নেই তবুও আছে এমন
নেই কি কত জিনিস ?
আমি তাদের অনেক জানি ,
তুই কি তাদের চিনিস ?
যেদিন তাদের রাত পোয়াবে
উঠবে চক্ষু মেলি
সেদিন তোমার ঘরে হবে
বিষম ঠেলাঠেলি ।
নাপিত ভায়া , শেয়াল ভায়া ,
ব্যাঙ্গমা বেঙ্গুমী
ভিড় ক’রে সব আসবে যখন
কী যে করবে তুমি !
তখন তুমি ঘুমিয়ে পোড়ো
আমিই জেগে থেকে
নানারকম খেলায় তাদের
দেব ভুলিয়ে রেখে ।
তার পরে যেই জাগবে তুমি
লাগবে তাদের ঘুম ,
তখন কোথাও কিচ্ছুই নেই
সমস্ত নিজ্ঝুম ।
জ্যোতিষী
ওই যে রাতের তারা
জানিস কি , মা , কারা ?
সারাটিখন ঘুম না জানে
চেয়ে থাকে মাটির পানে
যেন কেমনধারা!
আমার যেমন নেইকো ডানা ,
আকাশ – পানে উড়তে মানা ,
মনটা কেমন করে ,
তেমনি ওদের পা নেই বলে
পারে না যে আসতে চলে
এই পৃথিবীর ‘পরে ।
সকালে যে নদীর বাঁকে
জল নিতে যাস কলসী কাঁখে
সজনেতলার ঘাটে ,
সেথায় ওদের আকাশ থেকে
আপন ছায়া দেখে দেখে
সারা পহর কাটে ।
ভাবে ওরা চেয়ে চেয়ে
‘ হতেম যদি গাঁয়ের মেয়ে
তবে সকাল – সাঁজে
কলসিখানি ধরে বুকে
সাঁতরে নিতেম মনের সুখে
ভরা নদীর মাঝে ‘ ।
আর আমাদের ছাতের কোণে
তাকায় , যেথা গভীর বনে
রাক্ষসদের ঘরে
রাজকন্যা ঘুমিয়ে থাকে ,
সোনার কাঠি ছুঁইয়ে তাকে
জাগাই শয্যা‘পরে ।
ভাবে ওরা , আকাশ ফেলে
হত যদি তোমার ছেলে ,
এইখানে এই ছাতে
দিন কাটাত খেলায় খেলায়
তার পরে সেই রাতের বেলায়
ঘুমোত তোর সাথে ।
যেদিন আমি নিষুত রাতে
হঠাৎ উঠি বিছানাতে
স্বপন থেকে জেগে
জানলা দিয়ে দেখি চেয়ে
তারাগুলি আকাশ ছেয়ে
ঝাপসা আছে মেঘে ।
বসে বসে ক্ষণে ক্ষণে
সেদিন আমার হয় যে মনে
ওদের স্বপ্ন বলে ।
অন্ধকারের ঘুম লাগে যেই
ওরা আসে সেই পহরেই ,
ভোরবেলা যায় চলে ।
আঁধার রাতি অন্ধ ও যে ,
দেখতে না পায় , আলো খোঁজে ,
সবই হারিয়ে ফেলে ।
তাই আকাশে মাদুর পেতে
সমস্তখন স্বপনেতে
দেখা – দেখা খেলে ।
তালগাছ
তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে ।
মনে সাধ , কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
একেবারে উড়ে যায় ;
কোথা পাবে পাখা সে ?
তাই তো সে ঠিক তার মাথাতে
গোল গোল পাতাতে
ইচ্ছাটি মেলে তার ,
মনে মনে ভাবে , বুঝি ডানা এই ,
উড়ে যেতে মানা নেই
বাসাখানি ফেলে তার ।
সারাদিন ঝরঝর থত্থর
কাঁপে পাতা – পত্তর ,
ওড়ে যেন ভাবে ও ,
মনে মনে আকাশেতে বেড়িয়ে
তারাদের এড়িয়ে
যেন কোথা যাবে ও ।
তার পরে হাওয়া যেই নেমে যায় ,
পাতা – কাঁপা থেমে যায় ,
ফেরে তার মনটি —
যেই ভাবে , মা যে হয় মাটি তার ,
ভালো লাগে আরবার
পৃথিবীর কোণটি ।
দুই আমি
বৃষ্টি কোথায় নুকিয়ে বেড়ায়
উড়ো মেঘের দল হয়ে ,
সেই দেখা দেয় আর – এক ধারায়
শ্রাবণ – ধারার জল হয়ে ।
আমি ভাবি চুপটি করে
মোর দশা হয় ওই যদি !
