- বইয়ের নামঃ সুন্দরের হাতে আজ হাতকড়া, গোলাপের বিরুদ্ধে হুলিয়া
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমার কবিতার জন্যে
আমি কবিতা লিখবো বলে এই আকাশ
পরেছে নক্ষত্রমালা,
পরেছে রঙধনু-পাড় শাড়ি, অপরূপ চন্দ্রহার
নদীর গহনা পরে আছে গ্রামগুলি,
শুধু আমি কবিতা লিখবো তাই এই প্রকৃতি
পরেছে পুষ্পশোভা,
কানে পরেছে ফুলের দুল, হাতে ঝিনুকের চুড়ি।
মন হুহু-করা এমন উদাস বাতাস, এমন
স্নিগ্ধ বৃষ্টিধারা
এই ঝর্নার মুখর গান, ফুলের সৌরভ
কেবল আমার কবিতার মধ্যে, আমি কবিতা
লিখবো তাই।
আমি কবিতা লিখবো বলে ঘাসে এমন
শিশির মুক্তো
গাছের পাতায় এই ঘন সবুজ রঙ-
রাজহাঁসগুলির এমন আলতা-পরা পা,
শাদা বকের পাখার মতে এই নদীর জল
ফাল্গুনে এমন অগ্নিবর্ণ পলাশ-শিমুল;
আমি কবিতা লিখবো বলে মাছে দুচোখ
এমন রহস্যময়,
জলের শুভ্রতা এমন হৃদয়গ্রাহী।
আমি কবিতা লিখবো তাই শূন্যতার নাম আকাশ
জলের বিস্তারের নাম সমুদ্র,
গাছপালা, জঙ্গলের নাম অরণ্য
জলরেখার ভালো নাম নদী;
আমি কবিতা লিখবো বলে এই আকাশ ও প্রকৃতি জুড়ে
এতো সাজসজ্জা, এতো আয়োজন,
চিরবসন্তোৎসব।
আমার জীবনী
আমার জীবনী আমি লিখে রেখে যাবো
মাটির অন্তরে, ধুলোর পাতায়
লিখে রেখে যাবো মেঘের হৃদয়ে,
বৃষ্টির ফোঁটায়,
হাঁসের নরম পায়ে হরিণশিশুর মায়াময়
চোখে;
ফুলের নিবিড় পাপড়িতে আমি লিখে রেখে যাবো
আমার জীবনী-
লিখে রেখে যাবো বৃক্ষের বুকের মধ্যে
পাহাড়ী ঝর্নার ওষ্ঠে,
সবুজ শস্যের নগ্নদেহে।
আমার জীবনী আমি লিকে রেখে যাবো শিশিরে, ঘাসের
বুকে,
নদীর শরীরে, পদচিহ্ন আঁকা এই পথের ধুলোয়
লিখে রেখে যাবো সংসারের হাসি-কান্নার গভীরে;
আমার জীবনী আমি গেঁথে দিয়ে যাবো ঝরা বকুলের
বিষন্ন মালায়,
বর্ষার উদ্দাম ঢেউয়ে, সবুজ জমিতে,
প্রেমিকার মদির চুম্বনে।
আমার জীবনী আমি লিখে রেখে যাবো বিরহীর
দুচোখের জলের ধারায়; আমার জীবনী
আমি লিখবো না দূর নীহারিকালোকে, নক্ষত্রের উজ্জ্বল
অক্ষরে,
আমার জীবনী আমি রেখে দিয়ে যাবো ভোরের
পাখির কন্ঠে,
উদাসীন বাউলের গানে, পথিকের পথের দু’ধারে;
লিকে রেখে যাবো আমার জীবনী আমি
ব্যথিত কবির শ্লোকে,
দুঃখীর সজল আঁখিতে,
আমার জীবনী আমি লিকে রেখে যাবো
স্বপ্নের খাতায়
সমুদ্র-সৈকতে, অশ্রুজলে-ধোয়া প্রেমিকের
জীবনপঞ্জিতে।
আমি কেউ নই
আমি কেউ নই, আমি শরীরের
