- বইয়ের নামঃ একা হয়ে যাও
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- প্রকাশনাঃ ম প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আর কার কাছে পাবো
এতোটুকু স্নেহ আর মমতার জন্য আমি কতোবার
নিঃস্ব কাঙালের মতো সবুজ বৃক্ষের কাছে যাই-
হে বৃক্ষ আমাকে তুমি এতোটুকু ভালোবাসা দাও,
বনস্পতি আমাকে দেখিয়ে দেয় তোমার দুচোখ
বলে, ওই দুটি নিবিড় চোখের কাছে যাও।
কতোবার এতোটুকু ভালোবাসা চেয়ে আমি
নির্জন নদীর কাচে যাই-
বলি, পুণ্যতোয়া নদী, আর কিছু নয়,
আমাকে একটু তুমি সহানুভূতির স্পর্শ দাও,
নদী আমাকে দেখিয়ে দেয় তোমার ঠিকানা
বলে, গাছপালা, নদী বন রেখে তার কাছে যাও।
আমি এই ভালোবাসা চেয়ে বহুবার চঞ্চল ঝর্নার
কাছে যাই
হাত পেতে তার কাছে চাই এই তৃষ্ণার শীতল জলধারা,
সে আমাকে বলে, তোমার শুস্ক বুক
যদি একটু ভেজাতে চাও-
সজল বর্ষার মেঘ কিংবা ওই স্নিগ্ধ
জলাশয় ফেলে
ছুটে যাও তার কাছ, পাবে জল ক্লানি-,
পিপাসার।
ভেবো না যাইনি আমি আর কোনোখানে
বৃক্ষ, পত্র, অরণ্য, উদ্ভিদ, পাখি, প্রকৃতির কাছে
এতোটুকু ভালোবাসা চেয়ে কতোদিন
করেছি অপেক্ষা
অবশেষে এসেছি তোমার কাছে-
তুমি যদি না দাও আশ্রয়,
যদি না হয় আর্দ্র তোমার হৃদয়
তোমার এমন অনুভূতিশীল দুটি চোখ যদি
না বোঝে আমার দুঃখ-
তাহলে কীভাবে বলো নদী আর বৃক্ষের কাছে
স্নেহচ্ছায়া পাবো!
একা হয়ে যাও
একা হয়ে যাও, নিঃসঙ্গ বৃক্ষের মতো
ঠিক দুঃখমগ্ন অসহায় কয়েদীর মতো
নির্জন নদীর মতো,
তুমি আরো পৃথক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাও
স্বাধীন স্বতন্ত্র হয়ে যাও
খণ্ড খণ্ড ইওরোপের মানচিত্রের মতো;
একা হয়ে যাও সব সঙ্ঘ থেকে, উন্মাদনা থেকে
আকাশের সর্বশেষ উদাস পাখির মতো,
নির্জন নিস্তব্ধ মৌন পাহাড়ের মতো
একা হয়ে যাও।
এতো দূরে যাও যাতে কারো ডাক না পৌঁছে সেখানে
অথবা তোমার ডাক কেউ শুনতে না পায় কখনো,
সেই জনশূন্য নিঃশব্দ দ্বীপের মতো,
নিজের ছায়ার মতো, পদচিহ্নের মতো,
শূন্যতার মতো একা হয়ে যাও।
একা হয়ে যাও এই দীর্ঘশ্বাসের মতো
একা হয়ে যাও।
কেবল উন্মাদই পারে
আমি যে এখন কী করি না করি আর কখন কোথায় যাই
কিছুই জানি না
হয়তোবা পিপাসায় মুখে দেই কঠিন পাথর,
জল দেখে আমার দুচোখে শুধু রক্তস্রোতের দৃশ্য ভাসে
তাই তো এখন আমি সূর্যোদয় হলে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যাই, সারারাত
আতঙ্ক ও আশঙ্কায় কাঁপি।
দেখি আমার চোখের সামনে পুড়ে যায় শত শত মানুষের ঘর
সেই নির্দয় আগুনে পোড়ে শস্য, দুগ্ধবতী গাভী,
অসহায় মানবসন্তান
আর সেই সঙ্গে পুড়ে খাক হয় মনুষ্যত্ব, বিবেক
ও শুভ মূল্যবোধ।
আমার চোখের সামনে দেখি খসে পড়ে তারা,
শীতের দেশের অতিথি পাখির মতো দেখি তীরবিদ্ধ হয়
মানুষের বুক।
আমি কবিতারর খাতায় এখন তাই চেয়ে দেখি
সারা পাতা জুড়ে সেই কুতুবদিয়ার অগ্নিদগ্ধ শিশুদের
লাশ পড়ে আছে,
পড়ে আছে দূর হিমাচল প্রদেমের কোনো কিশোরের রক্তাপ্লুত দেহ
কিংবা বসনিয়ার কোনো ধর্ষিতা নারীর ছিন্নবস্ত্র,
একগোছা চুল-
এখানে ঘাসের বুকে শিশিরের পরিবর্তে তাই বসনীয় কোনো
জননীর অশ্রুবিন্দু জমে আছে;
এইখনে এই ধ্বংস, মৃত্যু, বিভীষিকা ও নিহত আত্মার পাশে,
আগুন জ্বালিয়ৈ ভস্মসাৎ করা মানুষের এই
ভণ্ডুল সংসার আর দুঃখের
পাশে
কীইবা করতে পারি আমি, ফেলতে পারি ক’ফোটা
চোখের জল,
মোছাতে পারে কয়টি মুখের ব্যথিত বিষাদঅশ্রু
ক’জনের অনাহারী মুখে দিতে পারি ক্ষুধার দুমুঠো অন্ন!
