যে কিছু হবে এমন
ক্ষমতা নাই।
বিশ্বগুরু-মশায় থাকেন
কঠিন হয়ে,
আমরা থাকি জগৎ-পিতার
বিদ্যালয়ে।
মা-লক্ষ্মী
কার পানে মা, চেয়ে আছ
মেলি দুটি করুণ আঁখি।
কে ছিঁড়েছে ফুলের পাতা,
কে ধরেছে বনের পাখি।
কে কারে কী বলেছে গো,
কার প্রাণে বেজেছে ব্যথা—
করুণায় যে ভরে এল
দুখানি তোর আঁখির পাতা।
খেলতে খেলতে মায়ের আমার
আর বুঝি হল না খেলা।
ফুলের গুচ্ছ কোলে প’ড়ে—
কেন মা এ হেলাফেলা।
অনেক দুঃখ আছে হেথায়,
এ জগৎ যে দুঃখে ভরা—
তোমার দুটি আঁখির সুধায়
জুড়িয়ে গেল নিখিল ধরা।
লক্ষ্মী আমায় বল্ দেখি মা,
লুকিয়ে ছিলি কোন্ সাগরে।
সহসা আজ কাহার পুণ্যে
উদয় হলি মোদের ঘরে।
সঙ্গে করে নিয়ে এলি
হৃদয়-ভরা স্নেহের সুধা,
হৃদয় ঢেলে মিটিয়ে যাবি
এ জগতের প্রেমের ক্ষুধা।
থামো, থামো, ওর কাছেতে
কোয়ো না কেউ কঠোর কথা,
করুণ আঁখির বালাই নিয়ে
কেউ কারে দিয়ো না ব্যথা।
সইতে যদি না পারে ও,
কেঁদে যদি চলে যায়—
এ-ধরণীর পাষাণ-প্রাণে
ফুলের মতো ঝরে যায়।
ও যে আমার শিশিরকণা,
ও যে আমার সাঁঝের তারা—
কবে এল কবে যাবে
এই ভয়তে হই রে সারা।
মাঝি
আমার যেতে ইচ্ছে করে
নদীটির ওই পারে—
যেথায় ধারে ধারে
বাঁশের খোঁটায় ডিঙি নৌকো
বাঁধা সারে সারে।
কৃষাণেরা পার হয়ে যায়
লাঙল কাঁধে ফেলে;
জাল টেনে নেয় জেলে,
গোরু মহিষ সাঁৎরে নিয়ে
যায় রাখালের ছেলে।
সন্ধে হলে যেখান থেকে
সবাই ফেরে ঘরে
শুধু রাতদুপরে
শেয়ালগুলো ডেকে ওঠে
ঝাউডাঙাটার ‘পরে।
মা, যদি হও রাজি,
বড়ো হলে আমি হব
খেয়াঘাটের মাঝি।
শুনেছি ওর ভিতর দিকে
আছে জলার মতো।
বর্ষা হলে গত
ঝাঁকে ঝাঁকে আসে সেথায়
চখাচখী যত।
তারি ধারে ঘন হয়ে
জন্মেছে সব শর;
মানিক – জোড়ের ঘর,
কাদাখোঁচা পায়ের চিহ্ন
আঁকে পাঁকের ‘পর।
সন্ধ্যা হলে কত দিন মা,
দাঁড়িয়ে ছাদের কোণে
দেখেছি একমনে—
চাঁদের আলো লুটিয়ে পড়ে
সাদা কাশের বনে।
মা, যদি হও রাজি,
বড়ো হলে আমি হব
খেয়াঘাটের মাঝি।
এ – পার ও – পার দুই পারেতেই
যাব নৌকো বেয়ে।
যত ছেলেমেয়ে
স্নানের ঘাটে থেকে আমায়
দেখবে চেয়ে চেয়ে।
সূর্য যখন উঠবে মাথায়
অনেক বেলা হলে—
আসব তখন চলে
‘বড়ো খিদে পেয়েছে গো—
খেতে দাও মা’ বলে।
আবার আমি আসব ফিরে
আঁধার হলে সাঁঝে
তোমার ঘরের মাঝে।
বাবার মতো যাব না মা,
বিদেশে কোন্ কাজে।
মা, যদি হও রাজি,
বড়ো হলে আমি হব
খেয়াঘাটের মাঝি।
মাতৃবৎসল
