সেদিন গেল ছেড়ে ,
আমার পথ নিল কে কেড়ে ,
আমার হারাল একতারা ।
কে নিল গো টেনে ,
আমায় পাঠশালাতে এনে ,
আমার এল গুরুমশায় ।
মন সদা যার চলে
যত ঘরছাড়াদের দলে
তারে ঘরে কেন বসায় ?
কও তো আমায় ভাই ,
তোমার গুরুমশায় নাই ?
আমি যখন দেখি ভেবে
বুঝতে পারি খাঁটি ,
তোমার বুকের একতারাটি ,
তোমায় ঐ তো পড়া দেবে ।
তোমার কানে কানে
ওরই গুনগুনানি গানে
তোমায় কোন্ কথা যে কয় !
সব কি তুমি বোঝ ?
তারই মানে যেন খোঁজ
কেবল ফিরে ভুবনময় ।
ওরই কাছে বুঝি
আছে তোমার নাচের পুঁজি ,
তোমার খেপা পায়ের ছুটি ?
ওরই সুরের বোলে
তোমার গলার মালা দোলে
তোমার দোলে মাথার ঝুঁটি ।
মন যে আমার পালায়
তোমার একতারা – পাঠশালায় ,
আমায় ভুলিয়ে দিতে পার ?
নেবে আমায় সাথে ?
এ – সব পণ্ডিতেরই হাতে
আমায় কেন সবাই মার ?
ভুলিয়ে দিয়ে পড়া
আমায় শেখাও সুরে – গড়া
তোমার তালা – ভাঙার পাঠ ।
আর কিছু না চাই ,
যেন আকাশখানা পাই ,
আর পালিয়ে যাবার মাঠ ।
দূরে কেন আছ ?
দ্বারের আগল ধরে নাচো ,
বাউল আমারই এইখানে ।
সমস্ত দিন ধ ‘ রে
যেন মাতন ওঠে ভ ‘ রে
তোমার ভাঙন – লাগা গানে ।
বাণী-বিনিময়
মা , যদি তুই আকাশ হতিস ,
আমি চাঁপার গাছ ,
তোর সাথে মোর বিনি – কথায়
হত কথার নাচ ।
তোর হাওয়া মোর ডালে ডালে
কেবল থেকে থেকে
কত রকম নাচন দিয়ে
আমায় যেত ডেকে ।
মা ব’লে তার সাড়া দেব
কথা কোথায় পাই ,
পাতায় পাতায় সাড়া আমার
নেচে উঠত তাই ।
তোর আলো মোর শিশির – ফোঁটায়
আমার কানে কানে
টলমলিয়ে কী বলত যে
ঝলমলানির গানে ।
আমি তখন ফুটিয়ে দিতেম
আমার যত কুঁড়ি ,
কথা কইতে গিয়ে তারা
নাচন দিত জুড়ি ।
উড়ো মেঘের ছায়াটি তোর
কোথায় থেকে এসে
আমার ছায়ায় ঘনিয়ে উঠে
কোথায় যেত ভেসে ।
সেই হত তোর বাদল – বেলার
রূপকথাটির মতো ;
রাজপুত্তুর ঘর ছেড়ে যায়
পেরিয়ে রাজ্য কত ;
সেই আমারে বলে যেত
কোথায় আলেখ – লতা ,
সাগরপারের দৈত্যপুরের
রাজকন্যার কথা ;
দেখতে পেতেম দুয়োরানীর
চক্ষু ভর – ভর ,
শিউরে উঠে পাতা আমার
কাঁপত থরোথরো ।
হঠাৎ কখন বৃষ্টি তোমার
হাওয়ার পাছে পাছে
নামত আমার পাতায় পাতায়
টাপুর – টুপুর নাচে ;
সেই হত তোর কাঁদন – সুরে
রামায়ণের পড়া ,
সেই হত তোর গুনগুনিয়ে
শ্রাবণ – দিনের ছড়া ।
মা , তুই হতিস নীলবরনী ,
আমি সবুজ কাঁচা ;
তোর হত , মা , আলোর হাসি ,
আমার পাতার নাচা ।
তোর হত , মা , উপর থেকে
নয়ন মেলে চাওয়া ,
আমার হত আঁকুবাঁকু
হাত তুলে গান গাওয়া ।
তোর হত , মা চিরকালের
তারার মণিমালা ,
আমার হত দিনে দিনে
ফুল – ফোটাবার পালা ।
বুড়ি
এক যে ছিল চাঁদের কোণায়
চরকা – কাটা বুড়ি
পুরাণে তার বয়স লেখে
সাতশো হাজার কুড়ি ।
সাদা সুতোয় জাল বোনে সে
হয় না বুনন সারা
পণ ছিল তার ধরবে জালে
লক্ষ কোটি তারা ।
হেনকালে কখন আঁখি
পড়ল ঘুমে ঢুলে ,
স্বপনে তার বয়সখানা
বেবাক গেল ভুলে ।
ঘুমের পথে পথ হারিয়ে ,
