অন্তর্জলী যাত্রা – কমলকুমার মজুমদারের লেখা একটি সমকালীন উপন্যাস। অন্তর্জলী যাত্রা উপন্যাসের বিষয়বস্তু সম্প্ররকে অনেকে জানতে চেয়েছে। আমি বলব আপনে মনোযোগ সহকারে উপন্যাসটি পড়ুন তাহলেই আপনার সকল প্রশ্ন উন্মোচিত হয়ে যাবে। অন্তর্জালী যাত্রা কমলকুমার মজুমদারের প্রথম এবং একমাত্র উপন্যাস যাহা ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয়।
অন্তর্জলী যাত্রা বইয়ের বিবরণঃ
- বইয়ের নামঃ অন্তর্জলী যাত্রা
- লেখকের নামঃ কমলকুমার মজুমদার
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
- প্রকাশিতঃ ১৯৫৯
অন্তর্জলী যাত্রা – কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাস
উপন্যাস ভূমিকা – কমলকুমার মজুমদার
ভূমিকা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
জীবনানন্দ দাশের অন্তত বারো কিংবা চোদ্দোটি উপন্যাসের (দু’টিকে বড়গল্প বলা যায়) সন্ধান পাওয়া গেছে এ পর্যন্ত এবং সম্ভবত আরও চারখানি উপন্যাস লুক্কায়িত আছে তাঁর পাণ্ডুলিপির জীর্ণ ভূপে। সেগুলি পুনরুদ্ধার কাজে ব্যাপৃত রয়েছেন ভূমেন্দ্র গুহ। এবং ছোটগল্প লিখেছেন প্রায় একশো কুড়িটি। তাঁর জীবদ্দশায় এগুলির একটিও প্রকাশিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথেরও উপন্যাসের সংখ্যা বারোটি এবং ছোটগল্পও একশো’র কমই হবে। সবই তিনি দেখে গেছেন মুদ্রিত অবস্থায়। রবীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে কবি ও কথাসাহিত্যিক। কিন্তু জীবনানন্দের এই দ্বিতীয় পরিচয়টি গুপ্ত ছিল বহুদিন। কেউ শখ করে একটি-দুটি উপন্যাস রচনা করতে পারেন, মুদ্রণের সম্ভাবনা থাক বা না থাক। কিন্তু এতগুলি উপন্যাস ও গল্প রচনা, যা বেশ পরিশ্রমসাধ্য কাজও বটে, কোনো রকম পাঠক-প্রত্যাশা না করেও একজন মানুষ, বিশেষত। একজন কবি, কেন করেছিলেন তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
কমলকুমার মজুমদার উপন্যাস লিখেছেন আটটি এবং কিছু গল্প। উপন্যাসগুলি এবং প্রায় সব গল্পই প্রকাশিত হয়েছে এক্ষণ, কৃত্তিবাসের মতন পত্রিকায়, কোনো বহুল প্রচারিত, অভিজাত বা সওদাগরি পত্রিকায় সে সব রচনার স্থান হয়নি। ব্যতিক্রম শুধু দুটি ছোট গল্প, ‘মতিলাল পাদরি’ ও ‘তাহাদের কথা’ মুদ্রিত হয়েছিল সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায়। কমলকুমার জীবনানন্দের মতন নিঃসঙ্গতা বিলাসী ছিলেন না। জীবনানন্দ যেন ইচ্ছে করেই তাঁর উপন্যাস-গল্পগুলি রেখেছিলেন পাঠকদের চোখের আড়ালে, কেন না, যে-সব পত্র-পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখতেন, তার কোনোটিতে একটু চেষ্টা করলে তাঁর উপন্যাস-গল্প ছাপা হতো না, এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। বাংলার অনেক কবিই কিছু কিছু গদ্যকাহিনী লিখেছেন, যেমন মাইকেল মধুসূদন, নজরুল ইসলাম, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী প্রমুখ, সবই মুদ্রিত, শুধু জীবনানন্দ তাঁর একটিও গদ্য কাহিনী কেন প্রকাশ করতে চাননি, সে রহস্য আর বোধহয় উদঘাটিত হবার সম্ভাবনা নেই।
কমলকুমার অল্প সংখ্যক পাঠক পেয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন, সেই জন্যই তিনি একটার পর একটা উপন্যাস লিখে গেছেন ছোট পত্রিকায়। হয়তো তিনি সচেতন ছিলেন, তাঁর রচনারীতি বৃহত্তর পাঠক সমাজের জন্য নয়। রচনাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের ব্যাপারেও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না, যতদূর জানি, তাঁর একটি মাত্র উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ এবং একটি গল্প সংকলন ‘নিম অন্নপূর্ণা’ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর জীবিতৎকালে। আর একটি উপন্যাস ‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক’ প্রকাশের প্রস্তুতি চলছিল, মুদ্রণ সম্পূর্ণ হবার আগেই তাঁর অকালমৃত্যু ঘটে।
এর পর কমলকুমারের উপন্যাসগুলি পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধার করেন তাঁর স্ত্রী দয়াময়ী মজুমদার। তিনি স্বয়ং বিদুষী এবং সুলেখিকা। কিন্তু কোনো বিচিত্র কারণে সধবা অবস্থায় তাঁর এই সব পরিচয় কিছুই জানা যায়নি, তিনি ছিলেন অন্তরালবুর্তিনী। এমনকী কমলকুমার তাঁর প্রথম উপন্যাস গ্রন্থটি পত্নীকে উৎসর্গ করলেও সেখানে সহধর্মিণীর নাম উল্লেখ করেননি, শুধু লিখেছিলেন স্ত্রীকে।
খ্যাতির আকাঙ্ক্ষায় লেখেননি কমলকুমার, অর্থের জন্য তো নয়ই। এক্ষণ পত্রিকায় সম্মান দক্ষিণা দেবার রেওয়াজ ছিল না, কমলকুমার কিছু পেয়েছিলেন কি না জানি না। কৃত্তিবাস পত্রিকা থেকে তিনি একবারই চেয়ে নিয়েছিলেন মাত্র তিরিশ টাকা। (প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, যে গুটিকয়েক ছাত্রকে তিনি ফরাসি ভাষা শিক্ষা দিতেন, তাদের কাছ থেকে গুরুদক্ষিণা নিতেন মাসিক একটাকা।)
তবে কমলকুমারের সাহিত্য রচনার প্রেরণা কী ছিল? তিনি ছিলেন উত্তম পড়ুয়া, তাঁর সময়ে, একশো বছরের বাংলা গদ্য সাহিত্য ছিল তাঁর নখদর্পণে, বিশেষ অনুরাগী ছিলেন বঙ্কিম এবং রাজশেখর বসুর, এই ভাষার ঐশ্বর্য নিয়ে তাঁর গর্ব ছিল, তবু কিছু একটা অভাববোধও ছিল। ধনী ভাষাগুলির সাহিত্য ঠিক একমুখী হয় না। অনেকগুলি ধারা থাকে, বাংলা গদ্য সাহিত্যে ঘটনা পরম্পরার ধারাটিই অতি প্রবল, অন্য আর কোনো ধারাই নেই বলতে গেলে। বাস্তব কখনো উত্তীর্ণ হয়নি পরা বাস্তবতায়। লোককথা, রূপকথা, প্রবাদ, ছড়া, হেঁয়ালি ইত্যাদির মধ্যেও থাকে যে সব লুক্কায়িত কাহিনী, সেগুলিও যে আধুনিক সাহিত্যের অন্তর্গত হতে পারে, তা নিয়ে পরীক্ষা হয়নি বিশেষ।
সেইজন্যই কমলকুমার শুধু সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হননি, তিনি নতুন ধারার প্রবর্তনে উদ্যত হয়েছিলেন, তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ বাংলা সাহিত্যে এসে পড়েছে আচম্বিতে, এর কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না, এই গদ্যরীতি ও কাহিনী বিন্যাস সম্পূর্ণ অভিনব। এরকম রচনার আস্বাদের জন্য বাংলার পাঠকরা দীক্ষিত নয়, সেইজন্যই কমলকুমার হয়তো আশা করেছিলেন, ছোট সাহিত্য পত্রিকার যে একটি নির্বাচিত পাঠকগোষ্ঠী থাকে, যাদের অধিকাংশই সাহিত্য রচনায় প্রয়াসী তারা অন্তত অনুধাবন করার চেষ্টা করবে। আমার মনে আছে, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ প্রকাশিত হয়েছিল একটি অল্প পরিচিত পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায়, কমলকুমার সেই পত্রিকাটি থেকে নিজের উপন্যাস-অংশ ছিঁড়ে নিয়ে, বেশ কিছু কপি আলাদা ভাবে সেলাই করে কিছু নবীন লেখককে উপহার দিয়েছিলেন এবং আমাকে দশ-বারোটি কপি দিয়ে বলেছিলেন, অন্য লেখকদের মধ্যে বিলি করে দিও, তারা পড়লেই আমি খুশি।
কমলকুমারের সমস্ত রচনার উপাদান দেশজ এবং মূলত গ্রাম ভিত্তিক। আমাদের সাহিত্যে গ্রাম বাস্তবতা বড় বেশি গ্রাম্য এবং আঞ্চলিক শব্দে কণ্টকিত। কমলকুমার গ্রামের মানুষদের তুলে দিয়েছেন উচ্চ পর্যায়ে, তারা হয়ে গেছে চিরকালীন মানুষ। খেলার প্রতিভা উপন্যাসে একটি মৃত ভিখিরির লাঠিটা নিতেও যাদের বিবেক-দ্বন্দ্ব হয়, তারা অনায়াসেই মহাভারতীয় চরিত্র হয়ে ওঠে।
তাঁর ভাষা শুধু সাধু বাংলা নয়, বাক্য বিন্যাস একেবারে স্বতন্ত্র। তিনি যে সাবলীল, ঝকঝকে চলিত ভাষাও লিখতে পারতেন, তার অনেক নিদর্শন আছে। বড় পত্র-পত্রিকায় শিল্প সমালোচনা এবং নানা বিষয়ে নিবন্ধ লিখতেন চলিত ভাষায়। কমলকুমারের বয়েসী অনেক লেখকই সাধু বাংলা চিরতরে পরিত্যাগ করে চলে এসেছিলেন চলিত অষায়, দৃষ্টান্ত ও প্রেরণা স্বরূপ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু কমলকুমার সাধু ও চলিত এই দুটি বাংলাই পোষণ করেছেন। অর্থাৎ, উপন্যাস-গল্পের ভাষা সম্পর্কে তাঁর বিশেষ চিন্তা ছিল, এ ভাষায় দায় নেই সহজ বোধ্যর, এ শিল্প-নির্মাণের ভাষা, যে-কোনো উচ্চাঙ্গ শিল্পের মতনই এর রস গ্রহণ করার জন্য পাঠকদের দীক্ষিত হতে হবে। যেহেতু কমলকুমারের ভাষার আর কোনো পূর্ব-নজির নেই, অন্য কোনো লেখকের সঙ্গেই তাঁর ভাষার তুলনা চলে না, তাই কমলকুমারের রচনাই বারবার পড়ে এর মর্ম উদ্ধার শিখতে হবে। সেই জন্যই কমলকুমারের যে-কোনো রচনাই বারবার পড়তে হয়।
তিনি নিজে অনেক সময় বলতেন, বাংলা গদ্যের সিনট্যাক্স হুবহু ইংরেজি গদ্যের অনুকরণে, তিনি সেই প্রথা ভেঙে ফেলে ফরাসি গদ্যের প্রকরণ আনতে চান। তাঁর এই উক্তি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। লিঙ্গ ভেদ কিংবা একবচন-দ্বিবচন বহুবচন অনুযায়ী ক্রিয়াপদ বাংলায় কোনোক্রমেই সম্ভব নয়, এ ব্যাপারে বাংলা সংস্কৃত থেকেও পৃথক। বিশেষণের সংস্থানের অদল বদল, যেমন কালো বেড়ালের বদলে বেড়াল কালো, ফরাসি অনুযায়ী এমন ব্যবহার কোথাও কোথাও আছে মাত্র। অন্য ভাষার অনুসরণে নয়, সম্পূর্ণ অভিনব বাকভঙ্গি নির্মাণেরই দুঃসাহস দেখিয়েছেন কমলকুমার। এ ভাষা অবশ্যই অনবদ্য কিন্তু বাংলা গদ্যের অন্তর্গত হবার মতন নয়। আর দ্বিতীয় কোনো লেখকের পক্ষে এই ভাষা রীতি গ্রহণ করা অসম্ভব। কেউ কেউ কিছুটা চেষ্টা করেও পশ্চাৎ অপসরণে বাধ্য হয়েছেন, এমন দেখেছি। এ এক আশ্চর্য মিনার, যা বাংলা সাহিত্যে চিরকাল স্বতন্ত্র হয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে। জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে কমলকুমারের তুলনা একারণেই মনে আসে। গদ্যে নয়, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ থেকে জীবনানন্দ যে কাব্য ভাষা গ্রহণ করেছিলেন, তা অননুসরণীয় এবং বাংলা কবিতায় তা পূর্বাপর রহিত। জীবনানন্দীয় গোত্রের দ্বিতীয় কোনো কবিকে খোঁজা নিরর্থক।
একটি ছোট অথচ মনোযোগী পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করবেন বলেই যেন কমলকুমার তাঁর কাহিনীগুলিতে ভাষার বর্ম দিন দিন আরও সুদৃঢ় করেছেন। তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে তুলনামূলক ভাবে ‘গোলাপ সুন্দরী’র ভাষা ততটা দুর্বোধ্য নয়, মাঝে মাঝেই ঝলসে ওঠে কবিত্বের মাধুর্য। ‘গোলাপ সুন্দরী’ পড়ার পর ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ ফিরে পাঠ করলে অনেক জট খুলে যায়। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র বিশ্বস্ত ভাবে চলচ্চিত্র রূপ দিয়েছেন গৌতম ঘোষ, সেটি যারা দেখেছেন, তাদের আর কাহিনী অনুসরণে কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়। তবু, কাহিনী জানা সত্ত্বেও এর ভাষা সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এ উপন্যাস বারবার পড়া যায়। সব সাহিত্যেই এরকম দৃষ্টান্ত খুব কমই থাকে।
অনেক লেখকেরই প্রথম জীবনের তুলনায় পরবর্ত্তীকালের ভাষা ক্রমশ সরল হয়ে আসে। কমলকুমারের সব ব্যাপারেই বিপরীত যাত্রা। তৃতীয় ও চতুর্থ উপন্যাসে তাঁর ভাষা আরও জটিল হয়েছে, যেন তিনি খেলা করছেন পাঠকদের সঙ্গে, কিংবা তাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। কেননা কোনো বাক্যে রেখে দিচ্ছে ব্যাসকুট। পঞ্চম উপন্যাস ‘সুহাসিনীর পমেটম’-এ এই রচনা প্রক্রিয়া আমি নিজেই প্রত্যক্ষ করেছি। লেখাটি সম্পূর্ণ হবার পরেও তিনি আঙ্গিক বদল করছেন বারবার। ছোট ছোট বাক্যগুলি তিনি জুড়ে দিলেন অসমাপিকা ক্রিয়ায়, তারপর বলতে গেলে বাক্যই থাকছে না, পাতার পর পাতা পূর্ণচ্ছেদহীন ঠাসা রচনা। আর সময় নেই বলে আমি যখন তাঁর কাছ থেকে শেষ পাণ্ডুলিপি কেড়ে নিয়েছি কৃত্তিবাস পত্রিকায় প্রকাশের জন্য, তারপরেও তিনি চুপি চুপি প্রেসে গিয়ে প্রচুর পরিবর্তন করেছেন, প্রফের পৃষ্ঠা কণ্টকিত করে তিনি সব সরলকে করেছেন জটিল, পরিবর্তিত প্রত্যেকটি শব্দ আগেরটির চেয়ে কঠিন।
কঠিন বলতে কিন্তু আভিধানিক শব্দ বোঝায় না। ব্যবহারের অনন্যতা। বাঙালি পাঠক তাতে অনভ্যস্ত বলেই হোঁচট খায়। যারা তাতে পেছন ফেরে, তারা কমলকুমারের পাঠক হবার যোগ্যতা তখনো অর্জন করেনি, বুঝতে হবে। যারা কাব্যপাঠে অভ্যস্ত, তারাই এগিয়ে যেতে পারে। এ ঠিক গদ্য নয়, কাব্যের সৌরভ সর্বত্র অথচ চকিতে এক একটি দেশজ শব্দ এসে ঘোর ভেঙে দেয়। “ঐ চন্দ্রালোক, তাহারা নিজেদের বড়ই ঘোলা বুঝিতে আছিল; নদীর ঝিল্লির ইত্যাদির আওয়াজ তাহাদের জানিত সমস্তবিধ শব্দের বাচকতাকে নষ্ট করিয়াছে; বস্তু দর্শনে নাম, নাম শ্রবণে বস্তু মনেতে আসে না; প্রায় প্রত্যেকেই এমন অবস্থা আপন অজ্ঞাতসারেই টের পাইতেছিল।” (খেলার প্রতিভা) এই যে ‘শব্দের বাচকতা’ এটা কমলকুমারের ভাষার সঠিক পরিচয়।
কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাসগুলি আসলে আধুনিক চম্পূ, যেরকম চম্পূ ইদানীংকালে অন্য কেউ লেখেন না, আর কেউ লিখতে পারবেন বলেও মনে হয় না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১. আলো ক্রমে আসিতেছে
অন্তর্জলী যাত্রা – আলো ক্রমে আসিতেছে
আলো ক্রমে আসিতেছে। এ নভোমণ্ডল মুক্তাফলের ছায়াবৎ হিম নীলাভ। আর অল্পকাল গত হইলে রক্তিমতা প্রভাব বিস্তার করিবে, পুনৰ্ব্বার আমরা, প্রাকৃতজনেরা, পুষ্পের উষ্ণতা চিহ্নিত হইব। ক্রমে আলো আসিতেছে।
অনতিদূরে উদার বিশাল বাহিণী গঙ্গা, তরল মাতৃমূৰ্ত্তি যথা, মধ্যে মধ্যে বায়ু অনর্গল উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে; এইস্থানে, বেলাতটে, বিবশকারী উদ্বিগ্নতা ক্ষুদ্র একটি জনমণ্ডলীকে আশ্রয় করিয়া আছে। কোথাও কারণের বিকার মাত্র নাই, প্রতিবিম্ব নাই, কোথাও স্বপ্ন পর্য্যন্ত নাই; এ কারণে যে, একটি মুহূর্তের সকল কিছুকে বাস্তব করত স্মরণীয় করিয়া একের যে নাম ভিন্ন ক্রমাগতই অপ্রাকৃতিক পার্থিব, তাহারই প্রাণবায়ু নিষ্ক্রান্ত হইবে এবং তাই মানুষমাত্রই নিশ্চল, ম্রিয়মাণ, বিমূঢ়। ইহাদের প্রত্যেকেরই। মুখে মুখে নির্বোধ গাম্ভীৰ্য্য আরূঢ় হইয়া রহিয়াছে মনে হয়, কখন তাহারা কপালে করাঘাত করিবার অমোঘ সুযোগ পাইবে তাহারই যেন বা কাল গণনা করিতেছে। কেননা চির অসূৰ্য্যম্পশ্যা জীবন এই প্রথম আলোকের শরণাপন্ন, কেননা শূন্যতা লবণাক্ত এবং মহাআকাশ অগ্নিময় হইবে।
আমাদের স্নেহের এ জগৎ নশ্বর, তথা চৈত্ররুক্ষ অগণন অন্ধকার সকলই, মৃন্ময় এবং অনিত্য; তথাপি ইহার, এই জগতের, স্থাবর ও জঙ্গমে পূর্ণিমা; ইহার চতুর্বিংশতিতত্ত্বে, মানুষের দুঃখে, কোমল নিখাদে–সর্বত্রে, এরূপ কোন তন্মাত্রা নাই যেখানে যাহাতে–হাসি নাই, কারণ সৰ্ব্বভূতে, বহুতে, তিনি বিরাজমান।
হায়! ইদানীং সেই বহুর মধ্যে একটিকে পরিত্যাগ করত মহাব্যোমে, বিরাট শূন্যতায়, চক্ষুহীন জিহ্বহীন স্তব্ধতায় তিনি অব্যক্ত হইবেন; চির রহস্যের, অনন্তের রূপ একই রহিবে। গঙ্গাতীরে অন্তর্জলী উদ্দেশ্যে আনীত সীতারাম চট্টোপাধ্যায় এই অগণিত বহুর মধ্যে–সেই নিঃসঙ্গ একটি।
সীতারাম অতীব প্রাচীন হইয়াছেন; অধুনা খড়ের বিছানায় শায়িত, তিনি, যেমত বা স্থিতপ্রজ্ঞ, সমাধিস্থ যোগীসদৃশ, কেবল মাত্র নিষ্পলক চক্ষুর্ঘয় মহাকাশে নিবদ্ধ, স্থির; তিলেক চাঞ্চল্য নাই, প্রকৃতি নাইক্রমাগতই বাঙ্ময়ী গঙ্গার জলছলাৎ তাঁহার বিশীর্ণ পদদ্বয়ে লাগিতেছিল।
অন্তবন্ত, অন্তরঙ্গ এ দেহ যে বৈরাগ্য আনিবার পক্ষে যথেষ্ট অঢেল তাহা অতিবৃদ্ধ সীতারামের। দেহের প্রতি তাকাইলেই সম্যক উপলব্ধি হয়; তদ্দর্শনে, আপনার হস্ত হইতে শিশুর কপোলস্পর্শজনিত যে রেশমী অনুভব তাহা অচিরেই উধাও হইবে; আপনার সকল স্মৃতি–একদা হয়ত যে মানসবেগ চম্পকে জড়াইয়াছিল, কখন হয়ত দূর পথশ্রমের পর–স্রোতস্বিনী দর্শনে যে শান্তি অনুভব, অথবা পরিপ্রেক্ষিত হইতে সৃষ্ট হইয়া ক্রমে দিনের আলোয় ভাঙিয়া পড়া যেমন বুদ্বুদের চরিত্র এবং তাহা। অনুধাবনে মানুষ যেমন বিনয়ী হইতে গিয়া অহঙ্কারী হইয়া উঠিয়াছে–এই সকল স্মৃতি মাত্রই ভ্রংশ হইবে এবং দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ করত আপনাকে নিশ্চিত বারম্বার বলিতেই হইবে, হায় এ-দেহ কি গোলাপের অন্যতম দীর্ঘতম পুরস্কার! এবং অজানিতের প্রতি বালকের মতই, আপনার অনাৰ্য্য অভিমান জন্মিবে।
বৃদ্ধের দেহে দেহে কালের নিষ্ঠুর ক্ষতচিহ্ন, অসংখ্য ঘুণাক্ষর, হিজিবিজি। মনে হয়, এ-দেহে পাপ অথবা পুণ্য, কিছুই করিবার যোগ্যতা নাই। বিশুষ্ক চৰ্ম্মের আবরণে কঙ্কালসমান মুখমণ্ডল–এখানে, কপালে চন্দন প্রলেপ অধিকন্তু বীভৎসতা হানিয়াছে। ভাববর্ণহীন চক্ষুদ্বয় কালান্তরে আপনি নিমীলিত হয়, পুনৰ্ব্বার কিসের আশায় খুলিয়া যায়। অব্যক্তের লীলা-সহচরী মাতা, কোন মাতা এ-দেহ হইতে বারেক সৃষ্টির বীজ সঞ্চয় করিয়া আপনার সঙ্গোপনে রাখিবেন কে জানে!
বৃদ্ধের ওষ্ঠদ্বয় বিচ্ছিন্ন এবং এই অপরিসর ফাটলে বিন্দু বিন্দু গঙ্গোদক পড়িতেছে, এক একটি বিন্দু। কুঞ্চিত ওষ্ঠে পড়িয়া চমকাইয়া টলিয়া স্থির হয়, পরক্ষণেই অতর্কিতে কোনরূপে মুখগহ্বরে প্রবেশ করে; কোনটি বা, কীট-পতঙ্গ যেমত, জীবন লাভ করিয়া চিবুকের অঙ্কুরিত দাড়িমধ্য দিয়া পথ পায়, নামিয়া যায়। এই সঙ্গে বিলম্বিত লয়ে ‘গঙ্গা-নারায়ণ-ব্ৰহ্ম বলো’র দুঃসহ নিপীড়িত মর্মান্তিক ভৌতিক ধ্বনিবিস্তার উত্থিত হইতেছে। তবুও সীতারাম প্রৌঢ়শিলার মতই অনড়, গঙ্গা-নারায়ণ-ব্ৰহ্ম বলিবার। কোন ধৈৰ্য্য তাঁহার আয়ত্তের মধ্যে ছিল না।
শিয়রের নিকটে কুলপুরোহিত কৃষ্ণপ্রাণ, কণ্ঠলগ্ন চেলীতে নারায়ণ শিলা, অত্যন্ত সন্তর্পণে কুশী হইতে গঙ্গাজল (চরণামৃত) বৃদ্ধের ওষ্ঠে ঢালিতেছেন। সীতারামের মস্তক তাঁহারই জ্যেষ্ঠপুত্র বলরামের উরু-উপরে ন্যস্ত। দক্ষিণে কনিষ্ঠ পুত্র হরেরাম। ইহারা সকলেই বৃদ্ধের আত্মার সদগতি নিমিত্ত ‘গঙ্গা-নারায়ণ-ব্রহ্ম’ পদটি আবৃত্তি করিতে যত্নবান। হরেরাম ঠোঁট কম্পিত করিতেছিল, ঝিমাইতেছিল, এবং মাঝে-মাঝে চক্ষুদুইটি বড় করত আপনাকে সজাগ করিয়া আবৃত্তির সুরের সহিত কণ্ঠস্বর মিলাইতেছিল।
মধ্যে, একপার্শ্বে, কবিরাজ বিহারীনাথ হাতের নাড়ী টিপিয়া অনন্য মনে বৃদ্ধের মুখপানে চাহিয়া আছেন। তাঁহার স্পর্শের মধ্যে নীলাবিসনা এই পৃথিবীর বাঁচার তির্য্যগ সূক্ষ্মগতি এবং তৎসহ সংখ্যাবাচক একের প্রথম উপলব্ধি ছিল। কবিরাজের পিছনেই একজন সৰ্বাঙ্গ চাঁদরে আবৃত করিয়া, অথচ মুখটুকু খোলা, দুলিয়া দুলিয়া গীতাপাঠ করিতেছে। লোকটির সম্মুখে পুঁথি, কিন্তু পুঁথি দেখিবার আলো নাই, প্রয়োজনও নাই একারণে যে লোকটির গীতা কণ্ঠস্থ। কখনও বা তাহার ঘুম বিজড়িত স্বরে শ্লোক পরম্পরা ব্যাখ্যাও শুনা যায় যথা “কৌমার যৌবন কিছুই স্থির নয়, আত্মার হেতু নাই, মৃত্যু নাই–আশ্চৰ্য, কেহই আমরা থাকিব না, আমরা অমৃতে যাইব…” সমস্ত কিছুই একসঙ্গে লোকটি বলিতে চাহে।
এবম্বিধ পাঠ, মরণোন্মুখ সীতারাম ব্যতীত আর আর যাঁহারা উপস্থিত তাঁহাদের মনে স্বতঃই নৈরাশ্যের সঞ্চার করিতেছিল। এই পরিবেশকে, গীতা ব্যাখ্যার গোঙানি ছাড়াও, এইক্ষণে অধিকতর ভয়ঙ্কর রহস্যময় করিয়াছিল নিকটবর্ত্তী চিতা নিৰ্বাপিত করার উদ্দেশ্যে জল নিক্ষেপের ফলে হস্ হস্ শব্দ, তৎসহ অনর্গল ধূমরাশি, যাহা বিচিত্র আকারে কুণ্ডলী সৃষ্টি করত এক এক সময়ে ইহাদের অতিক্রম। করিয়া অন্তর্হিত হইতেছিল। এবং অস্বস্তিকর নরবসার গন্ধ এখানে উদ্দাম। উপস্থিত সকলে, প্রতীয়মান সমস্ত কিছুর মধ্যে ভয়ঙ্কর চিরসত্যটি দেখিতে পাইতেছিল। কীৰ্ত্তনীয়ারা, তাহারা হতাশার চোখ দিয়া একটি গীত গাহিতেছিল। উপস্থিত সকলে মন দিয়া অনেক গীত শুনিতেছিল।
সীতারাম ও নিকটবর্ত্তী সকলকে পরিক্রমণ করিয়া একটি আধো-ঘুমন্ত কীৰ্ত্তনের দল মণ্ডলাকারে ঘুরিতেছে। দলটি ইহাদের পরিক্রমণ করিতে গঙ্গার উপর দিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছিল, যেহেতু সীতারামের পদদ্বয় গঙ্গা স্পর্শ করিয়া আছে। কীৰ্ত্তনের দল শ্রান্ত, তাহারা উৎসাহহীন, তাহারা ক্ষুধার্ত, তাহারা শিথিল গতিতে মনে হয় যেমন বা পলাইতেছে, তাহাদের নৌকার-গাত্রে-লাগা তরঙ্গরাজির। শব্দের মত ভয়প্রদ ভাঙা ভাঙা স্বরে নাম গান স্থানটিতে যথার্থই অন্ধকারের সৃষ্টি করিয়াছিল।
এই গোষ্ঠীর কিছু দূরে; জ্যোতিষী অনন্তহরি উবু হইয়া বসিয়া তামাক খাইতেছিলেন, তাঁহার মন। তখন সৌরজগতে বিচরণ করিতেছে, বিরাট অনৈসর্গিক জ্যোতির্মণ্ডলে তিনি যেন হারাইয়া গিয়াছেন। যেমন বা অশরীর হইয়া গিয়াছেন। তাঁহার হুঁকার গম্ভীর শব্দ এবং কভু বা হুঁকা হইতে মুখ সরাইয়া বিড় বিড় করিয়া কথা বলা, তাঁহারই পার্শ্বস্থিত অন্য এক ব্যক্তিকে ক্রমাগতই রোমাঞ্চিত করিতেছিল, এই ব্যক্তি লক্ষ্মীনারায়ণ। জ্যোতিষী অনন্তহরির ব্যবহারের কিঞ্চিত্র ইতর-বিশেষে লক্ষ্মীনারায়ণের ধৈর্যচ্যুতি এবং অতি উগ্র-আগ্রহের কারণ হইতেছিল, লক্ষ্মীনারায়ণ যেন বা শীতকাতর; তিনি বারম্বার উদগ্রীব হইয়া অনন্তহরির নিকটে মুখ সরাইয়া আনিতেছিলেন, এ কারণে যে, তাঁহার মনে হইতেছিল জ্যোতিষী তাঁহাকেই লক্ষ্য করিয়া কিছু বা বলিতেছেন; ইহাই সত্য যে তিনি কিছু শুনিবার আশায় বসিয়াছিলেন। এই স্থানে কাহার কণ্ঠস্বর আসিতেছিল, “হিঃ ইরে ডরে গেলে হে, হারে মন নিছুনি জান না গো, উ ঠাঁই মরণ নাই গো, লাও গো আঁট করি কলসটা ধর বটে লীচু করি হে, একঠাঁই শান্তি দাও হে”–এ স্বরগভীরে এতাবৎ মিলন অভিলাষী হরিণীর কণ্ঠ ছিল। এ স্বর প্রাণময়, কেননা শান্তি দাও’ কথাটি উচ্চারিত হয়।
একটি চিতা সাজান হইয়াছে, উপরে বর্তমান সত্য যেন বা স্মৃতি হইয়া দেখা দেয়, যেখানে নক্ষত্র নাই। চিতার নিকটে বসিয়া একটি ক্রন্দনরত বালক, সে লাউডগা-রুগ্ন সুন্দর, পিণ্ড হাতে করিয়া বসিয়া আছে, তথাপি তাহার ক্রন্দনে আকাশ আঁকা ছিল, তখনও লহরীতত্ত্ব ছিল। বালকের সম্মুখেই ব্রাহ্মণ। তাঁহার মুখে ভয়জনিত ক্লীব অবিশ্বাস; কিন্তু অনর্গল শ্লোক ধারা উৎসারিত হয়, এবং মাঝে মাঝে অঙ্গুলীস্থিত কুশ-অঙ্গুরীয় যথাযথ করার ইচ্ছাও দেখা যায়, মনে হয় যেন বা এই বন্ধনে সমস্ত কিছু বাঁধা আছে। এই নূতন আয়োজনের পাশেই আর একটি চিতা প্রায় নির্বাপিত। যেখান হইতে উক্ত কণ্ঠস্বর আসিতেছিল।
ক্রমাগত জল দেওয়ার ফলে এই চিতা প্রায় নির্বাপিত হইয়া আসিতেছে; এই স্থান হইতে গঙ্গাজল পর্য্যন্ত অনেক জন লোক দণ্ডায়মান : যে ব্যক্তি গঙ্গায় দাঁড়াইয়া, সে কলস পূর্ণ করিতেছে–তাহার হাত হইতে পূর্ণ কলস হস্তান্তরিত হইয়া আসিয়া এই চিতায় নিঃশেষিত হয়। ভস্মরাশি বিরক্ত হইয়া উঠে। কিন্তু প্রতিবারই দেখা যায় দণ্ডায়মান লোকগুলি এ কার্য সম্পাদন করিতে, কলসটি হাতে লইয়া, কেমন যেন বা ভীত। পয়ারবিলাসী মন উধাও, পা কাঁপিয়া উঠে। সকলেই নিৰ্বাক, সকলেই এই ত গাছ নড়ে, এই ত অন্য সকলে রহিয়াছে–এই কথা ভাবিয়া সমস্ত কিছুকে কলস প্রমুখাৎ যুত করিতে চাহে, তত্রাচ কলস প্রায় হস্তচ্যুত হয়। সকলেরই কলস বাঁচাইতে দেহ বাঁকিয়াছিল।
কেবলমাত্র বৈজু চাঁড়াল, রূপরসগন্ধের সততা মানিয়া নির্ভীক, দাঁড়াইয়া আছে, সে তাহার দুঃসাহসিক মোচে দৃপ্ত চাড়া দিয়া অদ্ভুত করুণাবাচক হাসি হাসিয়া অনেক কথাই বলিতেছিল, তাহার চোখে ঘুম নাই। কহিল, “আই গো, হুঁশিয়ার গো খুব হে, মনকে আঁচ ঠেল, হিঃ গতর খুব খাড়া রাখ মন” পুনৰ্ব্বার দু’এক কদম নিকটে আসিয়া বলিল, “ওগো মশাই গো, উটি কলসটি, তোমার হৃদয় গো, আবার উটি তোমার স্মৃতি বটে, দেখ যেন ভাঙেনি, উটি ভেঙে দিয়ে যাবে চিতায় হে” বলিয়া মাথাটি দিয়া এখানকার আলোকে ঈষৎ নাড়া দিল।
বৈজু কারণসলিলে একটি ক্ষুদ্রপল্লবিত শাখাবৎ, দূরে কোথাও দ্বীপ প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে, সুতরাং তার প্রতি সকলের আকর্ষণ অহেতুক নহে। তথাপি বৈজুর কথায় জনগণ অতিষ্ঠ হইয়া উঠিতেছিল, শুধু। কথা কেন, তাহার তুচ্ছ হেরফের গম্ভীর হইয়া দেখা দেয়, যেহেতু তাহার দেহকে অবলম্বন করিয়া একটি চাকচিক্য যেন স্বস্তিলাভ করিয়াছে। জনগণের একজন বৈজুর কথার উত্তরে, কেবলমাত্র নিজের অস্তিত্ব উপলব্ধির কারণেই বলিল, ‘এতেক কথা শিখালে কে বটে হে!
বৈজু-আশ্রিত চাকচিক্য দুলিয়া উঠিল! বৈজু চাঁড়াল হাস্য সম্বরণ করিতে পারিল না। ভোরের হাসিতে যে ভাই-ভাই ভাবটুকু থাকে, সেইটুকু এ-হাসিতেও ছিল। কিন্তু বৈজু একটু বেশী রকমে অভিমানী, সে ‘নীচ কুলোব, পাছে তাহার হাস্যধ্বনি কাহারও দেহে লাগে সে কারণে সে উৰ্দ্ধ আকাশে হাস্যধ্বনি ছড়াইয়া দিয়া কহিল, “কেনে গো বাবুমশায়, এখনও (!) অবাক কি হেতুক, তোমার কি মনে লয়!” বলিয়া আয়ত নয়নে ঈষৎ বিস্ময় হানিয়া তাহার দিকে চাহিল।
বৈজুর হাস্যধ্বনি শ্রবণে লোকটি ভয়ার্ত হয়, অত্যধিক অস্বস্তি সহকারে তাহার প্রতি সকলেই তাকাইয়াছিল, কারণ এরূপ হাস্য স্থানকালপাত্র ভেদে যারপরনাই অসংযত বলিয়া মনে হয়। অন্যপক্ষে বৈজু চাঁড়াল বুঝিল, লোকটি এক্ষেত্রে ছায়াবৎ, কোন স্বাভাবিকতা নাই, এবং তাহার যাহা কিছু বোধ ছিল, তাহার কিছুটা শবদাহের সহিত পুড়িয়া ছাই হইয়া গিয়াছে। সুতরাং সে এই শ্মশানভূমি নির্দ্দেশ করিয়া কহিল, “তুমি কি ভাব মনে রাত্তদিন শুধু জোড় খায় ই ঠাঁই।” এই উত্তরে ভীত লোকেরা ধরা পড়িয়া গেল। “ই যে মহাটোল বটেক, কত ডাগর ডাগর পণ্ডিত আচাজ্জি ই ঠেন পাঠ দেয় গো, কত যুক্তি আঁটে, আমি শুনি …হ্যাঁ…আমি শুনলাম বটে, তত্ত্বকথা বেজায় জানি হে, আত্মার সাকিম কুত্থাকে তার থানা কোথা; আমি যে তার সরিক!” বলিয়া আনন্দে ডানহাতখানি বাঁ হাতের এবং বাঁ হাতখানি ডানহাতের পেশীকে চাপড়াইল। ইহার কিঞ্চিৎ পরে অত্যন্ত গোপন খবর দিবার মত করিয়া বলিল, “কলস? সে যে হ্রিদয়! ইটা যে স্মৃতি, সিকথা গোবিন্দ আচাজ্জি বললে, মড়া পুড়াতে এসে বললে, বৈজু এ-ইটা ঘটাকাশ, ভাঙলেই পটাকাশে মিলবে বটে, হিসাব মিলে যাবে, আমরা ভাবি কলসটা স্মৃতি… হে হে অমনভাবে না…না…গো বাবু মশায়।”
বৈজুর কথার মধ্যেই নিৰ্বাপিত চিতার নিকটে এক কলস জল রাখা হইয়াছিল, শ্মশান যাত্রীদের একজন এই কলসটিকে ভাঙিয়া, এই স্থান পরিত্যাগ করত চলিয়া যাইবে; যে জন ভাঙিবে সে বাঁশটিকে ঠিক যুত করিয়া ধরে নাই দেখিয়াই, বৈজু তাহার কথা থামাইয়া হাঁ-হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসিল। পাছে চণ্ডালের ছোঁয়া লাগে তাই সকলেই যথাসম্ভব সরিয়া গেল। বৈজু আপনাকে সামলাইয়া বলিল, “খুব ডাগর জোর ধর হে বটে, এ হে বাবু…উ তো কলসী–তোমার মাগ লয়।” এবার মুচকি হাসিয়া কহিল, “আর কেনই বা তা লয়, হ্যাঁ জোর করি ধর, অন্যদিকে চাও, লাও মার শালা জোর গুঁতো, যাক শালা ঘটাকাশ পটাকাশে।”
রুদ্ধশ্বাস-স্তব্ধতা দেখা দিল, বৈজু পুনরায় বলিল, “ভাঙার শব্দ হলে ইদিক পানে আর চাহিবে না গো, শুধু হরি বোল দিবে…হরি বোল।”
এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বিকট ভাঙার শব্দ হইল, শূন্যতা বাড়িল। এই সঙ্গে অযুত হরিধ্বনি শোনা। গেল, বৈজু তাহার কথা কয়েকটি বলিয়া মুখোনি অর্ধ-উন্মুক্ত করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। সেও শব্দ শোনা মাত্র বলিয়া উঠিল, “সাবাস সাবাস” এবং ইহার ক্ষণেক পরেই, সে চকিত হইয়া বলিয়া ছিল, “হে রে রে রে…ই দিকে চেওনা…সোজা ঘরকে যাও…।”
তাহারা সকলেই ত্বরিত পদে, শ্মশান পরিত্যাগ করিয়া সুউচ্চ ভেড়ীপথে উঠিল, অদৃশ্য হইয়া গেল। ইহারা সকলেই–যে ইতিপূৰ্ব্বে ছিল–তাহার প্রমাণস্বরূপ বৃক্ষাদির পাতা কম্পিত হইতে লাগিল; কেননা তাহারা ভেড়ীপথ হইতে নামিবার কালে বৃক্ষের ডাল আকর্ষণ করত নামিয়াছিল।
কম্পমান পত্রাদির দিকে বৈজু কিয়ৎকাল চাহিয়া রহিল, কাহাকেও সে দেখিতে পায় নাই, সহসা নিৰ্বাপিত চিতার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, এখন সে তাহার পৌরুষে দুর্ধর্ষ ঘাড়খানি ঘুরাইয়া দেখিল ছোট ছোট প্রজ্বলিত পাটকাঠির টুকরা মাটিতে পতিত হইয়া ক্রমে নিভিতেছে, এবং তৎসহ গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ উৎসারিত হয়, “যে তোমার শোক মোহ এ সকল গেল” (শুধু মাত্র প্রেম রহিল সম্ভবত)। বৈজুনাথ, চিতাপ্রদক্ষিণকারী বালকের হস্তধৃত মুখাগ্নিনিমিত্ত প্রজ্বলিত পাটকাঠির আলোকে ভাঙা কলসের অনেক টুকরার মধ্যে পুনরায় কি যেন অনুসন্ধান করিতে ব্যস্ত হইল।
দুই একটি সেই ভাঙা কলসের টুকরা পা দিয়া সরাইতেই, একটি রৌপ্যখণ্ড তাহার চোখে পড়িল, ইহাই সে খুঁজিতেছিল। সত্বর রৌপ্যখণ্ডটি কুড়াইয়া লইয়া মহাউল্লাসে এক কদম, বগল বাজাইয়া, নৃত্য করিতে গিয়া সে একীভূত স্থির!
ক্কচিৎ কখনও সেও স্থির হয়!
সমীপস্থ চিস্থিত মৃতের কণ্ঠলগ্ন ফুলমালা জ্বলিতেছে, আর অন্য পাশে, বালকের বিহ্বল বিমূঢ় সদ্য শুনছিন্ন অসহায় মুখমণ্ডল আর ইতিমধ্যেই অগ্নিশিখা, এবং বালকের সম্মুখে ঘূর্ণিহাওয়া যেমত আবর্তিত হয় তদ্রূপ সমস্ত সৃষ্টি ঘুরিয়া উঠিল। পরক্ষণেই, বাবা গো’ বলিয়াই বহ্নিমান চিতার দিকে সে ছুটিতে উদ্যত হইল।
বৈজুনাথ অন্যমনস্ক, তথাপি আপনার দায়িত্বজ্ঞানে হাঁ-হাঁ করিয়া বাধা প্রদান করিতে গিয়াছিল। বালকটির বয়সী সঙ্গীরা বালককে ধরিয়া ফেলিল; তবুও এখনও, বালক স্বীয় আবেগ সম্বরণ করিতে সমর্থ হয় নাই। একথা সত্য যে, মৃত্যুর গভীরতায়, এক মুহূর্তের জন্য চন্দ্র সূৰ্য্যকে হারাইবার মত স্থিরতা তাহার নাই। যদিচ, সবুজতা তাহার কাছে নিশুতি রাত্রের ঝিঁঝি স্বর এমত, যদিও আপনার নিঃশ্বাস পরিদৃশ্যমান আলোকে আড়াল করিয়াছিল, যদিও স্পর্শবোধ ভোরের পাখীর কণ্ঠস্বরে উধাও।
বয়সী সঙ্গীরা তাহাকে, এমত মনে হয়, যেন বা দাঁত দিয়া টানিয়া ধরিয়া আছে। সুতরাং সান্ত্বনা দিবার ভাষা থাকিলেও উপায় ছিল না। সকলেরই জিহ্বা কটু কোন স্বাদে লিপ্ত, মুখ বিকৃত। তথাপি শুধুমাত্র একজনা কহিল, “ছিঃ পাগল” একথা সংস্কারবশতঃই সে বলে।
এই ছোট মন্তব্যটি বালকের সম্বিৎ ফিরাইয়া দিল; চিন্তাপ্রসূত, উখিত ধূম্রজালের দিকে তাকাইয়া, অন্যেরা ভীতভাবে মাথা নাড়িল। বৈজু বালকের দিকে ব্যাকুলভাবে চাহিয়া ধীরে ধীরে বলিল, “হা রে ননু, খোঁকা গো, মন তোমার পুঁড়ে” এবং পরক্ষণেই অতিশয় কোমল কণ্ঠে উচ্চারণ করিল, “দেহ চিতায় মন পুঁড়ে গো” এ কথার আবৃত্তির রীতিতে মনে হইল, সে কোন এক গীতের প্রথম কলি উদ্ধৃত করিল।
সমবেত জনমণ্ডলী, অল্পক্ষণের জন্য ক্ষিতিতত্ত্বের অনিত্যতা হইতে মন ফিরাইয়া তাহার দিকে আগ্রহভরে দেখিতে লাগিল। ইহাদের সকলেরই আশা, সে কিছু বলুক, কেননা তাহাদের তালু শুকাইয়াছে, কেননা মনে নানাবিধ হাড় স্তূপীকৃত হইয়াছে, কেননা তাহারা অলৌকিক পথশ্রমে ক্লান্ত।
বৈজু পুনৰ্ব্বার বলিল, “কেঁদোনি খোঁকা, একটি গল্প শুন–যে দিলে সেই নিলে, তুমাকে ভাল’র মধ্যে লোভী করে দিলে, কি করবে হে”–তাহার গলার স্বরে সহজ ঠিকানা ছিল, ফলে বালক ডুকরাইয়া কাঁদিয়া ক্ষণিক জিহ্বা দ্বারা ওষ্ঠ বুলাইয়া, একহাতে চোখ কচলাইতে কচলাইতে আপনার পিতার দেহের দিকে চাহিয়াছিল। এবং ক্ষণেক পরেই বৈজুনাথের বিষাদক্লিষ্ট স্মিতহাস্যময় মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল।
অন্যপক্ষে বৈজু আপনার কণ্ঠকে ঈষৎ সরস করিবার মানসে একটি ঢোক গিলিয়া নিতান্ত মেটে হইবার চেষ্টা করে। কিন্তু বালকের লাল চক্ষুদ্বয়–যেখানে কোন ভোর নাই, তাহাকে বিভক্ত করিয়া দিয়াছে। সে বিমূঢ়, কোনরূপে আপনার লাঠিখানি তুলিয়া লইয়া মুখোনি নীচু করিল, হস্তধৃত লাঠিখানি সে মৃদু মৃদু মাটিতে ঠুকিতেছিল। একবার কি এক কথা বলিতে গিয়া মুখ তুলিয়াই তৎক্ষণাৎ নামাইয়া অতি ধীরে বলিল, “কেঁদনি গো, খোঁকা গো” এই কথার পর একটি বিদেশী নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল, এবং তদনন্তর আপনার রোমশ বক্ষে হাত বুলাইতে বুলাইতে সে কহিল, “ওগো বাবু ইঠাঁই একো জীব আছে হে, ধুক ধুক ধুক ধুক করে, আমার যেটা সেটা লোহার” ইহার পর আকাশের দিকে চাহিয়া বলিল, “লোহারই বা কেনে, দধীচির অস্তি দিই গড়া, পালোয়ান পালোয়ান বাজ দিই গড়া, গড়া হঁই গেল? আকন্দ ফুল এমন কি, আমি দেখলে চিনতে লারবো, টুকুন ভাত গরাসে মনে লেয় আকাশ খাইছি। তবু তোমার চোখের জলের ভূতে আমাকে পেল।…হারে বাবু মানুষ, দেখনা কেনে গ্রামে গাঁয়কে হলুদ নিশান দিইছে, ভারী গরম (কলেরা) হ’লতার উপর বলে কার্তিক মাস যমের দক্ষিণ দুয়ার খোলা, কত থানা মুলুক ঠেন মড়া এল, এই দেখনা কেনে দড়িতে গিটদি…” বলিয়া কোমরের দড়ি দেখাইয়া পুনরায় কহিল, “সব শালা গরমের দেনাদার প্রজাখাতক, কত যে অনাথ হইল তা পাইমাপে আসে না খোঁকা, তাদের দেখলে আর কানতিসনা গো…উই যে শালা উপরে, যে শালা সবার ভিতরে, তার কলম মানতে হবেক…সে বড় কঠিন প্রাণ গো, কোন বোধ নাই, কান নাই, হাত নাই…বিকার নাই–এতবড় সংসারটা…চালায় হে.আইগো কথা শুনছো তোমরা…মড়ার হাত যে…মাটি ছুঁতে চায়, মাটি হা হা মাংটি…”
এইদৃশ্যে তাহারা সকলে যারপরনাই তটস্থ হয়; কিন্তু দক্ষতা এবং দূরত্ব বিচার তখনও পরিচ্ছন্নভাবে আসে নাই, তখনও তাহারা ললাটে করাঘাত-সুখে অলস। ফলে বৈজুর সাবধান বাণী কাজে দেয় নাই।
“হে হে গো, বাবু গো, হাতকে ঠেকা দাও ঠেকা দাও, না হলে জীবন বড় লষ্ট করবেক হে” এ কথার পর খানিক দ্রুত অগ্রসর হইয়া অঙ্গুলী নির্দ্দেশ করিয়া বৈজুনাথ বলিয়াছিল।
হাতটিকে তুলিবার জন্য, একজন একটি বাঁশ দিয়া তুলিয়া ধরিবার চেষ্টা করিল, মৃত সাপের মত শ্লথ এ হস্ত-সৌহার্দ্য অভিমানী, এ হাতখানি ব্যগ্রতার স্থির নশ্বর রূপ! ইদানীং পুনৰ্ব্বার অগ্নিতে সে মনোরমত্ব ঠেলিয়া দেওয়া হয়, লাখ প্রবাদবচন এবং দিগদর্শন পুড়িয়া পুড়িয়া ছাই হইবে।
বালক এ হেন দৃশ্য যে সহিতে পারে নাই, তাহা বৈজুনাথের চোখ এড়াইল না। বালক দৃঢ় করিয়া আপনকার নয়নযুগল মুদ্রিত করিল, আপনকার মুষ্টির মধ্যে কাহার মুষ্টি প্রবলভাবে ধরিতে চেষ্টা করিতেছিল। তাহার দেহ প্রদীপের শিখাবৎ।
বালকের স্বভাব বৈজুনাথকে আমোদের সন্ধান দিল। সে হাসিয়া উঠিল–আর অন্ধকার নাই, ব্যাঘ্র দীন হয়। সে কহিল, “লাও গো মানুষ বাবু, ভয়ে না ভালবাসায় চোখ বুজলে, এমন যেন শত্রুর না হয় বলে সবাই শুরু করে, অথচক এমনি হয়।”
আর আর সকলেই তাহার ইত্যাকার বাক্যবাণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সকলেই তাহাকে শক্ত করিয়া দেখিল, ইহাদের দৃষ্টিতে ভর্ৎসনা ছিল। বৈজুনাথ বুঝিল, মুখ দিয়া অনেকটা হাঁফ ছাড়িয়া কহিল, “হে গো, আমার কথা ধর না হে, কথায় আমার আঁকসাট নাই, আমি জাতচাঁড়াল গো, আমি তারাগুলা জলে দেখি আমার মাস শেয়াল শকুনে খায় না গো!”
এইটুকু মাত্র পদবিন্যাসে সকলেই মোহগ্রস্ত, এ কারণে যে তাহার বাক্যসমূহে জীবনের ক্লান্তি ছিল।
“মড়া দেখি দেখি আমি মাটি হইছি গো, আমি তো শব গো, বহুদিন মরে আছি হে…লাও বাবু মশায়, তোমাদেরই ই চিতা ত এখন গোড়া গাঁথছে, খোঁকাকে লিয়ে উ ঠাঁই বস গা, মনের কথা বল গা উ ঠাঁই…” বলিয়া বৈজু গঙ্গার দিকে অগ্রসর হইল।
.
সকলেই চলমান বৈজুনাথকে লক্ষ্য করিল, তাহার কোথায় যেন রঙের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস আছে–সে নিঃশ্বাস নেয়, না নিঃশ্বাস তাহাকেই নেয়–এ প্রশ্ন তাহাদের মনে উদয় হয়।
ইদানীং গঙ্গা, হাস্যময়ী, বহু বহুদূরে বজ্রমুষ্টি রক্তিম, বায়ুচিহ্ন–কোদাল কোপান যেমত ঢেউয়ে ঢেউয়ে ফুলমৃদু জাম রঙ। ক্রমাগতই জলজ পানা ভাসিয়া যাইতেছে, নিম্ন আকাশে ডানার হিলমিল, শূন্যতাকে অপহরণ করিতে আপনার সত্তা হারাইতেছে।
বৈজুনাথ গঙ্গার কিনারে দাঁড়াইয়া পৃথিবীর প্রত্যহের সূক্ষ্মতা দেখিল, বিস্মিত হইল, বার বার ডাকিল, “মা মা, মা গো।” তাহার কণ্ঠস্বরে শিশুহস্তের ছবি মুদ্রিত ছিল। ইহার পর শ্রদ্ধাভরে পুনৰ্ব্বার আপনার মস্তকে গঙ্গোদক লইয়া ছিটাইবার কালে মাতৃনাম উচ্চারণ করিল। মুখ ধুইল এবং এই সময়ে ঘাড় ফিরাইয়া কহিল, “ঠাকুর, বুড়ো কৰ্ত্তার কি দশা গো, গোণ ত পার করলেক, হে হে।”
যেহেতু এখন ফরসা হইয়াছে, ফলে এখন অক্ষর চিনা যায়, সংখ্যা স্বাভাবিক হয়। লক্ষ্মীনারায়ণ জ্যোতিষী অনন্তহরির সম্মুখে লম্বমান কোষ্ঠীপত্ৰ খুলিয়া ধরিয়া আছেন, কোষ্ঠী যেমত আয়না। জ্যোতিষী অন্যমনে বিচার করিয়া, কিছু পরে একটি কাঠি দিয়া নরম বেলাতটে কি লিখিতে লিখিতে অনেকখানি দূরে সরিয়া গিয়াছিলেন। এখন বৈজুনাথের প্রশ্নে একবার ফিরিয়া তাকাইলেন মাত্র, পরক্ষণেই লক্ষ্মীনারায়ণের দিকে চাহিয়া অন্যমনস্ক হইয়া হতবাক হইয়া রহিলেন।
লক্ষ্মীনারায়ণ তাঁহার বিচারের ফলাফল শুনিবার আশায় উদগ্রীব হইয়াছিলেন; এক্ষণে জ্যোতিষীকে এইভাবে তাকাইয়া থাকিতে দেখিয়া, যারপরনাই অস্বস্তি বোধ করত সহজ হইবার ভঙ্গী করিলেন। ইহাতে তাঁহার, লক্ষ্মীনারায়ণের, দেহ যেন বিকলাঙ্গ হইল। একদা তিনি গঙ্গার দিকে, যেখানে অন্যমনা হইবার অব্যর্থ সুযোগ স্রোতরূপে বৰ্ত্তমান, অন্যবার পরিক্রমণকারী, বৃত্তাকারে ক্রমাগতই, ভ্রাম্যমাণ কৃষ্ণকায় কীৰ্ত্তনের দলকে দেখিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণকে দেখিলে সত্যই মায়া হয়, কালের প্রতি চোখমুখে কোথাও সম্মানের লেশমাত্র উল্লেখ নাই। কাহাদের জিহ্বার আস্বাদনের, তৃপ্তির শব্দ—চক্চক্ শব্দ তিনি বাতাসে বাতাসে শুনিতে পান। এই শব্দ তাঁহাকে একীভূত করে। অতিকায় হিম জলজ দুর্ভাবনায় তিনি মূর্খ। এখন, কোনক্রমে আপনার একটি পা, মাটি হইতে উঠাইয়া, বাঁকাইয়া, ছড়াইয়া, পক্ষীরা যেমত করে, কিছুটা অবশতা দুর করত পুনরায় জ্যোতিষীর প্রতি কহিলেন, “বৈজু চাঁড়াল বেটা কি বলছে গো” বলিয়া আপনার মুখ দিয়া বৈজুকে নির্দ্দেশ করিলেন, নিজের মনোভাব যাহাতে প্রচ্ছন্ন থাকে সে কারণে তিনি একথা ঈষৎ হেনস্থা সহকারেই বলিয়াছিলেন। তথাপি তাঁহার বাক্যসকল কিছু পরিমাণ আর্দ্র।
জ্যোতিষী অনন্তহরির স্থির মুখোনি কঠিন হইয়া উঠিল, কহিলেন, “আঃ, চুপ কর ত।” ইহার মুখমণ্ডলের কঠিনতা যেন অগ্রবর্ত্তী অন্ধকারকে চাপিয়া ধরিল।
লক্ষ্মীনারায়ণ ইহার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তাঁহার দেহে এই বিরক্ত-উক্তি পাথরের মত আঘাত করে। ফলে মাথাটি নড়িয়া উঠিল। তিনি একটি শতছিদ্র সম্রম দিয়া নিজেকে ঢাকিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন এবং এখন সত্যই, মাত্র এখনই তাঁহার গাত্র সকালের শুদ্ধ শীতল হাওয়া স্পর্শ করিল।
বৈজুনাথ একদা স্রোত, অন্যপক্ষে শ্মশানভূমি দেখিয়াছিল। সে গঙ্গা হইতে উঠিয়া, নিৰ্বাপিত চিতা অভিমুখে গিয়া তত্রস্থ গহুর হইতে একটি কাঠকয়লা তুলিয়া লইতে তাহার দেহ অসম্ভব বাঁকিয়াচুরিয়া গিয়াছে, এখন ছাই কালোর উপরে দেখা যায় ভূমিস্পর্শরোদে তাহার পিঠ লাল, সে একটি অনিবাৰ্য্যরূপে প্রতীয়মান হইল; মুহূর্তের মধ্যেই একটি কাঠকয়লা বাছিয়া দাঁত মাজিতে মাজিতে বালকটির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল; বালকের চোখে জল আছে তাহা সত্ত্বেও, তাহার, বৈজুনাথের, রীতিনীতি দেখিয়া বিস্ময়ও বর্তমান এবং বালকের সঙ্গীদল এরূপ কাৰ্যে বিশেষ আশ্চর্যান্বিত হইয়া মুখ বিকৃত করিয়াছিল, নিশ্চয়ই তাহাদের মনে হয়, যে সে মানুষের ভীতিজনিত শ্রদ্ধাকে অবমানিত এবং ভালমন্দের সাধারণ রৌদ্রবহুল বিচারকে নষ্ট করিতেছে। ইহারা যেন বলিতে চাহে, এ কি কর গো?
বৈজুনাথ হৃদ্বয় কুঁচকাইয়া তাহাদের বিস্ময়কে সকালের প্রথম সূর্যে শুকাইয়া লইল, কহিল, “কি, আমার গতিক দেখে বেজার নাকি!”