মেঘের মধ্যে মা গো, যারা থাকে
তারা আমায় ডাকে, আমায় ডাকে।
বলে, ‘আমরা কেবল করি খেলা,
সকাল থেকে দুপুর সন্ধেবেলা।
সোনার খেলা খেলি আমরা ভোরে,
রুপোর খেলা খেলি চাঁদকে-ধরে। ‘
আমি বলি, ‘যাব কেমন করে। ‘
তারা বলে, ‘এসো মাঠের শেষে।
সেইখানেতে দাঁড়াবে হাত তুলে,
আমরা তোমায় নেব মেঘের দেশে। ‘
আমি বলি, ‘মা যে আমার ঘরে
বসে আছে চেয়ে আমার তরে,
তারে ছেড়ে থাকব কেমন করে। ‘
শুনে তারা হেসে যায় মা, ভেসে।
তার চেয়ে মা আমি হব মেঘ;
তুমি যেন হবে আমার চাঁদ—
দু হাত দিয়ে ফেলব তোমায় ঢেকে,
আকাশ হবে এই আমাদের ছাদ।
ঢেউয়ের মধ্যে মা গো যারা থাকে,
তারা আমায় ডাকে, আমায় ডাকে।
বলে, ‘আমরা কেবল করি গান
সকাল থেকে সকল দিনমান। ‘
তারা বলে, ‘কোন্ দেশে যে ভাই,
আমরা চলি ঠিকানা তার নাই। ‘
আমি বলি, ‘কেমন করে যাই। ‘
তারা বলে, ‘এসো ঘাটের শেষে।
সেইখানেতে দাঁড়াবে চোখ বুজে,
আমরা তোমায় নেব ঢেউয়ের দেশে। ‘
আমি বলি, ‘মা যে চেয়ে থাকে,
সন্ধে হলে নাম ধরে মোর ডাকে,
কেমন করে ছেড়ে থাকব তাকে। ‘
শুনে তারা হেসে যায় মা, ভেসে।
তার চেয়ে মা, আমি হব ঢেউ,
তুমি হবে অনেক দূরের দেশ।
লুটিয়ে আমি পড়ব তোমার কোলে,
কেউ আমাদের পাবে না উদ্দেশ।
মাস্টারবাবু
আমি আজ কানাই মাস্টার,
পোড়ো মোর বেড়ালছানাটি।
আমি ওকে মারি নে মা, বেত,
মিছিমিছি বসি নিয়ে কাঠি।
রোজ রোজ দেরি করে আসে,
পড়াতে দেয় না ও তো মন,
ডান পা তুলিয়ে তোলে হাই
যত আমি বলি ‘শোন্ শোন্’।
দিনরাত খেলা খেলা খেলা,
লেখায় পড়ায় ভারি হেলা।
আমি বলি ‘চ ছ জ ঝ ঞ’,
ও কেবল বলে ‘মিয়োঁ মিয়োঁ’।
প্রথম ভাগের পাতা খুলে
আমি ওরে বোঝাই মা, কত—
চুরি করে খাস নে কখনো,
ভালো হোস গোপালের মতো।
যত বলি সব হয় মিছে,
কথা যদি একটিও শোনে—
মাছ যদি দেখেছে কোথাও
কিছুই থাকে না আর মনে।
চড়াই পাখির দেখা পেলে
ছুটে যায় সব পড়া ফেলে।
যত বলি ‘চ ছ জ ঝ ঞ’,
দুষ্টুমি করে বলে ‘মিয়োঁ’।
আমি ওরে বলি বার বার,
‘পড়ার সময় তুমি পোড়ো—
তার পরে ছুটি হয়ে গেলে
খেলার সময় খেলা কোরো। ‘
ভালোমানুষের মতো থাকে,
আড়ে আড়ে চায় মুখপানে,
এম্নি সে ভান করে যেন
যা বলি বুঝেছে তার মানে।
একটু সুযোগ বোঝে যেই
কোথা যায় আর দেখা নেই।
আমি বলি ‘চ ছ জ ঝ ঞ’,
ও কেবল বলে ‘মিয়োঁ মিয়োঁ’।
রাজার বাড়ি
আমার রাজার বাড়ি কোথায় কেউ জানে না সে তো;