ভেতরে শরীর
গাছের ভেতরে গাছ,
এই অনন্ত দিনরাত্রির মধ্যে একটি বুদ্বুদ;
আমি মানুষের মতো কিন্তু মানুষ নই
শুধু মুখচ্ছবি
মানুষের একটি আদল
ছঅয়ার মানুষ;
আমি কেউ নই, কোননোকিছু নই
আমি মানুষের মতো
এক মুখোশ মানুষ
হয়তো জন্মেই মৃত আমি, হয়তো এখন
কেবল ছায়া,
মানুষের মতো
এই ছঅয়া-মানুষ;
আমি কেউ নই, আমি কোনোকিছু নই,
আমি ছায়ার ভেতরে শরীর
আমি কেউ নই, আমি মানুষের ভেতরে
মানুষ, ভেতর-মানুষ।
উদ্ভিদ মানুষ
মানুষের যা হবার তাই হয়, মানুষ হয় না
কোনো উদ্ভিন্ন মানুষ-
সম্পূর্ণ আলোকপ্রাপ্ত, অন্তরে বাইরে দ্যুতিময়।
সবুজ বৃক্ষের মতো যথার্থ হৃদয়বান হয় না মানুষ
হয় না সে আকামের মতো উন্মুক্ত উদার;
মানুষের যা হবার তাই হয় তার বেশি হয় না সে
আলোকিত প্রবুদ্ধ মানুষ,
হয় না আয়ত্ত তার সব বিদ্যা, সামান্যই হয় শেখা
মানবপ্রেমের পাঠ-
বরং হিংসা আর সহিংসতা চর্চায়ই যায় তার অর্ধেক জীবন
আরো বিশ কিছুকাল যায় ধনুর্বিদ্যা শিখে;
এরপর যেটুকু সময় বাকি থাকে কাটে
অনুশোচনায়, মনস্তাপে
মানুসের যা হবার তাই হয় তার বেশি হয় না যে
পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ মানুষ।
এই জীবনে
এই জীবনে হবে না আর মূলে যাওয়া,
চুড়োয় ওঠা-
কাটবে জীবন পাদদেশে, পাদমূলে;
খুব ভেতরে প্রবেশ করা হবে না আর এই জীবনে
হবে না আর ভেতর মধু ফের আহরণ,
হবে শুধুই ওপর ছোঁয়া, ওপর দেখা।
এই জীবনে হবে না আর তোমার নিবিড়
স্পর্শ পাওয়া,
হবে না এই নদী দেখা, জলাশয়ের
কাছে যাওয়া,
একটিবার তোমায় নিয়ে হ্রদের জলে একটু নামা-
হবে না আর পৌঁছা মোটেই ডুব-সাঁতারে
জলের গহীন তলদেশে,
জলে নামা, সাঁতার শেখা;
মূলের সঙ্গে হবে না আর ঠিক পরিচয়
মাত্র এখন অনুবাদের অর্ধ স্বাদেই তৃপ্ত থাকা,
এই জীবনে হবে না আর আকাশ দেখা,
চিবুক ছোঁয়া-
তোমায় নিয়ে নীল পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া;
এই জীবনে হবে না আর তোমার গোপন দেখা পাওয়া,
একন শুধু চোখের জলে দুঃখ পাওয়া,
নিজের মাঝেই ফুরিয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া।
এই জীবনে হবে না আর দুঃখ কারো
মোচন করা,
কারো অশ্রু মুছিয়ে দেয়া সাঁকো বাঁধা,
কারো ক্ষত সারিয়ে তোলা;
এই জীবনে হবে না আর মুগ্ধ ভ্রমণ,
কারো ক্ষত সারিয়ে তোলা;