সম্মুখের লোকটি এখনও গভীরভাবে তাহার প্রতি চাহিয়া আছে, অন্যান্য সকলে বিদ্রুপের স্মিতহাস্য রেখা আপন আপন শুষ্ক ওষ্ঠে মিলাইয়া, গম্ভীর। কেননা বৈজু এখনও ছায়া, কেননা বৈজু এখনও ব্যতিক্রম, কেননা বৈজু এখনও স্বেচ্ছাচারিতার বেদনাদায়ক নাম।
বৈজু অল্প আয়াসেই অনাদৃত দেহভঙ্গিমায় ইতোমধ্যের কবিপ্রসিদ্ধ সেই মোহকে চূর্ণ করিয়া না দিয়া সহজ কণ্ঠে কহিল, কেননা সে রঞ্জিত স্তব্ধতার সহিত অমোঘ শুন্যতার, শূন্যতা বোধের পার্থক্য, পার্থক্যের মধ্যে যে যুক্তিপূর্ণ স্বাভাবিকতা তাহা সে অবলীলাক্রমেই বুঝিত। বলিল, “কেইবা বেজার গো, এ আগা দেখে তুমিও সন্ন্যাসী হও না, আমি ত বেজার নই, মনে পড়ে বকাধাম্মিকের পালা? তুমিও আবার নাচতে নাচতে লাঙল ধরবে, ছেলে দুখালে, বউকে বলবে, মাই দে না কেনে? হা হা তুমি বলবে, ‘হারে এত ডালপালা, দাঁত মাজতে একোটা ভাঙলে পাত্তিস রে’ কিন্তু ঘাটকে মড়া থাকলে ছেড়ে যাবার হুকুম নাই গো।”–এ কথার মধ্যে স্পষ্টত দেখা গেল, সে রক্তে না হৃদয়ে অথবা স্মৃতিতে, কোথাও না কোথাও স্থির হইয়াছে।
“তাই বলে…?” লোকটি বলিয়াছিল।
ইহাতে সত্যই তাহাকে পীড়া দিয়াছিল। সে নিশ্চয়ই দুঃখী, ক্ষণেকেই ইতস্ততোর মধ্যে আপনাকে দেখিতে পায়; বুঝিল পৃথিবীটা তাহার আপন নয়, আপনার নহে; এ কথায় সে যেমত বা ঈষৎ স্ফীত, সে কারণে তাহার অধিকারের চারিদিকে পলকে, ঝটিতি, আপনাকে সামলাইয়া ভ্রুকুটি সহকারে তাকাইয়া একটি নিঃশ্বাস গ্রহণ করিল, এখানে সকালের গাঙ্গেয় শৈত্যে দ্রবীভূত বাতাস আপনকার চরিত্র, নিঃশ্বাসের কারণে হারাইল না–অন্তরীক্ষে হানা দিয়া ফিরিল। হায়, তাহার কোন দেবতা নাই, যে তাহার সহিত শুইয়া শুইয়া প্রীতিপদ, সুন্দর, সবুজতার, সন্ধ্যার, নক্ষত্রনিচয়ের, তীরদর্শনের, পক্ষিকুলের অবিমৃষ্যকারিতার, মিনতির, রাখালের গল্প সুর সংযোগে সূক্ষ্মতম নিঃশ্বাসের আওয়াজ করিয়া যাইবে। হায় সে বড় একা! বৈজুনাথ কয়লায় কালো তর্জ্জনীটা তুলিয়া উত্তর করিল, “বাবু বলি এক কথা, আচাজ্জিরা (আচাৰ্যরা) সতীদাহে যখন হাঁক তুলে, এয়োরা তোমরা সোনা দাও, স্বগ্যে সোনা ছাড়া কিছুই যায় না, স্বগ্যে যায় না–তা পরে চিতা লিভিয়ে সোনা তুলে তখন…” বলিয়াই বাঁচাল বৈজুনাথ দ্রুতপদে সে-স্থান পরিত্যাগ করিল।
সে এত দ্রুত গতিতে আসিয়াছিল যে আর একটু হইলেই অনন্তহরির অঙ্কের উপর পা পড়িত। লক্ষ্মীনারায়ণের হুমকিতে সে কোনরূপে আপনাকে সামলাইয়া কহিল, “ই গো ঠাকুর, পুণ্যাত্মা বুড়ার দশা কি গো?”
লক্ষ্মীনারায়ণ বলিয়া উঠিল, “হে বেটা চাঁড়াল, তুই বড় জ্বালাস দেখছি…যা বেটা…”
কাঠকয়লালিপ্ত হইলেও মুখোনিতে বোকা অপ্রস্তুতের ভাব লক্ষিত হইল। কাহারও গোণা কয়েকটি নিঃশ্বাসের পথ সে যেমত বা ভুলক্রমে রোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল।
এমত সময় অনন্তহরি কহিল, “আর একটু বাঁকি ওকে বল…”
লক্ষ্মীনারায়ণ ভয়মিশ্রিত চোখে ভিখারীর মত কিয়ৎক্ষণ জ্যোতিষীর দিকে চাহিয়া থাকিয়া, আর খানিক বৈজুর দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আর একটু বাঁকি।”
লক্ষ্মীনারায়ণ আকাশের দিব্যভাবের দিকে চাহিলেন। তাঁহার দেহ যেন গীতার উক্তি, অথবা পুরাণে লিখিত। গ্রহনক্ষত্রের সাক্ষাৎ নাই, তবু সৌরজগতের ভার তাঁহাকে দিকভ্রান্ত করিয়া দিল, রহস্যময় পরিক্রমণ বহুদূর হইতে নামিয়া আসিয়া তাঁহাকে কেন্দ্র করিয়া ইদানীং আবেগ সঞ্চারী; আপনার বদ্ধতাকে লইয়া কে মহা উল্লাসে খেলা আরম্ভ করে; ফলে আপনার ভার অনুমান ও উপলব্ধি করার মধ্যে যে ত্রাসের সঞ্চার অতীব সাধারণ, তাহা তাঁহার হইয়াছিল। এই উপলব্ধি হইতে পরিত্রাণ পাইবার নিমিত্ত কোন এক সূত্রে হঠাৎ তিনি বলিয়া ফেলিলেন, “আ মর, তু বেটা জাত জন্ম খোয়াবি? সরে দাঁড়া না মরণ!”–ইহা বলিতে লক্ষ্মীনারায়ণ রাগতভাবে স্ত্রীলোকের মত ঢং করিলেন, তাঁহার ব্যবহার অনেকাংশে ভাঁড়ের মতই।
বৈজুনাথ তাঁহার বাক্যে থতমত তূপীকৃত, কেন না বিচারের আঁচড় ইকড়ি ছাড়িয়া বেশ কিছুটা দুরে সে দাঁড়াইয়াছিল, এবং পরে, অতর্কিত কিছুটা দূরে পুনরায় সরিয়া গিয়া বলিল, “বিধান বল?…কাঁহাতক বুড়া মানুষটা হিম খাবে গো, আর মড়াবসার, মড়া পুড়ার গন্ধ শুকবে…বড় পুণ্যাত্মা গো.শুকনা ডালে পাখী দুটো বড় হিমসিম খায়।” বুড়া অর্থে গঙ্গাতীরে আনীত সীতারামকে উদ্দেশ্য করিয়াই, বৈজু এ সকল কথা বলিয়াছিল। তাহার এহেন সরল শেষ উক্তিতে পুরাতন মধুর পত্রের মায়া ছিল; সময় যেখানে শেফালি, সময় যেখানে অল্পবয়সী, সময় যেখানে হস্তীশাবকের ন্যায়…দর্শনের উপমা নহে– সত্যই পদ্মবনে জলকেলী করিতেছে। বৈজু একথা বলে নাই, সে আবৃত্তি করিয়াছিল, রমণীর বস্ত্রাঞ্চল যে বিশেষ মনোভাব প্রকাশের বাক্যরূপ, সেই গভীরতার, বাস্তবতার অনুভবের আস্থার হৃদয়াবেগের আদ্য অক্ষর এখানেও অস্থির, কেননা এই সূত্রে সূক্ষ্ম রেখার তথা সনাতন সৌন্দর্য্যের শুভ্র মাধুর্যের আখ্যানের ইঙ্গিত, প্রাকৃতজনের মঙ্গলজনক ইঙ্গিত সে করিয়াছিল। আঃ সে এক অপূর্ব আখ্যান! তাহা আদি-অন্তহীন উষ্ণতাকে কাব্যময় এবং উপত্যকা হইতে উপত্যকা অন্তরে তাহাকে বহন না করিয়া, যেখানে সুউচ্চ গৈরিক স্বর্ণাভ শীর্ষযুক্ত পৰ্ব্বতের ছায়া চলমান স্রোতধারার উপর বিস্তৃত, তাহারই তীরে স্থিত করত উপলব্ধি করে। লক্ষ্মীনারায়ণের ইহা ভাল লাগে নাই, তখনও তিনি আপনার দেহস্থিত অন্ধকারে ছুটাছুটি করিতেছিলেন। তিনি বিরক্তি সহকারে কিছু বলিবার পূর্বেই জ্যোতিষীর কথা শোনা গেল।
“ভবিতব্য…ভাগ্য” বলিয়া জ্যোতিষী অনন্তহরি হাতের কাঠি তুলিয়া, প্রাচীন একটি হাসি হাসিলেন–কিছুদূর পর্যন্ত পথ অনুধাবন করার এ হাস্য, এ হাস্যের বাস কোথায় কে জানে, তবে একথা আমরা জানি, এ হাস্য রাত্রের অন্ধকার দিয়া তন্তু প্রস্তুত করে, এবং যাহা নিষ্ঠুর হইলেও অমোঘ। এ হাসিকে কোন হাতই বুঝিয়া লইতে তথা প্রকাশ করিতে অদ্যও পারে নাই। কহিলেন, “ওরে চাঁড়াল, শিবের কলম মানবে না? কি! চন্দ্র সূৰ্য্য সব কিছুকে আক্কেল দিয়েছে রে,…তা ছাড়া তুই জানি না এ বড় পুণ্যের ঘাট, পঞ্চমুণ্ডীর ঘাট। এখানে বুডোর বাপ-ঠাকুরদা সব গঙ্গা পেয়েছে, তাই সে…”
পঞ্চমুণ্ডীর নাম শ্রবণ মাত্র বৈজুনাথের ঈষৎ রোমহর্ষ হয়। এ দেহের পৃষ্ঠদেশ সত্যই কি কিছু পূৰ্ব্বে লাল হইয়াছিল, যে চন্দ্র সূৰ্য্যকে সাক্ষ্য করিয়া অনেকবার আপনার বজ্রমুষ্টি দেখাইয়াছে, পৃথিবীতে সে সহজেই অযাচিতাবলম্বী হইয়া, কৌতুক পরতন্ত্র হইয়া অন্ধকারকে আপনার খেলার সঙ্গী হিসাবে আমন্ত্রণ করিয়াছে–সে এখন একীভূত; তাহারও সংস্কার ছিল, যুক্তি যেখানে কুসুমাদপি কোমল, অবশ। পঞ্চমুণ্ডী নামে সে চোখ দুইটি বড় করিয়া যেন বিপদ গণিল, ইহার পর জ্যোতিষীর পাশ দিয়া গঙ্গায় মুখ প্রক্ষালন করিতে করিতে আপন মনে কহিল, “পুণ্য না শালা হাতী”–তাহার পর হঠাৎ সে জ্যোতিষীকে উদ্দেশ্য করিয়া কহিল, “অত পুণ্যের ঘাট ত গঙ্গা খেলে কেনে গো” বলিয়া নিজের বিদ্রুপে নিজেই হাসিয়া উঠিল, এবং কেহ উত্তর করিল না দেখিয়া নিজেই উত্তর করিল, “গঙ্গা খেলে। কেনে, বলব? সে ঘাটকে গঙ্গা থাকতে দিবে কেনে, কত কটা মানুষ জলজ্যান্ত ধাঁই ধাঁই পুড়ল বল”–এই উত্তর, তাহার আচারের প্রতি যাহাদের কোন বিশ্বাস নাই, তাহাদেরই যেন বা ঘোর। অভিমানে বলিয়াছিল।
ইহারা দুইজনেই কিঞ্চিৎ ভয় ভয়, বৈজুনাথ যাহার পিছনে গঙ্গা, তাহার দিকে তাকাইলেন।
বৈজুনাথ ইঁহাদের অবস্থা দেখিয়া খানিক বিশ্বাস লাভ করিয়া পুনরায় আরম্ভ করিল, “কত কটা ডাগর সতীদাহ হল বল, লোকে শাঁখ বাজালে, উলু দিলে, আমার শ্বশুর বলত শশয়ে গেছে, আমি যেখন এ ঘাটকে জামাই হই এলাম–তারপর কত কটা গেল” বলিয়া গঙ্গা ছাড়িয়া উঠিয়া আসিয়া থমকাইয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখ লজ্জায় অথবা দুঃখে নীচু হইয়াছিল; একটি গভীর নিঃশ্বাস লইয়া, ঝটিতি মুখটি ঘুরাইয়া আঙুল দিয়া পশ্চাতের প্রবাহিণী গঙ্গাকে নির্দ্দেশ করত পুনরায় কহিল, “তাই বুঝি গঙ্গা, চোখের জলকে লোনা হল–কে জানে? বল ঠাকুর তোমরা পাঁচজন।” এরূপ কথা গল্প যখনই সে সুযোগ পাইয়াছে তখনই, হয় শবযাত্রীদের জাগাইয়া রাখিবার জন্য, নয় কেবলমাত্র অবসর বিনোদনের জন্য বলিয়াছে। হায়, শ্মশানেরও সুদীর্ঘ গল্প আছে। তথাপি এখন–তাহার কণ্ঠস্বরে এ কথা স্পষ্টতর হইল যে পৃথিবী বড় অন্ধকার আচ্ছন্ন, এ কারণে যে, তাহার বেদনায় নিয়মের প্রতি ক্ষোভ ছিল।
এ ক্ষোভ, নিমজ্জমান ব্যক্তির শূন্যতা আকর্ষণ উদ্যত হাতের মতই জ্যোতিষীর চোখে প্রতিভাত হয়, ফলে ভীত জ্যোতিষী আপনার শরীরকে মৃদু আন্দোলিত করিয়া কহিলেন, “থাম্ থাম্ বেটা চাঁড়াল, সে ঘাট কেন গেল, সে কথায় তোর কি দরকার।” একথা জ্যোতিষী শুধুমাত্র নিজেকে সহজ করিবার জন্যই আপনাকে আড়াল করিবার হেতু বলিয়াছিলেন, যেহেতু বৈজুনাথের বাক্যে ক্ষণিকের জন্য আপনার মোহ অহঙ্কার বিগত হয়, সেই হেতু সহসা এই সৃষ্টির রেখা সমূহ যাহা কখন ফুলে কভু ফলে, প্রায়ই শিশু আলিঙ্গনের বিচিত্র ভঙ্গিমায় প্রতিভাত–তাহা সকল বুদ্ধি হারাইয়া স্মৃতিকে ভ্রংশ করত অসংলগ্ন এলোমেলো হইয়া, অবশেষে–তাঁহার দৃষ্টির সম্মুখে অনাদি অনন্ত হইয়া দেখা দিয়াছিল। কিন্তু তিনি অতীব চতুর, পলকেই বেলাতটের অঙ্কে মনসংযোগ করিলেন।
“আঃ…রে” বলিয়া বৈজু জ্যোতিষীর কথা কয়টিকে যুত করত কহিল, “হায় কপাল, ছি ছি ছি গো আচাজ্জি” বলিয়া কেমন যেমন খুব সহজ নৃত্যের পদবিক্ষেপ একটু এদিক সেদিকে করিয়া পুনৰ্ব্বার কহিল, “সুতাহাট-থানার বাপ-মা তুমি মোড়ল, আমরা আবার কথা কইব কোন মুখে গো, ছোট জাত মোরাবল? আমরা গল্প বললাম হে। আমরা গল্প বলি। বুড়া ঠায় শুই আছে আর মড়াবসার গন্ধ, তাই বললাম হে…” বলিয়াই আপনার ভঙ্গিমায় বেলাতটের অঙ্ককে ভয়ার্ত করিল।
“থাক থাক, চুপ কর বেটা” লক্ষ্মীনারায়ণ বলিলেন, কেন না তিনি আশায় উত্তেজনায় অসহিষ্ণু হইয়াছিলেন, অবাধ্য অনন্তহরির অঙ্কের ফলাফলের প্রতি তাঁহার মন ছিল না।
তাঁহার ভর্ৎসনার সঙ্গে সঙ্গেই বৈজুনাথ উত্তর করিল, “আহা, নিজেকে রাগাইছ কেনে? বলি রাগ চাঁড়াল’?” বলিয়া কিশোরীসদৃশ হাসি হাসিল–তাহার বক্রোক্তি শুনিয়া অন্য দুইজন কিছুই করিতে পারিলেন না। বৈজুনাথ আবার সূত্র ধরিল, “আমার কথা মান কিন্তুক, শালা। এই ঘাট ভারী খানকী খচ্চর ঘাট! পঞ্চমুণ্ডী ছিলেন সে-ঠেন, মা গঙ্গার কাছে চালাকি, মাই বটে কোম্পানী, ডুবে গেল শালা পঞ্চমুণ্ডী”–এইটুকু বাক্যের মধ্যে সে উচ্ছ্বাসে স্ফীত বলীয়ান হইয়া উঠিয়াছিল, তবু এখন একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া অসহায়ভাবে–যে অসহায়তার মধ্যে গোধূলিলগ্নের অস্পষ্টতা, দূরাগত শঙ্খধ্বনির মায়া, বৎসহারা গাভীর আর্নরবের রেশ ছিল অথচ আর এক স্বরে বলিল, “জল যখন নেমে যায়, তখন কখনও কখনও সেই পাঁজা-মুণ্ডী গাঁথা পাঁজা দেখা দেয়, বলে কি জানো? বলে, ‘হেরে বেটা, ভাল করে চিতা সাজাস, আমার হাঁড়ি চড়বেক…’আমি শালা ডর করি না…দু শালা! মা আমার কোম্পানী, আমার আবার ডর কিসের…ভাবি দি শালা এক কুড়ল মেরে…শালা বলে কি না আমি তোকে শান্তি দেব, হা! শান্তি! ভাবি…থাক শালা চোখের জলের লোনা জলে ডুবে…এ ঘাটে বুড়োক না। শোয়ালেই পারতে গো।” এ কথা বলিতে বলিতে বৃদ্ধ সীতারামের মুখোনি তাহার মানসপটে ভাসিয়া উঠে। বৈজুনাথ নিশ্চয় শব সহ্য করিতে পারে কিন্তু মৃত্যু! আঃ পুনরায় ইহা একটি সুবৃহৎ গ্রন্থ–যাহাতে ফুলসকল লবণাক্ত, যাহাতে বিদ্যুৎ-দীপ্ত সবুজতার বিফলতার কথা, যাহা বৃত্তাকার ভ্রমণের অবশ্যম্ভাবী পরিপ্রেক্ষিত, যাহা দৃশ্যত নাই–তাহারই সূচনা করে। একারণে চাঁড়াল বৈজুনাথ কোনক্রমেই মৃত্যুকে সহ্য করিতে অক্ষম, কারণ তাহার আপনকার পূর্ণতা আর যে সেই হেতু সে বৃদ্ধকে এখনও পর্যন্ত ভাল। করিয়া দেখিতেও যায় নাই।
“জয় জয় মা…তারা ব্রহ্মময়ী গো” বলিয়া জ্যোতিষী উল্লাসে যেন বিদীর্ণ হইয়া গেলেন, হস্তস্থিত হুঁকা বেসামাল হয় এবং সত্বর উঠিয়া এক দৌড়ে, না লম্ফে, লক্ষ্মীনারায়ণের নিকটে প্রায় আসিয়া স্থির হইয়া বেলাতটের আঁকাজোকার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করিলেন, এসময় তাঁহার গভীর নিঃশ্বাস পড়িতেছিল, তাঁহার আপনার ছায়া অঙ্কের উপর বিস্তৃত, সে ছায়াকে অনভিজ্ঞ বালকের মত সরাইবার বৃথা চেষ্টা করিয়া এবার অন্য দিকে গিয়া তাঁহার মনঃ সংযুক্ত হইল। সীতারামের জীবন যে এইভাবে সংখ্যায় থাকিবে কে জানিত! সংখ্যার পিছনে আমি আছে, অহঙ্কার আছে, নিঃশ্বাসও বৰ্ত্তমান। বৈজুনাথ তাঁহার নিকটে আসিয়াছিল, অন্যত্রে লক্ষ্মীনারায়ণ খানিকটা উঠিয়া পুনরায় ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িলেন। জ্যোতিষী আপনার হাতের কাঠি দিয়া কি যেন ঠিক দিবার পরে ক্রমে পিছু হটিতে হটিতে যেখানে আঁকজোক সমাপ্ত হইয়াছে, সেখানে কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত করিয়া কোন সত্য দুর্ধর্ষ অনিবাৰ্য্যতা ঘোষণা করিবার মানসে এখন তাহার দুইহাত খানিক উত্তোলিত হইল, এ সময় আপনকার ওষ্ঠদ্বয় খানিক খুলিয়া নিবিষ্ট মনে নিম্নে লক্ষ্য করিলেন।
বৈজুনাথের আয়ত চক্ষুদ্বয় কোথায় যে স্থায়ী হইবে, তাহা ঠিক পায় নাই। এমত সময় শুনিল, জ্যোতিষী আস্ফালন করিতেছেন, “শালা যাবে কোথায়”, এ কথা শুনা মাত্রই সে যেমন নির্বোধ, তাঁহার দিকে তাকাইল। জ্যোতিষী তখনই’জিহ্বার দ্বারা আপনকার ওষ্ঠ তৃপ্তির সহিত লেহন করত করিলেন, “শ্যালা! ভৃগু যাবে কোথায়…।” এক হস্ত হইতে অন্য হস্তে হুঁকা লইয়া মহা দম্ভে টানিতে লাগিলেন। এইবার হুঁকা হইতে মুখ সরাইয়া কিঞ্চিৎ ধোঁয়া ছাড়িয়া সদর্পে হাসিয়া উঠিলেন। সৌরজগৎ তিন সত্য করিল।
“অনন্ত…” কম্পিতকণ্ঠে লক্ষ্মীনারায়ণ অনন্তহরির উত্তেজনার প্রতিক্রিয়ার বেগ সামলাইতে না পারিয়া ডাকিয়া ছিলেন। তাঁহার স্বরে যাত্রার শেষ দৃশ্যের শেষ রাত্রের অসংযম ফুটিয়া উঠিল।
“সাত তাড়াতাড়ি ঘর থে কেন বার করলে বুড়োকে হে? বড় কঠিন জান!” বলিয়া মাথা দুলাইয়া “হ্যাঁ হ্যাঁ” বলিয়া আপনার বিশ্বাসকে দৃঢ় করিয়া পুনরায় কহিলেন, “বড় কঠিন জান গো৷” বলিয়া, হুঁকা নিকটের মালসার কাছে রাখিলেন।
বৈজুনাথ জ্যোতিষীর অসংলগ্ন বাক্যে বড়ই ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছিল, সে একদা অনন্তহরির মুখপানে অন্যবার মানসিক যন্ত্রণা পীড়িত লক্ষ্মীনারায়ণের প্রতি দৃষ্টিপাত করত আপনার পরনের ঠেটিতে ক্রমাগতই হাতের তালু ঘষিতে ঘষিতে কহিল, “সে কি?” এ সময় তাহার কথায় এলোমলো অবিশ্বাসের ব্যঞ্জনা ছিল।
লক্ষ্মীনারায়ণ প্রায় বৈজুনাথের সহিত কণ্ঠ মিলাইয়া বলিয়াছিলেন, “বল কি?”
জ্যোতিষী কিঞ্চিৎ সমতা লাভ করিয়াছিলেন, কেননা গ্রহ সকল তিন সত্য করিয়াছে, তাহা স্বকর্ণে তিনি শুনিয়াছেন, ফলে আর চাপল্য নাই। তাঁহার দৃষ্টি এখান হইতে সোজা গিয়া পড়িল অদূরবর্ত্তী কীৰ্ত্তনদল বেষ্টিত স্থানে, যেখানে একটি স্থলিত পদবিক্ষেপে ভ্রমণরত বৃত্তের মধ্যে সীতারাম শায়িত। এই দৃশ্য দেখিতে দেখিতে তিনি যেন নিজেকে হারাইয়া ফেলিলেন! একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করত কহিলেন, “সীতারাম! ভাগ্য! পূর্ণিমায় যাবে” বলিতে বলিতে তিনি অতি ধীরে আপনার মুখমণ্ডল ঘুরাইতে লাগিলেন।
“পূর্ণিমা? বল কি ঠাকুর!” বৈজুনাথ ভীত হইল।
“পূর্ণিমা! পূর্ণিমা! চাঁদ যখন লাল হবে” বলিয়া উঠিতেই তাঁহার সর্ব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমত বা একটি বিন্দুতে পরিণত, রক্তিম চন্দ্রিমা আখ্যাটিতে তাঁহার অন্তরীক্ষ রহস্যময় দিব্য বিদ্যুতের আলোয় সমাকীর্ণ; এমন একদা চন্দ্র লাল হয়, যোদ্ধৃ সকল সমবেত হন, পাঞ্চজন্য বাজিয়া উঠে, ঘোর যুদ্ধের রক্তে ধরণী প্লাবিত হইয়াছিল–আকাশে পক্ষী ছিল না। এই ক্ষণ-চিত্র দেখিয়া তিনি, অনন্তহরি, নিষ্ঠার সহিত নমস্কার করিয়া কহিলেন, “চাঁদ যখন লাল তখন তার প্রাণ যাবে…যাবে কিন্তু একা যাবে না হে। দোসর নেবে…” একথা তিনি সকালের উদ্বেলিত গঙ্গার দিকে চাহিয়া বলিয়াছিলেন। হয়ত একথা বলিতে তাঁহার ইতস্তততা ছিল।
এই ভয়ঙ্কর আজ্ঞা, লক্ষ্মীনারায়ণ ও বৈজুনাথ দুইজনেই শুনিয়াছিল, দুইজনেই বিশেষ বিভ্রান্ত, দেহের নিকটে ভীমরুল আসিলে মানুষ যেমত ব্যতিব্যস্ত হইয়া কাঁপিয়া উঠে, তেমনি বৈজুনাথ কম্পমান, রোমাঞ্চিত। সে খানিক অস্ফুট শব্দ করত কহিল, “বল কি দোসর!”
জ্যোতিষীর এখনও ধ্যানস্থ অবস্থা, দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর করিলেন, “দোসর!”
“দোসর!” বলিয়া বৈজুনাথ এক-পা পিছু হাটিয়া গিয়া মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটাইয়া, একদা গঙ্গার দিকে পরক্ষণেই শ্মশানের চারিদিকে চাহিয়া, কুকুরের মত ঘ্রাণ লইবার চেষ্টা করত ভৌতিক প্রমাদ গণনার মধ্যে দণ্ডায়মান থাকিয়া হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল। ইহার পর যখন প্রশ্ন করিল, “সে কি ঠাকুর, দোসর পাবে কোথা থেকে?” তখন তাহার কণ্ঠস্বরে জীরেন রসের হিম ছিল। কৌতুক ছিল না। এ প্রশ্নে, নিমেষেই সে যেন উৰ্দ্ধ জ্যোতির্মণ্ডল হইতে ছুটিয়া আসিয়াছে এমত মনে হইল; যে বিরাট সৃষ্টির আর এক অঙ্গের তথ্য সম্যকরূপে জানে, পৃথিবীর স্বভাবময়ী প্রকৃতি যাহার আদিঘর, বন্ধন যাহার বীজমন্ত্র। যদিও ‘দোসর’ বাক্যের আপনকার সৌন্দৰ্য্য বিদ্যমান, যদিও হাটে মাঠে সে বাক্যের নিয়ত প্রতিধ্বনি শ্রুত, যদিও সে বাক্য অনন্ত জ্যোতির্মণ্ডলের এক নির্ঞ্ঝাট ত্রিগুণামিতিক বিচিত্র আকর্ষণ; কিন্তু সে বাক্য দেহ ধারণ করিয়াছে। ব্রাহ্মণ দুইজন আর এক ভাবের মানুষ, আপনকার গাত্র লেহন করিয়া পশুসকল যেমত আরাম পায়, তেমনি হঁহারা আপন আপন চক্ষুদ্বয়কে, মনকে, শ্বেতপদ্মকুসুমাদপি বিবেককে জিহ্বা দ্বারা লেহন করিতেছিলেন।
প্রথম অধীর বৈজুনাথ, আপনার পতিত জমির ন্যায় অনাদৃত বক্ষে হস্ত বুলাইয়া উর্বরতা, আদিম উৰ্ব্বরতাকে উত্থিত করত বেলাতটের ধূসর তান্ত্রিক যন্ত্রসমূহের মত অসংখ্যের হেতু, প্রক্ষিপ্ত অঙ্কের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াছিল। যাহা কালকে ইদানীং আপনার বাস্তবতাবলে এ হেন রূপ দিয়াছে যাহাতে তাহার ছায়া পর্যন্ত দৃশ্যমান। দুঃসাহসী বৈজুনাথ অধিকন্তু অনুধাবন করে যে রৌদ্রকর্মা অমোঘ বীভৎসতা এ সকল প্রতাঁকের পশ্চাতে ঘূর্ণায়মান, এবং ক্রমান্বয়ে আঘাত হানিতেছে। ইহাকে পরাস্ত করিবার মানসে অনন্তর এমন এক অঙ্গভঙ্গী করে যাহার অর্থ এই যে, এ বিশ্ব সংসারের ঊর্ধ্বে, নভে, জ্যোতির্মণ্ডলে কোথাও যদি সে পাঁচন হস্তে স্থিতবান হইতে পারিত, তবে ভালবাসার এই পৃথিবীকে অন্যত্র, আর এক ঘরে, লইয়া যাইত; ইহাতে তাহার ঔদ্ধত্য প্রকাশ হইত না এবং নিঃসন্দেহে দেবতাগণ। পুষ্পবৃষ্টি করিতেন। সেই অঙ্গভঙ্গীর কারণ এই যে, সে নিজস্ব প্রশ্নের গুরুভারে অত্যধিক হতবুদ্ধি হইয়া বিশেষরূপে নিষ্পেষিত হইতেছিল, কেননা সে ক্ষণিকের জন্য অনুভব করিল, স্বকর্ণে শুনিল, আধো স্বরে সমগ্র বসুন্ধরা–যাহা অন্তরে অনির্বাণ, মধ্যে সুপ্তি আচ্ছন্ন, এখানে শ্লেষাত্মক ভাষার উদর বিশিষ্ট–সেই বসুন্ধরা তাহাকে পিতারূপে সম্বোধন করিতেছে। ইহা শ্রবণে এই প্রথম সে, বৈজুনাথ, আপনার নিঃশ্বাস বায়ুকে আপনার সহজ চোখে দেখিয়াছিল। সে বুঝিল যে তাহার শ্বাসকষ্ট হইতেছে, রোমসকল হরষিত, গাত্র রিমরিম; কেননা আমরা জানি স্তনহীন মৎস্যসংসার যেমত স্বীয় দৃষ্টি দ্বারাই আপন আত্মজগণকে লালন পালন করে, তেমনি সে, বৈজুনাথ, পদতলে যাহার মৃত্তিকা বিস্তার, আর এক হতভাগ্য! তাহার উপায় অন্তর নাই, তবু সে আপন বক্ষ হইতে আদিমতা উজ্জীবিত হস্তখানি উঠাইয়া প্রকাশ্যে সমর-আহ্বান ভঙ্গীতে, আপনার তন্ময়তার মধ্যেই, আন্দোলিত করিয়া পরক্ষণেই মহা কৌতুকে কহিল, “দোসর! দোসর বলতে তবে বুঝি আমি! বুড়া বুঝি আমায় লিবে গো” তাহার শেষ পদটিতে ঝুমুরের ছন্দ ছিল এবং বলিতে বলিতে সে মহা উৎসাহে লাফাইয়া উঠিয়াছিল। এখন সে আপনার ঊরুদেশে অতীব আহ্লাদে চাপড় দেয়।
“ফের বেটা হারামজাদা চাঁড়াল! বড় বাড় বেড়েছে তোর…খড়ম পেটা করে আমি তোর নাম ভুলিয়ে দেবো…ছোট জাত।”–জ্যোতিষী তাহার উল্লাস দর্শনে রাগতভাবে এবম্বিধ কহিয়াছিলেন; ইহা অকৃত্রিম কিম্বা ইহার মধ্যে ইতস্তততা ছিল তাহা সঠিক বলিবার উপায় নাই; অন্যপক্ষে স্মৃতি-উদ্ভূত সম্ভবতার সম্মুখে যে অস্পষ্টতা, তাহা তাঁহাকে এক অলিখিত স্বরভঙ্গতার মধ্যে আনে; পুনৰ্ব্বার, হয়ত এই সত্য যে, সম্ভবতা যাহা বৰ্ত্তমানবৎ তাহা যে ভোজবিদ্যা দেখাইয়াছে, উহা যদিচ ভয়ঙ্কর তবু নির্ঘাত নিশ্চিত অব্যর্থ, সে কারণে মনুষ্যপদবাচ্য যে কোন জীব–এখন চাঁড়াল বৈজুনাথ, যে তাহার বিরোধিতা করিবে, উহাকে উপহাস করিবে–তাহা অপ্রমত্ত অনাৰ্য্য বালখিল্যতা এবং ইহা বাঞ্ছনীয় নহে। কারণ কোথাও না কোথাও উহা শ্ৰীসম্পন্ন, সুন্দর, স্বাভাবিক!
নিরভিমান বৈজুনাথ দমিল না, প্রসন্ন মনে তাঁহার কথার উত্তর দিল, “আর কোত্থাকে দোসর পাবে গো…তাই না বুলোম বটে, আমায় লিবে” বলিয়া এই দুইজন ব্রাহ্মণ ছাড়া তাহার আপনার কথার সায়-সাক্ষী লাভ করিবার আশায় অন্যান্য দিকে পর্য্যবেক্ষণ করিল।
জ্যোতিষী তৎক্ষণাৎ মুখভঙ্গী সহকারে কহিলেন, “হেঃ হেঃ আমায় লিবে”–ইহার পর আপনার কণ্ঠস্বরে সাবধানতার ছল আনিয়া বলিলেন, “হারামজাদ, তোর সাহস ত বড় কম নয়। সাধে কি চাঁড়াল জন্ম হয় তোর, কুট হবে, বেটা কুট হবে, বেটা বামুনের দোসর!” এইখানেই থামিতে হইল, এই জন্য যে সহসা এক ঝলক উগ্রতীব্র নরবসার গন্ধসহ ধূম ব্রাহ্মণের মুখোনিকে বিকৃত করে, তাঁহাদের দুইজনের অবয়বকে ধূসরে সমাচ্ছন্ন করিয়াছে; এবং জ্যোতিষীর শোযোক্ত কথা এ ধূমরাশি বহুদূরে লইয়া গিয়াছিল, এবম্প্রকার বাক্যে বৃক্ষের পত্রনিচয় চুপ, পক্ষিসকল উধাও। এখন আর পাণ্ডুর অস্পষ্টতা নাই। জ্যোতিষী চিক্ করিয়া থুতু ফেলিয়া কহিলেন, “পাষণ্ড, বেটা তুই কুকুর হয়ে জন্মাবি।”
ব্রাহ্মণের বাক্যে মুহূর্তের জন্য সকল কিছুই যেমত বা বিশেষ রূপ পরিগ্রহ করে; বৈজুনাথ, আশ্চৰ্য্য যে, কোন দৈববশে সহসা যেন ক্ষুদ্রকায়া হইয়াছিল, তাহাকে দেখিলে মনে হয়, পৃথিবী নহে–আপনার আকাশ লইয়াই বহু দেশে দেশে সে ভ্রমণ করিয়াছে, এখন বেচারী ক্লান্ত; এখন সে আপনকার নাসাপুট কম্পিত করত নিঃশ্বাস লয় এবং কহিল, “সে বড় ভাল হবে গো ঠাকুরকুকুর হওয়া ঢের ভাল”– বলিয়া অসহায়ভাবে হাসিল। ইহার অর্থ, হয়ত এই হয়, আহার-নিদ্রা-মৈথুন-ভয়ই আমার ভাল। এখানে প্রকাশ থাকে, কিছুদিন পূর্বে এক সাধকের নিকট ‘আয় মন বেড়াতে যাবি’ গীতটি শুনিয়া সে ভাবিয়াছিল শিখিবে; বিশেষত, কল্পতরুমূলে চারি ফল কুড়ায়ে পাবি’ পদটি ভাবিয়াছিল গঙ্গায় পা ডুবাইয়া অন্ধকার রজনীতে প্রাণ-ভরিয়া গাহিবে। সে আশা নিশ্চয়ই আর নাই। অনন্তর কাতর কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, “তবে, তবে কাকে লিবে গো ঠাকুর?”
এ হেন সরল প্রশ্নের বাক্যনিচয়ে সকালের আলোক পরিচ্ছন্নরূপে দেখা গেল।
“ফের হারামজাদা! যা বলছি এখান থেকে” বলিয়া জ্যোতিষী আর আয়ুক্ষয় না করিয়া লক্ষ্মীনারায়ণের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন।
লক্ষ্মীনারায়ণ ভূমিতে বসিয়া পড়িয়াছেন, আপনার জানুর উপর হস্ত স্থাপন করিয়া অধুনা বিনিদ্রা-জনিত ভারে অবসাদতিক্ত মস্তক রাখিয়া চক্ষু বুজাইয়াছিলেন। তাঁহার শরীর এই গণনার ফল ঘোষণায় অধিকন্তু নির্জীব, শীত-উষ্ণ বোধের সাধারণত্বের বাহিরে তিনি আপনা হইতেই সরিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন; আবার মনে হয়, তিনি নিশ্চিতভাবেই স্থির। যতক্ষণ গণনা চলিতেছিল, মন্ত্ৰপড়ার মত ভৌতিক শব্দ হইতেছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিম জ্ঞান তাঁহাকে স্বাভাবিক বৈষয়িক রাখিয়াছিল; এখন নিছক বিকারগ্রস্ত, স্নায়ুসকল পিঙ্গলকৃষ্ণ-বৃক্ষে পত্রাদি তিরোহিত কখনই হয় নাই, ভেককুলকে হরষিত করিবার নিমিত্তই প্রাবৃট পটলে মেঘমালা দেখা দেয়–লক্ষ্মীনারায়ণ, এরূপ প্রত্যয় হয় যে অঘঘারে ঘুমাইতেছেন।
“আই লক্ষ্মীনারায়ণ খুড়ো” জ্যোতিষী ডাকিলেন। কোন সম্পর্কে লক্ষ্মীনারায়ণ অনন্তহরির খুল্লতাত হইতেন।
লক্ষ্মীনারায়ণ এই ডাকে জাগিলেন সত্য, কিন্তু মাথা তুলিতে সমর্থ হইলেন না। কে যেমন বা জোর । করিয়া তাঁহার চক্ষু দুইটি মেলাইয়া ধরিয়াছে, যাহার একটি উস্কো চুলের তলে বিশ্রীভাবে চাহিয়া আছে। নিকটস্থ শব সৎকারের ধূমে তাহা যারপরনাই লাল, তৎসহ নরবসার গন্ধে দেহ ইন্দ্রিয়হীন অশরীরী বিকল, স্মৃতি তাঁহার এমন কি ধমনীর আশ্রয় ত্যাগ করত বহুদূরে কোন গ্রামে বিশৃঙ্খল আলুথালু প্রতীক্ষারত, এবং কৃতসঙ্কল্প বিমূঢ় তাঁহার চেতনা। বস্তুত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ব্রণবিরহিত সৌন্দর্য্যে রাত্র কিম্বা। দিনের কোন প্রভাব নাই, আশ্চর্য্য অথচ ভ্রমরের বিচিত্র ভাব সিদ্ধির অন্যতম কল্পনা বিদ্যমান; উহা । অজর–শুভ্রতায় যাহার জন্ম, পদ্মে যাহার জৈব ধৰ্ম্মের সৰ্বার্থসাধক বিহারভূমি, মৃত্যু যাহার নাই, সমাধিতে যাহার অস্তিত্ব। শ্মশান উহার ইহজনমের উপলব্ধি নহে, জীবনকে ভালবাসার সম্যক কারণও নহে। ব্রাহ্মণ্য ধৰ্ম্ম এক এবং ব্রাহ্মণ আর এক, ইহা ভাবিবার মত ধৃষ্টতা আমাদের নাই। তথাপি কেন যে অতর্কিতে এ হেন শূন্যতা,–মীন হইতে মানুষ যাহার আধার মাত্র–সেই শূন্যতা বাক্য-দেহ-মনকে আচ্ছন্ন করিয়া উপছাইয়া পড়িয়াছিল; তাহা আংশিকভাবে কল্পনা করিতে পারিলেও লক্ষ্মীনারায়ণ স্বীয় জিহ্বায় অন্য এক স্বাদ পাইবার চেষ্টা করিলেন; এবং অপ্রয়োজনে এদিক-সেদিক চাহিয়া মনে হইল, কোথাও কেহ নাই, ভয়াবহ নির্জনতায় এ স্থান পূর্ণ আর এ শ্মশানভূমি আপনার শায়িত ভৈরব রূপ, শবাসন পরিত্যাগ করিয়া দৃষ্টির সমক্ষে অতিকায় প্রাচীরবৎ দণ্ডায়মান। কারণ বারম্বারই একটি বালিকার, যে তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা সর্বাংশে লক্ষ্মীপ্রতিমার ন্যায়, তাহার সরল নিৰ্ম্মল মুখমণ্ডল তাঁহার মানসপটে ভাসিয়া উঠিয়া তাঁহাকে সৰ্বরূপে বিমূঢ় করিয়াছে এতদৃষ্টে লক্ষ্মীনারায়ণ ঈষৎ শঙ্কিত হইয়া অপ্রস্তুত হইয়া জ্যোতিষীকে ঝটিতি বলিলেন, “বলো।”
“বলো কি গো, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?…” অনন্তহরি প্রশ্ন করিলেন। অনন্তহরিকে তাঁহার দক্ষতার গর্ব এখনও অনেকটা স্ফীত করিয়া রাখিয়াছে। এ জয়ের নিকটে যে কোন মনোভাব তুচ্ছ, দুৰ্বল।
লক্ষ্মীনারায়ণ এমত মনে হয় বৃক্ষরোপণ দেখেন নাই, হরিৎক্ষেত্র বলিতে কোন পাখী অথবা নদীর নাম বুঝায় তাহা যেন তাঁহার জানা নাই, মেলা খেলায় বাজিকরকে ডম্বরু বাজাইতে দেখিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। তিনি জড়বৎ সম্বিৎহীন, কোনক্রমে মাথা দুলাইয়া, যেহেতু অনন্তহরির গৰ্ব্ব তাঁহাকে আহত করিয়াছিল, উত্তর করিলেন, “বোধ হয়…
কিন্তু আমার কি হবে?” তাঁহার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইল, এ কথায় দীক্ষালোভীর তীব্র ব্যাকুলতা ছিল, এবং তাঁহার দেহ দিয়া আশ্বিনের প্রমত্ত ঝড়ের ক্রমাগতই শব্দ নির্গত হয়; পূৰ্ব্বে ঐ নির্বাক জবুস্থবু অবস্থার মধ্যেও হয়ত বা লক্ষ্মীনারায়ণ আপনার নাম মনে করিতে পটু ছিলেন, ফলে সহজেই এ প্রশ্নও তাঁহার মনে আসিয়াছিল, ইহা কি সত্য! এবং এখন বেলাতটের আবছায়া ইয়েরোগ্লিফিক বিশ্লেষণের প্রতি ক্ষণেক দৃষ্টিপাত অন্তে জ্যোতিষীকে জিজ্ঞাসাও করিয়াছিলেন, “সত্যি অনন্ত.দোসর…” বলিবার কালে তাঁহার অঙ্কুরিত কাঁচাপাকা দাড়িসমেত মুখোনি অত্যন্ত কিস্তৃত হইয়াছিল। যদিচ তাঁহার বদনমণ্ডল আৰ্য্যশোভা বিমণ্ডিত।
এ প্রশ্ন একাধারে তাঁহাকে কোথায় যেমন বা তলাইয়া দিয়াছিল; আপনার দৃষ্টি দিয়া গুরুভারসম্পন্ন দেহকে রক্ষা নিমিত্ত চেষ্টা করিবার সুযোগ পৰ্য্যন্ত পান নাই, তেমনি অন্যত্রে হাজার কণ্ঠে জয়ধ্বনি তাঁহাকে নির্ভীক করিয়া তুলিয়াছিল।
জ্যোতিষী অনন্তহরি তাঁহার এ প্রশ্ন শুনিবামাত্র বিশাল হইয়া উঠিয়া সদম্ভে উত্তর করিলেন, “আরে বাবা এ কি চন্দ্র সূর্যের বিচার! তাদের বাপের ইচ্ছে; ভুল যদি হয়…আমার মাথায় ঘোল ঢেলে দিও। কার কলম তা জান?”
লক্ষ্মীনারায়ণ, বালিকাবধূ যেমত বা, জন্মগত সংস্কারবশে শিহরিয়া উঠিলেন; তাঁহার শত সহস্র রোমকূপে স্বেদবিন্দু সকল আসিয়া থমকাইল, যেহেতু তিনি অনুধাবন করিতে পারিয়াছিলেন ইহাই সত্য, ইহাই পথ। কেননা তাঁহার সমক্ষে অক্ষয় পরিক্রমণ সশরীরে আবির্ভূত, যেখানে সূৰ্য্যচন্দ্রগ্রহনক্ষত্ররাজি স্তন্যপায়ী উলঙ্গ শিশুমাত্র! তদনন্তর হাতে হাত ঘর্ষণে আপনাকে অনুভব করিয়া সাহসে সহজ হইয়া দেখিলেন অশীতিপর কালাহত সীতারামের গলে দিব্য বনমালা দুলিতেছে, আর যে বৃদ্ধ সীতারাম কোন এক ঐশ্বৰ্য্যভাবে বাঁকা–সৰ্ব্বলোক আরাধ্যা প্রাণাধিকা রাসেশ্বরীর ভাবে যেমন কৃষ্ণচন্দ্র বঙ্কিম–তেমনি; তিনি, স্থিতপ্রজ্ঞ সীতারাম অনাগত কাহার মধুরভাবে বঙ্কিম হইয়া আছেন। লক্ষ্মীনারায়ণের ঘুণাক্ষরেও মনে হয় নাই জ্যোতিষীর দম্ভ সর্বৈব মিথ্যা হইতে পারে, মনে করিবার আর কোন তর্কও উপস্থিত নাই, কারণ তাহা সত্য, অবশ্যম্ভাবী, কেননা অশরীরী কাহারা ঊর্ধলোক হইতে তিন সত্য করিয়াছিল।
লক্ষ্মীনারায়ণ আপনার আবেগ রোধ করিতে অপারগ, এবং তদ্দণ্ডেই উঠিয়া দৌড়াইয়া গিয়া জ্যোতিষী অনন্তহরির হস্তধারণপূৰ্ব্বক রোরুদ্যমান কণ্ঠে ক্রমে ক্রমে কহিলেন, “ভাই অনন্ত, মান বাঁচাও, মান বাঁচাও আমার। ব্রাহ্মণের ইহকাল পরকাল রক্ষা কর…কোন উপায়ে ওদের রাজী করাও…যদি না হয় আমি গঙ্গায় ঝাঁপ দেবো তুমি তুমি…”
লক্ষ্মীনারায়ণের কম্পমান হস্তের মধ্যে, মনুষ্যোচিত ব্যাকুলতার মধ্যে যেখানে ত্রিসন্ধ্যা এক হইয়া শান্তি লাভ করে, যাহার দ্বারা সমগ্র পরিদৃশ্যমান বিশ্বকে আপনার বাতায়নে দাঁড়াইয়া অক্লেশে আপনার মত দেখিতে গিয়া মানুষ আপনাকেই প্রমাণরূপে জানিয়াছে, এবং সর্বপ্রথম সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করিয়াছে, তখনও রাত ছিল, আকাশে তারা ছিল–এবম্প্রকার হস্তের মধ্যে অনন্তহরির হাতও কাঁপিতেছিল, ফলে আপন হস্তধৃত কাঠির কলম, যাহাতে অনন্ত জ্যোতির্মণ্ডলের ধূলিকণা লাগিয়াছিল–তাহা যেন বা শীতকাতর।
অনন্তহরি লক্ষ্মীনারায়ণের এহেন ব্যবহার দর্শনে, যাহার মধ্যে বজ্র ছিল, রমণীর ন্যায় তিনি ঈষৎ লজ্জাশীল বটে এবং কথঞ্চিৎ নড়বড়েও হইয়াছিলেন। পরক্ষণেই আশপাশ দেখিয়া দ্রুত বলিলেন, “আঃ খুড়ো ছাড় দিকি” বলিবার কালেই অতর্কিতে চিতাধূম আসে, আর যে তিনি নিজের মুখোনি আড়াল করিতে ব্যস্ত হন, তাই “লোকে কি বলিবে” একথা তাঁহার অব্যক্ত রহিল, অথবা চিরআয়ুষ্মন ধূম্ররাজি তাঁহাকে সচেতন করিল।
লক্ষ্মীনারায়ণের এইরূপ বন্ধনে পুরাতন সনাতন প্রকাশের মধ্যে নিটোল সম্পূর্ণ মুক্তি ছিল, জ্যোতিষীর অনুরোধ সত্ত্বেও হাত দুইখানি ছাড়িয়া দিবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না, কেননা আপনার বিশ্বাস, আপনার ধর্মের নয়নাভিরাম রূপ এখানে দেখা দিয়াছিল; আরও দেখিয়াছিলেন, তাঁহার কৰ্ম্ম, বায়ুচালিত চৈত্রের বিশুদ্ধ পাতার মত উধাও হইবার পূর্ধ্বমুহূর্তে কামজ্বর পীড়িত জীবের মত চঞ্চল!
এই শ্মশানের ভয়ঙ্কর ধূমরাশি, ইদানীং যাহা কিয়দংশে সবুজ, তাঁহাকে মোহগ্রস্ত করিতে সক্ষম হয় নাই, চক্ষুকে রক্তিম করিয়াছিল সত্য, কিন্তু তাঁহার অন্তস্থ সঙ্কল্প হইতে তাঁহাকে মনে বিচলিত করিতে পারে নাই! লক্ষ্মীনারায়ণ সংস্কারহীন নির্লিপ্ত বাস্তব জগতকে পর্য্যবেক্ষণ করিলেন, একটি দুর্ধর্ষ দেহ তথা বৈজুনাথ ধীর পদবিক্ষেপে ঘোরা ফেরা করে, নিকটে প্রজ্জ্বলিত চিতা যাহার মধ্যে অস্থিমেদ মাংস কৃষ্ণবর্ণ, ক্রমে পৃথিবীর আয়তনকে নিশ্চয়ই স্ফীত করিতেছে–এপাশে জলধারা অন্যদিকে পত্ৰবাহার। ইহারা কেহই সত্য নহে; কিছুই, না শ্মশান না জলধারা কিছুই তাঁহাকে নিৰ্ব্বোধ করিবার মত পূর্ণতা লাভ করে নাই। এই সসাগরা বসুন্ধরা তাঁহার জন্য বাঁচিয়া থাকুক, ইহাদের দিয়া তাঁহার ব্যক্তিগত কাজ আছে–কেননা তিনি সংস্কার আচ্ছন্ন–এমত মনে হয় নাই। ঈষৎ পূর্বের অবসাদগ্রস্ত মনোভাব এখন অপাংক্তেয়, বুদ্বুদধৰ্ম্মী। লক্ষ্মীনারায়ণের লক্ষ মনোবাসনা আর এক, তাহা এই হয় যে, কাল ক্রন্দনের অন্তর্গত, কিন্তু স্পন্দন নিশ্চিন্ত সত্য, কেননা উহা বিনিষ্কম্প স্তব্ধতায় ফুটে-উঠার একমাত্র দুর্ধর্ষ যুক্তি। পুনরায় তিনি, অল্প সুস্থতা পাইয়া জ্যোতিষীর হাত ঝাঁকানি দিয়া কহিয়াছিলেন, “তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। অনন্ত আমাকে বাঁচাও-”তুমি যদি বলে দাও–তাহলেই হবে…এখনো ত আয়ু আছে…”।
অনন্তহরি এক প্রকার জোর করিয়া আপনাকে মুক্ত করিয়া বিরক্তি সহকারে উত্তর করিলেন, “আঃ খুড়ো, তুমি বৃথা বাক্যব্যয় করছ; ওরা, মানে…ছেলেরা, কুলপুরোহিত কৃষ্ণপ্রাণ এরা সবাই ত রাজী। শুধু বিহারীনাথ–অবশ্য তখন বুড়ো অবস্থা…বেগোড় হয়েছিল…”
“এখন তোমার কথা…” লক্ষ্মীনারায়ণ ইহাতে তাঁহাকে পুনরায় অনুরোধমাত্র করিয়াছিলেন।
“আমার? আমি ত নিমিত্ত…শিবের কলম…” বলিয়া জ্যোতিষী লক্ষ্মীনারায়ণের পদদলিত আঁকের দিকে চাহিলেন, যেখানে জীবনের কিছুটা ছিল, ব্রাহ্মমুহূর্তের প্রাকৃতিক শোভা যাহার আয়ু।
বৈজুনাথ তাঁহাদের যেন বা আপনার দ্বারদেশ হইতে দেখিয়াছিল, প্রিয়জন যেন বিদেশ যাত্রা করে। অল্পকাল পরেই, তাহার দৃষ্টি খসিয়া তাঁহাদের ছায়ার উপর পড়িবামাত্রই সঙ্গে সঙ্গেই, সারা গাত্রে তাহার আপনকার–নিম্ন শ্রেণীর আধা-নিরীহ পশুর ক্ষুব্ধ, অসংযত, মর্মভেদী যন্ত্রণার, বিলাপের, ক্রন্দনের হৃদয়বিদারক শব্দসমূহ ধ্বনিত হয়, এবং ইহা সে নিরীক্ষণমানসে চঞ্চল চিত্তে, একদা দেহের দিকে ক্রমে বাঁধপ্রতিম বাহুর প্রতি মহা উদ্বেগ লক্ষ্য করত অস্থির। একথা সত্য, অদ্যাবধি কোন রাত্রই তাহার দোয়াঁশা হইয়া দেখা দেয় নাই, কোনদিন তাহার হস্তরেখার খাত ছাড়িয়া, অন্যত্রে যায় নাই। এখন, অনন্তর সে ভয়ে তৃষ্ণার্ত হইয়াছিল।
অনন্যমনে সে এক রাত্রের মধ্যে, অর্থাৎ গতরাত্রে ভেড়ীপথ হইতে দেখিয়াছিল, স্রোতবিকার চন্দ্রালোক এবং বেলাতটে পরিক্রমণরত বৃত্ত, যাহাদের নামগান হিম বাতাসে কিয়ৎপরিমাণে দুষ্ট, উপরন্তু যখন তখন কাশির আওয়াজ সমস্ত কিছু অন্ধকারের বক্রোক্তির মত শুনাইতেছিল। বৈজুনাথ তদ্দর্শনে যারপরনাই ত্রস্ত, ফলে সীমাহীন হইয়া গিয়াছিল–এমত অবস্থায় তাহার সুন্দর চক্ষুদ্বয়ের সম্মুখে আধিদৈবিক ভোজবিদ্যার কৌশল চকিতে খেলিয়া যায়, অবলীলাক্রমে প্রতীয়মান হইল, ক্রমাগত পরিবর্তনশীল বৃত্তের তথা যেমত বা রাশমণ্ডলের কেন্দ্রে যে জন একটি অভিব্যক্তিমাত্র, সে যেন নিকটের আকাশে বারেক উঠানামা করিতেছে। বৈজুনাথ বিস্ময়ে অস্ফুট বচনে প্রশ্ন করিয়াছিল, ইহা কি সত্য! এই সীতারাম, কীৰ্ত্তনের দল, কাশির আওয়াজ, বেলাতট এ সকল কিছুই কি স্বপ্ন। দেহ-মায়াবন্ত বৈজুনাথ ভয়ে শঙ্কায় কেমন যেন হইয়া শিবার মত ধ্বনি করিয়া উঠিতে চাহিল; তদনন্তর এক মুহূর্ত ভেড়ীপথে না অতিবাহিত করিয়া সবেগে দৌড়াইয়া তখনও প্রজ্বলিত একটি চিতার নিকট আসিয়া, গ্রীষ্মকালীন দ্বিপ্রহরের কুকুরের মতই জিহ্বা প্রলম্বিত করত হাঁপাইতে লাগিল। বারবারই তাহার মনে হইতেছিল, বাঁচিয়া গিয়াছি। যদিচ একথার কোন যুক্তিপূর্ণ, আপাত দৃষ্টিতে, হেতু ছিল না। পুনরায় সে সুস্পষ্টরূপে ভাবিল, চিতার কাছে আসিয়া সে নিশ্চিত বাঁচিয়াছে। এবং কোনসূত্রে কিঞ্চিৎমনোবল সঞ্চয় করত স্পন্দনশীল রহস্যটিকে আর একবার দেখিয়াছিল। কিন্তু পলকের জন্য তাহার এ হেন অনাৰ্য্য বিমূঢ়তা ছাড়াইয়া, ইহা সহজ হইল না যে সত্যই উহা সুন্দর।
পুনৰ্বার বৈজুনাথ ফিরিয়া আসিয়াছিল। তখনও দুই ব্রাহ্মণ অগ্রসর হইতেছিলেন; উহাদের দেখিয়া সহসা তাহার মনে হইল, ইহাদের পদযুগল একজনেরও মাটিতে নাই, তাঁহাদের পিঠে রাত্র, তাঁহারা শীর্ণ, সূক্ষ্ম, স্বপ্নহীন। এবং এখন সে বেলাতটে ধর্ষিত আঁকের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিল, সেখানে একটি ক্ষুদ্রকায়া ব্যাঙ, এই শায়িত ব্রহ্মাণ্ডের উপর দিয়া লাফাইয়া লাফাইয়া চলিতেছে। এসময় তাহার কানে কাকুতি-মিনতির স্বর আসিতেছিল; সেই হেতু চক্ষুদ্বয় তুলিতেই সম্মুখে অদূরে স্পষ্ট হইল, দুই ব্রাহ্মণ তখনও দাঁড়াইয়া, একজন যেন বা কর্দমাক্ত প্রতি অঙ্গই অসম্ভব এলোমেলো, অন্যজন ক্রমান্বয়ে আশ্বাস দিতেছেন, এবং ইহাতে বৈজুনাথের অতীব ঔৎসুক্য দেখা দেয়। এখন, তাঁহারা চলিতে আরম্ভ করিলেন। পরিক্রমণরত বৃত্তাকার কীৰ্ত্তনের দলের নিকট আসিয়া লক্ষ্মীনারায়ণ থমকাইয়া গিয়াছিলেন; এখন এই দল থামিয়াছিল, কেননা ভঁহারা পথ করিয়া যাইবেন, ফলে দলটি পাশাপাশি দুলিতেছিল।
অনন্তহরি তাঁহাকে, লক্ষ্মীনারায়ণকে, একপ্রকার টানিয়া ভয়ঙ্কর বহর মধ্যে প্রবেশের পরক্ষণেই পুনরায় উচিতমত কীৰ্ত্তনের দল চলিতে লাগিল।
এই শ্যামা আরামহীন বহ-মধ্য প্রতিনিয়ত অক্ষ ঘর্ষণের বিকট কর্কশ বীভৎস রোমহর্ষক শব্দে মথিত; পূর্বেকার মত আর সকল কিছুই স্থির। ইহা অনেকাংশে মনে হয় সুগভীর কৃপ-নিম্নে আলোকপাত হইয়াছে, সেখানে জলস্তর আয়না, উপরিস্থিত আমাদের প্রতিবিম্ব দূরত্ব নিবন্ধে সবিশেষ আবছায়া; অন্যপক্ষে আকাশ প্রতিভাত, দেখা যায়, নির্ভুল সম্যক আর্থিক। আর সকল কিছুই স্থির, পত্রচ্যুত শিশিরবিন্দুর ন্যায় গঙ্গোদকের বিন্দুর শব্দ, স্তব্ধতা অনেকানেক সন্দিগ্ধতাকে জলদান করিয়া পুনরায় আত্মসাৎ করিতেছে, এবং একের ঐশ্বর্যশালী নক্ষত্রখচিত উপাধিসমূহ ধীরে অন্তর্হিত হয়।
তথাপি কীৰ্ত্তনের ধ্বনিমধ্যে কোন আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা নাই, তৎসহ গম্ভীর কণ্ঠে ‘গঙ্গা নারায়ণ ব্রহ্ম আবৃত্তি-উচ্চারণের ভীতিপ্রদ রেশ অদ্য সকালের স্বর্ণাভ তীক্ষ্ণ রৌদ্রে খেলনার মত নিরীহ। আর যে সমবেত জনমণ্ডলীর চোখেমুখে–যাঁহারা আসীন তাঁহাদের মুখমণ্ডলে–কেশে, ভস্মকণা যায়, অনিবাৰ্যতাকে লইয়া ইহারা প্রহর জাগিয়াছে, ভূতপূজকদের মত ঘঁহারা একনিষ্ঠ বিশ্বাসী; গ্রন্থি নির্মাণের মধুর, সুচতুর, মনোরমা, দিব্য, ছবিলা, চারুকলা-সুকুমার কৌশলখানি মহা ঘোরে বিমোহিত আচ্ছন্ন, ইহা সত্ত্বেও এই মরজগত হইতে অতীব প্রাচীন যে বীজময় শরীর তাহা নির্লজ্জ উন্মুখ, মৃত্যু মৃত্যু মৃত্যুকে তাহা নিতান্ত অবহেলায় চপলমতি বালকের মত তুড়ি মারিতেছিল; প্রত্যেকের মনে ইদানীং বাস্তবতাকে শ্মশানের ক্ষিপ্রতাকে অগ্রাহ্য করত আপন আপন গৃহকোণের প্রতিচ্ছবি চিত্রিত হইয়াছিল।
অনন্তহরি এবং লক্ষ্মীনারায়ণের বৃত্ত ভেদ করিয়া আগমনে শুধুমাত্র যে আলোআঁধারের তারতম্য, কেবল যে স্থান পূর্ণাঙ্গ নিপট, আর সময় পরোক্ষ অনুভূতির বিষয় হইল, তাহা নহে, জাগ্রত সকলেই আপনকার দৃষ্টি তুলিয়া উহাদের মহাআবেগে আহ্বান করিল; একারণ যে, তাঁহারা মনে হয় সেই দেশ হইতে আসিয়াছেন, যেখানকার সকল সংবাদ কুশল, যেখানে বারিপাত আশাতীত, সংক্রামক ব্যাধি যেখানে নাই, যেখানে প্রতিটি চতুর্দশী বালিকাবধূ অন্তঃসত্ত্বা; ফলে তাঁহাদের দর্শনমাত্রই অনেকেরই রক্তে, স্ফীতনাসা-শঙ্খিনী-রমণীর কাম লালসা উন্মত্ত আঁচড় কাটিতে শুরু করে, সে রমণী–নিদাঘের দগ্ধ দ্বিপ্রহরে আপন স্বেদবিন্দু স্বীয় দেহহাপরি গতিচাঞ্চল্যে মদন দহনে নিপীড়িত, ক্ষিপ্ত, অধীরা, তাই সে আপন শরীরকে কভু বিরাট কখন অতল গভীর করিতে সমুৎসুক। ইহারা প্রত্যেকেই জাগিয়াছিল।
সীতারামের দেহের এক পাশে জ্যোতিষী অনন্তহরি বসিয়া পড়িলেন, ঠিক তাঁহার সম্মুখেই অন্যপার্শ্বে বিহারীনাথ। লক্ষ্মীনারায়ণ এখনও দণ্ডায়মান, কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ, ঈষৎ অপ্রস্তুত। এই হেতু যে তাঁহার মনে সংশয় ছিল, নিরাশাও ছিল, উপরন্তু উদ্বেগে বিনিদ্র শরীর বেপথুমান, কোন উপায়ে যে আপনাকে সুসংযত করিবেন তাহার ঠিক-ঠিকানা পাইতেছিলেন না, একদা সীতারামের যুদ্ধ-তিরোহিত নৈষ্কৰ্ম্মসিদ্ধ মুখোনি দেখিলেন, অন্যবার ভৌতিক গীতা-পাঠকের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিতেই অহেতুক ত্রাসের সঞ্চার হইল।
এতদূর অগ্রসর হইয়া নিশ্চয়ই লক্ষ্মীনারায়ণ গীতা পাঠ শ্রবণে ত্রস্ত হন নাই, ইহার হেতু এই যে এইস্থানের একজনকে তিনি অবশ্যই এড়াইতে চাহিয়াছিলেন। তিনি বিহারীনাথ। বিহারীনাথ আয়ুৰ্বেদিক, বিহারীনাথ নাড়ীজ্ঞানী। প্রবৃদ্ধ সীতারামের নাড়ী ধরিয়া বসিয়া আছেন। প্রতিমুহূর্তের নিয়ত কর্মশীল জগত, একটি সূক্ষ্ম প্রতিউত্তরকে কায়মনোবাক্যে প্রত্যক্ষ করিতেছিলেন–এ-কৰ্মশীল জগতের যদিচ রূপ রস গন্ধ বর্ণ ইত্যাদি কোন অবস্থা নাই। ইহাদের আগমনে তাঁহার মনোযোগের কোন ব্যাঘাত ঘটে নাই।
এখন তিনি বিহারীনাথ মুখোনি তুলিতেই, বুঝা গেল তাঁহার চক্ষুৰ্ধয় আশ্চর্য স্ফীত, এবং সেই কালে লক্ষ্মীনারায়ণের প্রতি কঠোর তথা ঘৃণাভরে, আর জ্যোতিষী অনন্তহরির প্রতি শান্তভাবে দৃষ্টিপাত করিয়া মস্তক আন্দোলিত করেন; ইহা তিনি যেন একটি লোক-গল্প আরম্ভ করিবেন, তাহারই প্রস্তুতি; ইহার মধ্যে মীমাংসা ছিল, সিদ্ধান্তও বলবান।
বিহারীনাথ ইঙ্গিতে যে কথা স্বীকার করিলেন, তাহাতে জ্যোতিষীর দৈববুদ্ধি ও দূরদৃষ্টির চেতনা-মিলিত যে অস্তিত্ব, তাহা নিমেষেই অতিকায় হইয়া উঠিল, অন্তরে তাঁহার ঘনঘটা, বাহিরে গৰ্ব্বে, তাঁহার ব্রাহ্মণসুলভ চক্ষুর্ধয়, যাহা নক্ষত্রলোকের বিহার দর্শন করিয়াছে, উহা চকিতে ঝটিতি তড়িৎময় হইল। অনন্তর তাঁহার দক্ষিণ হস্তখানি উত্তোলিত হইয়া সদম্ভে সজোরে আঘাত করিতে গিয়াসহসা সীতারামের নাভির নিকট থামিয়া, ত্বরিতে সরিয়া খড়ের উপর পড়িল, ধর্ষিত খড় মসমস করিয়া উঠে। পরক্ষণেই, জয় উল্লাসে অথচ দৃঢ় ভারী সংযত স্বরে জ্যোতিষী কহিলেন, “জয় জগদম্বে বলুন কবিরাজ মশাই! বলুন, আমার গণনা ঠিক কি না? যথার্থ কি না!”
