দিন ফুরোবে , সাঁঝের আঁধার
নামবে তালের গাছে ।
তখন এসে ঘরের কোণে
বসব কোলের কাছে ।
থাকবে না তোর কাজ কিছু তো ,
রইবে না তোর কোনো ছুতো ,
রূপকথা তোর বলতে হবে
রোজই নতুন করে ।
সীতার বনবাসের ছড়া
সবগুলি তোর আছে পড়া ;
সুর করে তাই আগাগোড়া
গাইতে হবে তোরে ।
তার পরে যেই অশথবনে
ডাকবে পেঁচা , আমার মনে
একটুখানি ভয় করবে
রাত্রি নিষুত হলে ।
তোমার বুকে মুখটি গুঁজে
ঘুমেতে চোখ আসবে বুজে —
তখন আবার বাবার কাছে
যাস নে যেন চলে !
দূর
পুজোর ছুটি আসে যখন
বকসারেতে যাবার পথে —
দূরের দেশে যাচ্ছি ভেবে
ঘুম হয় না কোনোমতে ।
সেখানে যেই নতুন বাসায়
হপ্তা দুয়েক খেলায় কাটে
দূর কি আবার পালিয়ে আসে
আমাদেরই বাড়ির ঘাটে !
দূরের সঙ্গে কাছের কেবল
কেনই যে এই লুকোচুরি ,
দূর কেন যে করে এমন
দিনরাত্তির ঘোরাঘুরি ।
আমরা যেমন ছুটি হলে
ঘরবাড়ি সব ফেলে রেখে
রেলে চড়ে পশ্চিমে যাই
বেরিয়ে পড়ি দেশের থেকে ,
তেমনিতরো সকালবেলা
ছুটিয়ে আলো আকাশেতে
রাতের থেকে দিন যে বেরোয়
দূরকে বুঝি খুঁজে পেতে ?
সে – ও তো যায় পশ্চিমেতেই ,
ঘুরে ঘুরে সন্ধে হলে ,
তখন দেখে রাতের মাঝেই
দূর সে আবার গেছে চলে ।
সবাই যেন পলাতকা
মন টেকে না কাছের বাসায় ।
দলে দলে পলে পলে
কেবল চলে দূরের আশায় ।
পাতায় পাতায় পায়ের ধ্বনি ,
ঢেউয়ে ঢেউয়ে ডাকাডাকি ,
হাওয়ায় হাওয়ায় যাওয়ার বাঁশি
কেবল বাজে থাকি থাকি ।
আমায় এরা যেতে বলে ,
যদি বা যাই , জানি তবে
দূরকে খুঁজে খুঁজে শেষে
মায়ের কাছেই ফিরতে হবে ।
পথহারা
আজকে আমি কতদূর যে
গিয়েছিলেম চলে !
যত তুমি ভাবতে পারো
তার চেয়ে সে অনেক আরো ,
শেষ করতে পারব না তা
তোমায় ব’লে ব’লে ।
অনেক দূর সে , আরো দূর সে ,
আরো অনেক দূর ।
মাঝখানেতে কত যে বেত ,
কত যে বাঁশ , কত যে খেত ,
ছাড়িয়ে ওদের ঠাকুরবাড়ি
ছাড়িয়ে তালিমপুর ।
পেরিয়ে গেলেম যেতে যেতে
সাত – কুশি সব গ্রাম ,
ধানের গোলা গুনব কত
জোদ্দারদের গোলার মতো ,
সেখানে যে মোড়ল কারা
জানি নে তার নাম ।
একে একে মাঠ পেরোলুম
কত মাঠের পরে ।
তার পরে , উঃ , বলি মা শোন্ ,
সামনে এল প্রকাণ্ড বন ,
ভিতরে তার ঢুকতে গেলে
গা ছ্ম্ছ্ম্ করে ।
জামতলাতে বুড়ি ছিল ,
বললে ‘ খবরদার ‘!
