তুমি যখন প্রশ্ন করো
তুমি যখন প্রশ্ন করো
আমি কে তোমায় ভালোবাসি?
অন্ধকারে লুকিয়ে মুখ
আমি নিজের মনেই হাসি।
উত্তরে কি বলবো বলো
বিশ্বকোষেও হয়তো নাই,
উথালপাতাল খুঁজে মরি
কোথায় যোগ্য শব্দ পাই।
জানো কি এই প্রশ্নে তোমার
হঠাৎ থামে নদীর ধঅরা
আকাশখানি কালো করে
মেঘে ঢাকা সন্ধ্যাতারা,
তার চেয়েও গভীর ঘন
লজ্জা ঢাকে আমার মুখ
পাইনে খুঁজে একটি কথাও
শঙ্কা-ভয়ে কাঁপে বুক;
এতোদিনেও বোঝেনি যে
আজ বোঝাবো কোন ভরসায়
না-বলা সেই ছোট্ট কথা
বলিনি কি কোনো ভাষায়?
বলিনি কি এই কথাটি
তোমার দিকে নীরব চেয়ে,
এই গান কি সারাজীবন
জীবন দিয়ে যাইনি গেয়ে?
সেই কথা তো জানে ভালো
শিশির-ভেজা ভোরের ফুল,
তুমি যখন প্রশ্ন করো
আমি করি অধিক ভুল।
পানুর জন্যে এলিজি
তোমাকে পানুই বলি, খুব ছোটো প্রিয় ডাকনাম
ভালো নাম তোমার জানি না; তবু নও তুমি কোনো
অচেনা মানুষ, খুব পরিচিত, খুব কাছের, পাশের
তুমিই হারিয়ে গেলে বহুদূরে অজানা আকাশে;
যতোই তোমার কথা ভাবি মনে হয় ফিরে এসে ঠিক
আবার বসবে কাছাকাছি, শধানে কুশল। হয়তোবা
এ-রকমই হবে, নিশ্চিতই হবে, মনে মনে ভাবি
কিন্তু তুমি আর বুঝি কথাই রাখবে না কোনোদিন।
তোমার টিকিট ছিলো, হ্যাণ্ডব্যাগ ছিলো, তবু কেন
মানুষ এমন তুমি ফিরে এলে কারগো-আরোহী
কেন হলে চলন্ত মানুষ তুমি স্তবির লাগেজ, কেন হলে,
তোমার টিকেট ছিলো, জামাজুতো ছিলো, সবকিছু ছিলো।
তুমি তো ভালোই ছিলে সামাজিক স্বচ্ছন্দ মানুষ
তোমার মমতা ছিলো, বুকভরা ভালোবাসা ছিলো,
তাই কি নিজেই তুমি হলে এই প্রেমের শহীদ
ভালোবাসা বেঁচে থাক, মানুষ মরেও যদি যায়।
হায়রে তোমাকে নিয়ে বেহুলার মতো সেই যে ভাসায়
তার ভেলা দূর নীলিমায়; মাদ্রাজ-সমুদ্র থেকে
বাংলাদেশে লালমাই পাহাড়ের কোলে, এই দীর্ঘ শবযাত্রা
শেষ হয়ে যায়, লখিন্দর উঠে বসে, কিন্তু তুমি
তবুও ওঠোনা। তোমাকে পানুই বলি, প্রিয় ডাকনাম
গোলাপ ফুটেছে আজো, দেখো চেয়ে ক্রিসানথিমাম।
পৃথিবী আমার খুব প্রিয়
ঢাকা আমার খুব প্রিয়, কিন্তু আমি থাকি
আজিমপুর নামক একটি গ্রামে; খুবই ছোটোখাটো
একটি গ্রাম, বলা চলে শান্ত-স্নিগ্ধ ছোট্ট একটি পাড়া
এখানেই এই কবরের পাশে আমি আছি; বস্তুত এখান থেকে
ঢাকা বহুদূরে, আমি সেই ঢাকা শহরের কিছুই জানি না
আমাকে সবাই জানে আমি ঢাকার মানুষ,
কিন্তু আমি বাস করি খুবই ছোট্ট নিরিবিলি গ্রামে
আমি এই ঢাকার খুব সামান্যই চিনি, সামান্যই জানি।
এখনো আমার কাছে ঢাকার দূরত্ব ঠিক আগের মতোই
রয়ে গেছে, এখনো ঢাকায় যেতে বাসে চেপে, ট্রেন ধরে,
