এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না – নবারুণ ভট্টাচার্য এর লেখা একটি জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না কাব্যগ্রন্থটি নবারুণ ভট্টাচার্যের লেখা প্রথম কবিতার বই যাহা ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয়।
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না বইয়ের বিবরণঃ
- বইয়ের নামঃ এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
- লেখকের নামঃ নবারুণ ভট্টাচার্য
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
- প্রকাশিতঃ ১৯৮২
আমাকে দেখা যাক বা না যাক
কে আমার হৃদ্পিণ্ডের ওপরে মাথা রেখে ঘুমোয়
কে আমাকে দুধ ও ভাতের গন্ধ দিয়ে আড়াল করে
কে আমার মাটি যেখানে আমি বৃষ্টির মতো শুষে যাই
আমি যখন দূষিত আকাশে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে উড়ি
আমার পালকে ছাই জমে জমে ধূসর হয়ে যায়
তখন আমার সামনে সবুজ গাছ হয়ে ওঠে কে
কে আমাকে চোখের পাতা বন্ধ করে আড়াল করে
কে আমাকে আগুন দিয়ে মশালের মতো জ্বালায়
কে আমার পৃথিবী যার ভেতরে আমি লাভার মতো
ফুটতে থাকি
আমি যখন পথ থেকে গলিতে তাড়া খেতে খেতে দৌড়ই
আমার পায়ের তলায় হাইওয়ে, আলপথ সব ফুরিয়ে যায়
তখন আমার সামনে আশ্রয় হয়ে ওঠে কে
এইসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে
আমার ওপরে অনেক অত্যাচার করতে হবে
এত অত্যাচার করার ক্ষমতা, দুর্ভাগ্যবশত,
কোনো শোষক, নিপীড়ক বা রাষ্ট্রমেশিন এখনও জানে না
যখন জানবে
তখন আমার প্রশ্নের সংখ্যাও অনেক বেড়ে যাবে
আমি প্রশ্নগুলোকে ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগোতেই থাকব
আমাকে দেখা যাক বা না যাক
প্রশ্নগুলো ফেটে অনেক সপ্তর্ষিমণ্ডল আকাশে দেখা যাবে।
আমার একটা মোটরগাড়ি চাই । নবারুণ ভট্টাচার্য
তিরিশ হাজার লোক ভাসছে
নোনা জলের ধাক্কায় তাদের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে
সেই জন্যে আমার একটা মোটরগাড়ি চাই।
লোড শেডিং-এ গলে যাচ্ছে বরফ রেফ্রিজারেটরে
মর্গের মধ্যে মড়ার চারপাশে বরফ গলছে
সবুজ টিকটিকির মতো সতর্ক থাকুন
বসন্ত আসছে
কিন্তু আমার একটা মোটরগাড়ি চাই।
পাখা বন্ধ করে দিয়েছি অসাড় নভেম্বরে
উইণ্টার প্যালেস এসে দখল করছে আমাকে
বেড়ে যাচ্ছে কোলেসটেরল, বমন, বুলেটের বরাদ্দ
মোমবাতি না থাকলে একটা হরিজনকে ধরে
জ্বালিয়ে দাও
তবুও আমার একটা মোটরগাড়ি চাই।
রেশমী সূর্যের প্যারাসুটে ঝুলে
একদিন ঈশ্বর নেমে আসবেন কলকাতায়
আমার, আমার বৌয়ের, আমার বাচ্চার মাথায়
এবং আরও যত হেঁটমুণ্ডু—ছিন্ন বা বিচ্ছিন্ন
সবের ওপরে ঝরবে ক্ষমার পারমাণবিক ভস্ম
ভাই, আমার একটা মোটরগাড়ি চাই।
কমরেড, আমার একটা মোটরগাড়ি চাই
সার, আমার একটা মোটরগাড়ি চাই
ঝকঝকে, রঙচঙে, ফাটাফাটি একটা মোটরগাড়ি।
এই মোটরগাড়ির চাকার তলাতেই
ঘিলু আর রক্ত ছিটিয়ে
অপেক্ষা করছে আমার নিয়তি ।
আমার খবর
আমি সেই মানুষ
যার কাঁধের ওপর সূর্য ডুবে যাবে।
বুকের বোতামগুলো নেই বহুরাত
কলারটা তোলা ধুলো ফ্যা ফ্যা আস্তিন
হাওয়াতে চুল উড়িয়ে
পকেট থেকে আধখানা সিগারেট
বার করে বলব
দাদা একটু ম্যাচিসটা দেবেন?
লোকটা যদি বেশি ভদ্র হয়
সিগারেট হাতে রেখে
এগিয়ে দেবে দেশলাই
আর আমি তার হাতঘড়িটার
দিকে তাকাব, চোখে জ্বলে উঠবে রেডিয়াম
ম্যায়নে তুঝসে মহববত করকে সনম—লেন দেন
খবরের কাগজ নয়
পুলিশের খাতায় আমার
দুটো ছবি থাকবে—একটা হাসিমুখ, একটা সাইড ফেস
তার নিচে লেখা ম্যাচ কেস
পেট ভরে পেট্রোল খেয়ে
হল্লা গাড়ি ছুটবে আমার খোঁজে
হেঁটমুণ্ডু শহর আমাকে খুঁজবে
আমি সেই মানুষ
বুকের বোতামগুলো নেই বহু রাত
যার কাঁধের ওপর সূর্য ডুবে যাবে।
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি–
যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি–
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী
প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না
আমি তাকে ঘৃণা করি–
আটজন মৃতদেহ
চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে
আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি
আট জোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে
আমি চিৎকার করে উঠি
আমাকে তারা ডাকছে অবেলায় উদ্যানে সকল সময়
আমি উন্মাদ হয়ে যাব
আত্মহ্ত্যা করব
যা ইচ্ছা চায় তাই করব।
ইস্তেহারে দেয়ালে স্টেন্সিলে কবিতা এখনই লেখার সময়
নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে কোলাজ পদ্ধতিতে
এখনই কবিতা লেখা যায়
তীব্রতম যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন মুখে
সন্ত্রাসের মুখোমুখি–ভ্যানের হেডলাইটের ঝলসানো আলোয়
স্থির দৃষ্টি রেখে
এখনই কবিতা ছুঁড়ে দেওয়া যায়
‘৩৮ ও আরো যা যা আছে হত্যাকারীর কাছে
সব অস্বীকার করে এখনই কবিতা পড়া যায়
লক্-আপের পাথর হিম কক্ষে
ময়না তদন্তের হ্যাজাক আলোক কাঁপিয়ে দিয়ে
হত্যাকারীর পরিচালিত বিচারালয়ে
মিথ্যা অশিক্ষার বিদ্যায়তনে
শোষণ ও ত্রাসের রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে
সামরিক-অসামরিক কর্তৃপক্ষের বুকে
কবিতার প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হোক
বাংলাদেশের কবিরাও
লোরকার মতো প্রস্তুত থাকুক
হত্যার শ্বাসরোধের লাশ নিখোঁজ হওয়ার
স্টেনগানের গুলিতে সেলাই হয়ে যাবার জন্য প্রস্তত থাকুক
তবু, কবিতার গ্রামাঞ্চল দিয়ে কবিতার শহরকে ঘিরে ফেলবার
একান্ত দরকার
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না
আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব
বুকের মধ্যে টেনে নেব কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল ও ভাসান
সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকি না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম্
অগণিত হৃদয় শস্য, রূপকথা ফুল নারী নদী
প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেব ইচ্ছেমতো
ডেকে নেব টলমলে হাওয়া রৌদ্রের ছায়ায় মাছের চোখের মত দীঘি
ভালোবাসা–যার থেকে আলোকবর্ষ দুরে জন্মাবধি অচ্ছুৎ হয়ে আছি–
তাকেও ডেকে নেব কাছে বিপ্লবের উৎসবের দিন।
হাজার ওয়াট্ আলো চোখে ফেলে রাত্রিদিন ইনটারোগেশন
মানি না
নখের মধ্যে সূঁচ বরফের চাঙড়ে শুইয়ে রাখা
মানি না
পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা যতক্ষণ রক্ত ঝরে নাক দিয়ে
মানি না
ঠোঁটের ওপরে বুট জ্বলন্ত শলাকায় সারা গায় ক্ষত
মানি না
ধারালো চাবুক দিয়ে খণ্ড খণ্ড রক্তাক্ত পিঠে সহসা আ্যালকোহল্
মানি না
নগ্নদেহে ইলেকট্রিক শক কুৎসিৎ বিক্রত যৌন অত্যাচার
মানি না
পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা খুলির সঙ্গে রিভলবার ঠেঁকিয়ে গুলি
মানি না
কবিতা কোন বাধাকে স্বীকার করে না।
কবিতা সশস্ত্র কবিতা স্বাধীন কবিতা নির্ভিক।