এ হেন প্রশ্নে নাড়ীজ্ঞানী বিহারীনাথ পুনৰ্ব্বার মাথা দোলাইয়া সম্মতি জানাইয়া, অতি সন্তর্পণে সীতারামের হাতখানি খড়ের উপরে রাখিলেন, এবং এই কাৰ্য্য করিতে তাঁহাকে কিঞ্চিৎ পিছনে সরিতে হয়। তদ্দর্শনে, এই সুযোগে লক্ষ্মীনারায়ণ সাহস সঞ্চয় করিয়া কোন মতে হাঁটু ভাঙ্গিয়া হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া পড়িলেন। বিহারীনাথ তাঁহাকে কঠিন ভাবে পলকের নিমিত্ত দেখিয়া, আপনকার ট্যাঁক হইতে নস্যের ডিবা বাহির করত কিঞ্চিৎ নস্য তালুতে ঢালিয়া, যুত করিয়া টিপ লইবার ছলে আপনাকে সংযতভাবে সামলাইয়া সশব্দে একটি টান দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার চক্ষু দিয়া খানিক জল নিঃসৃত হয় এবং এক নিমেষের আরাম উপভোগের পর কহিলেন, “আপনি যা বলেছিলেন তাই ঠিক।”
অনন্তহরি যারপরনাই আত্মহারা হইয়া বাঁকিয়া চুরিয়া একটি পায়ের উপর ভর দিয়া বসিলেন এবং খানিক, কি যেমন বা সীতারামের দেহের বিস্তৃতির মধ্যে খুঁজিবার কালে, হঠাৎ তাঁহার হস্তে সীতারামের এক সরল তেজোময় নিঃশ্বাস লাগিল, সন্ধ্যায় গৃহাভিমুখী রাখালেরা যে নিঃশ্বাস ফেলিয়া থাকে। তৎক্ষণাৎ মাতৃসুলভ চাহনিতে সীতারামকে দেখিয়া সহাস্য বদনে অবশেষে বিহারীনাথের কোলের নিকট যে হাতখানি সেইটি পলকে তুলিতে গিয়া ধীরতা অবলম্বনে আস্তে আস্তে মেলিয়া ধরিলেন।
বানরতুল্য টানা টানা দীর্ঘ সীতারামের বিশীর্ণ হাতখানির প্রতি সকলেই, দৃষ্টিক্ষম বলিয়াই, অন্যমনস্কতার সহিত লক্ষ্য করিয়াছিলেন। সেখানে সকালের রোদ একদা খরতর শ্বেত অন্যবার আঁধার, কেননা কীৰ্ত্তনের দল এখনও পরিক্রমণ করিতে ব্যর্থ, তাহারা নামগানে এখনও মুখর হাতখানি, চিরদিন নিদ্রালোককেই আহ্বান করিয়াছে, তাই ইহা বনবাসী তাপসচারীর হস্তের ন্যায় শুষ্ক, রসহীন। জ্যোতিষী। অনন্তহরি বৃদ্ধের হাতখানি লইয়া ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। অনেকবার ইহার উপর দিয়া ধূমরাশি খেলিয়া দুমড়াইয়া বক্র হইয়া ভয়াবহ কুহক সৃষ্টি করিয়া চলিয়া গেল, ইতিমধ্যে তিনি বার বার আপনার হাত দিয়া বিশীর্ণ করতল মুছিলেন, পরে গভীর রেখা সমন্বয়ের দিকে, মনে হয় যেমন, অর্থাৎ আপনারই পরিশ্রম কৃতকর্মের প্রতি স্ফীত চক্ষে অবলোকন করত দেহকে স্বেচ্ছায় কাঁপাইতে লাগিলেন, যাহাতে যেমন দেহের সৰ্ব্বত্রে ছড়াইয়া পড়িয়াছে তাহাকে পুনরায় একত্রিত করিতে পারেন। এ সময় বিশীর্ণ রোগা অতি বৃদ্ধ হাতখানি চমকাইতেছিল।
সম্ভবত একমাত্র লক্ষ্মীনারায়ণই এহেন-হাতখানির আদলে, চিতাধূমের মধ্যেও যাহা পরিচ্ছন্ন, যাহা এখন শ্বেত তখন ছায়া আবৃত, পরিব্যাপ্ত প্রকৃতির হর্ষ দেখিয়াছিলেন। তাঁহার মানসচক্ষে ক্রমে উদ্ভাসিত হইয়াছিল নামহীন পক্ষীর বক্ষদেশের উপর দিয়া, আপন ঐশ্বৰ্য্যরাশি ও বিলাসসামগ্রী লইয়া, দ্বিপ্রহরের নীল লবণসমুদ্র পার হইয়া যাইতেছে; দেখিয়াছিলেন, প্রকৃতি আপনার বিন্দুবৎ শরীর লইয়া স্বহস্তের ডম্বরু বাজাইতে বাজাইতে স্থবির পুরুষকে কেন্দ্র করিয়া নৃত্যময় পদবিক্ষেপে ভ্রমণশীলা। মানুষ বালকমাত্র, একথা মনে হয় নাই। একমাত্র তিনি, লক্ষ্মীনারায়ণ গঙ্গাতীরে আনীত সীতারামের প্রাণবায়ু নির্গমনের কালবিলম্ব-সমাচারে চোরা আনন্দের গুরুভার বহন করিতেছিলেন।
২. তীব্র কলহের অসভ্য ভয়ঙ্কর শব্দ
এমত কালে তীব্র কলহের অসভ্য ভয়ঙ্কর শব্দে সকলেই শশব্যস্তে, ব্যগ্রতা সহকারে মন ফিরাইলেন। এমনকি কীৰ্ত্তন সম্প্রদায়ের প্রত্যেকেরই চক্ষু তির্যকভাবে পড়িয়া যাইতে চাহিল। দুই ভাই, বলরাম এবং হরেরাম, প্রখর হইয়া উঠিয়াছে, ক্ষুরধার বচসায় দুইজনে ক্ষিপ্ত, শির সঞ্চালনে দুইজনেই অকাতর।
হরেরাম তখন বলিতেছিল, “তুমি ওখানে বসতে পাবে না।”
“কেন পাব না শুনি…ওঃ ওনার কথায়…”
“না পাবে না…ভাব আমি ঘাস খাই…বুঝি না…না?”
“বলি বোঝাটা কি শুনি…মাঢ়ভেতো বুদ্ধি…”
“খবরদার বলছি…চোর কোথাকার!”
“এই মুখ সামলে…না হলে আমি খড়ম পেটা…”
হরেরামের উত্তর করিবার পূর্বেই বিহারীনাথ রাশভারী কণ্ঠে ধমক দিয়া উঠিলেন। “ছিঃ ছিঃ তোমরা কি মানুষ না পশু? লোকটা এখন-তখন, ছিঃ ছিঃ তোমাদের কি কোন ধম্মজ্ঞান নেই।”
দুইজনেই ধমক খাইয়া বাক্য ত্যাগ করিলেও, অস্পষ্ট ক্রোধবাচক শব্দ তখনও করিতেছিল।
“ছিঃ ছিঃ! তোমরা…”
“ও-ই ত শুরু করলে…দেখুন না সেই কখন থেকে বাবা আমার কোলে মাথা দিয়ে আছেন, তাতে আমার পা অবশ হয়ে গেছে, তাই সাড় ফিরাবার জন্য একটু আঙুল মটকাচ্ছি…অমনি…”
“আঙুল মটকাবার জন্য বাবার পিঠের তলায় তোমার হাত চাবি খুঁজছিল…”
“হরে হরে আমি পৈতে ছিঁড়ে তোমায় অভিশাপ…”
“আবার বলরাম…” বিহারীনাথ দৃঢ়ভাবে কহিলেন।
বচসা থামিল। জ্যোতিষী পুনরায় বৃদ্ধের হাতের প্রতি মনঃসংযোগ করত ধীরে ধীরে বলিলেন, “কর-কোষ্ঠীর কথা আর এক, তবু এখানেও দেখুন…কোন…”
বিহারীনাথ বৃদ্ধের হাতের দিকে শিশুসুলভ মনে দেখিতেছিলেন। এই সময় জ্যোতিষী, বৃদ্ধের দেহের উপর দিয়া, শরীরকে বাঁকাইয়া কবিরাজের কানে কানে কহিলেন, “আর একটা কথা বলি, বুড়ো সীতারাম একা যাবে না,…সৰ্বস্ব পণ করতে রাজী, কবিরাজ মশাই–সীতারাম দোসর নিয়ে যাবেই.” বলিয়া যেক্ষণে বৃদ্ধের দেহ হইতে আপনকার দেহ সরাইয়া লইলেন, তৎক্ষণাৎ সকলেই বৃদ্ধের বক্ষে, যেখানে কতিপয় রোমরাজি–সেখানে এক অলৌকিক বিস্ময়কর দৃশ্যে হতবাক আশ্চর্য্য হইলেন।
সেইখানে এক নয়নাভিরাম, বাবু, সুন্দর প্রজাপতি চুপ হইয়াছিল; সকালের রোদ এবং রোদের অভাবে যাহার মনোহারিত্ব একই। এ জীব যেমন বা সোহাগের আরশিতুল্য, ফলে সকলেরই আসক্তির পরিসীমা ছিল না। সকলেই এই সৌন্দৰ্য্য দর্শনে অভিভূতের ন্যায় ‘আঃ বিস্ময়বাচক শব্দ করিয়াছিল সকলেরই মুখ এখনও অৰ্দ্ধ উন্মুক্ত!
লক্ষ্মীনারায়ণ এই বিভূতি দর্শনে স্তম্ভিত হইলেও একমাত্র তিনিই বলিয়া উঠিয়াছিলেন “প্রজাপতি প্রজাপতি” এবং তাঁহার চোখে জল দেখা দিল।
এখনও সকলেই মোহগ্রস্ত, শুধু বৈজুনাথ কীৰ্ত্তনের দলের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মারিয়া এই দৃশ্যটি দেখিবার চেষ্টা করিতেছিল।
এ-পতঙ্গ যে পতঙ্গ সৃষ্টির সাক্ষাৎ পরমায়ু, অক্ষর এবং রঙের মধ্যবর্ত্তী বাসনা, দুঃখীর মনচোরা ভ্রম স্বাধীনতা!
.
জ্যোতিষী অনন্তহরি ভূতাবিষ্টের মত কহিলেন, “কি(ম) আশ্চর্য! প্রজাপতি সিন্দুর।” এই দৃশ্যের সহিত তাঁহার দৃষ্টি যেমন বা জুড়িয়া গিয়াছিল, কোন ক্রমে সে-জীব হইতে দৃষ্টি ছাড়াইয়া আনিয়া কবিরাজের দিকে তাকাইলেন, বুঝা গেল তিনি অনন্তহরি, অতিশয় আহ্লাদিত হইয়াছেন। আধো আধো স্বরে, “প্রজাপতি, দোসর…দোসর নিবে” অন্যমনস্কভাবে বলিয়াছিলেন।
কবিরাজ এই যুক্তিহীন দৈব-ঘটনাকে প্রীতির চক্ষে না দেখিলেও, এ মহা আশ্চর্যে তিনি সত্যই হতবাক হইয়াছিলেন। সুন্দর তুচ্ছ পতঙ্গটি এরূপ ভয়ঙ্কর খেলা খেলিবে তাহা তাঁহার জানা ছিল না।
অনেকক্ষণ ধরিয়া সকলেই পতঙ্গটি দেখিল, এখনও যাহা স্পন্দনরহিত নির্বিকার। এ কথা নিমেষেই সকলে বুঝিল যে ইহা কোন সৌভাগ্যবতীর বারতা বহন করিয়া আনিয়াছে, জীবনই যাহার জীবিকা, উপাধান যাহার মনের কথার শ্রোতা, লতা পাতা কীট পতঙ্গ যাহার আপনজন, আপনার প্রতি বিতৃষ্ণাই যাহার কর্তব্য; যে বালিকা নিজহাতে শিব গড়িয়া ভক্তিভরে তাহার পূজা করিয়াছে, প্রণাম করিয়াছে। সেই মৃত্তিকা স্তম্ভে (!) আপনকার সুখমোক্ষ দাতাকে প্রত্যক্ষ করত আপনার জীবনে চন্দ্রালোক আনিয়াছে। সিন্দুরকে অক্ষয় করিবার মানসে কায়মনোবাক্যে দেহকে শুদ্ধ এবং মনকে সুন্দর রাখিয়াছে। এই কল্পনা লইয়া যে নিদ্রাচ্ছন্ন এই প্রজাপতি বুঝি তাহার সংবাদ আনিল!
এতক্ষণ পরে প্রজাপতি উড়িল, কীৰ্ত্তনের দল পথ ছাড়িল। ক্রমে ঊর্ধে আরও উর্ধে, নামিল, চলিল! এখন বৈজুনাথের দিকে পতঙ্গটি যাইতেই বৈজুনাথ বোকার মত সরিয়া গেল। এবং এই সময় শুনিল কে যেন হাঁকিতেছে, “আঃ মরণ, গোখোর বেটা…তোর গায়ে যেন না লাগে…”
বৈজুনাথ আর এক-পা ভূতচালিতের মত পিছু হটিতে গিয়া বেসামাল হইল।
কিন্তু লক্ষ্মীনারায়ণ এখনও প্রজাপতিটি লক্ষ্য করিতেছিলেন এবং অনবরত বৈজুনাথকে সরিতে বলিতেছিলেন, কারণ তাহার অঙ্গ যদি স্পর্শ করে তাহা হইলে তাহা অমঙ্গলসূচক হইবে।
কিন্তু হায়, প্রজাপতি শ্মশানে বিভ্রান্ত হইয়াছিল। তাহাকে চিতাধূমের মধ্যে দেখা গেল, অনন্তর। তাহাকে চিতার প্রায় নিকটে দেখা গেল এবং কালক্রমে সে যেন বিমোহিত হইল, রঙ হারাইল, চিতার শিখার রেখার মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেল। ধূম অধিকমাত্রায় নির্গতবান, ইদানীং পতঙ্গ অপ্রকট–শেষ অশ্রুজল যদি সে পতঙ্গের, বাষ্প হইয়া দূর ঊর্ধ্বে, ক্রমে শিশুর চাপল্যরীতি-মেঘকায়ানবজলধরে পরিণত, পুনশ্চ বিদ্যুল্লতায় তাহার নশ্বরতা দেখা দিবে এবং মরলোকের প্রেম সে বিভায় উদ্ভাসিত হইবে, রমণীর সৌন্দৰ্য্য ষটচক্র বাহিয়া পদ্মে মতিত্ব দিবে, আর যে আমরা স্থির হইব।
প্রজাপতি ফাঁকি দিয়াছিল। গোচরীভূত সম্বন্ধে সম্পর্কে চক্ষু হাইয়া গিয়াছে মাত্র, অনেকক্ষণ পরে লক্ষ্মীনারায়ণ এবং অন্যান্য সকলেই জমিয়া উঠা রুদ্ধশ্বাস পরিত্যাগ করিলেন। বৈজুনাথের তীব্র অথচ হতাশ স্বরে সকলেই ইহকাল ফিরিয়া পাইয়াছেন, সে বলিয়াছিল, “হায় গো, গেল গো ছাই হঁইয়ে, বীজ রাখলেন না হে–এ বড় অবাক কথা।”
মন পুনৰ্ব্বার শিরা-উপশিরায় তৎপর হইয়া উঠিল–তখনও স্তব্ধতা ছিল।
বিহারীনাথ আপনাকে সর্বপ্রথম, বিবেচনার মধ্যে পাইলেন; কিঞ্চিৎ চিন্তা করিয়া কহিলেন, “তাহলে জ্যোতিষী, দোসর তো নেবেই” এই বাক্যে নিঃশ্বাসের আওয়াজ ছিল, ইহার পর যোগ দিলেন, “তাহলে আর কি, তাহলে, মহাব্যোম বড় ‘একা’ জায়গা, অবশ্য প্রকৃতি সেখানেও আছে, দোসর দেখলে চিনে নেবে সীতারাম…বৈকুণ্ঠ বাস হবে।”
সকলেই বিহারীনাথের কথা বুঝিবার ভাণ করিলেন মাত্র। বিহারীনাথ তাহা বুঝিতে পারিলেন না, তিনি নিজের মনোভাবকে আরও রূঢ় করিয়া বলিলেন, “সাতশ’ মন কাঠ যোগাড় কর, সাত বেড়া পেরোতে হবে ত…” অতঃপর সঞ্চিত উষ্ময় দাঁতে দাঁত ঘষিতে লাগিলেন, এই যন্ত্রণাদায়ক বিরক্তিকর শব্দ সকলকেই বিশ্রী করিয়া তুলিয়াছিল।
তটপ্রপাতে তীরবাসীরা যেমত আতঙ্কিত হয়, উৎসাহী ব্যক্তিরাও তেমনি হইয়াছিলেন। একে অন্যের মুখপানে তাকাইয়া পরে অন্যমনা। অনন্তহরি একস্থ, খুব ধীরে আপনার ওষ্ঠের একান্ত ফাঁক করিয়া, একটি ভ্র উঁচু করত কহিলেন, “কবিরাজ মশাই, আপনার নাতির শ্বশুরের কোন এক আত্মীয় ফিরিঙ্গী ভাষা জানে তাই আপনি…” ইহার পর কণ্ঠস্বর আরও দৃঢ় করিয়া বলিলেন, “এ ব্যবস্থা আজকার নয়, মাদ্রীকে মনে পড়ে…”
এই শ্লেষে বিহারীনাথ চকিতেই মুখ ফিরাইয়া জ্যোতিষীর প্রতি কঠিনভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। জ্যোতিষীর ঠোঁটে কুঞ্চিত-হাসির রেশ ছিল, তাঁহার প্রতিপক্ষ যে সঙ্কটাপন্ন তাহা বুঝিয়া লইতে তাঁহার বিলম্ব হয় নাই, এবং তিনি সদম্ভে ঘোষণা করিলেন, “দোসর সীতারাম নেবেই, এ কথা ধ্রুবসত্য, মঙ্গল রাহু বৃহস্পতি ঘর…”
বিহারীনাথ আপনার ক্রোধ শান্ত করিতে সমর্থ হন নাই। বিবাহের প্রস্তাবে এতাবৎ একমাত্র তিনিই বাধা দিয়া আসিয়াছেন, এখন তাঁহার পরাজয় অবধারিত বুঝিয়া তাচ্ছিল্যভরে কহিলেন, “অবশ্যম্ভাবী…”
“শিবের কলম…”
“শিবের কলম, আপনারা দেখছেন সীতারামের কৰ্ম্মপাশ ক্ষয় হয়ে এসেছে…”
“ছিঃ ছিঃ কবিরাজ মশাই, সীতারামবাবুর জ্ঞান ফিরে এসেছে…সে শুনতে…” লক্ষ্মীনারায়ণ কোন রকমে বলিয়া ফেলিলেন।
“আঃ সত্য কথা ত…”
“বুঝলাম, বুঝলাম কবিরাজ মশাই, কিন্তু আমি কি মহাপাতক হব! আপনিও ত বর্ণশ্রেষ্ঠ, আপনিও কন্যার পিতা”–লক্ষ্মীনারায়ণ এই পর্যন্ত বলিয়া সাধু ভাষা খুঁজিতে লাগিলেন।
“আপনি এখানে সম্প্রদান করিলেই কি…” বিহারীনাথ বলিতে ছিলেন।
“স্বর্গ না লাভ হোক, জাতি কুলমান রক্ষা পাবে নিশ্চিত…এতে কোন সংশয় নেই”–অনন্তহরি কাতর লক্ষ্মীনারায়ণের হইয়া, কবিরাজকে বাধাদান করিলেন এবং পুনৰ্ব্বার কহিলেন, “দেশে বিদেশে পাত্র যদি লক্ষ্মীনারায়ণ খুড়ো পেত, সহৃদয় কাউকে পেত, নিশ্চয় এখানে আসত না। তারপর বিধির লিখন এমন কি স্ত্রীলোকেও জানে জন্ম মৃত্যু বিবাহ…”।
বিহারীনাথ সবই জানিতেন। সীতারামের প্রৌঢ় পুত্রদ্বয়ও পর্য্যন্ত বিবাহ করিতে স্বীকৃত হয় নাই! কেহই হয় নাই, সকলেই প্রয়োজন বুঝিয়াই বিবাহ করিবে। তথাপি কবিরাজ বলিয়া মানুষের প্রতি সংস্কার ছিল, আপনার ভিতরে কে যেমন বা আস্ফালন ব্যস্ত, তিনি আরম্ভ করিলেন, “আপনি জ্যোতিষী, তবু বুঝুন যে লোকের অহোরাত্র পার হয় কিনা…”
“অহোরাত্র নয়, চাঁদে যখন লাল পূর্ণিমা, সীতারাম পুণ্যবান, যাবার সময়েও সে মানরক্ষা করে যাবে” বলিয়া জ্যোতিষী অতি শ্রদ্ধাভরে সীতারামের মুখের দিকে লক্ষ্য করিলেন।
“কিন্তু সত্য কি কন্যার বৈধব্য-যোগ, আছে? না…” বিহারীনাথ দস্তাঘাত করিবার প্রয়াস পাইলেন।
অনন্তহরি তাঁহাকে তুচ্ছ করিয়া কহিলেন, “আগেই ত বলেছি দোসর…”
“বাঃ তাহলেই সব চুকে গেল!” পরাজিত বিহারীনাথ অদ্ভুত বিকৃত স্বরে এই কথা বলিলেন, তাঁহার মনোবৃত্তি ক্ষুণ্ণ, ক্ষুব্ধ, লজ্জিত, অপমানিত, বিপন্ন হইয়াছিল। তাঁহার রোমরাজি কণ্টকিত এবং স্বভাব নষ্টপ্রায়!
লক্ষ্মীনারায়ণ বিক্ষুব্ধ; পুত্রদ্বয় এবং কৃষ্ণপ্রাণ–ইহাদের ক্ষণকালের জন্য স্পষ্ট করিয়া দেখিয়া লইলেন। অনন্তহরির পদতলগত খড়গুলি এক প্রকার শব্দ করিয়া উঠিল, তাঁহার ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটিয়াছিল, ক্রোধান্ধ বিড়ালের মতই সাপাট ছাড়িয়া কহিলেন, “বলি আপনি ত জ্ঞানী সাজছেন, কেন, আপনারা বংশপরম্পরা ওষুধ এত্যাদি দেন না…”
“দেব না কেন, না দিলে ঘর দোর জ্বালাবে বলে…”
“বটে, ঘর রাখতে আপনি যেমন উপায়হীন তেমনি…লক্ষ্মীনারায়ণ আপনার ধৰ্ম্ম…আপনার সঙ্গে বাক্য নিষ্প্রয়োজন; এক্ষেত্রে ওঁদের কুলপুরোহিত, পুত্ররা বর্তমান…অমত নেই…ব্রাহ্মণের ধর্ম্ম রক্ষা করতে ব্রাহ্মণই আছে…”।
কৃষ্ণপ্রাণ কহিলেন, “অনন্তহরি, সীতারামের যখন জ্ঞান এসেছে, আৰ্ত্ত নয়, তখন তার একটা মত নেওয়া প্রয়োজন।”
ইতিমধ্যে রিক্ত-মেদ কুঞ্চিত হাতখানি ক্রমে ক্রমে অপগত হয়, তথা সীতারাম আপনার হাতখানি অপসারণ করিল, বিষাক্ত সর্পের ল্যাজ যেমন গহ্বরে অদৃশ্য; তদ্দর্শনে নিকটস্থ মানুষেরা নিশ্চিত হইয়াছিল, শুধুমাত্র লক্ষ্মীনারায়ণ ভীত।
সীতারাম প্রমাণ করিলেন, তাঁহার জ্ঞান আসিয়াছে এবং কৃষ্ণপ্রাণ দৃঢ়স্বরে বলিলেন, “জ্ঞান ফিরে এসেছে।”
‘জ্ঞান এসেছে’ উক্তিতে জলে নোঙ্গর নিক্ষেপ করার আওয়াজ ছিল, অনন্তহরি ইত্যাদির মধ্যে এক অপরিজ্ঞাত ভাবান্তর হয়–ক্রমাগতই কাহারা জপ করিতেছে, কাহারও মধ্যে শেষোক্ত চন্দ্রকলা পুনরায় দৃশ্যমান, কাহারও সম্মুখে জোনাকী খেলিতে লাগিল, কাহারও মধ্যে বর্ণচ্ছটা আলোড়িত হইল, কোথাও বিন্দু স্ফীত হইতে চাহিল!
সকলেই কিছুক্ষণ এইভাবে অতিবাহিত করিবার পর, সত্বর বৃদ্ধকে স্পর্শ করিবার জন্য আগ্রহান্বিত হইলেন। কেহ বা আপন আপন ইষ্টনাম জপ করিতে লাগিলেন, আরও মনে হয় কেহ বা নিদ্রাকে হস্ত দ্বারা স্পর্শ করিলেন।
জ্ঞান আসিল। বৃদ্ধের পুনরায় ‘আমি’ বলিবার ক্ষমতা আসিল। পৃথিবীর চক্রবৎ পরিবর্তনের শব্দ শ্রুত হইল।
বৃদ্ধের দৈহিক জ্ঞান বিষয়ে অনন্তহরি অত্যধিক আস্থাবান; লক্ষ্মীনারায়ণ অনবরত দুর্গা নামে ব্যস্ত, তৎসহ তাঁহার করজোড় কভু বক্ষস্থলে ক্কচিৎ কপালের আজ্ঞাচক্রে আবেগে উত্তেজনায় উঠানামা করিতে লাগিল। তাঁহার দেহের অনিশ্চয়ত্মক দ্বন্দ্ব তাঁহার নিঃশ্বাসে এখন যন্ত্র আঁকিয়া বীজমন্ত্র লিখিতেছিল।
জ্যোতিষীর হাতের মধ্য হইতে সীতারাম আপনার হাতটি সরাইয়া লইয়াছিলেন। তাঁহার চোখের পাতা দুই চারিবার উঠাপড়া করিয়া প্রমাণ করিল যে জ্ঞানলাভ হইতেছে। কবিরাজ তাঁহার বক্ষের কাছে মাথা রাখিয়া বুঝিলেন, পৃথিবীর জন্য আবার হৃদয় স্পন্দিত হইতেছে। এবং তিনি মাথা উঠাইতেই কুলপুরোহিত কৃষ্ণপ্রাণ সীতারামের কান হইতে তুলা খুলিয়া বলিলেন, “সীতারাম…”
সীতারাম তাঁহার দিকে চাহিলেন।
“তোমার বিয়ে…”
সীতারাম নির্বাক।
“তোমার বিয়ে, তুমি রাজী…”
দ্বিতীয় প্রশ্নে মনে হয় কৃষ্ণপ্রাণের কথা বুঝিয়া লইবার ইচ্ছা থাকিলেও এখনও, একাধারে কীৰ্ত্তন ও ব্যাখ্যার জন্য সীতারাম সঠিকভাবে শুনিতে পান নাই; কাতর মুখোনি কোনরূপে ঈষৎ নাড়িলেন; কৃষ্ণপ্রাণ তাহাতে যেন বুঝিতে পারিলেন, এবং সেই সঙ্গেই কীৰ্ত্তনকারী ও গীতাপাঠকারীকে থামিতে কহিলেন। তাহারা থামিল। পুনৰ্ব্বার তিনি সীতারামের কর্ণকুহরে বলিবার জন্য গলা পরিষ্কার করিয়া কহিলেন, “সীতারাম, ব্রাহ্মণের কন্যাদায়, তুমি তাকে আমাদের ইচ্ছা, বিয়ে করে, ব্রাহ্মণকে বাঁচাও…তুমি রাজী…”
অধুনা শায়িত সীতারামের মুখে কীৰ্ত্তন থামার দরুণ সকালের আলো পড়িয়াছিল; তিনি–টিয়াপাখী আপনার নাম শুনিলে যেমত মাথা ঘুরায়–তেমনি, মাথা ঘুরাইতে লাগিলেন, এমন মনে হয় উপস্থিত সকলকে যেন ঠিক দিয়া লইলেন, এবং ইহার পর উর্দ্ধ আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়াছিলেন। সীতারাম চাটুজ্জ্যের ইত্যাকার ভাব দেখিয়া কৃষ্ণপ্রাণ কাতরভাবে মাথা দুলাইয়া বলিলেন, “সম্ভবত রাজী নয়…”
এই কথায় লক্ষ্মীনারায়ণ কাঁদ কাঁদ হইয়া কহিলেন, “আর একবার…”
“রাজী হতেই হবে! না হলে সাবালক দুই পুত্র বর্তমান, তারাই মত দেবে…আমার গণনা মিথ্যে হতে পারে না…” অনন্তহরি মহা দর্পে বলিলেন।
“নাড়ী ফিরলেই যে সকল জ্ঞান থাকবে এমন নয়, মাঝে মাঝে লুপ্ত হবেই…” কবিরাজ মন্তব্য করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন, এবং ঘৃণায় বলিলেন, “অনেক পাপ ত করেছি, এটা নয় নাই করলাম…আমি যাচ্ছি, তবু বলি বাঁড়ুজ্জ্যে মশাই, আমার কাছে অনেক বিষ আছে…তার একটু আপনি…”
লক্ষ্মীনারায়ণ নিজের কানে আঙ্গুল দিয়া কহিলেন, “ছিঃ ছিঃ আপনি কি ব্রাহ্মণ!”
কবিরাজ আর অপেক্ষা করিলেন না।
“ঠাকুর মশাই আপনি বলুন” জ্যোতিষী অনুরোধ করিলেন।
“সীতারাম, ব্রাহ্মণের কন্যাদায়, বিয়ে করবে? রাজী…”
এই কথায় সীতারামের নাসিকাগহ্বর দিয়া জল আসিল। ধীরে ধীরে শীতকম্পিত হাতখানি মুখমণ্ডলে বুলাইয়া কোনমতে বলিলেন, “দাড়ি…” দন্তহীন, মাড়ি দেখা গেল; বাক্যের শব্দের পরিবর্তে হাওয়াই বেশী করিয়া শোনা গেল।
‘খেউরি হইব’ কথাটি বলিতে হইল না, সকলেই বুঝিয়া লইল।
লক্ষ্মীনারায়ণ বোকার মত হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, তাঁহার শরীর কিছুটা বাঁকিয়া নীচু হইয়াছিল, তাঁহার মুখের ঠিক নিম্নস্থান দিয়া অনুচ্চ হাসির স্রোত চলাফেরা করিতেছিল, এবং ইহার সহিত জ্যোতিষীর সরস মন্তব্য, “কবিরাজ বলে নাকি জ্ঞান নেই? না না জ্ঞান মাঝে মাঝে লুপ্ত হবে! এই জ্ঞানটুকুই যথেষ্ট…ব্রাহ্মণ বাঁচলো…যাও দাঁড়িয়ে কেন, লক্ষ্মীনারায়ণ, যাও মেয়ে আন।”
“এ্যাঁ”…
“হ্যাঁ হ্যাঁ…”
লক্ষ্মীনারায়ণ যে কি করিবেন তাহা ঠিক পাইলেন না। মাটি দেখিলেন, আকাশ দেখিলেন, পৈতা দেখিলেন, তাহার পর অদূরে গঙ্গা, পাগলের মতই দৌড়াইয়া গিয়া, “মাগো মা মা, এতদিন বাদে দয়া করিলে মা” বলিয়া হাত দিয়া জল মাথায় দিতে গিয়া, হঠাৎ গঙ্গায় নামিয়া অনবরত ডুব দিতে লাগিলেন। তাহার কিয়ৎক্ষণ পরেই উঠিয়া আসিয়া, জলসিক্ত বসনে, রুদ্ধকণ্ঠে প্রশ্ন করিবেন বলিয়া মুখ খুলিলেন, কিন্তু ওষ্ঠদ্বয় বাঁকিল কিন্তু শব্দ বাহির হইল না। এমত সময় ইষ্টদেবতা স্মরণ নিমিত্ত হাতখানি বক্ষের নিকটে স্থাপিত ছিল।
“কি, এই শ্মশানঘাটে স্নান করলে? মাথা খারাপ না কি?কি বল…?”
“হবে ত…” লক্ষ্মীনারায়ণের তখনও প্রত্যয় হয় নাই।
“সীতারাম নিজে রাজী, আবার…! কিন্তু হ্যাঁ, একটা কথা কি জান তোমায় বলে রাখা ভাল, এখনি কথা হচ্ছিল, কি হে বলরাম…কি বল আগের কালের মত ধৰ্ম্ম সত্যরক্ষা একালে নেই, বিয়ের পর তোমার যদি…”
“দেখবেন ঠাকুর মশাই, আমার মেয়ে তেমন…”
“তা নয়, কোম্পানীর রাজত্ব, ঘোর কলি, সহমরণে যে পুণ্য আছে একথা কেউ বিশ্বাস করে কি…যাই হোক…যদি না হয় তোমাকে নিতে হবে…শেষে স্ত্রী বলে একটা মামলা রুজু করে দিলে, এরা বলছে। ব্রাহ্মণের দায় উদ্ধার করতে গিয়ে…”।
“আপনি আমায় তামা তুলসী দিন, গঙ্গা আছেন, আমি…” লক্ষ্মীনারায়ণের সখেদ উক্তি শোনা গেল।
দূর হইতে কবিরাজের কণ্ঠ আসিল, “আর প্রয়োজন নেই, অল্প বয়সী বিধবার ভার কোন বাপ নেয়, আমি বুঝি না।” নিম্নকণ্ঠে মনে হয় বৈজুকে কহিলেন, “একবেলা খাওয়া উপোস, চুল কপচে দেবে, তবু সন্দেহ ঘোচে না…ইস, কিছু করবার যো নেই…”
“ঠাকুর মশায় বারুণ কর তুমি”–বৈজুনাথ অনুরোধ করিয়াছিল।
“বারুণ কে শুনবে? কৃষ্ণপ্রাণ, জ্যোতিষী অনন্ত এদের ত লাভ–সতীদাহ যখন হয় তখন।”
“হাঁ হাঁ জানি জানি, বলবে সোনা ছাড়া স্বগ্যে কিছু যাবে না, ওগো সোনা দাও, অক্ষয় স্বগ্য বাস…সোনা…আমায় বলবে, তুই শালা চাঁড়াল, বামুন কায়েতের সতী, এর ছায়া মাড়াবি না…তারপর চিতা লিভিয়ে সোনা খুঁজবে, আমায় বলবে বেশী গর্ত কর।”
“তা কেন বলবে না, যদি থানাদার…”
“কি হত? সে শালা ঘুষ লিত…”
একথায় বিহারীনাথ অন্যমনস্ক হইয়াছিলেন।
বৈজু মহাআক্রোশে বলিল, “একটু উঁচুজাত না হলে শালা আমি লাঠি ঘুরাতাম…”
“চুপ চুপ…”
“না, বড় প্রাণে লাগে, তোমরা ভাব আমি চাঁড়াল–মড়া দেখতে আমার বেজার নাই, সত্য, কিন্তু কেউ মরছে দেখলে বেজার লাগবে না…” থামিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “আমি চিতা সাজাব, সব পাপ আমার লাগবে, সেই পাপে বউটাকে কুমীরে নিয়ে গেল…”
কবিরাজ উঠিয়া কাহারও কাছে বিদায় গ্রহণ না করিয়া চলিয়া গেলেন–বৈজুও উঠিয়া মাটিতে একটি লাথি মারিল, তাহার পর বলিল, “কি ঠাকুর, কি হল…?”
লক্ষ্মীনারায়ণ যাইতে যাইতে বলিলেন, “হয়েছে, তোকে পেট ভরে খাওয়াব।”
“খাওয়া ছাড়া আমার কি আছে ঠাকুর!”
বেলা এখন প্রায় শেষ! একটি চিতার কোণে প্রজ্বলিত কাঠের উপরে হাঁড়ি টগবগ করিয়া ফুটিতেছে, এক একটি সুসিদ্ধ চাল লাফাইয়া উঠে; বৈজু ‘এ দেহ তরণী ডুবে যাবে’ গাহিতে গাহিতে একটি কঞ্চি দিয়া ভাত তুলিয়া দেখিবার সময় কান খাড়া করিল। কপাল কুঞ্চিত করিয়া কি যেমন একাগ্র মনে শুনিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
দূরাগত শব্দ আসিতেছে, সম্মুখে স্রোতময়ী গঙ্গার কল্লোল, পাতায় পাতায় হাওয়ার চপলতা সেশব্দকে ক্রমাগত বাধা দিতেছিল; বৈজু একান্তে ভাতের কাঠি রাখিয়া, অল্প শতচ্ছিন্ন চ্যাগড়া কুড়াইয়া হাঁড়ি ধরিয়া ফেন গালিতে লাগিল। এতাবৎ দূরাগত শব্দ এক্ষণে কিঞ্চিৎ স্পষ্ট রূপধারণ করিল, শোনামাত্রই বিরক্তি-উৎপাদনকারী ক্রমান্বয় দেশাড়ী সানাইয়ের আওয়াজ ঢাক ভেদ করিয়া ট্যাঁ ট্যাঁ করিয়া উঠিতেছে, আর ট্যাং ট্যাং করিয়া কাঁসির বজ্জাতি; বৈজু আর স্থির থাকিতে পারিল না। কোনমতে হড়মড় করিয়া ফেন গালাইয়া, আড়ায় রাখিয়া পরক্ষণেই দৌড়াইয়া গিয়া উচ্চ ভেড়ীর উপর উঠিল।
সম্মুখের দূরান্ত নিখোঁজ পৃথিবী দেখিতে গিয়া তাহার অসম্ভব ঘোর লাগিল। হয়ত মনে হইয়া থাকিবে এখন সন্ধ্যা হইলে ভাল হইত। অবিশ্রান্ত দূরত্বকে সম্ভবত বুঝিয়া লইবার কারণেই আপনার ছোট সীমাকে একদা দেখিয়া লইল, যাহার নিম্নে হিম জলরেখা, অজস্র প্রতিবিম্ব-সম্ভবা। এভাবে দেখা তাহাকে কোন দিব্য-সাহস দেয় নাই–শুধু তাহার বর্তমানতা, বাস্তব, সাধারণভাবে অস্তিত্বকে স্পষ্ট করে।
বহুদুরে ধান্যক্ষেতের মধ্য দিয়া ক্ষুদ্র একটি শোভাযাত্রা আসিতেছে। বৈজুনাথ বুঝিল যে ইহা কোন নিম্নজাতির শব নহে। স্পষ্টত দেখিল মধ্যবর্ত্তী ডুলির লাল কাপড়, তাহার এক এক প্রান্তে হেমন্তের হাওয়া উড়িতেছে। সম্মুখে সানাই বাদক, কখনও বা কাঁসিবাদক আলের উপর দিয়া গমনে টাল সামলাইতে না পারিয়া ধান ক্ষেতে নামিয়া পড়িতেছে; যদিচ শরৎ চলিয়া গিয়াছে তথাপি ধান নুইয়া। পড়ে নাই–বৈজু এক দৃষ্টিতে দেখিতে দেখিতে, হায় গো’ বলিয়া আপনকার গালে দুইহাত দিয়া চপেটাঘাত করিতে লাগিল। “হায় গো বাবা পঞ্চমুণ্ডি লেমিনাথ, তোমার লৈবিদ্য, দোসর বুঝি।”
কে একজন ঘাট হইতে ডাকিল, “হেই বৈজু চাঁড়াল, ঢাকের বাদ্দি শুনলে চলবে? এদিকে মড়া পড়ে।কোথায় হে?”
এ হেন ডাক অধুনা হাওয়া সংখ্যার মত ভাস্বর, ক্রমে ক্রমে বৈজু শুনিয়াছিল এবং এই প্রথম, হয়ত বা, সে আপনকার পিছনে যাইতে সক্ষম হইয়াছিল। যেখানে সে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ লাভ করিয়াও অপটু। যেখানে সে ক্রন্দনে সৰ্বরূপে দক্ষ, কেননা তাহাই উহার একমাত্র ভগবদ্দত্ত ক্ষমতা। আপনার নগ্নতা যেখানে সূর্যের আলঙ্কারিক বিচিত্রতা, আর একটা দিক।
কিয়ৎক্ষণ ধান্যক্ষেত্রের প্রতি তাকাইয়া সহসা হঠাৎ বৈজু ভেড়ী পথ হইতে ভয়ঙ্কর ভাবে চীৎকার করিল, “ওগো তোমাদের পুণ্যাত্মা বুড়ার ক’নে আসছে”, এদিকে শ্মশান যাত্রীদের বলিল, “বস গো বস, এনেছ তো মড়া, কাঠ তো এলো না এখনও, কত ধূম হবে, কত লাচনা গাওনা হবে, দেখবে না?” ইহার পরে সুরে গাহিল,
“তুমি আমার বাবার ঠাকুর,
টোপর মাথায় দিয়ে এলে,
বুড়ী হয়ে বসে থাক প্রাণ,
মাঝে মাঝে এসে ছোঁব–
তুমি আমার বাবার ঠাকুর”
ভেড়ীর উপরেই বৈজুনাথ নৃত্যের ভঙ্গী দেখাইয়া তেহাই দিল। বৃদ্ধ ব্যতীত সকলেই তাহার এই অসভ্য গান শুনিল, হরেরাম হাসিতে গিয়া গম্ভীর।
শ্মশান্যাত্রী দলের অযোগবাহশব্দ স্পষ্ট আপ্লুত স্বর স্বাভাবিক হইয়াছিল। শবের পাটছোঁয়া লোকটি বলিল, “সে কি গো, বউ? বিয়ের কনে!” এবং পরক্ষণেই আপনার অসংযম স্মরণ করিয়া সহসা উচ্চৈঃস্বরে, “ওগো খুড়ো গো” বলিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
‘ক’নে গো ক’নে, বাবা পঞ্চমুণ্ডি লেমিনাথের লৈবিদ্যি…”
“বলে কি!”
বৈজুনাথ কলমকাটা ভেড়ী পথ বাহিয়া নামিয়া আসিয়া ঘোট দৌড়ে এখানে উপস্থিত হইয়া স্ত্রীলোকের মত ভান করত কহিল, “ওমা, অবাক বললে বাছা! বাছা, বলি তোমার কি জাত গো? কেনে, শোন নাই…বামুন কায়েতের ঘরে সব সময় হয়…” বলিয়া ঝুমুরওয়ালী কেষ্টদাসীর মত ভান করিয়াছিল।
“এই শ্মশানে?”
এ বাক্যে বিস্মৃতি; যে লোকটি এ কথা বলিয়াছিল সে চির-চেনা একটি অন্ধকারকে ইদানীং অপরাহের আলোকে যাহা রেখাবৎ–তাহাকে পথ ছাড়িয়া দিল। যাহা সর্পগতিতে দূর কোন রক্তস্রোত দর্শনে অদৃশ্য।
‘শ্মশান’ কথাটা শুনিয়া বৈজুনাথ শ্লেষ্ময় ভারাক্রান্ত, কটাক্ষ করিতে উন্মত্ত হইয়া উঠিল, “তবে! পরলোকে সংসার কি খামার বাড়ী থেকে পাতবে? এই লাও! এই তার চারবাগাল বাড়ী, চালাকাঁৎ ঘর গো…” বলিতে বলিতে পশ্চিমে ফিরিয়া তাকাইল। কেননা বিরক্তিকর বাজনা এখন অতীব নিকটে।
ভেড়ীর একস্থানে শ্মশানে আসিবার সঙ্কীর্ণ পথ বৰ্ত্তমান, ইহার পুনরায় হঠাৎ বেশ প্রশস্ত স্থান সিঁড়ির মত এবং নীচে শ্মশান ভূমি।
এক একজন বাজনদার বেসামাল পায়ে নামিল। তাহার পর মুরারী নাপিত; তাহার পর লক্ষ্মীনারায়ণ দ্রুতপদে আসিয়াই পিছন ফিরিয়া বাঁশের ছাতা ঘাড়ে করিয়া ডুলি বাহকদের নির্দ্দেশ দিতে লাগিলেন, কিন্তু দেখা গেল ডুলি বাহকের পরিবর্তে একজন কাঠ লইয়া আসিতেছে। লক্ষ্মীনারায়ণ বলিলেন, “আঃ তুমি আবার কোত্থেকে এলে হে? একটু সবুর সয় না…”
সে কহিল, “বাঃ মড়া পড়ে আছে…”
লক্ষ্মীনারায়ণ তাহার কথায় নারায়ণ নারায়ণ’ করিয়া বলিলেন, “যত অলুক্ষণে কাণ্ড, যাও যাও ওরে তুই খুব সাবধান গা, দেখিস…হা হা কোন বিঘ্ন না হয়, আয় আয়…,
.
সঙ্কীর্ণ পথ, একটি ডুলি দেখা গেল।
সুন্দর লাল কল্কা ছাপ ‘আরকট ছিটের কাপড়ের মধ্যে অসম্ভব করুণ স্তিমিত ক্রন্দনের শব্দের আধার এই ডুলিখানি, জালা যেখানে রাখা সেখানেই সন্তর্পণে রাখা হইল।
এইস্থান হইতে বুড়া সীতারামকে–তথা বরকে স্পষ্ট দেখা যায়।
লক্ষ্মীনারায়ণ এখন তৎপর, ডুলির খুরা হইতে একটি কাঠি মাদুর বাঁধা ছিল, খুলিয়া লইয়া এখানে পাতিলেন। এখনও সীতারামের মাথার উপর হইতে ছাউনি, যাহা দুপুরের রৌদ্রের জন্য খাটান হইয়াছিল, তাহা খুলিয়া লওয়া হয় নাই। পুরোহিত বৃদ্ধের কানের তুলা খুলিয়া, “সীতারাম, ক’নে এসেছে” বলিয়া উঠিয়া, লক্ষ্মীনারায়ণের নিকটে আসিলেন। ডুলির মুখের পর্দায় ‘অযোধ্যায় রাজকৰ্ম্ম ব্যাপৃত রামচন্দ্র পার্শ্বে সীতা’ ছাপা, সেখানে, ইহার সম্মুখে লক্ষ্মীনারায়ণ দাঁড়াইয়া আপন কন্যাকে আহ্বান করিলেন, “এস মা এস।”
কিয়ৎক্ষণের পরে বলিলেন, “লজ্জা কি মা যশো…নেমে এস” ইহার পর নিজেই অধৈৰ্য্যতার সহিত ডুলির পর্দা খুলিয়া দিলেন। যশোবতাঁকে দেখা গেল।
অনিন্দ্যসুন্দর একটি সালঙ্কারা কন্যা প্রতীয়মান হইল, ক্রন্দনের ফলে অনেক স্থানের চন্দন মুছিয়াছে, আকর্ণবিস্তৃত লোচন রক্তাভ, হলুদ প্রলেপে মুখমণ্ডল ঈষৎ স্বর্ণসবুজ। সৰ্ব্বলক্ষণে দেবীভাব বৰ্ত্তমান, ফলে সহজেই মনে হইবে এ যেন বা চম্পক ঈশ্বরী, লক্ষ্মী প্রতিমা। শুধুমাত্র মুখোনি জন্ম দুঃখিনীর মতই বিষাদময়।
বৃদ্ধ সীতারাম কোনক্রমে মুখ আড় করিলেন, ক্রমাগত নিজের গাল চুষিবার শব্দ, সহসা কিঞ্চিৎ লালা গড়াইল, তিনি দেখিলেন, পটে আঁকা একটি ষড়ঐশ্বৰ্য্যময়ী দেবীমূৰ্ত্তি, এখন তাঁহার পায়জোড় পরিহিত পা মাটিতে ছোঁয়ান, দুটি হাতে দুইদিকের ডুলির চৌকার বাঁকা ধরিয়া আছেন।
এই ডুলির পশ্চাতে বাজনদাররা এ দৃশ্যে, বৃদ্ধদর্শনে, বাজনা ভুলিয়া গেল। কেহ ফুঁ দেয় আবার ঠিক হয়, কেহ বেতালা ঢাক বাজায়, কাঁসি খন খন বাজিয়া উঠে।
যশোবতী বৃদ্ধকে দেখিয়াই চক্ষু তুলিলেন, সীতারামের পিছনে, নিম্নে প্রবাহিণী গঙ্গা। দেখিলেন, স্রোতে গলিত দেহেশকুন বসিয়া মনঃসংযোগ করিতে চেষ্টা করিতেছে, তাহারই পার্শ্বে চক্রাকারে ঘুরিয়া । কাক তাহাকে বিরক্ত করে। বেলাতটে একটি অকেজো ভাওলিয়া, যাহার গায়ে মেটে সিন্দুর দিয়া আঁকা চক্ষু, নিম্ন দিয়া ধ্বনিসহকারে জল বহিয়া যাইতেছে। ক্কচিৎ জলজ পানা।
পুনৰ্ব্বার তিনি, যশোবতী, বৃদ্ধকে নিরীক্ষণ করিলেন।
পাতার ফাঁক দিয়া কঠোর সূৰ্য্যালোক পড়িয়াছে, বৃদ্ধের নাক দিয়া কাঁচা জল গড়াইতেছে, এবং অন্যান্য সকল কিছু শব্দকে পরাজিত করিয়া গাল চোষার আওয়াজ ক্রমবর্ধমান, তদ্দর্শনে ডুলিস্থিত প্রতিমা চৈত্রের পাতার মত কম্পিত, তাঁহার জ্ব-যুগলে যেন গুণ টানা হইল। দৃষ্টিকে ছাড়াইয়া চক্ষুদ্বয় আগাইয়া আসিতে চাহিল।
“সীতারামের বেশ জ্ঞান আছে, বিয়ের সময়ও উঠে বসবে, তুমি গিয়ে সীতারামের সঙ্গে একটু কথা বল, মেয়ে দেখে ওর পছন্দ হয়েছে কিনা…” নির্লিপ্তভাবে কৃষ্ণপ্রাণ ইহা বলিয়া লক্ষ্মীনারায়ণের নিকট দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিলেন। প্রথমতঃ ইহা যথারীতি আচারবিরুদ্ধ, তাহা কোনক্রমে মনে হইল না।
এই কথা কয়টি যশোবতীর যৌবন উচ্ছল শরীরখানিকে যেন বা নিঙড়াইয়া দিল, তাঁহার কণ্ঠ মধ্যে পাখীর বাসার স্বাদ ও গন্ধে রুদ্ধ, তাঁহার মুখোনি ডুলির পর্দার আড়ালে চকিতে অদৃশ্য এবং পরক্ষণেই মুখমণ্ডলের অর্ধভাগ পরিদৃশ্যমান হইল। অচৈতন্য হইবার পূর্বলক্ষণ জানিয়া পিতা লক্ষ্মীনারায়ণ সত্বর আসিয়া কন্যাকে ডাকিলেন, “যশো, যশো!”
যশোবতীর আয়ত চক্ষুদ্বয় এখন উন্মীলিত, তিনি আপনার আদরের পৃথিবী দেখিলেন, যে পৃথিবী শূন্যতার, সৌন্দর্য্যের, বাস্তবতার আধিভৌতিক সমস্যা এবং শুধুমাত্র তিনি উচ্চারণ করিলেন, “বাবা!”
এই স্বরের মধ্যে বিড়াল ও পাখীর ঘোরতর যুদ্ধের আওয়াজের রেশ ছিল। মুক্তাসদৃশ দন্তপাতি দিয়া তিনি তাঁহার নিম্ন ওষ্ঠ চাপিয়া ধরিলেন, এমত সময়ে মানসচক্ষে দেখিলেন, এক বৃক্ষ, শিকড় যাহার উচ্চে, শাখা নিম্নে, এবং পুনরায় তিনি, সমুদয় তাঁহার কাছে!
.
“আয় মা আয়, আমার মান রক্ষা কর।” তাহার পর ধীরে ধীরে সান্ত্বনার ছলে বলিলেন, “মঙ্গল কাজের সময় চোখের জল ফেলতে নেই মা।”
যশোবতী পিতার মুখের দিকে চাহিয়া নিজের দুর্বলতার হেতু সত্যই লজ্জিতা হইলেন, অত্যধিক দৃঢ়তার সহিত জুলির বাঁশ চাপিয়া ধরিয়াছিলেন, ফলে হাত ছাড়াইয়া লইবার পরেও হাত অৰ্দ্ধ উন্মুক্ত হইয়া রহিল। কন্যাকে ধরিয়া লক্ষ্মীনারায়ণ মাদুরের উপর বসাইয়া দিলেন।
এইস্থানের পরিবেশ দেখিয়া আপনার হতভাগ্যের কথা ভাবিবার মত কোন মনোবৃত্তি যশোবতী খুঁজিয়া পাইলেন না। শুধুমাত্র চক্ষু বুজাইয়া ঘুম চাহিলেন।
.
বাজনদারদের তখনও স্বাভাবিকভাব ফিরিয়া আসে নাই। কৃষ্ণণ কন্যাপক্ষের হইয়া তাহাদের ধমক দিলেন, তাহারা যুগপৎ নানাবিধ শব্দ করিয়া উঠিল; নাপিত সত্বর ক্ষুরে ধার দিতে লাগিল, তাহার মাথায় কৃষ্ণপ্রাণ গঙ্গাজল দিয়া শুদ্ধ করিয়া বলিলেন, “হরেরাম, নাপিতকে নিয়ে যাও বলরাম তুমি ওখানটা পরিষ্কার কর।”
দ্রুতগতি কাজ শুরু হইয়া গেল। লক্ষ্মীনারায়ণ ছাতার আড়া হইতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মোড়ক, ডুলির বাঁশ হইতে হাঁড়ী কলস নামাইলেন, কৃষ্ণপ্রাণ কলাপাতা কাটিলেন। সকল কিছুর ব্যবস্থা হইল।
যশোবতাঁকে যখন তাঁহার পিতা ডাকিতে আসিলেন তখন তিনি ডুলির উপর মাথা রাখিয়া প্রশান্তচিত্তে ঘুমাইতেছিলেন। পিতার ডাকে উঠিয়া বস্ত্রাদি সম্বরণ করিয়া একটি হাই তুলিবার কালে চারিদিকে তাঁহার দৃষ্টি পড়িল। আলস্যত্যাগ করা আর হইল না। কিছুকাল স্থির থাকিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া পিতার দিকে শিশুর মতই তাকাইলেন। অনন্তর শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, “কি করবো?”