আমি আজ কী যে করি, কখন কোথায় যাই
সন্ধ্যায় হয়তো করি প্রাতঃরাশ, মধ্যাহ্নে জ্বালাই
ঘরে আলো-
মনে মনে ভাবি প্রকৃতই সুস্থ হলে এইসব দেখে
অনেক আগেই সুতার ওপারে চলে
যাওয়া স্বাভাবিক ছিলো,
কেবল উন্মাদই পারে পৃথিবীর এই ছিন্নভিন্ন
রূপ দেখে সুস্থ ও স্বাভাবিক
থাকতে এখনো।
তারা আমাদের কেউ নয়
তারা আমাদের কেউ নয় যারা মসজিদ ভাঙে
আর মন্দির পোড়ায়,
তাদের মুখের দিকে চেয়ে সমস্ত আবেগরাশি
হয়ে যাও বরফের নদী-
অনুভূতির সবুজ প্রান্তর তুমি হয়ে যাও উত্তপ্ত সাহারা।
তাদের পায়ের শব্দ শুনে রুদ্ধ হয়ে যাও তুমি
চঞ্চল উদ্দাম ঝর্নাধারা,
মেঘ হও জলশূন্য, নীলিমা বিদীর্ণ
ধ্বংসস্তপ।
তারা আমাদের কেউ নয়, কখনো ছিলো না,
যারা মানুষের বাসগৃহে জ্বালায় আগুন,
শস্যক্ষেত্র করে ছত্রখান
লুট করে খাদ্য, বস্ত্র, যা কিছু সম্বল-
তাদের কণ্ঠস্বর শুনে ঘৃণায় কুঞ্চিত হও
সুন্দর গোলাপ, শুস্ক হও সব স্রোতস্বিনী,
ফলবান বৃক্ষ হও ছায়াহীন, নিষ্ফলা, নিষ্পত্র,
তারা আমাদের কেউ নয়, কোনোকালেও ছিলো না,
যারা এইভাবে শত শত ঘরে অনায়াসে আগুন জ্বালিয়ে
দিতে পারে
কিংবা করতে পারে এইভাবে মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়া,
যারা এভাবে বুনতে পারে হিংসার বীজ
করতে পারে দাঙ্গা-হানাহানি, রক্তপাত, সম্ভ্রম লুণ্ঠন,
তারা আমাদের কেউ নয়, কখনো ছিলো না;
মানুষের নামের তালিকা থেকে মুছে ফেলো
তাদের এ কলঙ্কিত নাম-
তাদের মুখের দিকে চেয়ে চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাও
মাতৃস্নেহ,
প্রেমিকার পবিত্র আবেগ,
মাদার তেরেসার অপার স্নেহের হাতখানি;
তাদের উদ্দেশ্যে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাও তুমি পাখিদের গান,
মোনাজাত, মীরার ভজন।
তোমার নিকটে
কেবল স্বপ্নের মধ্যে যাতে পারি আমি
তোমার নিকটে-
তা ছাড়া তোমার কাছে পৌঁছবার আর কোনো পথ খোলা নেই;
সম্ভাব্য সকল রাস্তা অবরুদ্ধ, নৌ বা
বিমানপথে
সতত প্রহরা
স্থলপথ জুড়ে অনেক আগেই ঘন
কাঁটাতার,
এখন দেখছি আমাদের দুজনের মাঝে লক্ষ কোটি মাইল দূরত্ব
তোমার নিকটে যাওয়ার পথ এতো দীর্ঘ
এমনি অচেনা
তার চেয়ে বরং কলম্বাস কিংবা ভাস্কো ডা গামার