চেয়ে দেখো মায়াকোভ্স্কি হিক্মেত্ নেরুদা আরাগঁ এলুয়ার
তোমাদের কবিতাকে আমরা হেরে যেতে দিইনি
বরং সারাটা দেশ জুড়ে নতুন একটা মহাকাব্য লেখবার চেষ্টা চলছে
গেরিলা ছন্দে রচিত হতে চলেছে সকল অলংকার
গর্জে উঠুক দল মাদল
প্রবাল দ্বীপের মত আদিবাসী গ্রাম
রক্তে লাল নীলক্ষেত
শঙ্খচূড়ের বিষ-ফেনা মুখে আহত তিতাস
বিষাক্ত মৃত্যুসিক্ত তৃষ্ণায় কুচিলা
টণ্কারের সূর্য অন্ধ উৎক্ষিপ্ত গাণ্ডীবের ছিলা
তীক্ষ্ম তীর হিংস্রতম ফলা–
ভাল্লা তোমার টাঙ্গি পাশ
ঝলকে ঝলকে বল্লম চর দখলের সড়কি বর্শা
মাদলের তালে তালে রক্তচক্ষু ট্রাইবাল টোটেম
বন্দুক কুরকি দা ও রাশি রাশি সাহস
এত সাহস যে আর ভয় করে না
আরো আছে ক্রেন্ দাঁতালো বুলডজার বনভয়ের মিছিল
চলামান ডাইনামো টারবাইন লেদ্ ও ইনজিন
ধ্বস-নামা কয়লার মিথেন অন্ধকারে কঠিন হীরার মতো চোখ
আশ্চর্য ইস্পাতের হাতুড়ি
ডক জুটমিল ফার্ণেসের আকাশে উত্তোলিত সহস্র হাত
না ভয় করে না
ভয়ের ফ্যাকাশে মুখ কেমন অচেনা লাগে
যখন জানি মৃত্যু ভালোবাসা ছাড়া কিছু নয়।
আমাকে হ্ত্যা করলে
বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে যাব
আমার বিনাশ নেই–
বছর বছর মাটির মধ্য হতে সবুজ আশ্বাস হয়ে ফিরে আসব
আমার বিনাশ নেই-
সুখে থাকব, দুঃখে থাকব সন্তান-জন্মে সৎকারে
বাংলা দেশ যতদিন থাকবে ততদিন
মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন
যে-মৃত্যু রাত্রির শীতের জ্বলন্ত বুদ্বুদ্ হয়ে উঠে যায়
সেই দিন সেই যুদ্ধ সেই মৃত্যু আনো
সেভেন্থ ফ্লিটকে রুখে দিক সপ্তডিঙ্গা মধুকর
শিঙ্গা ও শঙ্খে যুদ্ধারম্ভ ঘোষিত হয়ে যাক
রক্তের গন্ধ নিয়ে বাতাস যখন মাতাল
জ্বলে উঠুক কবিতা বিস্ফোরক বারুদের মাটি—
আলপনা গ্রাম নৌকা নগর মন্দির
যখন তরাই থেকে সুন্দরবনের সীমা
সারারাত্রি কান্নার পর শুষ্ক দাহ্য হয়ে আছে
যখন জন্মভূমির মাটি ও বধ্যভূমির কাদা এক হয়ে গেছে
তখন আর দ্বিধা কেন
সংশয় কিসের
ত্রাস কি
আটজন স্পর্শ করছে
গ্রহণের অন্ধকারে ফিস্ফিস্ করে বলছে কোথায় কখন প্রহরা
তাদের কণ্ঠে অযুত তারকাপুঞ্জ ছায়াপথ সমুদ্র
গ্রহ থেকে গ্রহে ভেসে বেড়াবার উত্তরাধিকার—
কবিতার জ্বলন্ত মশাল
কবিতার মলোটভ ককটেল
কবিতার টলউইন্ অগ্নিশিখা
এই আগুনের আকাঙ্ক্ষাতে আছড়ে পড়ুক।
একটা ফুলকির জন্যে
একটা কথায় ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে পড়বে কবে
সারা শহর উথাল পাথাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে
কাটবে চিবুক চিড় খাবে বুক
লাগাম কেড়ে ছুটবে নাটক
শুকনো কুয়োয় ঝাঁপ দেবে সুখ
জেলখানাতে স্বপ্ন আটক
একটা ব্যথা বর্শা হয়ে মৌচাকেতে বিঁধবে কবে
ছিঁড়বে মুখোশ আগ্নেয় রোষ
জুলবে আগুন পুতুল নাচে
ভাঙবে গরাদ তীব্র সাহস
অনেক ছবি টুকরো কাচে
একটা কুঁড়ি বারুদগন্ধে মাতাল করে ফুটবে কবে
সারা শহর উথাল পাথাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।
একটি অসাধারণ কবিতা
আমার ভালোবাসায় যে নিজেকে উৎসর্গ করেছিল
সেই মেয়েটি এখন আত্মহত্যা করছে।
নীল ও বিন্দু বিন্দু আমার কপালে ঘাম
তার কাছে আমি গভীর সার্থকতা ছিলাম
আমার তরফে কিছু প্রবঞ্চ নাও বুঝি ছিল
অথবা সে কোনোদিনও সমুদ্র দেখেনি।
সে এখন আত্মহত্যা করছে
তার আঙুল, লুকোনো নরম রক্ত, সাদা গলা
এখনও বেঁচে আছে
শুধু তার চোখের পলক পড়ছে না।
স্থির সম্মতির মতো অপলক আয়নায়
সে এখনও বেঁচে আছে
কোনোদিনও সমুদ্র দেখেনি।
আমাদের একইসঙ্গে সমুদ্রে যাওয়ার কথা ছিল
সে এখনও বেঁচে আছে
এখনও হয়তো যাওয়া যায়
নীল ও তুষারকণা আমার কপালে ঘাম।
এখনও তাকে সারারাত্রি চুমু খাওয়া যায়
এমনকী মৃত্যুর পরেও তাকে সারারাত চুমু খাওয়া যায়
ঘুমন্ত তাকে এত সুন্দর দেখাত
আরও গভীর ঘুমে সৌন্দর্য আরও জন্ম নেয়
কিন্তু সে এখনও বেঁচে আছে
শুধু তার চোখের পলক পড়ছে না।
তার আঙুল কঁপিছে দ্বিধায় ও বিভিন্ন কোণে বসানো পাথরে
নরম রক্ত নিভে যাচ্ছে ভয়ে
সাদা গলার মধ্যে স্বচ্ছ বাতাস ও রাত্রি
আমি এই ঢেউ ও ঝড়ের বিপদসঙ্কেতের কাছে কিছু না
এত ফেনা আর গভীর অন্ধকার প্রবালদ্বীপের মধ্যে
সামুদ্রিক অশ্বের হ্রেষায়
আমার নিজের ঠোঁট নিজেরই অচেনা।
অতল সার্থকতা ছিলাম
মৃত্যু, মরে যাওয়া, মরণের মতো
নীল ও বিন্দু বিন্দু আমার কপালে মুহূর্ত।
আমার ভালোবাসায় যে নিজেকে উৎসর্গ করেছিল
সেই মেয়েটি এখন আত্মহত্যা করছে।
কবির ঔদ্ধত্য
গাঢ় আঁধার দুমড়ে ভেঙে কোথায় চলেছিস
আগুন খেতে যাচ্ছি আমি, তোদের বাবার কী
এই দেশেতে কবির জন্ম দগ্ধ অভিশাপ
মাকড়কূলে সিংহ হেন, ভস্মে ঢালার ঘি।
যাবজ্জীবন হেলায় থাকি, প্রসাদ করে তুচ্ছ
জিভের ওপর গনগনে আঁচ কয়লা রেখে দি
মূষিক কবি, শৃগাল কবি ওড়ায় ন্যাড়া পুচ্ছ
আগুন ক্ষেতের শস্য দেহ ভস্মে সঁপে দি।
প্রতিষ্ঠানের প্রসাদ বিষ্ঠা হেলায় ঠেলে ফেলে
কবি থাকেন কাঠের চিতায় এমন আঁকি পট
অবহেলায় অবোধ এবং খেলায় এলেবেলে
কবির চিতায় পাপতরাসী গাথে তাহার মঠ।
ঘেন্না করি অবজ্ঞাতে বুটের পেরেক, চামড়া
আগুন হতে গেছেন তিনি, স্বর্ণপ্রভ কাঠ
ঘেন্না করি রাতবিরেতে আছেন যেমন—আমরা
দুস্থ ইতর ভাষাবিহীন নগ্ন এ তল্লাট
গণ্ডি ভেঙে আগুন মেঙে কোথায় চলেছিস
যেথায় খুশি যাচ্ছি আমি, তোদের বাবার কী
এই দেশেতে কবির জন্ম দগ্ধ অভিশাপ
বেশ্যাকূলে সীতার সামিল, ভস্মে ঢালার ঘি।
কলকাতা
নিয়নের বেশ্যাদের ফসফোরাস ছায়ার মধ্যে
আশ্চর্য ক্রেন ছিঁড়ে খাচ্ছে শহরের শিরা-উপশিরা
গল গল করে বয়ে যাচ্ছে, জমে থাকছে শহরের রক্ত
অলৌকিক ভিক্ষাপাত্রের মতো চাঁদ
দাঁতে কামড়ে ছুটে যাচ্ছের রাতের কুকুর
আমি একটা ফাঁকা এম্বুলেন্স পাক খাচ্ছি উদ্ভট শহরে
আমার জন্যে সবুজ চোখ জ্বলো ভাগ্য বা নিয়তি
যাকে আমি নিয়ে যাব তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না
সারা দেহ হা করে দিয়েছে স্ট্যাবকেস
সাদা সাদা অজ্ঞান মোহিনী নাসের মতো বাড়ি
এই অসুস্থ শহরের প্রত্যেকটা ম্যানহোলে অন্ধকারে
ঝলসে উঠছে ছুরি
আমার সাহসের মাংস ফালি ফালি করে দেবে বলে
আমাকে হুকের থেকে ছাল ছাড়িয়ে টাঙিয়ে দেবে মহাবিশ্বে
গলাকাটা অবস্থায়
আমিও শান দিয়ে নিয়েছি আমার দুধৰ্দাত ও বাঘনখে
ভীষণ রোখ আমার এই রহস্যের ভাগ আমাকে দিতে হবে
সব ভাগাভাগির শেষে আমাকে থাকতে হবে ফাঁকা ঘরে
আমাকে আঁকড়ে থাকবে অনাথ আশ্রমের শেষ প্রার্থনা
মৃত বলে কেউ আমাকে ঘোষণা করলেও
জেগে থাকবে আমার চোখের হীরা
কিন্তু এখন নিয়নের বেশ্যাদের ফসফোরাস ছায়ার মধ্যে
আশ্চর্য ক্রেন ছিঁড়ে খাচ্ছে শহরের শিরা-উপশিরা
কালবেলা
যুবকেরা গেছে উৎসবে
যুবতীরা গেছে ভোজসভায়
অরণ্য গেছে বনানীর খোঁজে
গরীব জুটেছে শোকসভায়।
গয়নারা গেছে নীরব লকারে
বন্যপ্রাণীরা অভয়ারণ্যে
বিমান উড়েছে আকাশের খোঁজে
গরীবরা শুধু হচ্ছে হন্যে।
পুরুষেরা গেছে নিভৃত মিনারে
গর্ভবতীরা প্রসূতিসদনে
কুমিরেরা গেছে নদীর কিনারে
গরীব জমছে নানা কোণে কোণে।
বিপ্লব গেছে নেতাদের খোঁজে
যুবকেরা গেছে উৎসবে
যুবতীরা গেছে বিশিষ্ট ভোজে
গরীবের হায় কী হবে?
