যেতে যেতে অরণ্যকে বলি
এমনও অরণ্য তাকে উদ্দাম মর্মর মূর্তি ধরে নেয়া যায়,
বাতাসের অতি দম্ভ বৃক্ষের সমান উঁচু মেঘ, আরো উঁচু
অরণ্যের সীমা
এও শুধু অরণ্যেরই শোভা পায় এতো উঁচু এমন বিশাল
তাই তো মর্মরমূর্তি অরণ্যকে নিঃশব্দ প্রস্তর বলে ভ্রম হয়, মনে হয়
এ নৈঃশব্দ্য প্রস্তরেরই প্রাণ।
অরণ্যও অনেকাংশে জলেরই মতন আস্থাবান অথবা এ জঙ্গমতা
মানুষেরই মতো জন্মগত
মানুষেরই মতো এই স্থিতিগ্রাহ্য পার্থিবতা অরণ্যকে দেখে
মনে হয়
চতুদিকে হাত তুলে আমাদেরই আদি কোনো পিতা কোনো
আদিম পুরুষ
রয়েছেন সম্পূর্ণ স্বাধীন সমাসীন, তারই কায়া
এজন্যই অরণ্যকে অনেকাংশে পার্থিব মানুষ যেন লগে
কখনো কখনো
তাহার ভিতরে বসে দুঃখের গভীর চলাফেরা দীর্ঘ করুণ নিঃশ্বাস
টের পাই
এমন নিশ্চিত ব্যস্ত এতো শব্দহীন এমন নির্জন কোলাহল, ঘুমিয়ে
পড়ার শব্দ
পাথরেরও ঘুম পায়, অরণ্যেরও অবসাদ লাগে,
বৃক্ষের উলঙ্গ মূর্তি আরো গূঢ় অধিক সংযম
আরো খাদ্য পানীয়ের টান এই অবিচ্ছিন্ন বিশুদ্ধ যৌনতা
যা কিনা স্বভাবে বদ্ধ অতি গূঢ় সুদৃঢ় যৌবন, মনে হয়
অরণ্যেতে আছে,
অরণ্যের অধিক অরণ্য সেও হয়তোবা একদিন সৃষ্টি হয়ে যাবে
কিংবা তাও নির্মাণ হয়েই আছে মানুষের সভ্যতার
স্বপ্নের ভিতর
সেই তো প্রস্তর, সেই তাম্র, প্রস্তর যুগের অস্ত্র,
অরণ্য প্রস্তরময়, অরণ্যও আমাদের লোক, তাকেও এভাবে চিনি
মাথায় জড়ানো সাপ পাগড়ির মতোই শাদামাঠা
কখনো পশ্চাৎ থেকে দেখে একান্তই ভিন্ন কেউ এসেছেন
তাও মনে হতে পারে,
আমি জানি আমি এই অরণ্যের খুব বেশি কিছুই জানি না
যতোখানি মানুষেরও জানি নিশ্চিতই অরণ্যেরও ততোটুকু
মাত্র জানা যায়
প্রকৃতই অরণ্য কি অধিক হৃদয়গম্য, পারি, ততোটুকু পারি
অধিক পারি না, ইহার অধিক কোনো কিছুই পারি না।
অরণ্য কি একদিন মানুষেরই মূর্তি ফিরে পারেব, এমন
শোকার্ত হবে, দুঃখশীল হবে তার মন
অরণ্যের মনুষ্য স্বভাব মানুষের অরণ্য প্রকৃতি এও কি সম্ভব
অর্থাৎ যা অরণ্য ও আমাদের উভয়েরই সমান অংশে ভাগ!
এই দেখে অরণ্যের নিকট আত্মীয় কেউ অথবা প্রস্তর
আরো মৌন ম্লান হয়ে যাবে
যেতে যেতে ইচ্ছে করে অরণ্যকে একদিন একথা শুধাই,
চলে যেতে যেতে।
শব্দ
শব্দ আমার ভালোবাসার পাত্র
মাত্র তাকে দিয়েছি এই শান্তি কোমল শান্তি
আরো অনেক দিনের দাহ, রাতের মেহকানি-
তবেই হবে শব্দ আমার গভীর প্রিয় পাত্রী!
শব্দ আমার ভালোবাসার বাগানবাড়ির বৃক্ষ
একখানি ডাল আকাশমুখী, একখানি তার পরম দুঃখী
আর একখানি ছুঁয়েছে কোনো গোপন দুর্নিরীক্ষ্য!
এতোদিন তো শব্দ কেবল শব্দ কেবল শব্দ
বুকের গভীর জলের ধারা তবেই তো সে স্বচ্ছ,
শব্দ তখন অধিক প্রিয় শস্য শালীন স্মরনীয়
শব্দ তোমায় শান্তি শান্তি! শব্দ তোমায় হৈমকানি-!
শব্দ তখন ভালোবাসার চিরকালীন পাত্রী!
এই শব্দে করেছি তোমায় শিল্প আমি শুদ্ধ
শব্দ তোমায় শান্তি শান্তি! শব্দ তোমায় হৈমকান্তি!
শব্দ তোমায় শব্দ!