“তাড়াতাড়ি নে মা, লগ্নের আর দেরী নেই।”
নাপিত তাহার ছোট বিলাতী আয়নাখানি এখানে বসাইয়া দিয়া গেল। যশোবতী ধীরে ধীরে সাজিতে লাগিলেন। দেহ কাঁপিয়া কাঁদিয়া চমকাইতেছিল, কপোল বহিয়া অশ্রুধারা বর্তমান, কিন্তু তথাপি মনে হয় যেন ক্রন্দনের সেই মনোভাব নাই; কেননা তিনি, যশোবতী, গঙ্গার জলোচ্ছ্বাসে পুনঃ পুনঃ শুনিয়াছিলেন, “হে কৌন্তেয়–হে কৌন্তেয়! সাক্ষাৎ ভগবান আপনার প্রাণপ্রিয় সখাকে যেন ডাকিতেছেন। হঠাৎ দেখিয়াছিলেন, কে যেমন বা নাড়ীসমূহ লইয়া নেতি ধৌতি করিতেছে।
চতুর্দিক অবলোকন করত যশোবতী বলিয়াছিলেন, এ কি খেলা! এবং শ্মশানের ধূম তাঁহাকে মলিন করিতে পারে নাই।
যশোবতী বধূবেশ আপনি ধারণ করিলেন।
৩. বরবেশে সীতারাম সত্যই আকর্ষণীয়
বরবেশে সীতারাম সত্যই আকর্ষণীয় হইয়াছিলেন; কেবলমাত্র ক্রমাগত গাল চোষা ছাড়া তাঁহার মুখে অন্য শব্দ ছিল না। বলরাম পিছন হইতে তাঁহাকে বেশ কিছুটা তুলিয়া ধরিয়াছে। এখন তাঁহাদের পরিক্রমণ করিয়া সাত পাক চলিতেছে, সীতারাম অনেকবার আপনার ভারাক্রান্ত মুখোনি তুলিয়া ধরিয়া দেখিতে চাহিলেন, ফলে তাঁহার দুর্বল স্কন্ধই কাঁপিয়াছিল।
শুভদৃষ্টির কালে, লক্ষ্মীনারায়ণ কন্যাকে বরের দিকে ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিতে অনুরোধ করিলেন। সীতারাম যশোবতাঁকে দেখিতেই গাল চোষার গতি বাড়িয়া গেল, বৃদ্ধ যেন উত্তেজনা সহ্য। করিতে পারিলেন না, অপ্রকৃতিস্থ হইয়া আপনার পুত্রের হাতে মাথা হেলাইয়া দিলেন, কে জানে হয়ত আপনার প্রৌঢ়ত্ব পার হইয়া যৌবনের উপর হেলিয়া পড়িতে চাহিয়াছিলেন! কিয়ৎকাল এইভাবে অতিবাহিত হইল। তিনি আবার ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহার হস্তে মালা দেওয়া হইল, জরাগ্রস্ত হস্ত মালা লইয়া আগাইতেছিল, সহসা কোথা হইতে কাশি আসিল, তবুও বৃদ্ধ মালা পরিত্যাগ করেন নাই, কিন্তু আর সম্ভবপর হইল না; দমকা হাওয়া তাঁহার হাত হইতে মালা খসাইয়া লইয়া গেল। সকলকে আশ্চৰ্য্য করিয়া মালাটি ধরিবার জন্য সীতারামের বাহু প্রসারিত হইয়াছিল, মালা দূরে গেল, হরেরাম মালা আনিতে ছুটিল কিন্তু অবলীলাক্রমে বৈজুর ছাগল সে মালাখানি সদ্ব্যবহার করিতে তখন মুখ আগাইয়া দিয়াছে।
সীতারাম তখনও প্রবল বেগে কাশিতেছিলেন, এমতাবস্থায় মন্ত্রচালিত পাষাণপ্রতিমা, যশোবতীর হস্তধৃত মাল্যখানি আসিয়া বৃদ্ধের কণ্ঠলগ্ন হইল।
এসময় বায়ু স্থির, গৃহাভিমুখী পক্ষীরা মুখরিত, স্রোত শান্ত এবং প্রকৃতি স্তব্ধ নিথর হইয়াছিল।
.
সীতারামের অবস্থার কথা স্মরণ করিয়া, শুভকাৰ্য্য যত সংক্ষেপে করা যায় তাহা করা হইতেছিল। ইতিমধ্যে কৃষ্ণপ্রাণ, দক্ষিণা আচারবিরুদ্ধ হইয়াছে, এই কথা বুঝিতে পারিলেন। পুরোহিতচিত কণ্ঠে কৃষ্ণপ্রাণ কহিলেন, “নিয়ম এই যে, আমি আর একটি মুদ্রা বেশী পাইব…”
লক্ষ্মীনারায়ণ ট্যাঁক খুঁজিলেন, কাপড় ভাল করিয়া ঝাড়িলেন। কোন মুদ্রাখণ্ডের সন্ধান পাওয়া গেল না। তখন তিনি শুধু মাত্র অসহায়ভাবে বলিলেন, “তা হলে…”
“সর্ব্বনাশের কিছু নেই, ভালমত অনুসন্ধান কর, ক্ষুণ্ণমনা ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ দ্বারা শুভকাৰ্য্য সম্ভব নয়” বলিয়া কৃষ্ণপ্রাণ স্মিতহাস্য করিলেন।
তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া কোন মুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেল না। লক্ষ্মীনারায়ণ আপনার লোকেদের কাছে কর্জ চাহিলেন, কিন্তু তাহাদের সকলের কাছেই কিছু কড়ি ছিল, রৌপ্যমুদ্রা ছিল না। সুতরাং লক্ষ্মীনারায়ণ আসিয়া অনুনয় বিনয় করত কহিলেন, “ঠাকুর মশাই, এখন…”
“রৌপ্যমুদ্রা বিনা শুভকাৰ্য্য হয় না…”
অদূরে বসিয়া বৈজুনাথ এই ব্যাপার দেখিতেছিল, সে একটি ঝাঁপা হইতে খানিক তাড়ি নিজের মুখে ঢালিয়া মন্তব্য করিল, “যাঃ শালা-পাকা খুঁটি বুঝি কাঁচে গো” তাহার কথা কাহারও কর্ণে প্রবেশ করিল না। তখনও লক্ষ্মীনারায়ণ দাঁড়াইয়া অপদস্থ হইতেছিলেন; বৈজুনাথ উচ্চৈঃস্বরে কহিল, “আমি ধার দিতে পারি” বলিয়া ঠেটির ট্যাঁকে হাত দিয়া অনুভব করিতে লাগিল।
লক্ষ্মীনারায়ণ অত্যন্ত রাগান্বিত, বৈজুনাথের কথায় তাঁহার সব্বাঙ্গ যেন হোমাগ্নিতে পরিবর্তিত হইল, তিনি ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, “হারামজাদা ইতর চাঁড়াল…”
শান্তকণ্ঠে বৈষ্ণব কৃষ্ণপ্রাণ সহাস্যবদনে কহিলেন, “কন্যা সম্প্রদানকালে ক্রোধ পরিত্যাজ্য” বলিয়া ক্রমাগত সাধুভাষায় আপনার মনোভাব ব্যক্ত করিতে লাগিলেন, “যে কোন জাতি বর্ণের নিকট হইতে ধাতু তথা অর্থমুদ্রা গ্রহণযোগ্য, একমাত্র মুদ্রার ক্ষেত্রে জাতিবিচার চলে না…এতদ্ব্যতীত শ্মশানে উচ্চ নীচ ভেদ নাই।” মনে হইল কোন অকাট্য সংস্কৃত শ্লোকের ইহা সরল ভাষায় অনুবাদ।
এই বিচারে সমবেত জনমণ্ডলী গভীর শ্রদ্ধার সহিত কৃষ্ণপ্রাণের প্রতি অনিমেষ নয়নে চাহিয়াছিল। লক্ষ্মীনারায়ণ বিভ্রান্ত, একবার ইহাদের দিকে অন্যবার তাঁহার নীচকুলোব মহাজনের দিকে তাকাইলেন। বৈজু ইহাদের কথাবার্তা শুনিয়াছিল, সে হাতের কব্জিতে মুখ মুছিয়া একটি মুদ্রা লইয়া দাঁড়াইয়া অন্যহাতে আপনার মোচ চুমরাইতেছিল। জ্যোতিষী অনন্তহরি লক্ষ্মীনারায়ণকে খানিক সৎসাহস দিলেন।
লক্ষ্মীনারায়ণ লজ্জিত পদে বৈজুর নিকট আসিয়া হস্ত প্রসারিত করিলেন। চণ্ডাল তাঁহার হস্তে মুদ্রাটি দিবার জন্য আপনার নেশা-বেসামাল দেহকে সংযত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড রোল উঠিল, “ওরে ব্রাহ্মণের চরণে দে, না হলে মহাপাতক হবি”; বৈজুর অবস্থা বুঝিয়া ব্রাহ্মণ এক-পা পিছাইয়া গিয়াছিলেন। সে টাল সামলাইতে না পারিয়া পড়িয়া গেল, তাহার হাত হইতে মুদ্ৰাখণ্ড গড়াইয়া প্রায় গঙ্গার কিনারে গিয়া পড়িল। বৈজু নেশাবিজড়িত কণ্ঠে বলিল, “আমি শালা ত প্রণামী দিচ্ছি না যে পায়ে দেবো…।” অবশ্য তাহার এ উক্তি কেহ নিশ্চিত শুনিতে পাইল না।
লক্ষ্মীনারায়ণ গঙ্গাজল মুদ্রাটির উপর ছিটাইয়া তাহাকে শুদ্ধ করিয়া লইয়া আসিলেন। পুনৰ্ব্বার এই শ্মশানভূমিতে পুণ্য বিবাহমন্ত্র উচ্চারিত হইল, আসন্ন সন্ধ্যার গঙ্গার কল্লোল-ধ্বনিকে আহত এবং স্তব্ধ করিয়া দূর গগনে আবর্তিত হইতে লাগিল। এই মন্ত্রশক্তি, মানব দেহের হিঙ্গুল রক্তস্রোতকে উদ্ধতনখর ও প্রকৃতিস্থ করিতে সক্ষম হয় নাই। ইহা মায়িক সুতরাং হৃদয়ের স্পন্দন পাতালগত শিকড়মতই স্থবির হইয়া রহিল।
বিবাহের প্রথম অধ্যায় নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হইল। মৎস্যক্ৰীড়া কড়ি খেলা পর্যন্ত হইল, পুরাতন উর্ণনাভের মত হাতখানি ক্রীড়াচ্ছলে, কখন বা কড়ি সন্ধানকালে, যশোবতীর দেহের সর্বত্রে কর্ষণ করিল। তিনি ভীতা হইলেন না, নিঃশ্বাসের গতির সমতার কোন ব্যতিক্রম ঘটিল না; নবোঢ়া বধুর মত ক্লান্ত হইয়াও তিনি যে সহজ হইয়াছিলেন, এমতও নহে। কৃষ্ণপ্রাণ গঙ্গাতীরের বাসর পরিত্যাগ করিয়া লক্ষ্মীনারায়ণের নিকটে গিয়া বলিলেন, “কি বলব, আমার মনে হয় আমরা যেন সত্যযুগেই আছি, মায়ের কি শক্তি।”
এখন আকাশ তারাতৃষ্ণ, তবু দেখা গেল লক্ষ্মীনারায়ণের মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে।
.
যশোবতী বসিয়া আছেন। তিনি যেন বা ত্রিগুণাত্মিক মায়ার দ্বারা পীড়িতা নহেন। অথবা স্বাভাবিক জ্ঞান তাঁহা হইতে অপহৃত হইয়াছে। সম্মুখে উদার গঙ্গা ইদানীং চালোকে বেলোয়াড়ী। তিনি কৃষ্ণতম অন্ধকারের আধার মাত্র, পরিদৃশ্যমান স্থূলতা যে অন্ধকারে অপ্রকট হইতেছে; যাহা ঘটিল তাহার স্মৃতি পর্যন্ত তাঁহাকে ক্ষেত্র করিয়া জাগিয়া উঠিতেছে না। অনেক প্রাণ আছে যাহার স্পন্দন নাই, ক্ষুধা নাই। শুধু মরণোন্মুখ ঘুমে তাঁহার চক্ষুদ্বয় খসিয়া আসিতেছে। তথাপি বেশ কিছুক্ষণ ধরিয়া তিনি যেমন বা কাশির মত আওয়াজ শুনিতেছিলেন। অনন্তর কোনক্রমে একবার পাশ ফিরিয়া দেখিলেন যে, আত্মরক্ষায় বদ্ধপরিকর পোকার মত দুটি চোখ তাঁহার দিকে চাহিয়া আছে, এতদৃষ্টে তাঁহার দেহ রোমাঞ্চিত হইল না, শুধু মাত্র অল্প ভাঙন দেখা গিয়াছিল। বৃদ্ধের হাতে মৃদু স্পন্দন ছিল, মনে হয় তাহা গঙ্গার হাওয়া-সম্ভব। যশোবতীর মুখে কালোচিত অবগুণ্ঠন ছিল না, তিনি অপলক নেত্রে বৃদ্ধের দিকে চাহিয়া রহিলেন, এ সময়ে তাঁহার দেহস্থিত কূট অন্ধকার যৌবশরীরকে আলোড়ন করিয়া সুদীর্ঘ দীর্ঘনিঃশ্বাস হইয়া চলিয়া গেল, নাসার বেসরকে তাহা লাল করিয়াছিল, নোলক তটস্থ হইয়াছিল, এবং জীবন সুদৃশ্য হইয়াছিল।
বৃদ্ধ সীতারাম অনেকক্ষণ একভাবেই ছিলেন, হয়ত নববধূর সহিত বাক্যালাপ করিবার তাঁহার বাসনা হইয়াছিল; তাহার জন্য শক্তি সঞ্চয় করিতেছিলেন। তিনি কি যেন বলিলেন…।
যশোবতী সত্যই তাঁহাকে বুঝিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, অভিমান তাঁহার হয় নাই। অন্তত তাঁহার মুখে একটি সপ্রতিভ লক্ষণ দেখা গিয়াছিল।
যশোবতাঁকে সীতারাম দেখিতে লাগিলেন। নববধুর দৃষ্টি এখন অন্যত্রে নিবদ্ধ ছিল। যেখানে মাদুরে বিশ্রামরত সকলের সম্মুখে উবু হইয়া বসিয়া, বৈজু গান শুনাইতেছিল। রামপ্রসাদী শেষ হইল। যাহাদের এখনও তেজ ছিল তারা আর একটা, আর একটা’, বলিয়া অনুরোধ করিল; তাহার প্রত্যুত্তরে সে কহিল, “বাবু মশায়, আমি এবার নিজ মন মত একটা গান বলব…”
বৈজুর বাক্যে কৃষ্ণপ্রাণ ইত্যাদি যাঁহারা জাগিয়াছিলেন তাঁহারা হরিধ্বনি করত কহিলেন, “তাই হোক।” বৈজু তাহার জোয়ারী গলায় হস্তের ঝাঁপা বাজাইয়া ধরিল, “বলি শোন–
বিবাহ এক রক্তের নেশা,
বর বউ যেন বাঘের মত…”
গীতের বাণী পোড়া কাগজের মত গঙ্গার হাওয়ায় ফর ফর করিয়া উড়িয়া যাইতেছিল, তথাপি শ্রোতাদের কর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল; বৈজু এখনও তাহার হাঁটুর প্রায় কাছেই চাপড় মারিয়া হৈ হৈ করিয়া গাহে।
ব্রাহ্মণেরা এ উহার দিকে চাহিয়া তারস্বরে হো হো শব্দ করিয়া উঠিয়া তাহার পরেই কিয়দংশ সমস্বরেই কহিলেন, “মর হারামজাদা…বেল্লিক…শালা…চাঁড়াল…”। কৃষ্ণপ্রাণ আপনার খড়ম হাতে লইয়াছিলেন।
বৈজুনাথের কোন কিছুই হয় নাই। সে উঠিয়া নেশা বিবশ পা ছড়াইয়া আবার চলিতে আরম্ভ করিল, গান তাহার কণ্ঠে ছিল।
“বিবাহ এক রক্তের নেশা–
বর বউ যেন বাঘের মত,
বাঘ বাঘিনী রক্ত চোষা ॥”
যশোবতী অত্যধিক বিস্ময় সহকারে এই গান শুনিতেছিলেন। বৈজুর দেহ দুলিতেছে। সহসা কৃষ্ণপ্রাণ ছুটিয়া আসিয়া বলিলেন, “দেখ ব্যাটা চাঁড়াল, আমি তোর গান ঘুচিয়ে দেবো…”
“হেরেরেরে–কি অল্ল্যায় হলো…” বলিয়া বৈজু ঈষৎ টলিয়াছিল। “ন্যায় অন্যায় তুই কি করে বুঝবি বজ্জাত হারামজাদা…” নিজের ব্যাঘ্ৰস্বর শুনিয়া কৃষ্ণপ্রাণ নিজেই চমকাইয়া শঙ্কিত এবং নিজের হস্তপ্ত খড়মের দিকে চাহিয়া কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইলেন।
“তা বটে তা বটে, ন্যায় অন্যায় বুঝবই যদি তবে চাঁড়ালির পেটে জন্মাব কেনে…”
“ফের যদি গাইবি হারামজাদা তো…” তদনন্তর কণ্ঠস্বর মিহি করিয়া কৃষ্ণপ্রাণ কহিলেন, “বিয়ের ক’নে বসে–”
“তা বাসরঘরে গোঁপ চোমরান গান হবে না ঠাকুর, এ কি হবিষ্যি গান হবে…”
“তুই মাতাল, তা না হলে…”
বৈজু ঐ স্থান হইতে বিবাহের বাসর দেখিল। কি দেখিল সেই জানে, হয়ত বা নানা আসনে চন্দ্রালোকই দেখিয়া থাকিবে। সে গম্ভীর হইয়া অল্পক্ষণ দাড়ি চুলকাইল। তাহার পর সজল নেত্রে কহিল, “চাঁড়ালের ঘরে জন্মেছি ঠাকুর, ন্যায় অন্যায় জানিনা। তবু তুমি শেখালে গো” বলিয়া প্রণাম করিল। কৃষ্ণপ্রাণ তাহাকে প্রণত রাখিয়া ফিরিয়ে গেলেন।
প্রভুভক্ত কুকুর যেমন প্রভুর দিকে মুখ তুলে, তেমনই সীতারাম নববধূর দিকে মুখ তুলিয়া কিছু বলিতে চাহিলেন। বৈজুর গানের অসৎ কলিগুলি যশোবতী শুনিয়াছিলেন, তথাপি তাঁহার মনে কোন বিকার উপস্থিত হয় নাই, এ কারণ যে সেখানে পুষ্পের অজ্ঞতা ব্যতীত কিছুই ছিল না।
বৈজুর দিক হইতে মুখ ফিরাইয়াই বৃদ্ধের দিকে দৃষ্টি পড়িল। গাল চোষার অল্প আওয়াজ এখন আগ্রহের সৃষ্টি করিয়াছিল, তিনি স্বীয় মুখোনি তাঁহার প্রায় নিকটেই আনিলেন, কিন্তু চো চোক আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শুনিতে পাইলেন না। কিছুক্ষণ পরে মুখ তুলিতে গিয়া দেখিলেন, আপনার বসন প্রান্ত বৃদ্ধ মুঠা করিয়া ধরিয়া আছেন, অতঃপর ক্ষিপ্রবেগে তাঁহারই হাতের কব্জি ধরিতেই তিনি সবিস্ময়ে দেখিলেন, অঙ্গুলিগুলি একটির পর অন্যটি নামিতেছে উঠিতেছে। ইহাতে, ইহাতেই মনে হয় যশোবতীর চক্ষুর্ঘয় কিঞ্চিৎ উদগ্রীব হইয়াছিল।
যদিচ আপাত দৃষ্টিতে এহেন অঙ্গুলি আন্দোলন সত্যই ত্রাসের সঞ্চার করে, তবু তাহারই মধ্যে প্রেমিকের হৃদয়ের উষ্ণতার, গভীরতার, সুকুমার ব্যঞ্জনা ছিল; সুকুমারস্বভাবা যশোবতী হাতটি ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলেন, ইদানীং অনুভব করিলেন, বৃদ্ধের এই বিশীর্ণ হাতখানির মধ্যে বলবতী ধাবমান ইচ্ছা প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে এবং তাঁহার সমস্ত হাতখানিকে উর্দ্ধে লইয়া যাইতে চাহিতেছে। যশোবতীর সাহায্যে প্রবীণ হাতখানি শক্তিলাভ করিল, যেন আপনা হইতে উঠিয়া তাঁহার অবগুণ্ঠন উন্মোচন করিয়াই সেখানে স্থির হইয়া রহিল।
এই দেহের অথৈ সৌন্দৰ্য্য যেমন বা সন্ন্যাস লইয়াছে। স্তম্ভিত বৃদ্ধকে মুহূর্তের মধ্যেই চরিত্রবান করিল, সীতারাম আমিত্ব-অহঙ্কার বর্জিত, কিন্তু মানুষের দন্তপাতি অদৃশ্য হইলেও, জিহ্বা অক্ষয় হইয়া আপন স্থানে বসিয়া থাকে, রস উপলব্ধি করে। উদ্ভিন্নযৌবনার হেমদেহ স্পর্শে বৃদ্ধের গায়ে যেন মাংস। লাগিল। সীতারাম কি যেন বলিলেন। যশোবতী তাহা সঠিক বুঝিয়ে না পারিয়া নূতন করিয়া ঘোমটা রচনা করিবার জন্য দুই হাতে বসন প্রান্ত উত্তোলন করা মাত্রই প্রাচীন হাতখানি তাহার বক্ষে আসিয়া দারুভূত হয়, শতাব্দীক্লিষ্ট বল্কলসদৃশ অঙ্গটি দেখিয়া যশোবতী এককালে অন্ধকার-শঙ্কিত, উৎখাত হইলেন। তাঁহার দীর্ঘশ্বাসের আঘাতে বৃদ্ধের হাতখানি ক্রমে যেমন বা নামিয়া গেল।
“বউ বউ” মর্মান্তিক শব্দ হইল। যশোবতী মুখোনি নিকটে আনিলেন, এখন বৃদ্ধের চোখদুটি আয়ত হইল, কহিলেন, “ঘোমটা…না না।”
যশোবতী ঘোমটা খুলিয়া, পরমুহূর্তে যথাস্থানে রাখিয়া সকল দিক নিরীক্ষণ করত অতি সন্তর্পণে ঘোমটা উন্মোচন করিলেন।
পক্ককেশ-চন্দ্রালোকে যশোবতী চির-রহস্যের সম্মুখে আসিয়া নিঃসঙ্গ; বৃদ্ধের গূঢ় অন্ধকারকে সুযোগ বলিয়াই মনে হইল। আবেগে কহিলেন, “বাঁচব বাঁচব” ফলে মুখের কষ বহিয়া লালা নিঃসৃত হয়।
নিঃসঙ্গতা-আহত যশোবতী কেবলমাত্র মস্তক আন্দোলিত করিলেন।
“তুমি…এসেছ” ইহার পর কম্পিত অঙ্গুলি দ্বারা আপনাকে নির্দ্দেশ করিয়া নিশ্চয় বলিয়াছিলেন, “বাঁচব”; সীতারামের কথা স্পষ্ট না হইলেও তাঁহার আকৃতিতেই বক্তব্যকে প্রকাশ করিতেছিল। অনন্তর বৃদ্ধ একটি দম লইয়া, পদাঘাত করিবার অমানুষিক ঔদ্ধত্যের সহিত কহিলেন, “বাঁচব” এবং যুগপৎ মহা আক্রোশে আকাশের দিকে–এখন যে আকাশ চন্দ্রাহত তারা ভরা–তাহার দিকে চাহিলেন।
আকাশে, উর্ধে, ক্রমাগতই হংসবলাকায়ূথ, যাহাদের ছায়া ইতঃমধ্যের শূন্যতায় নিখোঁজ সুতরাং তাহারা অশরীরী; তথাপি, কভু নিম্নের স্রোতের শব্দকে নিষ্ফল করত তাহাদের মুখনিঃসৃত ধ্বনি শোনা যায়; যশোবতাঁকে এ শব্দনিচয় দিকভ্রান্ত করে–কেন না তিনিও দেখিতেছিলেন, একদা মনে হইল এ-শব্দ বৃদ্ধের মুখপ্রসূত শব্দ বৈ অন্য নহে; সেই হেতু বৃদ্ধের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। সেখানে এখনও বৃদ্ধের চোখে শিশির তত্ত্ব। আরবার তিনি, যশোবতী, উড্ডীয়মান হংসশ্রেণী দেখিলেন।
অকস্মাৎ দেখা গেল, এ-উড্ডীয়মান হংসশ্রেণী কি যেমন বা পরিত্যাগ করিল, ফলে এ-দিঙমণ্ডল চকিতেই নিষ্ঠুর কুটিল, আকাশপথে কি যেন, পালক যেমত, ভাসিয়া ভাসিয়া নামে। ক্রমে ইহা স্পষ্ট। একটি উর্ণা তথা ব্যাধের জাল খসিয়া আসিতেছে যাহা কিছুকাল পূৰ্বে নিশ্চয়ই হংসশ্রেণীকে রুদ্ধ করিয়াছিল।…অনুঢ়া, রম্য, প্রাণময়ী অদ্যও–এ হংসশ্রেণী; জালটি আকাশে যদিও একাকী, তথাপি সৌখীন, বাবু, নয়নাভিরাম! এ দৃশ্যে সীতারাম পশুশাবকের মতই কুঁকুঁ শব্দ করিতেছিলেন, এখন শিহরিয়া প্রাণান্ত মুখব্যাদান করিয়া তড়িৎ বেগে একটি হাত আপনার চোখের উপর রাখিতে চেষ্টা করিলেন, কেননা জালের ছায়া তাঁহার দেহে পড়িয়াছিল।
যশোবতী এতক্ষণ বিন্দু মাত্র, যেহেতু এই নৈশ সৌন্দৰ্য্য, তাঁহার বালিকা মনে ভয়াবহ রূপে দেখা । দেয়, নির্বাসিত লহমার ব্যথায় তাঁহার জানকীসদৃশ শরীর জর্জরিত, এবং রোমহর্ষে যে অস্তিত্ব খুঁজিয়া। পাইয়াছিলেন–তাহার বলে পার্শ্বস্থিত নিপীড়িত বৃদ্ধকে দেখিয়াই বস্ত্রপ্রান্ত দ্বারা তাঁহার, বৃদ্ধের, স্বামীর মুখমণ্ডল আবৃত করিলেন।
সীতারামের ক্রন্দনের আপ্লুত স্বর ও মুখ মারুতে বস্ত্রখণ্ড উঠা নামা করিতেছিল। ভৌতিক ভাবে সহসা বস্ত্রপ্রান্ত উড়িয়া গেল, একটি কণ্ঠস্বর হাওয়ায় উড়িল, “ভয় ভয়।”
যশোবতী বুদ্ধিভ্রংশ হইলেন না, বৃদ্ধের কপালের দুইপার্শ্বে হাত রাখিয়া আকাশ ঢাকিলেন। কামযোগ। দূরত্বের মধ্যে দুজনে মুখোমুখী। সহসা যশোবতী কেমন যেন পাগলিনী হইলেন, মোলক কম্পিত, নথ রাশ মানিতেছে না।…সীতারাম বলিলেন, “ভয় ভয়।” দিশাহারা যশোবতী মুখোনি আরও নীচু করিলেন, অঙ্গের মাংসল খেমটা সাহস বৃদ্ধের চোখে মুখে বর্ষিত হইল।
চকিত হরিণীর ন্যায় তাকাইলেন, তাঁহার মুখে লালার চিহ্ন। এ সময় দুরাগত হাস্যধ্বনি। গঙ্গার নিকটে বসিয়া একটি পা ছড়ান অন্ধকার সেই উলঙ্গ গীতখানি ধরিয়াছে।
যশোবতী যেমন বা অপমানিত হইয়াছিলেন।
তথাপি উঠিয়া চারিটি খুঁটিতে চাঁদোয়া বাঁধিয়া আসিয়া বৃদ্ধের পাশেই বসিলেন। সীতারাম এই চাঁদোয়ার জন্য কিছুটা সোয়াস্তি বোধ করিয়াছিলেন, কেননা মৎস্য-পিত্ত আকাশ নাই, কেবলমাত্র চাঁদোয়ার কতক ছিদ্র বহিয়া আলোক সম্পাত হইয়াছে। ভয় যেন অন্য কোথাও স্তন্যপানরত।
.
সীতারাম ডাকিলেন, “বউ”.তাহার অনেকক্ষণ পর আবার শোনা গেল, “আমি আবার আমার জমি-” আশ্চর্যের বিষয় এই যে এইবার স্পষ্টই শোনা গেল, “বউ তোমাকে নিয়ে ঘর ঘর” এই কথা তিনি এক নিঃশ্বাসে বলিয়াছিলেন। ছেলেমানুষের মত তাঁহার বাচন ভঙ্গি, ছেলেমানুষের মত আশা। যশোবতী সম্মুখের স্রোত দেখিতে দেখিতে এই বাক্যগুলি শুনিয়াছিলেন।
“বউ, গান বল–”
যশোবতীর চক্ষুদ্বয় বিস্ময়ে ভরিয়া গেল, জীবনে এই বোধহয় প্রথম হাসি আসিল, পাছে অন্য কোন লোক তাঁহার হাসি শুনিতে পায়, সেই হেতু মুখে সত্বর বস্ত্রপ্রদান করিয়াছিলেন। হাস্য সম্বরণ যখন হইল না তখন স্বামীর দেহের পাশেই মুখ খুঁজিয়া কুকুর কুণ্ডলী থাকিয়া হাসিতে লাগিলেন। বৃদ্ধ সীতারাম ইহাতে উৎসাহিত বোধ করিয়া গীত ধরিলেন, শুদ্ধবঙ্গভাষা অপহৃত হইয়াছে, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা দিয়া শব্দ উৎসারিত হইতে লাগিল। রেনিটি’র ঘরের কীৰ্ত্তন ‘কি হে বাঁশী বাজায়, বধূ’ এ গীতের অন্যকলি অস্পষ্ট, ক্রমাগত ‘বধূ’ই শুনা গেল। আর যে যখন তিনি খাদ হইতে (!) স্বর আনিবার চেষ্টা করিতেছিলেন তখন একনিষ্ঠ গাম্ভীর্য্য মুখ চোখে ঠিকরাইয়া প্রকাশ পাইল। বৃদ্ধ থামিয়া যুগপৎ হাসিতে ও নিঃশ্বাস লইতে লাগিলেন। যশোবতী অন্যদিকে মুখ করিয়া থাকা সত্ত্বেও যেন স্বামীর দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন এবং মধ্যে মধ্যে হাসিতেছিলেন।
সীতারাম উত্তেজনায় অস্থির, এইবার ‘কালীয়দমন’ যাত্রার একটি টপ্পা ধরিলেন। “বলি পরাণ বাঁশী ফেলে দাও, আমাকে মজিও না প্রাণ তোমাতে মজাও”–এই মধ্যরাত্রে গঙ্গাযাত্রী বৃদ্ধের বুকে পীতধড়া বনমালা পরিহিত কালো ছোঁড়ার চাপল্য জোয়ার হানিল। আশ্চৰ্য্য হাতের ফেরতাই দেখা দিল, তেহাই পড়িল এবং সঙ্গে সঙ্গে হিক্কা উঠিল। যশোবতী তখনও হাসিতেছিলেন।
তিনি এই ভয়ঙ্কর পরিবর্তনের কথা কোনক্রমেই জানিতে পারেন নাই। আপনার কোমরের কষি আলগা হইল, তিনি উঠিয়া স্বামীর এই বিকট মূর্তির দিকে চাহিয়া যেন ফুলিয়া উঠিলেন। বস্ত্রের কষি হইতে হস্তদ্বয় মুক্ত করিয়া তাঁহার বুকে হাত বুলাইতে লাগিলেন, কি করা কর্তব্য তাহা তিনি জানিতেন না।
.
অতি প্রত্যুষে কুশণ্ডিকা হইয়া গেল। ঢাকি বাহক সকলেই চলিয়া গেল। বৃদ্ধের পৃষ্ঠের রক্তিম নারায়ণ-চিহ্ন তখনও নববধূর চোখে ভাসিতেছিল, কখন স্রোত কভুবা মৎস্যের লাফান তাঁহার দৃষ্টিপথে
পড়িয়াছিল। কোন কিছুকে অর্থ করিবার মত তাঁহার মন ছিল না।
লক্ষ্মীনারায়ণ গঙ্গার নিকটে বসিয়া যশোবতাঁকে উপদেশ দিতেছিলেন। পুরাকালের রমণীগণের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের মহিমা কীৰ্ত্তন হইতেছিল। যশোবতী একদৃষ্টে পিতার কথা শুনিতেছিলেন, এই চাহনির মধ্যে এতেক সরলতা ছিল, যে…লক্ষ্মীনারায়ণের মনে হইতেছিল, যশোবতী তাঁহার কথা ঠিক বিশ্বাস করিতেছেন না, ফলে তিনি ঈষৎ নির্বোধ বনিয়া ঘোট ঘোট অঙ্গ ভঙ্গিমায় তাহা ঢাকিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন।
“বাবা” যশোবতী ডাকিলেন।
গঙ্গার হাওয়া এবং জলোচ্ছাসে যে রৌদ্র, তাহা উচ্চারিত বাক্যটিকে লিখিত করিয়া দেয়; এ কারণে যে যশোবতীর ‘বাবা’ কথাটি বলার ভঙ্গিতে যে নিঃসঙ্গতা ছিল, যে নিঃসঙ্গতায় বাদল ছিল, যে বাদলে আদিম উষ্ণতার হেত্বাভাস–তাহা তাঁহাকে, লক্ষ্মীনারায়ণকে, বিবৃত করিয়াছিল।
লক্ষ্মীনারায়ণের মনের কোথাও যেন সে কথা, শিশুসুলভ হাতের নরম স্পর্শ করিয়াছিল, ব্রাহ্মণদেহে যোগসাধনার ধারা বর্তমান, মূঢ় জনের মত অল্পেই হা-হা করিয়া কাতর হইয়া উঠে না। কারণ মনে পাণ্ডিত্যের ধারা বর্তমান, তবু প্রবহমান গঙ্গার দিক হইতে সুযোগ বুঝিয়া দৃষ্টি ফিরাইলেন। কেননা সেখানে, এ গঙ্গায় উপত্যকার অন্তস্থিত পার্বত্য ছায়ায় যে মাতৃত্ব উৎপন্ন উৎসাহিত উৎসারিত বর্ধিত হয়, তাহারই দ্বাপরকালিক আভাস ছিল!
ইদানীং সে গঙ্গা–শিবের জটা বহিয়া যাহা নামিয়াছে, যাহাতে কোন গল্প নাই–তাহা, পিতা ও কন্যার ইতঃমধ্যে সঞ্চারিত। যশোবতী স্বচক্ষে সেই পবিত্র স্রোতেধারা দেখিয়াছিলেন; এখন মুগ্ধ, তিনি মনে মনে আকাশ লইয়া খেলিতে মুখর বাত্ময়; যে অমরতা লইয়া ইহজগত, তাহার আলো তাহার পুষ্পরাশি নয়ছয় করিয়াছে, কাব্যে যাহা ছন্দ-মিলের ধ্বনি মাত্র, সুশীল ও সুবোধ মানুষের মৃত্যুতে যাহা সান্ত্বনা বচন, তাহা, এখন, এই খেলার বস্তু এবং যাহা যশোবতী অবোধ পৃথিবী হইতে সংগ্রহ করিয়াছিলেন। তিনি অন্যমনস্কা অথবা সংস্কারবশতভাবে ডাকিলেন, “বাবা।”
এই সম্বোধনের মধ্যে ত্রিসন্ধ্যা এক হইয়াছিল! লক্ষ্মীনারায়ণ অন্ধকার হইয়া নিশ্চিহ্ন, ক্রমাগত গ্রহনক্ষত্রের স্বভাব সুলভ আবেগসঞ্চার তাঁহাকে কেন্দ্র করিয়া দৃঢ় হইয়া উঠিল, যাহাকে নিগ্রহ করিতে তিনি শক্তিহীন। তাঁহার মন যুক্তির জগতের জন্য চঞ্চল; সেখানে শস্যের জীর্ণতা মনকে সহজ করিলেও মন বীজকে সাদরে রাখে, জীর্ণতাকে সঙ্গোপনে লালন করে। লক্ষ্মীনারায়ণ অগোচরে আপনার নাম, নিজেই, ধরিয়া ডাকিয়া পরে কহিলেন, “মা গো, সব কপাল! তুমি সীতাকে জান মা, রাবণবধের পরে রাম তাঁকে ত্যাগ করেন সীতা সহ্য করলেন, লক্ষ্মণ চিতা সাজালেন…মে হৃদয়ং নিত্য নাপসৰ্পতি রাঘবাৎ, কোন ক্রমেই তাঁর মন রাঘব থেকে ছেড়ে যায়নি। মা আমার কত ব্যথা সহ্য করেছিলেন, তবু পতিভক্তি…” লক্ষ্মীনারায়ণের চোখে জল আসিল। নিশ্চয়ই পৈতা দিয়া চোখ মুছিলেন।
যশোবতীও পিতার চক্ষু মুছাইয়া কহিলেন, “তুমি তুমি…” আর কিছু বলিতে পারিলেন না। অথচ নির্ভীক গম্ভীর সুন্দরী মনোরমা যশোবতী বলিতে চাহিয়াছিলেন, ‘পিতা তুমি আমাকে সনাথ করিয়াছ– ইহা হইতে আর কি রমণীর প্রেয় হইতে পারে; তিনি ঊর্ধ্বে আছেন ইহা আমি জানিতাম, পরে অন্তর্যামী জানিয়াছিলাম, এখন…’ বলিয়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়াছিলেন–যাহা ডালিমের বেদনাময় যৌবনের দ্বারা সম্ভব। কারণ এ সময় শোনা গেল, চণ্ডাল হাঁকিতেছে, “ঠাকুর এস, এস হে। এখুনি আবার যাত্রী আসবে…গো।”
বৈজুনাথের ডাকে লক্ষ্মীনারায়ণ যেন বা মুক্ত আকাশ দেখিলেন, কন্যাকে তদবস্থায় রাখিয়া কয়েক পদ আসিয়া মনে হইল যেন আপন গৃহদ্বারে পৌঁছিয়াছেন। নিশ্চিন্তভাবে খানিক দণ্ডায়মান থাকিয়া সহসা ঘুরিয়া দেখিলেন, যশোবতী সীতারাম হইতে এখন দূরে।
লক্ষ্মীনারায়ণ কন্যাকে ডাকিলেন। যশোবতী বলিলেন, “বাবা আমি এখানে…”।
“ছিঃ ছিঃ অমন ক’র না, লোকে কি বলবে? তোমার দুই ছেলে রয়েছে…তাছাড়া যেটুকু সময় পাও স্বামীসেবা কর মা…।”
যশোবতী স্বামীর নিকটে গিয়া বসিলেন।
.
বৈজুনাথ এ জমিকে প্রণাম করিয়া চিতার মাপ লইতে লাগিল। মাটির উপর হামাগুড়ি দিয়া হাত মাপিতে মাপিতে অনেক দূর পর্যন্ত গেল; খুঁটি বসান হইল, সে গান গাহিয়া উঠিল, সে গান, “যে দেশে রজনী নেই মা, সেই দেশের এক লোক পেয়েছি”। দাঁড়াইয়া হাঁটু ঝাড়িয়া খুব বিজ্ঞের মত কহিল, “বেশ হয়েছে, লাও এবার নিকিয়ে ষটকোণে বীজমন্ত্র লেখ…জয় গুরু!”
“মর হারামজাদা! ওরে চাঁড়াল, চিতাটা যে একটু বড় হল, তোর কি মনে হয়?”
“চিতা বড় হবে কেনে…উত্তর দক্ষিণে গঙ্গা, একজন জ্যান্ত…শালা হাওয়া ভারী খচ্চড় জাত, জ্যান্তই থেকে যাবে…তখন হা হুতাশ…করবে কে…” এই বলিয়া পুনৰ্ব্বার হাঁটুতে হাত দিল।
“লে শালার আবার মায়া ফুকারি…” অনন্তহরি ছ্যাঁচড়া কণ্ঠে বলিলেন।
বৈজুনাথ রুখিয়া উত্তর করিল, “না শালা আমরা কাঁদি না, মুতি–চোখে ত জল নেই।”
“আঃ আস্তে আস্তে, আমার মেয়ে রয়েছে বসে…তোর একটা…”
“ওহো এখনও ত তার নাড়ী আছে ঠাকুর…”
“হারামজাদা তোর জ্বালায় পৃথিবীতে কি চন্দ্র সূৰ্য্য উঠবে না…মারের চোটে…”
“বাবু তোমাদের থেকে উঁচু জাত নেই…যারা…আচ্ছা আচ্ছা ঠাকুর, বুড়ো আর কনে বউ যদি…” বলিয়াই বৈজুনাথ যশোবতীর দিকে তাকাইল। ঘাসে মুখ রাখিয়া হরিণী যেমত চাহিয়া থাকে, সেইরূপ দৃষ্টি দেখিতে পাইয়া সে থ’ হইয়া গেল। সে বলিতে চাহিল, “আচ্ছা সারা দুনিয়ার লোক মিলে যদি হা-হুঁতাশ করে, আকাশে কি তাহলে টেলিগ্রাফ হবে?’ পরক্ষণেই অতি সন্তর্পণে মুখ ফিরাইল। স্বগত উক্তিতে ওষ্ঠ কম্পিত, অস্পষ্ট পাখোয়াজের বোল শুনা যাইতেছে।
ব্রাহ্মণেরা সকলেই প্রশ্ন করিল, “কি রে…”
“না, ভাবছি বাবু…”
“ভাবনার কি আছে…” কৃষ্ণপ্রাণ কহিলেন।
“বাবুমশায় সুখে পুড়তে পারে সেটাও ত দেখতে হবে…। আমার মতে চিতা আরও বড় দরকার…”
মুখভঙ্গী করিয়া অনন্তহরি কহিলেন, “তুই শালা কাঠ দিবি? শালা আমার খাঞ্জা খাঁ। এত কাঠ পাবে কোথায়…”।
“বাড়ীর খরচার মত কাঠ লোকে জমা রেখেছে–তারা দেবে কেন?” কৃষ্ণপ্রাণ কহিলেন।
“ওই ত বলে কে…” লক্ষ্মীনারায়ণ শুধুমাত্র সায় দিলেন।
“লে লে চিতা ছোট কর…”
“ভাবছ কেনে গো, কত কর্পূর আসবে, মাখন ছুঁড়বে, এইটা সতীদাহ বলে কথা! এ কি তোমার আমার লাস? পুড়ল না পুড়ল কি এসে গেল? মড়ার মুখ থেকে ছাগল পিণ্ডি চাটবেক…”
বলিয়া সে গর্ব অনুভব করিল।
ব্রাহ্মণেরা সকলেই মুখ বিকৃত করিয়াছিলেন। বৈজুনাথ একের পর এক সকলের মুখের দিকে তাকাইয়া নিজের মধ্যে যেন ফিরিয়া গেল। অনন্তর গভীর নিঃশ্বাস ত্যাগ করত কহিল, “কত সোনা পড়বে, ইঃ–সতীদাহ বলে কথা।” বলিয়া সেই ভাবেই দাঁড়াইয়া রহিল, পরক্ষণেই অদূরে দেখিল, সেই সীতা-স্মৃতি নয়নযুগল।
এহেন দৃষ্টি তাহাকে যেন আকর্ষণ করিতেছিল; সে, চণ্ডাল বৈজুনাথ, আপনার অজ্ঞাতেই দুই এক পা আগাইয়া গেল। ব্রাহ্মণ সকলেই, তাহাকে সচেতন করিলেন। সে অন্যমনস্কভাবে ঘুরিয়া দাঁড়াইল, সম্মুখের উচ্চবর্ণের মুখগুলি সে এমত দৃষ্টিকোণ হইতে দেখিয়াছিল, যাহাতে প্রত্যেকেই তাহার কাছে বীভৎস প্রতীয়মান হয়। ইঁহাদের, ব্রাহ্মণদের, সাধারণ কথাবার্তায় কলহরত খানকীদের আওয়াজ ছিল; সে আপনকার ভারাক্রান্ত মুখোনি উঠাইবার চেষ্টা করিল, আবার প্রয়াস পাইল; একারণে যে, সে অদ্য ফুটন্ত ফুলের বীরত্বের উপর দিয়া বহমান একটি কাকলী শুনিল, এই পাখী হলুদ, অভিমানী বধূদের কথা কহিতে অনুরোধ করে। মনে হইল তারা, কাহারা বাতায়নে দাঁড়াইয়া সুদূরতা দেখে।
ইতিমধ্যে কে যেন কহিল–”তাহলে…কি হবে…?”
“আর মাপের দরকার নেই…”
“খেলা করবার জন্য মাপ নেওয়া হচ্ছে.” এই উষ্মপ্রকাশ করিয়াই তৎক্ষণাৎ লক্ষ্মীনারায়ণ মিষ্টকণ্ঠে কহিলেন, “নে বাবা…কত কাঠ লাগবে বল, সেই অনুপাতে কাঠ যোগাড় করতে হবে ত…!”
চণ্ডালের চোখে জল ছিল না, তবু যেন তাহার মনে হইল তাহার চোখে জল আছে, সে হাত দিয়া চক্ষু মুছিয়া কহিল, “বললাম হে…তুমি গুঁড়ি দশ বার যোগাড় কর, চেলা ক’গাড়ি আর যারা আসবে সবাই কাঠ আনবে বয়ে গো। আগে আমার মনে পড়েনি…তুমি…”
“না না…খুঁটি ছোট কর…”
চণ্ডাল আবার মাপিতে হামাগুড়ি দিতে বসিল, দুই হাত মাপিয়াই সে স্থির; এক অনৈসর্গিক অনুভব বৈজুনাথকে আকাশ বাতাসের সংস্পর্শে আনিয়া দিল, মাটির প্রতি গভীর মনোযোগে একনিষ্ঠ একাগ্রতা সহকারে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল, কাহাকে যেন সে দেখিতে পাইয়াছে–শাস্ত্র যাহাকে ভাবময় তত্ত্ব বলে, তাহার সহিত সে অনায়াসে কথা কহিতে পারে। সে অবাক, সে অভাবনীয় স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করিল, অনন্তর আপন ধীর কণ্ঠস্বরে তাহাকে গল্প বলিতে সুরু করিল, “রাম নামে অযযাধ্যার রাজার পুত্র ছিল…” এসময় দৃশ্যমান মায়া অন্তর্ধান হয়, সে রুষ্ট হইয়া মহা আক্রোশে মাটিতে চপেটাঘাত করিল। নিজের ওষ্ঠদ্বয় কামড়াইতে লাগিল; মনের মধ্যে অগণন কালো সাদা দেখিল, তাহার অর্থ এই হয় যে ‘এ মাটি আমার আমি তার–’ এক মুহূর্তের জন্য মুখোনি জন্তুর মত বাঁকা করিয়া দণ্ডায়মান ব্যক্তিদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, আরবার যশোবতাঁকে দেখিল। ইহার পরে তাহার বিরাট দেহটা উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে, সে হাঁটু ঝাড়িতে ঝাড়িতে কহিল, “আমি পারব না…চিতা করতে।”
“সেকি…বেটা মহাপাতক হবি রে।” পলকের জন্য যশোবতীর দিকে চাহিয়া লইয়া সে কহিল, “আমার খিদে পেয়েছে…”
পুনরায় সে কহিল, “আমার খিদে পেয়েছে।” ইহার অর্থ আধ্যাত্মিক, বৈজ্ঞানিক না ভৌতিক তাহা কেহ নির্ণয় করিতে সময় ক্ষয় করিলেন না।
“কেন চণ্ডাল হয়ে জন্মেছিস জানিস, তুই বেটা জাত বজ্জাত…তোর পাখা উঠেছে…”
বৈজুনাথ কোন উত্তর করিল না। তাহার গতি আসন্ন-প্রসবা গাভীর মতই ভারাক্রান্ত, কখনও বা সে শান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। আবার চলিল, গঙ্গার জল মাথায় দিল।
সম্ভবত, রাত্র দিন যদি সত্য হয়, তাহা হইলে, সালঙ্কারা যশোবতী ইহা দেখিয়াছিলেন। উহা বৈশাখের শূন্য প্রান্তরের দ্বিপ্রহরের নভ-আগত নূতন ধূলার সূর্যমুখী ঘূর্ণি যেমত স্পন্দিত একটি দেহ বৈভব–যাহার অন্তরীক্ষে নরকপাল এবং অন্য অন্য অস্থিনিচয় এবং বহির্দেশে, পাহাড়ী গ্রামের নিরবচ্ছিন্ন অপরাহু! অবশ্য যুগপৎ যশোবতীর সমস্ত দেহমন বৈজু-আলোড়িত গঙ্গা হইতে ভগবানের পূৰ্ব্বত কণ্ঠস্বর শুনিল।
অনন্তর বৈজুনাথ গঙ্গা ত্যাগ করিয়া বিমূঢ়ভাবে সকলকে দেখিয়া বিড়ালের মতই চক্ষুদ্বয় সঙ্কীর্ণ করে এবং পরক্ষণেই এক দৌড়ে আপনার আড়ায় গিয়া রক্ষিত ঝাঁপা হইতে তরল জ্ঞানহীনতা পান করিল।
সমবেত ব্রাহ্মণগণ বৈজুনাথের ব্যবহারে যারপরনাই আশ্চৰ্য্যান্বিত; কিছুকাল অতিবাহিত হইল, অনন্তহরি কহিলেন, “ওর জন্যে ভেব না, বেটা নেশাখোর… কাঠ এসে পড়লেই সব ঠিক হবে…তুমি আর দাঁড়িও না খুড়ো।”
কৃষ্ণপ্রাণ তাঁহার কথায় সায় দেওয়াতে লক্ষ্মীনারায়ণ কালবিলম্ব আর না করিয়া আপন কন্যার কাছে। আসিলেন, যশোবতী তখনও সেইভাবে বসিয়া আছেন। পিতা কন্যাকে দেখিয়া চমকাইয়া উঠিলেন, কেননা যশোবতাঁকে অপরিমিতা কৃষ্ণবর্ণা দেখাইতেছিল; তথাপি তিনি কোনমতে অসংলগ্নভাবে অনেক। কথাই কহিলেন, “কি মা, বেশ ভাল লাগছে ত…যাক সব ভালয় ভালয় হল। মা, ভগবানকে ডাক…মন। বসছে ত মা…তিনি বল দেবেন, আমি…আমি এবার যাব।” পিতা যেন আদিমতা।
“বাবা…”
“কোন ভয় নেই, তোমার পুণ্যে মাগো–আমাদের স্বর্গ বাস হবে, মৃত্যু মরণ যদি…কেউ আগে, কেউ পরে; আবার এমনও হতে পারে” বলিয়া জি কাটিয়া কহিলেন, “সীতারাম পুনর্জীবন লাভ করতে পারে…তোমার কপাল জোর” বলিয়াই নিকটে অপেক্ষমাণ ব্রাহ্মণদের সমর্থনের আশায় তাকাইলেন।
তাঁহারা, ব্রাহ্মণেরা, ইহাতে পুঁথিগত মস্তক আন্দোলন করেন। ইহার পর তাঁহাদের মৃত্যু সম্পর্কে অসংখ্য যোগের প্রেরণা, যুবতীজনের বক্ষের বসন্তকে ভিখারী মায়াবাদে সম্মোহিত করিল; কিন্তু একথা প্রকাশ থাক, কিছু পূর্বাহে–যখন লক্ষ্মীনারায়ণ তাঁহাকে কৃষ্ণবর্ণা দেখেন, তখন তাঁহার কন্যার চতুর্থ অবস্থা আগত; ফলে, যশোবতীর কেমন এক বিশ্বাস হইয়াছিল যে তিনি নিজেই সাধক রামপ্রসাদকে বেড়া বাঁধিতে সাহায্য করিয়া থাকিবেন। এবং একারণে এখনও সৰ্ব্ব দেহে বিদ্যুৎ খেলিতেছিল। তিনি আপনার সেই অন্তরঙ্গতা লইয়া ইহাদের স্নেহ বচন শুনিতেছিলেন, এমত সময়ে তাঁহাদের বাক্যে সতীমাহাত্ম্য গৰ্জন করিয়া উঠিল–কৃষ্ণপ্রাণ যথাযথ অলঙ্কার দিয়াছিলেন।
যশোবতী কৰ্ত্তব্যবশে একদা স্বামীর প্রতি অবলোকন করিয়া ভাবিলেন, জীবন যৌবন দিয়া অমোঘকালের সহিত যুদ্ধ আর কতকাল! ঝটিতি তাঁহার সম্মুখে উদ্ভাসিত হইল জগজন-চিতচোর। নারায়ণ, শ্রীকৃষ্ণ সাক্ষাৎ পূর্ণব্রহ্ম, তাঁহার মুকুটের ময়ূর-পুচ্ছে ইহলৌকিক যোনি-চিহ্ন!
.
যশোবতীর দৃষ্টিপথে, মানস চক্ষে, কল্পনায়, সতীদাহ অনুষ্ঠান ভাসিয়া উঠিল; অনেক সতীদাহ দেখিয়াছিলেন, সুতরাং তাঁহার পক্ষে এ কল্পনা কষ্টসাধ্যের নয়। দেখিলেন, অসংলগ্ন অনেক রূপ কৰ্ম্ম ভাসিয়া উঠিল, কখন আপনার প্রায়শ্চিত্ত পিণ্ডদান কখন বা আপনার তর্পণাদি উদক ক্রিয়ার নিমিত্ত, গঙ্গা অভিমুখে ধীর মন্থর গতিতে তিনি গমনশীলা, এ গতি অতীব সুদারুণ। প্রতি পদক্ষেপে অতীত পদদলিত হইতেছে, সম্মুখে জাগ্রত অবস্থামাত্র। তিনি যেমত বা নীড়ৈকলম্পট শ্যেনপক্ষীর ন্যায়, ক্রমাগতই ধাবমান। এখন ত্রিতাপহারিণী গঙ্গায় তাঁহার সুন্দর তড়িৎ-সম্ভবা তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ দেহের অধোভাগ নিমজ্জিত, সুখস্পর্শ হস্তের অঙ্গুলিতে কুশ অঙ্গুরীয় ইদানীং কিয়ৎ পরিমাণে আপনাকে ভেদজ্ঞানে রাখিয়াছে, দ্বিবিধবোধের মধ্যে তাঁহার চেতনা অলস। একদিক আয়ুষ্মান্–অন্যপক্ষে রথের শব্দ, শূন্যে পক্ষীরা উড্ডীয়মান।
সহসা বায়ু স্তব্ধ, আলোকরশ্মি বস্তুরূপ ধারণ করত ধ্বংসপ্রাপ্ত, দুঃখ অস্ফুট আঃ ধ্বনি সহকারে লুপ্ত হইল। আতপ-তপ্ত পদ্মের ন্যায়, পরিক্লিষ্ট উৎপলের ন্যায় ধূলামলিন স্বর্ণের ন্যায় যশোবতী, মুখমণ্ডল তুলিয়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করত চাহিলেন, পারিপার্শ্বিক দিকসমূহে শূন্যতা মেঘসন্নিভ; কাব্যঘন কিছুকাল পূৰ্ব্বের আপনার গাত্রহর্ষে লোক চরাচর যে আবেগে স্পন্দিত হইয়াছিল, তাহারই ক্ষীণ, সূক্ষ্ম, ম্লান, ধীর, অস্পষ্ট, অল্পকম্পন তরঙ্গস্তর এখানে পরিব্যাপ্ত। পিতৃলোকগত যশোবতী! আপনাকে আহ্বান করিতে গিয়া স্বপ্নহীন; তাঁহার ওষ্ঠদ্বয় কম্পিত হইল–সঙ্গে সঙ্গে বনান্তরাল চমকিত সবুজতা ফুসিয়া উঠল, অন্তঃসত্ত্বা সর্পের গর্ভপাত হইল। শ্রাবণমেঘের কিশোর বজ্র সকল দিত্মণ্ডলে ইতস্ততঃ ছুটাছুটি করিতে লাগিল।
যশোবতী নির্বিকার, গঙ্গার শৈত্য আর নাই, কুশ অঙ্গুরীয় অজগলস্তন; গম্ভীরকণ্ঠে কহিলেন, “তুমি পিতৃলোকে গমন করিয়াছে, মদ্দত্ত সুনির্মল স্বচ্ছ জল গ্রহণ কর”, বলিতে ‘তুমি’ শব্দ উচ্চারিত হইল না, বলিলেন, “আমি পিতৃলোক গমন করিয়াছি মদ্দত্ত সুনির্মল জল গ্রহণ করি…” এসময় তাঁহার স্বরভঙ্গ, জিহ্বা কণ্ঠগত শুষ্ক হইয়াছিল, স্তন্যপানে সুতৃপ্ত ধ্বনির ন্যায় তাঁহার কণ্ঠস্বর বিশ্বসংসারে আলোড়িত হয়। ক্রমে আপনার মুখগহ্বরে সকল কিছু দান করিতে গিয়া হচেতন হইয়া গঙ্গায় পতিত হইলেন। সকলে তাঁহাকে কোনরূপে গঙ্গা হইতে উদ্ধার করিয়া এখানে আনিল। জ্ঞানের পর তাঁহার ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু হাস্য ছিল।
চতুর্দোলার আসনে যজ্ঞবাট করা হইয়াছে, চারিভিতে ছোঁড়া কদলীবৃক্ষ লাল সূতা দিয়া গণ্ডীবদ্ধ, উপরে মালাকার মেঢ় ঝুলাইতে ব্যস্ত, প্রতিটি মেঢ়ে দশমহাবিদ্যার এক এক রূপ আলেখ্য, শেষ কয়েকটি মালাকরের ছেলেরা আঁকিতেছে, তাহাদের বধূরা ফুলমালা গাঁথে, ধান্য কঙ্কন, খৈয়ের সাত নহর তৈয়ারী হয়। দিকে দিকে হরিধ্বনি, কাঁসর ঘণ্টা ঢাক বাজিতেছে, পক্ষীরা ভয়ার্ত পলায়মান, গাছে গাছে ‘চালকা’ কাপড়ের নিশান উড়িতেছে। কীৰ্ত্তন হয়, কোথাও খাঞ্চে করিয়া সামলা মাথায় একজনা। ঢপ গাহিতেছে, তাহার সামলার চুমকী পুঁতি আবেগে চঞ্চল। সিন্দুর বিক্রেতা গেরী মাটিতে লা। মিশাইয়া ভাটি বসাইয়াছে; নূরীরা রুলী গড়ে, তাঁতিরা এবং কাঁপালিরা সূতা কাটিয়া আলতায় রঙ করিতেছে, ছুতার আপন মনে তুলসীমালা গাঁথিতে ব্যস্ত; বাটাদার কড়ির পাহাড় করিয়াছে; লোয়াদার বাতাসাওয়ালারা একদিকে বাতাসা কাটিতেছে (যাহা অসম্ভব কারণ লোয়াদা এইস্থান হইতে, পদব্রজে, প্রায় চল্লিশ মাইল)। পুণ্যলোভী স্ত্রীলোকেরা স্থানচ্যুত হইবার আশঙ্কায়, পার্শ্ব পরিবর্তন পর্য্যন্ত করিতেছেন না, ফলে অনেকেই স্থান অপবিত্র করিতেছেন। কেহ কেহ উত্তম স্থানের লোভে দৌড়াদৌড়ি করিতেছেন। ব্রাহ্মণেরা শশব্যস্তে পাঁজী পাঠ করিতেছেন, অন্যান্যেরা পরামর্শে নিশ্চল, সহসা নস্য লইয়া পুনৰ্ব্বার শাস্ত্রীয় বুদ্ধিযুক্ত। যশোবতী একভাবে বসিয়াছেন, বর্গভীমা মন্দিরে ইষ্টকে প্রতিমা উল্লিখিত ভঙ্গীতে; অভিজাত গৃহের রমণীরা তাঁহাকে সাজাইতে ব্যস্ত, তাঁহারা আপন আপন গৃহ হইতে প্রসাধন সামগ্রী আনিয়াছেন, গোলাপ-পাশে সূক্ষ্ম কারুকার্য্য, ইঁহাদের আনীত দর্পণের পিছনে কলাইকৃত প্রসাধনরত রাধা প্রতিমা, জড়োয়া সুখপক্ষী অঙ্কিত কাজললতা। স্বর্ণভৃঙ্গার হইতে তাঁহাকে উম্মল-পানি দেওয়া হইতেছে, তিনি সহাস্যবদনে তাহা পান করিতেছেন এবং তাঁহার চক্ষু আরক্ত। হায় মোহিনী মায়া! গোলাপের সহচরী, ফলে গোলাপের ম্লান তাঁহাকে পাইয়াছিল। নিকটে বন্ধ-চিত্র জাঁতি দিয়া একজন গুবাক কাটিতেছেন। জাঁতির সুরত ক্রীড়ারত স্ত্রী-পুরুষের হেবজ হাস্য, লোকক্ষয়কারী প্রবৃদ্ধকালের অহঙ্কারকে চূর্ণ করিতেছে! এয়োস্ত্রীগণ চুল দিয়া পথ মার্জনা করিলেন, জল সিঞ্চিত হইল। অধুনা যশোবতী চতুর্দোলায়, তিনি যেন লক্ষ্মীমূৰ্ত্তি, একহস্তে প্রস্ফুটিত পদ্ম, কখনও বা দেখিলেন পঞ্চ পল্লব, অন্য হাতে বরাভয়। যশোবতী ইদানীং সাক্ষাৎ চম্পক ঈশ্বরী। তাঁহাকে নামান হইল। হাজার হাজার স্ত্রী শরীর তাঁহার পায়ের কাছে কাছে গড়াইয়া পড়িতেছে। কাহারও মস্তকে তাঁহার পা পড়িয়া পিছলাইতেছে; কোন কোন রমণী অজ্ঞান হইতেছেন। কত শাঁখা তাঁহার পায়ে লাগিতেছে সিঁন্দুর পড়িতেছে। চতুর্দোলা হইতে নামিবার পরে অনেকেই তাঁহার স্মৃতি সংগ্রহের জন্য কেশ আকর্ষণ করিতে তৎপর…, একটি একটি চুল গেল, অনেক কিছুই গেল, ক্রমে বীভৎস রূপ ধারণ করিলেন। তিনি দৌড়াইয়া চিতায় উঠিলেন…অগ্নি সংযোগ করা হইল, শাঁখা কড়ি স্বর্ণালঙ্কার উড়িল। লেলিহান শিখায় গৃহাভিমুখী সুখপক্ষীর দল ছত্রাকার, কোনটি বা বিমোহিত হইয়া চিতার মধ্যে নিশ্চিহ্ন। প্রলয়ের শব্দ ধ্বনিত হইল। একটি রমণী তাঁহাকে দেখিয়া অচেতন হইলেন, ক্রোড়ের শিশু স্তন্যপান করিতে লাগিল আর কাঁদিতে লাগিল। চিতা হইতে দেখিলেন–পার্থিব মায়াবন্ধনে অধীর হইয়া একটি লোক লাঠির উপরে মুখ ন্যস্ত করিয়া আছে, আর কখনও কখনও লোকটির দৃষ্টি ধূম উদগীরণকে অনুসরণ করিতেছে।
যশোবতীর ভ্রম দর্শন অপগত হইল। তিনি যেন বা ঝুঁকিয়া পড়িতেছিলেন, কোনক্রমে টাল সামলাইয়া কহিলেন, “বাবা তুমি” বলিয়া লক্ষ্মীনারায়ণের কানে কানে কহিলেন, “ভয়!”ভয় বাক্যটিতে যে তৃণগুল্ম জড়াইয়াছিল তাহা সকলই কাঁপিয়া উঠিল।
“কোন ভয় নেই মা, তোমার ছেলেরা রইল, আমিও যত তাড়াতাড়ি…”
যশোবতী আশ্বস্ত হইলেন।
লক্ষ্মীনারায়ণ অন্য পার্শ্বে, বেলাতটে শায়িত বলরাম ও হরেরাম উদ্দেশ্যে কহিলেন, “তোমাদের বাড়ীতে কি খবর দেবে…।”
“একটা খবর…চিড়ে গুড় ত বহু আছে…এখন,…থাক আপনি তাড়াতাড়ি আসবেন” বলরাম কহিল।
৪. সীতারাম চক্ষু বুজিয়াছিলেন
সীতারাম চক্ষু বুজিয়াছিলেন। তাঁহাকে বিরক্ত করা বাঞ্ছনীয় নহে। যশোবতী সম্মুখের কলাপাতা হইতে একমুঠা ধান্য লইয়া পিতৃঋণ শোধ করিবার কালে অসম্বরণ করিতে পারিলেন না। বন্ধনের সকল কিছু সামগ্রীর উপর তিনি ভাঙ্গিয়া পড়িলেন। লক্ষ্মীনারায়ণের বুক ফাটিয়া গেল, তিনি চোখের জল ফেলিতে ফেলিতে স্থান ত্যাগ করিলেন; অন্যান্য ব্রাহ্মণেরা তাঁহার জন্য ভেড়ীর উপরে অপেক্ষা করিতেছিলেন, এবং পরে তাঁহাদের আর দেখা গেল না।
একমাত্র, যশোবতী এই দিবালোকে, মানুষের সহজাত বেদনা লইয়া রোরুদ্যমানা, এ সময় একখানি ভয়ঙ্কর হাত তাঁহার চোখের সম্মুখে গাছ কৌটা এবং বিক্ষিপ্ত ধান্যের মধ্যে ভেকের মত স্তব্ধ। নড়িল। পাখীরা উড়িয়া গেল। হাতখানি যশোবতাঁকে আশ্বাস দিয়া উঠানামা করে, ধীরে আপন সম্বিতের সুক্ষ্মতার কলমকাটা পথ বহিয়া তাঁহার, যশোবতীর মুখমণ্ডলে উঠিল। এখনও তাঁহার মুখে চোখে ধান লাগিয়া আছে, তথাপি বৃদ্ধের দিকে তাকাইলেন, কাল আহত, বৃদ্ধ কুঞ্চিত, অভিজ্ঞ ওষ্ঠদ্বয় কম্পিত, তাহা হইতে, “আমি আছি…আছি.” একথা আসিল।
যশোবতী এই উক্তি আপনার ধর্মের ঘোরে বিশ্বাস করিয়াছিলেন; নির্ভরতা যাহাতে অনায়াসে তাহার মধ্যে প্রবেশ করিতে পারে, সেই হেতু আপনার চক্ষুদ্বয় স্ফীত করিলেন।
সীতারাম বলিলেন, “বউ বউ…জোর পাচ্ছি…”
যশোবতী উদগ্রীব আগ্রহভরে তাঁহার দিকে চাহিলেন; দেখিলেন, সীতারাম তাঁহার বাম হস্তের তর্জ্জনী কোনমতে নাসা গহ্বরের নিকটে লইয়া যাইতেছেন, পুনৰ্ব্বার কিঞ্চিৎ সরাইয়া আনিতেছেন, এদৃশ্য তাঁহার মত সুকুমারমতি যুবতীর মনে ক্লৈব্যের সঞ্চার করে, তথাপি তিনি নিশ্চলা। এহেন আশ্বাস লইয়া সুখনিদ্রার জন্য চক্ষুদ্বয় নিমীলিত।
.