এই জীবনে হবে না আর মুগ্ধ ভ্রমণ,
মূলে যাওয়া-
তোমায় ছোঁয়া।
কীভাবে তোদের বলি
আজ আর কীভাবে তোদের কাতর মুখের দিকে
চেয়ে বলি
কোথাও তোদের জন্য একখণ্ড
জমি যদি নাও থাকে
তবুও আছে তোদের পিতার এই বুক,
যে-কোনো সবুজ জমির চেয়ে স্নেহচ্ছায়াময়,
অধিক সবুজ;
যে-কোনো নদীর চে’ও জলময়
তোদের এ পিতার হৃদয়
আজ কী করে তোদের বলি, তোদের পিতার
এই দুটি চোখ
পৃথিবীর সব আশ্রয়ের চে’ও
নিরাপদ অনন্ত আশ্রয়
এই তোদের অক্ষম পিতার দুইখানি হাত
তোদের আগলে রাখার জন্য যে-কোনো কিছুর চেয়ে
বেশি কার্যকর, শক্তিশালী-
আজ আর কীভাবে তোদের বলি
এই পিতৃহৃদয়
প্রেইরী অঞ্চলের চেয়েও তৃণাচ্ছাদিত
ছায়াময়;
বড়ো ভয় হয় অক্ষম পিতার
এই নিস্ফল আশ্বাস শুনে যদি
তোমরা না পাও ফিরে মনোবল
কিংবা সাহস
আজ তাই বারবার ভঅবি
কীভাবে তোদের কাতর মুখের দিকে চেয়ে বলি
এইসব কথা!
তুমি ও কবিতা
তোমার সাথে প্রতিটি কথাই কবিতা, প্রতিটি
মুহুর্তেই উৎসব-
তুমি যখন চলে যাও সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর
সব আলো নিবে যায়,
বইমেলা জনশূন্য হয়ে পড়ে,
কবিতা লেখা ভুলে যাই।
তোমার সান্নিধ্যের প্রতিটি মুহূর্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো
মনোরম
একেটি তুচ্ছ বাক্যালাপ অন্তহীন নদীর কল্লোল,
তোমার একটুখানি হাসি অর্থ এককোটি বছর
জ্যোৎস্নারাত
তুমি যখন চলে যাও পৃথিবীতে আবার হিমযুগ
নেমে আসে;
তোমার সাথে প্রতিটি কতাই কবিতা, প্রতিটি গোপন কটাক্ষই
অনিঃশেষ বসন্তকাল
তোমার প্রতিটি সম্বোধন ঝর্নার একেকটি কলধ্বনি,
তোমার প্রতিটি আহ্বান একেকটি
অনন্ত ভোরবেলা।
তাই তুমি যখন চলে যাও মুহূর্তে সব নদীপথ
বন্ধ হয়ে যায়
পদ্মার রুপালি ইলিশ তার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে,
পুষ্পোদ্যান খাঁখাঁ মরুভূমি হয়ে ওঠে;
যতোক্ষণ তুমি থাকো আমার নিকটে থাকে
সপ্তর্ষিমণ্ডল
মাথার ওপরে থাকে তারাভরা রাতের আকাশ,
তুমি যতোক্ষণ থাকো আমার এই হাতে
দেখি ইন্দ্রজাল
আঙুলে বেড়ায় নেচে চঞ্চল হরিণ;
তুমি এলে খুব কাছে আসে সুদূর নীলিমা
তোমার সান্নিধ্যের প্রতিটি মুহূর্ত সঙ্গীতের
অপূর্ব মূর্ছনা
যেন কারো অবিরল গাঢ় অশ্রুপাত;
তোমার সাথে প্রতিটি বাক্য একেকটি কবিতা
প্রতিটি শব্দ শুভ্র শিশির।
তোমাকে লিখবো বলে একখানি চিঠি
