অন্নদামঙ্গল – ভারতচন্দ্র রায়ের লেখা একটি অসাধারণ মঙ্গলকাব্য। অন্নদামঙ্গল কাব্যটি রচিত হয়েছে দেবী অন্নপূর্ণার মাহাত্ম্য্যব্যঞ্জক নিয়ে। ভারতচন্দ্র তার পৃষ্ঠপোষক নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়এর অনুরোধে ১৭৫২ সালে কাব্যটি রচনা করেন। অন্নদামঙ্গল সমগ্র কাব্যটি তিনটি খণ্ডে বিভক্ত: (১) অন্নদামঙ্গল বা অন্নদামাহাত্ম্য্য, (২) বিদ্যাসুন্দর বা কালিকামঙ্গল ও (৩ মানসিংহ বা অন্নপূর্ণামঙ্গল।
অন্নদামঙ্গল বইয়ের বিবরণঃ
- বইয়ের নামঃ অন্নদামঙ্গল
- লেখকের নামঃ ভারতচন্দ্র রায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অন্নদামঙ্গল
অন্নদামঙ্গল রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রচিত একটি মঙ্গলকাব্য। কাব্যটি দেবী অন্নপূর্ণার মাহাত্ম্যব্যঞ্জক। ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে ভারতচন্দ্র এই কাব্য রচনা করেছিলেন। ভারতচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষক নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় বাংলায় প্রতিমায় দেবী অন্নপূর্ণার পূজা প্রচলন করেন। তিনিই ভারতচন্দ্রকে রায়গুণাকর উপাধি প্রদান করে দেবীর মাহাত্ম্যব্যঞ্জক একটি কাব্য রচনার অনুরোধ করেন। সমগ্র কাব্যটি তিনটি খণ্ডে বিভক্ত: (ক) অন্নদামঙ্গল বা অন্নদামাহাত্ম্য, (খ) বিদ্যাসুন্দর বা কালিকামঙ্গল ও (গ) মানসিংহ বা অন্নপূর্ণামঙ্গল। মঙ্গলকাব্য ধারায় অন্নদামঙ্গল কাব্যকে একটি পৃথক শাখা রূপে গণ্য করা হয় না; কারণ ভারতচন্দ্র ভিন্ন অপর কোনো কবি এই বিষয়বস্তু অবলম্বন করে কাব্যরচনা করেননি।
সমগ্র অন্নদামঙ্গল কাব্যের কোনো প্রাচীন নির্ভরযোগ্য পুথি পাওয়া যায় না। প্রাপ্ত পুথিগুলির লিপিকাল ১৭৭৬-১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়। ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে এই কাব্যটি প্রথম মুদ্রিত হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪৭ ও ১৮৫৩ সালে এই গ্রন্থের দুটি সংস্করণ প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর কৃত সংস্করণটি আদর্শ ধরে অন্নদামঙ্গল কাব্যের অন্যান্য সংস্করণগুলি প্রকাশিত হয়। লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম, প্যারিসের বিবলিওথেক নাসিওনেল দে ফ্রান্স, এশিয়াটিক সোসাইটি ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে এই কাব্যের কয়েকটি প্রাচীন পুথি সংরক্ষিত আছে।
ভারতচন্দ্র স্বয়ং অন্নদামঙ্গল কাব্যকে “নূতন মঙ্গল” অভিধায় অভিহিত করেছেন। কবি এই কাব্যে প্রথাসিদ্ধ মঙ্গলকাব্য ধারার পূর্ব ঐতিহ্য ও আঙ্গিককে অনুসরণ করলেও, বিষয়বস্তুর অবতারণায় কিছু নতুনত্বের নিদর্শন রেখেছেন। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের ন্যায় অন্নদামঙ্গল গ্রামীণ পটভূমি বা পরিবেশে রচিত হয়নি; এই কাব্য একান্তই রাজসভার কাব্য। ভারতচন্দ্র এই কাব্যের আখ্যানবস্তু সংগ্রহ করেছিলেন কাশীখণ্ড উপপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, ভাগবত পুরাণ, বিহ্লনের চৌরপঞ্চাশিকা (চৌরীসুরত পঞ্চাশিকা), এবং ক্ষিতীশবংশাবলীচরিতম্ ইত্যাদি গ্রন্থ ও লোকপ্রচলিত জনশ্রুতি থেকে। অন্নদামঙ্গল কাব্যের বৈশিষ্ট্য হল ছন্দ ও অলংকারের সুদক্ষ প্রয়োগ। সংস্কৃত ভাষায় পারঙ্গম ভারতচন্দ্র প্রাচীন সংস্কৃত কাব্যের বিভিন্ন ছন্দ ও অলংকার সার্থকভাবে এই কাব্যে প্রয়োগ করেন। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কাব্য সম্পর্কে মন্তব্য করেন, “রাজসভাকবি রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল-গান রাজকণ্ঠের মণিমালার মতো, যেমন তাহার উজ্জ্বলতা তেমনি তাহার কারুকার্য।” অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে: “অন্নদামঙ্গলকাব্য অষ্টাদশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের অন্যতম। … মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কর্তৃক অন্নপূর্ণা পূজা উপলক্ষ্যে মহারাজের নিজ কীর্তি এবং তাঁহার পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের রাজ্য ও রাজা উপাধি লাভের কাহিনী বর্ণনাই ছিল কবির প্রধান উদ্দেশ্য। দেবী অন্নদা (অন্নপূর্ণা) কীভাবে ভবানন্দ মজুমদারকে কৃপা করিলেন, এবং ভবানন্দ কীভাবে জাহাঙ্গীরের দ্বারা অন্নপূর্ণা পূজা করাইয়া রাজত্ব ও রাজা খেতাব লাভ করিলেন – ইহার বর্ণনাই ছিল কবির প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য। কিন্তু কবি পৌরাণিক অংশ বিশেষ ফলাও করিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।” (উইকি)