ফেরি পার হতে হয় রোজ, এমনটি
তারপরও ঢাকা গিয়ে পৌঁছতে পারি না; ঢাকার মানুষ
তবু বিশটি বছর এই একখানি গ্রামেই রয়েছি,
খুব চুপচাপ, নিরিবিলি, একখানি অভিভূত গ্রাম।
ঢাকা আমার খুব প্রিয় শহর, কিন্তু আমি পছন্দ করি গ্রাম
আজিমপুরের এই খোলা মাঠ, এই সরু গলি,
ঢাকার মানুষ তবু আজিমপুরের এই ছোট্ট গ্রামেই থাকতে ভালোবাসি
পৃথিবী আমার খুব প্রিয়, কিন্তু আমি বাংলাদেশ ছেড়ে
কোথাও যাবো না।
মানুষ বড়ো ক্রন্দন জানে না
সবাই কলহে পটু, মানুষ বড়ো পছন্দ করে না
তবু দেখো মা তোমার উদ্দেশ্যে নীরবে এই
কবিতার দীঘৃ অশ্রুপাত
কেউ সে-কথা জানে না, শুধু আমি জানি এই কবিতা
তোমারই জন্য কতো ভাসিয়েছে বুক।
যাদের ব্যথিত ভেবে এতোদিন প্রকৃতিকে উপেক্ষা করেছি
ভেবেছি যাদের চোখ শ্রাবণের জলভরা নদী,
আজ দেখি তাদের চোখে একবিন্দু শিশিরও জমেনি
অনুভূতিহীন সেইসব চোখে শুধু ধু-ধু মরুভূমি;
তাই সবাই যখন দেখি অশ্রুর চেয়েও এই তীরকেই বেশি
ভালোবাসে
তখন নিজেই মুখ ঢেকে তোমার উদ্দেশে শুধু ফেলি অশ্রুজল।
তোমার সন্তান আমি তীর ছোঁড়া কখনো শিখিনি
শৈশবেও তীরন্দাজ হওয়ার ইচ্ছা কোনোদিন হয়নি আমার,
তাই তোমর উদ্দেশে এই অশ্রুপাত ছাড়া আর কোনো
যোগ্য ভাষা নেই
সবই যখন আজ বড়ো বেশি ব্যস্ত শুধু যার যার প্রাপ্য
বুঝে নিতে
যে যেমন পারে আজ টেক্কা দিয়ে চলে যেতে চায়,
তখন মা একান্ত বৈভবহীন আমি তোমার উদ্দেশে উৎসর্গ করেছি
আমার এই অশ্রুভেজা দীন পঙ্ক্তিমালা;
তাদের কারো মতো আমার তো মূল্যবান মণিমুক্তো নেই
এই ব্যর্ততার অশ্রুবিন্দু দিয়ে তাই তো তোমার জন্য বসে
মালা গাঁথি
তাই রাত জেগে জেগে আমি লিখে রাখি এই দীর্ঘশ্বাস।
রাত্রির আকাশ জানে তোমার উদ্দেশে কতো করি অশ্রুপাত,
মানুষ জানে জানে, ক্রন্দন জানে না।
মানুষ সহজে ভুলে যায়
মানুষ সহজে ভুলে যায়, আমি ভুলতে পারি না
এখনো শিশির দেখে অশ্রুভেজা চোখ মনে পড়ে,
সবুজ অরণ্য দেখে মনে পড়ে স্নেহের আঁচল
ভোরের শিউলি দেখে শৈশবের স্মৃতি চোখে ভাসে।
মানুষের মতো আমি এতো বেশি স্বাভাবিক নই
আমার নিশ্বয় কিছু স্নেহমায়া, পিছুটান আছে,
শোকদুঃখ, ভালোবাসা আমাকে এখনো দগ্ধ করে
পাথরের মতো এতোটা নিস্পৃহ আমি হতে পারি নাই।
মানুষ সহজে ভুলে যায়, বেশ ভুলে যেতে পারে
আমি এ-রকম ভুলতে পারি না। শুধু মনে পড়ে,
জল দেখে মনে পড়ে, মেঘ দেখে মনে পড়ে যায়
আঁধারে হারালো যারা সেইসব হারানো মানুষ।
কোথাও পাবো না তারে বৈশাখে কি ব্যথিত শ্রাবণে
মানুষ সহজে ভোলে, আমি কেন ভুলতে পারি না?