তোমাকে লিখবো বলে একখানি চিঠি
কতোবার দ্বারস্ত হয়েছি আমি
গীতিকবিতার,
কতোদিন মুখস্ত করেছি এই নদীর কল্লোল
কান পেতে শুনেছি ঝর্ণার গান,
বনে বনে ঘুরে আহরণ করেছি পাখির শিস্ত
উদ্ভিদের কাছে নিয়েছি শব্দের পাঠ;
তোমাকে লিখবো বলে একখানি চিঠি
সংগ্রহ করেছি আমি ভোরের শিশির,
তোমাকে লেখার মতো প্রাঞ্জল ভাষার জন্য
সবুজ বৃক্ষের কাছে জোড়হাতে দাঁড়িয়েছি আমি-
ঘুরে ঘুরে গুহাগাত্র থেকে নিবিড় উদ্ধৃতি সব
করেছি চয়ন;
তোমাকে লিখবো বলে জীবনের গূঢ়তম চিঠি
হাজার বছর দেখো কেমন রেখেছি খুলে বুক।
ফুটেছে ফুল, বিরহীতবু চাঁদ
ফুটেছে ফুল ঠোঁটের মতো লাল
আকাশে চাঁদ বিরহী চিরকাল;
কে যেন একা গাইছে বসে গান
সন্ধ্যা নামে, দিনের অবসান।
দুর পাহাড়ে শান্ত মৃদু পায়ে
রাত্রি নামে স্তব্ধ নিঝুম গাঁয়ে;
শূন্যে ভাসে মেঘের জলাশয়
এই জীবনে সবকিছুই তো সয়।
বিরহী চাঁদ মোমের মতো গলে
বুকের মাঝে কিসের আগুন জ্বলে;
মন পড়ে রয় কোন অজানালোকে
নিজেকেই সে পোড়ায় নিজের শোকে।
ফুটেছে ফুল ঠোঁটের মতো লাল
বিরহী চাঁদ বিরহী চিরকাল;
ফুটেছে ফুল বিরহী তবু চাঁদ,
বাইরে আলো, ভেতরে অবসাদ।
মধুপুরে
মনটা ভীষণ উড়ু উড়ু, আমি যেন
উড়ো পাতা,
ঝাউবনের কান্না শুনি বুকের মধ্যে
সারা দুপুর-
উড়তে উড়তে কোথায় যাবো, ঠিকানা ঠিক
কোথায় পাবো
নাকি শেষে হারিয়ে যাবো,
এই আমি এই উড়ো পাতা, উড়ো পাতা!
মনটা ভীষণ উড়ু উড়ু টেবিলে বই, লেখার
কাগজ
ঝড় বয়ে যায় মনের ভেতর; সব
উড়ে যায়
আমিও যাই
মনটা ভীষণ উড়ু উড়ু শালবনে
কার ছায়া দেখি-
লোকাল ট্রেনে যাচ্ছি কোথায়!
আমার এখন মনে পড়ে তোমার চোখে
বৃষ্টি নামা,
তবু উড়ু উড়ু এই দুপুরে মধুপুরে হয় না নামা।
সুন্দরের হাতে আজ হাতকড়া, গোলাপের বিরুদ্ধে হুলিয়া
সুন্দরের হাতে আজ হাতকড়া, গোলাপের বিরুদ্ধে
হুলিয়া,
হৃদয়ের তর্জমা নিষিদ্ধ আর মননের সম্মুখে প্রাচীর
বিবেক নিয়ত বন্দী, প্রেমের বিরুদ্ধে পরোয়ানা;
এখানে এখন পাখি আর প্রজাপতি ধরে ধরে
কারাগারে রাখে-
সবাই লাঞ্ছিত করে স্বর্ণচাঁপাকে;
সুপেয় নদীর জলে ঢেকে দেয় বিষ, আকাশকে
করে উপহাস।
আলোর বিরুদ্ধাচারী আঁধারের করে শুধু স্ততি,
বসন্তের বার্তা শুনে জারি করে পূর্বাহ্নে কারফিউ,
মানবিক উৎসমুখে ফেলে যতো শিলা ও পাথর-
কবিতাকে বন্দী করে, সৌন্দর্যকে পরায় শৃঙ্খল।