তখন বৈকাল হইবে। সীতারাম বেশ তৎপরতা ফিরিয়া পাইয়াছেন, শিশু যেমন উর্দ্ধে হস্ত উত্তোলন করে তেমনি আপনার হস্তদ্বয় উঠাইবার চেষ্টা করিতেছিলেন। সহসা আপনার জানুর নিকটে শায়িত যশোবতাঁকে দেখিবার চেষ্টা করিয়া কহিলেন, “বউ, সকাল কখন হবে!” আশ্চৰ্য্য যে এই শব্দগুলি স্পষ্টই বাহির হইয়া আসিল। বৃদ্ধের আপনার কানে তুলা থাকা সত্ত্বেও নিজেই পরিষ্কার শুনিতে পাইলেন। এ কথাও তিনি বুঝিয়াছিলেন নিশ্চিত যে তাঁহার প্রশ্নের কোন অর্থ হয় না।
যশোবতী নিশ্চিত জাগ্রত ছিলেন, তিনি ধীরে চক্ষু উন্মীলন করিলেন। ইত্যাকার কথায়, কিছু মনে হইবার পূর্বেই দেখিলেন একটি অদ্ভুত লম্বা শলাকার মত চাবিকাঠি সমেত হাত তাঁহার দৃষ্টি সমক্ষে নড়িতেছে।
যশোবতীর হঠাৎ মনে হইল এ চাবি স্বর্গের নাকি’, এই সঙ্গে সীতারামের গলার স্বর, “মোহর মোহর”–সত্যই চাবিকাঠি নববধূকে পরিহাস করিয়াছিল, নিঃশ্বাস কাঙাল জীবনের কাছে ইহা ভ্রুকুটি মাত্র; জমি হইতে উচ্ছেদ হওয়া কৃষক যেভাবে আপনার জমিতে পা দিতে ভীতি অনুভব করে, সেইরূপ তাঁহার মনোভাব; পৃথিবী তাঁহার কাছে পারঘাটা বৈ অন্য কিছু নহে! অভিমানে ক্ষোভে যশোবতী উন্মাদ, তাঁহার রগ স্ফীত, স্বীয় চূর্ণ কুন্তলের নিম্নে নীলাঞ্জনছায়াকে তাঁহার রেশমী নখগুলি ক্ষত বিক্ষত করিল, রোমকূপে জোনাকি জ্বলিল; ক্ষিপ্ত হইয়া তিনি চাবিকাঠি লইয়া দূরে নিক্ষেপ করিলেন। চাবিকাঠি গঙ্গার প্রায় নিকটে পড়িল। যশোবতী আপনার ক্রোধ সম্বরণ করিতে অপারগ হইলেন, তাঁহার কল্যাণময়ী হস্ত বৃদ্ধের ব্যাকুল হস্তকে নিপীড়ন করিল! বৃদ্ধ শিশুর মত কাঁদিয়া উঠিলেন।
চাবিকাঠি গঙ্গার কিনারে পড়িবার সঙ্গে সঙ্গে বলরাম ছুটিয়া আসিয়া চাবিটি তুলিয়া লইয়া দৌড়াইতে আরম্ভ করিল। হরেরাম পিতাকে ক্রন্দনরত দেখিয়াও শুধু মাত্র প্রশ্ন করে, “মা, তুমি কি চাবিকাঠি…” আর কিছু জানিবার নাই, কারণ পলায়মান ভ্রাতাই তাহার সদুত্তর, সুতরাং সেও তাহার পশ্চাদ্ধাবনে ব্যাপৃত হয়।
.
দূরে বৈজুনাথ, এ দৃশ্য তাহার সমক্ষে ঘটিতেছিল! এবং সে নিমেষেই ভেড়ী পথে উঠিয়া দেখিতে লাগিল, ধাবমান দুই ভাই দৃষ্টির বহির্ভূত হইতেই সে সরল ভাবে হা-হা করিয়া হাসিয়া অতর্কিতে থামিয়া শ্মশানের দিকে তাকাইল, কেননা এমত সময়ে তাহার কানে ক্রন্দনধ্বনি পৌঁছায়।
বৃদ্ধের শিশুহারা রমণীসুলভ ক্রন্দন, নিকটস্থ সৃষ্টিসমূহকে, সৃষ্টির অন্তরীক্ষের সহনশীলতাকে, সহনশীলতার মধ্যে হিরন্ময় কোষকে, হিরণ্য কোষের সহজ তত্ত্বকে আগ্রহান্বিত করিল।
এবং যশোবতী–তাঁহার আত্মা যেরূপ দেহকে ভালবাসেন, দেহ যেরূপ আত্মাকে, এবং এই বিচ্ছেদশীল অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের গুণে বাহিরের জগতেও সাড়া দিলেন, তিনি বিচলিত। একথাও সত্য যে, তিনি অনুতপ্তা। ত্বরিতে তিনি উঠিয়া বৃদ্ধের ব্যথিত হস্তখানি যেমন বা শিশুহস্ত, তাহার ব্যথা মহা আবেগভরে আপনার কপোল দ্বারা ধীরে ধীরে অপনোদন করিবার চেষ্টা করিলেন। একারণে তাঁহার যৌবন-বিলাসপটু শরীর করুণা রসে পরিষিক্ত হয়।
বৃদ্ধ এখনও ক্রন্দনরত; যশোবতী সস্নেহে স্বীয় আঁচলপ্রান্ত দ্বারা তাঁহার চক্ষু মুছাইলেন, নাক মুছাইলেন, সহসা তিনি বুঝিলেন, যে বৃদ্ধ হাতখানি ঘুরাইতে চাহিতেছেন, ইদানীং বিচলিত যশোবতী তাঁহাকে সাহায্য করিলেন। সীতারামের হাত এখন তাঁহার গালেই ছিল, সুতরাং নববধূ স্মিতহাস্য করত মুখ আনত করিলেন।
অদূরে কাহার চিতা জ্বলিতেছিল, তাহারই আঁধার আসে। এবং এ-সময় বিরাট রাজসিক একটি দীর্ঘশ্বাস–স্বভাবত মেঘ দর্শনে উতলা, দূর পথদর্শনে প্রগম্ভ, নবোঢ়া দেহের বিসর্পিল চক্রান্ত ভাঙ্গিয়াই ক্রমে উঠিল; বৃদ্ধের হাত বাদুড়সদৃশ এবং তাঁহার, যশোবতীর কপোল–প্রত্যুষের প্রথম আকাশে যাহার উপমা–সেই কপোল অবলম্বন করত ঝুলিতেছিল।
যশোবতী যিনি স্বয়ং মোহিনী মায়া, তিনি অকাতর, এখন আর হায়া ছিল না, তাঁহার শূন্য দৃষ্টি চিতার প্রতি নিবদ্ধ; সহসা লক্ষ্য করিলেন যে সেই চিতার উপর দিয়া অর্থাৎ এক পার্শ্ব দিয়া একটি দৃপ্ত ভাবগম্ভীর মুখমণ্ডল উঠিতেছে, ফলে তিনি চকিত হইয়াছিলেন। কোথাও বা দগ্ধ অর্ধদগ্ধ দেহবিকারের পশ্চাতে এই মুখোনি, ঐশ্বৰ্যশালিনী নীলান্ধিবসনা এই ধরিত্রীর দাম্ভিক প্রতিভা যেমত বা। এই মুখমণ্ডলের বর্ণচ্ছটায় উদাত্ত ধীর গম্ভীর বেদগান ছিল; এ বেদগানের মধ্যে যেমন আনন্দ, আনন্দের মধ্যে যেমন প্রণাম, প্রণামের মধ্যে যেমন পুষ্পের রহস্য, পুষ্পের রহস্যের মধ্যে যেমন সরল রেখা– তাহা ওতপ্রোত হইয়া উদাত্ত, এতদ্ভিন্ন যুধিষ্ঠিরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উত্তরের রূপময় বাস্তবতা। পৃথিবীতে বার্ধক্য নাই, জরা নাই, একই ভাব স্থির। তদ্দর্শনে বালিকাবধূর শরীর যেমন বা আপনার মেরুদণ্ডে দৃঢ়ভাবে গাঁথিয়া যাইতে লাগিল।
বৈজুনাথ কোন এক শবদাহে ব্যাপৃত, কেননা শবযাত্রীগণ শব ফেলিয়া পলায়ন করিয়াছে।
সে চিতাগ্নির মধ্যে বীভৎস অঙ্গগুলিকে লাঠিদ্বারা একত্রিত করিতে করিতে কহিল, “হারে, মায়াকান্নায় ড্যাঙা ভাসে, লাস ফেলে পালান। …ওলাউঠো হোক ওলাউঠো…শাল্লা কান্নায় পোঁদের তেনা সপসপ করে, মরি কি মায়ার বাহার গো” বলিয়া অতঃপর অনতিদূরে গিয়া একটি কাষ্ঠখণ্ড তুলিয়া চিতায় নিক্ষেপ করিল, আর একটি খণ্ড উঠাইতেই এক অপার্থিব বিভূতি দর্শনে আপনার দমের ‘‘ আওয়াজ করিয়াই সে জ্ঞানরহিত, সে চলৎশক্তিহীন, অত্যধিক বিস্ময়ে মন্ত্রমুগ্ধ এবং একারণে দেহ বক্র, ওষ্ঠদ্বয় বিভক্ত, সময়ও দিকবিরহিত।
পশ্চাতে পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা জবুস্থবু, উর্ধে অম্বর, সম্মুখেই স্বামী-সোহাগলালিত যশোবতী, এ কোন ঘোর বাস্তবতা! এই কি পৃথিবী! তথাপি এ হেন দৃশ্যে গোলাপ ছিল, এ হেন দৃশ্যের স্বাদ ছিল। অন্যপক্ষে, লজ্জিতা যশোবতী ধীরে স্বামীর হস্তখানি নামাইয়া লইতে প্রয়াস পাইলেন, এবং নিজের বাম হস্তদ্বারা আপনার বক্ষের সুসজ্জিত বস্ত্রকে সুরক্ষিত করিলেন। বৈজুনাথ, তদৃষ্টে, জিহ্বদ্বারা আপনার ওষ্ঠ চিন্তিতভাবে লেহন করত হস্তধৃত কাষ্ঠখণ্ডে শ্বাপদ আক্রোশে থুথু দিয়া চিতায় নিক্ষেপ করিল। সে যেমত বা পরাভূত। মনে হয় ধরিত্রী যেন তাহার বাদ সাধিয়াছে।
সেইহেতু সে, বৈজুনাথ, মতিভ্রমে উন্মাদ। কণ্টকিত, ধৰ্ম্মশূন্য রূপচরিত্রহীন, তামসিক, অবিচলিত, খর পায়ে নবদম্পতির অভিমুখে যাইতেই প্রজ্বলিত চিতা তাহার পথ রোধ করিল।
প্রজ্বলিত চিতা তাহার পথ রোধ করিল; যে চিতা, যাহা দাহ্যমান, যাহা অনির্বাণ, যাহা শেষ, যাহা। বন্ধুহীন! বৈজুনাথ আপনার জিহ্বা দ্বারা আপন গাত্র বুলাইতে চাহিল। কিন্তু হায়, অমোঘ অবস্থা, শুধু মেদ গন্ধ, নিষ্ঠুর অগ্নি ও তাহার দাহিকা শক্তি আমাদের দেওয়া নাম ও বাস্তবতা–এক হইয়া ক্রমাগত সেখানে অঙ্ক কষিতেছে। এবম্প্রকার মহামারী অজর সত্য হইতে চক্ষু তুলিল, অথবা সত্য ক্ষণেকের জন্য নিমেষেই অচিরাৎ আপন মায়া অপসরণ করে, সে অনতিদূরে দেখিল।
উহারা কে এখন যাহারা এক! কোথাও তাহার, অবোধ কোমলাঙ্গ কৌমার্য রসময়ী, কোথাও বীজবৎ শুষ্ক, কভু পাণ্ডুর, হঠাৎ শুভ্র, পরক্ষণেই আরবার রক্তিম! এই অবাস্তব–এই কঠিন, অন্ধকারহীন। দাম্পত্যজীবনমিথুন তাহাকে এককালে অলৌকিক, এবং বিস্ময়ে আরূঢ় করিল–অদ্ভুত এক অনুভবে, যদিচ তাহা রম্য উপলব্ধি, সৰ্বাঙ্গ সঙ্গীন! চণ্ডাল বৈজুনাথের বিভ্রম ঘটিল হয়ত বা, চিতার অন্যধারে ইদানীং যে দাম্পত্য মাটি স্পর্শ করিয়া আছে–তাহা যেন তাহারই সমগ্র অন্তর! এখনও সে স্তম্ভিত, আচম্বিতে সে ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া কয়েক পদ অগ্রসর হয়। বেলাতটের ঐ দৃশ্য তাহাকে গুণ করিয়াছিল, সে কয়েক ছটা পিছু হটিল; তদনন্তর নিজের হস্তদ্বয় দেখিয়াই জন্তুর মত শব্দ করত ঊর্ধে লম্ফ প্রদান করিয়া ভূপতিত হইল।
এ হেন তেজোময় শরীর রৌদ্রকৰ্ম্মা আক্রোশে ঝটিতি ধরাশায়ী। ইহাতে শ্মশানভূমির ধূলিকণাসকল চমকিত, আর যে, তাহার পতনে স্থাবর জঙ্গম অতিমাত্রায় বিষাদগ্রস্ত; এই ঘটনার পিছনে কতটুকু অভিমান–যতটুকু অভিমানে পিতা কর্তৃক ধৃত স্বীয় হস্ত মুক্ত করিয়া যে কোন শিশু আপনার স্বাবলম্বন চায়। এখন বৈজুনাথের চক্ষুদ্বয় তমসাচ্ছন্ন, আঁখিপল্লব মুদিত, অনন্তর সে কোনক্রমে, সাহসে চোখ খুলিল, দেখিল। দৃষ্টি ফিরাইয়া ভয়ার্ত চোখে নৈকট্য, সান্নিধ্য, সাযুজ্য দর্শন করে–যাহার এক অংশ ব্রীড়া, অন্য অংশ জটিল বাস্তবতা! পতনের বেদনা এসময় তীব্র হইয়া দেখা দেয়, আর মাথা তুলিয়া থাকা সম্ভবপর নয়। সে ধীরে ভূমি উপরি আপনার মস্তক স্থাপনা করিল। সমগ্র বিশ্ব যেমন বা চক্রাকারে শরীরের মধ্যে ঘূর্ণায়মান, আপনার দেহগত ভাবনা তাহাকে বিশেষ আলোড়িত করিতে থাকিল। হায় সে সামান্য জীব–সে বড় দুঃখের! মন হইতে ভালবাসা ধীরে নিষ্ক্রান্ত হইয়া যে অধঃ মধ্য নভের অনৈসর্গিক মহিমা রহস্যে রূপান্তর লাভ করত পুনরায় সৌন্দৰ্য্য নামে প্রত্যাবর্তন করে, কোন সূত্রেই তাহা সে টের পায় নাই। অদ্যও : নির্বোধ, দিনের পর দিন মৃতকে লইয়া কালাতিপাত করিয়াছে। মড়া পুড়াইয়াছে।
এখন বৈজুনাথ কিয়ৎপরিমাণে সুস্থ; সে আকাশের দিকে মুখ রাখিয়া তাহার বজ্র-দেহটি মেলাইয়া দিল। অনেকক্ষণ এইভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর, সহসা বুঝিল, কাহার কণ্ঠস্বরকে সুগম সুস্পষ্ট করিবার নিমিত্ত সমগ্র শব্দ তরঙ্গ অনড়, নিথর এবং লোকচরাচরে কেহ নাই এবং শুধু ক্রমাগত একটি ‘ডাক’ ধ্বনিত হইতেছে। ঔৎসুক্যপরতন্ত্র চণ্ডাল তাহার মর্ম গ্রহণ মানসে একাগ্র। কে যেমন বা তাহাকে ডাকিতেছে, এবং আশ্চৰ্য্য তাহাকে ‘ও ঘুম, ও ঘুম’ নামে সম্বোধন করে। নিয়ত এই ‘ও ঘুম’ বাক্যটি শুনিতে শুনিতে তাহার চিত্তে দুৰ্যোগময়ী ঘোর সমুপস্থিত। তথাপি ইহা বোধ করি সত্য যে, তাহার সাড়া দিবার বাসনা জাগরূক হইল। এমত অবস্থায় সে অনুভব করে আপনকার দীর্ঘ ক্ষমতাবান শরীর যেমন বা কর্দম-স্বরূপ, অবলীলাক্রমে তাহার চক্ষুদ্বয় উন্মীলিত হইল, নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে অনেক কিছুই দেখিতে চাহিল কিন্তু পারিল না; আপনার বক্ষের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিল, দেখিল, তাহার নিঃশ্বাস বাত্যায় বক্ষস্থিত লোমরাজি শরৎকালীন ধান্যক্ষেত্রের মত ব্যস্ত; বেলাভূমির মাটিতে তাহার হাত দুইখানি আঁকড়াইয়াছিল। তাহার দৃপ্ত চোখের তারকায় সফরী চঞ্চলতা, তাহার অন্তরীক্ষ স্ফীত।
যদিও সে জাগ্রত, যদিও নরবসার গন্ধে এ স্থান পার্থিব, যদিও.বেদনা অনুভব এখনও তাহাকে নিঃশ্বাস লইতে সাহায্য করিতেছিল, তবু ইতিপূৰ্বের সৃষ্টিছাড়া ডাক তাহাকে কণ্টকিত করিয়াছিল। অনন্তর আপনার সম্পর্কে তাহার অসম্ভব সন্দেহ উপস্থিত হইল। তাহার অস্তিত্ব কেহ কি জানে! না সত্যই সে ঘুম! ঘোর বিপৎকালে মেঘঘটা যামিনীর তীক্ষ্ণ মুহুর্মুহুঃ বজ্রপাতে, অথবা ভূমিকম্পে আপনার কুশলবার্তা অর্থাৎ আমি আছি, এ বার্তা গ্রামান্তরে শঙ্খধ্বনি করত সে কখনই পৌঁছাইয়া দেয় নাই।
‘আমি কি ঘুম!’
‘আর জন্মে আমার নাম কি ঘুম ছিল?’ বৈজুনাথ, যাহার কোনদিন ভয় ছিল না অথবা যে কোনদিন ব্রাসিত নয়, সে ইদানীং যারপরনাই ভীত, শঙ্কিত, ত্রস্ত পাণ্ডুর। এ মহাশ্মশান, যেখানে সে একাকী, নির্ভীক কালযাপন করে, এখানকার রাত্র তাহার নিকট স্বাভাবিক যন্ত্র মাত্র। গঙ্গার জড়-মধ্যরাত্রের বায়ু সঞ্চালনে এ স্থানসমূহ যখন বিশ্রী তখন তাহার, বৈজুনাথের, বন্ধুগণ–ক্রীড়াসহচরগণ আইসে। বীভৎস, চৈত্যবৃক্ষ সম ভয়ঙ্কর প্রেত সকল মিলিয়া নৃত্য আরম্ভ করে, বিপুল আনন্দে দিগ্বিদিক অধৈৰ্য্য; কিছু দূরের নিদ্রা, কিছু অজানিত বিশ্রাম অন্তরালে বীজদৃপ্ত ভাবনাকে–মার্জার যেমন মূষিককে–ব্যতিব্যস্ত করে সেইরূপ বিঘ্ন সাধন করিয়া থাকে। এ খেলায় অবৈধ প্রণয়ের গর্ভপাত-হেতু ভ্রণপিণ্ড যাহা প্রেত-পরিণত সেও আপন পিণ্ডময় শরীর আন্দোলিত করত মহানন্দ প্রকাশে অস্থির; অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মৃত রমণীর প্রেত অধিক রসময়ী; ক্রমাগত ইহারা, ভয়ঙ্করদর্শন প্রেত-সকল, এবং বৈজুনাথ ঘুরিয়া ঘুরিয়া খেলা করে; খেলার শেষে তাহারা ক্রমান্বয়ে বলে, “তেষ্টা তেষ্টা।”
বৈজুনাথ বালকসুলভ চাপল্যে তাহার অঙ্গুলিদ্বারা গঙ্গাকে নির্দ্দেশ করে।
কখনই সে ভয় পায় নাই।
সে প্রশ্ন করিল, “আমি, আমি কি ভূত! না না না…নিশ্চয় প্রেত…না আমি চণ্ডাল? হয়ত আমি চিতা! এখন পুনরায় তাহার কণ্ঠে প্রসন্নতা বর্তমান। কেননা গঙ্গার স্রোত তাহার সহিত কথা কহিয়াছে।
.
এখন অপরাহু সন্ধ্যাগত।
যশোবতী কেশবিন্যাস কালে কিছু কিছু অনাবৃত হইয়া পড়িবার ভয়ে সকল দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। তবুও প্রসাধনরত এই ডালিমের বাস্তবতাকে আর একজন অলক্ষ্য হইতে দেখিতেছিল। স্বামী সীতারাম অধুনা যেন কেমন অনড়, ফলে যশোবতীর নিজের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়াছিল; পুত্রদ্বয়ের কথা তাঁহার স্মরণ হইল, অবশ্য তাহাদের যে কি হইল তাহা ভাবিবার পর্যন্ত তাঁহার উৎসাহ। ছিল না। তথাপি তিনি বেণী রচনা করিতে করিতে চকিত পদে খানিক দূর অতিক্রম করিয়া থমকাইয়া দাঁড়াইলেন, আপনার স্বাধীনতাকে অচিরাৎ সাক্ষাৎ করিয়া গম্ভীর, যতদূর এখান হইতে দেখা যায় ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, টিয়ার ঝাঁকে তাহা যেন আত্যন্তিক প্রসারী, এই স্বাধীন মনোভাব দিয়া আপন বেণী বন্ধন কাৰ্যে মনঃসংযোগ করিলেন।
পদচারণে ব্যাপৃতা, এ শ্মশানে নির্ভয়ে আপন গোপনতাকে সন্ধ্যা সমাগমের জন্য প্রস্তুত করা একমাত্র তাঁহার দ্বারাই সম্ভব; তৎকালে নিশ্চয়ই পুষ্পবৃষ্টি হইয়া থাকিবে, তৎকালে ধ্রুবসত্য যে, গোলাপ তাঁহার অনুগামিনী হইয়া থাকিবে। তিনি আবার ফিরিয়া আসিলেন।
সীতারাম প্রশ্ন করিলেন, “কি?” অর্থাৎ কোথায়?
যশোবতী এমত প্রশ্নে ঈষৎ অবাক। তাহার পর কহিলেন, “ছেলেরা” এবং স্বামীর কানের তূলা সরাইয়া কহিলেন, “আঁধার হল…ছেলেরা ত কেউ…”
“মরুক…আমি আছি…”
বৃদ্ধের ঘোষণাউক্ত ‘আমি’ বাক্য সৌষ্ঠবে যে ক্ষুদ্র তন্মাত্ৰা বৰ্ত্তমান, তদনুরূপ ক্ষুদ্র একটি ক্ষণস্থায়ী নির্ভরতা যশোবতীর মনে সঞ্চারিত হইয়াছিল। তিনি নোলকটি একটি অঙ্গুলিদ্বারা ঈষৎ আন্দোলিত করিতে করিতে অন্যমনস্কা হইলেন এবং এককালেই শুনিয়াছিলেন “কাজল”।
বৃদ্ধের চোখে দিবার নিমিত্ত একটি কাজললতা ছিল, তাহা খুলিয়া, যশোবতী সস্নেহে তাঁহাকে কাজল পরাইতে লাগিলেন। এখন, নিশ্চয়ই মনে হইল এ কাজল–এ অন্ধকার, শিখাতে দাহ্য হয় নাই, আলো পার হইয়া আসিয়াছে। পথশ্রমে উহা কাতর বা ম্লান কভু নহে।
কাজলচৰ্চ্চা কালে তিনি বার বার স্বামীর মুখাবলোকন করিয়াছিলেন, এ কারণে যে, তাঁহার সকল সময় মনে হইতেছিল, সীতারাম এখনও হস্তের আঘাত-প্রসূত ব্যথায় মর্মাহত, এখনও তাঁহার অশ্রুসিক্ত নিঃশ্বাস ক্রমে ক্রমে পড়ে, এবং এইহেতু এই প্রথম যশোবতীর চিন্তাসূত্র গৃহী হইল। ইতঃপূৰ্ব্বে শুধু সংস্কার ছিল। এক্ষণে বুঝিলেন সম্মুখে যাহা, তাহা গঙ্গা, তাহার প্রতিটি জলবিন্দুতে মেঘ এবং সে মেঘের পিছনে প্রশান্ত, সুন্দর, শান্ত, অক্ষয়, পিতা নীলিমাসুতরাং বৃদ্ধের জন্য ব্যাকুলতায় পদদ্বয় নাচিয়া উঠিল, তিনি যেমন স্বামীর জন্য বিশ যোজন পথ অক্লেশে দৌড়াইতে দৌড়াইতে আসিতেছেন–রক্ত, মাংস, গোঙানি, জিহ্বা–তাঁহার এ পথে মায়া সৃষ্টি করিতে পারে নাই। তিনি সিদ্ধা।
সীতারামের চক্ষুর্ঘয়ে বিদ্যুৎ খেলিতে আরম্ভ করিয়াছিল, কোথা হইতে জোয়ালঠেলা ক্ষমতা সঞ্চয় করিয়া তিনি নিজেকে প্রকাশ করিতে চাহিলেন, সন্তরণ অভিজ্ঞ পুরুষ যেমত সহজেই জলের তলদেশ হইতে উল্কা গতিতে উপরের দিকে আসে সেইরূপ তিনি উঠিয়া আসিলেন, বারম্বার ওষ্ঠদ্বয় কম্পিত হইল, কিন্তু বাক্যস্ফূৰ্ত্তি হয় নাই। করুণভাবে আপনার স্ত্রীর প্রতি চাহিয়া, প্রাণান্ত করিয়া কণ্ঠে শুদ্ধ স্বর আনিতে চাহিলেন, চক্ষে জল আসিল।
পতি ব্যাকুলা যশোবতী বস্ত্রপ্রান্ত দ্বারা স্বামীর ওষ্ঠভাগ, যাহা জলসিক্ত, সযতনে মুছাইলেন, কেননা ইদানীং তাঁহার আপনকার দেহবর্ণের স্বর্ণ-পীত এবং দূর অম্বরের নীল, আর এক অনন্য সবুজতার সৃষ্টি করিয়াছে–তিনি আড়নয়নে এ-শোভা দেখিয়া সম্মোহিত রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিলেন। এই গূঢ় উপলব্ধিতে আপনার দেহের ভিতরে কাহারা…যেন বা আলিঙ্গন করিতে লাগিল।
“চাঁদ”…
যশোবতী ‘চাঁদ’ বুঝিয়া লইয়া স্বামীর প্রতি স্মিতহাস্য করত চাহিলেন।
“চাঁদ”…
যশোবতী এক্ষণে তাঁহার বাক্য, বোধ করি, অনুধাবন করিতে পারিয়া চাঁদোয়া টানাইবার জন্য ব্যগ্র হইলেন। সীতারাম অত্যধিকভাবে প্রতিবাদ করত করিলেন, “না না…।”
যশোবতী ইহাতে স্বামীর কানের তূলা বিশেষ সন্তর্পণে বাহির করিয়া কল্পনাতীত স্নেহস্বরে বলিলেন, “হিম পড়বে যে…” একথা বলিতে বলিতে হঠাৎ তাঁহার বাল্যের স্মৃতি জাগিল। একদা ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ত্রস্ত দুধের লাউ গাছ দেখিয়া মনে বড় দুঃখ হইয়াছিল।
সীতারাম আকাশ দেখিয়া, হিম স্মরণে, সম্মত হইলেন।
চাঁদোয়া খাটান হইল। সীতারাম এই মুহূর্তটুকুর জন্য যেন বা সকল শক্তি সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছিলেন; তিনি যে অথৰ্ব্ব একথা ভুলিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন। নববধুর প্রতি তাকাইয়া বলিলেন, “আকাশ…বড় ভয়…”
উদগ্রীব হইয়া তাঁহার কথা শুনিয়া, যশোবতী সগর্বে বলিলেন, “কেনে গো, আমি আছি” আবার স্পষ্ট করিয়া বলিলেন, “ভয় কি, ভগবান আছেন।”
তাঁহার কথা যেন বা বৃদ্ধের মনঃপূত হইল না, অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া নববধূর হস্তটি স্পর্শ করিয়া বুলাইতে চাহিলেন, পরে কোনমতে আপনার গণ্ডদেশে লইয়া চাপিয়া ধরিয়াছিলেন। যশোবতী অনুভব করিলেন, বৃদ্ধ কাঁদিতেছেন।
বার্ধক্যের অশ্রু যশোবতাঁকে বহু জন্মের পুঞ্জীভূত সঙ্গ, বন্ধুত্ব, সৌহার্দ্য, অন্তরঙ্গতা, মিত্রতা, মিত্রতার মধ্যে যেমন গঙ্গাজল, গঙ্গাজলের মধ্যে যেমন আপনি, আপনার মধ্যে যেমন অক্ষর, তাহা এক নিমেষেই দান করিল। এখন তিনি যেন তাঁহার স্বামী হইতেও আতুর, একদা মনে হইল সীতারাম শিশুবৎ, ইহাকে সাদরে কোলে লওয়া যাইতে পারে, পরক্ষণেই কৰ্ত্তব্যজ্ঞান ফিরিয়া পাইয়া তাঁহার চক্ষুদ্বয় মুছাইয়া বলিলেন, “কাঁদো কেনে গো…”
“আমি…বাঁচব…”
সীতারামের উক্ত ‘আমি’ কথাটা যশোবতাঁকে অভিমানী করিল, যেখানে তিনি, যশোবতী, বন-মায়া, তিনি বলিতে চাহিলেন, ‘আমি’ বল না, শুধু বল বাঁচব কিন্তু তবু আপনার বিরক্তি দাঁতে কাটিলেন।
“আমায় ত ভগবান এনেছেন তোমায় বাঁচাবার জন্য গো।”
“বউ ভয় মায়া” বলিয়া অঙ্গুলি দ্বারা যশোবতীর প্রতি ইঙ্গিত করিলেন।
“মায়া…”
“আমার জন্য?” এইটুকু মাত্র প্রশ্ন করিতে যশোবতী কোনক্রমে সক্ষম হইয়াছিলেন।
তাঁহার আজন্ম সযত্নে রক্ষিত অভিমান, দেহের মধ্যে পলকেই কুম্ভকের সৃষ্টি করিল, প্রথমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস এবং তদনন্তর নেত্রে অশ্রু দেখা দিল, এখন বিগলিত হয়; তবু এ সত্য অনস্বীকার্য যে, অষ্টলক্ষণ সমুদয় প্রভাবসম্পন্ন, ফলত ললাটে স্বেদবিন্দু ও অন্তরের পুলক আকল্প-নবীন একভাবের সূচনা-নয়নে উন্মীলন আকাঙ্ক্ষায়, কৃষ্ণ মেঘোদয়ে ময়ূরসমান; এবং ধীরা, নবোঢ়া, লাজুক, শীলা, বিহুলা, বিড়ম্বিত, মুহ্যমান–বিষাদময়ী যশোবতী প্রগম্ভ হইলেন, আপনকার দেহ হইতে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হইল; তিনি মুহুর্মুহুঃ বলিতে লাগিলেন, “সত্যিই…সত্যিই মায়া হয়” বলিতে বলিতে আপনার ভগ্নস্বরে আপনি সম্মোহিত হইয়া, জরাজীর্ণ কালাহত স্বামীর কণ্ঠ ঝটিতি আবেষ্টন করত রমণী জীবনের, প্রকৃতি জীবনের, প্রথম, মধ্য এবং শেষ এবং শ্রেষ্ঠ আশ্রয় গ্রহণ করিলেন।
তাঁহার, যশোবতীর জীবন সার্থক হইয়াছিল।
অদ্যের এই বেলাতটের পড়ো-নিঃসঙ্গ সৌন্দর্য্যের বাস্তব-বিদ্যমানতার জন্য, এই আদিষ্ট ভূমি– ভূতগ্রামের জন্য, তিনি নিজেই বর প্রার্থনা করিয়াছিলেন; এবং বালকস্বভাব ভোলানাথ, যিনি সৰ্ব্বমঙ্গলময়, যিনি চিৎস্বরূপ, যাঁহার বিভূতির অন্তর্গত দৃশ্যাদৃশ্য সৃষ্টি, যিনি অদ্বিতীয় পুরুষ, ষড়ৈশ্বৰ্য্যময়ী শ্যামার চরণাশ্রিত প্রৌঢ়শিলাবৎ অনড়; ইদানীং যিনি শঙ্কর, যাঁহার বাম জঙঘাপরি নবারুণ প্রকট-চম্পকদীপ্ত-বিদ্যুৎপর্ণা আসীনা, অর্থাৎ পাৰ্ব্বতী, অধরে মধুরার ‘মিথুন-হাস্য’ এবং উদাসীকে প্রেক্ষণব্যস্ত–সেই পাৰ্বতীপ্রিয় শঙ্কর, যিনি অবিচারিত চিত্তে মানুষকে চারিফল দান করেন, তিনি নিশ্চয়ই, যশোবতীর প্রার্থনায়, বলিয়াছিলেন–”তাহাই হউক”। এবং তিনি, যশোবতী, বৃদ্ধকে জড়াইয়া ধরিলেন।
উদ্ভিন্ন বনজযৌবনার মৃণালসদৃশ ভুজবন্ধনে বৃদ্ধ’ পরিত্রাহি ডাক ছাড়িলেন, আকুল সমুদ্রের প্রায়-নিমজ্জমান ব্যক্তির ন্যায় মুখব্যাদান করিলেন। আকাশ অন্ধকার হয়। যশোবতী ভীতা হইয়া তাঁহার হাতখানি অপসারণ করিতে গিয়া পুনরপি কণ্ঠ আবেষ্টন করিয়াছিলেন। বৃদ্ধের কণ্ঠরোধ হইবার উপক্রম হইল। নববধূর হাতখানি সরিয়া গেল, তিনি শশব্যস্তে ব্যগ্রতার সহিত, “কি হয়েছে গো অমন করছ। কেনে…লেগেছে?” অত্যন্ত সরল কণ্ঠে বলিলেন।
অনন্তর, বিশুদ্ধ বায়ু লইবার মানসে সীতারামের মস্তক সঞ্চালিত হয়, তাঁহার প্রাণ বুঝি যায়; ইদানীং যে প্রাণ তাঁহার সহজ বন্ধন মাত্র। যশোবতীর শরীর আড়ভাবে ন্যস্ত ছিল। তিনি উপস্থিতবুদ্ধিরহিত, কেবলমাত্র আকৰ্ণবিস্তৃত নয়ন যুগল তড়িৎ ভঙ্গিমা চকিত, কোনমতে আলুথালু বেশে উঠিয়া বৃদ্ধের প্রতি মনোনিবেশ করিলেন।
বৃদ্ধ স্বাভাবিক ভাবে শুইয়া আছেন।
দুঃখিনী বন্ধুহীনা যশোবতী উন্মত্তের ন্যায় সমস্ত দিগদর্শন করিলেন, কেহ নাই। সর্পদেহী– আপকাল দেখিয়া তিনি শঙ্কিতা, জরায়ুস্থিত আসনে তাঁহার সর্ব শরীর বক্র হয়। কিয়ৎক্ষণ পরে নির্জীব কণ্ঠে বারংবার কহিলেন, “ওগো কথা বল, কথা বল…” এবং স্বামীর কর্ণের নিকটে মুখ লইয়া তারস্বরে বলিলেন, “কথা বল”। এই ব্যাকুলতা শূন্যতায় প্রতিধ্বনিত হইল, তাঁহার শিহরণ উপস্থিত, মুখ তুলিয়া প্রতিধ্বনির দিকে তাকাইবার চেষ্টা করিয়া চন্দ্রালোক দেখিলেন, যে চন্দ্রালোক জলে স্থলে– এখানে সেখানে।
“বউ…”
নাগরাজ বাসুকির দ্বারা নববধূর দেহটি আন্দোলিত হইল। বিস্ময়ে যশোবতীর মুখ খুলিয়া গেল, পলকেই মুখনিঃসৃত লালা আসিয়া পড়িল। তিনি তৎপরতার সহিত তাহা অপসারিত করিয়া বলিলেন, “এই যে আমি, খুব লেগেছিল হ্যাঁ গো” এবং সেইকালে সৰ্ব্বদিক অবলোকন করিয়া ‘আমি’ প্রতিধ্বনি বাক্যটিকে লক্ষ্য করিয়াছিলেন। পরে অতীব মধুর কণ্ঠে কহিলেন, “খুব লেগেছিল।”
“না না” বলিয়া বৃদ্ধ অতি ধীরে তদীয় পত্নীর হস্ত স্পর্শ করিলেন।
.
যশোবতী অতি সন্তর্পণে স্বামীর অভিপ্রায় মত পুনৰ্ব্বার কণ্ঠ আলিঙ্গন করত আনন্দ বর্ধন করিয়াছিলেন। উপত্যকার শান্ত হ্রদের ব্রাহ্ম মুহূর্তে সন্তরণরত শ্বেত মরাল আপনার দীর্ঘ, ব্য, সর্পিল গ্রীবা বাঁকাইয়া এই সপ্তবন্ধনের নিঃশ্বাসকে তির্যকভাবে দেখিয়াছিল। বৃদ্ধের ভাঙা ভাঙা কুঞ্চিত ওষ্ঠে নিশ্চিত হাসি ছিল। রাত্রনিহিত, তৃপ্তির অনন্য মরীচিকা, সুন্দর জোছনায় হেমন্তের শিশিরসিক্ত শেফালিকার মধ্যস্থতায় ব্যক্ত, উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।
“আমি খুব ভয় পেয়েছিলুম”–নববধূ কহিলেন। এমন যে তাঁহার গাত্রবাস স্পন্দিত হইয়া উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে।
“ভয়!” এ বাক্য উক্তির সহিত তাঁহার, বৃদ্ধের, মুখগহ্বর দেখা যায়, মাড়ি অস্পষ্ট, উল্লিখিত ফলে, তাহা নিজেই ভীতির কারণ হইল।
এ কথা শ্রবণে যশোবতী সমস্ত প্রকৃতি আলোড়ন করিলেন, আপনার সুবৃহৎ চক্ষুদ্বারা দিক সকল দেখিয়া কহিলেন, “ভয় কি গো?” এবং পুনরপি বাস্তবজগৎ নিরীক্ষণ করত বলিলেন, “এই দেখ” বলিয়া কাংস্যবিনিন্দিত কণ্ঠে “ইংহি ইক ইক” বলিয়া রক্ত মন্থনকারী এক অদ্ভুত ধ্বনি তুলিলেন। এই হৃদয়-উদ্বেল-পটু শব্দে একমাত্র রাহুই সাড়া দেয়-জলপানরত ভয়ঙ্কর জীবসকল প্রাণভয়ে স্থির। চাঞ্চল্য দারুভূত। তিনি যেন হাসিয়াছিলেন।
একমাত্র বৃদ্ধ তাঁহার এ হেন দুর্ধর্ষ ডাকে নিশ্চিন্ত হইয়া জাগিয়া উঠিলেন। কিছুই তখনও চক্ষু মেলিতে সাহস করে নাই।
গঙ্গার শীতল বায়ুচাঞ্চল্যে জোনাকি-ঝাঁক তরঙ্গায়িত কভুবা ছত্রভঙ্গ, কোথাও কেহ নাই; লোক চরাচর স্তব্ধ। অলৌকিক দাম্পত্যজীবন যাহা তেজোময় দুস্পধর্ষ, আমাদের ক্রন্দন, আমাদের প্রতিবিম্ব, শ্মশানভূমিতে ইদানীং অশরীরী।
যশোবতী তপ্ত-উষ্ণ নিঃশ্বাস-বায়ুর মধ্য হইতে প্রশ্ন করিলেন, “হ্যাঁ গো তোমার কত কষ্ট হয়েছে, না গো…”
“না…না…ভাল…”
নববধূ স্বামীকে সচেতন মায়াময় করিবার মানসে শ্রীযুক্ত কণ্ঠে কহিলেন, “তোমার যদি কিছু হত, আমি গঙ্গায় ঝাঁপ দিতুম…”
বৃদ্ধ অবাক হইয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলেন। তিনি যেমন বা ধারাবর্ষণ-ক্ষান্ত ধরিত্রী দর্শন করিলেন। অনর্গল বৃষ্টি হেতু সমস্ত প্রান্তর জলময়, তথাপি প্রাণকুল ব্যস্ত।
“এ জীবন গেল, কি হয়েছে? আবার জন্মাব আবার ঘর পাতব”–এ কথায় এই লোকক্ষয়কারী শ্মশানভূমি যেন পক্ষীশাবকের ন্যায় কাতর হইয়া উঠিল। কেননা তাঁহার, ভাগ্যবতী যশোবতীর, অঞ্চলে তুরুপের ইহলোক, তাহার বীজ এবং বাঁচিবার ইচ্ছা-চিন্তা সকলই বাঁধা ছিল।
“আমার…সঙ্গে?”
শিশুর মত মাথা দোলাইয়া যশোবতী কহিলেন, “হিঁ গো, তুমি ছাড়া আর কে…! জান, আর জন্মে নিশ্চয় তোমায় কষ্ট দিয়েছিলুম, তাই এত দেরী হল আসতে। জান আমি ভূত হয়ে ঘুরছিলাম! তুমি যখন মাঠে মাঠে খেলেছ, ফড়িং ধরেছ, তখন কত হাততালি দিয়েছি, আমি সব দেখেছি…” এ কথায় যশোবতীর গভীর সংস্কার ছিল না। বিশ্বাস ছিল। সীতারাম যুবকের মত স্ত্রীর উরুতে চাপড় দিলেন, শাশ্বত সত্য কম্পিত; রমণীর জরায়ু মহানন্দে মহুয়া-বেসামাল নৃত্য করিতে লাগিল, আর যে কাহারা– মর্ত্যবাসী সম্ভবত, ঘোররবে অট্টহাস্য সহকারে মাদল বাজাইতে উন্মাদ। সমগ্র চক্ষুষ্মন, সমগ্র পরমায়ু আশ্বস্ত, একারণ যে তাহারা এক মনোহর দিব্য দৃশ্য দেখে–যে, এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড একটি মহতী জরায়ু, যেখানে বাঁশরীগীত প্রতিধ্বনিত এবং আপাতত বলিলেন, “আবার হবে”।
বৃদ্ধ সীতারামের সরল বাক্যে যশোবতী অল্পমাত্রায় স্থানীয় হিমবায়ু অনুভব করিলেন। তন্নিবন্ধন শুধুমাত্র বুঝিয়াছিলেন তাঁহার ইদানীং আদিত্যবর্ণ দেহ নানাবিধ অলঙ্কারভূষিতা, এবং এমন কি যাহা ধূলা, তাহাই তাঁহার স্নেহাস্পদ, কেননা ধূলাই তাঁহার প্রথম সন্তান; তিনি রমণী।
প্রৌঢ়শিলাসম সীতারাম এখন স্পন্দিত, প্রথমত যশোবতীর প্রাণ উচাটনকারী ঘোর রবে, দ্বিতীয়ত আপনার দেহে ক্ষণমাত্রস্থায়ী বিদ্যুৎ দর্শনে, স্বভাবে অধিষ্ঠিত হইয়া কহিলেন, “বউ গান বল।”
এ কথায় যশোবতী হাস্য সম্বরণ করিতে অপটু, মুখে বস্ত্রখণ্ড প্রদান করিলেন, দেহ-সকালের উড্ডীয়মান পারাবত যুথ যেমত সহসা ছত্রভঙ্গ হয়, তেমনি–ছত্রভঙ্গ হইল।
“বল” বৃদ্ধ কহিলেন। এ বাক্যের ভিত্তিতে এই ইচ্ছা ছিল যে কাল পরাস্ত হউক।
যশোবতী সেই ভাবেই মাথা নাড়িয়া প্রকাশ করিলেন, সঙ্গীত তাঁহার আয়ত্তে নাই। অনন্তর মহা আগ্রহে বলিলেন, “তুমি বল না।”
“না তুমি…”;
বৃদ্ধ অপেক্ষা করিলেন, তাহার পর অভিমানে মুখ ঘুরাইয়া লইলেন। যশোবতী অভিমানী স্বামীকে তুষ্ট করিবার জন্য, কোন মতে ‘বেহাগে’ গাহিতে লাগিলেন।
“তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা,
অমানিনা মানদেন কীৰ্ত্তনীয়ঃ সদা হরি”…
সদ্য যৌবনপ্রাপ্তির সুললিত মধুস্বর লীলা ভক্তির ঔদার্যে বাত্ময় হইয়া উঠিল। হাজার হাজার বৎসর, তাহার সেতু, তাহার হৰ্ম্মরাজি, জলযান, তাহার যুদ্ধ বিগ্রহ, তাহার প্রমোদক নন, রভস, ছুন্নৎ, হারেম, একটি আদরণীয় নবপ্রসূত মেষ শাবকের চপলতায়, রম্য ছায়ায় অবাক হইল। এমত সময় একটি বিরক্ত স্বর মৃত্যুমুখী নিঃশ্বাসের গড় গড় ধ্বনি তাঁহাকে বাধা দিল, বৃদ্ধ তিক্ত স্বরে কহিলেন, “হরিধ্বনি দাও না তার থেকে”…।
পতিপ্রাণা যশোবতী অপ্রস্তুত হইয়া থামিলেন, এখন তাঁহার শিরায় রক্ত প্রবাহ নিখাদকে কেন্দ্র করিয়া মন্থর গতিতে আবর্তিত হইতেছিল, তিনি সৃষ্টি ও স্থিতির মধ্যবর্ত্তী কোন স্বর যুক্ত করত ভাবিলেন, কি গাহিবেন! অবশেষে ধরিলেন–
“যাই যাই যাই যাই লো আমায় বাঁশীতে কে ডেকেছে,
পড়ে থাক ভেসে যাক কলস আমার–যমুনায়,
আমায়–বাঁশীতে কে ডেকেছে…”
যশোবতীর করতল মৃদু মৃদু বৃদ্ধের হস্তে আপনার গীতের তাল রক্ষা করিতে ব্যস্ত। গানের অন্তরীক্ষে যে সৌখীনতা তাহা নিয়ত জোনাকির পশ্চাদ্ধাবন করিল। সীতারামের শিরা উপশিরা, ঝড় সমাগমে স্বলিত কবরীর কেশরাশির ন্যায় ইতস্ততঃ প্রক্ষিপ্ত, উড়ন্ত, বাউরী, আসক্ত, বলবান, কোটি সর্পের মত–সম্মুখে বিদ্যমান মুখমণ্ডল তথা দেহটিকে কখনও বাঁধিতে কখনও বা কশাঘাতে সুস্ফীত করত–দীর্ঘায়ত করত মধুপান করিতে চাহিতেছে।
ঐ গীত ভেদ করিয়া হরিধ্বনির অট্টরোল উঠিল। পুনরায় জলদগম্ভীর শ্লেষাত্মক ত্রুর নিষ্ঠুর কর্কশ কণ্ঠে ‘হরিধ্বনি’ শ্রুত হইল। বৃক্ষস্থিত পক্ষীসকল ব্রাসিত, কাহারও বা স্বীয় অসাবধানতা বশত, বক্ষ রক্ষিত ডিম্ব সকল, পরস্পর আঘাতে শব্দ করিয়া উঠিল।
যশোবতী গীত না থামাইয়াই এই ভয়ঙ্কর আওয়াজ শুনিয়াছিলেন এবং তদবস্থায় ভেড়ীপথের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করত দেখিলেন, ইহা শব যাত্রীদের হরিধ্বনি নহে, মাত্র একজন লোকই স্কন্ধে একটি বাঁক লইয়া অল্প দুলিতেছে। দেখিলেন, এই কায়ার পদনিম্ন হইতে মৃত্তিকা খসিয়া গেল, সে কোনমতে আপনাকে সামলাইয়া কিছুক্ষণ পরে বাঁক লইয়া একভাবে নামিয়া গেল। কায়াটিকে আর দেখা গেল না। কেন কি জানি, তাঁহার মনে হইল, পুনৰ্ব্বার বিকট হরিধ্বনি হইবে। তিনি গীত থামাইয়া স্বামীর কানে তুলা ভরিয়া দিবার কালে দেখিলেন, সীতারাম অদ্ভুত আরামে নিশ্চিহ্ন। তাঁহার দেহ যশোবতীর সুখকর প্রীতিবৰ্ধক স্পর্শ দ্বারা আমোদিত, প্রহৃষ্ট করিতে প্রয়াস পাইলেন।
যশোবতী অন্যমনা হইয়া ভেড়ী পথের দিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন। সেখানে কেহ নাই। কেবলমাত্র পূৰ্ব্বকার ঘটনার স্থানটি দর্শনে নববধূ শিহরিয়া উঠিলেন, একদা যাঁহার স্বরভেদ প্রলয়কালীন অবস্থার সূচনা করিয়াছিল, তাঁহার এ বৈলক্ষণ সমুৎপন্ন! এই ক্ষুদ্র ছাউনির আশ্রয় যতটুকু আশ্বাস নির্ভর, তাহা তাঁহার দেহে সঞ্চারিত করিয়াছিল! এখনকার ছায়াই তাঁহার নির্ভরতা!
“বউ…” ইহার পর বৃদ্ধ অসম্ভব শক্তি সঞ্চয় করিয়া কহিলেন, “মাটি মাটি, ভিজে ভিজে…”
যশোবতী ইহার অর্থ সঠিক করিতে না পারিয়া ভাবিলেন স্বামী বোধ করি কোন ঔষধ চাহিতেছেন। ইতিমধ্যে বৃদ্ধ কিছু বলিবার আপ্রাণ চেষ্টায় পরিশ্রান্ত। যশোবতী অত্যন্ত ব্যগ্র তৎপরতার সহিত মস্তকের নিকটে রক্ষিত ছোট হাঁড়ি খুঁজিতে গিয়া তুলসী গাছটি হেলিয়া স্বামীর কাঁধে পড়িল, যশোবতী এক হাতে তুলিয়া ধরিলেন।
“গাছ…”
যশোবতী, তুলসী চারাটি তাঁহার কাছে লইয়া যাইতেই গাছটি নিকটে পাইয়া বৃদ্ধ যেন উচ্ছ্বসিত; তিনি কী অনুযোগ করিয়াছিলেন তাহা আর স্মরণ ছিল না। গাছটি যেমন প্রস্ফুটিত চম্পকদাম, বৃদ্ধের আগ্রহ-আতিশয্যে যশোবতী ইহাকে বৃদ্ধের হস্তস্পর্শ করিবার সাহায্য করিলেন।
বৃদ্ধ সীতারাম এক্ষণে তাঁহার হস্ত দ্বারা যশোবতীর সাহায্যে গাছটির নিম্নে কি যেন খুঁজিতে খুঁজিতে–অন্ধকারে এতদিন পরে সব্বার্থসাধক কিছু অন্বেষণে একাগ্র, হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, “শিকড়” কোন ক্রমে নিজের নাসিকার নিকটে আনিলেন। কণা কণা মৃত্তিকা পড়িল। মুখগহ্বরে প্রবেশ করিল, তিনি আস্বাদ গ্রহণ করিয়াই “মাটি” বলিয়াই অসম্ভব জোরে স্ত্রীর ঊরুদেশে আহ্লাদে এক চাপড় মারিলেন। তুলসী গাছটির নিম্নের মৃত্তিকাকে এই আশ্চর্যভাবে আস্বাদন করিতে দেখিয়া নববধূর মনে হইল যেন স্বামী তাঁহারই, যশোবতীর, প্রথম সন্তানের আস্বাদ গ্রহণ করিতে উৎফুল্ল।
বৃদ্ধের মস্তক উত্তেজনায় অনেকখানি ছাড়িয়া উঠিয়া আবার যথাস্থানে ফিরিল। “আঃ আঃ বউ…” কোন ইন্দ্রিয় যেন চরিতার্থ হইয়াছে। যদিও যশোবতী স্বামীর এরূপ ব্যবহারকে উন্মত্ততার লক্ষণ বলিবার মত সময় পান নাই, তথাপি ইহা যথার্থ যে, তিনি কিঞ্চিত্র বিচলিত হইয়াছিলেন। সকল সময়ই তাঁহার মনে হইতেছিল, বাবলাকাঠ নির্ম্মিত হালের ফলা যেমত বৎসরে একদা লক্ষ মাণিক্যের বিভা ফিরিয়া পায়, তদ্রূপ, বৃদ্ধ যেমন বা শক্তি ফিরিয়া পাইয়া বলীয়ান হইয়া উঠিয়াছেন। ইহাতে, তাঁহার ইচ্ছা হইল, তিনি যেন স্বামীর ছায়ার মত হইবার সৌভাগ্য লাভ করেন, তাঁহার ইচ্ছা হইল ইহার আড়ালে যেন তাঁহার স্থান হয়।
গাছটিকে বৃদ্ধের মস্তকে স্পর্শ করাইয়া যথাস্থানে রাখিয়া বস্ত্র সম্বরণপূর্বক একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করত স্বামীকে সহসা নূতন করিয়া আবিষ্কার করিলেন।
বৃদ্ধের ক্ষীণ চক্ষু বৈদূৰ্য্যমণির ন্যায় প্রভাসম্পন্ন এবং বৃদ্ধ ওষ্ঠ বিভক্ত করিয়া মহাবিশ্বাসে ক্রমে ক্রমে, “বউ আমি আবার ঘর পাতব…” এবং কিয়ৎ পরিমাণে দম লইয়া কহিলেন, “ছেলে দুব”। এ হেন অহঙ্কারে স্থাবর ও জঙ্গমসমূহ উলুধ্বনি করে, বিশাল বিন্দুতে পরিণত হইল। হায়, ইহার পরই কি ঘোর যুদ্ধের শুরু, ইহার পরই কি বসুধা শিশু হস্তীর মত মহারঙ্গে দুলিয়াছিল? ব্রীড়াবনত নববধূ মুহূর্তের জন্য দিকসমূহ এবং ত্রিলোক লইয়া নিশ্চিন্তে কড়ি-খেলা করিলেন।
“এখন থাম, তুমি আর কথা বল না” বলিয়াই স্বামীর কর্ণের নিকটে গিয়া গান শুরু করিলেন। বুঝিলেন তাঁহার কর্ণের তূলা অপসারণ করা হয় নাই, তদ্দণ্ডেই তূলা অপসারণ করিয়া কহিলেন, “কি হচ্ছে গো…”
“বড় মন কেমন করছে।”
একথা শুনিয়া দয়িতার মন ভাবাবেগে অধীর; তদুত্তরে কিছু বলিবার ছিল না, আপনার পুষ্প-তীর্থ নয়নের, এক্ষেত্রে, অবলোকই সর্বৈব সত্য। তবু তাঁহার স্বর শ্রুত হইল। “আর ভেব না গো…” বলিয়া স্বামীকে ঘুম পাড়াইবার চেষ্টায় তাঁহার সুখস্পর্শ হাতখানি পালকের মত অনুভব বৃদ্ধের কপালে দান করিল।
সীতারাম সম্ভবত ঘুমাইলেন।
যশোবতী অনেকক্ষণ পর্যন্ত বৃদ্ধের সমান নিঃশ্বাস বায়ুর গমনাগমন নিরীক্ষণে বিস্ময়াভিভূত তন্ময়। একদা আপন সরলতাবশে, স্বীয় নিঃশ্বাস প্রশ্বাস কিঞ্চিত্র অনুভব করত তিনি স্বাভাবিকতা আশ্রয়ী। তাঁহার নিদ্রা নাই, জাগরণ লইয়া অপেক্ষমাণ হওয়া, বসিয়া থাকার এই সূত্রপাত, তৎকালেই তিনি ইহাও দেখিয়াছিলেন যে, নিকটে, দূরে, বায়ুও দুর্দিনকারিণী মহতী মায়ায় আরূঢ় হইয়া তথা প্রতিকূলতা স্ফীত হইয়া উঠিয়া ইতস্ততঃ বিচরণশীল এবং মধ্যে মধ্যে ভস্মরাশি লঘু স্বচ্ছ মেঘের ন্যায় বেলাতট অতিক্রম করিয়া অবশেষে লতাগুল্মতরুরাজির গহনতায় বিলুপ্ত। আর যে, যশোবতী এ জাগরণ লইয়া একভাবে বসিয়া কালক্ষয়ে নিমগ্না, যে জাগরণের কোন চিত্ররূপ নাই, ইহা মনোরম দীপ্তি সমম্বিতা সৰ্ব্বদাই বাস্তবতাকে পরোক্ষভাবে জ্ঞান করে, পদ্ম এবং ভ্রমরের মিলন, একটি অভিনব ইসারায় তাঁহারই সমক্ষে উপস্থিত; যদিচ ইহা অমোঘ সত্য যে, এখন পুত্রবৎসলা তথাপি এখন মদিরনয়না চন্দ্রনিভানন গুরুনিতম্বিনী যশোবতী আপনার জাগরণে বিনিদ্র।
অনেকক্ষণ পরে যশোবতী ধীর কণ্ঠে সলজ্জভাবে স্বামীর দেহের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, “হ্যাঁ গো, আমার তরে তোমার মায়া হয়?”