০১. গণেশ বন্দনা
গণেশায় নমো নমঃ : আদি ব্রহ্ম নিরুপম : পরমপুরুষ পরাৎপর।
খর্ব্বস্থূল কলেবর : গজমুখ লম্বোদর : মহাযোগী পরম সুন্দর।।
বিঘনাশ করো বিঘ্নরাজ।
পূজা হোম যজ্ঞ যাগে : তোমার অর্চ্চনা আগে : তব নামে সিদ্ধ সর্ব্ব কাজ।।
স্বরগ পাতাল ভূমি : বিশ্বের জনক তুমি : সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়ের মূল।
শিবের তনয় হয়ে : দুর্গারে জননী কয়ে : ক্রীড়া কর হয়ে অনুকূল।।
হেলে শুণ্ড বাড়াইয়া : সংসার সমুদ্র পিয়া : খেলাচ্ছলে করহ প্রলয়।
ফুৎকারে করিয়া বৃষ্টি : পুনঃ কর বিশ্বসৃষ্টি : ভাল খেলা খেল দয়াময়।।
বিধি বিষ্ণু শিব শিবা : ত্রিভুবন রাত্রি দিবা : সৃষ্টি পুনঃ করহ সংহার।
বেদে বলে তুমি ব্রহ্ম : তুমি জপ কোন্ ব্রহ্ম : তুমি সে জানহ মর্ম্ম তার।।
যে তুমি সে তুমি প্রভু : জানিতে নারিনু কভু : বিধি হরি হর নাহি জানে।
তব নাম লয় যেই : আপদ্ এড়ায় সেই : তুমি দাতা চতুর্ব্বর্গদানে।।
আমি চাহি এই বর : শুন প্রভু গণেশ্বর : অন্নপূর্ণামঙ্গল রচিব।
কৃপাবলোকন কর : বিঘ্নরাজ বিঘ্ন হর : ইথে পার তবে যে পাইব।।
আপনি আসরে উর : নায়কের আশা পূর : নিবেদিনু বন্দনা বিশেষে।
কৃষ্ণচন্দ্রভক্তি আশে : ভারত সরস ভাষে : রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে।।
০২. শিব বন্দনা
শঙ্করায় নমো নমঃ : গিরিসূতা প্রিয়তম : বৃষভবাহন যোগধারী।
চন্দ্র সূর্য্য হুতাশন : সুশোভিত ত্রিনয়ন : ত্রিগূণ ত্রিশূলী ত্রিপূরারি।।
হর হর মোর দুঃখ হর।
হর রোগ হর তাপ : হর শোক হর পাপ : হিমকরশেখর শঙ্কর।।
গলে দোলে মুণ্ডমাল : পরিধান বাঘছাল : হাতে মুণ্ড চিতাভস্ম গায়।
ডাকিনী যোগিনীগণ : প্রেত ভূত অগণন : সঙ্গে সঙ্গে নাচিয়া বেড়ায়।।
অতি দীর্ঘ জটাজুট : কণ্ঠে শোভে কালকূট : চন্দ্রকলা ললাটে শোভিত।
ফণী বালা ফণী হার : ফণিময় অলঙ্কার : শিরে ফণী ফণী উপবীত।
যোগীর অগম্য হয়ে : সদা থাক যোগ লয়ে : কি জানি কাহার কর ধ্যান।।
অনাদি অনন্ত মায়া : দেহ যারে পদচ্ছায়া : সেই পায় চতুর্ব্বর্গ দান।।
মায়ামুক্ত তুমি শিব : মায়াযুক্ত তুমি জীব : কে বুঝিতে পারে তব মায়া।
অজ্ঞান তাহার যায় : অনায়াসে জ্ঞান পায় : যারে তুমি দেহ পদচ্ছায়া।।
নায়কের দুঃখ হর : মোর গীত পূর্ণ কর : নিবেদিনু বন্দনা বিশেষে।
কৃষ্ণচন্দ্রভক্তি আশে : ভারত সরস ভাষে : রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে।।
০৩. সূর্য্য বন্দনা
ভাস্করায় নমঃ : হর মোর তমঃ : দয়া কর দিবাকর।
চারি বেদ কয় : ব্রহ্মতেজোময় : তুমি দেব পরাৎপর।।
দিনকর চাহ দীনে।
তোমার মহিমা : বেদে নাহি সীমা : অপরাধ ক্ষম ক্ষীণে।।
বিশ্বের কারণ : বিশ্বের লোচন : বিশ্বের জীবন তুমি।
সর্ব্বদেবময় : সর্ব্ববেদাশ্রয় : আকাশ পাতাল ভূমি।।
একচক্র রথে : আকাশের পথে : উদয়গিরি হইতে।
বাহ অস্তগিরি : এক দিনে ফিরি : কে পারে শক্তি কহিতে।।
অতি খরতর : পোড়ে মহীধর : সিন্ধুর জল শুকায়।
পদ্মিনী কেমনে : হাসে হৃষ্টমনে : তোমার তত্ত্ব কে পায়।।
দ্বাদশমূরতি : গ্রহগণপতি : সংজ্ঞা ছায়া নারী ধন্যা।
শনি যম মনু : তব অঙ্গজনু : যমুনা তোমার কন্যা।।
বিশ্বের রক্ষিতা : বিশ্বের সবিতা : তাই সবিতা নাম।
তুমি বিশ্বসার : মোরে কর পার : করি হে কোটি প্রণাম।।
কোকনদোপর : থাক নিরন্তর : অশেষ গুণসাগর।
বরাভয় কর : ত্রিনয়ন ধর : মাথায় মাণিকবর।।
স্মরিলে তোমায় : পাপ দূরে যায় : আসরে উদয় হবে।
কৃষ্ণচন্দ্র ভূপে : চাহিবে স্বরূপে : ভারতচন্দ্রের স্তবে।।
০৪. বিষ্ণু বন্দনা
কেশবায় নমো নমঃ : পুরাণ পুরুষোত্তম : চতুর্ভূজ গরুড় বাহন।
বরণ জলদঘটা : হৃদয়ে কৌস্তুভচ্ছটা : বনমালা নানা আভরণ।।
কৃপা কর কমললোচন।
জগন্নাথ মুরহর : পদ্মনাভ গদাধর : মুকুন্দ মাধব নারায়ণ।
রামকৃষ্ণ জনার্দ্দন : লক্ষ্মীকান্ত সনাতন : হৃষীকেশ বৈকুণ্ঠ বামন।
শ্রীনিবাস দামোদর : জগদীশ যজ্ঞেশ্বর : বাসুদেব শ্রীবৎসলাঞ্ছন।।
শঙ্খ চক্র গদাম্বুজ : সুশোভিত চারিভূজ : মনোহর মুকুট মাথায়।
কিবা মনোহর পদ : নিরুপম কোকনদ : রতননূপুর বাজে পায়।।
পরিধান পীতাম্বর : অধর বান্ধুলীবর : মুখসুধাকরে সুধাহাস।