কিছু একটা পুড়ছে
কিছু একটা পুড়ছে
আড়ালে, বেরেতে, তোষকের তলায়, শ্মশানে
কিছু একটা পুড়েছেই
আমি ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছি
বিড়ি ধরিয়েছে কেউ
কেউ উবু হয়ে ফুঁ দিচ্ছে উনুনে
কেউ চিতায় তুলে দিয়েছে
আন্ত্রিক রোগে মৃত শীর্ণতম শিশু
ওলট পালট খাচ্ছে জ্বলন্ত পাখি
কোথাও গ্যাসের সিলিণ্ডার ফেটেছে
কোথাও কয়লাখনিতে, বাজির কারখানায় আগুন
কিছু একটা পুড়ছে
চার কোনা ধরে গেছে
জ্বলন্ত মশারি নেমে আসছে ঘুমের মধ্যে
কিছু একটা পুড়ছে
ক্ষুধায় পুড়ছে নাড়ি, অন্তেরা
ভালোবাসায় পুড়ছে যুবক
পুড়ছে কামনার শরীর, তুষ, মবিলে ভেজানো তুলো
কিছু একটা পুড়ছেই
হল্কা এসে লাগছে আঁচের
ইমারত, মূল্যবোধ, টাঙানো বিশাল ছবি
প্রতিশ্রুতি, টেলিভিশন, দুপ্তপ্রাপ্য বই
কিছু একটা পুড়ছে
আমি হাতড়ে হাতড়ে দেখছি কী পুড়ছে
কিছু একটা পুড়ছে
কী ছুঁয়ে হাতে ফোস্কা পড়ছে
কিছু একটা পুড়ছে, গনগন করছে
চুপ করে পুড়ছে, মুখ বুজে পুড়ছে
ঝড় যদি ওঠে তাহলে কিন্তু দপ করে জ্বলে উঠবে
কিছু একটা পুড়ছে বলছি
দমকলের গাড়ি, নাভিকুণ্ডল, সূর্য
কিছু একটা পুড়ছে
প্রকাশ্যে, চোখের ওপর
মানুষের মধ্যে
স্বদেশ!
কুষ্ঠরোগীর কবিতা
আমার এ কুষ্ঠরোগ
সারানো কি কলকাতা শহরের কাজ
যার হাইড্রেণ্টে জল নেই।
তাই আমি অকুতোভয়ে
চেটে নিই তেজস্ক্রিয় ধুলো
জিভের ঝাড়নে
যাতে করে টেবিল
সব সময় ফিটফাট থাকে
বোঝা যায় না কিছুতে
এটা কুষ্ঠরোগীর টেবিল।
আমার সংগ্রহে আছে
অকিঞ্চিৎকর কিছু ছায়াপথ, তারা
সাইকেল-রিকশায় ছেঁড়া চেনের চাবুক
যা আমার হৃদ্পিণ্ডে রক্তাক্ত আছড়ায়
এবং বিশেষ গোপন
কিছু ন্যাপথলিনের তৈরি চাঁদ
যা আমি প্রস্রাবাগার থেকে সংগ্রহ করে
আমার মেঘের পোশাকের ভাঁজে ভাঁজে
রেখে দিয়েছি।
অলৌকিক কোনো অতলস্পর্শে
আমার এ ব্যাধি সেরে গেলে
আমি গাছের আয়নায়
সবুজ ছায়া ফেলব মায়াময়
এবং সেই অরণ্যে
আমাকে চিতার মতো সুন্দর দেখাবে।
আমার এ কুষ্ঠরোগ
সারানো কি কলকাতা শহরের কাজ
যার হাইড্রেণ্টে জল নেই।
তাই আমি অকুতোভয়ে
চেটে নিই তেজস্ক্রিয় ধুলো
জিভের ঝাড়নে
যাতে করে টেবিল
সব সময় ফিটফাট থাকে
বোঝা যায় না কিছুতে
এটা কুষ্ঠরোগীর টেবিল।
আমার সংগ্রহে আছে
অকিঞ্চিৎকর কিছু ছায়াপথ, তারা
সাইকেল-রিকশায় ছেঁড়া চেনের চাবুক
যা আমার হৃদ্পিণ্ডে রক্তাক্ত আছড়ায়
এবং বিশেষ গোপন
কিছু ন্যাপথলিনের তৈরি চাঁদ
যা আমি প্রস্রাবাগার থেকে সংগ্রহ করে
আমার মেঘের পোশাকের ভাঁজে ভাঁজে
রেখে দিয়েছি।
অলৌকিক কোনো অতলস্পর্শে
আমার এ ব্যাধি সেরে গেলে
আমি গাছের আয়নায়
সবুজ ছায়া ফেলব মায়াময়
এবং সেই অরণ্যে
আমাকে চিতার মতো সুন্দর দেখাবে।
কে?
সারারাত
চাঁদের সাবান দিয়ে
মেঘের ফেনায় সব ঢেকে
কার এত কাজ পড়েছে
যে আকাশটাকে কেচে দেয় ?
সারাদিন
সূর্যের ইন্ত্রি দিয়ে
বিরাট নীল চাদরটা
ঘষে ঘষে সমান করে দেয়
কার এসব খাটুনি ?
এর উত্তর জানতেন
কোপার্নিকাস
আর জানে
চারচাকা জলে ঐ
ব্রেকডাউন বাস।
খারাপ সময়
খারাপ সময় কখনও একলা আসে না
তার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আসে
তাদের বুটের রঙ কালো
খারাপ সময় এলে
রুমাল দিয়ে হাসি মুছে ফেলতে হয়
ফুসফুস গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়
জুয়ার বাজার মরা জন্তুর মতো ফুলতে থাকে
ভালোবাসার গলা কামড়ে ধরে
ঝুলতে থাকে ভয়
ল্যাম্পপোস্টের ওপর থেকে
হতভাগ্যরা গলায় দড়ি
দিয়ে ঝোলে
তাদের ছায়ায় কালোবাজারীরা
লুকোচুরি খেলে
ভি. ডি. বেশ্যার দালাল আর
জেমস বণ্ডরা রাস্তায়
কিলবিল করে
ভিড় ঠেলে সাইরেন বাজিয়ে
পুলিশভ্যান চলে যায়
তার মধ্যে পুলিশ বসে থাকে
তাদের বুটের রঙ তাদের
ঠোঁটের মতো কালো
তাদের ঘড়িতে খারাপ সময়।
গ্রহণ
চুপ
এখন গ্রহণ চলছে
তাই সব কিছু ছায়া দিয়ে ঢাকা।
দুরন্ত চীনেমাটি বাসনের দোকান
ঠাস্—কাপ না প্লেটের চিৎকার
মহেঞ্জোদড়োর সেই ছানিপড়া ষাঁড়
আচমকা ঢুকে পড়ে
নেড়ে যাচ্ছে শিঙ
সহসা নাকেতে ঘুষি
মেরে সরে গেল ছায়া
শ্যাডো বক্সিং !
চুমু!
ছায়ার তৈরি বৌ
তার হাতে ছায়া ছায়া শাঁখা
ছায়ার সিলিঙে ঘোরে
ভৌতিক ছায়াময় পাখা
ছায়াতে শিশুটি কাঁদে
তার মুখে দাতব্য স্তন
অকাতরে গুঁজে দেয়
ছায়াঢাকা বিদেশী মিশন।
বাহ
টেলিভিশনেতে ছায়া খেলা করে
উপচ্ছায়া রাতারাতি প্রচ্ছায়া হয়
ছায়ার জানলা দিয়ে হু হু করে
ছায়াচূর্ণ ঢোকে
খিল খিল করে কেউ কেঁদে ওঠে
ছায়া নামধারী কোনো প্রেমিকার শোকে!
পার্টনার!