ইহা কি জিজ্ঞাসা? অথবা সন্দেহ? এ জিজ্ঞাসার উপর দিয়া কি যাযাবররা পুনরায় অশ্ব ছুটাইবে; রাত্রে, অগ্নিকে কেন্দ্র করত মণ্ডলাকারে জনগণ, ইহাকে বিষয় করিয়া শুধু গীত গাহিতে গাহিতে শুধুই নৃত্য করিবে; দুঃখময় অজস্র বৃত্তাকার পদক্ষেপ।
এ প্রশ্নে সৰ্ব্বত্রেই বিষাদ দেখা দিল। যশোবতী আবার এই পুরাতন প্রশ্ন করিলেন, “হ্যাঁ গা, আমার তরে তোমার মায়া হয়?”
তাঁহার এই অনাথা, নিঃস্ব, ভিখারী, ভাঙাকপালে, কাঙাল প্রশ্নের উত্তরে সহসা শুনিলেন, “কনে বউ, কনে বউ।”
খুব চাপা স্বর এবং খুট্ খুট্ শব্দ। এ স্বর যেন অন্নময়। এ স্বর মধুর হইলেও ক্ষেত্ৰ-দাহের বীভৎস নিষ্ঠুর আওয়াজের বিকার ছিল। এই ডাকে গোলাপের শোভা নষ্ট হইল; যেন কাব্য প্রলয়ে সমাচ্ছন্ন হইয়াছে, যেন চিত্র-সংজ্ঞা ধূলাদষ্ট হইয়াছে, যেন মহতী কীৰ্ত্তি অবসন্না হইয়াছে, যেন শ্রদ্ধা অপমানিতা, প্রজ্ঞা ক্ষীণ, যেন দেবস্থান বিধ্বস্ত হইয়াছে, নদী স্বল্পতোয়া, বেদ-ব্রাহ্মণ ধূসরিত হইয়াছে। অথচ বৃদ্ধের ওষ্ঠদ্বয় নির্বাক। ফলে এখন, তিনি চারিভিতে চাহিলেন। একদা ভেড়ীপথের দিকে, আচম্বিতে গঙ্গার প্রতি; দিত্মণ্ডলে আলোকিত অন্ধকার। তখনও নববধূ উপলব্ধির অবকাশ পান নাই যে, তাঁহার চিত্ত ঝাক্ষিপ্ত। তিনি বিমূঢ় অন্যথা তিনি চঞ্চল। ঝটিতি গঙ্গা প্রতি দৃষ্টিপাতে যশোবতী ভূতগ্রস্ত; গঙ্গা চন্দ্রালোক বিচ্ছুরিত উদ্বেল, বেলাতটে মাংসপিণ্ডবৎ, কৃষ্ণবর্ণ স্পন্দিত শরীরকুম্ভীর যেমত, কে যেন আসিতেছে দৃশ্যমান হইল; তদ্দর্শনে তিনি সম্মোহিতা, আবিষ্ট, নাস্তিক, শক্তিরহিত। একদা তাঁহার স্বীয় অজর-প্রশ্নআত্মক গীতের রেশ তাঁহার কানে আসিল এবং চকিতে তিনি সম্বিত ফিরিয়া পাইয়া পদদ্বয় গুটাইয়া লইয়া আধো-উঠা অবস্থায় স্বামীর দিকে সরিয়া গিয়াছিলেন।
পুনরায় “কনে বউ কনে বউ” ডাক।
সম্মুখে অপকীৰ্ত্তি। নীল মেঘসদৃশ অবয়ব এখনও গতিশীল। তিনি ব্যাঘাক্রান্ত যূথভ্রষ্টা হরিণীর ন্যায়, যেন নিজ শরীর মধ্যে প্রবিষ্টা হইয়া অধিকতর কম্পিত হইলেন। ইহা ব্যাকরণ-সংস্কারহীন অর্থান্তর প্রতিপাদক বাক্যের ন্যায়, অনেক কষ্টে বুঝিতে পারিয়াছিলেন উহা একটি দেহ; উহা শ্মশান ও চৈত্যবৃক্ষের ন্যায়, উহা চণ্ডাল।
চণ্ডাল বৈজুনাথ সাষ্টাঙ্গ বিস্তার করত, বুকে হাঁটিয়া আসিতেছে আর মধ্যে মধ্যে কলস ভাঙ্গানি খোলামকুচি–যাহা তাহার আগমনে বিঘ্ন উৎপাদন করে, তাহা কুড়াইয়া হুঁড়িয়া হুঁড়িয়া পিছনের দিকে। ফেলিতেছে; এই ভয়ঙ্কর সর্পিল গতিকে ছাপাইয়া বড় আপনার করিয়া ‘কনে বউ’ ডাকটি শোনা যাইতেছিল, সে ক্রমশঃ অগ্রসর হইতেছে। ইহাতে যশোবতী ত্রস্ত হইয়া, কি জানি কেন, অচিরেই স্বামীকে আগলাইয়া দেহটির দিকে চাহিলেন। কি জানি কেন এই মরু-রাত্রে এ হেন বাধাকে, সহসা হাস্যোদ্দীপক মজার, রগড়, আমোদজনক মনে হয় কিন্তু নিমেষেই সেই প্রতিক্রিয়া আবছায়া, ক্রমে লুপ্ত এবং তিনি পদাঘাত নিমিত্ত পা উঠাইয়া ক্ষণেক তদবস্থায় রাখিয়া ধীরে ধীরে যথাস্থানে পাটি রাখিলেন, একারণে যে তিনি বুঝিয়াছিলেন, শত্রু তাঁহার আস্ফালনের বহু দূরে।
সেখানে এখনও ভাঙা খোলামকুচির টুকরা ঊর্ধ্বে উঠিয়া অদৃশ্য, এই খোলামকুচির টুকরা অগণন দেহের পথ প্রদর্শন করে–যে দেহগুলি বীভৎস, ভয়াল, শ্লেষ্মবৎ এবং অশরীরী; তাহারা সকলেই তৃষ্ণার্ত, তাহারা সকলেই বৈজুর অন্তরঙ্গ; যাহাদের লইয়া সে খেলা করে। নববধূ উপলব্ধি করিলেন সেই প্রেতগুলির কাহারও হস্তে মরুভূমি, কাহারও হস্তে অপঘাত, কাহারও বা হস্তে চোরাবালির আজ্ঞা। ইহারা অগ্নিকে স্বীকার করে না। ইহারা অন্তঃসত্ত্বা ছাগলকে ভালবাসে…। এই ভয়ঙ্কর শোভাযাত্রা বৈজুর ঊর্ধেই প্রতিভাত, তাঁহার তালু শুষ্ক, যেখানে সিক্ততা নাই আর্দ্রতা নাই জল নাই, সেখানে শব্দও নাই; যশোবতী তৃষ্ণার্ত্ত; আর ভৌতিক দৃশ্য ক্রমশঃ অগ্রসর হয়।
বৈজুনাথ অনুচ্চ রবে হাসিল, এ সময় বক্ষখানি তুলিয়া ধরিয়াছিল, এবং একটি নিঃশ্বাস লইয়া কহিল, “কনে বউ, আমি ভূত নই, প্রেত নই… আমি বৈজু বটে গো।”
যশোবতীর সঘন, উপর্যুপরি নিঃশ্বাসে কবরী খুলিয়া গেল, তাঁহার মস্তক আন্দোলিত হয়।
“তবে বটে, ভূত প্রেতের সঙ্গে আমার কথা হয়, তারা আমার স্যাঙাৎ” বলিয়া মাটির নিকটে মুখ রাখিয়া হাস্য করিতে কিঞ্চিৎ ধূলা উড়িল এবং সে যুগপৎ কহিল, “আমাকে এক বেটা ও ঘুম এই ঘুম বলি ডাকে, আমি সে শালার বুকে লাথি মারি”–একথা শেষ হওয়ায় উর্ধস্থিত অশরীরী যাহারা তৃষ্ণার্ত্ত–তাহারা হা-হা করিয়া হাসিয়া খুসী হইল। পুনরায় ভগ্নস্বরে সে বলিতে আরম্ভ করিল, “তুমি জান…তুমি কি? দোসর…ভাঙ্গা কুলো। আমি বৈজুনাথ, আমার বটে মড়া পুড়বে সহ্য হয়” বলিয়া বালকের ন্যায় আহ্লাদিত হইয়া, ভঙ্গী সহকারে কহিল, “চিতায় যে কত লোক আমার হাতে ঠেঙা খায়, আমার দরদ নাই…” আবার অনুচ্চ হাসির শব্দ করিয়া দৃষ্টি নামাইল। পরক্ষণে বুকফাটা কণ্ঠে কহিল, “কিন্তু জ্যান্ত কেউ পুড়বে আমার আমার…কষ্ট হয়…” বলিয়া দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া, আপনার হস্ত ঠেটিতে ঘষিতে লাগিল; তাহার পশ্চাতে, নিম্নে, সমতল গঙ্গা স্রোতোময়ী।
“ওগো বাবু আমি ভাবের পাগল নই–আমি ভবের পাগল! তুমি পুড়বে চচ্চড় করে…ভাবতে আমার–চাঁড়ালের বুক ফাটছে গো” এবং বৈজুনাথ কহিল, “তুমি পালাও না কেনে।” এ স্বর যেমত বা দাড়িম্বকে বিদীর্ণ করিয়া উৎসারিত।
যশোবতী একথা শুনিবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তিনি আপনার হস্তের একটি বলয় তাহার প্রতি নিক্ষেপ করিবার মানসে প্রায় খুলিতে গিয়া মৃতপ্রস্তর; তিনি প্রমাদ গণিলেন।
বৈজুনাথকে নববধূর দেহস্থিত কিয়দংশে অবিড়ম্বিত চন্দ্রালোক যেন উৎসাহিত করিল, ধীরে ধীরে কহিল, “আমি বড় গতরক্যাঙলা লোক গো, কনে বউ, তুমি পুড়বে, আকাশ লাল হবে, ভয়ে গোরু পৰ্য্যন্ত বিইয়ে ফেলবে গো। তুমি গেলে, কি আর বলব আমি চাঁড়াল, দেশে আকাল দেখা দেবে…লাও…লাও তুমি পালাও…কনে বউ পালাও।”
ইতিমধ্যে হস্ত হইতে বলয়খানি বিচ্যুত হইয়া তাঁহার হিতাহিত জ্ঞানকে স্পষ্টতর করে, পুনরপি বলয়টি ঝটিতি তির্যকভাবে দেখিলেন, দেখিলেন গত সন্ধ্যায় তিনি সম্যক স্বাধীনতা দিয়া তিনিই বন্ধনলীলায় মুমুক্ষু; আর যে বন্ধন-তিতিক্ষার নামই ত স্বাধীনতা! এবং ভগবান তাঁহার কোলে, ফলে নয়ন নিমীলিত করত পথ অনুসন্ধান মানসে কিয়ৎক্ষণ যাপন করিলেন। অনন্তর যশোবতী বৈজুনাথের সকল কথা যাহা তখনও নিকটস্থ শূন্যতাকে বিচলিত করিয়া ঘূর্ণায়মান, তাহা শুনিতেছিলেন; কিন্তু কতখানি যে তাহার মর্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা নির্ণয় করা কঠিন নহে। অসম্ভব রাগান্বিত হইয়া কি যেন বলিলেন; হায় এখনও তিনি তৃষ্ণার্ত অথবা ঊর্ধ্বলোকের বীভৎস প্রেতসকলের, যাহারা নিয়ত তৃষ্ণার্ত–তাহাদের প্রতিধ্বনি মাত্র; শুধু শব্দ হইল। যে শব্দের অর্থ নাই। ইহার পর তিনি শক্তি সঞ্চয় করিয়া মাটিতে একটি পদাঘাত করিলেন…।
…সঙ্গে সঙ্গে বৈজুনাথ গড়াইয়া কিছু দূরে গেল, তাহার গাত্র ধূসরিত হরিশোভা, সে সংযত চিত্তে বলিল, “কনে বউ তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছ, আকাশের লেগে ভয় পাও হে, মাটির লেগে ভয় কেনে?” বলিয়া আর এক পাক দিল; ইহার পরে বেলাতটের দিকে চাহিয়া কহিল, “তুমি আকাশ কালো করবে গো, হাতী হাতী ধোঁয়া উঠবে, সতী হবে, তোমার নামে কত মানত, কত নোয়া শাঁখা জমা হবে। তোমার নামে অপুত্রের পুত্র হবে, নিধনের ধন হবে।” ক্ষিপ্রবেগে মুখ ফিরাইয়া বলিল, “তোমার বরে হিজড়ে ঢ্যাঁড়া দিবে হাটে–হো সতীর বরে গো মানুষ হইলাম” বলিয়া হাসিয়া আরবার কহিল, “তোমার স্বল্প বাস হবে, পান তামাক পাবে। হ্যাঁ গা কনে বউ, স্বগটা কেমন গো-দুধ আলতায়?” ইহার পর অদ্ভুত হাস্য করত আপনকার মস্তক মাটিতে স্থাপনা করে; এ-মাটি বড় সুন্দর, তাহার কেশরাশিতে মৃত্তিকা লাগিল।
যশোবতীর হিম রোমাঞ্চ ক্ৰমে শব্দ হইয়া আসিল।
বৈজুনাথ, তদ্রূপ, পূৰ্ব্বের ন্যায় পাক দিয়া ঘুরিয়া গেল। বলিল, “কনে বউ ভাবের ঘরে চুরি…ভাল লয়…” এই বচনের মধ্যে শ্লেষময় সাবধানতার হুঙ্কার ছিল। কহিল, “ভাবের ঘরে চুরি ভাল লয়” মনে হয় সে যেন কানে কানে কথাটি কহিতেছে। বাণবিদ্ধ পশু যেমত মুখোনি হন্তার দিকে তুলিয়া চাহিয়া থাকে, সেইভাবে বৈজুনাথ মুখটি তুলিল। ক্রমে পতিতপাবনী গঙ্গার দিকে চাহিয়া উচ্চারণ করিল, “ভাবের ঘরে চুরি।” অবশেষে তাহার মুখটি নিস্তব্ধ না’য় পরিস্ফুট।
“ছাই মেখে বসে থাকলে কি মতে ঠাকরুণ, তুমি ত আর পান্না ভৈরবী লও গো, যে নোড়াকে শিব বলবে হে! যত ছাই মাখো হে, সোনার প্রতিমা সূৰ্য্য সূৰ্য্যই; তুমি বড় সুন্দর গো, শ’ শয়ে দেখেছি, তোমার মত দেখি নাই” বলিয়াই পাক দিয়া আবার সে ঘুরিয়া নিকটে আসিল। খোলামকুচি সকল গায়ে বিদ্ধ হয়। বলিল, “আমি ভাবের কথা বললাম না হে…আমি ভবের পাগল, আমি জাত চাঁড়াল, ভাব পাব কোথা গো, ভাব আকাশগাছের ফল, তবে হ্যাঁ তুমি যদি বল…কেনে গো চাঁড়াল? হাটভাতারী। খানকি মাগীর দুয়ারের মাটি যেমন সত্য হয়, পুণ্যের হয়; তেমনই হে, শ্মশান মশানের মাটিতে” বলিয়া এক মুঠা মাটি তুলিয়া মুষ্টি উন্মুক্ত করিতে করিতে বলিল, “তুমি বলবে, এই মাটিতে ভাবের কথার হরিনুট…তুমার আবার ভাবনা কি গো” ইহার পর নিজেই উত্তর করিল, সে মাগী যেমন খানকিই থাকে পুণ্য পায় না; হারে কপাল! তেমনি, আমি ভাব পাই না গো, খোল বড় ভালবাসি গো, দেখনা কেনে ভূতগুলো আমার পড়শী স্যাঙাত!” বলিয়া হাতের উপর মস্তক রাখিয়া শুইয়া একদৃষ্টে যশোবতীর প্রতি চাহিয়া রহিল।
কিছুকাল অতিবাহিত হইয়াছে, যশোবতী হৃত শক্তি ফিরিয়া পাইয়াছেন। দক্ষিণহস্তে কাজললতা মুষ্টিবদ্ধ করিয়া কহিলেন, “চাঁড়াল”–এই সম্বোধনবাক্য তাঁহার কণ্ঠবিবর হইতে ক্ষিপ্ত জন্তুর মত লম্ফ দিয়া বাহির হইল। এবং করস্থিত বলয় ছুঁড়িয়া অন্যান্য দুই একটি অলঙ্কার ঝটিতি খুলিয়া উন্মত্তের ন্যায় ছুঁড়িয়া বলিলেন, “এই নাও…ডাকাত…” তাঁহার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইল।
চণ্ডাল বৈজুনাথ ইহার জন্য প্রস্তুত ছিল না, তাহার দশাসই দেহ বাঁকিয়া চুরিয়া গেল। যশোবতীর উক্ত বাক্য প্রতিধ্বনিত হইল। অলঙ্কার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া চণ্ডাল মাটি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখে ক্ষুব্ধ অসহায়তা, ক্রমে কুটির হাসি, পদ্মপত্রে জলের মত চঞ্চল। সে তাহার বাম পদখানি মৃত্তিকার উপর দিয়া সম্মুখে পশ্চাতে লইয়া যাইতে লাগিল গোরু যেমনে ক্ষুর ঘর্ষণ করে, এবং শেষ বারের মত দৃষ্টি নিক্ষেপ করত কহিল, “মর” বলিয়া দ্রুতপদে স্থান পরিত্যাগ করিয়া সে এখন আপনার আড়ায় অদৃশ্য, আর যেন তাহার ছায়াও অন্তর্হিত হইল। ইদানীং তাহার স্থানেই নিম-শূন্যতা, ভ্রমর, দিবাস্বপ্ন।
জ্যোতির্মণ্ডলের যে মনঃস্বিতা অবলীলায় শ্যামঘন পৃথিবীকে আপনার বিচিত্রতায় রাখিতে চাহিয়াছিল, উদ্বুদ্ধ করে, তাহা যেন নাই। যশোবতী ছাউনিতে চিত্রার্পিতের ন্যায়, তিনি নববধু, তিনি মিলন অভিলাষিণী তাঁহার মাংসল যৌবনকে লইয়া, যে, দূরত্বের ইঙ্গিত সকল, সাফল্যের তন্দ্রা সকলই, হিম তুষার সফেন তরঙ্গ, লাল কম্পনে অরুণাভ গিরিপ্রান্তর সকল যে খেলা করিবে, এ গীত আমন্ত্রণ তিনি শুনিয়াছিলেন। তাহারা বলিয়াছিল, আমাদের বাহু নাই তথাপি তোমাকে তড়িৎ-আলিঙ্গন করিব, আমাদের ওষ্ঠ নাই তথাপি তোমাকে চুম্বন করিব, আমরা সদেহে তোমার মধ্যে প্রবেশ করত তোমাকে আনন্দ দান করিব। কেননা আমরা নব্য, কেননা যেহেতু আমাদের কল্পনা নাই। তিনি একদা রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিয়া সম্মুখবর্ত্তী অবকাশ দেখিলেন, আপনার অলঙ্কারগুলি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত, ক্লান্ত পতঙ্গ যেমন বা; সোনাকে অবলম্বন করিয়া কোন ঝা শ্বেত হয়! যশোবতী একইভাবে আপনার মিলন-আগ্রহকে স্পর্শ করিয়াছিলেন।
৫. চণ্ডাল সূক্ষ্ম হইতে পারিল না
চণ্ডাল সূক্ষ্ম হইতে পারিল না, আপনার ছোট আড়ায় আসিয়া, সঘন নিঃশ্বাস ফেলিল; সে মনে হয় পলাইয়া আসিয়াছে, সে মনে হয় পথ হারাইয়াছে।
বৈজুনাথ যে দুই কলস মদ আনিয়াছিল তাহার একটি হইতে নরকপালে ঢালিয়া পান করিল, পরক্ষণে নরকপালের দিকে চাহিয়া বিড় বিড় করিয়া কি যেন বা বলিল, রুক্ষ আড়ষ্ট নিঃশ্বাস কণ্ঠস্বরে পাতা পোড়ার শব্দ, যাহা শুদ্ধ ভাষায় সম্ভবত বলিয়াছিল, “হায় কার অঞ্জলিবদ্ধ হাত, তুমি হাড় হয়ে আছ। এ কপাল কাহাকে আহ্বান করে। মন কি সকল সময় উর্ধলোকে–সেখানে যায়।”
ইহার পর অঙ্গুলি দিয়া আসব গ্রহণ করত চুষিতে লাগিল। যদিও সে এ প্রশ্ন করিয়াছে, যদিও সে আপনার মধ্যে শ্রান্তিকে দর্শন করিয়াছে, আপনার অনুভব স্রোতকে তাহার নিজস্ব প্রকৃতিতেই দেখে, তবু পুনরায় ঢালিল। পান করিয়া গঙ্গার তীরে গিয়া দাঁড়াইয়া ব্যাকুল স্বরে কহিল, “মা মা গো লেমিনাথ শালাকে জরিয়ে দাও গো, আর পাপ নয় মা গো…পাপীকে উদ্ধার কর।” বলিতে বলিতে বৈজু তাহার নিজের দেহের মধ্যস্থিত এক অত্যাশ্চর্য গাম্ভীর্যের সম্মুখীন; অন্যপক্ষে হ্রদ, তুষার, বহু বহু, জলে স্থলে ঊর্ধে যাহা কিছু বাক্যের অন্তরালে অশরীরী হইতেছে, ইহারা তাহার স্বপ্নের সামগ্রী, ইহারা তাহার পথিপ্রজ্ঞার ফলক, যে সে সুখে নিদ্রা যাইতে পারিবে তাহারই এই অপরিমিত আয়োজন। অনন্তর রাগত স্বরে কহিল, “শালী”, বলিয়া কয়েক পদ ছুটিয়া আসিয়া হয়ত সংস্কার বশে, হয়ত রুষ্টকৰ্ম্মা নিয়তি তাহাকে বিড়ম্বিত করে, অগ্নিহীন চিতায় নামিয়া স্থির; ভস্মরাশি, তাহার সহসা পদাঘাতে চকিত, বিভ্রান্ত; বৈরাগ্যজননী এই চিতায় এখন সে এবং তাহার ছায়া। সে ঘোর শেষ লইয়া একা; অদূরে অসংখ্য বাক্যনিচয় নিরর্থক। এত দুর্ধর্ষ শরীর, এক ভীম উর্বরতা এখন দারুভূত; উপরের উৎকৃষ্ট প্রতিবিম্ব এবং নিকটের স্রোত সর্প-মিথুনের মত, দিব্য, সুস্থ, চিত্তহারী বন্ধনে দীপ্যমান। চিতামধ্য হইতে এ লীলাচাতুর্য দেখিয়া সে যুগপৎ বিহ্বল, চমকিত, রিক্ত। ঝটিতি আপনার বল লাভ করিয়া উন্মত্ত হইয়া হুঙ্কার দিয়া হরিধ্বনি করিল, উত্তরোত্তর তাহার কণ্ঠ উচ্চগ্রামে উচ্চগ্রামে।
মনুষ্যদেহী চণ্ডালের ঈদৃশ দুঃসহ সঘন চীৎকারে দিকসকল আর এক চক্ষুতে পরিণত, ভ্রাতৃজীবনসকল ত্রাসযুক্ত; বৃক্ষ পত্রাদি থরহরি এবং সুখনীড় এ পৃথিবী এক মহাধ্বনিতে পরিপূর্ণ হইল, বিশ্বসংসার বুঝি যায়!
তাহার কণ্ঠনাদে এ-বাক্যই ঘোষিত হইল যে আমি, বৈজুনাথ, মাতা যেমন দেহ দেন, তেমনি নরদেহকে আমি সৎকারে সাহায্য করি। সেই বৈজুনাথ এক অবৈধ প্রণয় দেখিয়াছে, এক বিসদৃশ মিথুনের সে দ্রষ্টা, যে মিথুন অন্যায়, যুক্তিহীন। আপনাকে স্বকীয় চীৎকারে সম্মোহিত করত চিতা হইতে এক লম্ফে উঠিয়া অসূৰ্য্যম্পশ্যা ব্যাকরণশুদ্ধ অন্ধকারকে আপনার ভাই সম্বোধন করিয়া দাম্ভিক হইল এবং কিছুক্ষণ পরে নবদম্পতির চাঁদোয়াকে বেষ্টন করিয়া, বৈজয়ন্তীমালার ইঙ্গিত ধরিয়া, সহুঙ্কারে ছুটাছুটি করিতে লাগিল, মুখে “ওই লম্বোদরজননী হাই শিবশন্তো” এবং তাহার দক্ষিণ হস্ত ঊর্ধে ঘুরিতে ব্যস্ত।
যশোবতী বিস্মিত হইবার পূর্বেই সীতারাম, এই ভয়ঙ্কর শব্দে, কাঁদিয়া উঠিলেন। কাঁদিতে কাঁদিতে কহিলেন, “শীত শীত…” বলিয়া স্ত্রীকে আঁকড়াইয়া ধরিতে চাহিলেন। যশোবতী স্বামীর হস্তদ্বয় আপনার কণ্ঠে স্থাপনা করত এখন অন্য হাতে কাজললতা মাটিতে ঠুকিতেছিলেন।
বৈজুনাথ এখন শুধু “বল হরি হরি বোল…লম্বোদর” বলিয়া তাঁহাদের চক্রাকারে পরিভ্রমণ : করিতেছে। তাহার পদখনিত ধূলা উড়ে, ছায়া মাটিতে নাই, যাহা জৈবিক, যাহা মনহীন, যাহা হয় অহিতৈষী।
যশোবতী আর সহ্য করিতে পারিলেন না। আপনার দুর্জয় সাহস নিজেকেই আতঙ্কিত করিল, তিনি শুধু নানাবিধ একত্র মিশ্রিত ব্যাঘ্ৰ কভু কর্কশ, চক্রবাক সহসা তীক্ষ্ণ, বায়স কভু দীর্ঘ, ঋষভ ঝটিতি উদ্ধত–নিনাদে উচ্চারণ করিলেন, “এই…এই।”–অর্থাৎ খবরদার খবরদার।
নয়ন সমক্ষে এ কোন ভীম তীব্রতা!
সীতারাম এখনও তেমনি আলিঙ্গন করিয়া আছেন, যে আলিঙ্গনের প্রতি বিন্দুতে, কেয়ারিতে, বিশাল দিব্য সুদীর্ঘ শেষহীনতা ঝিম; যে, অতিবড় গঞ্জের বারাঙ্গনায়ও পর্যন্ত সে-সুদীর্ঘতা বুঝিতে সমুৎসুক এবং এই অপ্রাকৃতিক আরাম যাহার অন্তর্বর্তী চালোক, যে চন্দ্রালোকের অন্তর্বর্তী ভ্রমণশীলতার অভিধা, যে ভ্রমণশীলতার অন্তর্বর্তী সুন্দরের উষ্ণতার বিচিত্রতার মাধুর্যের সুধার লৌকিকতার জ্যামিতির ভূমিকার উৎপ্রেক্ষা অবর্ণনীয়া; তাহাকেই, সেই আরামকেই রমণীকুলশ্রেষ্ঠা যশোবতী আপন রোমকূপ-সহস্র, যাহা পুরুষ মানুষের, ইতরজনের অবামনসগোচর, তাহা দ্বারা স্বাদ গ্রহণে প্রগম্ভ; এই হেতু যে ইতঃপূর্বের বৈজুনাথের চক্রান্ত যাহাতে শ্মশানের মেদগন্ধযুক্ত মৃত্তিকা চিরতপ্ত এবং সে তাপ হরিহরণকারী, তাহা মৃত্যুকে বীভৎস ফলে জীবনকে জঙঘাদ্বয়ের মধ্যে লুক্কায়িত করিতে উৎসাহদানে–বিফলকাম হইয়াছে, একারণ জঙ্ঘা যেহেতু তাহাই মানুষের একমাত্র পলায়নের ক্রোড়, অন্যপক্ষে স্বাধীনতা। চক্রান্ত বিফলে যশোবতী জয়গর্বিত, ফলে তিনি ভাবনাবিরহিত মনে তখন সেই অলঙ্কার বলয় ইত্যাদি, যেগুলি আত্মরক্ষাকল্পে ব্যবহার করিয়াছিলেন, সে সকল পুনরায় সংগ্রহে ব্যাপৃতা হন। অদূরে চণ্ডালের দেহ চিহ্ন, বেলাপৃষ্ঠে মুদ্রিত, বৈজুনাথ যেন বা আপনার এই ছায়াকে পাহারায় রাখিয়া গিয়াছে। তাঁহার এই অলঙ্কার সংগ্রহ যাত্রা না অভিসার, শূন্য তীর ঝটিতি মহাগুল্ম, তৃণস্থান, লতাবিতান গহন কাননে আচ্ছাদিত। শুধু মৃত্তিকা ও তাহার অচ্ছেদ্য সম্পর্ক এখানেই তিনি অলঙ্কারাদি অন্বেষণ করেন, হৃত সম্পদ লাভ করিয়া একদা গঙ্গায় তাহা শুদ্ধ করিবার নিমিত্ত কয়েক পদ অগ্রসর হইয়াছিলেন, তিনি তীরে দণ্ডায়মানা, নিম্নে জলোচ্ছাস; সহসা তাঁহার ধারণা হয় স্রোতোধারার উপর আপনার সম্পদ সমুদয় মেলিয়া ধরিলেই শুদ্ধ হইবে, ইহার পর আবার এই আক্রমণ।
উগ্রতেজা বলিষ্ঠ বৈজুনাথ এখনও তেমনিভাবে তাঁহাদের বেষ্টন করিয়া সবেগে ধাবমান, তাহার পদদলিত তপ্ত ও তীব্রতর প্রভাবিশিষ্ট ধূলারাশি শূন্যমার্গে উখিত; সে দাম্ভিক, তাহার ঔদ্ধত্যের পরিসীমা নাই, তাহার বেগবিক্রমে একথাই প্রকাশিত যে, আমি মহাবিটপীসকল অক্লেশে উৎপাটন করিব, আমি উত্তুঙ্গ গিরিসকল বিদারণ করিব, আমি মত্ত সাগরকে সংক্ষোভিত করিব। স্বপ্নের দ্রষ্টাকে আমি দাস রাখিব, আমার গতি অব্যর্থ, কি সাগরশৈলে কি বনে অথবা পাতালে–কোথাও আমার গতি প্রতিহত হয় না।
সীতারাম-অভিলাষিণী যশোবতী দুরদৃষ্ট দর্শনে প্রমাদ গণনা করিলেন; একধারে, অতি প্রতীক্ষার অরুণাভ ভেদ করিয়া মনসিজ আলিঙ্গন; অন্যত্রে জাগরণে, প্রত্যক্ষে–নাদ উচ্চনাদ গর্জন মেঘরব, এবং ধূলারাশি! সাধ্বী আর এক মুহূর্তকাল বিলম্ব না করিয়া স্বামীর আলিঙ্গন এক স্থানে রাখিয়া অর্থাৎ স্বামীর ভয়ার্ত হস্তদ্বয় হইতে আপনাকে মুক্ত করত কোমরে কাপড় জড়াইয়া কোন সময় যে কাজললতা হাতে দুষ্টকৰ্ম্মা চণ্ডালের পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছেন, তাহা তিনি নিজেই জানিতেন না। কালসর্পের মত বেণী চমকাইতে লাগিল, এবং তাঁহার পূর্বপুরুষের সাধনার দেহখানি শুধুমাত্র শব্দময়। আননে চন্দ্রালোক নাই, নিয়ম লঙঘন করত এখন, ওতপ্রোত সূৰ্য্যালোক দীপ্তি দান করে।
চণ্ডাল তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিল; বৈজুনাথের দেহ যেমত বা একটি সাষ্টাঙ্গ খাড়া প্রমাণ; দেখিল গঙ্গায় যেন ঢল নামিয়াছে; দেখিল, যাহা ভয়ঙ্কর উহা দুধর্ষ, তাহা অভিরাম, হাজার জোনাকি। সে গতি কোনক্রমে সম্বরণ করিয়া দুই পা পিছাইয়া গিয়াছিল, নিরক্ষর বিড়ম্বনায় তাহার শ্রবণশক্তি ক্লীব, দৃষ্টি হস্তীদলিত অন্ধকার মাত্র; গঙ্গাতীরে, স্তব্ধতার তলে, কেন না স্রোত অধুনা রেখানিচয়, বৃদ্ধের গোঙানির শব্দ শোনা যায়। চণ্ডাল ভূত-চালিতের মত কি জানি কেন আপনার হস্ত প্রসারিত করিয়া ক্রমে ভীতভাবে নামাইয়া লইল, আপনার ওষ্ঠ লেহন করিল।
“চণ্ডাল”–শুদ্ধভাষায় মানিনী যশোবতী তারস্বরে হুঙ্কার দিয়া উঠিলেন; ইনি সেই যিনি আপন দয়িতের ভয় নিবারণার্থে ভয়ঙ্কর ডাকে একদা সমস্ত মেদিনীকে প্রকম্পিত, সমস্ত স্পন্দনকে শিথিল করিয়াছিলেন। অতএব তাঁহার নির্ভীক উচ্চনাদে বৈজুনাথ বিহ্বল; সে কোনক্রমে আপনকার চক্ষুদ্বয় তুলিয়া সেই অপূৰ্ব্ব রমণীকে অবলোকন করিতে গিয়া আকল্প নবীন অতি সূক্ষ্ম স্পন্দনের বিভূতি দেখে, যাহা দিব্যচক্ষুর অন্তর্গত, যাহা কাব্য-মনসার চিৎস্বরূপ; তথাপি মূঢ় বৈজুনাথ, যে সন্ধ্যা এবং ব্রাহ্মমুহূৰ্ত্ত সম্পর্কে নিশ্চেতন অনভিজ্ঞ, সে আপনার সুদীর্ঘ নিঃশ্বাসে আপনাকে বলবান করিয়া রূঢ় চক্ষে চাহিল, এবং নির্বোধের ন্যায় ঈষৎ হাস্য করিল।
যশোবতী সরোবর সরিৎ, নদী, লতাগুল্মাদি সপ্তপর্ণবনানী, গিরিসমূহ, ভূতগ্রাম সকলের, মৎস্যাদি উভচর সকলের যেন–পথরোধ করত এখনও দৃঢ়, একক; তাঁহার অবগুণ্ঠন নাই, হস্তে সীতারামের। কাজল চচ্চা নিমিত্ত ফলক ইব কাজললতা, মারাত্মক ছুরিকার ন্যায় শোভা পাইতেছে; ঈদৃশী লজ্জাহীনতা এবং দুর্জয় আভঙ্গ দেহসৌষ্ঠবের মধ্যে তিনি নিশ্চয়ই বিদ্যমান ছিলেন, তন্নিবন্ধন অনন্তর চণ্ডালকে পূর্ণভাবে নিরীক্ষণ করত কহিলেন, “তোমার…তোমার মনে কি কোন মায়া-দয়া নেই” একথা বলিতে বলিতে তাঁহার, হরিণনয়না যশোবতীর, সুতপ্ত অশ্রুধারা নামিল।
এ হেন বাক্যে অনাৰ্য্য চণ্ডালের শিরা-উপশিরা হা-হা করিয়া উঠিল, আজন্ম ক্ষুৎপিপাসা কাতর তাহার মন, কথাগুলিকে যেমত বা আহার করিবার মানসে আঘ্রাণ করিল এবং উত্তর দিল, “দয়া মায়া…” এ উচ্চারণে ভঙ্গ ছিল।
সঙ্গে সঙ্গে প্রতিধ্বনিত করিলেন, “হু”–তখন তিনি ক্রোধে ফুঁসিতেছিলেন।
“বটে বটে, এ শ্মশানে” বলিয়া বৈজুনাথ অত্যধিক তাচ্ছিল্য-সহকারে সমগ্র শ্মশানকে অঙ্গুলিদ্বারা নির্দ্দেশ করিয়া পুনরায় যোগ করিল, “এ শ্মশানে পাব কুত্থাকে গো কনে বউ”–এ সময় তাহার অঙ্গুলিতে চন্দ্রলোক লাগিয়াছিল, এবং ইহার পর আপনার মনে দয়া মায়া’ বলিয়া হাসিয়া উঠল।
যশোবতী চণ্ডালের হাস্য তরঙ্গের প্রতি মনোনিবেশ করিলেন, তখনও তিনি যথার্থ সম্বিৎ ফিরিয়া পান নাই, তিনি এখনও অনবগুণ্ঠিতা, তবু ইহা ধ্রুব যে, তিনি আলোতে, অন্ধকারে, একাকিনী, লোকচক্ষে, রক্তমাংসে বধূ; তাঁহার তীক্ষ্ণ রূঢ় সাহসদীপ্ত গম্ভীর কণ্ঠস্বর শ্রুত হইল “তুমি কি ওঁকে মেরে ফেলতে চাও? তোমার মনে কি ভগবান এতটুকু মায়া মমতা…”
“ভাল গল্প গো ভাল গল্প! মায়া মমতা একমাত্তর আমার থাকার কথা, না? আমি জাত চাঁড়াল, বলি মায়া মমতা কোথাকে পাব গো, ও সব ত বামুন কায়েতের ঘরে মরাই মরাই…বেশ মিঠে হিম হাওয়া, না গো…”
“চাঁড়াল”
“ভুল বেগোড় বুঝলে বটে বামুনের মেয়ে, এক গল্প বলি, এখানে যা ছিল, একটু একটু করে সবই পাঁচ ভূতের চিতায় গেছে…মায়া দয়া!”
“তুমি”…
“হ্যাঁ গো কনে বউ তুমি কখন কেঁদেছ?”
যশোবতী সহসা মৃত্তিকায় পদাঘাত করিয়া দর্পভরে কহিলেন, “তুমি ওঁকে শান্তিতে…” এবং উক্তির সঙ্গে সঙ্গেই এবাক্যের ম্লান নিদারুণ ছায়া দুইজনের ইতিমধ্যে নিপট হইয়া দেখা দিল, আর যে ক্রমে তাহা বিলীয়মান। যশোবতী চণ্ডালকে নিরুত্তর দেখিয়া আরবার সুন্দর করিয়া কথা কয়টি উচ্চারণ করিলেন, “তুমি কি শান্তিতে…”
“মরতে” ইহা বৈজুনাথ প্রশ্ন করে নাই, তাহার কণ্ঠস্বরের বেদনা কোন তুমুল সমুদ্র পার হইতে চাহিল, অনন্তর কুয়াশায় আবছায়া স্বরে কহিল “কনে বউ তুমি খুব খাসা, তাই হে যা বল তাই সে কথাই তোমার লাগসই হে, এখন তুমি বল দয়া মায়া আছে কি না, বাঃ!”
বাক্য, শব্দের পূর্বের এক অচিন নিস্তব্ধতা এখানে আবর্তিত হইল! মিলন অভিলাষিণী সুন্দরী, অন্যধারে শ্মশান পরিচর্যাকারী নরদেহ।
বৈজুনাথের ওষ্ঠ ওঠানামা করে; ঝটিতি, এই গহনরাত্রে যাহার একান্তে কুয়াশা আবৃত খরধারা, তাহার ভগ্নস্বর শ্রুত হইল, “বামুনের মেয়ে, কনে বউ, আমি আকাশ খাই গো, তুমি পূব দক্ষিণ দশ দিক কখন দেখেছ…এখানে তোমার তরে সব সোনা হবে” বলিয়া কিঞ্চিৎ শ্মশান-মৃত্তিকা তুলিয়া আরম্ভ করে, “দেখ, দেখ তুমি হেঁটে গেলে, এ মাটি আবাদ হবে…” বলিতে বলিতে বৈজুনাথ ষড়ৈশ্বৰ্য্যময়ীর প্রায় নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল।
চণ্ডালের করপুটে মৃত্তিকা, কুয়াশা নাই, যশোবতী সজল স্নেহময়ী চক্ষে এ মৃত্তিকা দেখিয়া, চকিতে কয়েক পদ পশ্চাদপসরণ করিলেন। বৈজুনাথ হস্তস্থিত মৃত্তিকারাশি ফেলিয়া দিয়া ম্লান হাস্যে কহিল, “কাল শালা যাকে লিয়েছে সে যাক্। কিন্তু কেউ কাউকে ঠেলে চিতায় ফেলবে, এটা কি বল? ওগো বাবু, আমার দোষ লিও না,– এ সময় তাহার আওয়াজ কুয়াশা-বিজড়িত, আর্দ্র, শ্রমখিন্ন; দীনমানসে আন্তরিক ভাবে বলিল, “আমি মারলে ঠেঙ্গা ফিরলে লাঠি নই, উঁচু নই চাঁড়াল গো, চাঁড়াল…পুঁথিপাঠ নাই, তোমার চিতা করব না হেঁকে বললুম…আমি ঠাকরুণ ইন্দ্ৰত্ব আশা করি না, বৈকুণ্ঠবাস চাই না, নয় হে দুঃখ হয়েছিল…দেহ বড় ভালবাসি মড়াকে যত্ন করি…”
“চণ্ডাল”–যশোবতী উচ্চৈঃস্বরে তাহাকে প্রকৃতিস্থ করিতে চাহিলেন, সমস্ত আবহাওয়া এখন তাঁহাকে কিয়দংশে শান্ত করে, আর তিনি সম্যক, হয়ত বুঝিয়াছিলেন, বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, এই, ইহা শ্মশানভূমি হইলেও ইহা আদর্শতুল্যা অলাতচক্রাকৃতি পৃথিবীর, যাহা উত্তম হাস্যধ্বনি পরিমণ্ডিত, অংশ; নিম্নে, উগ্র তীব্র ক্ষিপ্ত বেগবতী স্রোতস্বিনী!
যশোবতীর কণ্ঠস্বর সঙ্গীতময় হইত যদি তাহা আকাশচারী; কাব্যময় হইত যদি তাহা সৃজনক্ষম; চিত্রমায়া হইত যদি তাহা বর্ণিকাভঙ্গধর্মী।
“হা হা, বুঝি বুঝি গো রহ রহ.কনে বউ, যে মানুষ নিজে ভস্ম হতে চায়, সে এ সোনার ত্রিভুবন জ্বালাতে পারে গোগা…ছিলাম শব তোমায় দেখি শিব হইলাম গো,– এইটুকু বলিয়াই আপনার জিহ্বা কাটিয়া কান মলিয়া কহিল, “না হয় ভস্ম হব গো, তবু আমি তোমার হাতেই হব গো, রামের হাতেই হব হে…”
“তুমি যাবে কি না”–এ বাক্য সাগর অভিমুখী, সাগররূপ কান্তর মিলন অভিলাষিণী স্রোতকান্তার একনিষ্ঠতা দর্শনে সাহসী হইয়া তিনি বলিয়াছিলেন।
“আমি এ হতে দিব না গো…তুমি পালাও হে, দুনিয়াটা খুব বড় কনে বউ–দুনিয়াটা খুব বড় বলতে, আমার কেমন রোমাঞ্চ হচ্ছে হে…পালাও কনে বউ।”
“মড়াই তোমার বুদ্ধিতে চলে…”
“মড়া” বৈজুনাথ এবম্প্রকার বিস্ময়ে এ বাক্য উচ্চারণ করে যে, বাক্যের সহিত চিত্র এই প্রথম একক হইয়া, একটি বিস্ফারিত নেত্র, পরিক্রমণশীল! ইহা সে দর্শনে অনড়, আপনকার ক্ষোভ, মর্মবেদনা, অপ্রসন্নতা, কিছু প্রশমিত হইবার পর সে ধীরে ধীরে কহিল, “মড়া!” ক্ষুদ্র একটি নিস্তব্ধতা দেখা গেল, ইহাও তাহার বাক্য বৈ অন্য নহে, এবং করুণ আর্তনাদে কহিল, “নর দেহ, নর দেহ যার কেউ নেই যে নিজে ছিল” পরক্ষণেই আপনার দুর্বলতা বুঝিয়া সশ্লেষে বলিল, “মড়া আই গো কি গেদা গো তোমার কনে বউ…আমি কি মানুষ হব না, বামুনের মেয়ে, কখন হয়ত বলবেক হারে তোর বড় নপর চপর, বেটা তুই পাতকুড়নোর অধম ছোট জাত…হাঁটছিস আমাদের মত, কনে বউ আমার হাতে জল চলে না রূপো চলে…বুদ্ধি…”
“তুমি যাবে কি না…”
বৈজুনাথ হয়ত তাঁহার মানরক্ষা নিমিত্ত দুয়েক পদ ধীর পদক্ষেপে সরিয়া আসিয়া হঠাৎ বসিয়া পড়িয়া কুয়াশা পরিবৃত গঙ্গার দিকে চাহিল, ছোট একটি দীর্ঘশ্বাস, সম্ভবত তাহার, চণ্ডালের, ঘুরিতে ঘূর্ণায়মান অপসারিত; ক্রমে শান্ত কণ্ঠে আপন মনে বলিতে লাগিল, “তোমার বিয়ে দেখলাম গো, গান গাইলাম গো, আমি তারাগুলোকে জলে দেখি, জাত চাঁড়াল এমন বিয়া-সাদি আমি দেখি নাই, মাগভাতার মাদুরে এক, হেঁসেলে দুই, প্রকারে তিন–আমার বউ বলত; তোমার বিয়ার দিন তারিখ নাই। কিন্তু তুমি দিয়ে দিলে বুড়ার হাঁড়িতে চাল, তাই বলে…এমন বিয়ে এ যে ভেল্কী…বুঝাও কোন মতে সিদ্ধ, তবে হ্যাঁ খুব খেয়েছিলাম গো–এ এক অবাক গল্প না গো কনে বউ?”
যশোবতী চণ্ডালের গতিবিধি অনুসরণ নিমিত্ত এখনও সেখানেই; আপনার ছায়ার প্রতি তীব্র কুঞ্চিত দৃষ্টি হানিয়া বৈজুনাথকে দেখিলেন, যাহার গাত্রবস্ত্র, গামছা, আলুলায়িত যাহা মন্থর বায়ুতাড়িত।
যশোবতী বাক্যহীনা, তথাপি বেলাতটে, এখন আসীন বৈজুনাথের মনে হইল, কনে বউ তাহার বোকা সরল কথায় বিদ্রূপ করিলেন, ফলে সে গম্ভীর স্বরভঙ্গে বলিল, “আমরা আর কি বল আমাদের ত জ্বললে আঁধার, নিভলে আলো–এ বড় ভাগ্য যে আমা হেন মানুষ নিঃশ্বাস নেয়!”
যশোবতী হেঁয়ালী বুঝিলেও একথা তাঁহার বিশ্বাস ছিল, যে বৈজুনাথ সেইটুকুর মধ্যে বাঁচিয়া নাই, তাহার পিছনে সম্পর্ক আছে, অনেক ঔদ্ধত্য আছে, সে দুর্ধর্ষ; অনন্য মনে এ সকল কিছু তিনি জ্ঞান করিতেছিলেন এবং এই সূত্রে হয়ত তাঁহার মনে হইয়াছিল তিনি যশোবতী, কি এখনও দিক নির্ণয় করিতে সক্ষম, তিনি কি প্রহর মানিতে পারদর্শী, তিনি কি ফুলসকল ফলসমূহ মৎস্যাদিকে চিনিয়া লইতে অভিজ্ঞা! এবং ঠিক এই সময়ই প্রত্যক্ষ করিলেন যে চণ্ডাল বৈজুনাথ বাঁকিয়া সম্মুখে তাহার হস্তদ্বয় ভুমি’পরি ন্যস্ত, পদদ্বয় কিছু বিস্তৃত, অবাক নয়নে তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়াছে। তাঁহার, যশোবতীর, দৃষ্টি অনুভব করিয়া কহিল, “তুমি কি সুন্দর…”
“চণ্ডাল” তাঁহার বাক্য মেঘরহিত আকাশকে বিদীর্ণ করিল।
“সত্যিই তুমি সুন্দর কনে বউ…” বলিয়া বৈজুনাথ উঠিয়া দাঁড়াইয়া ধূলা হাতে হাত আঘাত করত ঝাড়িয়া ফেলিয়া কহিল, “যাক আর সময় বেশী নেই, কাল…কাল যখন চাঁদ লাল হবে কিন্তু তবু বলব কনে বউ তুমি সত্যই মাটি ছুঁয়ে বলছি কাল চাঁদ যখন লাল হবে,– বলিতেই সে, চণ্ডাল, অচিরাৎ ত্রাসে বিমর্ষতায় নিদ্রিত, স্বপ্ন তদীয় রজনী লইয়া নিঃশ্বাস তাহার মিত্র হইয়া দেখা দিল; অঙ্গুলি যেখানে হাসে, সেই দুয়ে হাস্যধ্বনি, মত্ত মাতঙ্গ স্বভাব এবং তাহা ঘোর, মেঘদর্শন, অধুনা তরঙ্গায়িত! বৈজুনাথ আত্মসম্বরণ করিল, জাগিল; সমস্ত, প্রতিবিম্বিত দীপ্তিতে, আধোউদ্ভাসিত বৰ্তমান সমাকীর্ণ উদ্ভট ব্যাকুল দৃশ্যমানতা অবলোকনে তাহার মনে হয়, আপনার স্বপ্নকে লইয়া এখানেই ঘর করিবে, কেন না এই লোক চরাচর তাহার স্যাঙাৎ, ইহার সহিত তাহার বহুকালের প্রণয়, তথাপি যাহাকে কিছুক্ষণ পূৰ্ব্বে আপন আত্মম্ভরি মনে, পৃথিবীটা খুব বড়’ বলিতে রোমাঞ্চিত হয়, কেননা সে ঐ সূত্রে সুমহান বিরাটত্ব অনুভবে ক্ষণমাত্র বীতচেতন। ক্রমে বৈজুনাথ মায়িক স্বরে কহিল, “কিন্তু তবু বলি সময় নাই গো, আমার এক গল্প শুন হে তুমি, তুমি কনে বউ তুমি লিজে নারী কি পুরুষ একথা জানি না, তুমি কোন দেশের কোন মাহালের তা জানি না, কিন্তু পুড়বে ভাবতে যেন আমি চৌচির, এ কথা ভাবতে আমি মুরারী গো (অর্থাৎ দারুভূত)” ইহার পর চণ্ডালের কণ্ঠস্বর যেন শায়িত এবং শোনা গেল, “অহরহ তুমি তুমি ভাবতে আমি যেন তুমি হই যাই হে” এবং পুনরায় তাহার শব্দপ্রবাহ ব্যক্ত করে, “মনে লয়, মন মানে ভরত–আহা জনক রাজা হরিণ হরিণ হরিণ করতে হরিণ” বলিতেই তাহার দেহ হরিণের নিরীহগতি প্রযুক্ত, সে কিছুটা চলিল।
অন্যপক্ষ এতাবৎ, সূক্ষ্ম যশোবতী, নিম্নে, নিকটে, আপন ইহকাল দিয়া স্বামীর অস্তিত্ব-অভিজ্ঞান সকল দেখিয়া লইতে কৃতনিশ্চয়; ফলে এই হয় ধ্রুব যে, বাগ্মী চণ্ডালের অজস্র ধ্বনিপ্রবাহ তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করে নাই; শুনিতেন যদি, তাহা হইলেও, তাঁহার কোনই বিচ্যুতি ঘটিত না, তাঁহার সঙ্কল্পের নিকট উহা বালখিল্য উচ্ছাস পরম্পরা, যাহাকে নিমেষেই, ধরিত্রীপৃষ্ঠের বারিপাত হেতু ক্ষেত্রের অলীক ঝরণা পরাস্ত করিতে এক লহমা, তথাপি তাঁহার একথা মনে হইলেও হইতে পারে, যে, ইহা কি শ্মশান? বীজ বপন করিলে যথার্থই এখানে কি অঙ্কুর দেখা দেয় না!
বৈজুনাথ হরিণগতি সম্বরণ করত চকিতে ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া অব্যর্থ কণ্ঠে বলিল, “তোমাকে আমি মরতে দিব না হে”,–পুনরায় দ্রুত পাশ হাঁটিয়া কহিল, “পারতুম যদি, তোমায় ছুঁয়ে দিতুম গো কনে বউ।”
এবম্প্রকার ভাষায় যশোবতীর দেহ, শিখা যেমত, ভ্রমর যেমত, পদ্মপত্র যেমত, তড়িৎ প্রবাহ যেমত, অতীব চঞ্চল, আপনার মস্তক সঞ্চালন করিয়া অন্তর্মুখী হইতেই হস্তধৃত কাজললতা মাটিতে খসিল। তিনি, ইহা কি সত্য, সম্মোহিতা হইলেন।
বৈজুনাথ যশোবতীর এ বৈলক্ষণ্য অনুধাবন করে নাই, সে উদ্দীপ্ত, সে আপনার কথা সাজাইতে ব্যস্ত, “হ্যাঁ গো, তোমার সত্যি সত্যি বিয়ে হয়েছে, না সেটা স্বপ্ন…কে জানে বাপু.আমার কেমন আঁট নাই…মনে হয় দশ রাত জাগা…কখন কোথায় মনে লেয় না, কখন না থাকলে কোথায় সেটা নাই…মনে লেয় আমার গা-চাটা বয়েস…” বলিয়াই অতি সূক্ষ্মভাবে হাসিয়া নববধূর প্রতি দৃষ্টিপাত করিল।
যশোবতী পর্ব্বতছায়ার মত স্থির।
এতদ্দৃষ্টে, চণ্ডাল স্তম্ভিত, নিস্পৃহ; ইহার কিছুক্ষণ পরে সে কেমন এক ভাবের ভাবী হইয়া, ঘোর বশে মৃত্তিকা তুলিয়া করজোড়ে, চণ্ডাল বৈজুনাথ, সুন্দর প্রার্থনার কণ্ঠে বলিতে আরম্ভ করিল, “তোমায় মান্য করি কনে বউ, তুমি বামুনের মেয়ে আমার দোষ লিও না, তুমি একবার ভাব আমি খল কটু নই, তুমি হে গহনা ছুঁড়লে…আমি কিন্তুক সে মনা নই হে, তঞ্চক বঞ্চক…সত্যিই যদি, তাহলে লিয়ে ফেরার হতুম…” বলিয়া সে অল্পকাল থামিল, মৃত্তিকারাশি ঝরা শব্দ শোনা গেল।
সহসা ঐ শান্ত একটানা শব্দ ভেদ করিয়া বিদ্রুপাত্মক এক ঘোষণা হইল, “মাতাল বজ্জাত।” ইহা যশোবতী বলিয়াছিলেন।
বৈজুনাথ যুগপৎ, অন্যরূপে ইহার প্রতিধ্বনি করিল; মৃত্তিকা সকল সদম্ভে ফেলিয়া, আপনার গণ্ডে বার বার চপেটাঘাত করত কহিল, “হা কপাল, কপাল, চেনা মানুষকে চিনতে লারলে গো, চোখ কালো বলে কি দিনমান আঁধার হবে হে? মদ! বলি গল্প শোন, মদ আমাকে সৎ করেছে তাই না এতেক বললুম…মদকে দুষো না, মদের নাম প্রমোদন…মদ আমায় সংযম করে,…তোমাকে খোলাখুলি বললাম হে তারই জোরে…”
“তুমি যাবে না…”
“ওই গো ভাবের ঘরে চুরি,– এবং পরক্ষণেই মুখভঙ্গী সহকারে কহিল, “তুমি কি ভাবো ওই ঘাটের মড়া তুমার সোয়ামী…
“হ্যাঁ, স্বামী” যশোবতীর এই উত্তরে সমগ্র বিশ্বের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ছিল, এ স্বীকারোক্তির অখণ্ড তৈলধারাবৎ পতিভক্তিতে কাল বিমর্পিত হইল; স্পন্দন গতি যাবতীয় দ্রব্যসকলের আর প্রয়োজন নাই–চন্দ্র সূৰ্য্য অচিরাৎ দায়মুক্ত।
বৈজুনাথ একমাত্র জীব যে আপনার মাথা তুলিতে এখনও সমর্থ, সে যারপরনাই শক্তিতে ফুকার দিয়া উঠিল, “মিছা মিছাই মিথ্যা হে কঠিন মিথ্যা গো” সমস্ত জীব জগতের হাহাকার তাহার এই আৰ্তনাদ, যাহা দিগ্বিদিকে মাথা ঠুকিয়া ফিরিল; অতঃপর সে দন্তঘর্ষণ করিতে করিতে ব্যক্ত করে, “আ হা…মানুষ এক অচিন গাছ, মানুষ বড় ডাগর জীব গো, কাঠের বিড়াল দিয়া ইন্দুর ধরে…..তাই না?” বলিয়া হা-হা রবে হাস্য করিয়া আবার জলদগম্ভীর কণ্ঠে কহিল, “মিথ্যা।”
তাহার, বৈজুনাথের, বাক্যশব্দ যেমন বা সূৰ্য্যকে নাম ধরিয়া ডাকিল, ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকারে সময় আরূঢ় হইয়া উদ্দাম, কৰ্ম্ম প্রতিশ্রুত হইয়া আবর্তিত হইল।
বৈজুনাথ আর বাক্যক্ষয় করিল না, সে শ্লথ পদবিক্ষেপে অগ্রসর হয়; সে যেমন বা কিয়দংশে মর্মাহত, চন্দ্রালোকে এত বড় মিথ্যার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না, ফলে তাহার মস্তক অবনত; একবার, সে মুখ ফিরাইয়া যশোবতাঁকে নিরীক্ষণ করে, দেখিল, তিনি তখনও তেমনভাবেই দণ্ডায়মানা।
.
