একটা ফুলকির জন্যে
একটা কথায় ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে পড়বে কবে
সারা শহর উথাল পাথাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে
কাটবে চিবুক চিড় খাবে বুক
লাগাম কেড়ে ছুটবে নাটক
শুকনো কুয়োয় ঝাঁপ দেবে সুখ
জেলখানাতে স্বপ্ন আটক
একটা ব্যথা বর্শা হয়ে মৌচাকেতে বিঁধবে কবে
ছিঁড়বে মুখোশ আগ্নেয় রোষ
জুলবে আগুন পুতুল নাচে
ভাঙবে গরাদ তীব্র সাহস
অনেক ছবি টুকরো কাচে
একটা কুঁড়ি বারুদগন্ধে মাতাল করে ফুটবে কবে
সারা শহর উথাল পাথাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।
একটি অসাধারণ কবিতা
আমার ভালোবাসায় যে নিজেকে উৎসর্গ করেছিল
সেই মেয়েটি এখন আত্মহত্যা করছে।
নীল ও বিন্দু বিন্দু আমার কপালে ঘাম
তার কাছে আমি গভীর সার্থকতা ছিলাম
আমার তরফে কিছু প্রবঞ্চ নাও বুঝি ছিল
অথবা সে কোনোদিনও সমুদ্র দেখেনি।
সে এখন আত্মহত্যা করছে
তার আঙুল, লুকোনো নরম রক্ত, সাদা গলা
এখনও বেঁচে আছে
শুধু তার চোখের পলক পড়ছে না।
স্থির সম্মতির মতো অপলক আয়নায়
সে এখনও বেঁচে আছে
কোনোদিনও সমুদ্র দেখেনি।
আমাদের একইসঙ্গে সমুদ্রে যাওয়ার কথা ছিল
সে এখনও বেঁচে আছে
এখনও হয়তো যাওয়া যায়
নীল ও তুষারকণা আমার কপালে ঘাম।
এখনও তাকে সারারাত্রি চুমু খাওয়া যায়
এমনকী মৃত্যুর পরেও তাকে সারারাত চুমু খাওয়া যায়
ঘুমন্ত তাকে এত সুন্দর দেখাত
আরও গভীর ঘুমে সৌন্দর্য আরও জন্ম নেয়
কিন্তু সে এখনও বেঁচে আছে
শুধু তার চোখের পলক পড়ছে না।
তার আঙুল কঁপিছে দ্বিধায় ও বিভিন্ন কোণে বসানো পাথরে
নরম রক্ত নিভে যাচ্ছে ভয়ে
সাদা গলার মধ্যে স্বচ্ছ বাতাস ও রাত্রি
আমি এই ঢেউ ও ঝড়ের বিপদসঙ্কেতের কাছে কিছু না
এত ফেনা আর গভীর অন্ধকার প্রবালদ্বীপের মধ্যে
সামুদ্রিক অশ্বের হ্রেষায়
আমার নিজের ঠোঁট নিজেরই অচেনা।
অতল সার্থকতা ছিলাম
মৃত্যু, মরে যাওয়া, মরণের মতো
নীল ও বিন্দু বিন্দু আমার কপালে মুহূর্ত।
আমার ভালোবাসায় যে নিজেকে উৎসর্গ করেছিল
সেই মেয়েটি এখন আত্মহত্যা করছে।
কবির ঔদ্ধত্য
গাঢ় আঁধার দুমড়ে ভেঙে কোথায় চলেছিস
আগুন খেতে যাচ্ছি আমি, তোদের বাবার কী
এই দেশেতে কবির জন্ম দগ্ধ অভিশাপ
মাকড়কূলে সিংহ হেন, ভস্মে ঢালার ঘি।
যাবজ্জীবন হেলায় থাকি, প্রসাদ করে তুচ্ছ
জিভের ওপর গনগনে আঁচ কয়লা রেখে দি
মূষিক কবি, শৃগাল কবি ওড়ায় ন্যাড়া পুচ্ছ
আগুন ক্ষেতের শস্য দেহ ভস্মে সঁপে দি।
প্রতিষ্ঠানের প্রসাদ বিষ্ঠা হেলায় ঠেলে ফেলে
কবি থাকেন কাঠের চিতায় এমন আঁকি পট
অবহেলায় অবোধ এবং খেলায় এলেবেলে
কবির চিতায় পাপতরাসী গাথে তাহার মঠ।
ঘেন্না করি অবজ্ঞাতে বুটের পেরেক, চামড়া
আগুন হতে গেছেন তিনি, স্বর্ণপ্রভ কাঠ
ঘেন্না করি রাতবিরেতে আছেন যেমন—আমরা
দুস্থ ইতর ভাষাবিহীন নগ্ন এ তল্লাট
গণ্ডি ভেঙে আগুন মেঙে কোথায় চলেছিস
যেথায় খুশি যাচ্ছি আমি, তোদের বাবার কী
এই দেশেতে কবির জন্ম দগ্ধ অভিশাপ