পাটোয়ারি বুদ্ধি ভুলে এবারে ধর্মে দাও মন।
ভূমণ্ডলে আপাতত ছায়ার গ্রহণ।
ঘুমন্ত দৈত্য
শহরের খাওয়া হয়ে গেছে
শহরের এখন খিদে নেই
তাই উচ্ছিষ্ট মানুষ, মা, বাচ্চা
আজ রাতটা বেঁচে আছে ফুটপাথে।
শহরের কামনাও এখন নেই
অতএব ঘুমোতে গেছে বেশ্যারা।
শহর এখন সরগরম নয়
বরং কিছুটা ঠাণ্ডাই।
শহর এখন ঘুমোচ্ছে
শহর এখন ঘুমোচ্ছে
তার টাকা আর লোভ আগলে
শহর এখন ঘুমোচ্ছে।
মিথ্যে খবর কাগজে ছাপার শব্দ
বাদে আর সব শব্দ চুপ
এমনকী শহরের পোষা
পুলিশ ভ্যানগুলোও থানায় ঝিমোচ্ছে।
এক পশলা পেট্রল বৃষ্টি হয়ে গেছে
আগুনমাখা একটা রাগী উল্কাকে
পথ দেখিয়ে শহরে নিয়ে আসার
এটাই সময়
শহর এখন ঘুমোচ্ছে এসো,
হাতে দেশলাই রাখো।
জুয়াড়ির নৌকো
দেখেছি জুয়াড়ির নৌকো তিনজন আরোহীকে নিয়ে
অশুভ আকর্ষণে ছুটে যাচ্ছে কালো পাল তুলে
লষ্ঠনের চোরা আলো লেপে গেছে ঝুলে।
লটকে পড়েছে বিবি, উলঙ্গ নর্তকীর শেষ রাত্রি যেন
ফেনা মুখে ঠিকরোয় গ্লাস
তিনহাতে ঘুরে আসে তাস
ছৈ-এর ঘোমটায় অবসন্ন গণিকার গান
ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত, চুমু, হাসি
তিন জুয়াড়ির মুখ, লোভাতুর দুর্গন্ধ নিঃশ্বাসে
অম্ল বমির গন্ধ ভেসে গেলে জলে
জুয়াড়ির নীেকো ছুটে চলে।
দেখেছি জুয়াড়ির নৌকো অদম্য তান্ত্রিক
কী অক্লেশে প্রবেশ করে সমুদ্রের যোনির ভিতর
অনুর্বর অস্তিত্ব, সংখ্যাতীত আত্মার স্তর
ডুবে থাকা প্রেত দ্বীপ, শ্যাওলার বেড়াজাল
সাঙ্কেতিক ফোরামিনিফেরা
কোকেন ভেজানো চোখ, বেঁকা ছুরি, অদৃশ্য তস্করের ডেরা
জুয়াড়ির নৌকো ঠিক তীব্রবেগে পথ করে নেয়
সুন্দরীর নাভিকুণ্ডে তীব্র ঘূর্ণির মধ্যে
শ্বাসরুদ্ধ নোনাজল ঠেলে
জুয়াড়ির নীেকো যায় ফসফরাস আহবান জ্বেলে।
দেখেছি আকাশতলে, মৃতদেহ বিক্রয়ের হাটে
এক অঞ্জলি জলে, দর্শন-বাণিজ্যের ঘাটে
শ্মশানে ও স্নানলগ্নে, সভ্যতার ভাগাড়ে
জুয়াড়ির নৌকো ঠিক ধীর চুপিসাড়ে
কালো পাল মেলে দিয়ে বাদুড়ের ডানার আকারে
শূন্যতা তুচ্ছ করে অন্ধকার দিকে চলে যায়।
কখনও ভেবেছি আমি অসহ্য এ ভীতি দৃশ্য
আর দেখব না
নিজেকে পতিত আর মারীর শিকার বলে মনে হয়
মজ্জা, স্নায়ু, চৈতন্য কতদিন ভয়ঙ্করে নিমজ্জিত
ছুটে গেছি অত্যাচার শেষ করে দিতে
সমুদ্রজলের রাত্রে, মিনার চূড়ায় কিংবা
যোদ্ধা রেলপথে
সময় যখন প্রায় ত্যাগ করে চলে গেছে
অযুত চাকার শব্দে, অণুক্ষুদ্র শহরের পথে, বিষাক্ত নীলজলে
মৃত্যুর ফণার পরে জুয়াড়ির নৌকো
আমি দেখেছি তখনই
ক্রূরলাস্যে দ্যূতিমান দুমূর্ল্য নরকের মণি।
টেলিভিশন
চৌকো একটি আয়তন
একপাশে পর্দা
একটি প্রাত্যহিক কফিন
কফিনের ভেতরে
যারা হাসে, খবর বলে, খবর হয়
তাদের বিচিত্র কেরামতি
জীবন্মৃত মানুষের খুবই প্রিয়
একটি ঠাণ্ডা স্টুডিওর থেকে
মৃতা চিত্ৰতারকার প্রেম
অন্ধকার টাওয়ার থেকে
পাঠানো হয়
তাই দেখে শিশু ও শিশুর মা
আনন্দ পায়
মৃতের দূরদৃষ্টি
প্রাত্যহিক কফিনের পর্দায়
মৃত ডলফিনের খেলা
রোজ চৌকো কফিনের পর্দায়
মৃত্যুর কী দূরদৃষ্টি
ঐ চৌকো বাক্সটির মধ্যে
মৃতা চিত্ৰতারকার মাংসের খোঁজে
কয়েকটি আরশোলা ও একটি ইঁদুর
কফিনে ঢুকে দেখে
তার ও ট্রানজিস্টরের
এক জটিল সমাজ-ব্যবস্থা।
তোমার, আমার, আমাদের
তুমি হাতজোড় করে মাফ চাইতে পারো
পায়ের ওপর মাথা ঠুকতে পারো কাঁদতে কাঁদতে
মুচলেকা দিতে পারো যে কখনও সাহস দেখাবে না
অথবা বেছে নিতে পারো হাসপাতালের রোগশয্যা
বা মধ্যদুপুরে রক্তবমি
যা তোমার পছন্দ
কিন্তু একটা ব্যবস্থা দেগে দিয়েছে তোমাকে
তোমার পিঠের ওপর গরম লোহা দিয়ে
আমার পিঠের ওপরেও মৃত্যুর নম্বর লেখা
আমাদের বন্দী শিবিরের মানুষের মতো দেখতে
যদিও খোলাচোখে কাঁটাতার দেখা যাচ্ছে না
নম্বর কেউ পড়েই চলেছে যদিও শোনা যাচ্ছে না
কী করার আছে দরকার ভাববার সকলের
গাছের ডালের ছায়া ক্রুশের মতো দেখতে
ক্রুশ যখন রয়েছে তখন আছে তাতে
ওঠার মানুষ, ওঠাবার মানুষ
মানুষের হাতে পায়ে পেরেক মারার মানুষ
তাই সবটাই যখন অবশ্যম্ভাবী পূর্বনির্ধারিত, অমােঘ
তখন কেন একবার চিৎকার করে উঠব না
একবার চেষ্টা করব না স্বাধীন, মুক্ত, অবাধ হবার
আর কী করার আছে তোমার, আমার, আমাদের
দেশবাসীর?
দুটি প্রাথমিক প্রশ্ন
অনেক গ্রামবাসী
তাদের চারজন কমরেডের মৃতদেহর জন্যে
শহরতালুকের মর্গের বাইরে
সকাল থেকে বসে আছে।
একজন শ্রমিক
হায় কি দুর্বল তার ইউনিয়ন
রেললাইনের দিকে তাকিয়ে ভাবছে
আত্মহত্যা করলে কি বাঁচা যাবে?
অনেকগুলো বাচ্চা
পোস্টারের কাগজ আর প্যাকিংবাক্সের ঘরে
খেলে খেলে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছে
ওদের মা ফিরলে তবে খেতে দেবে।
এখন কি আমার শিল্পচর্চা করা মানায়?
বুড়ো পাহাড়ের পিঠে গাছগুলো ঝড় মাখছে
আকাশের চোখ অন্ধ করে দিচ্ছে ধুলো
গতকালের কালো মেঘগুলো আজকে লাল।
এখন কি আমার নিজের কষ্ট নিয়ে ভাবার সময়?
