মনে পড়া
মাকে আমার পড়ে না মনে ।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে
হঠাৎ অকারণে
একটা কী সুর গুনগুনিয়ে
কানে আমার বাজে ,
মায়ের কথা মিলায় যেন
আমার খেলার মাঝে ।
মা বুঝি গান গাইত , আমার
দোলনা ঠেলে ঠেলে ;
মা গিয়েছে , যেতে যেতে
গানটি গেছে ফেলে ।
মাকে আমার পড়ে না মনে ।
শুধু যখন আশ্বিনেতে
ভোরে শিউলিবনে
শিশির – ভেজা হাওয়া বেয়ে
ফুলের গন্ধ আসে ,
তখন কেন মায়ের কথা
আমার মনে ভাসে ?
কবে বুঝি আনত মা সেই
ফুলের সাজি বয়ে ,
পুজোর গন্ধ আসে যে তাই
মায়ের গন্ধ হয়ে ।
মাকে আমার পড়ে না মনে ।
শুধু যখন বসি গিয়ে
শোবার ঘরের কোণে ;
জানলা থেকে তাকাই দূরে
নীল আকাশের দিকে ,
মনে হয় মা আমার পানে
চাইছে অনিমিখে ।
কোলের ‘পরে ধরে কবে
দেখত আমায় চেয়ে ,
সেই চাউনি রেখে গেছে
সারা আকাশ ছেয়ে ।
মর্তবাসী
কাকা বলেন , সময় হলে
সবাই চ ‘ লে
যায় কোথা সেই স্বর্গ – পারে ।
বল্ তো কাকী
সত্যি তা কি
একেবারে ?
তিনি বলেন , যাবার আগে
তন্দ্রা লাগে
ঘণ্টা কখন ওঠে বাজি ,
দ্বারের পাশে
তখন আসে
ঘাটের মাঝি ।
বাবা গেছেন এমনি করে
কখন ভোরে
তখন আমি বিছানাতে ।
তেমনি মাখন
গেল কখন
অনেক রাতে ।
কিন্তু আমি বলছি তোমায়
সকল সময়
তোমার কাছেই করব খেলা ,
রইব জোরে
গলা ধরে
রাতের বেলা ।
সময় হলে মানব না তো ,
জানব না তো ,
ঘণ্টা মাঝির বাজল কবে ।
তাই কি রাজা
দেবেন সাজা
আমায় তবে ?
তোমরা বল , স্বর্গ ভালো
সেথায় আলো
রঙে রঙে আকাশ রাঙায় ,
সারা বেলা
ফুলের খেলা
পারুলডাঙায় !
হোক – না ভালো যত ইচ্ছে —
কেড়ে নিচ্ছে
কেই বা তাকে বলো , কাকী ?
যেমন আছি
তোমার কাছেই
তেমনি থাকি !
ওই আমাদের গোলাবাড়ি ,
গোরুর গাড়ি
পড়ে আছে চাকা – ভাঙা ,
গাবের ডালে
পাতার লালে
আকাশ রাঙা ।
সেথা বেড়ায় যক্ষীবুড়ি
গুড়িগুড়ি
আসশেওড়ার ঝোপে ঝাপে
ফুলের গাছে
দোয়েল নাচে
ছায়া কাঁপে ।
নুকিয়ে আমি সেথা পলাই ,
কানাই বলাই
দু – ভাই আসে পাড়ার থেকে ।
ভাঙা গাড়ি
দোলাই নাড়ি
ঝেঁকে ঝেঁকে ।
সন্ধেবেলায় গল্প বলে
রাখ কোলে ,
মিটমিটিয়ে জ্বলে বাতি ।
চালতা – শাখে
পেঁচা ডাকে ,
বাড়ে রাতি ।
স্বর্গে যাওয়া দেব ফাঁকি
বলছি , কাকী ,
দেখব আমায় কে কী করে ।
চিরকালই
রইব খালি
তোমার ঘরে ।
মুর্খু
নেই বা হলেম যেমন তোমার
অম্বিকে গোঁসাই ।
আমি তো , মা , চাই নে হতে
পণ্ডিতমশাই ।
নাই যদি হই ভালো ছেলে ,
কেবল যদি বেড়াই খেলে
তুঁতের ডালে খুঁজে বেড়াই
গুটিপোকার গুটি ,
মুর্খু হয়ে রইব তবে ?