সঙ্গে লক্ষ্মী সরস্বতী : নাভিপদ্মে প্রজাপতি : রূপে দশদিক পরকাশ।।
ইন্দ্র আদি দেব সব : চারিদিকে করে স্তব : সনকাদি যত ঋষিগণ।
নারদ বীণার তানে : মোহিত যে গুণগানে : পঞ্চমুখে গান পঞ্চানন।।
কদম্বের কুঞ্জবনে : বিরহ সানন্দ মনে : শীতল সুগন্ধ মন্দ বায়।
ছয় ঋতু সহচর : বসন্ত কুসুমশর : নিরবধি সেবে রাঙ্গা পায়।।
ভৃঙ্গের হুঙ্কার রব : কুহরে কোকিল সব : পূর্ণচন্দ্র শরত যামিনী।
বীণা বাঁশী আদি যন্ত্রে : গান করে কাম তন্ত্রে : ছয় রাগ ছত্রিশ রাগিনী।।
ঊর প্রভু শ্রীনিবাস : নায়কের পূর আশ : নিবেদিনু বন্দনা বিশেষে।
ভারত ও পদ আশে : নূতন মঙ্গল ভাষে : রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে।।
০৫. কৌষিকী বন্দনা
কৌষিকি কালিকে : চণ্ডিকে অম্বিকে : প্রসীদ নগনন্দিনী।
চণ্ডবিনাশিনি : মুণ্ডনিপাতিনি : শুম্ভনিশুম্ভঘাতিনি।।
মহিষমর্দ্দিনি : দুর্গবিঘাতিনি : রক্তবীজনিকৃন্তনি।
দিনমুখরবি : কোকনদচ্ছবি : অতুল পদ দুখানি।।
রতননূপুর : বাজায়ে মধুর : ভ্রমর ঝঙ্কার মানি।।
হেমকরিকর : উরু মনোহর : রতনকদলীকায়।
কটি ক্ষীণতর : নাভি সরোবর : অমূল্য অম্বর তায়।।
কমলকোরক : কদম্বনিন্দক : করিসুতকুম্ভ উচ।
কাঁচলিরঞ্জিত : অতি সুশোভিত : অমৃতপুরিত কুচ।।
সুবলিত ভুজ : সহিত অম্বুজ : কনকমৃণাল রাজে।
নানা আভরণ : অতি সুশোভন : কনক কঙ্কণ বাজে।।
কোটি শশধর : বদন সুন্দর : ঈষৎ মধুর হাস।
সিন্দূরমার্জ্জিত : মুকুতারঞ্জিত : দশনপাঁতি প্রকাশ।।
সিন্দূর চন্দন : ভালে সুশোভন : রবি শশী এক ঠাঁই।
কেবা আছে সমা : কি দিব উপমা : ত্রিভুবনে কেহ নাই।।
শিরে জটাজুট : রতন মুকুট : অর্দ্ধশশী ভালে শোভে।
মালতীমালায় : বিজলী খেলায় : ভ্রমর ভ্রময়ে লোভে।।
কহি যোড়করে : উরহ আসরে : ভারতে করহ দয়া।
কৃষ্ণচন্দ্র রায়ে : রাখ রাঙ্গাপায়ে : অভয় দেহ অভয়া।।
০৬. লক্ষ্মী বন্দনা
উর লক্ষ্মী কর দয়া।
বিষ্ণুর ঘরণী : ব্রহ্মার জননী : কমলা কমলালয়া।।
সনাল কমল : সনাল উৎপল : দুখানি করে শোভিত।
কমল আসন : কমল ভূষণ : কমলমাল ললিত।।
কমলচরণ : কমলবদন : কমলনাভি গভীর।
কমলদুকর : কমলঅধর : কমলময় শরীর।।
কমলকোরক : কদম্বনিন্দুক : সুধার কলস কুচ।
করিঅরিমাঝে : জিনি কবিরাজে : কুম্ভযুগ চারু উচ।।
সুধাময় হাস : সুধাময় ভাষ : দৃষ্টিতে সুধা প্রকাশ।
লাক্ষার কাঁচলি : চমকে বিজলী : বসন লক্ষ্মীবিলাস।।
রূপ গুণ গান : যত যত স্থান : তুমি সকলের শোভা।
সদা ভুঞ্জে সুখ : নাহি জানে দুখ : যে তব ভকতি লোভা।।
সদা পায় দুখ : নাহি জানে সুখ : তুমি হও যারে বাম।
সবে মন্দ কয় : নাম নাহি লয় : লক্ষ্মীছাড়া তার নাম।।
তব নাম লয়ে : লক্ষ্মীপতি হয়ে : ত্রিলোক পালেন হরি।
যাদোগণেশ্বর : হৈল রত্নাকর : তোমারে উদরে ধরি।।
যে আছে সৃষ্টিতে : নাম উচ্চারিতে : প্রথমে তোমার নাম।
তোমার কৃপায় : অনায়াসে পায় : ধর্ম্ম অর্থ মোক্ষ কাম।।
উর মহামায়া : দেহ পদচ্ছায়া : ভারতের স্তুতি লয়ে।
কৃষ্ণচন্দ্রবাসে : থাক সদা হাসে : রাজলক্ষ্মী স্থিরা হয়ে।।
০৭. সরস্বতী বন্দনা
উর দেবী সরস্বতী : স্তবে কর অনুমতি : বাগীশ্বরি বাক্যবিনোদিনী।
শ্বেতবর্ণ শ্বেতবাস : শ্বেত বীণা শ্বেত হাস : শ্বেতসরসিজনিবাসিনী।।
বেদ বিদ্যা তন্ত্র মন্ত্র : বেণু বীণা আদি যন্ত্র : নৃত্য গীত বাদ্যের ঈশ্বরী।
গন্ধর্ব্ব অপ্সরাগণ : সেবা করে অনুক্ষণ : ঋষি মুনি কিন্নরকিন্নরী।।
আগমের নানা গ্রন্থ :আর যত গুণপন্থ :চারিবেদ আঠার পুরাণ।
ব্যাস-বাল্মীকাদি যত : কবি সেবে অবিরত : তুমি দেবী প্রকৃতি প্রধান।।
ছত্রিশ রাগিনী মেলে : ছয় রাগ সদা খেলে : অনুরাগ সে সব রাগিণী।
সপ্ত স্বর তিন গ্রাম : মূর্চ্ছনা একুশ নাম : শ্রুতিকলা সতত সঙ্গিনী।।
তান মান বাদ্য ভাল : নৃত্যগীত ক্রিয়া কাল : তোমা হৈতে সকল নির্ণয়।
যে আছে ভুবন তিনে : তোমার করুণা বিনে : কাহার শকতি কথা কয়।।
তুমি নাহি চাহ যারে : সবে মূঢ় বলে তারে : ধিক্ ধিক্ তাহার জীবন।
তোমার করুণা যারে : সবে ধন্য বলে তারে : গুণিগণে তাহার গণন।।
দয়া কর মহামায়া : দেহ মোরে পদচ্ছায়া : পূর্ণ কর নূতন মঙ্গল।
আসরে আসিয়া উর : নায়কের আশা পূর : দূর কর অজ্ঞান সকল।।
কৃষ্ণচন্দ্র নরপতি : গীতে দিলা অনুমতি : করিলাম আরম্ভ সহসা।
মনে বড় পাই ভয় : না জানি কেমন হয় : ভারতের ভারতী ভরসা।।
০৮. অন্নপূর্ণা বন্দনা
অন্নপূর্ণা মহামায়া : দেহ মোরে পদচ্ছায়া : কোটি কোটি করি যে প্রণাম।