মায়ের কোলে এসে
পূর্ণ চাঁদের হাসিখানি
ছড়িয়ে দিল হেসে ।
সন্ধেবেলায় আকাশ চেয়ে
কী পড়ে তার মনে ।
চাঁদকে করে ডাকাডাকি ,
চাঁদ হাসে আর শোনে ।
যে – পথ দিয়ে এসেছিল
স্বপন – সাগর – তীরে
দু – হাত তুলে সে – পথ দিয়ে
চায় সে যেতে ফিরে ।
হেনকালে মায়ের মুখে
যেমনি আঁখি তোলে
চাঁদে ফেরার পথখানি যে
তক্খনি সে ভোলে ।
কেউ জানে না কোথায় বাসা ,
এল কী পথ বেয়ে ,
কেউ জানে না , এই মেয়ে সেই
আদ্যিকালের মেয়ে ।
বয়সখানার খ্যাতি তবু
রইল জগৎ জুড়ি —
পাড়ার লোকে যে দেখে সেই
ডাকে , ‘ বুড়ি বুড়ি ‘ ।
সব – চেয়ে যে পুরানো সে ,
কোন্ মন্ত্রের বলে
সব – চেয়ে আজ নতুন হয়ে
নামল ধরাতলে ।
বৃষ্টি রৌদ্র
ঝুঁটি – বাঁধা ডাকাত সেজে
দল বেঁধে মেঘ চলেছে যে
আজকে সারাবেলা ।
কালো ঝাঁপির মধ্যে ভরে
সুর্যিকে নেয় চুরি করে ,
ভয় – দেখাবার খেলা ।
বাতাস তাদের ধরতে মিছে
হাঁপিয়ে ছোটে পিছে পিছে ,
যায় না তাদের ধরা ।
আজ যেন ওই জড়োসড়ো
আকাশ জুড়ে মস্ত বড়ো
মন – কেমন – করা ।
বটের ডালে ডানা – ভিজে
কাক বসে ওই ভাবছে কী যে ,
চড়ুইগুলো চুপ ।
বৃষ্টি হয়ে গেছে ভোরে
শজনেপাতায় ঝরে ঝরে
জল পড়ে টুপটুপ ।
লেজের মধ্যে মাথা থুয়ে
খাঁদন কুকুর আছে শুয়ে
কেমন একরকম ।
দালানটাতে ঘুরে ঘুরে
পায়রাগুলো কাঁদন – সুরে
ডাকছে বকবকম ।
কার্তিকে ওই ধানের খেতে
ভিজে হাওয়া উঠল মেতে
সবুজ ঢেউয়ের ‘পরে ।
পরশ লেগে দিশে দিশে
হিহি করে ধানের শিষে
শীতের কাঁপন ধরে ।
ঘোষাল – পাড়ার লক্ষ্মী বুড়ি
ছেঁড়া কাঁথায় মুড়িসুড়ি
গেছে পুকুরপাড়ে ,
দেখতে ভালো পায় না চোখে
বিড়বিড়িয়ে বকে বকে
শাক তোলে , ঘাড় নাড়ে ।
ঐ ঝমাঝম বৃষ্টি নামে
মাঠের পারে দূরের গ্রামে
ঝাপসা বাঁশের বন ।
গোরুটা কার থেকে থেকে
খোঁটায় – বাঁধা উঠছে ডেকে
ভিজছে সারাক্ষণ ।
গদাই কুমোর অনেক ভোরে
সাজিয়ে নিয়ে উঁচু ক’রে
হাঁড়ির উপর হাঁড়ি
চলছে রবিবারের হাটে ,
গামছা মাথায় জলের ছাঁটে
হাঁকিয়ে গোরুর গাড়ি ।
বন্ধ আমার রইল খেলা ,
ছুটির দিনে সারাবেলা
কাটবে কেমন করে ?
মনে হচ্ছে এমনিতরো
ঝরবে বৃষ্টি ঝরোঝরো
দিনরাত্তির ধরে !
এমন সময় পুবের কোণে
কখন যেন অন্যমনে
ফাঁক ধরে ওই মেঘে ,
মুখের চাদর সরিয়ে ফেলে
হঠাৎ চোখের পাতা মেলে
আকাশ ওঠে জেগে ।
ছিঁড়ে – যাওয়া মেঘের থেকে
পুকুরে রোদ পড়ে বেঁকে ,
লাগায় ঝিলিমিলি ।
বাঁশবাগানের মাথায় মাথায়
তেঁতুলগাছের পাতায় পাতায়
হাসায় খিলিখিলি ।
হঠাৎ কিসের মন্ত্র এসে
ভুলিয়ে দিলে একনিমেষে
বাদলবেলার কথা ।
হারিয়ে – পাওয়া আলোটিরে
নাচায় ডালে ফিরে ফিরে
বেড়ার ঝুমকোলতা ।
উপর নিচে আকাশ ভরে
এমন বদল কেমন করে
হয় , সে – কথাই ভাবি ।
উলটপালট খেলাটি এই ,
সাজের তো তার সীমানা নেই ,
কার কাছে তার চাবি ?
এমন যে ঘোর মন – খারাপি
বুকের মধ্যে ছিল চাপি
সমস্ত খন আজি —
হঠাৎ দেখি সবই মিছে
নাই কিছু তার আগে পিছে
এ যেন কার বাজি ।