আমার তাতে কীই বা হবে ,
মুর্খু যারা তাদেরই তো
সমস্তখন ছুটি ।
তারাই তো সব রাখাল ছেলে
গোরু চরায় মাঠে ।
নদীর ধারে বনে বনে
তাদের বেলা কাটে ।
ডিঙির ‘ পরে পাল তুলে দেয় ,
ঢেউয়ের মুখে নাও খুলে দেয় ,
ঝাউ কাটতে যায় চলে সব
নদীপারের চরে ।
তারাই মাঠে মাচা পেতে
পাখি তাড়ায় ফসল – খেতে ,
বাঁকে করে দই নিয়ে যায়
পাড়ার ঘরে ঘরে ।
কাস্তে হাতে চুবড়ি মাথায় ,
সন্ধে হলে পরে
ফেরে গাঁয়ে কৃষাণ ছেলে ,
মন যে কেমন করে ।
যখন গিয়ে পাঠশালাতে
দাগা বুলোই খাতার পাতে ,
গুরুমশাই দুপুরবেলায়
বসে বসে ঢোলে ,
হাঁকিয়ে গাড়ি কোন্ গাড়োয়ান
মাঠের পথে যায় গেয়ে গান ,
শুনে আমি পণ করি যে
মুর্খু হব বলে ।
দুপুরবেলায় চিল ডেকে যায় ;
হঠাৎ হাওয়া আসি
বাঁশ – বাগানে বাজায় যেন
সাপ – খেলাবার বাঁশি ।
পুবের দিকে বনের কোলে
বাদল – বেলার আঁচল দোলে ,
ডালে ডালে উছলে ওঠে
শিরীষফুলের ঢেউ ।
এরা যে পাঠ – ভোলার দলে
পাঠশালা সব ছাড়তে বলে ,
আমি জানি এরা তো , মা ,
পণ্ডিত নয় কেউ ।
যাঁরা অনেক পুঁথি পড়েন
তাঁদের অনেক মান ।
ঘরে ঘরে সবার কাছে
তাঁরা আদর পান ।
সঙ্গে তাঁদের ফেরে চেলা ,
ধুমধামে যায় সারা বেলা ,
আমি তো , মা , চাই নে আদর
তোমার আদর ছাড়া ।
তুমি যদি মুর্খু বলে
আমাকে মা না নাও কোলে
তবে আমি পালিয়ে যাব
বাদলা মেঘের পাড়া ।
সেখান থেকে বৃষ্টি হয়ে
ভিজিয়ে দেব চুল ।
ঘাটে যখন যাবে , আমি
করব হুলুস্থূল ।
রাত থাকতে অনেক ভোরে
আসব নেমে আঁধার করে ,
ঝড়ের হাওয়ায় ঢুকব ঘরে
দুয়ার ঠেলে ফেলে ,
তুমি বলবে মেলে আঁখি ,
‘ দুষ্টু দেয়া খেপল না কি ?’
আমি বলব , ‘ খেপেছে আজ
তোমার মুর্খু ছেলে ।
রবিবার
সোম মঙ্গল বুধ এরা সব
আসে তাড়াতাড়ি ,
এদের ঘরে আছে বুঝি
মস্ত হাওয়া – গাড়ি ?
রবিবার সে কেন , মা গো ,
এমন দেরি করে ?
ধীরে ধীরে পৌঁছয় সে
সকল বারের পরে ।
আকাশ – পারে তার বাড়িটি
দূর কি সবার চেয়ে ?
সে বুঝি মা তোমার মতো
গরিব – ঘরের মেয়ে ?
সোম মঙ্গল বুধের খেয়াল
থাকবারই জন্যেই ,
বাড়ি – ফেরার দিকে ওদের
একটুও মন নেই ।
রবিবারকে কে যে এমন
বিষম তাড়া করে ,
ঘণ্টাগুলো বাজায় যেন
আধ ঘণ্টার পরে ।
আকাশ – পারে বাড়িতে তার
কাজ আছে সব – চেয়ে ?
সে বুঝি , মা , তোমার মতো
গরিব – ঘরের মেয়ে ।
সোম মঙ্গল বুধের যেন
মুখগুলো সব হাঁড়ি
ছোটো ছেলের সঙ্গে তাদের
বিষম আড়াআড়ি ।
কিন্তু শনির রাতের শেষে
যেমনি উঠি জেগে ,
রবিবারের মুখে দেখি
হাসিই আছে লেগে ।
যাবার বেলায় যায় সে কেঁদে
মোদের মুখে চেয়ে ।
সে বুঝি , মা , তোমার মতো
গরিব ঘরের মেয়ে ?