আসরে আসিয়া উর : নায়কের আশা পূর : শুন আপনার গুণগ্রাম।।
কৃপাবলোকন কর : ভক্তের দুরিত হর : দারিদ্র্যদুর্গতি কর চূর্ণ।
তুমি দেবী পরাৎপরা : সুখদাত্রী দুঃখহরা : অন্নপূর্ণা অন্নে কর পূর্ণ।।
রক্তসরসিজোপরি : বসি পদ্মাসন করি : পদতলে নব রবি দেখা।
রক্তজবাপ্রভা হর : অতি মনোহরতর : ধ্বজব্রজাঙ্কুশ ঊর্দ্ধরেখা।।
কিবা সুললিত উরু : কদলীকাণ্ডের গুরু : নিরুপম নিতম্বে কিঙ্কিণী।
শোভে নিরুপম বাস : দশদিক্ পরকাশ : ত্রিভুবনমোহনকারিণী।।
কটি অতি ক্ষীণতর : নাভি সুধাসরোবর : উচ্চ কুচ সুধার কলস।
কণ্ঠ কম্বুরাজ রাজে : নানা অলঙ্কার সাজে : প্রকাশে ভুবন চতুর্দ্দশ।।
কিবা মনোহর কর : মৃণালের গর্ব্বহর : অঙ্গুলি চম্পকচারুদল।
ফণিরাজ ফণামণি : কঙ্কণের কন্কনি : নানা অলঙ্কার ঝলমল।।
বাম করতলে ধরি : কারণঅমৃত ভরি : পানপাত্র রতননির্ম্মিত।
রত্নহাতা ডানি হাতে : সঘৃত পলান্ন তাতে : কিবা দুই ভুজ সুললিত।।
চর্ব্ব্য চষ্য লেহ্য পেয় : নানারস অপ্রমেয় : বিবিধ বিলাসে পরশিয়া।
ভুঞ্জাইয়া কৃত্তিবাস : মধুর মধুর হাস : মহেশের নাচন দেখিয়া।।
দেবতা অসুর রক্ষ : অপ্সর কিন্নর যক্ষ : সবে ভোগ করে নানা রস।
গন্ধর্ব্ব ভুজঙ্গ নর : সিদ্ধ সাধ্য বিদ্যাধর : নবগ্রহ দিক্পাল দশ।।
জিনি কোটি শশধর : কিবা মুখ মনোহর : মণিময় মুকুট মাথায়।
ললিত কবরীভার : তাহে মালতীর হার : ভ্রমর ভ্রমরী কল গায়।।
বিধি বিষ্ণু ত্রিলোচন : আদি দেব ঋষিগণ : চৌদিকে বেড়িয়া গান করে।
আগম পুরাণ বেদ : না জানে তোমার ভেদ : তুমি দেবী উরহ আসরে।।
ঘটে কর অধিষ্ঠান : শুন নিজ গুণগান : নায়কের পূর্ণ কর আশ।
রাজার মঙ্গল কর : রাজ্যের আপদ হর : গায়কের কণ্ঠে কর বাস।।
স্বপনে রজনীশেষে : বসিয়া শিয়রদেশে : কহিলা মঙ্গল রচিবারে।
সেই আজ্ঞা শিরে বহি : নূতন মঙ্গল কহি : পূর্ণ কর চাহিয়া আমারে।।
বিস্তার অন্নদাকল্পে : কত গুণ কব অল্পে : নিজগুণে হবে বরদায়।
নূতন মঙ্গল আশে : ভারত সরস ভাষে : রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আজ্ঞায়।।
০৯. গ্রন্থ সূচনা
অন্নপূর্ণা অন্নদা অষ্টভূজা। অভয়া অপরাজিতা অচ্যূতঅনুজা।।
অনাদতা অনন্তা অম্বা অম্বিকা অভয়া। অপরাধ ক্ষমো অগো অব গো অব্যয়া।।
শুন শুন নিবেদন সভাজন সব। যেরূপে প্রকাশ অন্নপূর্ণা মহোৎসব।।
সুজা খাঁ নবাব সুত সরেফরাজ খাঁ। দেওয়ান আলমচন্দ্র রায় রায়রাঁয়া।।
ছিল আলিবর্দ্দী খাঁ নবাব পাটনায়। আসিয়া করিল যুদ্ধ বধিলেক তায়।।
তদবধি আলিবর্দ্দী হইলা নবাব। মহাবদজঙ্গ দিলা বাদশা খেতাব।।
কটকে মুরসীদ্কুলী খাঁ নবাব ছিল। তারে গিয়া আলিবর্দ্দী খেদাইয়া দিল।।
কটকে হইল আলিবর্দ্দীর আমল। ভাইপো সৌলদজঙ্গে দিলেন দখল।।
নবাব সৌলদজঙ্গ রহিলা কটকে। মুরাদবাখর তারে ফেলিল ফাটকে।।
লুঠি নিল নারী গাড়ী দিল বেড়ী তোক। শুনি মহাবদজঙ্গ চলে পেয়ে শোক।।
উত্তরিল কটকে হইয়া ত্বরাপর। যুদ্ধে হারি পলাইল মুরাদবাখর।।
ভাইপো সৌলদজঙ্গে খালাস করিয়া। উড়িষ্যা করিল ছার লুটিয়া পুড়িয়া।।
বিস্তর লস্কর সঙ্গে অতিশয় জুম। আসিয়া ভুবনেশ্বর করিলেন ধূম।।
ভুবনে ভুবনেশ্বর মহেশের স্থান। দুর্গাসহ শিবের সর্ব্বদা অধিষ্ঠান।।
দুরাত্মা মোগল তারে দৌরাত্ম্য করিল। দেখিয়া নন্দীর মনে ক্রোধ উপজিল।।
মারিতে লইয়া হাতে প্রলয়ের শূল। করিতে যবন সব সমূলে নির্ম্মূল।।
নিষেধ করিল শিব ত্রিশূল মারিতে। বিস্তর হইবে নষ্ট একেরে বধিতে।।
অকালে প্রলয় হৈল কি কর কি কর। না ছাড় সংহারশূল সংহর সংহর।।
আছয়ে বর্গির রাজা গড় সেতারায়। আমার ভকত বড় স্বপ্ন কহ তায়।।
সেই আসি যবনেরে করিবে দমন। শুনি নন্দী তারে গিয়া করিল স্বপন।।
স্বপ্ন দেখি বর্গি রাজা হইল ক্রোধিত। পাঠাইয়া রঘুরাজ ভাস্কর পণ্ডিত।।
বর্গি মহারাষ্ট্র আর সৌরাষ্ট্র প্রভৃতি। আইল বিস্তর সৈন্য আকৃতি-বিকৃতি।।
লুটি বাঙ্গালার লোকে করিল কাঙ্গাল। গঙ্গা পার হইল বান্ধি নৌকার জাঙ্গাল।।
কাটিল বিস্তর লোক গ্রাম গ্রাম পুড়ি। লুটিয়া লইল ধন ঝিউড়ী বহুড়ী।।
পলাইয়া কোঠে গিয়া নবাব রহিল। কি কহিব বাঙ্গালার যে দশা হইল।।
লুটিয়া ভুবনেশ্বর যবন পাতকী। সেই পাপে তিন সুবা হইল নারকী।।
নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়। বিস্তর ধার্ম্মিক লোক থেকে গেল দায়।।
নদীয়া প্রভৃতি চরি সমাজের পতি। কৃষ্ণচন্দ্র মহারাজ শুদ্ধ শান্তমতি।।
প্রতাপতপনে কীর্ত্তিপদ্ম বিকাশিয়া। রাখিলেন রাজলক্ষ্মী অচল করিয়া।।