আমি বললেম বারণ শুনে
‘ ছ – পণ কড়ি এই নে গুনে ‘,
যতক্ষণ সে গুনতে থাকে
হয়ে গেলাম পার ।
কিছুরই শেষ নেই কোত্থাও
আকাশ পাতাল জুড়ি ।
যতই চলি যতই চলি
বেড়েই চলে বনের গলি ,
কালো মুখোশপরা আঁধার
সাজল জুজুবুড়ি ।
খেজুরগাছের মাথায় বসে
দেখছে কারা ঝুঁকি ।
কারা যে সব ঝোপের পাশে
একটুখানি মুচকে হাসে ,
বেঁটে বেঁটে মানুষগুলো
কেবল মারে উঁকি ।
আমায় যেন চোখ টিপছে
বুড়ো গাছের গুঁড়ি ।
লম্বা লম্বা কাদের পা যে
ঝুলছে ডালের মাঝে মাঝে ,
মনে হচ্ছে পিঠে আমার
কে দিল সুড়সুড়ি ।
ফিসফিসিয়ে কইছে কথা
দেখতে না পাই কে সে ।
অন্ধকারে দুদ্দাড়িয়ে
কে যে কারে যায় তাড়িয়ে ,
কী জানি কী গা চেটে যায়
হঠাৎ কাছ এসে ।
ফুরোয় না পথ ভাবছি আমি
ফিরব কেমন করে ।
সামনে দেখি কিসের ছায়া ,
ডেকে বলি , ‘ শেয়াল ভায়া ,
মায়ের গাঁয়ের পথ তোরা কেউ
দেখিয়ে দে – না মোরে । ‘
কয় না কিছুই , চুপটি করে
কেবল মাথা নাড়ে ।
সিঙ্গিমামা কোথা থেকে
হঠাৎ কখন এসে ডেকে
কে জানে মা , হালুম ক’রে
পড়ল যে কার ঘাড়ে ।
বল্ দেখি তুই , কেমন করে
ফিরে পেলেম মাকে ?
কেউ জানে না কেমন করে ;
কানে কানে বলব তোরে ?
যেমনি স্বপন ভেঙে গেল
সিঙ্গিমামার ডাকে ।
পুতুল ভাঙা
সাত – আটটে সাতাশ ‘, আমি
বলেছিলাম বলে
গুরুমশায় আমার ‘পরে
উঠল রাগে জ্বলে ।
মা গো , তুমি পাঁচ পয়সায়
এবার রথের দিনে
সেই যে রঙিন পুতুলখানি
আপনি দিলে কিনে
খাতার নিচে ছিল ঢাকা ;
দেখালে এক ছেলে ,
গুরুমশায় রেগেমেগে
ভেঙে দিলেন ফেলে ।
বললেন , ‘ তোর দিনরাত্তির
কেবল যত খেলা ।
একটুও তোর মন বসে না
পড়াশুনার বেলা! ‘
মা গো , আমি জানাই কাকে ?
ওঁর কি গুরু আছে ?
আমি যদি নালিশ করি
এক্খনি তাঁর কাছে ?
কোনোরকম খেলার পুতুল
নেই কি , মা , ওঁর ঘরে
সত্যি কি ওঁর একটুও মন
নেই পুতুলের ‘পরে ?
সকাল – সাঁজে তাদের নিয়ে
করতে গিয়ে খেলা
কোনো পড়ায় করেন নি কি
কোনোরকম হেলা ?
ওঁর যদি সেই পুতুল নিয়ে
ভাঙেন কেহ রাগে ,
বল দেখি মা , ওঁর মনে তা
কেমনতরো লাগে ?
বাউল
দূরে অশথতলায়
পুঁতির কণ্ঠিখানি গলায়
বাউল দাঁড়িয়ে কেন আছ ?
সামনে আঙিনাতে
তোমার একতারাটি হাতে
তুমি সুর লাগিয়ে নাচো !
পথে করতে খেলা
আমার কখন হল বেলা
আমায় শাস্তি দিল তাই ।
ইচ্ছে হোথায় নাবি
কিন্তু ঘরে বন্ধ চাবি
আমার বেরোতে পথ নাই ।
বাড়ি ফেরার তরে
তোমায় কেউ না তাড়া করে
তোমার নাই কোনো পাঠশালা ।
সমস্ত দিন কাটে
তোমার পথে ঘাটে মাঠে
তোমার ঘরেতে নেই তালা ।
তাই তো তোমার নাচে
আমার প্রাণ যেন ভাই বাঁচে —
আমার মন যেন পায় ছুটি ।
ওগো তোমার নাচে
যেন ঢেউয়ের দোলা আছে ,
ঝড়ে গাছের লুটোপুটি ।
অনেক দূরের দেশ
আমার চোখে লাগায় রেশ ,
যখন তোমায় দেখি পথে ।
দেখতে পায় যে মন
যেন নাম – না – জানা বন
কোন্ পথহারা পর্বতে ।
হঠাৎ মনে লাগে ,
যেন অনেক দিনের আগে ,
আমি অমনি ছিলেম ছাড়া ।