সমুদ্রযাত্রাও
ছিলো অনেক সহজ;
এই দক্ষিণ মেরুর পথ পাড়ি দিয়ে উত্তর
মেরুতে
যেতে কোটি কোটি সৌরবর্ষ
হেঁটে যেতে হবে,
নৌপথে সেখানে যেতে
পৃথিবীর সবক’টি মহাসাগর পাড়ি দিতে হবে কয়েক লক্ষ বর
দ্রুততম মহাশূন্য যানেও এই দূরত্ব পেরুতে গেলে
লেগে যাবে আরো অনেক জীবন;
কেবল ঘুমের মধ্যে তোমার দুচোখে স্বপ্ন হয়ে
যেতে পারি আমি
সোনার কাঁকই দিয়ে খুব যত্নে বেঁধে দিতে পারি
ঘন চুল,
সহজে দেখতে পারি তোমার কোমল পায়ে কোথায়
ফুটেছে ঠিক কাঁটা,
ছড়ে গেছে কয়টি আঙুল, দুই ওষ্ঠে শুষে নিতে
পারি সব
রক্ত, পূঁজ, বিষ;
কেবল সেখানে হাত ধরে পাশাপাশি বসতে পারি পার্কের ছায়ায়
কিংবা নির্জন লেকের ধারে,
কোনো মৌন রেস্তরাঁয়
এ ছাড়া তোমার নিবিড় সান্নিধ্য লাভ
কখনো সম্ভব নয়
তোমার আমার নিভৃতে বসার মতো
এতোটুকু নির্জনতা নেই এ শহরে-
একটিও সবুজ উদ্যান নেই, তিতির-শালিক নেই,
যার পাশে নিরিবিলি একটু বসতে পারি,
মৃদু স্বরে একটু করতে পারি বাক্যালাপ
এমনটি পরস্পর সামান্য কুশল বিনিময়।
এই সমস্ত দূরত্ব আর বাধার প্রাচীর ভেদ করে
কেবল স্বপ্নের মধ্যে অনায়অসে যেতে পারি আমি
তোমার নিকটে।
দান
আমি চাই একটি ছোটো নদী,
তুমি দাও অসীম সমুদ্দুর-
আমার চাওয়া শ্যামল মাটির ঘর,
তুমি দেখাও রাজার অন্তঃপুর।
আমি চাই একটুখানি ছায়া,
তুমি দাও স্নিগ্ধ নীলাকাশ-
আমার চাই একটু সবুজ জমি,
তুমি করো অনন্তে চাষবাস।
আমি চাই কোনো সজল মেঘ,
তুমি বলো অনন্ত অম্বর-
আমি চাই একটি স্নেহের হাত,
তুমি দেখাও বিশ্বচরাচর।
দুঃখীর জীবনে তুমি
এই দুঃখীর জীবনে তুমি ফোটাও
সামান্য দুটি ফুল,
না হোক গোলাপ-চাঁপা নিরিবিলি
দুইটি বকুল;
আমার তাতেই হবে চাইবো না
অনন্ত আকাশ,
কেবল শিশির দিলে একফোঁটা
ভূলি দীর্ঘশ্বাস।
এই দুঃখীর জীবনে তুমি দিও
এতোটুকু ছায়া,
জলভরা মেঘ যদি নাই পাও
কিছু স্নেহমায়া;
এই দুঃখীর জীবনে তুমি জ্বেলে
দাও সন্ধ্যার আলো-
তাতেই উঠবো হয়ে আলোকিত,
হয়ে যাবো ভালো।
ষাটের দশক
কোথায় কেমন আছ তুমি প্রিয় ষাটের দশক
তোমার কি এখন খুবই কষ্ট, তুমি খুবই একা,
দরোজায় তোমার কি শুধু দীর্ঘশ্বাস গ্রিলে বিষণ্ন গোধূলি?