রাজা রাজচক্রবর্ত্তী ঋষি ঋষিরাজ। ইন্দ্রের সমাজ সম যাঁহার সমাজ।।
কাশীতে বান্ধিলা জ্ঞানবাপীর সোপান। উপমা কোথায় দিব না দেখি সমান।।
দেবীপুত্র বলি লোক যাঁর গুণ গায়। এই পাপে সেই রাজা ঠেকিলেন দায়।।
মহাবদজঙ্গ তারে ধরে লয়ে যায়। নজরানা বলে বার লক্ষ টাকা চায়।।
লিখি দিলা সেই রাজা দিব বার লক্ষ। সাজোয়াল হইল সুজন সর্ব্বভক্ষ।।
বর্গিতে লুটিল কত কত বা সুজন। নানা মতে রাজার প্রজার গেল ধন।।
বদ্ধ করি রাখিলেন মুরশিদাবাদে। কত শত্রু কত মতে লাগিল বিবাদে।।
দেবিপুত্র দয়াময় ধরাপতি ধীর। বিবিধ প্রকারে পূজা করিল দেবীর।।
চৌত্রিশ অক্ষরে বর্ণাইয়া কৈলা স্তব। অনুকম্পা শ্রবণে হইল অনুভব।।
অন্নপূর্ণা ভগবতী মুরতি ধরিয়া। স্বপন কহিল মাতা শিয়রে বসিয়া।।
শুন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র না করিহ ভয়। এই মূর্ত্তি পূজা কর দুঃখ হবে ক্ষয়।।
আমার মঙ্গলগীত করহ প্রকাশ। কয়ে দিলা পদ্ধতি গীতের ইতিহাস।।
চৈত্রমাসে শুক্লপক্ষে অষ্টমী নিশায়। করিহ আমার পূজা বিধি-ব্যবস্থায়।।
সভাসদ তোমার ভারতচন্দ্র রায়। মহাকবি মহাভক্ত আমার দয়ায়।।
তুমি তারে রায়গুণাকর নাম দিও। রচিতে আমার গীত সাদরে কহিও।।
আমি তারে স্বপ্ন কব তার মাতৃবেশে। অষ্টবাহ গীতের উপদেশ সবিশেষে।।
সেই আজ্ঞা মত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। অন্নপূর্ণা পূজা করি তরিল সে দায়।।
সেই আজ্ঞামত কবি রায়গুণাকর। অন্নদামঙ্গল কহে নবরসভর।।
১০. কৃষ্ণচন্দ্রের সভা বর্ণন
নিবেদন অবধান কর সভাজন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভার বিবরণ।।
চন্দ্রে সবে ষোল কলা হ্রাসবৃদ্ধি তায়। কৃষ্ণচন্দ্র পরিপূর্ণ চৌষট্টি কলায়।।
পদ্মিনী মুদয়ে আঁখি চন্দ্রেরে দেখিলে। কৃষ্ণচন্দ্রে দেখিতে পদ্মিনী আঁখি মেলে।।
চন্দ্রের হৃদয়ে কালী কলঙ্ক কেবল। কৃষ্ণচন্দ্র হৃদে কালী সর্ব্বদা উজ্জ্বল।।
দুই পক্ষ চন্দ্রের অসিত সিত হয়। কৃষ্ণচন্দ্রে দুই পক্ষ সদা জ্যোৎস্নাময়।।
প্রথম পক্ষেতে পাঁচ কুমার সুজন। পঞ্চদেহে পঞ্চমুখ হৈল পঞ্চানন।।
প্রথম সাক্ষাৎশিব শিবচন্দ্র রায়। দ্বিতীয় ভৈরবচন্দ্র ভৈরবের প্রায়।।
তৃতীয় সে হরচন্দ্র হর অবতার। চতুর্থ মহেশচন্দ্র মহেশ আকার।।
পঞ্চম ঈশানচন্দ্র তুল্য দিতে নাই। ফুলের মুখটী জয়গোপাল জামাই।।
দ্বিতীয় পক্ষের যুবরাজ রাজকায়। মধ্যম কুমার খ্যাত শম্ভুচন্দ্র রায়।।
জামাতা কুলীন রামগোপাল প্রথম। সদানন্দময় নন্দগোপাল মধ্যম।।
শ্রীগোপাল ছোট সবে ফুলের মুখটী। আদান প্রদানে খ্যাত ত্রিকুলে পালটী।।
রাজার ভগিনীপতি দুই গুণধাম। মুখটী অনন্তরাম চট্ট বলরাম।।
বলরাম চট্টসুত ভাগিনা রাজার। সদাশিব রায় নাম শিব অবতার।।
দ্বিতীয় অনন্তরাম মুখুর্য্যের সুত। রায় চন্দ্রশেখর অশেষ গুণযুত।।
ভূপতির ভাগিনীজামাই গুণধাম। বাঁড়ুরি গোকুল কৃপারাম দয়ারাম।।
মুখ কৃষ্ণজীবন কৃষ্ণভক্তের সার। পাঠকেন্দ্র গদাধর তর্ক অলঙ্কার।।
ভূপতির পিসা শ্যামসুন্দর চাটুতি। তার কৃষ্ণদেব রামকিশোর সন্ততি।।
ভূপতির পিসার জামাই তিনজন। কৃষ্ণানন্দ মুখুর্য্যা পরম যশোধন।।
মুখুর্য্যা আনন্দিরাম কুলের সাগর। মুখ রাজকিশোর কবিত্ব কলাধর।।
প্রিয়জ্ঞাতি জগন্নাথ রায়চাঁদ রায়। শুকদেব রায় ঋষি শুকদেব প্রায়।।
কালিদাস সিদ্ধান্ত পণ্ডিত সভাসদ্। কন্দর্প সিদ্ধান্ত আদি যত পারিষদ।।
কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় কুলীন প্রিয় বড়। মুক্তিরাম মুখর্য্যা গোবিন্দভক্ত দড়।।
গণক বাঁড়ুর্য্যা অনুকূল বাচস্পতি। আর যত গণক গণিতে কি শকতি।।
বৈদ্য মধ্যে প্রধান গোবিন্দরাম রায়। জগন্নাথ অনুজ নিবাস সুগন্ধ্যায়।।
অতিপ্রিয় পারিষদ শঙ্কর তরঙ্গ। হরষিত রামবোল সদা অঙ্গসঙ্গ।।
চক্রবর্ত্তী গোপাল দেয়ান সহবতি। রায় বক্সী নন্দগোপাল মহামতি।।
কিঙ্কর লাহিড়ী দ্বিজ মুনসী প্রধান। তার ভাই গোবিন্দ লাহিড়ী গুণবান্।।
কালোয়াত গায়ক বিশ্রাম খাঁ প্রভৃতি। মৃদঙ্গী সমজ খেল কিন্নর আকৃতি।।
নর্ত্তক প্রধান শেরমামুদ সভায়। মোহন ঘোষালচন্দ্র বিদ্যাধর প্রায়।।
ঘড়িয়াল কার্ত্তিক প্রভৃতি কতজন। চেলা খনেজাদ যত কে করে গণন।।
সেহাফির জমাদার মামুদ জাফর। জগন্নাথ শিরোপা করিলা যার পর।।
ভূপতির তীরের ওস্তাদ নিরুপম। মুজঃফর হোসেন মোগল কর্ণসম।।
হাজারি পঞ্চমসিংহ ইন্দ্রসেনসূত। ভগবন্ত সিংহ অতি যুদ্ধে মজবুত।।