সে বাড়ি কি থাকত যদি লোকে জানতে পেত।
রুপো দিয়ে দেয়াল গাঁথা, সোনা দিয়ে ছাত,
থাকে থাকে সিঁড়ি ওঠে সাদা হাতির দাঁত।
সাত মহলা কোঠায় সেথা থাকেন সুয়োরানী,
সাত রাজার ধন মানিক – গাঁথা গলার মালাখানি।
আমার রাজার বাড়ি কোথায় শোন্ মা, কানে কানে—
ছাদের পাশে তুলসি গাছের টব আছে সেইখানে।
রাজকন্যা ঘুমোয় কোথা সাত সাগরের পারে,
আমি ছাড়া আর কেহ তো পায় না খুঁজে তারে।
দু হাতে তার কাঁকন দুটি, দুই কানে দুই দুল,
খাটের থেকে মাটির ‘পরে লুটিয়ে পড়ে চুল।
ঘুম ভেঙে তার যাবে যখন সোনার কাঠি ছুঁয়ে
হাসিতে তার মানিকগুলি পড়বে ঝ’রে ভুঁয়ে।
রাজকন্যা ঘুমোয় কোথা শোন্ মা, কানে কানে—
ছাদের পাশে তুলসি গাছের টব আছে যেইখানে।
তোমরা যখন ঘাটে চল স্নানের বেলা হলে
আমি তখন চুপি চুপি যাই সে ছাদে চলে।
পাঁচিল বেয়ে ছায়াখানি পড়ে মা, যেই কোণে
সেইখানেতে পা ছড়িয়ে বসি আপন মনে।
সঙ্গে শুধু নিয়ে আসি মিনি বেড়ালটাকে,
সেও জানে নাপিত ভায়া কোন্খানেতে থাকে।
জানিস নাপিতপাড়া কোথায়? শোন্ মা কানে কানে—
ছাদের পাশে তুলসি গাছের টব আছে যেইখানে।
লুকোচুরি
আমি যদি দুষ্টুমি করে
চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি,
ভোরের বেলা মা গো, ডালের ‘পরে
কচি পাতায় করি লুটোপুটি,
তবে তুমি আমার কাছে হারো,
তখন কি মা চিনতে আমায় পারো।
তুমি ডাক, ‘খোকা কোথায় ওরে। ‘
আমি শুধু হাসি চুপটি করে।
যখন তুমি থাকবে যে কাজ নিয়ে
সবই আমি দেখব নয়ন মেলে।
স্নানটি করে চাঁপার তলা দিয়ে
আসবে তুমি পিঠেতে চুল ফেলে;
এখান দিয়ে পুজোর ঘরে যাবে,
দূরের থেকে ফুলের গন্ধ পাবে—
তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে
তোমার খোকার গায়ের গন্ধ আসে।
দুপুর বেলা মহাভারত-হাতে
বসবে তুমি সবার খাওয়া হলে,
গাছের ছায়া ঘরের জানালাতে
পড়বে এসে তোমার পিঠে কোলে,
আমি আমার ছোট্ট ছায়াখানি
দোলাব তোর বইয়ের ‘পরে আনি—
তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে
তোমার চোখে খোকার ছায়া ভাসে।
সন্ধেবেলায় প্রদীপখানি জ্বেলে
যখন তুমি যাবে গোয়ালঘরে
তখন আমি ফুলের খেলা খেলে
টুপ্ করে মা , পড়ব ভুঁয়ে ঝরে।
আবার আমি তোমার খোকা হব,
‘গল্প বলো’ তোমায় গিয়ে কব।
তুমি বলবে, ‘দুষ্টু, ছিলি কোথা। ‘
আমি বলব, ‘ বলব না সে কথা। ‘
শীত
পাখি বলে ‘আমি চলিলাম’,