কোথায় তোমার সেই উদ্দাম অশ্বের গতিবেগ,
মধ্যরাতে কাঁপানো ফুটপাত-
রক্তমাংসে পরস্পর ভালোবাসাবাসি, সেই বাঁধভাঙা অথই জোয়ার
আজ এই বয়সের ভাঁজপড়া তোমার মুখের দিকে
আমি আর তাকাতে পারি না;
প্রিয় ষাট, কোথায় তোমার সেই আলোকিত ডানা
চিতার চোখের মতো ভীষণ উজ্জ্বল দুটি চোখ,
বুকে অজস্র প্রেমের পঙ্ক্তিমালা-
কোথায় তোমার সেই হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে
অবাধ্য উত্তাল কেশরাশি
চলেছো কেমন একা দুপুরের খররৌদ্রে ঢাকার রাস্তায়,
এখন এসব কিছু শুধু অতীতের দূর ম্লান স্সৃতি
এখানে ওখানে তুমি মাত্র স্মৃতির পাথর-
কোথঅওবা সকরুণ মৌন এপিটাফ,
এখন তোমা রদিকে প্রিয় ষাটের দশক মুখ তুলে
তাকাতে পারি না।
নিজেরই আমর ভয় করে এখন তোমার সাথে বাক্যালাপ করে
কী রকম স্বার্থপর, দারুণ হিশেবী হয়ে গেছো তুমি-
মেপে মেপে মদ্যপান করো, সিগারেট একটি কি দুটি,
নানা অসুখ বেঁধেছে বাসা তোমার শরীরৈ-
কারো বক্ষে, শিরদাঁড়ায়, কারো হৃৎপিণ্ডে, পাকযন্ত্রে
কারো রক্তে শর্করা, কারো উচ্চ রক্তচাপ
উত্তর-চল্লিশে এই বিভেদের বিরূপ বাতাসে সবাই বিচ্ছিন্ন একা একা;
তোমার লাবণ্য আর রূপ বুঝি শীতের বিবর্ণ পাতা মতো
যায়, ঝরে যায়।
প্রিয় ষাটের দশক, আমাদের সবুজ সোনালি দিনরাত
এখনো তোমার সেই অসম্ভব মায়াময় সুন্দর মুখটি মনে পড়ে,
তোমার দুফোঁটা অশ্রু, নিবিড় আবেগ,
সবচেয়ে হার্দ্য অনুভূতি, প্রেম, ঘৃণা, তীব্র উত্তেজনা
এখনো তোমার সেই সুখদুঃখ আর স্মৃতি বুকে নিয়ে
বহুরাত একা জেগে থাকি;
দুঃখ করো না, প্রিয় ষাট, আমাদের সোনালি যৌবন
শোনো তাহলে তোমার কানে কানে বলি-
এখনো তোমাকে আমি ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি।
হিংসা তার আদিগ্রন্থ
মানুষ কিছুই শিখলো না আর, কিছুই শিখলো না
এইসব বয়স্ক বালক-
শুধু আদিবিদ্যা তীর ছোঁড়া ছাড়া তার কিচুই হলো না শেখা,
কেবল শিকার আর রক্তপাত ব্যতীত বিশেষ কোনো পাঠ
করলো না শেষ বুঝি এই নির্বোধ মানুষ;
মনে হয় হিংসা তার আদিগ্রন্থ, শেষ বই
এই রক্তপাত
তাই কি এখনো তার চোখেমুখে লেখা সেই আদিম অক্ষর?
সে কোনো নিলো না শিক্ষা আলোকিত দিবসের কাছে
উজ্জ্বল সূর্যের কাছে, দ্যুতিময় নক্ষত্রের কাছে-
তার যা কিছু সামান্য বিদ্যা অন্ধকার রাত্রি আর
বধ্যভূমি, পিশাচের কাছ থেকে শেখা।
কখনো বসলো না সে হাঁটু গেড়ে স্নিগ্ধ নদী, নীলাকাশ
শ্যামল বৃক্ষের পাদদেশে-
শিশুর পবিত্র মুখ থেকে নিলো না সে অনন্ত সুঘ্রাণ,
সে কেবল বারবার তুলে নিলো শিকারীর তীর, তরবারি
আজো সে তেমনি কুরুক্ষেত্রে দুষ্ট দুঃশাসন।
পাঁচ সহস্র বছর আগে যেখানে সে ছিলো
এখনো তেমনি সেখানেই হামাগুঁড়ি দেয়, চার পায়ে হাঁটে,
এর বেশি কিছুই হলো না তার শেখা
একচুলও এগুলো না তার এই লনড় জাহাজ।
ঘুরে ফিরে সেখানেই ফিরে এলো অর্বাচীন অথর্ব মানুষ
নিজেকে ধ্বংস করা ছাড়া সম্ভবত কিছুই হলো না জানা তার-
আর অপরের হৃদয় রক্তাক্ত করা ছাড়া কিছুই শিখলো না
এই মানুষ নামের দ্বিপদ প্রাণীরা।