শস্যযাত্রা
তোমাকে ধরবে না এই কালো পাটকেলে কামিজে
খুলে এই অস্থায়ী পোশাক পঁচিশ-বছর-ভেজা জরাজীর্ণ পাখা
আঁধারে রোদ্দুরে জমা শ্লেষ্মা-বসা বুকের ভিতরে
অন্য বুক তুলে নিয়ে
অন্য স্তব্ধ বিস্মিত হৃদয়, হৃদয়হরণ ভালোবাসা ও প্রত্যয়ে
তোমাকে ধরবো এই মেদমজ্জা মাংসের ভিতরে, অন্য পারে।
এই হাত হবে না তখন আর স্তুল মাংসের প্রতীক
পাবে স্বতন্ত্র আকৃতি
তারও অধিক ব্যঞ্জনা, কোনো শুভার্থী সন্নসী, কোনো
কামমুক্ত স্বতন্ত্র পুরুষ
কোনো সৃষ্টিস্পর্শ মর্মমুখরতা, কোনো আদিম সন্ন্যাস!
ততো দিন শুধু ভ্রমণের কাল অর্থাৎ ততোদিন তোমার অপেক্ষা।
এই অপেক্ষায় অপেক্ষায় পাখা আরো জীর্ণ হবে
চোখ আরো হবে অন্ধ অনুজ্জ্বল
আরো ক্ষীণ অবসন্ন হবে প্রাণ হবে অধিক বিবর্ণ
ওষ্ঠাগত,
শৈশব থেকে এ যৌবন অর্থাৎ বন্দী থেকে এ বাউল
এক স্বপ্ন থেকে জাগরণ
চালাক চতুর ভিন্ন এক দেশের বাসিন্দা ;
সেও কালো পাটকেলে কামিজ এই যৌবনের ঘামমাখা কাঁথা
এও বদলাতে হবে, এই পঁচিশ-বছর-ভেজা জরাজীর্ণ পাখা
যৌবনের ছেঁড়া এই বেশবাস ফেলে পুনরায় শৈশবের দিকে যাত্রা,
শস্যারম্ভ
তুমুল সন্ন্যসী তবু শুভার্থী স্বাধীন,
তখন তোমার চুলে সমস্ত শরীরে এই সোনালি শস্যের
স্পর্শ এঁকে দেবো আর
দেখো নারী বাঘ ঈশ্বর ও স্বর্গীয় বিষ নিঃসঙ্কোচে মানুষের
মতন খেয়েছি।
সামান্য জল
অষ্টপ্রহর নদীর ধারা গভরি বহনীয়
বুকের মধ্যে সামান্য জল সহজ স্মরণীয়;
সাগর জোড়া নোনা জলের গহীন গহনতা
বুকের ভিতর শান্ত জলে অশান্ত তীব্রতা।
চোখের ধারা বুকের ধারা উষ্ণ অধীর জল
তাহার চেয়ে সাগর নদী সরল সমতল;
নদীল ধারা নদরি বুকে সহজ বহে যায়
বুকের গোপন জলের ধারা কোথায় রাখি হায়!
সাগর ভরা জলের চেয়েও আমার বুকে জল
তোমার গভীর সংবেদনায় নিবিড় টলমল।
সুখীমৃত্যু
মুখ দখে তোমাকে চিনেছি, দুঃখে নয়
আনন্দে আমার মৃত্যু হবে আমি সন্দেহ করি না
তবু স্লেহে জেনেছি তুমি সেই প্রিয় মৃত্যুসখা
তুমি সেই প্রিয়তম মানুষের প্রত্যাশিত মুখ
শীতগ্রীষ্মে তোমাকেই স্মরণ করেছি। একদিন গ্রাম ছেড়ে
গৃহস্থালি ছেড়ে নদীর ভাঙন ছেড়ে এসেছি এখানে
এই শহরের আলোকিত উৎসবের নিচে, ব্যবধানে
মনে হয় তোমরা সবাই আজ আমার মৃত্যু চাও
নিকটে তাকালে তার নিদর্শন দেখি, বড়ো ভীত হই,
এমন কবিত্ব কিছু নয়, প্রকৃতই মরিতে চাহি না।
শুনেছি শীতের শেষে এইখানে সমারোহ হবে
হাওয়ায় উদ্ভিদে ঘাসে ফুলেজলে নতুন পাতায়
সমস্ত বোধের উৎস খুলে যাবে আর মানুষের
উৎসাহ জাগাবে, সে-রকম সুখী হবে লোকে।
আমি তাই আয়ত্তের অধিক চলেছি যেন এইভাবে
উড়িয়ে পুড়িয়ে আমি ঝরে খসে যাই। শুধু মনে মনে ভয়
পাছে তৃপ্তি পাই পাশে সুখী হই পাশে মৃত্যু হয়,
বিবাহিত সুখ তাই স্পর্শও করেনি, কামে প্রেমে আরো
হয়েছি সন্ন্যাসী, সুখী আমি একথা বুঝেছি আজ ভিতরে বাহিরে
তাই ঘরছড়া তাই অন্যমুখী তাই এভাবে উড্ডীন
একদিন ভালোবাসা ছাড়া আর অন্য খেলা আমার ছিলো না
আজ বড়ো ভয় পাই ভালোবেসে যদি বন্দী হই
তাই জড়ত্বে সঁপেছি, অন্ধকারে হাওয়া এসে লাগে
এই মূক বন্দী প্রাণে আমি টের পাই। তোমাকে চিনেছি
আমি মুখ দেখে ব্যবহার দেখে, তুমি দুঃখ নও
তুমি শারীরিকভাবে সহনীয়, তুমি সুখ,
এইখানে এই সুখে আমার মৃত্যু হবে।