যশোবতী ইদানীং একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করত, আত্মকেন্দ্রিক, এবং নিমেষেই সহজ, এবং অতি দ্রুত আপনার অঙ্গাভরণ সংযত বিন্যস্ত করিয়া, যেন বা দৌড়াইয়া, স্বামীর নিকট প্রত্যাবর্তন করিলেন। অর্ধ-আস্বাদিত আলিঙ্গন, চাঁদোয়ার ছোট অন্ধকারে, যাহা তিনি রাখিয়া সম্মুখ সমরে নামিয়াছিলেন তাহা সন্ধান করিতে এখন প্রয়াসী।
বৃদ্ধ সীতারাম তখনও কাঁদিতেছিলেন; ধীর বিলম্বিত লয়ে ক্রন্দনের ধারা শূন্যতায় উঠে নামে। যশোবতীর কেমন যেমন ভাবান্তর দেখা দিল, অবশ্য তাহা কয়েক মুহূর্তের জন্য, যদিও তিনি স্বামীর নিকটেই তথাপি আৰ্ত্ত ত্রাস আবিষ্ট রোরুদ্যমান বৃদ্ধের সযত্নে চক্ষু মুছাইবার মত স্নেহ তাঁহার মধ্য হইতে অন্তর্হিত; ভূতগ্রস্তের ন্যায় তিনি বসিয়া আছেন, কৃষ্ণপক্ষের শশিকলা যেরূপ ক্রমশঃ ক্ষীণা, তেমনই তিনি, যশোবতী, অঘোরচারী ঈপ্সিত অমাবস্যা তাঁহার ধমনীতে, রক্তে, পরিপ্লাবিত। কিছুকাল পূর্বের কথা, তামসিক চণ্ডালের রাজসিক কণ্ঠে সত্ত্বগুণ দীপ্ত বাক্যালাপ সম্ভবত তাঁহাকে, তাঁহার দেহ হইতে উচ্ছেদ করিয়াছিল, অবশ্যই সত্যই অমৃতবারি সেচন করে নাই। কখনও কখনও তাঁহার পলাতক মন দেহের সহিত সহজ বন্ধন লাভ কালে, তথা দেহের সহিত মন সংযুক্ত হইবার কালে, দেহ ওতপ্রোতভাবে দুলিয়াছিল; যশোবতী আপনার ললাটে, এ সময়, দক্ষিণ হস্ত প্রদান করিয়াছিলেন; তাহা কি করাঘাত সূত্রে অথবা স্বেদ মুছিবার কারণে তাহা জানিবার উপায় নাই–কেন না উহাতে কোন চিত্রসংজ্ঞা ছিল না। আর যে এইক্ষণেই তিনি মানসচক্ষে অবলোকন করেন, কাহারা যেমত বা এক মধুর গীত গাহিতে গাহিতে আসিতেছে, ইহাদের স্বেদ নাই, ইহারা ক্লান্ত নহে, যে গীতের মধ্যে আশা, যে আশার মধ্যে গোলাপের গন্ধ, যে গোলাপ গন্ধের মধ্যে বাল্যকাল, যে বাল্যকালের মধ্যে নিরীহতা, কাহার অন্তরীক্ষ আলেখ্য বহনে গর্বিত।
এই দৃশ্যকাব্য তিনি যেন পান করিতেছিলেন, কিছুকাল এইভাবে অতিবাহিত, পরে আপনার দেহভার অনুভব হয়। চণ্ডালের সহিত সাক্ষাৎকার অতীব আশ্চৰ্য্য, শরীর তদবধি সন্তপ্ত, তিনি জল লইয়া চক্ষু কর্ণে এবং আপনার পদযুগের বৃদ্ধা অঙ্গুষ্ঠার উপর দিয়া, অতি বিস্ময়কর কথা যে, তিনি। আপনার বিকলাঙ্গ ছায়ার উপর জল সিঞ্চিত করিয়া, এখন আলগোচে কিঞ্চিৎ পান করিলেন। শীতল জলের স্পর্শে বুঝিয়াছিলেন, মস্তক শিরঘূর্ণনে উপদ্রুত, যদিচ শিরঘূর্ণন এখনও প্রশমিত হয় নাই, তথাপি তদবস্থায় আপনার চমৎকার সুডৌল মৃণালভুজদ্বারা জন্মান্তরের স্বামীকণ্ঠ, মহতী গভীর হৃদয়ে আলিঙ্গন করিয়াছিলেন।
.
সপ্তর্ষি মণ্ডলের অনতিপূৰ্ব্বে চন্দ্র প্রতিভাত।
অলৌকিক দম্পতি ঘুমে নিশ্চিহ্ন, খুব ধীরে শয্যার খড় বায়ু-সঞ্চালিত। ইহা শ্মশানভূমি, এখানে ঘুমন্তরা আনীত হয়, এখানেও ঘুম আসে; দুজনেই স্বামী এবং স্ত্রী ঘুমে দৃষ্টিরহিত। এক পার্শ্বে মৃতকল্প বৃদ্ধ, অন্যপার্শ্বে পরিশ্রান্ত যশোবতী, ঘুমঘোরে অনেকখানি শয্যাচ্যুত হইয়া বাহিরে, হিমক্লিষ্ট ভূমির উপরে আসিয়া পড়িয়াছিলেন, দেহ ত্রিভঙ্গ, কুণ্ডলীকৃত নহে, কর্কশ ধ্বনি ব্যক্ত, এবং তাঁহার অর্ধ উন্মুক্ত মুখ বহিয়া লালা নিঃসৃতবান। এমত অবস্থায় তাঁহার নিঃশ্বাস-আলোড়িত বক্ষের উপর একটি ছায়া পড়িল।
‘ভাবের ঘরের চোর’ এই উক্তিও শোনা গেল।
হঠাৎ ছায়া উধাও; কেননা যাহার ছায়া সে কিঞ্চিৎ দূরে সরিয়া যায়। এ ছায়া চণ্ডালের, চণ্ডাল এখনও সম্ভবত নিশ্চেষ্ট হয় নাই, ধৃষ্টতা এখনও প্রধুমিত হইতেছিল; বৈজুনাথের সহসা অপসরণের কারণ এই যে, সে এক অদ্ভুত কিছু এই সান্নিধ্যের মধ্যে দেখে।
একদা যশোবতীর বিবাহের পূর্বে, এক রাত্রে সে ভেড়ীপথ হইতে অন্তর্জলীসুত্রে আনীত, সীতারামকে কেন্দ্র করিয়া কীৰ্ত্তন পরিক্রমণ দেখিয়াছিল; চক্রাকারে ভ্রমণকে মাঝে মাঝে শ্মশানের। চিতার আলোকচ্ছটা উল্লেখ করিতেছিল, আর কুয়াশাবৃত চন্দ্রালোকে যাহা প্রহেলিকা। মন্দিরগাত্রে। রাশমণ্ডলের আলেখ্যর ন্যায় সমস্ত সংস্থান, নেহাৎ সহজ হইলেও উহা অতিকায়, উহা ভয়প্রদ। সেই অনুভূতির কথা মনে করিয়া বৈজুনাথ এখন শুষ্ক, দুৰ্বল; তাহার কেমন যেন মনে হইল সে কীৰ্ত্তনের চক্রকে ভেদ করিয়া আসিয়াছে; সত্যই, সে শঙ্কিতচিত্তে আপনার চারিপার্শ্বে লক্ষ্য করিল। সত্যই সেই রহস্যময়, মস্তক আবৃত, শীতকুণ্ঠিত লোকগুলি ভ্রাম্যমাণ কিনা!
পুনরায় একই মনোভাবে ঘুমন্ত যুগলমূর্তি দর্শনে সে নিঃসন্দেহে হতজ্ঞান, সম্মুখে রাশমণ্ডলের প্রাণস্বরূপ কেন্দ্র চারিভিতে আলোক উদ্ভাসিত, আর মধ্যে চাঁদোয়ার অন্ধকার, বৃদ্ধ আবছায়া, যশোবতী প্রতীয়মানা; বৈজুনাথ সম্যক উপলব্ধি করে যে তাহার শক্তি অপহৃত হইয়াছে, ক্ষমতা বাষ্পময়, পদদ্বয় রোগীর ন্যায় কম্পিত। কিন্তু তাহার পূর্ধ্বমুহূর্তের চিন্তার আলোড়ন এখন ছিল; সে একদা শুনিল, তাহার আপনার দেহমধ্যে উন্মত্ত মাভৈঃ’ ধ্বনি। ক্রমাগত একই ধ্বনি শুনিতে শুনিতে তাহার চক্ষু সঙ্কীর্ণ হইয়া উঠে, এবং স্বীয় মৃদু হাস্যে সমস্ত সকল বিড়ম্বনাকে উচ্ছেদ করত কহিল, “হা রে ভাবের ঘরের চোর। কনে বউ, এই ত দেমাক, টিকারী, চৈত্রের দুপুরের ক্ষেতের মত পড়ে আছে, রহো রহো হে হে মরণের ছাঁচ হে, মিথ্যেবাদী আমি! সতী হব লোকমান্যি হব…সতী রাণী হে, আমি জাত চাঁড়াল আকাশ বাতাস ভালবাসি না, গঙ্গা লয়, ধুক ধুক করা নরদেহ বড় ভালবাসি…আমি…” এ সকল কথা যখন সে বলে, তখন তাহার ছায়া পুনরায় শ্রীঅঙ্গের উপর বিস্তৃত হয়। আমি’ বলার পরক্ষণেই তাহার ছায়া অদৃশ্য।
বৈজুনাথ চাঁদোয়ার একপার্শ্বে এখন, খড় চড় চড় করিয়া উঠিল, বৃদ্ধ সীতারামকে আচম্বিতে দুই হাতে তুলিয়া দাঁড়াইবার কালে, তাহার একটি হাত যশোবতীর কোমল অঙ্গ স্পর্শ হয়। এইভাবে বৃদ্ধকে নির্বোধের মত তুলিয়া লওয়াতে চাঁদোয়ায় বৃদ্ধদেহটি আবৃত হইয়া পড়িয়া সাক্ষাৎ বিঘ্ন উৎপাদন করে, বেচারী অশীতিপর মরণোম্মুখ বৃদ্ধের প্রাণান্ত আকুল দুঃখধ্বনি একবার মাত্র শুত হয়। তাহার পর নির্বিকার! ইহাতে চণ্ডাল, সত্যই বিমূঢ়, স্থির; সে যেন চন্দ্রালোককে জিজ্ঞাসা করিল, সে যেন শ্মশানভূমিকে জিজ্ঞাসা করিল, সে যেন পারিপার্শ্বিক অন্ধকার সকলকে প্রশ্ন করিলকি ব্যাপার? কিন্তু পরক্ষণেই সে কৃতনিশ্চয়, বদ্ধপরিকর, চাঁদোয়া-আবৃত অবস্থায় বৃদ্ধকে দক্ষিণে কভু বামে আন্দোলিত করিল, দ্রুত কার্য সম্পাদন নিমিত্ত চণ্ডাল হিতাহিত কাণ্ডজ্ঞানরহিত; সীতারামের সূত্রবৎ দেহ এমত মনে হয় যেন জালে পড়িয়াছে; শত চেষ্টাতেও বৈজুনাথ কোনরূপে তাহাকে মুক্ত করিতে সমর্থ নহে। কখন মহা আক্রোশে দাঁত দিয়া চাঁদোয়ার কাপড় ধরিল, কখনও বা চুপ কখনও বা খুঁটিতে পদাঘাত করিল; পদাঘাত করিতেই হাঁড়িকুড়ি লণ্ডভণ্ড ছত্রাকার। বৈজুনাথ দেহ লইয়া অন্তর্ধান করিল।
এই শব্দে যশোবতীর ত্বক, সূক্ষ্মতা জাগ্রত হইল সত্য কিন্তু গভীর নিদ্রা ভঙ্গ হইল না। তিনি অভিভূত অবস্থায় গাত্রবস্তু আপনার শরীরে আচ্ছাদিত করিয়া পার্শ্ব পরিবর্তন করিলেন। নববধুর প্রাণ, জীবনঅভিলাষী দুদ্ধর্ষ চণ্ডাল আপনার কার্যসিদ্ধি নিমিত্ত দ্রুতগ হইল। সীতারামের পদদ্বয় এবং বামহস্ত ভৌতিকভাবে আন্দোলিত, ঘর্মাক্ত চণ্ডাল দাঁত দিয়া রজ্জুবন্ধন ছিন্ন করিয়া পলায়ন করিবার পূৰ্ব্বে যশোবতাঁকে দেখিয়া লইবার ইচ্ছা করিল, কিন্তু তাহা সম্ভবপর হয় নাই কারণ চাঁদোয়া ছিঁড়িয়া যবনিকার সৃষ্টি করিয়াছিল। অভাগিনী তখনও ঘুমে অচেতন। বৈজুনাথ বৃদ্ধকে লইয়া ক্ষিপ্রবেগে ক্রমশঃ ঢালুতীরে নামিয়া গেল।
পরোপকারে দৃঢ়সংকল্প বৈজুনাথ বৃদ্ধকে লইয়া বিশেষ সন্তর্পণে গঙ্গায় পদক্ষেপ করিতে করিতে নামিতে লাগিল। তাহার কণ্ঠে বার বার ধ্বনিত হইল, “পাপ আবার কি–পাপ শালা…তুমি শালা যত নষ্টের গোড়া, হ্যাঁ…দোসর লাও শালা বুড়ো–” বলিতে বলিতে সে কিছুটা গঙ্গায় নামিল। একবার মুমূর্ষ দেহটি দক্ষিণে বামে আন্দোলিত করে। ইহার একটি পা গঙ্গাস্রোতে, অন্যদিকে হস্ত গঙ্গার জলস্পর্শ করিয়াছে। বৈজুনাথের ঊরু জলমগ্ন, সে পা টিপিয়া টিপিয়া অগ্রসর হইতেছিল।
অচৈতন্য সীতারামের হস্ত সহসা যেন দৈববলে, মন্ত্রবলে বৈজুনাথকে হতচকিত করিয়া তাহার কণ্ঠ আবেষ্টন করিল। সে টলিয়া গেল, তাহার পর সম্বিৎ ফিরিয়া পাইয়া কহিল, “ওরে শালা বিলে দোসরঘোর” বলিয়া আপনার চিবুক দ্বারা আঘাত করিল, দুইহস্ত প্রসারিত করিয়া দেহটি দূরে সরাইল, তথাপি বন্ধন মুক্ত হইল না। সে পদদ্বয় হইতে ডান হাতখানি সরাইয়া লইতে বৃদ্ধের দেহ জলে পড়িল। তথাপি আলিঙ্গন মুক্ত হইল না–পুনৰ্ব্বার চেষ্টা করিল; তাহার পর আস্তে আস্তে কহিল, “কি রে বাবা, আমায় দোসর লিবি নাকি” সঙ্গে সঙ্গেই বৈজুনাথ ভীত।
বৃদ্ধকে আর কোলে লওয়ার কথা তাহার স্মরণ হইল না, সে দুই হস্ত ছাড়িয়া পালাইবার চেষ্টা করিল। …বৃদ্ধ তাহার কণ্ঠে জগদ্দল হইয়া আছে। সে যেমত ভাঁড়ে বাঁধা নেউলের দশাপ্রাপ্ত হইল। গঙ্গার জল চোখে মুখে দিল এবং সিক্ত বৃদ্ধকে কোনক্রমে তীরে লইয়া উঠে।
সীতারামকে মাটিতে রাখিতেই দ্বি-খণ্ডিত লতার মত বৈজুকণ্ঠলগ্ন হস্তদ্বয় খসিয়া পড়িল। বৈজুনাথ অবাক হইয়া তাঁহার হাতের দিকে তাকাইল; এখন তাহার সাহস ফিরিয়াছে, দৌড়াইয়া আপনার আড়ায় ঢুকিয়া মদ্য পান করিয়া কিছু রঞ্জু ও ছোট একটি কলস হস্তে এখানে উপস্থিত হইল। বৃদ্ধের হাত দুটি একত্রিত করিয়া বাঁধিবার কালে বারবার সে পিছনে তাকাইয়াছিল।
.
যশোবতীর হঠাৎ নিদ্রাভঙ্গ হয়, উঠিয়াই তিনি কবরী রচনার জন্য বেণীতে হস্তদ্বয় প্রদান করিয়া পক্ষীর মত মুখোনি ঘুরাইতেই, ছিন্ন চাঁদোয়ার প্রতি লক্ষ্য পড়িল, হাই মুখে রহিয়া গেল, আর যে, চাঁদোয়া কিছুমাত্র উত্তোলন করিতেই, যখন দেখিলেন যে সেই প্রিয় বৃদ্ধ দেহটি নাই তখন নির্বোধের মত হস্ত দিয়া বিছানা অনুভব করিলেন। চাঁদোয়া পড়িল, তিনি তাহা ছিন্ন করিয়া যখন দেখিলেন কেহ নাই, তখন তাঁহার মস্তক শুষ্ক পাতার মত কাঁপিল। বুড়ো বলিয়া তারস্বরে চীৎকার করিয়াই জিব কাটিলেন। নিজের উন্মুক্ত মৎস্যচিহ্ন ঊরুদেশে আপনাকে উদ্বুদ্ধ করিবার নিমিত্ত চিমটি কাটিতে লাগিলেন, আর যে তৎকালে হৃতবৎসা গাভী যেমত চীৎকার করে সেইরূপ তারস্বরে গগন বিদীর্ণ করিলেন—”কৰ্ত্তা -কৰ্ত্তা- কৰ্ত্তা।”
.
যশোবতী কোনদিকে খুঁজিবেন! বিভ্রান্তভাবে দৌড়াইলেন, স্রোত পথরোধ করে অন্যদিকে নিঃসঙ্গ নৌকা, অন্যদিকে ভেড়ীপথের লতাপাতা আগাছা পথরোধ করিল। তাঁহার পায়ে লতা জড়াইয়া গেল, তিনি বৈজুনাথের আড়ার দিকে গতি ফিরাইলেন, খানিক পথ আসিতেই তিনি স্তম্ভিত, শাসহীন, দেখিলেন–ব্যগ্র, ব্যস্ত বৈজুনাথ স্বামীর হস্তে রঞ্জু বাঁধিতেছে; কলসটি যেমন বা ভূতগ্রস্ত। কি যে করা উচিত তাহা তিনি ভাবিয়া পাইলেন না। আপনার তর্জ্জনী গণ্ডদেশে স্থাপিত হইল। হৃদ্বয় সচাপশরযোজিত ধনুলতার মত বক্র, নয়নযুগল স্ফীত।
বৈজুনাথের দেহ চঞ্চল, সে ক্রমাগতই রোমাঞ্চিত; অথচ কোনক্রমেই তাঁহার আগমন উপলব্ধি করিতে পারে নাই, এ কারণে যে, তাহার কণ্ঠ হইতে অনর্গল কটুক্তি আক্রোশ বাহির হইতেছিল, যথা– “দোসর শালা।”
যন্ত্রচালিতের মত দু’এক পা অগ্রসর হইয়া যশোবতী অতর্কিতে দৌড়াইয়া গিয়া নিকটস্থ ভস্মপরিবৃত একখানি অর্ধদগ্ধ কাষ্ঠ হস্তে তুলিয়া লইয়া উন্মাদিনীর মত ছুটিয়া আসিয়া বৈজুনাথকে আঘাত করিলেন। বৈজুনাথের পিঠ বাঁকিল দড়িসমেত হাত কিছু দূরে গেল, যশোবতী থামিলেন না। বৈজুনাথ কোন অঙ্গ দিয়া নিজেকে রক্ষা করিবে ভাবিয়া পাইতেছিল না, পশুর মত চীৎকার করিতে করিতে ধরাশায়ী হইল।
.
দেবী প্রতিমার ভঙ্গীতে দণ্ডায়মানা যশোবতী, হস্তে কাষ্ঠ খণ্ড। পায়ে ছিন্নলতা চমকিত, ক্রোধে জ্ঞানরহিত-অপরিসীম ক্রোধ দেহের মধ্যে শব্দ তরঙ্গ যেমত বা কম্পমান, সহসা তাঁহার কি এক রূপান্তর হয়।
ক্রোধ হইতে কাম সঞ্জাত (!) হইল, দিকসকল তমসাচ্ছন্ন, তিনি এহেন ঘনঘটায় একাকিনী, আপনার সুদীর্ঘ অন্তরীক্ষে প্রবেশ করিতে সাহসী হইলেন, আপনার আয়ত্তের বহির্ভূত হইলেন। পলাশের উষ্ণতা এখানে নিঃশেষিত বিকারগ্রস্ত হইবেক, বহুধা ধমনীর মধ্যে কখনও সুঙ্গ হাস্য খিলখিল করিয়া উঠিল, এখন স্ফীত হয়; সুন্দর সূক্ষ্ম ভঙ্গিমায় ঊর্ধ্বে চিত্তশরীরে উঠিয়া সৌরজগতে পথ হারাইল। নির্বিকার সমাধি–অল্পকাল পরে, ক্রমে বিস্ময় আসিল, তথাপি মনে হয় তিনি যেমত বা সনাথ আছেন এবং এরূপ অনুভবে, লোকচক্ষুর সম্মুখে তিনি যেমন বা বিবসনা হইয়া গেলেন, ব্ৰীড়াবনত মুখে শঙ্কায় প্রমাদ গণিলেন, কেননা চতুঃষষ্ঠি প্রকার লক্ষণসমূহ দেখা দেয়, কেননা মৎস্যচিহ্ন উরুদেশ সিক্ত এবং আপন জিহ্বা দংশন করত দক্ষিণ পা বাম পদের পার্শ্বে স্থাপিত করিয়া কিয়ৎকাল নির্জীব অবস্থায় রহিলেন। তাঁহার পিছনে, গঙ্গায়, কারণ সলিলে স্রোত ছিল। …আঃ রমণী! আঃ আশ্চর্য! যে তুমি দুটি অব্যক্তকে একই দেহে–যে দেহে, সূক্ষ্মতা, আলো পায়, ধারণ কর। এক হৃদয়ে অন্য জরায়ুতে। তুমি সেই লীলা সহচরী।
এখন যশোবতী হস্তধৃত কাষ্ঠখণ্ড গঙ্গায় নিক্ষেপ করিলেন। কাষ্ঠের অন্তস্থিত অগ্নি সশব্দে নিৰ্বাপিত হইল।
ক্রমে তাঁহার জ্ঞানের সঞ্চার হয়, ত্বরিতে নতজানু হইয়া বসিয়া দেখিলেন, চণ্ডাল বৈজুনাথ শুইয়া পড়িয়া ছটফট করিতেছে, নিজের কাঁধের একস্থানে বুলাইতে বুলাইতে বলিতেছে, “তোমার তরে কনে বউ…” মাটি হইতে মুখ না তুলিয়াই সে এই কথা বলিয়াছিল।
যশোবতী ঘৃণায় মুখ ফিরাইয়া ক্রমে ক্রমে দেখিলেন, বৃদ্ধের আপনার মস্তক অতিক্রম করিয়া হস্ত দুইখানি বিস্তৃত, দেহ যেন একটি রেখাবৎ, বসন সিক্ত, স্বামীর দুরদৃষ্ট দর্শনে পাগলিনীর মত ছুটিতে, যাইতে, লজ্জিত হইয়া ক্ষণকাল দাঁড়াইলেন। পরক্ষণেই চীৎকার করিয়া উঠিলেন। অসহায় ক্রন্দনরোলে ত্রিভুবন বিদীর্ণ হয়। পৃথিবী আর একবার দুঃখময়ী হইল। বিদ্যুৎবেগে স্বামীর নিকট গিয়া, তাঁহার হস্ত নিজ বক্ষে ধারণ করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন, কখনও কখন ‘ঠাকুর’ এই বাক্য শুধুমাত্র উচ্চারণ করিয়াছিলেন।
“কৰ্ত্তা কথা কও গো” বলিয়া তিনি গঙ্গার বেলাতট চাপড়াইয়া কাঁদিতে লাগিলেন। সীতারাম এখন দেহমাত্র। যশোবতী কোনরূপে তাঁহার ঊর্ধ্বাঙ্গ আপনার উরুর উপরে স্থাপন করিয়া অঞ্চলপ্রান্ত দিয়া মুখ মুছাইতে মুছাইতে স্বরভঙ্গ কণ্ঠে নানা কথা বলিলেন। “কৰ্ত্তা কোথা গেলে গো, আমাকে ফেলে…”
মধ্যে মধ্যে “কথা কও কথা কও”…এই অনুরোধ বাক্য পৃথিবীকে মায়া বশীভূত করে। কালক্রমে তাঁহার ধারণা জন্মিল ইনি, বৃদ্ধ, প্রাণহীন নহেন, অচৈতন্য মাত্র। এবং এই বোধে, তাঁহার সহজ জ্ঞান ফিরিয়া আসিল, মুহূর্তেই তিনি আপনার বস্ত্রদ্বারা গাত্র মুছাইয়া, অনন্তর, স্বামীদেহ যতনে তুলিবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। পুনঃপুনঃ বলসঞ্চয়হেতু, গভীর নিঃশ্বাস লইলেন; আপনাকে প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত জিহ্বা নোলকে ঠেকিল। তথাপি এ অধ্যবসায় বিফল হয়।
৬. যশোবতী বিমূঢ় হইয়া গঙ্গার দিকে চাহিলেন
যশোবতী বিমূঢ় হইয়া গঙ্গার দিকে চাহিলেন। এক্ষেত্রে কি করিবেন তাহা মনে আসিলেও তিনি সঙ্কুচিত হইয়াছিলেন, তাঁহার পদনখগুলি চঞ্চল।
বৈজুনাথের কাষ্ঠের আঘাতপ্রসূত জ্বালাভাব তখনও ছিল, ভাগ্যশঃ কাষ্ঠের উপর ভস্ম আবৃত এবং তাহার একটি স্থানেই অগ্নি প্রজ্বলিত থাকার ফলে বিশেষ কিছু আহত করিতে সক্ষম হয় নাই। তথাপি সে কোনক্রমে উঠিয়া দাঁড়াইয়া স্বলিত পদে দম্পতির নিকট আসিয়া দাঁড়াইয়া কহিল–”এ তোমার স্বামী,…”
মুখমণ্ডল আন্দোলিত করিয়া তুলিয়া যশোবতী কহিলেন–”হ্যাঁ।”
বৈজুনাথ কহিল-”সরো গো।”
যশোবতী দৃঢ়তার সহিত আপন স্বামীকে আঁকড়াইয়া রহিলেন।
“লাও সর কনে বউ–উঠ, দিয়ে আসি।”
এ অনুরোধে যখন যশোবতীর ভাবান্তর হইল না, তখন বৈজুনাথ ঝটিতি দেহটি তুলিয়া লইল, চণ্ডালের হস্তস্পর্শে ব্রাহ্মণকন্যা ক্ষিপ্রবেগে জাতিসম্রম রক্ষা মানসে সরিয়া গিয়াছিলেন। তিনি মাটি ছাড়িয়া সত্বর উঠিয়া স্বামীর জন্য পাগল হইয়া কাড়িয়া লইতে গেলেন। চণ্ডালের অঙ্গস্পর্শ হইবামাত্র তিনি যখন ইতঃস্তত করিতেছিলেন, তখন চণ্ডাল সীতারামের মস্তক দ্বারা তাঁহাকে ঠেলা দিয়া সীতারামকে গালাগাল দিতে দিতে অগ্রসর হইল।
বৈজুনাথ লম্বা লম্বা পায় চলিতেছে। তিনি আধো ছুটন্ত, স্বামীর মাথাটা ঝুলিয়া পড়িয়াছে দেখিয়া তিনি ব্যথিত হইয়া অনেক কথাই বলিতেছিলেন। কখন বা মস্তকটি তুলিয়া ধরিবার ইচ্ছা ব্যগ্র হইয়াছিল!
বৈজুনাথ সীতারামকে শোয়াইয়া দিয়া হাঁফ ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “লাও ঘর কর!”
যশোবতী তাহার দিকে এখন কঠিনভাবে কটাক্ষপাত করিলেন, আর সে নির্বোধের মত স্থানত্যাগ করিতে উদ্যত হয়।
চণ্ডাল বৈজুনাথ কিছুকাল সম্মুখের সংস্থানটির বিদ্যমান আলো অন্ধকারের উপর নিজের মুখোনি বুলাইয়া, ফিরিয়া দাঁড়াইয়া, আপনার স্তব্ধতাকে এই শ্মশানে শায়িত দেখিয়া একটি পা বাড়াইল; সে, সম্বিৎ, নিশ্চয়ই লাভ করে। তাহার পৃষ্ঠস্থিত আঘাতের চিহ্ন, এ হেন চন্দ্রালোকে, যশোবতীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। একারণে, তর্দশনেই তিনি এককালে ম্লান এবং গম্ভীর হইয়াছিলেন।
বৈজুনাথ, আপনার হৃতস্তব্ধতা আবার পাইয়া, ঘুরিয়া, তাঁহাকে তদবস্থায় দেখিয়া অবাক হয়, নিঃশ্বাস লইয়া কহিল, “কনে বউ, বেগোড় বুঝ দিও না গো।” বলিয়াই সে প্রস্থান করিল।
যশোবতী তাহার বাক্যে কর্ণপাত করিলেন না, কেননা শ্মশান আর শবাসনে নাই, ইহা খাড়া–এ সত্য হইতে তিনি ধীর নিঃশ্বাস লইয়াছিলেন। নিজেই আপনার অশ্রুজলের উষ্ণতা অনুভব করত রোদন করিলেন, এমত সময় দৃষ্টিপথের উপর দিয়া একটি শুষ্কপত্র–শুষ্কপত্রের মধ্যে যেমন অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতার মধ্যে যেমন স্বীকারোক্তি, স্বীকারোক্তির মধ্যে যেমন বেদনা, বেদনার মধ্যে যেমন আলিঙ্গন, আলিঙ্গনের মধ্যে যেমন বুদ্বুদ, একটি শুষ্কপত্র খরখর খর করিয়া চলিয়া গেল। তিনি স্বামীর দিকে চাহিলেন, বৃদ্ধকে সিক্ত দেখিয়া, কর্দমাক্ত দেখিয়া, তাঁহার কৰ্ত্তব্যবোধ আসিল; সুতরাং বৃদ্ধের নোংরা। বস্ত্র কারণ বৃদ্ধ অসংযত হন, খুলিয়া তাঁহার সর্বাঙ্গ সযত্নে সংস্কার করিয়া, একটি অন্য কটে’ পরাইয়া। দিলেন, তদনন্তর বস্ত্র ধৌত করিবার জন্য মনস্থির করিতে প্রস্তুত হইলেন।
ক্রমাগত স্রোতের দিকে চাহিয়া, তাঁহার আপনাকে বড় সহায়সম্বলহীন, ফলত বড় আপনার বলিয়া বোধ হয়; কোন কিছুর স্মৃতি মনে উদয় হইল না, শুধু মাত্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অন্ধকার ছোটাছুটি করিতেছে; যিনি উপরে আছেন, মাটিতে আর আর যাহারা, সকলই এক্ষণে নামমাত্র বৈ অন্য নহে।
এক এক সময় আত্মনিগ্রহ করিতে বাসনা হইল, দংশন করিতে ইচ্ছা করিল। এ কারণ যে, এই দুৰ্বত্তের অস্তিত্ব তাঁহাকে অধিকতর কাতর করিয়াছিল। স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি পর্যন্ত রহিত হইয়াছিল। এক্ষণে যে কি করা উচিত তাহা ভাবিয়া কিনারা করিতে পারিতেছিলেন না। অথচ সত্বর বস্ত্র ধৌত না। করিলে শুচিতা রক্ষা হয় না। স্বামীকে চক্ষের আড়াল করিতে তাঁহার কোন ক্রমে সাহস হইতেছিল না।
অনন্যউপায় তিনি স্বামীর কাপড়টি, আলগোচে লইয়া নৌকার পাশে যে অল্প আড়াল ছিল, সেখানে বসিয়া কাপড়টি কাচিলেন এবং একার্য সম্পাদনের মধ্যে বার বার উঠিয়া স্বামীকে দেখিয়াছিলেন। নিজের পট্টবস্ত্র অশুদ্ধ হওয়াতে ভাল মত ভিজাইয়া তীরে উঠিয়া স্বামীর কাপড়টি নৌকায় মেলিয়া দিয়া দেখিলেন, স্বামী শয্যায়, এবং কোথাও কেহ নাই; সত্বর জলের নিকটে আসিয়া গামছাখানি কোনমতে অঙ্গাচ্ছাদন করিয়া আপনার কাপড়খানি কাচিয়া মেলিয়া দিয়া পুনৰ্ব্বার গঙ্গার মাটি ভালভাবে গাত্র মার্জনার পর, স্নান সমাপন করত তীরে উঠিয়া, আপনকার বক্ষ সংলগ্ন গামছাপ্রান্ত খুলিয়া নিঙড়াইতে লাগিলেন, এ সময় তাঁহার দেহ বক্র হয়।
বৈজুনাথ এই বস্তুসংস্কার দেখিল; স্নানলীলা দেখিতে দেখিতে সে উজ্জ্বল হইয়া গেল, ক্ষীণমধ্যা অপূৰ্ব্ব ললিতপদ বন্ধনে দেহ তাহাকে, চণ্ডালকে, যেন বা মনুষ্যোচিত করিল। ভেড়ীর পিছনে সে দণ্ডায়মান, একটি পা শীতকাতর কম্পিত! নিঃশ্বাসে সম্মুখের বৃক্ষপত্র সরিয়া যায়, এবং একারণে। চক্ষুর্ঘয়ের মধ্য দিয়া জিহ্বা বাহির হইয়া পড়িতেছিল। সে আর স্থির থাকিতে পারিল না, জন্তুর মত সেই স্থান বাহিয়া উঠিবার চেষ্টা করিল। মাটি ধ্বসিল, পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করিয়া ভেড়ী পথে উঠিয়া দাঁড়াইয়া, আপনার গতি সংযত করিতে না পারিয়া, এই পার্শ্বের কলমকাটা পথ বাহিয়া,–মাভৈঃ মাভৈঃ গর্জন করিতে করিতে নামিয়া আসিয়া, গঙ্গার তীরে কর্দমের উপর পড়িয়া গেল; তাহার, সম্মুখের হস্ত দুইখানি কর্দমে, সে পশুর মত তাঁহার, যশোবতীর, দিকে চাহিয়া স্থির। যশোবতী এখন বিমূঢ়, সমস্ত দেহ যেন তাঁহার বক্ষে আশ্রয় করিয়াছে, দুই হস্ত সেখানে স্থাপন করত লজ্জায়, শঙ্কায়, ত্রাসে সঙ্কুচিত হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। এবম্প্রকার অঘটনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। বৈজুনাথ কাদা ভাঙ্গিয়া পশুর মতই থপ থপ করিয়া আসিতেছে, লোলজিহ্বায় জোনাকির আলো। ভূততাড়িতের মত তিনি পলাইতে উদ্যতা হইলেন।
বৈজুনাথ উঠিয়া এক লম্ফে আসিয়া তাঁহার গামছাপ্রান্ত আকর্ষণ করিল, তিনি অনিচ্ছাসত্ত্বে ঘুরিয়া গেলেন; সে অতর্কিতে তাঁহার একটি হাত ধরিল এবং নিজের হস্তের গামছা মাটিতে ফেলিয়া একটি লাথি মারিয়া–কেননা এনীচ কার্যে সম্ভবত বসুন্ধরা বাধাদান করিয়াছিলেন–ইহার পরক্ষণেই যশোবতীর সুন্দর রূপলেখা, নশ্বর দেহখানি দুই হস্তে তুলিয়া ধরিল।
যশোবতী প্রথমত আপনকার বিবস্ত্র অবস্থার নিমিত্ত, দ্বিতীয়ত যে তাঁহার দেহ পরপুরুষের বন্ধনে উপলব্ধি করিয়া এককালে লজ্জায়, ক্ষোভে, নিশ্চয় দুঃখে, নিশ্চিত ব্যথায়, কাতরতায়–নিৰ্বাপিত, বিন্দুমাত্র, চেতনাহীন হইয়া গিয়াছিলেন। সহসা স্বীয় দেহের মধ্যে অসম্ভব বিস্ফোরণের শব্দ শুনিতে। পাওয়া মাত্রই, পলকেই এ দুযোগময়ী অজ্ঞানতা নিশ্চিহ্ন হয়, এবং ক্রমে অধীরতায়, ক্রোধে, অপমানে, মুখ দিয়া দেখিতে, কান দিয়া বলিতে, নাসিকা দ্বারা শুনিতে চাহিলেন।
বৈজুনাথ মুখোনি তুলিয়া মুখোনি এমত ভাবে ঘুরাইল যেন সে আপনার দৃষ্টিপথকে পরিষ্কার করিয়া লইতেছে, যেহেতু তাহার ভ্রম হইয়াছিল মনে হয়, কেননা সে, যশোবতীর অনাবৃত দেহে, স্পষ্টতই শুভ্র। সুদীর্ঘ উপবীত দেখিয়াছিল, যেমন পান্না ভৈরবীর অঙ্গে সে ইতঃপূৰ্বে দেখিয়াছে–ফলে সে বড় দ্বিধায় পড়িল, একদা আপন মনে প্রশ্ন করিল, এই কি কনে বউর সাধনা…? এবং এ-প্রশ্নের কি যে উত্তর দিয়াছিল সে-ই জানে। তবে একথা সত্য যে তাহার মন পূৰ্ব্ব হইতেই পৃথক হয়, কেননা সে বলিয়া চলিয়াছে, “এখন তুমি শব, শব ছাড়া কিছু নও।” এ হেন নেতি-বিচারসম্মত উক্তিতে সে আপনাকেই সম্মোহিত করিবার অবশ্যই চেষ্টা করিতেছিল, যেরূপে কালিনী কন্যার সম্মুখে ভক্ত শূন্যতার মন্ত্র উচ্চারণ করে, আপনার দেহস্থিত অস্থিমালা ঘুরায়।
যশোবতী রাবণ কর্তৃক ধৃত সীতার মতই আর্তনাদ করিয়া উঠিলেন, এবং যুগপৎ এই নীচকুলোদ্ভবকে আঁচড়াইতে চেষ্টা এবং দংশন করিবার জন্য মরীয়া হইয়া উঠিলেন, প্রচণ্ড দুর্ধর্ষ বৈজুনাথ ক্রমাগতই তাঁহাকে নিবৃত্ত করিতেছিল এবং এ সময় তিনি কৰ্ত্তা কৰ্ত্তা’ বলিয়া এত উচ্চৈঃস্বরে ডাকিয়াছিলেন যে, নিশাচর পক্ষিকুল ইহাতে বিমোহিত হয়।
“কনে বউ, কনে বউ শব হয়ে থাক।…মিছাই রাত কাটাও হে…মিছাই…মা আমার কোম্পানী, তিনি বলেছে গো, তুমার মরণ নাই; মেয়েদের মরণ নাই…”
“কৰ্ত্তা কৰ্ত্তা…”
“অখণ্ড তোমার কৰ্ত্তা, তুমি মরবে কেনে গো…আমি আছি, বাঁচাব…এমন ঠাঁই ছেড়ে আসব তোমাকে, ফরসা হবে, তেনা (কাপড়) নাই আসতে লারবে, তুমি ইহকাল পাবে…” সে ইহার পর অনেক কিছু বলিতে চাহিল, কিন্তু পৃথিবী তাহার কাছে অতীব ডাগর, ডবকা, দশাসই, মনোরম; ছোট করিয়া কিছু বলিতেও পারিল না…।
“চাঁড়াল, চণ্ডাল…তোমার ভাল …”
“আমার আবার ভাল, কি বল্লিস গো কনে বউ…চুপ চুপ, আমার ঘরণী হাসবে বটে!”
“চণ্ডাল আমি যদি বামুনের মেয়ে…”
“আমার যেন সতীদাহ হয়, ভাবের ঘরে চুরি ভাল লয় গো…”
“চণ্ডাল আমি অভিশাপে…”
এই কথায় সে, বৈজুনাথ, উল্লসিত হইয়া চৌকিদারের মত ‘হোই’ দিয়া কহিল, “গল্প জান গো, অভিশাপ লাগবে না, দেহচিতায় মন যার পুড়ে” বলিয়াই হাসিল; একারণে যে এ বাক্য দ্ব্যর্থবোধক।
দুঃখিনী যশোবতী কহিলেন, “আমি জানি, শয়তান বজ্জাত।”
বৈজুনাথ থামিতে থামিতে, থামিল।
“নরকের কীট হয়ে জন্মাবি…খল।”
এবম্প্রকার উক্তি বৈজুনাথ এমনভাবে শুনিতে চেষ্টা করিল যেমন বা, মনে হয়, এ কথা অন্যত্র হইতে আসিতেছে।
“তোর (!) মতলব…আমি…” যশোবতীর কণ্ঠ লজ্জায় ক্ষোভে রুদ্ধ হইল।
বৈজুনাথ ইহাতে অধাৰ্মিক, নিন্দনীয় ইঙ্গিত বুঝিল। তাহার ডাগর চক্ষুৰ্ধয় রাগে বন্ধ হইল; যশোবতীর উক্তি যেন বা তাহার চোখে পড়িয়াছে, সে কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করিয়া মুখ দ্রুত সঞ্চালিত করত, আপনাকে সুস্থির করিবার প্রয়াস পাইল। আর যে, চকিতেই সে অস্ত্রাঘাতপ্রাপ্ত শাপদের ন্যায়, আকাশকে যুঁড়িয়া, ফুসিয়া গর্জিয়া, উঠিয়াছিল। সেই হেতু যশোবতীর ক্রন্দন, ক্ষণেকের জন্য থামিয়া যায়, এবং সে, বৈজুনাথ, আপনার দাঁতে দাঁতে ঘর্ষণ করত কহিল, “কি বল্লিস গো কনে বউ, তুমার মনে এই ছিল হে, শ্মশান আমার ঘরণী আমি তার শ্বশুর ঘর, ছি গো ছি, তুমি নারী কি পুরুষ তা আমি জানি না, ভেবেছিলুম তুমি পান্না ভৈরবীর মত সাদা!” বলিয়াই সে অত্যধিক ঘৃণ্য সামগ্রীর মতই যশোবতাঁকে যেমত বা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল।
যশোবতী নিশ্চয়ই আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, কিছুকাল এলো এঁটেল বেলাতটে অদ্ভুতভাবে পড়িয়া রহিলেন, কেবল ক্রন্দনের হেতু তাঁহার সোহাগের শরীর উঠে নামে। এখন অপমান এবং ক্ষুব্ধধৰ্ম্ম তাঁহার মনোযন্ত্রণার কারণ হইয়াছিল। অগণন সিক্ত কেশরাশি ঝটিতি মস্তক আন্দোলনে সরাইয়া একটি হাতের কনুইয়ের উপর সমস্ত উত্তমাঙ্গের ভার ন্যস্ত করিয়া, অন্যহাতের তর্জ্জনী দ্বারা তাঁহাকে ইঙ্গিত করত শোকাভিভূত স্বরে কহিলেন, “বদমাইস শয়তান, আমার স্বামী অথৰ্ব্ব…তাই তোর এত আস্পর্ধা”– এইটুকুতেই বুঝা গেল যে তাঁহার স্বরভঙ্গ হইয়াছে।
বৈজুনাথ অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়াছিল, সে শুধু কহিল, “ছি গো গো, ছি” এবং ইহার পর বারম্বার শুনিল ‘আমার স্বামী অথৰ্ব্ব’–ইত্যাকার কথা তাহাকে বড়ই ছোট করিয়াছিল, এবং সে যথাযথ উত্তর মুখে আসিলেও বলিতে পারে নাই; পরক্ষণেই সে দ্রুত পদবিক্ষেপে ভাওলিয়া নৌকার কাছে আসিয়া, খানিক দূরে শায়িত বৃদ্ধকে দেখিল। এখন সে একটি ডাল কুড়াইয়া যশোবতীর পট্টবস্ত্র যাহা কিঞ্চিৎমাত্র শুষ্ক হইয়াছে, তাহা কোন উপায়ে ডাল দ্বারা তুলিয়া, কিছুদূর পর্যন্ত আসিয়া তদনন্তর নৌকাভিমুখে ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া, বেলাতটে এখনও ক্রন্দনরত যশোবতীর দিকে পিছু হাঁটিতে লাগিল। বেশ নিকটে পৌঁছাইয়া কোনরূপে পট্টবস্ত্র প্রদান করত কহিল, “কাপড় কনে বউ যেন শ্মশান আমার ঘরণী, আমি কিছু নই, কেউ নই, নই’-এর আমি কিছু…”
বস্ত্রখণ্ড, যশোবতীর অনতিদূরে, বজ্রাহত পক্ষীর মত পড়িল; বিদ্যুৎবেগে কাপড়খানি ধরিতে গিয়াই তিনি প্রায় উন্মাদের ন্যায় হইয়াছিলেন, দেহ পুড়িতেছে, বস্ত্রদর্শনে লজ্জা বেশী করিয়া তাঁহাকে গ্রাস করিল। অপমান তাঁহাকে নিগৃহীত, নিপীড়িত করে; মনে হইল বস্ত্র তাঁহার এ-লজ্জাকে কোন ক্ষেত্রেই ঢাকিতে সমর্থ হইবে না, এবং নিঃস্ব মুষ্টি আস্ফালন করিয়া, ‘আমি’ বলিয়াই তিনি মুহ্যমান, বিমূঢ়; সৰ্বসময় তাঁহার মনে হইতেছিল যেমত বা কোন অমূল্য সম্পদ হারাইয়াছেন, ফলে ‘আমি যদি সতী’ একথা তাঁহার বাধিল, অশ্রুপ্লুত নয়নে স্পন্দিত ওষ্ঠে তিনি কহিলেন, “তুই কৃমি কীট হয়ে থাকবি…” এ-ভয়ঙ্কর অভিশাপ তাঁহার বক্ষ উদ্বেলিত, স্বরকে আপ্লুত করিয়া উচ্চারিত হয়।
“মনুষ্য জনমে গড় করি, আমি আর চাইনা কনে বউ…কৃমিকীট কুকুর হওয়া ভাল গো, তাদের জাগা-ঘরে চুরি নেই, যাতনাও দেয় না। হে মা আমার কোম্পানী, সামনে আছেন, তোমার শাপ যেন ফলে।” এইসকল মনোভাব ব্যক্ত করিবার কালে, বৈজুনাথের হস্ত অঞ্জলিবদ্ধ ছিল, যে অঞ্জলির মধ্যে দক্ষতা ছিল না, এ কারণে যে তাহা করফেঁড়ে পরিণত হয় নাই, তথাপি তাহা দ্বিধা দোমনা নয়। এখন সে আবার কহিল, “লাও তোমার হইয়ে আঙুল মটকালুম গো, তিন সত্য করে কলির পাপ সত্যযুগ ঘুরে এল। …বড় বেগোড় বুঝলে হে…”
“দেখতুম শয়তান, উনি যদি জোয়ান হতেন…”
বৈজুনাথ এই বাক্যে খুব মজা পাইল, জিহ্বা দংশন করত কহিল, “ইঃ…হায় হায় গো! কি পাপ! তখন আমি তোমার সামনে দাঁড়াবার ভরসা রাখতুম। কি বলিস গো কনে বউ, তখনও কুকুর বেড়ালের সঙ্গে গা চাটাচাটি করে মণ্ডা খেতুম হে, আমি জাত চাঁড়াল।…ঘাট মানছি…” বলিয়া দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিল; পৃথিবী শুদ্ধ হইল।
.
যশোবতী রোদনে যেন কূল পাইতেছিলেন না, ফলে বৈজুনাথ তাহার কণ্ঠ কিঞ্চিৎ উচ্চগ্রামে তুলিয়া বলিল, “শ্মশান আমার ইহকাল, আমার মনে পুণ্য নাই পাপও নাই, যদি থাকত!… তুমিই কাল হতে কনে বউ…লাও, আমি দাঁড়াব না তোমারও সময় হয়ে এল, কাল পূর্ণিমা…আমি যাব। লাস যদি আসে…তারাই দেখবে; তুমি পুড়বে আমি দেখতে…হ্যাঁ জেনো হে আমার মনে শুকের (শুকদেব) বাস” বলিয়া সে চলিয়া গেল। চন্দ্রালোক বর্ধিত হইল।
যশোবতীর আপনকার ব্যথা ইন্দ্রিয়সমূহকে এরূপ জর্জরিত করিয়াছিল যে বৈজুনাথের কোন কথাই তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করে নাই। তিনি নিজেকে একা পাইয়া, অবুঝের মতই কাঁদিয়া উঠিলেন, বারম্বার মিলন অভিলাষিণী নববধূ বলিলেন, “আমার কেউ নেই গো, আমার কেউ নেই।”
ভেড়ীর উপর হইতে বৈজুনাথ দেখিল।
দূরে, স্রোতক্ষুব্ধ বেলাতটে, একাকিনী যশোবতী, তিনি দণ্ডায়মানা, হস্তোপরি মুখমণ্ডল ঢাকিয়া ক্রন্দনরত, একপার্শ্বে কেশদাম হাওয়ায় সর্পিল, নিম্নে জলোচ্ছাস। এখন তিনি উর্দ্ধে মুখ তুলিয়া হস্তদ্বয় আশায় উত্তোলন করত ডাকিলেন, “ভগবান ভগবান” বলিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। একদা, কাহাদের যেন বা সম্মুখের আকাশে দেখিলেন, দেখিলেন… আরব্য রজনী সমূহ এখানেই স্বপ্ন কুড়ায় আর কাহারা তাহাদের অনুনয় করে, “আমাদের বিনিদ্র রজনীর বারমাস্যা নিয়ে যাও, নিয়ে যাও…” তিনি আরও দেখিলেন, গোলাপের কেশরাশ্রিত পরাগ, যাহা ভ্রমরের অঙ্গীভূত হয়, আঃ ভ্রমর! তুমি বুদ্বুদের বাহন, দুঃখের বাহক। সে পরাগ শূন্যতার মোহিনী মায়াতে বিমোহিত হইয়া অচিরাৎ ভ্রমর অঙ্গচ্যুত–খসিয়া পড়িয়া ইদানীং উঠানামা করে…এরূপ নানাবিধ দর্শনে তিনি ভীতা, আৰ্ত্ত। কাক যেমত সূৰ্য্য দর্শনে ব্রাসিত হয়–কেননা, সূৰ্য অন্ধকারকে নিশ্চিহ্ন করিয়াছেন, অন্ধকার কালো, যেহেতু, সে, কাকও কালো, তাই ভয়ার্ত–তেমনি সেইরূপ ত্রস্ত শঙ্কিত হইলেন। তাঁহার ক্রন্দন উত্তরোত্তর বর্ধিত হইল, সে ক্রন্দনধ্বনি পত্র-মৰ্ম্মরের সংঘাতে বর্ণ, এবং বর্ণসমূহ স্রোতের সংঘর্ষে এবং শূন্যতার গভীরতা দ্বারা শব্দব্যঞ্জনালাভে একটি পদবিন্যাস সৃষ্টি করিল…ভগবান তোমার চাতুৰ্য মেলা-বিলাসী বালককে মোহিত করুক; আমি জানি জল বাষ্প হয়, আমি মধ্যপথে নিশ্চিহ্ন হয় না, আমি জানি বাষ্পবিন্দুকে সূৰ্যতেজ ধ্বংস করিতে সক্ষম হয় না, আমি জানি যখন তাহা মেঘতনু লাভ করে তখনই বিগলিত– এ চাতুৰ্য্য, এ বিভূতির জন্য, আমার মন নাই, মোক্ষ নাই, কেননা আমিই বিভূতি, আমিই তোমার চাতুৰ্য্য, আমি তোমার সুদীর্ঘ স্বাধীনতা, এ জীবনকে ‘খেলা’ বলি; তুমি আমার স্বাধীনতা, আমি বন্ধুহীন, দীন, তুচ্ছ। ইদানীং তোমার ক্ষণিকত্ব বহনে আমি বড় ক্লান্ত।
.
তিনি ঊর্ধ্বলোকে নির্ভীকভাবে অবলোকন করিলেন, যেখানে বিন্দুর অণিমার ক্রমাগত উঠানামা–ইহার পর স্বামীর কাপড়খানি তুলিয়া স্থলিতপদে স্বামীর শয্যাপার্শ্বে আসিয়া কিঞ্চিৎ গঙ্গাজল আপনকার মস্তকে ছিটাইলেন। মানুষের কখনই কেহ নাই একথা সত্য, নিকটে কেহ নাই একথা ভয়ঙ্কর সত্য। নিভৃত গোপন নিঃসঙ্গ নির্জনতা লইয়া কতকাল কাটাইবে, বিরহ কবে অরুণোদয় দেখিবে–যে ভগবান আমার জন্য ক্ষুদ্র হইয়াছেন…
“বউ”…
“কিগো” বলিয়াই মনে পড়িল স্বামীর দুর্গতির কথা, তিনি ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। বারম্বার বলিতে লাগিলেন, “তুমি তুমি…”
“তুমি…কোথা…”
“এই কাপড় কাচতে…”
“এ্যাঁ”…
যশোবতী কানের তূলা খুলিয়া বলিলেন, “তোমার কাপড় কাঁচতে…”
“কেন?” যশোবতী আশ্চর্য্য হইলেন, বৃদ্ধের মুখপানে চাহিয়া দেখিলেন, কহিলেন, “তোমার কাপড় নোংরা হয়েছিল যে”…
“কষ্ট কষ্ট”
“না না…” তাঁহাকে আশ্বস্ত করিতে চাহিলেন। হঠাৎ কিসের শব্দ হইল। তিনি দেহকে খানিক উঁচু করিয়া লইয়া চারিদিকে দেখিলেন, অনন্তর শুনিলেন ছাগলের স্বর। দেখিলেন, বৈজুনাথের নৌকার ছইএর মত আড়াখানি, যাহা উল্টাইয়া পড়িয়া আছে, এবং অন্যদিকে ভেড়ীপথের উপর দাঁড়াইয়া কে একজনা ছাগলটিকে টানিতেছে। সে নিশ্চয়ই সে, এবং সেইক্ষণে একথা বুঝিলেন যে বৈজুনাথ সত্যই চলিয়া গেল।
যশোবতী স্বামীর পাশ ঘেঁষিয়া বসিলেন। কিছু পূৰ্ব্বে সংগ্রাম এবং ইদানীং ক্লান্তি অবর্ণনীয় নির্লিপ্ততার মধ্যে তাঁহাকে আনিতেছিল; বৈজুনাথের বিদায় গ্রহণ তাঁহাকে জাগ্রত করে, ক্রমে শৈত্য অনুভব এবং কিছুপরে শিবা ধ্বনি এবং তদুত্তরে পেচকের পীড়াদায়ক খর স্বর তাঁহাকে একীভূত করিল। ক্রমে দিত্মণ্ডলের বিনিষ্কন্দ্র মৌনতা ত্রিতাপহারিণী বহমান গঙ্গাকে ভয়াল করিয়া তুলে। ইহাতে যশোবতী সত্যই আতঙ্কিত, অনন্য উপায়ে নির্জীব প্রাচীন স্বামীর দিকে ভরসা করিয়া তাকাইলেন, বক্ষে হস্ত স্থাপন করত ইষ্ট দেবতা গোপীবল্লভকে স্মরণ করিতে বসিলেন। বারম্বার চক্ষু খুলিয়া গেল, অর্ধসিক্ত বসনের হিম তাঁহাকে শিহরিত করিল, ওষ্ঠ দংশন করিয়া কি যেন ভাবিলেন, রাত্র গণনা। করিলেন; জাঁতিটি লৌহ, ফলে স্বামীর শিয়রের তলে পুঁজিয়া নিজের হস্তমধ্যে অস্ত্রস্বরূপ কাজললতাটি লইলেন। চণ্ডাল নাই একথা ভাবিতেই–একাকী এই শ্মশানে, দংশনোম্মুখ বৃশ্চিকের মতই যাহার বর্তমানতা–স্বামীকে লইয়া সমস্যা বিড়ম্বনায় সঙ্গীন অবস্থায় পড়িলেন; আর একবার চণ্ডালের আড়ার দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন।
“বউ…”
স্বামীর ডাকে তাঁহার দেহ যেমত বা মোচড় দিয়া উঠিল, এ ডাকটিকে হস্তদ্বারা ধরিতে চাহিলেন; কেননা, মনে হয়, এহেন দুর্বিপাকে তাহা ব্রহ্মাস্ত্রের মতই কাজ দিবে, এবং এ ডাক শ্রবণমাত্রই তিনি উত্তর করেন, “এই যে গো, কেনে?” কিন্তু সীতারাম কোনই সাড়া দিলেন না, নিশ্চয়ই তিনি ঘুমের মধ্য হইতে আপন পত্নীকে সম্বোধন করিয়াছিলেন। বৃদ্ধ ঘুমে অচৈতন্য, কারণ পরিশ্রান্ত, তাঁহার নিঃশ্বাসে বক্ষের ঘড় ঘড় ধ্বনি এই চক্ষুহীন নির্মম স্থানটিকে পুনঃপুনঃ রক্তাক্ত, পাংশু, ফ্যাকাশে, শব, অস্বাভাবিক, রুক্ষ, প্রেতাত্মক করিতেছিল।
যশোবতী, এ শ্মশান–যাহার পৈশাচিক রূপটি, প্রত্যেক জিহ্বাকে নাবালক, প্রত্যেক দৃষ্টিপথে জ্যোতির্মণ্ডলের বীজ ছড়াইয়া দেয় এবং এখানকার কিঞ্চিত্র শব্দে অন্য স্তব্ধতা থরহরি–এই সেই রমণী একদা যাঁহার মারাত্মক প্রলয়ঙ্করী শব্দে ত্রিভুবন মথিত হয়–তিনি আৰ্ত্ত, তিনি আর সহ্য করিতে অক্ষম। পলাতক জন্তুর পদধ্বনি শ্রবণে কতবার চমকাইলেন, তিনি যেন প্রাণপণ মাটি আঁকড়াইয়া থাকিতে প্রস্তুত, আর সম্ভব হইল না, হিতাহিত বিবেচনা অদৃশ্য হইল, তিনি আপন স্বামীকে ছাড়িয়া দৌড়াইয়া ভেড়ীপথে উঠিলেন।
মাঠে আবছায়া কুয়াশা, যে কোন বস্তুতেই নীচকুলোদ্ভব চণ্ডাল বিদ্যমান হইল, যশোবতী ছোট করিয়া হাঁক ছাড়িলেন, স্বর বক্র হইল। কণ্ঠ পরিষ্কার করিয়া চৌকিদারী কণ্ঠে হাঁকিলেন।
এ এক অদ্ভুত স্থান হইতে তিনি আর এককে ডাকিতেছেন, যে মানুষ তাঁহার আসন্ন ভীতি হইতে রক্ষা করিবে। এ স্থান লতা গুল্ম তৃণ বৃক্ষে আচ্ছন্ন, আর তিনি একটি বেশী প্রকাশ। এ ভাবনায় তাঁহার দেহ দুলিয়া উঠিল, তথাপি আত্মসম্বরণ করিলেন।
অনেকবার এইরূপ করা হইল, কিন্তু প্রতিটি হাঁকই করুণ প্রতিধ্বনি হইয়া ফিরিয়া আসিল। মহা আক্ষেপে যশোবতী বৃক্ষ আঁচড়াইলেন, এবং প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ করিবার কালে তাঁহার মনে হইল শেষবারের মত ডাকিয়া চলিয়া যাইবেন। সুতরাং এইবার হাঁক দিলেন।
তদুত্তরে নিকটস্থ বৃক্ষের পার্শ্ব হইতে ছাগধ্বনি আসিল। দুঃখিনী যশোবতী মহাউদ্বেগে যত্রতত্র দৃষ্টি সঞ্চালন করিলেন। আর, আবার, ছাগলের খেদধ্বনি শোনা গেল। যশোবতী বালিকাই বটে…তাঁহার মধ্যে ছাগটিকে আলিঙ্গনের বাসনা দেখা দেয়। আর যে, পরক্ষণেই মনে হইল, ছাগ আছে বলিয়াই যে চণ্ডাল আছে এমন নহে; এ বড় ন্যায়ের কথা। পলকেই সবিস্ময়ে শুনিলেন ছলাৎ করিয়া একটি শব্দ; ব্যগ্র নয়নে দেখিলেন, একটি বাঁকলগ্ন কলস হইতে জলীয় কিছু পড়িল; যদিচ আধো আলো আধো অন্ধকার, ইহার পর প্রকৃতির রজগুণরাশির তথা পাতা লতাগুল্মের ছায়া যাহার সৰ্ব্বশরীরে-সশরীরে বাঁক কাঁধে বৈজুনাথকে দেখা গেল।
যশোবতী প্রথমে সচকিত, কেননা ভয়, দ্বিতীয়ত লজ্জিতা যেহেতু আত্মাভিমান, বৃক্ষের পিছনে মুখ লুকাইলেন।
“কনে বউ”–বৈজুনাথ কোনক্রমে উচ্চারণ করিল।
অন্ধকার তাঁহার মুখমণ্ডলকে বৈচিত্র্য দান করত চলিয়া গেল, কেননা মলয় পবন ক্ষণিকের জন্য পত্র-রাশিকে শতচ্ছিন্ন করে, এ হেন সময়ে সহসা আলো আসিল; যশোবতী আপনার মধ্যে পদ্মগন্ধ। উপলব্ধি করিলেন, অল্পক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বৃক্ষ গাত্রে নখরাঘাত করিতে করিতে বলিলেন, “আড়া ভেঙে দিলে যে…” ইহা ব্যতীত তিনি কি আর প্রশ্ন করিতে পারেন!
