মানবিক বৃক্ষ
তোমার মতন কোনো গাছ নেই স্বয়ংসম্পূর্ণ
এই উদার বৃক্ষমূলে নতজানু নবীন তাপস
ক্ষমায় স্নেহে ও প্রেমে কখনো হিংসায়
তুমি বাঁধো বিপুল মজ্জায় তাকে
রক্তে রক্তে তুমি তার লাল তরু, কিংশুক-অশোক
তোমার ছায়ায়, করতলে আভূমি আকাশ নত,
নীল গঢ় নিসর্গসম্ভার
তোমার মতন কোনো পরিপূর্ণ গাছ নেই,
কখনো গভীর রাতে দুঃস্বপ্নে সন্ত্রস্ত যুবা
খোঁজে যে-স্নিগ্ধ গাছ
মনে হয় যদি পাই ডালে ডালে জ্যোৎ্লারাত আলোকিত
ক্রিসমাস বৃক্ষের বিক্রম
কিংবা ফেরারী মানুষ অকস্মাৎ ঘরে ফিরে যার নিচে দাঁড়ায়
স্বস্তিতে
রাস্তায়, পার্কে, গহন অরণ্যে তেমন গাছ কোথায়?
বনজ বৃক্ষরাজি বড়ো ম্লান, একা, নির্জন
ভয়াবহভাবে নীরব, নিরপরাধ, সহানুভূতিহীন
সে শুধু দাঁড়িয়ে আছে যেন হৃতরাজ্য দণ্ডিত সুলতন,
অধোবধনে দেখছে সব, তার করণীয় কিছু নেই,
এই অক্ষম গাছের নিচে আমাদের এতোচটুকু বয়স কমে না
দুঃখে-সন্তাপে হৃদয়ে হৃদয়ে ওঠে বিস্তীর্ণ মৈনাক
কাঁদি, চিৎকারে বলি
অধঃপতিত যুবার এই শাসি-ভোগের আগে
তুমি তাকে উদ্ধার করো, গাছ
তোমার জন্মগত অদৃশ্য পোশাক খুলে ফেলো গাছ,
দাঁড়াও সম্মুখে
উজ্জ্বল নীল বাহু মেলে আলোড়নে আজন্ম জড়াও
গাছ তবু চিবরদিন নিঃশব্দ ও অমানবিক।
তোমার মতন কোনো গাছ নেই,
সীতা, তুমি গাছ, জীবনের পরিপূর্ণ তরু
অরণ্যে, প্রকৃতিতে দাঁড়ালেই বুঝি
সীতা, তোমার মতন কোনো গাছ নেই
এমন সম্পূর্ণ, মানবিক।
রবীন্দ্রোত্তর আমারা কজন যুবা
শুনুন রবীন্দ্রনাথ এ যুগে ভীষণ দায় বাঁচা, বড়ো অসহায়
আমারা কজন যাবা আপনার শান্তিনিকেতনে প্রত্যহ প্রার্থনা
করি হে ঈশ্বর, আমাদের
শান্তি দাও, প্রত্যহ প্রার্থনা করি মঠে ও গির্জায়
আমাদের শান্তি দাও, দাও মহান ঈশ্বর, তবু
সর্বত্র আজ অনাবৃষ্টি, রৌদ্রে
পোড়ে মাঠ, বোমায় শহর পোড়ে, লোকালয় উচ্ছন্নে যায়
মারী ও মড়কে কাঁপে দেশ, শুনুন রবীন্দ্রনাথ এ যুগে আমরা বড়ো
অসহায় কজন যুবকও বিশেষত আমরা কজন যুবা
ব্যক্তিযত নিখোঁজ সংবাদ যারা ঢেকে রাখি সর্বক্ষণ আস্তিনের
পুরু ভাঁজে, বড়োই রুগ্ন আমরা
এ যুগে নিঃশ্বাস নেবো প্রকৃতিতে বৃষ্টিতে বা উদার অনণ্যে দাঁড়াবো
এমন জো নেই কোনো,
আমাদের সন্নিকটে বনভূমি নেই।
এখণ ভীষণ রুগ্ন আমরা, সারা গায়ে কালোশিরা, চোখ ভর্তি
নিঃশেব্দ আঁধার, যেখনে যাই আমরা কজন যুবা
যেন বড়ো বেশি ম্লাম ফ্যাকাশে বৃদ্ধ, চোখমুখে
স্পষ্ট হয়ে লেগে থাকে যাবতীয় অনাচার, নিজের কাছেও
আজ নিজেদের লুকাবার রাস্তা খোলা নেই, এ যুগে আমরা
কড়ো অসহায় কজন যুবক ; শুনান রবীন্দ্রনাথ তবু আমরা
কজন যুবা আজো ভালোবাসি গান, তবু
আমরা কজন যুবক
বড়ো ভালোবাসি মাধবীকে, ভালোবাসি মাধবীর বাংলাদেশ
তার নিজস্ব বর্ণমালা রবীন্দ্রসঙ্গীত।
শুনুন রবীন্দ্রনাথ আমরা কজন যুবা, বড়ো বেশি অসহায় কজন
যুবা, তখন তাকিয়ে দেখি সূর্যাস্ত অস্তিত্বে রৌদ্র
ওঠে, পাখি নাচে, আমরা কজন এই ভয়ানক রুগ্ন যুবা পুনরায়
মাঠে যাই আমরা নিঃশ্বাস নিই সঙ্গীতের উদার নিসর্গে, আমরা
যেন ধীরে ধীরে বেঁচে উঠি
তখন মনে হয় এমনি করেই বুঝি এদেশে
বিপ্লব আসে, একুশে ফেব্রুয়ারি আসে, নববর্ষ আসে;
আমরা কতিপয় যুবা
তাই আর সব পরিচয় যখন ভুলে যাই এমনকি ভুলে