ফুল বলে ‘আমি ফুটিব না’,
মলয় কহিয়া গেল শুধু
‘বনে বনে আমি ছুটিব না’।
কিশলয় মাথাটি না তুলে
মরিয়া পড়িয়া গেল ঝরি,
সায়াহ্ন ধুমলঘন বাস
টানি দিল মুখের উপরি।
পাখি কেন গেল গো চলিয়া,
কেন ফুল কেন সে ফুটে না।
চপল মলয় সমীরণ
বনে বনে কেন সে ছুটে না।
শীতের হৃদয় গেছে চলে,
অসাড় হয়েছে তার মন,
ত্রিবলিবলিত তার ভাল
কঠোর জ্ঞানের নিকেতন।
জ্যোৎস্নার যৌবন-ভরা রূপ,
ফুলের যৌবন পরিমল,
মলয়ের বাল্যখেলা যত,
পল্লবের বাল্য – কোলাহল—
সকলি সে মনে করে পাপ,
মনে করে প্রকৃতির ভ্রম,
ছবির মতন বসে থাকা
সেই জানে জ্ঞানীর ধরম।
তাই পাখি বলে ‘চলিলাম’,
ফুল বলে ‘আমি ফুটিব না’।
মলয় কহিয়া গেল শুধু
‘বনে বনে আমি ছুটিব না’।
আশা বলে ‘বসন্ত আসিবে’,
ফুল বলে ‘আমিও আসিব’,
পাখি বলে ‘আমিও গাহিব’,
চাঁদ বলে ‘আমিও হাসিব’।
বসন্তের নবীন হৃদয়
নূতন উঠেছে আঁখি মেলে—
যাহা দেখে তাই দেখে হাসে,
যাহা পায় তাই নিয়ে খেলে।
মনে তার শত আশা জাগে,
কী যে চায় আপনি না বুঝে—
প্রাণ তার দশ দিকে ধায়
প্রাণের মানুষ খুঁজে খুঁজে।
ফুল ফুটে, তারো মুখ ফুটে—
পাখি গায়, সেও গান গায়—
বাতাস বুকের কাছে এলে
গলা ধ’রে দুজনে খেলায়।
তাই শুনি ‘বসন্ত আসিবে’
ফুল বলে ‘আমিও আসিব’ ,
পাখি বলে ‘আমিও গাহিব’,
চাঁদ বলে ‘আমিও হাসিব’।
শীত, তুমি হেথা কেন এলে।
উত্তরে তোমার দেশ আছে—
পাখি সেথা নাহি গাহে গান,
ফুল সেথা নাহি ফুটে গাছে।
সকলি তুষারমরুময়,
সকলিআঁধার জনহীন—
সেথায় একেলা বসি বসি
জ্ঞানী গো, কাটায়ো তব দিন।
শীতের বিদায়
বসন্ত বালক মুখ-ভরা হাসিটি,
বাতাস ব’য়ে ওড়ে চুল—
শীত চলে যায়, মারে তার গায়
মোটা মোটা গোটা ফুল।
আঁচল ভরে গেছে শত ফুলের মেলা,
গোলাপ ছুঁড়ে মারে টগর চাঁপা বেলা—
শীত বলে, ‘ভাই, এ কেমন খেলা,
যাবার বেলা হল, আসি। ‘
বসন্ত হাসিয়ে বসন ধ’রে টানে,
পাগল করে দেয় কুহু কুহু গানে,
ফুলের গন্ধ নিয়ে প্রাণের ‘পরে হানে—
হাসির ‘পরে হানে হাসি।
ওড়ে ফুলের রেণু, ফুলের পরিমল,
ফুলের পাপড়ি উড়ে করে যে বিকল—
কুসুমিত শাখা, বনপথ ঢাকা,
ফুলের ‘পরে পড়ে ফুল।
দক্ষিনে বাতাসে ওড়ে শীতের বেশ,
উড়ে উড়ে পড়ে শীতের শুভ্র কেশ;
কোন্ পথে যাবে না পায় উদ্দেশ,
হয়ে যায় দিক ভুল।
বসন্ত বালক হেসেই কুটিকুটি,
টলমল করে রাঙা চরণ দুটি,
গান গেয়ে পিছে ধায় ছুটিছুটি—
বনে লুটোপুটি যায়।