“আড়া ছাড়া কি আর ভাঙব হে, উঁচু যারা তারা উনুন ভেঙে চলে যায়, আমার উনুন চিতা…তাই আড়া…তুমি আমায় ডাকতে কেনে এসেছ হে তা জানি বটে, বলব…”
যশোবতী তাহার দিকে চাহিলেন, দেখিলেন পত্রগুল্মের ছায়াচিত্রিত একটি মানুষ।
“শ্মশানে একা বড় ডর, না হে? শব না হলে শ্মশানে থাকে কে গো, শিব নিজে এখানে শব হয়ে থাকে, আমরা কোন ছার–এ বড় কঠিন ঠাঁই, দিন রাতে দেখা নাই। ভয় কেনে গো, তিনকুড়ি তন্ত্র আরজন্মে করেছ, এখনও মায়া…তাহলে? আমি কলসীর ভার কমাবার জন্য একটু সেবা করেছিলুম হে তাই…দেখা, কনে বউ। চণ্ডাল হয়ে জন্মেছি বলে আমি দোষ দিইনি রাগ করিনি, আমি ধম্ম খোয়াইনি, লাথি ঝাঁটা খেয়ে আছি…কিন্তু তুমি…” বলিতে বলিতে তাহার কণ্ঠে যেন বা পোকা ঢুকিল। সে কিছুকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বাঁক নামাইয়া সত্বর মদ্যপান করত দাঁড়াইয়া উঠিয়া কহিল, “এক গল্প বলি হে, তোমার রঙ যেমন দুধে আলতায়, আমার রক্তে তেমন দুধে আলতায়…কেনে? যে কোম্পানী। উপরে, সে আমাদের রক্তে দুধ দিইছে, যেমন তোমাদের বুকে দুধ দেয় গো, আমাদের রক্তে দুধ দেয় হে। চিতার আগুন আমার কিছুই চ্যামটে খয়রা করেনি হে, বড় কষ্ট হয় তাই…যা কিছু জেনো বটে হে শ্মশানেই আমার আঠা…তোমার শাপ মনে লয়, আমার মনে ড্যাঙ্গাডহর আছে, বীজ বৈখরী…চায়…পাপ আছে…”
“চণ্ডাল, আমি…”
“আমি! আমি! তুমি কার আমি। তুমি ত এক প্রহরের শ্বাস টানা শব; কাল এতক্ষণ চাঁদ যখন লাল, তখন লয়…তাই আমি বলেছিলুম বটে হে…রক্ত আমার দুধে আলতায় গো।”
“এখন না মরে আমার উপায় কি বলতে পার…আমায় ফেন দেবার লোক কই…”
“তোমার কেউ নেই…তোমাদের জাতে কুটুম…”
“আমাদের, কেউ থাকে না…”
“বড় ডাগর জটাধারী কথা গো, গঙ্গার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পার…”
“তুমি ভুল বুঝলে হে, আমার স্বামী ত আছেন, যাক ও কথা, তুমি আজ রাত্রে যেও না” বলিয়া চলিয়া গেলেন, কেননা এ সময় পুনরায় আপনার দেহে তীব্র পদ্মগন্ধ আলোড়িত হয়।
.
ক্রমাগত পাখী ডাকিতেছে, হাওয়া ছিন্নভিন্ন; সীতারাম যেন প্রাণ লাভ করিয়া সটানা কণ্ঠে ভোরাই গাহিতেছিলেন, “রাই জাগো রাই জাগো।” যশোবতী, শ্রান্ত, ঝড় বিলুণ্ঠিত বৃক্ষ বা, ঘুমে অচৈতন্য। ক্রমাগত গীত আসিতেছিল, ক্রমে তিনি নয়নযুগল উন্মীলন করিলেন; যে পৃথিবী প্রাণময়, যে পৃথিবী প্রতিবিম্বময়, তাহা রঙীন হইল; স্বামীর গান তাঁহাকে মোহিত করিয়াছিল। ভাবের ভাবি করিতেছিল। ভালো লাগিতেছিল।
“বউ ভোর গো”…
যশোবতী কোনমতে স্বামীর কানের তুলা খুলিয়া, “এখানে শ্বশুর শাশুড়ী ত কেউ নেই, ঘুমোই না” শিশুর মত কহিলেন।
“ঘুমাও ঘুমাও”…
“না গো, আমি” বলিয়া উঠিয়া বসিলেন, আলস্য বিদূরিত করিবার পর স্বামীর প্রতি চাহিলেন।
“বল তুমি আছ বলে বড় বাঁচবার সাধ হচ্ছে…”
“কি করে এত স্পষ্ট বলছ গো, ওমা…”
বৃদ্ধ হাসিলেন। “তোমার জন্য বাঁচবার…”
“ঠাকুর ঠাকুর…তোমাকে বাঁচতেই হবে।”
“তোমার উপর বড় মায়া পড়ে গেছে, মায়া হয়…বুক চিরে দেখাব…”
যশোবতী অবাক হইলেন, নিঃশব্দে কহিলেন, “ঠাকুর ঠাকুর…”
.
“আমার বড় খিদে পাচ্ছে…” বৃদ্ধ কিছু পরে কহিলেন।
“চিঁড়ে খাবে? পারবে?”
“হ্যাঁ!…আচ্ছা আমায় তোমার মনে ধরেছে…”
“ছিঃ ছিঃ…কি যে…”
“আমার বড় আয়না দেখতে সাধ হয়।”
“ফর্সা হোক…”
অনেকক্ষণ পর ইতস্ততঃ করিয়া সহসা কি যেন বা তাঁহার, বৃদ্ধের, স্মরণ হয়; ফলে তিনি অবিচারিত চিত্তে বলিলেন, “আচ্ছা বউ, আমাদের ফুলশয্যা…” এবম্প্রকারের কথা বলিবার পরক্ষণেই তাঁহার সম্ভবত লজ্জা হইল।
যশোবতী নীরব থাকিয়া কহিলেন, “কেন হবে না…”
সম্ভবতঃ পূৰ্বের উক্তি চাপা দিবার জন্য বৃদ্ধ কহিলেন, “বউ…আমি যদি মরি তোমার মন কেমন করবে?”
অকপটে যশোবতী কহিলেন, “খুব”–এ বাক্যে আন্তরিকতা ছিল, গঙ্গার বাস্তবতা ছিল।
“হুঁ…মিছাই”
“মিথ্যা আমার মরণেও নেই, কৰ্ত্তা।”
“সত্যি “…
“সত্যি “…
যখন রীতিমত আলো হইল তখন সীতারাম সলজ্জভাবে স্ত্রীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, “বউ আমি উঠব, বসব।”
“কষ্ট হবে না…”
“না, বসে একটু ডাকব…”
সীতারামের ঠিক পিছনে, যাহাতে তিনি হেলান দিতে সমর্থ হন, তাহার উপযোগী করিয়া একটি কলস উল্টাইয়া বসাইয়া দিয়া বৃদ্ধকে কোন ক্রমে উঠিয়া বসিতে সাহায্য করিলেন। এ সময়, সীতারাম বক্ষে কর স্থাপন করত আকল্পনবীনা এই পৃথিবী দর্শন করিয়া ইষ্টমন্ত্র জপ করিয়া, “রাধা শ্যাম” স্মরণ করিলেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই চক্ষু খুলিয়া গেল, চতুর্দিকে চাহিয়া ভারী খুসী হইলেন, “বউ বড় ভালো লাগছে গো–”
ইহাতে যশোবতীর বড় আনন্দ হয়, এবং বৃদ্ধের ক্রমাগত গাল-চোষার মুদ্রাদোষ আর তাঁহার চোখে পড়িল না।
“বহুদিন পরে যেন দেখছি…” বলিয়া তিনি একটি গভীর নিঃশ্বাস লইয়া পরে ত্যাগ করিবার কালে অল্প কিঞ্চিৎ কাশিলেন এবং তৎসহ একটি “আঃ” শব্দে স্বস্তির ধ্বনি শোনা গিয়াছিল। গঙ্গাকে প্রণাম করিতে করিতে কহিলেন, “মা মা মাগো”–পুনৰ্ব্বার খুসী মনে, টপ্লাগায়কের মত, চারিদিকে চাহিলেন। বলিলেন, “মনে হয় সব যেন আমার…”
অনন্তর মাটিতে হাত চাপড়াইতে চাপড়াইতে কহিলেন, “আঃ কি সুন্দর…” সহসা হাতটি লইয়া লেহন করিলেন।
যশোবতী সত্বর তাঁহার হস্তটি ধরিয়া ব্যাকুলভাবে আপনকার অঞ্চল প্রান্ত দ্বারা পরিষ্কার করিতে করিতে বলিলেন, “ছিঃ গো ছেলেমানুষী করছ গো, শ্মশানের মাটি…কেউ মুখে দেয়…বৈরাগ্য হবে যে গো, আমার থেকে মন উঠে যাবে, এ দেহ দেখে নেতিবিচার করবে” বলিয়া স্বেচ্ছায় আপন লজ্জা ত্যাগ করত চটুল হাসি হাসিয়া বৃদ্ধের-দেখা পৃথিবীটিকে নিরীক্ষণ করিলেন।
“তা বটে তা বটে…আচ্ছা বউ আমার বুক দশ মরদের মত না, আ… আয়না…”
“আয়না কোথায় পাব…আমি তো জলে…”
“আমাকে দাও…”
যশোবতী একটি মালসায় জল লইয়া আসিলেন। অধৈৰ্য্য বৃদ্ধ জলপূর্ণ মালসাটি লইবার জন্য মন্ত্রবলে অত্যুগ্র আগ্রহ হস্ত প্রসারিত করিলেন, যশোবতী তাঁহার হস্তে দিলেও মালসা ছাড়েন নাই, তিনি নতজানু হইয়া স্বামীর সম্মুখেই বসিয়া ছিলেন। বৃদ্ধ যশোবতাঁকে অজস্রবার মৃদু ভর্ৎসনা করিলেন, “আঃ ঠিক করে ধর না–কি কচ্ছ পাগল–কখনও স্থিরভাবে নিজের, একদৃষ্টে প্রতিবিম্বের দিকে, জীবনের দিকে চাহিয়া রহিলেন–তাঁহার শীর্ণ স্কন্ধ স্পন্দিত হইল–ধীরে মুখোনি তুলিয়া পত্নীর দিকে তাকাইয়া কহিলেন, “আমায় সুন্দর–”
যশোবতী আপনকার সুন্দর মুখোনি আন্দোলিত করিলেন, বৃদ্ধের, স্বামীর, উক্তি সমর্থিত হইল।
বৃদ্ধ সীতারাম স্বীয় প্রতিবিম্বের পশ্চাতে অম্বর, কখনও মেঘমালা এবং উড়ন্ত পক্ষী দেখিলেন– দুস্তর গাম্ভীৰ্য আসিল, এবং প্রশ্ন করিলেন। বৃদ্ধ আপনার চক্ষু দেখিলেন, মমত্ববোধ আসিল এবং সেই প্রশ্ন করিলেন, বৃদ্ধ আপনার দন্ত দেখিতে মাড়ি দেখিলেন, ঝটিতি জিহ্বা দেখিলেন ভয় আসিল, সত্বর প্রশ্ন করিতে গিয়া দেখিলেন, ভয়ঙ্কর কাশির ধমকের মধ্যে মালসা দু’জনের হস্তচ্যুত হইয়া ভাঙ্গিয়া খান খান হওয়ার মধ্যে, এ বিপর্যয়ের মধ্যেও একটি প্রশ্ন শোনা গেল। যশোবতী বারম্বারই বলিয়াছিলেন, “তুমি সুন্দর তুমি সুন্দর তুমি সুন্দর।”
যশোবতী তাঁহার স্বামীকে ধরিয়া যত্নে কলসে ঠেস দিয়া ধরিয়া রহিলেন। অসুস্থতা প্রশমিত হইল। গঙ্গোদক দিয়া স্বামীর চোখ মুছাইয়া দিলেন।
“আমায় সত্যিই সুন্দর দেখতে, না…”
“হ্যাঁ…”
“তুমি…ঠাট্টা? আমায় রাজপুতুল বলত…”
যশোবতী করুণ স্বরে উত্তর দিলেন, “কেন এ কথা বলছ গো”
বৃদ্ধ রূঢ়ভাবে তাঁহার দিকে কটাক্ষপাত করিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলেন। যশোবতী বুঝিলেন স্বামী মনঃক্ষুণ্ণ হইয়াছেন; কি ভাবে যে বুঝাইবেন তাহা ভাবিয়া পাইলেন না, অবশেষে তাঁহার বক্ষ স্পর্শ করিয়া কহিলেন, “মিথ্যা বললে পাপ হয়, আমার মরণে মিথ্যা নাই গো…সত্যিই তুমি সুন্দর”
বৃদ্ধ আনন্দে বিহ্বল হইয়া কি যে বলিবেন স্থির করিতে পারিলেন না, “জরা যেন কে নিয়েছিল?”
“তোমার তো জরা নেই, যদি থাকে জরা সে তো আমি, আবার জন্মাবে আবার আসব…” বৃদ্ধ পত্নীর আশা শুনিয়া কহিলেন, “আমাকে তোমার মনে ধরেছে…” “মনই তো সব।”
৭. জলের আয়নার প্রতিবিম্ব
এখনও জলের আয়নার প্রতিবিম্ব বৃদ্ধের অঙ্গে খেলিয়া উঠিতেছিল। যশোবতী খোলামকুচি দিয়া অন্য মনে নির্লিপ্ত ভাবে এতল-বেতল খেলিতেছিলেন। বৃদ্ধকে এই ক্রীড়া উৎসুক করিয়াছিল, তিনি নিবিষ্ট মনে তাহা লক্ষ্য করিতেছিলেন, তদবস্থায় কহিলেন, “মানুষ এমন ঘুরে ঘুরে আসে…” একটি শ্বাসের শব্দ শোনা গেল, শূন্যতা সৌখীন হইল। যশোবতী নিমেষের জন্য খেলা স্থগিত রাখিয়াছিলেন, পর মুহূর্তেই আরম্ভ করিলেন।
বৃদ্ধ খেলা দেখিতে দেখিতে প্রস্তাব করিলেন, “এস এস আমরা বাঘবন্দী খেলি…”। খেলিবার কালে কতবার যশোবতাঁকে, “জুয়াচোর, এ খুঁটি কি করে এল” ইত্যাকার দোষারোপ করিয়াছিলেন। এমত সময় ঘোর হরিধ্বনি শোনা গেল। বৃদ্ধ কর্ণে হস্তপ্রদান করিলেন।
“তুলা দি…”
“না…”
“ধর আমি যদি যাই, তুমি…” বলিয়া বৃদ্ধ একটি চাল দিলেন।
যশোবতী একদৃষ্টে স্থির থাকিয়া স্মিতহাস্য করত মস্তক আন্দোলিত করিয়া আপনার দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করিলেন, “জাল ছিঁড়ে যাবে, পুকুর ছেড়ে ত যাবে না।”
“না, ওটা দিও না তোমার খুঁটি মার খাবে…ভয়…করবে না।”
“তুমি আছ আমার ভয় কি…আমি যে তোমার মধ্যেই সরলভাবে যশোবতী একান্ত নির্ভরতা প্রকাশ করিলেন।
তথাপি বৃদ্ধের মন মানিল না, খুঁটি ধরিয়া কহিলেন, “টক্কা না ফক্কা…”
“টক্কা…”
দেখা গেল বৃদ্ধের হাতে খুঁটি রহিয়াছে; বৃদ্ধ আনন্দে আটখানা, “তাহলে বাঁচবো গো…আবার মড়া পোড়ার গন্ধ আসছে, বাঁচবো? তুমি ধর।”
যশোবতীর ক্ষেত্রে দেখা গেল সেখানেও একই ফল। উল্লাসে বৃদ্ধ বলিলেন, “আর ভাবনা নেই…আমি কিন্তু পাল্কীতে যাবো…তুমি আমার কাছে…বড্ড খিদে পাচ্ছে গো।”
“চিঁড়ে ছাড়া…”
“দ্যুৎ–দুধ”
“কোথায় পাব গো…”
“আমার বাড়ীতে কত গোরু…তুমি উঠে দেখ না, মাঠে কত…চণ্ডালকে ডাক না…”
“আমি ডাকবো কি করে?” বলিয়াই যশোবতী আপন অন্তরে শিহরিত হইলেন।
“তাতে কি…”
ক্রমে বৃদ্ধ অবোধ হইয়া উঠিলেন। “একটু দুধ তা-ও” হুঁ হুঁ করিয়া কান্নার শব্দ আসিল। যশোবতীর তাঁহাকে বুঝানোর চেষ্টা বিফল। তবু বৃদ্ধ পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করিতে লাগিলেন, “দুধ না হলে জোর পাব কি করে? তুমি যোগাড় কর…”
যদিও স্বামীর জন্য নববধূ কাতর হইয়াছিলেন, তথাপি কহিলেন, “আমি বউ মানুষ…তারা এখুনি আসবে, তখন নয়…লক্ষ্মীটি অমন ক’র না…”
“আমি আমি…”
যশোবতী অগত্যা উঠিলেন, ভেড়ীপথের উপর হইতে দেখিলেন অনতিদূরে বুনোদের বাড়ী, কিছু উত্তরে। তিনি ভেড়ীপথ ধরিয়া গিয়া দাঁড়াইলেন, এখান হইতে বুনোদের গৃহপ্রাঙ্গণ দেখা যায়। যশোবতী ভেড়ীপথেই–তাহাদের গৃহসম্মুখে দাঁড়াইয়া, একটি স্ত্রীলোককে তিনি ইঙ্গিত করিয়া ডাকিলেন, তাঁহার ক্ষুদ্র কলসটি দেখাইয়া কহিলেন, “একটু দুধ দেবে…” বলিয়া তাহার দিকে একটি সিক্কা পয়সা ফেলিয়া দিলেন। স্ত্রীলোক সিক্কা পয়সা কুড়াইয়া লইয়া দুধ আনিয়া দিল, দুধ তিনি কাঁখে লইতে শুনিলেন, “কি কনে বউ?”
যশোবতী কিঞ্চিৎ বিচলিত হইলেন। যাহা কিছু ঘটিয়াছে তাহা এতক্ষণ মনেই ছিল না, এবং তাহার কোন কিছুই তাঁহার স্মরণ ছিল না। চণ্ডালকে আপাদমস্তক দেখিয়া চিনিতে পারিলেন, গুণ্ঠন টানিয়া চলিতে শুরু করিলেন।
“দুধ আনতে এসেছিলে…হে হে আমি ছিলাম ঠায়, আমাকে বললে না কেনে, পাঠিয়ে দিতাম গো…তুমি বউ মানুষ,– চণ্ডাল কহিল।
“এলাম…”
“এখন বুড়ার গায়ে গত্তি লাগবে বটে…এ হে হে এখানে লামছ কেনে গো…”
তাহার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই যশোবতী ভেড়ীপথ ভাঙ্গিয়া নামিয়া পড়িলেন। অল্প দুধ ছলকাইল, চণ্ডাল পিছু ছাড়িল না।
এক্ষেত্রে যশোবতী তাহাকে কিছু বলিতে চাহিলেও লজ্জায় বলিতে পারিতেছিলেন না। কখনও তাঁহার গতিকে দ্রুত করিয়াছিলেন, কিন্তু তথাপি চণ্ডাল তাঁহার পিছু পিছু আসিতেছিল।
“কয়েক প্রহর বাদে গো, এসব মাটি নিয়ে খেয়োখেয়ি হবে গো”–বৈজুনাথ নিজের দিকে চাহিয়া বলিল।
যশোবতী চলিতে লাগিলেন।
“হে গো আমার কথার উত্তর দাও না কেনে…”
“এখন যাও…”
“আহা” বলিয়া বৈজুনাথ কিঞ্চিৎ সহজ হইবার চেষ্টা করিল।
“চণ্ডাল…”
“তোমার কথায় কনে বউ আমার জন্মান্তর হল, আমি এখন…”
“এখন যাও…”
চণ্ডাল বৈজুনাথ স্থির হইল; তাহার পর, তিনি অগ্রসর হইলেন। এ সময় সত্বর চণ্ডাল তাঁহাকে অনুসরণ করিতে গিয়া পিছলাইয়া পড়িতে যশোবতী এ শব্দে সচকিত হইয়া ঘুরিয়া হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না।
বৃদ্ধের কর্ণে একটি হাস্যের শব্দ আসিল। তিনি কোথা হইতে হাস্যধ্বনি আসিতেছে তাহা অনুধাবন করিবার চেষ্টা করিয়া, বক্রদৃষ্টিতে দেখিলেন; দেখিলেন, যশোবতী এবং চণ্ডাল। সীতারাম অসম্ভব চঞ্চল হইয়া উঠিলেন, শিরা-উপশিরা স্ফীত হইল, অভ্যন্তরে কে যেন ধূম্রজালের সৃষ্টি করিল, আপনকার মাড়ি ঘর্ষণ করিলেন, ইহার শব্দ শয্যার খড়ে প্রতিধ্বনিত হইয়াছিল। যুগপৎ বিস্ময়ে ঈর্ষায় বার্ধক্য যেন যৌবদশা প্রাপ্ত হইল। তিনি ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিলেন। ভাবিলেন, আমার আকাশই ভাল; কিন্তু সহস্র ধিক্কার তাঁহাকে মাটিতেই ধরিয়া রাখিল। চক্ষুর্ঘয় কোনক্রমেই বন্ধ রাখিতে পারিলেন না। আক্ষেপে ক্ষোভে অভিমানে তিনি পুড়িতে লাগিলেন। একবার মাত্র কহিলেন–”তুমি না বামুনের বউ, ছিঃ” বলিয়া, ক্ষোভে দুঃখে অন্যদিকে মুখ করিয়া রহিলেন, তাঁহার শরীর তরঙ্গায়িত, সম্মুখে শ্মশান।
যশোবতী স্বভাবসুলভ স্থিরভাবে, দুধের কলস রাখিয়া নিকটে ভেড়ীর খাঁজনে, ঝিক্ করিয়া পালা দিয়া, তুষের মালসা হইতে অগ্নিসংযোগ করত দুধ গরম করার পর বৃদ্ধের নিকট আসিয়া বলিলেন, “দুধ পাওয়া গেল” বলিয়া স্বামীর প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া দেখলেন, তিনি যেমত বা মৃগী রোগাক্রান্ত। তিনি তাঁহার গায় ব্যাকুল চিত্তে হস্তপ্রদান করিবামাত্র বৃদ্ধ মহারোষে তাঁহাকে নিবৃত্ত করিতে চেষ্টা করিলেন। যশোবতীর তাহাতে কোনরূপ মান হইল না। স্বামীর জন্য চিন্তাকুল হইয়া পুনরপি সস্নেহে তাঁহার সেবা করিবার জন্য তৎপর হইবামাত্র বৃদ্ধ যেন রাগতস্বরে এক কালেই অজস্র কথা বলিয়া গেলেন–কহিলেন, “কোথা মরতে গিয়েছিলে?”
“দেরী হয়ে গেল বড়, না গো…”
পত্নীর সরল কণ্ঠস্বর তাঁহাকে, বৃদ্ধকে, অতিমাত্রায় কুপিত করিল। “খাব না ও দুধ…”
“সে কি…”
“না” বলিয়া আরবার মুখ ফিরাইলেন।
“আর দেরী হবে না…লক্ষ্মীটি…তুমি যদি রাগ কর তাহলে আমি যাই কোথা…রাগ ক’র না…।” বৃদ্ধ স্বামীর রাগের কারণ বুঝিয়া, অভাগিনী তাঁহাকে তুষ্ট করিবার মানসে যত্নবান হইলেন। অঙ্গুলিপ্রদান করত বুঝিলেন, দুধ প্রায় ঠাণ্ডা হইয়া যায়।
“দুটি পায়ে পড়ি…দেরী…”
“ফেলে দাও দুধ…”
যশোবতী তাঁহার পদদ্বয় ধরিয়া অনেক কাকুতি মিনতি করিতে লাগিলেন। বৃদ্ধ কহিলেন, “মরণকালে আমার এই ছিল! ছুঁয়ো না আমাকে…হারামজাদী নষ্ট খল খচ্চর মাগী…”
হরিণনয়না যশোবতী, পবিত্র যশোবতী স্বামীর পদদ্বয় হইতে মস্তক তুলিয়া বিস্ময়াবিষ্টের মত তাকাইলেন। তাঁহার চক্ষুদ্বয় যেন কাঁচে রূপান্তরিত হইল। যেন দ্রুতগতি অসংখ্য পতঙ্গ তাঁহার কানে গুঞ্জন করিতে লাগিল। সত্ত্বরজস্তম গুণাবলী হইতে কে যেন তাঁহাকে অব্যাহতি দিল।
বিকৃত মুখব্যাদান করত কহিলেন, “রাক্ষুসী ন্যাঙনী মাগী-লেথিয়ে তোর মুখ ভাঙ্গি…”অনেকবার তাঁহার কুৎসিত মাড়ি বাহির হইল, যাহা বন্যবরাহের মুখগহ্বরসদৃশ রেশমী, অনেকবার তাঁহার গাল-চোষার বিকৃত আওয়াজ শোনা গেল।
ভগবান! তুমিও বোধ করি অদ্যাবধি এত গঞ্জনা শোনো নাই। এ হেন অশ্রাব্য ঘৃণাসঞ্জাত কুকথায় বাত্যাক্ষুব্ধ লতিকার মতই যশোবতী থরহরি। অধর দুটি আপনাদের আকর্ষণ অমান্য করত মুক্ত হইতে চাহিতেছে, কে যেন বা তাঁহার কর্ণে, ‘তোমরা আমাকে কি পেয়েছে, তোমরা কি!’ বাক্যাবলী বলে।
সম্মুখে উৎক্ষিপ্ত বৃদ্ধ সরলরেখা। ক্রোধে হস্ত মস্তকের নিকটে–এবং কেশ বর্তমান এরূপ জ্ঞানে আকর্ষণ করিয়া ফিরিতেছিল। মধ্যে মধ্যে ‘ওহো হো হো’ শব্দ।
.
নদীসৈকত, শ্মশান, অশরীরী মায়া এই নির্মমতা পর্য্যবেক্ষণ করিতেছিল!
যশোবতী স্বামীর দুর্বল একটি পা, বক্ষে স্থাপন করত কি যেন বলিতে চাহিয়াছিলেন, ইহাও সত্য তাঁহার মধ্যে কে যেন একটি শ্লোক জপ করিতেছিল—’ন পতিঃ সুখমেধত যা স্যাপি শতাত্মজা।’ পরক্ষণেই বিশুদ্ধস্বভাবা, নিষ্কলুষ, পাপবিরহিতা যশোবতী ইত্যাকার শ্লোক শ্রবণ কালে, আপনার অভ্যন্তর বিহ্বল লোচনে নিরীক্ষণ করিয়াছিলেন, সেখানে অল্পবয়সী ঘুম ছিল, সেখানে ঘোর জটাজাল আবৃত মধ্যরাত্র। কোন এক দুবৃত্ত তস্কর ছিদ্র করিতে যত্নবান, ক্রমাগত খর খর শব্দ। তাঁহার শিরাসমূহ টঙ্কার দিয়া উঠিল। স্বামীকে তিনি তবু শুধু মাত্র বলিলেন, “বাঁচাও বাঁচাও…” কিন্তু শোনা গেল “ওগো ওগো…”
বৃদ্ধ তখনও ক্ষান্ত হন নাই।
“আমায় আর কষ্ট দিও না–আমার…” একদা তিনি শ্মশানের দিকে ভয়ঙ্করভাবে চাহিলেন। সেখানে আবছায়া চণ্ডাল, বুক যেন তাহার অধিকতর স্ফীত, যেন ব্যাঘ্ৰ খেলিয়া ফেরে, যেখানে চালোক উৎসবে লতাপত্রের ছায়া ছিল।
সীতারামের পদদ্ধয় অশ্রুসিক্ত, তবু, তাঁহার ক্রোধে যেমন বা নূতন করিয়া দন্তপাতি দেখা দিয়াছে। তিনি পৈতা ছিঁড়িয়া অভিশাপ দিতে গেলেন। দুগ্ধপাত্র স্থানচ্যুত হইল। এখন কাক আসিয়া সেই দুগ্ধ পানে ব্যাপৃত।
অভিশাপের উত্তরে যশোবতী বলিলেন, “আর জন্মে যেন তোমাকে পাই…” আপনার সত্ত্বগুণকে রক্ষার নিমিত্ত এ আপকালেও ক্রমাগত অনেক কথার মধ্যে এই কথা বলিয়াছিলেন যে, “সমুদ্র যেমন তীরভূমিকে লঙ্ঘন করে না, তেমনি আমিও আপনাকে কখনই লঙঘন করিব না।”
“মাগী…পটানি ফাজিল–গঙ্গা ডুবে মর গা–”
এসময় বৃদ্ধের মুখের কষের পাশেই মাড়ি, কিছুটা নাসা-গহ্বর এবং অদূরে সুন্দর পবিত্র মুখোনি দেখা গেল।
“বেশ আমি যাচ্ছি…তাই যাব…”
“মর মর…মরগে…”
স্খলিত জড়িত পদে যশোবতী কয়েক পদ বায়ুতাড়িত–গঙ্গাতীর ঢাল বশে–তাঁহার গতি দ্রুত হইল। হাহাকার করত গঙ্গার দিকে ছুটিয়া গেলেন।
সীতারামকে এই দৃশ্য প্রবুদ্ধ করে। শায়িত দেহ যেন ঊর্ধে লক্ষ্যপ্রদান করিল–চক্ষে উল্কার বেগ, তিনি উচ্চৈঃস্বরে থমকাইয়া বলিলেন, “বউ বউ চণ্ডাল চণ্ডাল” বলিয়াই মুখ হাঁ করিয়া আপনার সহধর্মিণী যশোবতীর নীতিজ্ঞানহীন সংকল্প দেখিতে লাগিলেন।
এবম্প্রকার দৃশ্যে চণ্ডাল বৈজুনাথ স্থির, তর্জ্জনী তুলিয়া দিনির্ণয় করিতেছিল, না হিসাব করে তাহা প্রমাণসাপেক্ষ, এখন সে স্বর-বৈষম্য শুনিল, গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়া এক দমে দুঃখিনী যশোবতীর নিকটে গিয়া পড়িল। যশোবতী তখন ডুবিতে গিয়া ক্রমাগতই ভাসিয়া উঠিতেছেন।
“কনে বউ…লাও চল…তুমি কি আর গঙ্গায় ডুবতে পার গো? গঙ্গা যে তোমার মধ্যে ডুববেক…হে হে গো…লাও চিৎ সাঁতার দাও গো-কেঁদে কেঁদে দম নাই তোমার যে,– বৈজুনাথ কহিল।
অসহায়ভাবে চণ্ডালের প্রতি চাহিয়া কহিলেন, “না আমি কি খেলা…”
“এ যে গঙ্গার জল বাড়ান কথা গো, জমি-হাঁসিল কথা বটে তোমার মুখে…কনে বউ, ড্যাঙায় দাঁড়িয়ে বল, লাও চল…”
“না আমি মরব…”
“কোন দুঃখে! মরতে পারলে তুমি বাঁচতে…”
তাঁহাকে প্রদক্ষিণ করত কহিতে লাগিল, “এখন খ্যান (ক্ষণ) আসে নাই…বললেই হল হে–চল চল-হরগৌরী দেখে আমাদের পাপ যাবেক গো…”
“না…”
“শেষ মেষ কি আমায় ধরতে হবে হেবামুনের মেয়ে আমার পাপ বাড়িও না। লাও মাথা খাও তোমার পায়ে পড়ি, চল…”
দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া ঝটিতে উল্টাইয়া সাঁতার কাটতে লাগিলেন। তীরে উঠিয়া অবনতমস্তকে স্বামীর নিকটে আসিলেন।
যশোবতী সিক্তবসনে দণ্ডায়মানা, আপনকার অঙ্গুলিতে তাঁহার দৃষ্টি, নিম্নেই বৃদ্ধ স্বামী। বৃদ্ধ অন্যদিকে চাহিয়া অনুযোগ করিলেন, “তুমি না আমায় ছেড়ে যাবে না…ছোট ছেলে মাকে হয়ত মারলে…তাতে মা তাকে ছেড়ে যাবে…আমি বুড়ো…” বলিয়া সীতারাম দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলেন, ইহার পর কহিলেন, “তা ছাড়া এই শ্মশানে মড়ার গন্ধে আমি কি আর আমি আছি বউ…”
যশোবতী ইত্যাকার কথায় ব্যথিত হইলেন, তিনি ক্ষণেকের জন্য চারিদিকে অনুভব করিলেন, নিজের চিতা-চিহ্নের দিকে নজর পড়িল, তথাপি স্বামীর জন্য ব্যাকুলতা ছাড়া আর কোন ভাবান্তর আসিল না।
“তুমি রাগ করলে গো, সীতাকে কিন্তু তুমি ত জান…”
“জানি…”
“তবে? রাম তাকে দুষ্ট বললেন, তবু তিনি…আমার কথা…দেহের বিকার গো…”
যশোবতীর দেহলগ্ন বস্ত্র শুকাইতেছে, মনোবেদনা ক্ষয় হইতেছিল, পুনরায় সমলোষ্ট্ৰাশ্মকাঞ্চন বুদ্ধির প্রত্যাবর্তন হইল; কেবলমাত্র নাসার বেসর চমকিত, নিঃশ্বাসে কম্পিত। তিনি যে দেহ বহিয়া বেড়াইতেছিলেন, সে দেহ শূন্য কলসের মত–তবুও তাহার গুরুভার ইদানীং জ্ঞান হইতেছিল– ক্লান্তিতে তাঁহার আঁখিপক্ষ্ম নামিয়া আসিতেছিল। মধ্যে মধ্যে ভিজা চুল এলো করিয়া দিয়াছিলেন।
“বউ কিছু খাও…”
“ভাল লাগছে না…”
“কেউ ত এল না–তাহলে তুমি চাট্টি ভাত খেতে…তারা কখন আসবে…”
“কি জানি…”
“তুমি রাগ করছো…”
“না গো…”
“আমায় ছুঁয়ে বল।”
“সত্যি …”
“তুমি আমার কে জান না…তুমি এই আকাশ ঢেকে দাঁড়াবে…তুমি শ্মশানকে…”
যশোবতী সনাথ হইলেন। বৃদ্ধের পার্শ্বেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন।
.
বেলা যখন প্রায় লাল হইয়াছে, তখন যশোবতীর নিদ্রা ভঙ্গ হইল। চক্ষু মেলিয়া সহসা কি জানি কেন গাছ পাতা নদী জলকে তাঁহার বড় পরিচিত বোধ হয়। ইহা সেই বৃদ্ধের দেখা পৃথিবী মনে হইল, তাহাদের তিনি যেন নিঃশ্বাস দান করিতেছেন। শ্মশানের বহু কিছুই তাঁহাকে বিকল করিল না, আবালবৃদ্ধবনিতা যেরূপ এ শ্মশানকে মহৎ বোধে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে, সেইরূপ শ্মশানকে, তাঁহার, মহৎ বোধ হইল না–এই তিনি শ্মশান দেখিলেন, আর এক প্রসূতিগৃহে যাহা কূট গতিস্পন্দনে অধীর, যাহা মৃচ্ছকটিকসদৃশ ওঙ্কার, যাহা জাতিস্মর স্তব্ধতা।
তবু মাত্র চঞ্চল পদধ্বনি শ্রুত হয়, অষ্টসাত্ত্বিক বিকার সম্ভব মহাপ্রসাদের গন্ধ নরবসার গন্ধে, ভরপূর বহু মেঘমালার সখেদ ক্রন্দনধ্বনি, কভু, এ ক্ষেত্রে, সবুজতা আনিতে সক্ষম হইবে না। স্বাহাবিরহী লেলিহান শিখা দিণ্ডলে পরিব্যাপ্ত, লক্ষ মায়া ছাই হইয়া গিয়াছে, লক্ষ ক্রোড় খার হইয়া যায়–শোণিতস্রাবী বজ্রযান অন্ধকার। এ শ্মশানে শিব শব হইয়া আছেন, মহাবিদ্যা–আলুলায়িত। কেশরাশি যাঁর, তিনি আনন্দে শিহরিত। কারণ সলিল বাষ্প হইয়া যায়–শ্মশানকে মণ্ডলাকারে অমর হ্লাদিনী শক্তি পরিক্রমণ করিতেছে। ঘুম মৃত্যুর নির্জন প্রতিবিম্ব–মৃত্যুর ভালবাসা, ঘুমই সে-ভালবাসা বিলায়, জীবনে ফুলকারী সোহাগ আনে। যশোবতী ঘুম চোখে দেখিলেন, যেখানে তিনি অমর।
সহজেই যশোবতীর মনে হইয়াছিল, এ দেহসকল দৃশ্য–আমি তাহার সাক্ষীস্বরূপ।
তিনি সন্ন্যাসিনীর ন্যায় সকল কিছুই আলো এবং অন্ধকার দেখিলেন। সদ্য নিদ্রোখিতা হওয়ায় তাঁহার ভ্রম হয়, ইদানীং অপরাহুকে তাঁহার অকারণেই মনে হইল যে, পুনরপি ভোর হইল। যেমন বা তাঁহার জন্মান্তর আসন্ন, বহু প্রাচীনতম ‘আমি’ ক্রমে ক্ষীয়মাণ হইতেছে। যশোবতী বৃদ্ধের দিকে চাহিলেন।
“বউ ঘুম ভাঙল…”
যশোবতী অল্প হাসিলেন। “বউ আমার উপর রাগ নেই ত?”
“না গো তুমি আমায় অন্যায় কিছু ত বলনি” বলিতে বলিতে এতক্ষণ পরে তাঁহার শ্মশান দর্শনের ভীতি হইল।
“আমায় দুঃখু দিও না” দীর্ঘশ্বাসকে সংযত করিতে করিতে বৃদ্ধ বলিলেন, “তুমি আমায় ছেড়ে যাবে না ত?”
সঙ্গে সঙ্গে যশোবতী তাঁহার মুখ চাপিয়া ধরিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁহার চম্পকসদৃশ হস্তকে ক্রমে ক্রমে ঠেলিয়া কয়েকটি কথা আসিল, “আমার কেউ নেই।”
“আমি আছি কৰ্ত্তা তুমি ছাড়া আমি কই” বলিয়া পুনৰ্ব্বার যশোবতী সেই অব্যবহিত অহৈতুকী অবিচ্ছিন্ন মনে বৃত্তি লাভ করিলেন। ললাটে স্বেদবিন্দু দেখা দিল। দেহের রুক্ষতাকে চমকিত করিয়া যৌবন চঞ্চল হইল।
অনুক্ষণ ডাক ছাড়িয়া কে যেন বলিতেছিল, “আমি আছি–” মধ্যরাত্রে সে স্বর ধৈবতে দুঃখিত হইয়া, গান্ধারে কাঁদিয়া পুনরায় বিদ্যুৎ রেখাব দেখিয়া শুদ্ধ স্বরে ফিরিয়াছিল।
বৃদ্ধের চোখে জল আসিল। আপনাকে সম্বরণ করিয়া কহিলেন, “বউ চুল বাঁধবে না…”
“হ্যাঁ…”
বৃদ্ধ কি যেন বলিতে গিয়া থামিলেন।
“কি গো…”
“তুমি ভুলে গেছ…”
যশোবতী ভ্রূ কুঞ্চিত করিলেন।
“তুমি ভাবছ বুড়ো বরের আবার অতশত…”
“আহা বল না কেনে…”
“ফুলশয্যা…”
যশোবতী জিব কাটিয়া গণ্ডস্থলে অঙ্গুলিপ্রদান করত কহিলেন, “আই গো, দেখেছ…মরণদশা, আমার একেবারে খেয়াল নেই গো…ছিঃ…”
“চুলটা বেঁধে লাও”,বৃদ্ধের স্বর গদগদ হইল।
“না, সন্ধ্যে হয়ে এল, গাছে হাত দেওয়া যাবে না…কৰ্ত্তা আমি দুটো ফুল নিয়ে আসি।”
“কি ফুলই বা পাবে…”
“তোমার পূজার ফুল সব ঠাঁই জন্মায় গো, কেনে আকন্দ। তুমি ত শিব…। না পাই বেলপাতা।”
বৃদ্ধ আচম্বিতে তাঁহার হস্তধারণ করিয়া আপনার কম্পন অনুভব করিয়াই স্থির, এই মুহূর্তে আসন্ন সন্ধ্যায় দুজনে দুজনের প্রতি গভীরভাবে দেখিলেন। দুজনে দুজনকেই পান করিলেন। সম্বিৎ ফিরিয়া আসিল। নববধূ আর দেরী করিলেন না।
যশোবতীর দেহ যেমত জ্বরে উষ্ণ; গায়ে জল বসিয়াছিল অথবা যোগনিদ্ৰাপ্রসূত দেহ ভারাক্রান্ত। তিনি ধীর পদক্ষেপে ভেড়ীপথে উঠিলেন, চারিদিক প্রেক্ষণ নিমিত্ত লক্ষ্য করিলেন, সম্মুখে চারিদিকে শ্মশান, শায়িত স্বামী, নিম্নে গঙ্গা। অন্যত্রে ধান্যক্ষেত্র, বহুদূরে গ্রাম, রাখাল গোরুসকল লইয়া ফিরিতেছে, এমত সময়ে তাঁহার শ্রবণে আসিল ক্রমাগত ‘আয় আয়’ ধ্বনি। সম্ভবত বুনো স্ত্রীলোকেরা তাহাদের পালিত পশুপক্ষীকে প্রত্যাবর্তন করিতে বলিতেছে। এই ‘আয় আয়’ ধ্বনি তাঁহার দেহের নিকটে আসিয়া পরিক্রমণ করিতে লাগিল। তিনি আপনার দেহের উষ্ণতা অনুভব করিলেন। অধৈৰ্য্য হইয়া ভেড়ীর ঢাল বাহিয়া দ্রুতপদে নামিলেন, নামিবার কালে তিনি বৃক্ষাদি ধরিয়াছিলেন, যাহাতে অসাবধানতাবশতঃ পদস্খলন না হয়। এবং ঝটিতি একটি কচু পাতা লইয়া ফুল চয়নে ব্যাপৃত হইলেন। এখনও শুনা যায় ‘আয় আয়’ ধ্বনি।
ফুল লইয়া আসিয়া মালা গাঁথিলেন–চাঁদোয়ার খুঁটি মালার হারে সজ্জিত হইল। সীতারাম যশোবতাঁকে দেখিলেন, আর তিনি দেখিলেন পিছনে লাল চাঁদ। মিলনের অভিলাষে নববধূ পূর্ণাঙ্গ। ফুল অনটন হইল। ফলে, যশোবতাঁকে পুনরায় ফুল আনিতে যাইতেই হইল। এই সেই লতাবিতান পরিমণ্ডিত উৎকৃষ্ট কানন, এখানে নববধূ আরবার ফুলচয়নে ব্যাপৃতা।
‘আয় আয়’ ধ্বনি তাঁহার গাত্রে যেমত লাগিয়া যাইতেছে, তিনি বিরক্ত একারণে যে, বড়ই তাঁহার অসোয়াস্তি হইতেছিল, এবং ঠিক এই সময়ই কাহার গলার স্বর, ক্রমাগত কথার স্রোত শুনিয়াই সচকিত হইয়া প্রথমে নির্লিপ্ত, পরে আগ্রহের সহিত অনুধাবন করিতে সচেষ্ট হইলেন, তাঁহার কর্ণমূল রক্তিম হয়। দেখিলেন, চণ্ডাল বৈজুনাথ, মনে হয় শায়িত, গাছে গাছে অনেকটা অদৃশ্য, কিন্তু তাহার মুখমণ্ডল সম্পূর্ণ দেখা যায়, হস্তদ্বয় উত্তোলিত। ইহাতে মনে হয় কাহাকে যেন ঊর্ধ্বে ধারণ করত সে এ-সকল কথা কহিতেছে। এখন বৈজুনাথ বলিল, “তুমি কি গো, তোমার মন কি গো; মোষের শিঙে সরষে দাঁড়ায় না, তার বেহদ্দ গো ধনি।”
যশোবতী ইত্যাকার বাক্যে অন্ধ হইয়া গেলেন, নথ কম্পিত হয়, তাঁহার রাশ আন্দোলিত।
বৈজুনাথ ছড়া কাটিল–
“হেই বড়াই, হে বড়াই মেরো না আমলার ছড়ি,
কাটান কাটায়ে দিব খাজনার কড়ি,
ঘরকে ঠায় নিমগাছটি নিম ঝুরঝুর করে,
সদাই বিড়ালী বিটি লিওলিয়াই করে,
ফল লিবি না কোদাল লিবি সত্যি করে বল,
নয়ত ভাশুর ভাতার ধর”
ইহার সহিত তাহার উচ্চ হাস্যধ্বনি শোনা গেল।
“কুত্থাকে ছিলে হে ধনি এতে কাল, মনের মানুষকে ভুলে, কত আকাশ গেল, বাতাস গেল, এতদিন পরে–তবু ভাল হে, তবু ভাল হে–বিনিসুতোর মালা গাঁথুনী মালিনী গো।”
এক একটি কথা এমন যেন বা উহা কর্দমের ঢেলা, ক্রমাগত তাঁহার দিকে আসিতেছে, আর যে, তিনি, যশোবতী, কোনক্রমে আত্মরক্ষা করিতেছেন। কখনও বা গাছের সঙ্গে মিশিতেছেন; এখন হস্তচ্যুত ফুলগুলি কুড়াইতে বসিয়া মুখ ঘুরাইয়া যাহা দেখিলেন, তাহা বীভৎস এবং পলকের জন্য জ্ঞানশূন্য হইলেন।
এ সময় চণ্ডাল বৈজুনাথ ঝটিতি আপনার মুখের সম্মুখে একটি নরকপাল আনিল, যাহার সহিত এতাবৎ কথা কহিতেছিল।
চণ্ডাল নরকপাল লইয়া মহা আদর করিতেছিল, কাকুতি মিনতি করিতেছিল, বাক্যের দাসখত দিতেছিল। “তুমি ত আমার সব গো–এখন এত কথা বলছি? বেঁচেছিলাম কি করে? কেনে? ডিমের মত নড়ন নাই চড়ন নাই, ধুক ধুক নাই…পায় পড়ি গো…প্রত্যয় যাও–ওমা”, অতঃপর সহসা সে মুখ ঘুরাইয়া কপট আশ্চর্য সহকারে কহিল, “ওমা, কনে বউ যে!”
এই ডাকই তাঁহার সম্ভ্রম নষ্ট করিল, তিনি আত্মরক্ষায় প্রয়াসী হইলেন।
“দে দে, ঘোমটা দে লোলোকে বলবে কি? হায়া নাই সরম নাই, কোথাকার খড়মপেয়ে, খোয়াড়ে লিয়ে যাবে হে…কনে বউ…” বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে কহিল, “আমার বউ এসেছে গো এতদিন বাপের ঘরে হাঁড়ি ঠেলত, ধান ভানত…লে লে শালী আবার হায়া কি গো–ই ছি ছি তোমায় দেখি সরমাইছে, হারে কপাল বৃষভানুনন্দিনীর আবার সরম–মেয়েমানুষ শালী পুরুষের হাড় লিয়ে খেল মাঠে বসি যখন, ডুগডুগি বাজাতে যখন, এত হায়া কোথায় থাকে…হে হে…বিবাহ এক রক্তের লেশা–” বলিয়া নরকপালে ঠোনা মারিল, নাচাইল।
যদি নির্ম্মাল্যবৎ যশোবতীর অনেক অভিজ্ঞতা হইয়াছিল, চৈত্র প্রান্তরের ঘূর্ণি হাওয়ার ন্যায় সোজা হইয়াছিলেন, এরূপ কাণ্ড তিনি আশা করেন নাই, সংক্রান্তির সাগরসঙ্গমের হিম হাওয়া তাঁহার গায়ে বিষক্রিয়া করিতেছিল। চণ্ডালের হস্তে নিঃসঙ্গ চালোকে মধ্যরাত্ৰ খেলিতেছিল।
“সুন্দরী তুমি” নিশির ডাকের মত আওয়াজ আসিল “চন্দন চাঁদ তোমার কাছে পোড়া কাঠ…গো…তুমি সত্যই সুন্দর, তুমি ত্রিলোকেশ্বরের ঘরণীর থেকে সুন্দর…তুমি…”। বৈজুনাথ এখন প্রায় যশোবতীর নিকটে আসিয়া পড়িয়াছিল। তাহার আর পিছু হটিবার পথ নাই, আকন্দ বৃক্ষ তাহা রোধ করিয়াছে, আর অল্প দূরে ঢাল-নিম্নে খালের মত, যাহা জলাশয়।
যশোবতী উন্মাদ কণ্ঠস্বরে ভাঙ্গিয়া পড়িলেন, “চণ্ডাল”–
“ওলো! ওলো! সরে আয়, ওলো, তোকে দেখে কনে বউ ভয় পাচ্ছে লো” বলিয়া এক হাতে নরকপালকে লইয়া প্রায় স্কন্ধের কাছে স্থাপন করিয়া কিঞ্চিৎ ঘুরিয়া দাঁড়াইল।
“তুমি কে?” ‘কি’ বলিতে গিয়া যশোবতী ‘কে’ প্রয়োগ করিলেন। তাঁহার কণ্ঠে ক্রন্দন ছিল।
“বড় আধ্যাত্মিক প্রশ্ন গো কনে বউ…শেষ নিঃশ্বাস নিয়ে যে জীব বেঁচে থাকে, আমি সেই জীব বটে গো…”
“পথ ছাড়…”
“কনে বউ, একে দেখে…কঙ্কাল দেখে ভয় পাচ্ছ কেনে? এ তো তোমার ভিতর আছে, তোমাকে খাড়া রেখেছে। একটু চেয়ে দেখ কত সুন্দর, কত মায়া, আকাশ বাতাস গঙ্গার থেকে এ বড় সুন্দর বটে…তুই খুব সুন্দর না রে,– বলিয়া তাহার চিবুক ধরিল।
যশোবতী বুঝিলেন, বৈজুনাথ মাতাল। তাহার গাত্র হইতে নরবসার গন্ধ, তাহার মুখে প্রকৃতির গন্ধ।
“চণ্ডাল ওটা ফেলে দাও…”
“সে কি গো আমার ঘরণী যে বটে, আমি গেরস্থ…ঘরণীকে ফেললে মহাপাতক হব যে…”
“চণ্ডাল!” এ স্বরে যশোবতীর ইহকালের প্রতি বাসনা ছিল।
“অমন কথা তুমি ব’ল না, তুমি কে? না সতী। তোমার নামে কুট সারবে…লে লে সতী মাকে গড় কর, সেবা দে বউ” বলিয়া তাঁহার পায়ের নিকটে নরকপাল রাখিতে গেল।
যশোবতীর ভয়ে যেন গায়ে কাঁটা দিল, “পিশাচ চাঁড়াল!”
বৈজুনাথ উঠিয়া দাঁড়াইয়া হাসিল, “ওগো সতী হুজুর, আমি মড়া পোড়াই, চাঁড়াল বটে, তবু পুরুষ মানুষের জান বটে, পুরুষের হৃদয়, এখানটা পুড়তে সময় লেয়, তোমার এখানটা পুড়তে সময় লেয়” বলিয়া আপনার উদর দেখাইয়া কহিল, “তুমি এখানের কথা কি জান, মনের জন্য পিশাচ আমি হই– এই আমার ঘরণী, তুমি যদি…বুড়ো যদি তোমার ইহকাল পরকাল হয়, এই বা কি দোষ করলে গো কনে বউ। লে লে বউ গড় কর, সবই মায়া বটে।”
“না না…” যশোবতীর কণ্ঠস্বরে যেন আকাশ বিদীর্ণ হইল।
“একটুক সিন্দুর দাও গোতোমার নামে এর গায়ে মাংস লাগবে…এই আবার ভাতে কাঠি দিবে, বিয়োবে, মাই দিবে গো। টুকুন সিন্দুর, সতীর সিন্দুর মেঙ্গে লে বউ…”
“চণ্ডাল…আমাকে কেন ভয় দেখাচ্ছ?”
“ভয় দেখাব কেনে, বউ দেখাই, সিন্দুর মাঙ্গি, এ শ্মশানে আর আমি পাব কোত্থাকে? এ শ্মশানে এক সিদ্ধ ছিল, মেয়েদের চুলের পৈতা ছিল, এক কঙ্কালকে ‘ওগো ভৈরবী গিন্নী’ বলে ডাকত যে হে…”।
যশোবতীর চর্ম লোল, জিহ্বা শুষ্ক হইয়াছিল। নরমুণ্ডের দিকে চাহিয়া রহিলেন। তিনি অনাদি অনন্তকালের দৃশ্য দেখিয়াছিলেন।
চণ্ডাল কহিল, “অনেক ভেবে চিন্তে আমি একে ঘরে তুলোম…আমি…তোমাকে কনে বউ, আগে বাঁচাতে চেয়েছিলাম…তুমি গালমন্দ করলে, তখন ভাবলাম এ আমি কি ভুল করছি। তোমাকে না বাঁচাবার সুকৃতি ফলে তুমি যে যে ঘরে জন্মাবে আমিও কাছে জন্মাব–এটা কি বেশী চাওয়া?”
যশোবতীর মনে, নিশ্চয় একথা সত্য যে, যিনি মায়া বহির্ভূতা তাঁহার মনে, তপোবন-বিরোধী বিকার উপস্থিত হইল।
বৈজুনাথ নরকপালে সস্নেহে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল, “না, সতাঁকে পেলে হনুমানের মত আয়ন ঘোষ হয়ে থাকতে হবে, বুড়ো তখন কেলে ছোঁড়া হয়ে” বলিয়া নরকপাল বংশীর ন্যায় ধরিয়া কহিল, “বাঁশী বাজাবে, তুমি জল আনতে ছুটবে–তার থেকে এই ভাল…”
যশোবতী এ ইঙ্গিত বুঝিতে পারেন নাই, একারণ যে তাঁহার ভীতি তখনও ছিল।
যশোবতী ইতিমধ্যে ক্ষিপ্রবেগে নরকপাল তাহার হাত হইতে ছিনাইয়া লইয়া উর্ভে ধারণ করিলেন,চণ্ডাল তাঁহাকে ধরিতে গেল, হাত দিয়া কঙ্কাল লইতে গেল। কোন মতে যশোবতী আকন্দ গাছ অতিক্রম করত পলায়ন করিতে গিয়া সহসা পড়িয়া গেলেন; এক হাতে নরকপাল জলাশয়ের করের মধ্যে প্রতীয়মান।
চণ্ডাল পশুর মত হাতে ভর দিয়া, হামাগুড়ি দিয়া স্থির।
উন্মাদহাস্যে কহিলেন “না”…তাঁহার একটি হাত নরকপালের কাছে যেখানে কর, যেখানে জলজ লজ্জাবতী, তাহার উপর অদ্ভুতভাবে আন্দোলিত হইল, লজ্জাবতী লতা ব্রীড়াবনত হয়।
চণ্ডাল তাঁহার একটি হাত ধরিয়াছে, সহসা কিসের শব্দ হইল।
.
বায়ু স্থির, পাখীরা উড়িয়া গেল, ধরিত্রীর বক্ষে কে যেন হাঁটু ডলিতেছে। ত্রিলোক এক হইয়াছে। ওজস্বিনী বিশাল তরল সমতল শ্মশান দাম্ভিকভাবে আসিতেছে, মহাব্যোমে স্ফুলিঙ্গ উদ্ধত।
চণ্ডালের ঘরণী করের মধ্যে ডুবিয়াছিল, ইন্দ্রিয়াসক্ত, সমগুণপ্রধাণা যশোবতী বেপথুমানা; মহা আবেগে মুষ্ঠিতে দূর্বাদল আকর্ষণ করিয়াছিলেন। নিঃশ্বাসে অজাগর ঠিকরাইতেছে। নীহারধূমাকানিলনলান খদ্যোৎ বিদ্যুৎ স্ফটিক শশীসম্ভব আলো আপনার কপালে খেলিতে লাগিল।
“কনে বউ…কোটাল।”
কপাল কুঞ্চিত করিলেন, সুখশয্যা ত্যাগ করিবার তাঁহার ক্ষমতা নাই। “কোটাল কোটাল” বলিয়া যেমন সে উঠিতে যাইবে, কনে বউ তাহার হাত বজ্রজোরে ধরিলেন। তিনি দেহাভিমানিনী, কেননা সম্ভবত অষ্টপাশ ছিন্ন হয়।
“কোটাল বান হে আসছে হে বুড়ো…”
“কনে বউ এসো…বুড়ো…তোমার বর।”
“মরুক…”
.
একটি নিঃশ্বাসের পরেই তিনি, যশোবতী, পরিশ্রান্ত ঘর্মাক্ত অশ্বের মত ছুটিয়া আসিলেন। ভেড়ী পথে উঠিলেন। এক দিকে বিগলিত লৌহের মত, জল-পৰ্বত আসিতেছে, নিম্নে ফুলশয্যা, আর অপেক্ষমাণ বৃদ্ধ স্বামী। ফুলহার সকল দোলায়মান, যাহা দূর হইতে বিছানা, ফুলহার, যেমন বা গোলাপশীতল পোম্পাইয়ের আতিশয্য।
সহসা বৃদ্ধের সঙ্গে কে যেন বিশ্বাসঘাতকতা করিতে আসিতেছে। বাণবিদ্ধ পাখীর মত কর্কশ করুণ স্বরে ডাকিলেন–”বউ…”
বিস্ফারিতনেত্রা যশোবতী দুর্দশা দেখিলেন, তাঁহার পদদ্বয় ঘর্মাক্ত হইল, তাঁহার কর্তব্যবুদ্ধি ফিরিয়া আসিল। তিনি ছুটিতে গিয়া দেখিলেন তাঁহার হাত এখনও চণ্ডাল ধরিয়া আছে। তিনি শিশুর মত আপনকার পা মৃত্তিকায় ঠুকিতে লাগিলেন, গগন শঙ্কিত হইল। আর যে, হঠাৎ তিনি চণ্ডালের হস্তে কামড় দিতেই বৈজুনাথ হাত ছাড়াইয়া লইল। এত জোরে তিনি কামড়াইয়াছিলেন যে বৈজুনাথের হাতের চুল ছিঁড়িয়া মুখে আসিয়াছিল। থুথু করিতে করিতে তিনি তড়িৎবেগে ভেড়ীপথেই ছুটিতে লাগিলেন, কখন আপনার হস্ত দংশন করিলেন, কখনও আবার দেখা গেল আপনার গণ্ডে চপেটাঘাত করিতে করিতে ছুটিতেছেন।
গুপ্তঘাতকের হস্তে বৃদ্ধ সীতারাম আহত। জল আলোড়নে, বৃদ্ধদেহ চক্ৰ দিয়া উঠিল, মৃত্তিকা তৈজস ছত্রাকার হইল। এতৰ্দশনে যশোবতী জলে নামিয়া পড়িলেন। একটি বৃষকাষ্ঠ ধরিলেন, ক্রমাগত “কৰ্ত্তা কৰ্ত্তা” চীৎকারে হাত ছাড়িয়া গেল! বান…সহসা তাঁহাকে লইয়া গেল। কোনক্রমে একটি প্রতিমার কাঠামো ধরিলেন। পরমুহূর্তে বানের তোড়ে প্রতিমার কাঠামো তাঁহাকে লইয়া খাড়া হইয়া দাঁড়াইল।
একবার বৃদ্ধকে দেখিলেন।
অল্পবয়সী ষড়ৈশ্বৰ্য্যশালিনী পতিপ্রাণা “কৰ্ত্তা-কৰ্ত্তা” বলিয়া প্রতিমার কাঠামো ছাড়িয়া জলে লাফ দিলেন। ক্রন্দন করিতে করিতে সন্তরণের বৃথা চেষ্টা করিলেন, দু’একবার ‘কা” ডাক শোনা গেল।
ইহার পর শুধুমাত্র রক্তিম জলোচ্ছ্বাস! কেননা চাঁদ এখন লাল। একটি মাত্র চোখ, হেমলকে প্রতিবিম্বিত চক্ষুসদৃশ, তাঁহার দিকেই, মিলন অভিলাষিণী নববধুর দিকে চাহিয়াছিল, যে চক্ষু কাঠের, কারণ নৌকাগাত্রে অঙ্কিত, তাহা সিন্দুর অঙ্কিত এবং ক্রমাগত জলোচ্ছাসে তাহা সিক্ত, অশ্রুপাতক্ষম, ফলে কোথাও এখনও মায়া রহিয়া গেল।