নির্গুণের গান
হাঁটুর ওপরে যারা হেঁটে যান
আমরা সেই নির্গুণের জয়গান গাই
আমরা শব্দগুলো ঠিক ঠিক উচ্চারণ করতে পারি না
এটা বিরাট দোষের ব্যাপার নয়
আমরা এখন বিভিন্ন শস্যের খোসা চিবোচ্ছি
অতএব বিভিন্ন স্বর বেরোচ্ছে আমাদের কষ্ঠ থেকে
হাঁটুর ওপরে যারা হেঁটে যান
আমরা সেই নির্গুণের জয়গান গাই
অকারণে প্রশ্ন তুলে লোকসান দিতে আমরা রাজি নই
প্রশ্নের উত্তরও প্রশ্ন—আমরা শুধু এইমাত্র বুঝি
যত্রতত্র ও সর্বত্র তাই বেজে ওঠে আমাদের শিঙা,
পিলে চমকানো খোল ও বগল
হেই বাবা, দেই বাবা, এটা পয়সা দে যাবেন বাবা
চোপরদিন অনাহারে আছি বাবা
গ্রহণ হোক বা না হোক আমরা দান গ্রহণ করে থাকি
হাঁটুর ওপরে যারা হেঁটে যান
আমরা সেই নির্গুণের জয়গান গাই
শাস্ত্রীয় স্বরগ্রাম বা ভদ্র রসিকতা আমরা জানি না
আমাদের তাতে বিন্দুমাত্র লজ্জাও নেই
মজ্জার ভেতরে যাদের ইয়ার লুকিয়ে আছে
তাদের মজা পেতে পয়সা খরচ হয় না
হাঁটুর ওপরে যারা হেঁটে যান
আমরা সেই নির্গুণের জয়গান গাই
হাঁটুর ওপরে নির্গুণেরা হেঁটে যান
যেমন তাঁদের ছাঁদ তেমনই রগুড়ে চলন
স্রেফ ক্ষুধা আর নেশা তাঁরা সঙ্গে করে এনেছেন
কিন্তু ভোজ্যবস্তু বা বোতল কোনোটারই ব্যবস্থা করেননি
হাঁটুর ওপরে যারা হেঁটে যান
আমরা সেই নির্গুণের জয়গান গাই
গর্ভপাতকীর পুরস্কার তাঁদের প্রলুব্ধ করে না
তারা মুহুর্মুহু দেহক্রীড়ায় মত্ত হয়ে ওঠেন
এই প্রচণ্ড শক্তি তারা কোথায় সঞ্চয় করেছেন
হাড় বার করা চতুর্মুখ দেখে বোঝবার জো-টি নেই
হাঁটুর ওপরে যারা হেটে যান
আমরা সেই নির্গুণের জয়গান গাই
তাঁরাই মনুষ্যরূপে প্রবৃত্তি
প্রবৃত্তি সেই বস্তু যা জয় করা
অকারণে মানুষ মারারই সামিল
তাই বুট ও বুলেটে যারা ছত্ৰখান
যাঁরা চরম আহাম্মক, ফেরার বা লোপাট
আমরা সেই নির্গুণের জয়গান গাই
হাঁটুর ওপরে যারা হেঁটে যান
আমরা সেই নির্গুণের জয়গান গাই
নীল
আমি তোর অকৃত্রিম শুভাকাঙক্ষী, নীল
শকুনের ঠোঁট নখ ছিড়েছিল যাকে
প্রতিহিংসার ফুল ফুসফুস জুড়ে ফুটে থাকে
রক্ত ও স্মৃতির মধ্যে আমি ঠিক খুঁজে নেব মিল
আমি তোর অকৃত্রিম শুভাকাঙক্ষী, নীল।
আমার দেশের রাত্রি বারুদের মতো ছোঁয়া যায়
নীল সেই আশ্চর্য রাত দেখেছিল
ছুঁয়েছিল ফাটা ছেঁড়া মানুষের অসংখ্য চোখ
অশ্রুমতীর ঢেউ তার শব বুকে রেখেছিল
বর্শার ফলার মতো ধারালো হাওয়ায়
নীল, তোকে ফের ছোয়া যায়।
নীল, আমি ছুঁয়ে আছি শিরছিন্ন কবন্ধ স্বদেশ
ছুঁয়ে আছি ধান, মৃত্যু, জন্ম, ক্রোধ, ঋণ
নীল আমি ছুঁয়ে আছি আদিবাসী ধনুকের ছিলা
নীল, তোর স্পর্শে আমি রক্তমুখী নীলা।
শৃগালের দাঁত নখ ছিঁড়েছিল তাকে
প্রতিহিংসার ফুল ফুসফুস জুড়ে ফুটে থাকে
রক্ত ও স্মৃতির মধ্যে আমি ঠিক খুঁজে নেব মিল
আমি তোর অকৃত্রিম শুভাকাঙক্ষী, নীল।
পটভূমি—১৩৮৮
কোনো এক কুঠুরিতে লণ্ঠনের নিভে আসা আঁচে
দেখা যায় একটি মেয়ে নিজের কাপড়ে গলা বেঁধে
একলাই ঝুলে আছে
ঘরের কোণেতে শুধু খচ্ খচ্ শব্দ ইঁদুরের
পোকাধরা বাসি চাল চুরি করে গর্ততে লুকোয়
মেয়েটি যে অন্তঃসত্তা—সেই সত্তাটিও ক্রমে মরে
তুমি কি লজ্জা পাও নিজের সত্তার কন্দরে?
তুমি কি সরব হও বেশ্যাবাহী শহরে বন্দরে ?
এরকম মুহুর্তে ঐ ঝুলন্ত চিত্রটির পাশে
সহসা যদি রেডিওতে বেজে ওঠে মুগ্ধমতি জাতীয় সংগীত
তাহলে বুঝতে হবে শূন্যে দু পা রেখে ঐ মেয়ে
রাষ্ট্রকে জানাচ্ছে তার পাওনা সম্মান
যেরকম বলা হয় নগ্নপদ স্কুলের শিশুদের
দুর্লভ পুণ্য আনে দূষিত নালার জলে স্নান
ইতিমধ্যে রোঁয়াওঠা বৃদ্ধ কিছু ইঁদুরের দল
স্ফীতোদর বিড়ালের সঙ্গে করে সম্ভোগ,
লালসার খেলা
এভাবেই কেটে যায় বেলা ও অবেলা, কালবেলা
মৃতা যুবতীটি ঝোলে, লন্ঠনের কাচে জমে কালো
এর চেয়ে দেশদ্রোহী নাম নিয়ে জুলে ওঠা
লক্ষগুণে ভালো
তুমি কি ক্রুদ্ধ হও নিজের সত্তার কন্দরে ?
তুমি কি যুদ্ধ চাও শহরে ও গ্রামে, বন্দরে ?
পুলিশ করে মানুষ শিকার
বনবিবি না দক্ষিণরায়
কোন থানেতে মানত রাখতে
যাচ্ছে থানার বড়বাবু
হাতে বন্দুক, পায়ে জুতোবুট
চা সিগারেট চাখতে চাখতে
কোন থানেতে মানত রাখতে
যাচ্ছে নোনা সোঁদা হাওয়ায়
বনবিবি না দক্ষিণরায়
মানুষ করে মানুষ শিকার
মানুষ শিকার করে মানুষ
দলের মানুষ কলের মানুষ
কত ছলাকলার মানুষ
কুমিরও নয় কামটও নয়
বড় শেয়াল, চৌসাপা নয়
বল্লমে চোখ উপড়ে নিয়ে
কোপ মারে দা, কাতান দিয়ে
তাদের ধরতে যাচ্ছ নাকি
নোনা ফেনা সোঁদা হাওয়ায়
কোন মানত পড়ল ফাঁকি
বনবিবি না দক্ষিণরায়
স্টিমার ঘাটে ভিড় করে ভয়
মানত করে ফেরার সময়
বাঁশের সঙ্গে হাত-পা বাঁধা
রক্তে মুখে জেবড়ে কাদা
আনছ কাকে ঝুলিয়ে নিয়ে
বুলেটে চোখ উপড়ে দিয়ে
মানত রাখা হল কোথায়
বনবিবি না দক্ষিণরায়
পুলিশ করে মানুষ শিকার
মানুষ শিকার করে পুলিশ
দলের পুলিশ কলের পুলিশ
কত ছলাকলার পুলিশ
যাচ্ছে নোনা সোঁদা হাওয়ায়
চা সিগারেট চাখতে চাখতে
কোন থানেতে মানত রাখতে
বনবিবি না দক্ষিণরায়।
পেট্রল আর আগুনের কবিতা
এক শালার সঙ্গে দেখা হল
সে কাশছে
তাকে বললাম—গুরু, চলবে?
সে বললে—না
লাস্ট টিপ মারিয়ে গ্যারেজে ফিরছি
দম নেই
এই বলে সে চলে গেল কাশতে কাশতে
সে একটা দোতলা বাস।
তারপর দেখলাম
দশতলা একটা বাড়ি
হাতে রাবারের দস্তানা পরে
বাচ্চা একটা রাস্তার
গলা টিপে ধরেছে
আর ল্যাম্পপোস্টগুলো
ঝটপট করে পালাতে চেষ্টা করছে।
ধারালো চাঁদ ঝলসায় রাতের গলায়
প্ল্যানেটেরিয়ামের ইলেকট্রনিক ঘড়িতে
তখন দারুণ জ্বর
অন্ধকার ফাঁকা ময়দানে
একটা ট্রাম টাল খায়
আচমকা চলে গেল পুলিশভ্যান
ঘুমন্ত কুকুরগুলোকে চমকে দিয়ে
রোজ চমকে দেয়।
আমি জানি
খুব ভালো লিখলেও
একটাও ফাঁসি
থামানো যাবে না
আমি জানি
গরিবদের ভয় দেখানোর জন্য
এই সব কিছু—
লাস্ট টিপ, কাশি, ভয় পাওয়া
ঝটপট করা, হল্লাগাড়ির ধমকে
চমকে ওঠা, টাল খেয়ে খেয়ে
মরা, জ্বরে ছাই হয়ে যাওয়া
এর একটাও
কবিতা লিখে থামানো যাবে না
ধুলোর ঝড়ের মধ্যে
চোখ বন্ধ করে
আমি হাঁটতে শিখিনি
একদিন পেট্রল দিয়ে
সব আগুন আমি নিভিয়ে দেব
সব আগুন আমি নিভিয়ে দেব
পেট্রল দিয়ে।
পোস্টার
ছোট্ট এক হাত মুঠোকরা ন্যাড়ামাথা পোস্টার
সে বলছে
অন্ধ আকাশে লক্ষ বিদ্যুৎ
লক লক করে উঠলেও
ছোট ও নিরীহ গাছেরা ভয় পায় না।
প্রতি কর্তৃপক্ষকে
বিধিসম্মত সতর্কীকরণ পড়ি
পড়ে আসছি
জন্মে, নিরবধি।
পড়ে আসছি সেই জন্মান্ধতা থেকে
দৃষ্টিহীনতায়, অন্ধকারে, চক্ষুহীন উৎসবে
বিধিসম্মত সতর্কীকরণ।
একবর্ণও বিশ্বাস করি না
যা কিছু নিষিদ্ধ তাতে আছে আমার বিধান।
বরফ আর আগুন
আমি একটা ছোট্ট শহরে চলে গিয়ে
রেকর্ড বা পেরাম্বুলেটর বিক্রি করতে পারি
মুখে কান্নার রুমাল বেঁধে আমি বাচ্চাদের
খেলনার রেলে ডাকাতি করতে পারি আমি
প্ল্যাটফর্মের ওপর চক দিয়ে লিখতে পারি
পায়ে পায়ে মুছে যাওয়ার কবিতা
কিন্তু দুজন মেয়েকে ভালোবেসে
আমি যে কষ্ট পেয়েছিলাম
সেকথা কখনও ভুলতে পারব না।
আমি নিজের বুকের মধ্যে শব্দের ছুরি
বসিয়ে দিতে পারি
আমি অসম্ভব উঁচু চিমনির গা বেয়ে ওপরে উঠে
নিচে বয়লারের আগুনে লাফ দিতে পারি
আমি সমুদ্রে জামা ধুয়ে নিয়ে এসে
পাহাড়ের হাওয়ায় শুকিয়ে নিতে পারি
কিন্তু দুজন মেয়েকে কষ্ট দিয়ে
আমি এত ভালোবেসে ছিলাম
সে কথা কখনও ভুলতে পারব না।
আমি রেগে গেলে সাংঘাতিক সশস্ত্র
রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে পারি
ঠাণ্ডা মাথার শির ছিঁড়ে তার-কাটা
ট্রামের মতো থমকে থাকতে পারি
জুতোর মতো মুখটাকে চকচকে করে তুলতে পারি
কিন্তু দুজন মেয়েকে ভালোবেসে
আমার রক্ত বরফ আর আগুন হয়েছিল
সে কথা কখনও ভুলতে পারব না।
বিপ্লবের চিত্রকল্প
বেশ কয়েকজন কবি বিনাপয়সায় ডাক্তারি করছে
চাঁদের মধ্যে লাফিয়ে পড়ার আগেই প্রেমিক গ্রেফতার
পুলিশ-ভ্যানগুলোকে চবিবশ ঘণ্টার মধ্যে ইস্কুলের বাস করে
ফেলা হবে
মধ্যরাত্রে বিভিন্ন জনবিরোধী পার্টির লাইন উপড়ে ফেলা হচ্ছে
চিঠি ফেলার বাক্সের মধ্যে চড়ুই পাখিরা বাসা করেছে বলে
কাজ আচল
জনৈক তাত্ত্বিক একোয়ারিয়ামের মধ্যে বেড়াল পুষেছেন
রেডিও কেউ খুলছে না কারণ নেতাদের বক্তৃতা শুনতে
ভালো লাগছে না
আলোচনা চলছে গাছ ও মাছের চারার ওপর বিষগ্ন সংগীতের
প্রভাব নিয়ে
এখন থেকে চোখের জলেই মোটরগাড়ি চলবে
কে বলবে আমাদের এই নতুন সমাজ-ব্যবস্থায় সমস্যা নেই
খবরগুলো শুনে কি তাই মনে হচ্ছে?