নদী তালি দেয় শত হাত তুলি,
বলাবলি করে ডালপালাগুলি,
লতায় লতায় হেসে কোলাকুলি—
অঙ্গুলি তুলি চায়।
রঙ্গ দেখে হাসে মল্লিকা মালতী,
আশেপাশে হাসে কতই জাতী যূথী,
মুখে বসন দিয়ে হাসে লজ্জাবতী—
বনফুলবধূগুলি।
কত পাখি ডাকে কত পাখি গায়,
কিচিমিচিকিচি কত উড়ে যায়,
এ পাশে ও পাশে মাথাটি হেলায়—
নাচে পুচ্ছখানি তুলি।
শীত চলে যায়, ফিরে ফিরে চায়,
মনে মনে ভাবে ‘এ কেমন বিদায়’—
হাসির জ্বালায় কাঁদিয়ে পালায়,
ফুলঘায় হার মানে।
শুকনো পাতা তার সঙ্গে উড়ে যায়,
উত্তরে বাতাস করে হায়-হায়—
আপাদমস্তক ঢেকে কুয়াশায়
শীত গেল কোন্খানে।
সমব্যথী
যদি খোকা না হয়ে
আমি হতেম কুকুর-ছানা—
তবে পাছে তোমার পাতে
আমি মুখ দিতে যাই ভাতে
তুমি করতে আমায় মানা?
সত্যি করে বল্
আমায় করিস নে মা, ছল—
বলতে আমায় ‘দূর দূর দূর।
কোথা থেকে এল এই কুকুর’?
যা মা, তবে যা মা,
আমায় কোলের থেকে নামা।
আমি খাব না তোর হাতে,
আমি খাব না তোর পাতে।
যদি খোকা না হয়ে
আমি হতেম তোমার টিয়ে,
তবে পাছে যাই মা, উড়ে
আমায় রাখতে শিকল দিয়ে?
সত্যি করে বল্
আমায় করিস নে মা, ছল—
বলতে আমায় ‘হতভাগা পাখি
শিকল কেটে দিতে চায় রে ফাঁকি’?
তবে নামিয়ে দে মা,
আমায় ভালোবাসিস নে মা।
আমি রব না তোর কোলে,
আমি বনেই যাব চলে।
সমালোচক
বাবা নাকি বই লেখে সব নিজে।
কিছুই বোঝা যায় না লেখেন কী যে।
সেদিন পড়ে শোনাচ্ছিলেন তোরে,
বুঝেছিলি?— বল্ মা সত্যি করে।
এমন লেখায় তবে
বল্ দেখি কী হবে।
তোর মুখে মা, যেমন কথা শুনি,
তেমন কেন লেখেন নাকো উনি।
ঠাকুরমা কি বাবাকে কক্খনো
রাজার কথা শোনায় নিকো কোনো।
সে – সব কথাগুলি
গেছেন বুঝি ভুলি?
স্নান করতে বেলা হল দেখে
তুমি কেবল যাও মা, ডেকে ডেকে—
খাবার নিয়ে তুমি বসেই থাকো,
সে কথা তাঁর মনেই থাকে নাকো।
করেন সারা বেলা
লেখা – লেখা খেলা।
বাবার ঘরে আমি খেলতে গেলে
তুমি আমায় বল, ‘দুষ্টু ছেলে!’
বক আমায় গোল করলে পরে—
‘দেখছিস নে লিখছে বাবা ঘরে!’
বল্ তো, সত্যি বল্,
লিখে কী হয় ফল।
আমি যখন বাবার খাতা টেনে
লিখি বসে দোয়াত কলম এনে—
ক খ গ ঘ ঙ হ য ব র,
আমার বেলা কেন মা, রাগ কর।
বাবা যখন লেখে
কথা কও না দেখে।
বড়ো বড়ো রুল – কাটা কাগজ
নষ্ট বাবা করেন না কি রোজ।
আমি যদি নৌকো করতে চাই
অম্নি বল, নষ্ট করতে নাই।
সাদা কাগজ কালো
করলে বুঝি ভালো?