বেশ্যাকূলে সীতার সামিল, ভস্মে ঢালার ঘি।
কলকাতা
নিয়নের বেশ্যাদের ফসফোরাস ছায়ার মধ্যে
আশ্চর্য ক্রেন ছিঁড়ে খাচ্ছে শহরের শিরা-উপশিরা
গল গল করে বয়ে যাচ্ছে, জমে থাকছে শহরের রক্ত
অলৌকিক ভিক্ষাপাত্রের মতো চাঁদ
দাঁতে কামড়ে ছুটে যাচ্ছের রাতের কুকুর
আমি একটা ফাঁকা এম্বুলেন্স পাক খাচ্ছি উদ্ভট শহরে
আমার জন্যে সবুজ চোখ জ্বলো ভাগ্য বা নিয়তি
যাকে আমি নিয়ে যাব তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না
সারা দেহ হা করে দিয়েছে স্ট্যাবকেস
সাদা সাদা অজ্ঞান মোহিনী নাসের মতো বাড়ি
এই অসুস্থ শহরের প্রত্যেকটা ম্যানহোলে অন্ধকারে
ঝলসে উঠছে ছুরি
আমার সাহসের মাংস ফালি ফালি করে দেবে বলে
আমাকে হুকের থেকে ছাল ছাড়িয়ে টাঙিয়ে দেবে মহাবিশ্বে
গলাকাটা অবস্থায়
আমিও শান দিয়ে নিয়েছি আমার দুধৰ্দাত ও বাঘনখে
ভীষণ রোখ আমার এই রহস্যের ভাগ আমাকে দিতে হবে
সব ভাগাভাগির শেষে আমাকে থাকতে হবে ফাঁকা ঘরে
আমাকে আঁকড়ে থাকবে অনাথ আশ্রমের শেষ প্রার্থনা
মৃত বলে কেউ আমাকে ঘোষণা করলেও
জেগে থাকবে আমার চোখের হীরা
কিন্তু এখন নিয়নের বেশ্যাদের ফসফোরাস ছায়ার মধ্যে
আশ্চর্য ক্রেন ছিঁড়ে খাচ্ছে শহরের শিরা-উপশিরা
কালবেলা
যুবকেরা গেছে উৎসবে
যুবতীরা গেছে ভোজসভায়
অরণ্য গেছে বনানীর খোঁজে
গরীব জুটেছে শোকসভায়।
গয়নারা গেছে নীরব লকারে
বন্যপ্রাণীরা অভয়ারণ্যে
বিমান উড়েছে আকাশের খোঁজে
গরীবরা শুধু হচ্ছে হন্যে।
পুরুষেরা গেছে নিভৃত মিনারে
গর্ভবতীরা প্রসূতিসদনে
কুমিরেরা গেছে নদীর কিনারে
গরীব জমছে নানা কোণে কোণে।
বিপ্লব গেছে নেতাদের খোঁজে
যুবকেরা গেছে উৎসবে
যুবতীরা গেছে বিশিষ্ট ভোজে
গরীবের হায় কী হবে?
কিছু একটা পুড়ছে
কিছু একটা পুড়ছে
আড়ালে, বেরেতে, তোষকের তলায়, শ্মশানে
কিছু একটা পুড়েছেই
আমি ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছি
বিড়ি ধরিয়েছে কেউ
কেউ উবু হয়ে ফুঁ দিচ্ছে উনুনে
কেউ চিতায় তুলে দিয়েছে
আন্ত্রিক রোগে মৃত শীর্ণতম শিশু
ওলট পালট খাচ্ছে জ্বলন্ত পাখি
কোথাও গ্যাসের সিলিণ্ডার ফেটেছে
কোথাও কয়লাখনিতে, বাজির কারখানায় আগুন
কিছু একটা পুড়ছে
চার কোনা ধরে গেছে
জ্বলন্ত মশারি নেমে আসছে ঘুমের মধ্যে
কিছু একটা পুড়ছে
ক্ষুধায় পুড়ছে নাড়ি, অন্তেরা
ভালোবাসায় পুড়ছে যুবক
পুড়ছে কামনার শরীর, তুষ, মবিলে ভেজানো তুলো
কিছু একটা পুড়ছেই
হল্কা এসে লাগছে আঁচের
ইমারত, মূল্যবোধ, টাঙানো বিশাল ছবি
প্রতিশ্রুতি, টেলিভিশন, দুপ্তপ্রাপ্য বই
কিছু একটা পুড়ছে
আমি হাতড়ে হাতড়ে দেখছি কী পুড়ছে
কিছু একটা পুড়ছে
কী ছুঁয়ে হাতে ফোস্কা পড়ছে
কিছু একটা পুড়ছে, গনগন করছে
চুপ করে পুড়ছে, মুখ বুজে পুড়ছে
ঝড় যদি ওঠে তাহলে কিন্তু দপ করে জ্বলে উঠবে
কিছু একটা পুড়ছে বলছি
দমকলের গাড়ি, নাভিকুণ্ডল, সূর্য
কিছু একটা পুড়ছে
প্রকাশ্যে, চোখের ওপর
মানুষের মধ্যে
স্বদেশ!