ঘরে ফিরে শুভলক্ষ্মী রেকর্ডের শুভ্ৰাত ভজন
মুহুর্তের কণ্ঠে আনে দ্বাদশ দেউল জাগা তীর,
প্রবাস-সমুদ্রহীন, অকল্প চাওয়ার বুকে স্থির ;
কত দিন হ’য়ে গেলো খুঁজেছি সে পথের লগন ।
নীল আঁকা চীনে হাঁস ফুলপাত্রে উড়েছে মিং যুগে
ডেস্কে তারি কাছে আসা ; শূন্য শান্ত ; বেঁচেছি দৈবাৎ
—ককটেল আতিথ্যে কারো ধূম্রতা বিলাসী কক্ষে ভুগে—
কার্পেটে তুরানী নক্সা, নিয়ে তারি ঐন্দ্রিক দৃক্পাত ৷।
চিত্ৰ-আসি, তীর্থ-আসি : শিরায় মনের দুঃখে ঝড়ে
জমা-মেঘ-সন্তর্পিত ব্যবধান চূৰ্ণ-করা দিনে
পাতঞ্জলি সূত্ৰ পড়ি, কোচে শুয়ে ভাবি, বই খোলা
প্ৰাঞ্জল আয়ুকে কেন প্রত্যহ ধুলোর ধর্মে ভ’রে
অব্যবহিত-হারা আবিস্মিত ইট গেঁথে তোলা ।
আখ্রোটের কাঠে-খোদা কাশ্মীর ভূস্বৰ্গ স্বপ্ন চিনে
চুমকি-বসানো হ্রদ— মনে আছে ? –ধরি বুকে তাই ;
স্বামীজি অখিলানন্দ তাঁর কাছে মধ্যে-মধ্যে যাই ৷।
বড়োবাবুর কাছে নিবেদন
তালিকা প্রস্তুত
কী কী কেড়ে নিতে পারবে না-
হই না নির্বাসিত-কেরানি।
বাস্তুভিটে পৃথিবীটার সাধারণ অস্তিত্ব।
যার এক খন্ড এই ক্ষুদ্র চাকরের আমিত্ব।
যতদিন বাঁচি, ভোরের আকাশে চোখ জাগানো,
হাওয়া উঠলে হাওয়া মুখে লাগানো।
কুয়োর ঠান্ডা জল, গানের কান, বইয়ের দৃষ্টি
গ্রীষ্মের দুপুরে বৃষ্টি।
আপন জনকে ভালোবাসা,
বাংলার স্মৃতিদীর্ণ বাড়ি-ফেরার আশা।
তাড়াও সংসার, রাখলাম,
বুকে ঢাকলাম
জন্মজন্মান্তরের তৃপ্তি যার যোগ প্রাচীন গাছের ছায়ায়
তুলসী-মন্ডপে, নদীর পোড়ো দেউলে, আপন ভাষার কন্ঠের মায়ায়।
থার্ডক্লাসের ট্রেনে যেতে জানলায় চাওয়া,
ধানের মাড়াই, কলা গাছ, কুকুর, খিড়কি-পথ ঘাসে ছাওয়া।
মেঘ করেছে, দু-পাশে ডোবা, সবুজ পানার ডোবা,
সুন্দরফুল কচুরিপানার শঙ্কিত শোভা,
গঙ্গার ভরা জল; ছোটো নদী; গাঁয়ের নিমছায়াতীর-
হায়, এও তো ফেরা-ট্রেনের কথা।
শত শতাব্দীর
তরু বনশ্রী
নির্জন মনশ্রী :
তোমায় শোনাই, উপস্থিত ফর্দে আরো আছে-
দূর-সংসারে এলো কাছে
বাঁচবার সার্থকতা।।
মিল
মিশোতে কি পারবে ঠিক ক’রে
মৃত্যুকেই এ মুক্তি-জীবনে
রোজ-রোজ ;
যেমন নীলের ধূলি পৃথিবী মাটিতে গাঁথা অবলীন
প্ৰাণবায়ু প্ৰাণভূমি প্রাণশূন্য।
কান্নাবিন্দু অলক্ষ্য মুক্তোয় ঝরা
এই যে আলোয় মিশ্র আপনি বাংলার আশীৰ্বাণী
আনে দূরে ঘোর-দেয়া এপারের ঘরে নিত্য সুধা,
সে কি এই শেষ দৃষ্টিভরা।
মনে হয় ফিরে-পাওয়া মৃন্ময়ী বাসায়
গোলক চাপার তলে ব’সে আছি,
খোয়াই-পেরোনো স্থির সম্পূর্ণ স্বীকৃতি
শান্তিনিকেতনে,
অথচ সবই সে কোন পূর্বজীবনের সন্ধিমাখা,