যোগরাজ হাজারি প্রভৃতি আর যত। ভোজপুরে সোয়াল বেঁদেলা শত শত।।
কুল্লমালে রঘুনন্দন মিত্র দেয়ান। তার ভাই রামচন্দ্র রাঘব ধীমান।।
আমীন রাঢ়ীয় দ্বিজ নীলকণ্ঠ রায়। দুই পুত্র তাঁহার তাঁহার তুল্য কায়।।
বড় রামলোচন অশেষ গুণধাম। ছোট রামকৃষ্ণ রায় অভিনব কাম।।
দেয়ানের পেশকার বসু বিশ্বনাথ। আমীনের পেশকার কৃষ্ণসেন সাথ।।
রত্ন গজ আদি গজ দিগ্গজ সংখ্যায়। উচ্চৈঃশ্রবা উচ্চৈঃশ্রবা অশ্বের লেখায়।।
হাবসী ইমামবক্স হাবসী প্রধান। হাতী ঘোড়া উট আদি যাহার যোগান।।
অধিকার রাজার চৌরাশী পরগণা। খাড়ী যুড়ী আদি করি দপ্তরে গণনা।।
রাজ্যের উত্তর সীমা মুরশিদাবাদ। পশ্চিমের সীমা গঙ্গা ভাগীরথী খাদ।।
দক্ষিণের সীমা গঙ্গাসাগরের ধার। পূর্ব্বসীমা ধূল্যাপুর বড়গঙ্গা পার।।
ফরমানা মহারাজ মনসবদার। সাহেব নহবৎ আর কানুগোই তার।।
কোঠায় কাঙ্গুরা বড়ী নিশান নহবৎ। পাতসাহী শিরপা সুলতানী সুলতানৎ।।
ছত্রদণ্ড আড়ানী চামর মোরছল। শিরপেঁচ মোরছী কালগী নিরমল।।
দেবীপুত্র নামে রাজা বিদিত সংসারে। ধর্ম্মচন্দ্র নাম দিলা নবাব যাহারে।।
সেই রাজা এই অন্নপূর্ণার প্রতিমা। প্রকাশিয়া পূজা কৈল অনন্ত মহিমা।।
কবি রায়গুণাকর খ্যাতি নাম দিয়া। ভারতেরে আজ্ঞা দিলা গীতের লাগিয়া।।
অন্নপূর্ণা ভারতেরে রজনীর শেষে। স্বপনে কহিলা মাতা তার মাতৃবেশে।।
অরে বাছা ভারত শুনহ মোর বাণী। তোমার জননী আমি অন্নদা ভবানী।।
কৃষ্ণচন্দ্র অনুমতি দিলেন তোমারে। মোর ইচ্ছা গীতে তুমি তোষহ আমারে।।
ভারত কহিলা আমি নাহি জানি গীত। কেমনে রচিব গীত এ কি বিপরীত।।
অন্নদা কহিল বাছা না করিহ ভয়। আমার কৃপার বলে বোবা কথা কয়।।
গ্রন্থ আরম্ভিয়া মোর কৃপা সাক্ষী পাবে। যে কবে সে হবে গীত আনন্দে শিখাবে।।
এত বলি অমৃতান্ন মুখে তুলি দিলা। সেই বলে এই গীত ভারত রচিলা।।
১১. গীতারম্ভ
অন্নপূর্ণা মহামায়া : সংসার যাহার ছায়া : পরাৎপর পরম প্রকৃতি।
অনিবার্য্য নিরুপমা : আপনি আপন সমা : সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় আকৃতি।।
অচক্ষু সর্ব্বত্র চান : অকর্ণ শুনিতে পান : অপদ সর্ব্বত্র গতাগতি।
কর বিনা বিশ্ব গড়ি : মুখ বিনা বেদ পড়ি : সবে দেন সুমতি কুমতি।।
বিনা চন্দ্রানল রবি : প্রকাশি আপন ছবি : অন্ধকার প্রকাশ করিলা।
প্লাবিত কারণ জলে : বসি স্থল বিনা স্থলে : বিনা গর্ভে প্রসব হইলা।।
গুণ সত্ত্ব তমোরজে : হরি হর কমলজে : কহিলেন তপ তপ তপ।
শুনি বিধি হরি হর : তিন জনে পরস্পর : করেন কারণ জলে জপ।।
তিনের জানিতে সত্ত্ব : জানাইতে নিজ তত্ত্ব : শবরূপা হইলা কপটে।
পচাগন্ধ মাংস গলে : ভাসিয়া কারণ জলে : আগে গেলা বিষ্ণুর নিকটে।।
পচাগন্ধে ব্যস্ত হরি : উঠি গেলা ঘৃণা করি : বিধিরে ছলিতে গেলা মাতা।
পচাগন্ধে ভাবি দুখ : ফিরিয়া ফিরিয়া মুখ : চারি মুখ হইলা বিধাতা।।
বিধির বুঝিয়া সত্ত্ব : শিবের জানিতে তত্ত্ব : শিব অঙ্গে লাগিলা ভাসিয়া।
শিব জ্ঞানী ঘৃণা নাই : বসিতে হইল ঠাঁই : যত্নে ধরি বসিলা চাপিয়া।।
দেখিয়া শিবের কর্ম্ম : তাহাতে পশিলা মর্ম্ম : ভার্য্যারূপা ভবানী হইলা।
পতিরূপে পশুপতি : দুজনে সন্তুষ্ট অতি : ক্রমে সৃষ্টি সকল করিলা।।
বিধির মানসসুত : দক্ষমুনি তপোযুত : প্রসূতি তাঁহার ধর্ম্মজায়া।
তাঁর গর্ভে সতী নাম : অশেষ মঙ্গলধাম : জনম লভিলা মহামায়া।।
নারদ ঘটক হয়ে : নানা মত বলে কয়ে : শিবের বিবাহ দিলা সতী।
শিবের বিকট সাজ : দেখি দক্ষ মুনিরাজ : বামদেব হৈল বামমতি।।
সদা শিবনিন্দা করে : মহা ক্রোধ হৈলা হরে : সতী লয়ে গেলেন কৈলাসে।
দক্ষের বিধাতা বাম : না লয়ে শিবের নাম : সদা নিন্দা করে কটুভাষে।।
আরম্ভিয়া দেবযাগ : নিমন্ত্রিলা দেবভাগ : নিমন্ত্রণ না কৈলা শঙ্করে।
যাইতে দক্ষের বাস : সতীর হইল আশ : ভারত কহিছে করজোড়ে।।
১২. সতীর দক্ষালয়ে গমনোদ্যোগ
কালীরূপে কতশত পরাৎপরা গো।
অন্নদা ভুবনা বালা : মাতঙ্গী কমলা : দুর্গা উমা কাত্যায়নী বাণী সুরবালা গো।।
সুন্দরী ভৈরবী তারা : জগতে সারা : উন্মুখী বগলা ভীমা ধূমা ভীতিহরা গো।
রাধানাথের দুঃখ ভরা : নাশ গো সত্বরা : কালের কামিনী কালী করুণাসাগরা গো।।
নিবেদন শুনহ ঠাকুর পঞ্চানন। যজ্ঞ দেখিবারে যাব পিতার ভবন।।
শঙ্কর কহেন কটে যার ঘরে যাবে। নিমন্ত্রণ বিনা গিয়া অপমান পাবে।।
যজ্ঞ করিয়াছে দক্ষ শুন তার মর্ম্ম। আমারে না দিবে ভাগ এই তার কর্ম্ম।।
সতী কন মহাপ্রভু হেন না কহিবা। বাপঘরে কন্যা যাবে নিমন্ত্রণ কিবা।।