বিষুব অরণ্যে, জ্যোৎস্নার তল্লাসী আলোয়
কত অভিমানে বলি আমার কী-ই বা আসে যায়
বিষুব অরণ্যে যদি দপ করে জ্বলে ওঠে প্রজাপতি
যদি জোনাকিতে ঝলসায় লক্ষ্যমুগ্ধ স্নাইপারের চোখ
চাঁদমারি আকাশে ভাসে মেঘের শেষ যুদ্ধ শেষ ধোঁয়া
কাঁটালতা ছিঁড়ে এগিয়ে আসা কম্যাণ্ডোর মতো পিপাসায়
আমি তো জানি
আমার চেয়েও দ্বিগুণ ত্রিগুণ
কী দারুণ অভিমানে
রক্তাক্ত থাবা চাটতে চাটতে
দলিত মথিত প্যাস্থার
হলুদ গন্ধক পাহাড়ে চলে যায়।
শীতের দুপুর যেন গভীর অরণ্য জুড়ে বিষাদের গান
বুলেট বিদ্ধ যারা, গারদে আটক যারা
—তাদের অযুত অপমান
ঝর্ণার প্রলেপ জলে ধুয়ে যায়, ধুয়ে গেলে
ফুরাবে এ বেলা
পতঙ্গ, পাখি সব ভুলে যাবে একদিন
অবশ রক্তের গন্ধে শিকার ও আততায়ী খেলা
কয়েকটি শুষ্কপত্র থাবার তলায় ভাঙে, শব্দচুর্ণ
প্যান্থার চোখ তোলে
সেই চোখে বঞ্চ নার হিম
গাছ ও পাতার কাছে পালকের উষ্ণতা
ঘিরে আসে অসহায় ডিম
ত্রস্ত সূর্য তার কেশর লুকায়ে ফেলে পাহাড়ের ঘাড়ে।
বিষুব অরণ্যে তবু জীবনের শর্ত মেনে
আহত প্যান্থার বাঁচে
বাঁচে চুপিসাড়ে
কারণ সে জানে
বুটের তলায় থাকে ধাতব পেরেক
রাইফেলে সন্ধানী আলো বাঁধা থাকে
খোঁয়াড়ে, খাঁচায়, সেলে মুখগুলি যেন কত করুণ লণ্ঠন
জঙ্গলে বিটিং, মদাশিকার, পেট্রলে জ্বালানো চালাঘর
সাঁজোয়া করাতে খণ্ড খণ্ড মানুষ, দাঁতের দাগ বসা পোড়া গাছ
সেঁকোবিষে মারা মাছ, জিপের টায়ারে মাখা মাটি
শোষণ ও অত্যাচারে
অন্তহীন তার দেশ গ্রাম মহাদেশ গ্রাম
তথায় এখনো
শিশুমৃত্যু, অপুষ্টি, ধর্ষণ, লুটে ও তরাজে
সরফরাজন্যবর্গ নানা বেশে সাজে
টিভির পর্দার মতো পক্ষীহীন নীলাভ আকাশ
বিমান মহড়ার পক্ষে বড় লাগসই
ফেনা নোনা মাটির মধ্যে ভাঙা কাচ, টিন তুঁতে
ছেঁড়া কাক, বাঁচার লটারি
হাইওয়ে দিয়ে ছোটে রাক্ষস পণ্যের কনভয়
ডিজেল বাম্প ওড়ে, চাপা পড়া রাস্তা থাকে পড়ে
টিভির পর্দায় ভাসে চমৎকার দেশ
প্রচণ্ড উল্লাসের মধ্যে জাতীয় স্টেডিয়াম থেকে
মহাকাশে উঠে যায় হাজার শিশুর
গ্যাস ভরা করোটি
মূর্খমন্ত্রী ছিন্ন মুণ্ডে পদাঘাত করে, মুণ্ড গড়ায়
খেলার তো এই সবে শুরু
লক্ষ লক্ষ কবন্ধ হাততালি দেয়
আমন ও আমানির মধ্যে নাচে দুর্ধর্ষ মাল ও মালিনী
পর্যাপ্ত অর্থে মেলে অপর্যাপ্ত যোনি
মগজেতে ছাপা থাকে কাগজের প্ৰেতকথা, মৃতের কুশল
রম্ভার দাম্ভিকতা, সারশূন্য খোসা, খোলা, আঁশ
সেলোফেন, ব্রয়লার পালক
বুদ্ধি জীবাণু ও সাহিত্যসেবনের দুগ্ধকলায়
কত সরীসৃপ আসে ডলার ফলারে
মড়ক মহড়া না মাতাল খোঁয়ারি
এঁটো মুখে চুমু খায়, থুথু বিনিময়ে মাতে
ছি ছি বলে ছ-পা নেড়ে উড়ে যায়
নিন্দুক ডিগ্রিধারী মাঝি
তত্ত্বের ভেক্টর মশা শব্দবমন করে
হানে মহামারী
সমগ্র দেশটি পচে, হেজে যায়, পাঁকে ডোবে, তলায় ভাগাড়ে
এশীয় নিস্তুব্ধতা
এই মৃত্যু উপত্যকা জুড়ে
কেরোসিনে জ্বলন্ত নারী
নির্ভুল আলোকিত করে রাখে
এই মধ্যযুগ, এই বধ্যভূমি
আহত প্যান্থারের চোখে ঘুম নেই, ঘুম নেই, ঘুম নেই
ঠায় জেগে আছে
জ্যোৎস্নার আলো আঁতি পাঁতি খুঁজে গেছে খরগোশে
শৃগাল বা হায়নার ফসফোরাস, ত্রাস চক্ষুদ্বয়
অট্টহাসি হেঁকে ওঠে—সার্চ অ্যাণ্ড ডেস্ট্রয়
আমি কত দীন, ক্লাব, রেনিগেড, সংগ্রামবিমুখ
ফিস ফিস করে বলি আমার কী-ই বা আসে যায়
ধুলায় চুম্বন আছে, অশ্রু আছে শুকনো হাওয়ায়
রক্তাক্ত ভিজে থাবা কষ্ট করে টেনে নিতে নিয়ে
দলিত মথিত প্যান্থার
হলুদ গন্ধক পাহাড়ে চলে যায়।
বুভুক্ষু ক্ষুধার্ত মানুষ
বুভুক্ষু ক্ষুধার্ত মানুষ । নবারুণ ভট্টাচার্য
বুভুক্ষু ক্ষুধার্ত মানুষ
সে সবকিছু খায়
মুখে পুরে দেয় বালি, রোদুর, পাথর
মুঠো মুঠো লোহা, মেঘ, আগুন
খায় বৃষ্টি, চেটে নেয় অনাবৃষ্টি
অসুখ, লরির চাকা, দেশলাই, ফলিডল
সব সে খেয়ে নিতে পারে
তার এত খিদে
সে নিজেও জানে না
বুভুক্ষু পেট-পিঠ সাঁটা মানুষের একটিই সভ্য গুণ
সে সুখী ও স্বাস্থ্যবান মানুষদের খায় না
যদিও তারা দুবেলা রটায়
বুভুক্ষু ক্ষুধার্ত মানুষ আদপে নরখাদক
কবে যে সে খেয়ে নেবে
দেশ, দেশবরেণ্য, ভোট, খোঁচড়
টন টন বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি
ফাইভস্টার হোটেল, ভিডিও, রোটারি ক্লাব
জেল, টেলিফোন, ক্যাসেট, টিভি
সে খেয়ে নেবে কবে
তাকে ভয় না পেলেও
তার খিদেকে অনেকেই ভয় পায়
মৃত্যুও তার কাছে খাবার ছাড়া
আর কিছু নয়
তাই শ্মশানও তার ধারে কাছে ঘেঁষে না
সে দুঃখ খায়, কষ্ট খায়, কান্না খায়
কখনও কখনও পেলে ভাত-রুটি খায়
খুব খুব মার খায়
লাথি খায়, বুলেট খায়
তবু সে মরে না
বুভুক্ষু ক্ষুধার্ত মানুষ
সব সময়, সব অবস্থায় বেঁচে থাকে।
ভাবনার কথা
একটা রুটির মধ্যে কতটা খিদে থাকে
একটা জেল কতগুলো ইচ্ছেকে আটকে
রাখতে পারে
একটা হাসপাতালের বিছানায়
কতটা কষ্ট একলা শুয়ে থাকে
একটা বৃষ্টির ফোঁটার মধ্যে
কতটা সমুদ্র আছে
একটা পাখি মরে গেলে কতটা
আকাশ ফুরিয়ে যায়
একটা মেয়ের ঠোঁটে কতগুলো চুমু
লুকোতে পারে
একটা চোখে ছানি পড়লে কতগুলো আলো
নিভে আসে
একটা মেয়ে আমাকে
কতদিন অচ্ছুৎ করে রাখবে
একটা কবিতা লিখে কতটা হট্টগোল
বাধানো যায়
ভাসানের সুন্দরবনে সোনার তরী
ওই ভাসে শকুনের অর্ধভুক্ত শিশু
তাকে তির্যক রেখায় ঠেলে এক কাষ্ঠ দাঁড়
বোধহয় অসামাজিক এক লজ্জায় অধোমুখ