বিদেশের ক্ষণোজ্জল সায়াহ্নে এখানে শুধু বাঁশি
যা-কিছু প্ৰত্যক্ষ তারি জরি
সূৰ্যসুতোর জালে আয়ুময় আন্দোলিত
মুহুর্ত মন্দিরে ঝলমল,
পর্দা সেও : তুলে তাকে
একেবারে দেখবো কি ডুবে-যাওয়া পান্থজীবনের
অবিচল ধারণায়—
প্ৰবাসে সর্বস্বহারা দিনে উদ্ভাসিত ;
পারবে কি, চৈতন্যময় মন,
পারবে কি ক্ষুধায় কাঁদা বুক ৷।
রাত্রি
অতন্দ্রিলা,
ঘুমোওনি জানি
তাই চুপি চুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে
বলি, শোনো,
সৌরতারা-ছাওয়া এই বিছানায়
—সূক্ষ্মজাল রাত্রির মশারি—
কত দীর্ঘ দুজনার গেলো সারাদিন,
আলাদা নিশ্বাসে—এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুঁই
কী আশ্চর্য দু-জনে দু-জনা—
অতন্দ্রিলা,
হঠাত্ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জ্যোত্স্না,
দেখি তুমি নেই ||
সংলাপ
(১৯৫৫)
“সরু সামাজিক পথে চ’লে
একটু-আধটু কঁচা জায়গা তবুও মনের মধ্যে রাখা :
আগাছায় ছায়া-দেয়া আদিমতা ।
শোনো, বন্ধু, অলিগলি আঁকাবাঁকা তাতে ঘুরি।
চমক পাথরে মোড়া উজল মনন সভ্যতায়
অতিথি, তবুও ফিরে গিয়ে
ব’সে থাকি ভাঙা ঘাটে, সেই শিবতলা পুলে
গঙ্গার ওপারে, দেখি, কিছু নয়, মাছটা, পাখিটা,
কানাই ঘোরায় লাঠি, ছোটো ছেলেমেয়ে ভিড় করে,
হাঁ ক’রে তখুনি মানে জাদুবিদ্যে, ভেঁপু কেনে।
দামী রাজ্যে স্বনির্বাসী গরিব বাঙালি
তারি যে নিতান্ত সার্থী, ছেড়া চটি প’রে চলে যাই
আত্মীয় যুগের মধ্যগ্রামে,
একেবারে প্রাথমিক প্ৰণতির ।
আহা, ঐ বোষ্টমী ভিখারি
কিছু না জেনেও গায় কত সে পুরোনো ধ্বনিভরা
গান,
ছন্দ তার যেন নান্দী পাঠ, একতারা বাজা
ভাঙা ব্যাকরণে মেশা পার্থিব যোগের সংসারতা
হাটের বাটের, ছোঁয়া রাধা-কৃষ্ণ প্ৰেমধ্যানে,
শিব-পার্বতীর কথা, শৈল স্নিগ্ধ নীল হিমাচল
হাওয়ায় পুজোর ঠাণ্ডা আনে কলকাতায়,
বাংলা ঘরে-ঘরে ;
এ সব বলবারই নয়, হয়তো, কী জানি
প্রামাণ্যই নয়, তবু এতেও সূক্ষ্ম ধন
নরহরি বার্তা আছে তোমাদেরও ।
আশ্বিনে সানাই বাজে শোনো দূর শ্রুতি।
আজ আমার বুক ভরা, সবাইকে শ্ৰদ্ধা ক’রে বলি
সুন্দর স্বাগত দিলে, দেখো ছুটি অর্জেছি
দুই তীরে,
আন্তর্জাতিক মন শিকড়ে মাটিকে আঁকড়ে থাকে
যে-মাটি এ-বুকে আজো বাংলা পার্থিব,
যদি ফোটে মেঠো ফুল, তাই নাও সেই মাটি থেকে
যাত্রী-অৰ্ঘ্য নব বৎসরের ॥”
সমাবর্ত
নিরবধি কালের সকাল । নীল ইস্পাতী রেলে জ্ব’লে ওঠে
কালো দ্যুতি, দুটো-পঁচিশের ট্ৰেন এলো ব’লে, প্রশ্নচক্ষু স্থির
সিগ্নলের— হঠাৎ সবুজ দৃষ্টি— ঝোড়ো এক্সপ্রেস ছোটে
সময়ের অন্য দূরে দূরে ; থেমে যায় আন্দোলিত ভিড়