যত কন সতী শিব না দেন আদেশ। ক্রোধে সতী হৈলা কালী ভয়ঙ্কর বেশ।।
মুক্তকেশী মেঘবরণা দন্তুরা। শবারূঢ়া করকাঞ্চী শব কর্ণপুরা।।
গলিত রুধিরধারা মুণ্ডমালা গলে। গলিতরুধির মুণ্ড বাম করতলে।।
আর বাম করেতে কৃপাণ খরশাণ। দুই ভুজে দক্ষিণে অভয় বরদান।।
লোলজিহ্বা রক্তধারা মুখের দুপাশে। ত্রিনয়ন অর্দ্ধচন্দ্র ললাট বিলাসে।।
দেখি ভয়ে মহাদেব ফিরাইলা মুখ। তারা রূপ ধরি সতী হইলা সম্মুখ।।
নীলবরণা লোলজিহ্বা করালবদনা। সর্পবান্ধা ঊর্দ্ধ এক জটাবিভূষণা।।
অর্দ্ধচন্দ্র পাঁচখানি শোভিত কপাল। ত্রিনয়ন লম্বোদর পরা বাঘছাল।।
নীল পদ্ম খড়্গ কাতি সমুণ্ড খর্পর। চারি হাতে শোভে আরোহণ শিবোপর।।
দেখি ভয়ে পলাইতে চান পশুপতি। রাজরাজেশ্বরী হয়ে দেখা দিলা সতী।।
রক্তবর্ণা ত্রিনয়না ভালে সুধাকর। চারিহাতে শোভে পাশাঙ্কুশ ধনুঃশর।।
বিধি বিষ্ণু ঈশ্বর মহেশ রুদ্র পঞ্চ। পঞ্চপ্রেতনিরমিত বসিবার মঞ্চ।।
দেখিয়া শঙ্কর ভয়ে মুখ ফিরাইলা। হইয়া ভুবনেশ্বরী সতী দেখা দিলা।।
রক্তাবর্ণা সুভূষণা আসন অম্বুজ। পাশাঙ্কুশ বরাভয়ে শোভে চারি ভুজ।।
ত্রিনয়ন অর্দ্ধচন্দ্র ললাটে উজ্জ্বল। মণিময় নানা অলঙ্কার ঝলমল।।
দেখি ভয়ে মহাদেব গেলা এক ভিতে। ভৈরবী হইয়া সতী লাগিলা হাসিতে।।
রক্তবর্ণা চতুর্ভূজা কমলআসনা। মুণ্ডমালী গলে নানা ভূষণভূষণা।।
অক্ষমালা পুথি বরাভয় চারি কর। ত্রিনয়ন অর্দ্ধচন্দ্র ললাট উপর।।
দেখি ভয়ে বিশ্বনাথ হৈলা কম্পিত। ছিন্নমস্তা হৈলা সতী অতি বিপরীত।।
বিকশিত পুণ্ডরীক কর্ণিকার মাঝে। তিন গুণে ত্রিকোণমণ্ডল ভাল সাজে।।
বিপরীত রতে রত রতিকামোপরি। কোকনদ বরণা দ্বিভূজা দিগম্বরী।।
নাগযজ্ঞোপবীত মুণ্ডাস্থিমালা গলে। খড়্গে কাটি নিজমুণ্ড ধরি করতলে।।
কণ্ঠ হৈতে রুধির উঠিছে তিন ধার। একধারা নিজমুখে করেন আহার।।
দুই দিকে দুই সখী ডাকিনী বর্ণিনী। দুই ধারা পিয়ে তারা শবআরোহিণী।।
চন্দ্র সূর্য্য অনল শোভিত ত্রিনয়ন। অর্দ্ধচন্দ্র কপালফলকে সুশোভন।।
দেখি ভয়ে ত্রিলোচন মুদিলা লোচন। ধূমাবতী হয়ে সতী দিলা দরশন।।
অতি বৃদ্ধা বিধবা বাতাসে দোলে স্তন। কাকধ্বজরথারূঢ় ধূম্রের বরণ।।
বিস্তারবদনা কৃশ ক্ষুধায় আকুলা। এক হস্ত কম্পমান আর হস্তে কুলা।।
ধূমাবতী দেখে ভীম সভয় হৈলা। হইয়া বগলামুখী সতী দেখা দিলা।।
রত্নগৃহে রত্নসিংহাসনমধ্যস্থিতা। পীতবর্ণা পীতবস্ত্রাভরণ ভূষিতা।।
এক হস্তে এক অসুরের জিহ্বা ধরি। আর হস্তে মুদ্গর ধরিয়া উর্দ্ধ করি।।
চন্দ্র সূর্য অনল উজ্জ্বল ত্রিনয়ন। ললাটমণ্ডলে চন্দ্রখণ্ড সুশোভন।।
দেখি ভয়ে ভোলানাথ যান পলাইয়া। পথ আগুলিলা সতী মাতঙ্গী হইয়া।।
রক্তপদ্মাসনা শ্যামা রক্তবস্ত্র পরি। চতুর্ভূজা খড়্গ চর্ম পাশাঙ্কুশ ধরি।।
ত্রিলোচনা অর্দ্ধচন্দ্র কপালফলকে। চমকিত বিশ্ব বিশ্বনাথের চমকে।।
মহাভয়ে মহাদেব হৈলা কম্পমান। মহালক্ষ্মীরূপে সতী কৈলা অধিষ্ঠান।।
সুবর্ণ সুবর্ণ বর্ণ আসন অম্বুজ। দুই পদ্ম বরাভয়ে শোভি চারি ভূজ।।
চতুর্দন্ত চারি শ্বেত বারণ হরিষে। রত্নঘটে অভিষেকে অমৃত বরিষে।।
ভারত কহিছে মাগো এই দশ রূপে। দশ দিকে রক্ষা কর কৃষ্ণচন্দ্র ভূপে।।
১৩. সতীর দক্ষালয়ে গমন
এ কি মায়া এ কি মায়া কর মহামায়া। সংসারে যে কিছু দেখি তব মায়াচ্ছায়া।।
নিগম আগমে তুমি নিরুপমকায়া। ত্রিগুণ-জননী পুনঃ ত্রিদেবের জায়া।।
ইহলোকে পরলোকে তুমি যে সহায়া। ভারত কহিছে মোরে দেহ পদচ্ছায়া।।
পলাইতে না পেয়ে ফাপর হৈলা হর। কহিতে লাগিলা কম্পমান কলেবর।।
তোমরা কে মোরে কহ পাইয়াছি ভয়। কোথা গেল মোর সতী বলহ নিশ্চয়।।
কালীমূর্ত্তি কহিতে লাগিলা মহাদেবে। পূর্ব্ব সর্ব্ব জান কেন পাসরিলা এবে।।
পরমা প্রকৃতি আমি ভেবে দেখ মনে। প্রসবিনু তুমি বিষ্ণু বিধি তিন জনে।।
তিন জনে তোমরা কারণজলে ছিলা। তপ তপ তপ বাক্য কহিনু শুনিলা।।
তিনজনে পরস্পরে লাগিলা জপিতে। শবরূপে আইলাম ভাসিতে ভাসিতে।।
পচাগন্ধে উঠি গেলা বিষ্ণু ভাবি দুখ। বিধি হৈলা চতুর্মুখ ফিরি ফিরি মুখ।।
তুমি ঘৃণা না করিয়া করিলা আসন। প্রকৃতি রূপেতে তোমা করিনু ভজন।।
পুরুষ হইলে তুমি আমার ভজনে। সেই আমি সেই তুমি ভেবে দেখ মনে।।
এত শুনি শিবের হৈল চমৎকার। প্রকাশ করিলা তন্ত্র মন্ত্র সবাকার।।
লুকাইয়া দশ মূর্ত্তি সতী হৈলা সতী। গৌরবর্ণ ছাড়ি হৈলা কালীর মূরতি।।
মোহিত মহেশ মহামায়ার মায়ায়। যে ইচ্ছা করহ বলি দিলেন বিদায়।।
রথ আনি দিতে তবে কহিবা নন্দীরে। রথে চড়ি গেলা সতী দক্ষের মন্দিরে।।