শিশুটি উল্টে যায় লবণ তরলে
মুখ রেখে মাতলার গভীর লুকোনো ভিতে
হালের হেলায় নাক বেঁকে
সোনার তরীটি তার রিলিফ ভারের ভরে
সুন্দরী ঘাটের দিকে ধায়
নারীর চোখের মণি অন্ধ থাকে শীতের হাওয়ায়
স্পর্শকাতর জল ঝরে সেই দেহের মন্দিরে, ঘিরে
রিলিফ ক্যাম্পে যবে শিশুদের দেওয়া হয়
কমলালেবু ও সাবুগোলা বেবিফুড ওই তার কোল খালি
ওই পারে মৌখালি কৈখালি আর কত না আস্তানা
মসিদবাড়ির মাটি মৃত্তিকার অসংখ্য কুটির
ছিল সেই সব গ্রামে আছে ফাঁকা
বান্টু হটেনটট ও বিবিধ জাতির মানুষ
তারাও এ এক রোমাণ্টিক সাইক্লোনে নাড়া খেয়ে
জলবন্দী হিড়হিড় করে এসে হাজির দূরদর্শনের সংবাদে
তালদি রিলিফ ক্যাম্পে তাদের শীতে কাঁপা থরথরে জীবন
ঝুলে আছে ড্রাইডোলে, হাই তোলে ফোলানো ফাপানো মানুষ
নিশ্চয় পৌঁছেছে রাশি রাশি ভার নিয়ে সোনার তরণী
শহরেরা শহরে সুন্দর, গ্রামবাসী সুন্দর ফ্লাডে
সংবাদে গর্ভস্ফীত কিছু চঞ্চু বান গোলাবাড়ি লাটে
নেমে দেখে বেবাক লোপাটে,
প্রাণ নেই, কিছু নেই, তাই সংবাদ
ডানা ঝাড়ে সকালের মুদ্রিত শকুন
চন্দ্রালোকে শিশুটিকে বৈঠায় পেয়ে
ইন্দ্রনাথ শুনেছিল ডাকে তাকে তার সহোদর
সোনার তরীর সামনে অনন্ত শান্তির এক পারাবার
বেনো পচা হাড়ধোয়া জল খাবল খাবল করে
লাট থেকে বাদা আর কাদাধোয়া শামুক আবাদ
শকুনের সামনে এক জটিল দুরূহ সমস্যা
জাত যাবে গরু খেলে, পাতে তার যদি আছে কোলভরা ছেলে
সোনার তরকে টানে কুলছাপা অশ্রুর জোয়ার
কাঁকড়ার গর্ত থেকে সম্মোহিত উঠে আসে চাঁদের চুম্বক
আকর্ষিত জল যদি তার কণ্ঠলগ্ন হত ক্ষণ যৌনতায়
কামটের বিস্ময়ে স্তব্ধ হত গরানের ঘেরি
বিস্ফোরক চিত্রকল্পে জল লক্ষ দাঁতে কাটে ফাটা মজা ভেড়ি
এশিয়ার কোনো ঘরে শীতঘুমে যে কটি মানুষ
ইতস্তত মৃত পাক খায়, টানে ছোটে, লুকায় কাদায়
রাশি রাশি ভারা ভারা দুগ্ধময় ধান ছেঁড়ে জলের হাঁসুয়া
মৃত ধীবরের জাল তারই দেহের মতো নানা দোটানায়
এবম্বিধ খণ্ডচিত্রে সোনার তরীটি দেখো বড়ই মানায়
তুমি যদি পুণ্য চাও এই লগ্নে শেষকৃত্য সারো
জলজ বায়স আসে তারকার ফোটা খই খেতে
ভোলো দুঃখ, কে তোমার স্তনদাত্রী ছিল, কে বা পিতা
নুড়ো জ্বালো মাটি দাও, অভাগীর অপার মহিমা
সুন্দরবনের তটে সিক্ত ও লবণাক্ত মানুষের চিহ্নলুপ্ত ধোঁয়া
আকাশের হেলিকপ্টারে মুক্ত চার পাখায় জড়ায়
দুর্বল ও ধর্মভীরু মানুষ যেমন, তেমন অপার কঠোর শাস্তি
শেষকৃত্য সারো, ছোঁড়ো ভোটের রিলিফ, বলো এই নাও বড়ি
প্রকৃতির ঘনঘটা হতবুদ্ধি করে প্রভু, এখনও কখনও
যতক্ষণ না গায়ে দিয়ে মৃতের কাপড় জরাক্রান্ত
বালকটি জানে যত মাটি ফেলা হয় ঢের বেশি তার হয় লেখা
গজমন্ত্রী তুষ্ট থাকে অলীক ঘুষের জাঙ্গলে
কোন দল, কোন মত, কোন মোহ ও প্রমেহ
কুলাক ও ঠিকাদার খচীতে সাহস করে মনে
নিয়তির আবির্ভাব একাশির সুন্দরবনে
পাগল জলের তোড়ে কে বাঁচায় গরু বা ছাগল
কার সাধ্য স্রোত থেকে টেনে তোলে ভীত বৃদ্ধকে
খড়ের চালের থেকে খড় সরে, সরে বাঁশ, তলায় মানুষ
কে সে মূঢ় খোজ চায় নিখোঁজ ও নিশ্চিহ্ন গৃহের
ওই দেখো, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অর্থনীতি বা ধন্দ সসেমিরা
গমকে চলেছে দেখো সুন্দরী বাংলায় সোনার তরীটি
কলিকাতা মহান নগরে প্রায় সমান্তরাল সরকারি পর্যটন উৎসব
চলো সব দল বেঁধে মহামতি ক্যানিঙের খাসজমি দেখে আসি
ভাগ্য প্রসন্ন হলে ক্যামেরায় জুটে যাবে রঙিন কঙ্কাল
বা সাম্প্রতিক খুলি
শ্মশানের পাশে জল থাকে কিন্তু দেখেছ কি বিস্তীর্ণ জলের শ্মশান
নুনমাখা মাটি দেখ বন্ধ্যার মতো হাসে বিকৃত মাথায়
ক্ষতবিক্ষত স্তন নিমজ্জিত যোনি ওষ্ঠ নুনে চাপা ওই পাথর প্রতিমা
চার ঠাং তুলে রাখা অর্থহীন গাভী বা নোনা জলে ঢুকে মরা
মৎস্য প্রকল্পের মাছ
বিঘৎ জলের মধ্যে রূপসী শিঙির মৃত্যু, রাজহংসীর মতো নাচ
কিছু বোকা ওই মাছ খেয়ে গেছে ক্ষুধার ওপারে
এদিকের বর্বর মানুষ জল নেমে যেতে উঠে আসে
চিন্তাহীন জড়বুদ্ধি থাকে, কামড়ায় না বা কাড়ে না সঞ্চয়
সোনার তরীর দিকে তাকায় না অপলক, শোনে না আশ্বাস
আমন মানুষের গায়ে লেগে আছে শোষক পোকা
আমন মানুষের অন্তরে লেগে আছে শোষক পোকা
এ মানুষ এমনই নিঃস্ব যে অন্যতর মানুষের তুলনায় ভারহীন
তিন দিনে দুশো গ্রাম চিঁড়ে পেলে ক্লান্ত চিবোয়
টক খিচুড়ির মধ্যে দক্ষ জিভে খুঁজে নেয় গোপন কলেরা
শহরে হাজির হয় পেটভাতে পরিণত পঙ্গু ক্রীতদাসে
অবশ্য ক্রিমিনাল আছে কিছু নানাকিছু অসভ্য প্রস্তাব দেয় নিশিকালে
বলে এই পদস্থ শৃগালবাহী সোনার তরীটি দাও নিবিড় সমাধি,
কবরস্থ করো যারা ছদ্ম বাঁধ বাঁধে, মজায় তালুক
ঘেড়োভাঙা লাটে তাই মহাজন বড়ই অসহায় হয় দারোগার দেরি দেখে
দিনের মুক্তার পরে ডালা বন্ধ করে দেখ অন্ধ ঝিনুক
ত্রিকালজ্ঞ হেতালের মাথা ঘেরে আরক্ত পশ্চিম
গদ কাদা বাঁশ হাড় উধাও আড়ত নৌকোর মৃতদেহ ঢেলে
নোনাফেনা যে যুবক তাকে ঠাই দেয়নি তো সোনার তরণী
চরে একা শোনে সেই অপসৃয়মান শব্দ ডিজেল ইঞ্জিনের
অতএব হেটে যায়, পায়ে ঠেকে শাখা পরা হাতছানি আর
মৃত বহু মানুষের আঁশটে চোখের পাতা
নদীর কোটাল ফেরে যুবক ভিখারি হয়, রাজপুত্র হয় এই গ্রহে
মরালির মরা নদী, খাড়ি গাঙ, হেঁটেই পেরোয় যেন জাগর বিগ্ৰহ
উলঙ্গ হাওয়ার শিস তার গায়ে ডোরা ডোরা আঁকে