কেই বা জানে আমি আবার
আর – একজনও হই যদি !
একজনারেই তোমরা চেন
আর – এক আমি কারোই না ।
কেমনতরো ভাবখানা তার
মনে আনতে পারোই না ।
হয়তো বা ওই মেঘের মতোই
নতুন নতুন রূপ ধরে
কখন সে যে ডাক দিয়ে যায় ,
কখন থাকে চুপ করে ।
কখন বা সে পুবের কোণে
আলো – নদীর বাঁধ বাঁধে ,
কখন বা সে আধেক রাতে
চাঁদকে ধরার ফাঁদ ফাঁদে ।
শেষে তোমার ঘরের কথা
মনেতে তার যেই আসে ,
আমার মতন হয়ে আবার
তোমার কাছে সেই আসে ।
আমার ভিতর লুকিয়ে আছে
দুই রকমের দুই খেলা ,
একটা সে ওই আকাশ – ওড়া ,
আরেকটা এই ভুঁই – খেলা ।
দুষ্টু
তোমার কাছে আমিই দুষ্টু
ভালো যে আর সবাই ।
মিত্তিরদের কালু নিলু
ভারি ঠাণ্ডা ক – ভাই !
যতীশ ভালো , সতীশ ভালো ,
ন্যাড়া নবীন ভালো ,
তুমি বল ওরাই কেমন
ঘর করে রয় আলো ।
মাখন বাবুর দুটি ছেলে
দুষ্টু তো নয় কেউ —
গেটে তাদের কুকুর বাঁধা
করতেছে ঘেউ ঘেউ ।
পাঁচকড়ি ঘোষ লক্ষ্মী ছেলে ,
দত্তপাড়ার গবাই ,
তোমার কাছে আমিই দুষ্টু
ভালো যে আর সবাই ।
তোমার কথা আমি যেন
শুনি নে কক্খনোই ,
জামাকাপড় যেন আমার
সাফ থাকে না কোনোই !
খেলা করতে বেলা করি ,
বৃষ্টিতে যাই ভিজে ,
দুষ্টুপনা আরো আছে
অমনি কত কী যে !
বাবা আমার চেয়ে ভালো ?
সত্যি বলো তুমি ,
তোমার কাছে করেন নি কি
একটুও দুষ্টুমি ?
যা বল সব শোনেন তিনি ,
কিচ্ছু ভোলেন নাকো ?
খেলা ছেড়ে আসেন চলে
যেমনি তুমি ডাকো ?
দুয়োরানী
ইচ্ছে করে , মা , যদি তুই
হতিস দুয়োরানী !
ছেড়ে দিতে এমনি কি ভয়
তোমার এ ঘরখানি ।
ওইখানে ওই পুকুরপারে
জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে
ও যেন ঘোর বনের মধ্যে
কেউ কোত্থাও নেই ।
ওইখানে ঝাউতলা জুড়ে
বাঁধব তোমার ছোট্ট কুঁড়ে ,
শুকনো পাতা বিছিয়ে ঘরে
থাকব দুজনেই ।
বাঘ ভাল্লুক অনেক আছে ,
আসবে না কেউ তোমার কাছে ,
দিনরাত্তির কোমর বেঁধে
থাকব পাহারাতে ।
রাক্ষসেরা ঝোপে ঝাড়ে
মারবে উঁকি আড়ে আড়ে ,
দেখবে আমি দাঁড়িয়ে আছি
ধনুক নিয়ে হাতে ।
আঁচলেতে খই নিয়ে তুই
যেই দাঁড়াবি দ্বারে
অমনি যত বনের হরিণ
আসবে সারে সারে ।
শিঙগুলি সব আঁকাবাঁকা ,
গায়েতে দাগ চাকা চাকা ,
লুটিয়ে তারা পড়বে ভুঁয়ে
পায়ের কাছে এসে ।
ওরা সবাই আমায় বোঝে ,
করবে না ভয় একটুও যে ,
হাত বুলিয়ে দেব গায়ে ,
বসবে কাছে ঘেঁষে ।
ফলসা – বনে গাছে গাছে
ফল ধরে মেঘ করে আছে ,
ওইখানেতে ময়ূর এসে
নাচ দেখিয়ে যাবে ।
শালিখরা সব মিছিমিছি
লাগিয়ে দেবে কিচিমিচি ,
কাঠবেড়ালি লেজটি তুলে
হাত থেকে ধান খাবে ।