সাত ভাই চম্পা
সাতটি চাঁপা সাতটি গাছে,
সাতটি চাঁপা ভাই—
রাঙা – বসন পারুলদিদি,
তুলনা তার নাই।
সাতটি সোনা চাঁপার মধ্যে
সাতটি সোনা মুখ,
পারুলদিদির কচি মুখটি
করতেছে টুক্টুক্।
ঘুমটি ভাঙে পাখির ডাকে,
রাতটি যে পোহালো—
ভোরের বেলা চাঁপায় পড়ে
চাঁপার মতো আলো।
শিশির দিয়ে মুখটি মেজে
মুখখানি বের করে
কী দেখছে সাত ভায়েতে
সারা সকাল ধ’রে।
দেখছে চেয়ে ফুলের বনে
গোলাপ ফোটে – ফোটে,
পাতায় পাতায় রোদ পড়েছে,
চিক্চিকিয়ে ওঠে।
দোলা দিয়ে বাতাস পালায়
দুষ্টু ছেলের মতো,
লতায় পাতায় হেলাদোলা
কোলাকুলি কত।
গাছটি কাঁপে নদীর ধারে
ছায়াটি কাঁপে জলে—
ফুলগুলি সব কেঁদে পড়ে
শিউলি গাছের তলে।
ফুলের থেকে মুখ বাড়িয়ে
দেখতেছে ভাই বোন—
দুখিণী এক মায়ের তরে
আকুল হল মন।
সারাটা দিন কেঁপে কেঁপে
পাতার ঝুরুঝুরু,
মনের সুখে বনের যেন
বুকের দুরুদুরু।
কেবল শুনি কুলুকুলু
একি ঢেউয়ের খেলা।
বনের মধ্যে ডাকে ঘুঘু
সারা দুপুরবেলা।
মৌমাছি সে গুনগুনিয়ে
খুঁজে বেড়ায় কাকে,
ঘাসের মধ্যে ঝিঁ ঝিঁ করে
ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকে।
ফুলের পাতায় মাথা রেখে
শুনতেছে ভাই বোন—
মায়ের কথা মনে পড়ে,
আকুল করে মন।
মেঘের পানে চেয়ে দেখে—
মেঘ চলেছে ভেসে,
রাজহাঁসেরা উড়ে উড়ে
চলেছে কোন্ দেশে।
প্রজাপতির বাড়ি কোথায়
জানে না তো কেউ,
সমস্ত দিন কোথায় চলে
লক্ষ হাজার ঢেউ।
দুপুর বেলা থেকে থেকে
উদাস হল বায়,
শুকনো পাতা খ’সে প’ড়ে
কোথায় উড়ে যায়!
ফুলের মাঝে দুই গালে হাত
দেখতেছে ভাই বোন—
মায়ের কথা পড়ছে মনে,
কাঁদছে পরান মন।
সন্ধে হলে জোনাই জ্বলে
পাতায় পাতায়,
অশথ গাছে দুটি তারা
গাছের মাথায়।
বাতাস বওয়া বন্ধ হল,
স্তব্ধ পাখির ডাক,
থেকে থেকে করছে কা – কা
দুটো – একটা কাক।
পশ্চিমেতে ঝিকিমিকি,
পুবে আঁধার করে—
সাতটি ভায়ে গুটিসুটি
চাঁপা ফুলের ঘরে।
‘গল্প বলো পারুলদিদি’
সাতটি চাঁপা ডাকে,
পারুলদিদির গল্প শুনে
মনে পড়ে মাকে।
প্রহর বাজে, রাত হয়েছে,
ঝাঁ ঝাঁ করে বন—
ফুলের মাঝে ঘুমিয়ে প’ল
আটটি ভাই বোন।
সাতটি তারা চেয়ে আছে
সাতটি চাঁপার বাগে,
চাঁদের আলো সাতটি ভায়ের
মুখের পরে লাগে।
ফুলের গন্ধ ঘিরে আছে
সাতটি ভায়ের তনু—
কোমন শয্যা কে পেতেছে
সাতটি ফুলের রেণু।
ফুলের মধ্যে সাত ভায়েতে
স্বপ্ন দেখে মাকে—