প্রসূতি সতীরে দেখি কালীর বরণ। কহিলা দেখিয়াছিলা স্বপন যেমন।।
আহা মরি বাছা সতী কালী হইয়াছ। ছাড়িবে আমারে বুঝি মনে করিয়াছ।।
স্বপনে দেখেছি দক্ষ শিবেরে নিন্দিবে। শিবনিন্দা শুনি তুমি শরীর ছাড়িবে।।
শিব করিবেন দক্ষে যজ্ঞ সহ নাশ। তোমা দেখে স্বপ্নে মোর হইল বিশ্বাস।।
জগন্মাতা হয়ে মাতা বলেছ আমায়। জন্মশোধ খাও কিছু চাহিয়া আমায়।।
মার বাক্যে মাতা কিছু আহার করিয়া। যজ্ঞ দেখিবারে গেল সত্ত্বর হইয়া।।
কৃষ্ণবর্ণা দেখি সতী দক্ষ কোপে জ্বলে। শিবনিন্দা করিয়া সভায় আগে বলে।।
ভারত শিবের নিন্দা কেমনে বর্ণিবে। নিন্দাচ্ছলে স্তুতি করি শঙ্কর বুঝিবে।।
১৪. শিবনিন্দায় সতীর দেহত্যাগ
সভাজন শুন : জামাতার গুণ : বয়সে বাপের বড়।
কোন গুণ নাই : যেথা সেথা ঠাঁই : সিদ্ধিতে নিপূণ দড়।।
মান অপমান : সুস্থান কুস্থান : অজ্ঞান জ্ঞান সমান।
নাহি জানে ধর্ম্ম : নাহি মানে কর্ম্ম : চন্দনে ভস্ম জ্ঞেয়ান।।
যবনে ব্রাহ্মণে : কুক্কুরে আপনে : শ্মশানে সরগে সম।
গরল খাইল : তবু না মরিল : ভাঙ্গড়ের নাহি যম।।
সুখে দুঃখ জানে : দুঃখে সুখ মানে : পরলোকে নাহি ভয়।
কি জাতি কে জানে : কারে নাহি মানে : সদা কদাচারময়।।
কহিতে ব্রাহ্মণ : কি আছে লক্ষণ : বেদাচারবহিষ্কৃত।
ক্ষত্রিয় কখন : না হয় ঘটন : জটা ভস্ম আদি ধৃত।।
যদি বৈশ্য হয় : চাষী কেন নয় : নাহি কোন ব্যবসায়।
শূদ্র বলে কেবা : দ্বিজ দেয় সেবা : নাগের পৈতা গলায়।।
গৃহী বলা দায় : ভিক্ষা মাগি খায় : না করে অতিথি সেবা।
সতী ঝি আমার : গৃহিণী তাহার : সন্ন্যাসী বলিবে কেবা।।
বনস্থ বলিতে : নাহি লয় চিতে : কৈলাস নামেতে ঘর।
ডাকিনীবিহারী : নহে ব্রহ্মচারী : এ কি মহাপাপ হর।।
সতী ঝি আমার : বিদ্যুৎ আকার : বাতুলের হৈল জায়া।
আমি অভাজন : পরম ভাজন : ঘটক নারদ ভায়া।।
আহা মরি সতী : কি দেখি দুর্গতি : অন্ন বিনা হৈলা কালী।
তোমার কপাল : পর বাঘছাল : আমার রহিল গালি।।
শিবনিন্দা শুনি : রোষে যত মুনি : দধীচি অগ্যস্ত আদি।
দক্ষে গালি দিয়া : চলিলা উঠিয়া : শ্রবণে কর আচ্ছাদি।।
তবু পাপ দক্ষ : নিন্দি কত লক্ষ : সতী সম্বোধিয়া কহে।
তার মৃত্যু নাই : তোর নাহি ঠাঁই : আমার মরণ নহে।।
মোর কন্যা হয়ে : প্রেতসঙ্গে রয়ে : ছি ছি এ কি দশা তোর।
আমি মহারাজ : তোর এই সাজ : মাথা খেতে আলি মোর।।
বিধবা যখন : হইবি তখন : অন্নবস্ত্র তোরে দিব।
সে পাপ থাকিতে : নারিব রাখিতে : তার মুখ না দেখিব।।
শিবনিন্দা শুনি : মহাদুঃখ গণি : কহিতে লাগিল সতী।
শিবনিন্দা কর : কি শকতি ধর : কেন বাপা হেন মতি।।
যারে কালে ধরে : সেই নিন্দে হরে : কি কহিব তুমি বাপ।
তব অঙ্গজনু : ত্যজিব এ তনু : তবে যাবে মোর পাপ।।
তিনি মৃত্যুঞ্জয় : গালিতে কি হয় : মোরে যেতে আছে ঠাঁই।
কর্ম্মমত ফল : যজ্ঞ যাবে তল : তোর রক্ষা আর নাই।।
যে মুখ পামর : নিন্দিলে শঙ্কর : সে মুখ হবে ছাগল।
এতেক কহিয়া : শরীর ছাড়িয়া : উত্তরিলা হিমাচল।।
হিমগিরিপতি : ভাগ্যবান্ অতি : মেনকা তাঁহার জায়া।
পূর্ব্বতপোবলে : তাঁহার উদরে জনমিলা মহামায়া।।
সতী দেহত্যাগে : নন্দী মহারাগে : সত্বরে গেল কৈলাসে।
শূন্যরথ লয়ে : শোকাকুল হয়ে : নিবেদিলা কৃত্তিবাসে।।
শুনিয়া শঙ্কর : শোকেতে কাতর : বিস্তর কৈলা রোদন।
লয়ে নিজগণ : করিলা গমন : করিতে দক্ষে দমন।।
কৃষ্ণচন্দ্র রায় : রাজা ইন্দ্রপ্রায় : অশেষ গুণসাগর।
তাঁর অভিমত : রচিল ভারত : কবি রায় গুণাকর।।
১৫. শিবের দক্ষালয়ে যাত্রা
মহারুদ্ররূপে মহাদেব সাজে। ভভম্ভম ভভম্বম শিঙ্গা ঘোর বাজে।।
লটাপট জটাজুট সংঘট্ট গঙ্গা। ছলচ্ছল টলট্টল কলক্কল তরঙ্গা।।
ফণাফণ্ ফণাফণ্ ফণিফণ্ণ গাজে। দিনেশপ্রতাপে নিশানাথ সাজে।।
ধক্ধ্ধক্ ধক্ধ্ধক্ জ্বলে বহ্নি ভালে। ববম্বম্ ববম্বম্ মহাশব্দ গালে।।
দলমল দলমল গলে মুণ্ডমালা। কটি কট্ট সদ্যোমরা হস্তিছালা।।
পচা চর্ম্মঝুলি করে লোল ঝুলে। মহাঘোর আভা পিনাকে ত্রিশূলে।।
ধিয়া তাধিয়া তাধিয়া ভূত নাচে। উলঙ্গী উলঙ্গে পিশাচী পিশাচে।।
সহস্র সহস্র চলে ভূত দানা। হুহুঙ্কারে হাঁকে উড়ে সর্পবীণা।।
চলে ভৈরব ভৈরবী নন্দী ভৃঙ্গী। মহাকাল বেতাল তাল ত্রিশৃঙ্গী।।
চলে ডাকিনী যোগিনী ঘোর বেশে। চলে শাঁকিনী প্রেতিনী মুক্তকেশে।।
গিয়া দক্ষযজ্ঞে সবে যজ্ঞ নাশে। কথা না সরে দক্ষরাজে তরাসে।।
অদূরে মহারুদ্র ডাকে গভীরে। অরে রে অরে দক্ষ দে রে সতীরে।।
ভুজঙ্গপ্রয়াতে কহে ভারতী দে। সতী দে সতী দে সতী দে সতী দে।।