যাই নিজেদের নাম, তখনো মনে রাখি
রবীন্দ্রনাথ আমাদের আবহমান বাংলাদেশ
আমাদের প্রদীপ্ত বিপ্লব,
রবীন্দ্রনাথ আমাদের চিরদিন একুশে ফেব্রুয়ারি।
শহরে, এই বৃষ্টিতে
ঢাকার আকাশ আজ মেঘাচ্ছন্ন, মাধবী এখন তুমি বাইরে যেও না
এই করুণ বৃষ্টিতে তুমি ভিজে গেলে বড়ো ম্লান হয়ে যাবে তোমার শরীর
এই বৃষ্টিতে ঝরে যদি কারো হিমে তোমার কোমল দেহের আদল
মাধবী বৃষ্টিতে তুমি বাইরে গেও না। মাধবী তুষারপাতে
বাইরে যেও না।
এ শহরে বৃষ্টি এলে আমি ভেসে যাই কান্নার করুণ ভেলায়
হাতে নিয়ে তোমার একদা দেয়া উপহারের গোপন অ্যালবাম
এই তুষর বৃষ্টিতে যদি সব ছবি মুছে গিয়ে লেগে থাকে জলের গভীর চিহ্ন
শুধু জল, আমার কান্নার মতো করুণ কোমল সেই জল,
সেই তুষারের দাগ
আমি যদি ভেসে যাই এমনি অথই তুষারজলে তুমি তবু নিরাপদে থাবো
সেই হৃদয়ের হৃতরাজ্যে কোনোদিন আর ফিরে যাবো না, যাবো না
সেখানে প্রত্যহ এক আততায়ী যুবকের বহুবিধ কঠিন শসন ;
শহরে বৃষ্টি এলে গলে গলে পড়ে সব ময়লা কফ বিভিন্ন অসুখ
শোকের তুষার জলে বড়ো ভয়, মাধবী তুমি তাই বাইরে এসো না
সেই ভালো আমার জীবনে তুমি সুবিখ্যাত কিংবদন্তী হয়ে থাকো আজ।
সবাই মেলায় যায়
দুপুর গড়িয়ে গেলো আমাদের মেলা দেখতে যাওয়া
হলো না তো, দুপুর গড়িয়ে গেলে মেলার শৌখিন সব
খেলনা ফুরিয়ে গায়, একে একে ফুরিয়ে যায় মেলার জৌলুস
ধনীর দুলাল এসে ফি বছর আগেভাগে আমাদের
মেলা থেকে নিয়ে যায় মজার খেলনাগুলো, নিয়ে যায় দামী সব
কাঠের আসবাব, সারা মেলা থেকে তন্নতন্ন করে
খুঁজে নিয়ে যায় মেলার যা কিছু রম্য দর্শনীয় শৌখিন দ্রব্যাদি
অথচ আমরা মেলায় যাই দুপুর গড়িয়ে গেলে
শেষবেলা করে, যা কিছু না কিনলে নয় নেহাৎ সেটুকু
কেনাকাটা করে ঘরে ফিরি, কিন্তু আমার বড়োই ইচ্ছে
মেলা থেকে ঘর সাজাবার কিছু ছবি কিনে নেবো;
প্রতি বঠর আমাদের বাড়ির লাগানো মাঠে মেলা বসে
দিব্যি সবাই সময়মতো মেলায় যায়
ছেলেমেয়েদের হতে দেয় এটাসেটা লজেন্স বা মেলার মিঠাই
বউঝির জন্যে নিয়ে আসে ডুড়ে শাড়ি, পছন্দমতো
নানান মাপের চুড়ি, মেলার আনন্দ তারা লুটে ঘরে নিয়ে
আসে, মেলা থেকে ফিরে এসে ঘরে তারা মেলাই
বসায়, আমাদের এই বাড়ির লাগোয়া মেলা বসে
তবু মেলায় পা বাড়ালে দেখি দুপুর গড়িয়ে গেছে
সেই তো কখন ;
আমরা মেলায় গাবো কথা ছিলো ঘুরে ঘুরে
দেখবো মেলায় কোথায় বসেছে সারি সারি
ছবির দোকান, কোথায় নাগরদোলায় ঘুরছে
ঘর সাজাবার কিছু ছবি কিনে নেবো, এই মেলা
থেকে আমি নিয়ে আসবো ঘরে কিছু
আনন্দ-সম্ভার;
অথচ মেলায় গেলে
দেখি মেলা থেকে ঘরে ফিরছে লোকজন, কারো
হাতে প্রসাধনী, কারো ফুলতোলা মাটির কলস হাতে,
নানান পণ্য নিয়ে দেখি ঘরমুখো মেলা-ফিরতি লোক, মেলায়
মানুষ নেই, দেকানপাট একে একে উঠে
গেছে, সারা মেলা ভর খাঁখাঁ শূন্যতা চাদ্দিকে
ভাঙএচারা, ছেঁড়া মোড়কের অংশ, খোসা,
এই শূন্য মেলা থেকে আমি কী করে
কিনবো বলো ঘর সাজাবার ছবি, আনন্দের
কিছুটা আশ্বাস, কথা ছিলো মেলায় যাবো
সময়মতো ডাকবে আমায়, দুপুর গড়িয়ে গেলো,
বিকেল গড়িয়ে গেলো, আমাদের
মেলা দেখতে যাওয়া হলো না তো, আমরা মেলায় যাবো
আমাদের কোনোদিন হলো না সময়।