সকাল বেলা ‘জাগো জাগো’
পারুলদিদি ডাকে।
হাসিরাশি
নাম রেখেছি বাব্লারানী,
একরত্তি মেয়ে।
হাসিখুশি চাঁদের আলো
মুখটি আছে ছেয়ে।
ফুট্ফুটে তার দাঁত কখানি,
পুট্পুটে তার ঠোঁট।
মুখের মধ্যে কথাগুলি সব
উলোটপালোট।
কচি কচি হাত দুখানি,
কচি কচি মুঠি,
মুখ নেড়ে কেউ কথা ক’লে
হেসেই কুটি-কুটি।
তাই তাই তাই তালি দিয়ে
দুলে দুলে নড়ে,
চুলগুলি সব কালো কালো
মুখে এসে পড়ে।
‘চলি চলি পা পা’
টলি টলি যায়,
গরবিনী হেসে হেসে
আড়ে আড়ে চায়।
হাতটি তুলে চুড়ি দুগাছি
দেখায় যাকে তাকে,
হাসির সঙ্গে নেচে নেচে
নোলক দোলে নাকে।
রাঙা দুটি ঠোঁটের কাছে
মুক্তো আছে ফ’লে,
মায়ের চুমোখানি-যেন
মুক্তো হয়ে দোলে।
আকাশেতে চাঁদ দেখেছে,
দু হাত তুলে চায়,
মায়ের কোলে দুলে দুলে
ডাকে ‘আয় আয়’।
চাঁদের আঁখি জুড়িয়ে গেল
তার মুখেতে চেয়ে,
চাঁদ ভাবে কোত্থেকে এল
চাঁদের মতো মেয়ে।
কচি প্রাণের হাসিখানি
চাঁদের পানে ছোটে,
চাঁদের মুখের হাসি আরো
বেশি ফুঠে ওঠে।
এমন সাধের ডাক শুনে চাঁদ
কেমন করে আছে—
তারাগুলি ফেলে বুঝি
নেমে আসবে কাছে!
সুধামুখের হাসিখানি
চুরি করে নিয়ে
রাতারাতি পালিয়ে যাবে
মেঘের আড়াল দিয়ে।
আমরা তারে রাখব ধরে
রানীর পাশেতে।
হাসিরাশি বাঁধা রবে
হাসিরাশিতে।
০১.ভূমিকা (শিশু)
জগৎ – পারাবারের তীরে
ছেলেরা করে মেলা ।
অন্তহীন গগনতল
মাথার ‘পরে অচঞ্চল ,
ফেনিল ওই সুনীল জল
নাচিছে সারা বেলা ।
উঠিছে তটে কী কোলাহল —
ছেলেরা করে মেলা ।
বালুকা দিয়ে বাঁধিছে ঘর ,
ঝিনুক নিয়ে খেলা ।
বিপুল নীল সলিল -‘ পরি
ভাসায় তারা খেলার তরী
আপন হাতে হেলায় গড়ি
পাতায় – গাঁথা ভেলা ।
জগৎ – পারাবারের তীরে
ছেলেরা করে খেলা ।
জানে না তারা সাঁতার দেওয়া ,
জানে না জাল ফেলা ।
ডুবারি ডুবে মুকুতা চেয়ে ,
বণিক ধায় তরণী বেয়ে ,
ছেলেরা নুড়ি কুড়ায়ে পেয়ে
সাজায় বসি ঢেলা ।
রতন ধন খোঁজে না তারা ,
জানে না জাল ফেলা ।
ফেনিয়ে উঠে সাগর হাসে ,
হাসে সাগর – বেলা ।
ভীষণ ঢেউ শিশুর কানে
রচিছে গাথা তরল তানে ,
দোলনা ধরি যেমন গানে
জননী দেয় ঠেলা ।
সাগর খেলে শিশুর সাথে ,
হাসে সাগর – বেলা ।
জগৎ – পারাবারের তীরে
ছেলেরা করে মেলা ।
ঝঞ্ঝা ফিরে গগনতলে ,
তরণী ডুবে সুদূর জলে ,
মরণ – দূত উড়িয়া চলে ,
ছেলেরা করে খেলা ।
জগৎ – পারাবারের তীরে
শিশুর মহামেলা ।