পতঙ্গের তস্কর বেশ্যার বুদ্ধিজীবীর বণিকের শহরে
ধর্ষণে দর্শনে বহুমুখী কৃতী লুব্ধ পাপের ও পচনের নগরে
অকস্মাৎ ফেটে পড়ে ঢোল ও ডগর বাজে নাকাল রেডিও
ও কার রুক্ষ অনাথ অবাধ্য চুল দাউ দাউ উড়ে ঢোকে টিভির পর্দায়
পিতৃমাতৃহীন ও কে প্রেতকষ্ঠে ডাকে
ভাই রে–বাদা ভেসে গেছে
বাঘ আর বনবিবি যুবকের হাত ধরে
শেষ রাতে হাঁটা পথে শহরে এসেছে।
ভিয়েতনামের ওপর কবিতা
আমি অনেক ভেবে দেখেছি।
আজকে—এই সভায়
ভিয়েতনাম নিয়ে একটা কবিতা
আমার পক্ষে পড়া সম্ভব নয়
কারণ ব্যাপারটা অসম্ভব কঠিন
কীরকম দেখতে সেই কবিতা
তার হাতে কী থাকবে
সে অন্ধকারে দেখতে পায় কিনা
কতদিন তাকে জেলে থাকতে হয়েছে
আমি তার কিছুই
হদিশ করতে পারছি না
শব্দগুলো ভীষণ রক্তাক্ত, অসম্ভব বেপরোয়া
তার ওপরে অনেক শব্দ ঝলসে গেছে নাপামে
কিছু কিছু শব্দ উন্মাদ ও কালা হয়ে গেছে
কোনো কোনো শব্দকে হাত বেঁধে
হেলিকপ্টার থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে
অথচ এই শব্দগুলোকে সাজাতে না পারলে
ভিয়েতনামের কবিতা হবে না
শব্দ আমার কাছে চুইংগাম
মৃত বুদ্ধিজীবীর টেলিফোন নম্বর
মনোপলি দৈনিকের অশিক্ষিত
সম্পাদককে খুশি করার পাসপোর্ট বা প্রসাধন নয়
শব্দগুলোকে আমি গ্রেনেডের মতো
সাম্রাজ্যবাদী ক্যাবারের মধ্যে ছুড়ে দিতে চাই
শব্দগুলোকে আমি
রাস্তার বাচ্চাদের মধ্যে
আপেল আর বিস্কুটের মতো বিলিয়ে দিতে পারি
কিন্তু শব্দগুলো আমার হাতে চেটোর মধ্যে ফেটে যাচ্ছে
আমি লিখতে পারছি না
একটা জিনিস আমি বুঝেছি
একটা মিথ্যে কবিতা যত মিথ্যে কথা বলতে পারে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টও তা পারে না
কিন্তু একটা সত্যি কবিতা
ঘুমন্ত শিশুদের সারারাত বিমান আক্রমণ
থেকে আড়াল করে
ভিয়েতনাম নিয়ে কবিতা
সারা পৃথিবী জুড়ে লেখা হতে পারে
সেই আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায়
আমি অংশগ্রহণ করতে প্রস্তুত
সেই কবিতা লেখায়
ব্লাস্ট ফার্নেস, রকেট, ট্র্যাক্টর আর
পিয়ানো ব্যবহার করা হবে
বেশ, তবে সেই কবিতা লেখা হোক
আপনারা আসুন
(আমি কোনো শ্রমিক বা কৃষককে কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না)
এখানে যারা নেই তারাও আসুক
থেকে সেই আশ্চর্য কবিতা লেখা যায়
আমি সেই কবিতার কথা একটু
ভাবতে পারি মাত্র
কবিতার শব্দগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে
ঝোড়ো হাওয়ায় ঝাণ্ডার মতো উড়ছে কবিতা আমার
আর ছাই হয়ে যাচ্ছে পেণ্টাগন
ফাসিস্তদের কুৎসিত মুখ
চেজ ম্যানহাটান ব্যাঙ্ক
চিলি, রোডেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার
কারাগার
আর সেই আশ্চর্য আলোর মধ্যে
অসংখ্য মানুষের উৎসবে
পৃথিবীর সমস্ত সাইগন
হো চি মিন নগর হয়ে উঠছে
সেই মুক্ত শহরে
প্রথম যে জিপটা ঢুকছে
তার মধ্যে কতগুলো বাচ্চাছেলে বসে
তারা আঁকা একটা ফ্ল্যাগ উড়ছে
—তাদের হাতে সাবমেশিনগান
দেখতে অনেকটা এরকম
ভিয়েতনামের ওপরে লেখা
আমাদের সেই আশ্চর্য কবিতা।
মাংসনগরে, পণ্যের বাজারে
আপনার ত্বকের সুরক্ষার জন্য সত্যিই কার্যকরী ক্রীম নাপাম
কিনুন দুরন্ত ধার দেওয়া রেজর ব্লেড, হাতের শিরা কাটুন,
কাগজের কার্টুন জমান
কিনুন পেসমেকার, আপনার অজান্তেই ব্যাটারি ফুরিয়ে যায়
শিশুদের জন্যে কিনুন মেশিনপিস্তল, শটগান, ইদুর মারার ললিপপ
কিনুন আত্মাকে ধরার বেলুন, ঘুমপাড়ানি বুলেট, রক্ত দূষিত করার
টনিক
স্বল্পমূল্যে যোগ দিন স্তম্ভিত ব্রয়লারের দলে, ডিনার পার্টিতে, ভোটার
লিস্টে
কিনুন বিপ্লবী বুফিল্ম, সোনাগাছির ভিডিও, বিল্লা ও রঙ্গার সমগ্র
রচনাবলী
কিনুন ছোট্ট লাইটার যা স্টুপিড মেয়েদের পুড়িয়ে মারতে দারুণ
উপযোগী
কিনুন মানুষের চামড়ার স্ট্রেচলন, জিভের রবার, শিশুর হাড়ের ডটপেন
খুচরো পাপ ও ধর্ষণের নোট স্থায়ী আমানতে রাখুন যাতে
মেয়াদ ফুরোলে গণহত্যা ও শিশুমেধ পাওয়া যায়
কিনে ফেলুন নিউক্লিয়র ছাতা, হিরোশিমার বিস্কুট, লেবাননের
কমলালেবু যার খোসার থেকে সলতে বেরিয়ে
কিনুন নিকারাগুয়া, ইরান-ইরাক, এল সালভাদর, আরোয়ালের ফটো-অ্যালবাম নিজেকে কিনে ফেলুন বৌ-বাচ্চাসমেত
সঙ্গে ফাউ মর্গ, হোপ-৮৬, রেফ্রিজারেটর, রাজ্যসভা, ইনভার্টার, কমোড,
ক্রিমেটোরিয়াম
কিনুন আমার এই ক্রুদ্ধ মেজাজের সিগারেট বা কবিতা
ঘৃণার ফিন্টার লাগানো।
মৃত্যুর একটি গান
আমি তো করিনি ভুল
সে এনেছে ফুল
ফুলের সঙ্গে ছিল কিছু ছেঁড়া পাতা
ফুলওলা বসেছিল তালিমারা ছাতা
কান্নায় ভিজে গেল একমাথা চুল
আমি তো করিনি ভুল
সে এনেছে ফুল
ফুল এল গাড়ি চড়ে ফুল এল রিক্সায়
ফুল এল মুখ বুজে ফুলে ফুল মিশ খায়
ফুল এল মরে মরে ফুলের আঁচল ধরে
ফুল এসে ঢেকে দিল মোমের পুতুল
আমি তো করিনি ভুল
সে এনেছে ফুল
পাপড়ি জড়ানো ছিল আগুনের হলকায়
সুগন্ধ মিশে ছিল তাঁত-বোনা কলকায়
আগুনের লতাপাতা আগুনের আকুলতা
যেই ছুঁল গলে গেল মোমের পুতুল
আমি তো করিনি ভুল
সে এনেছে ফুল
ম্যাচবাক্সের মানুষ
বারুদ মাখানো তাদের ঘরের দেওয়াল
হালকা কাঠের খটখটে নিচু ছাদ
ফ্যাকাশে অনেক মানুষ এখানে থাকে
অর্থহীন ও নিতান্ত বরবাদ।
তাদের শরীরে রক্ত আছে কি নেই
ভাববার মতো সেটা একখানা কথা
বদরাগী এরা মিশকালো সেই রাগ
জমাট আঁকড়ে রয়েছে তাদের মাথা।
কী জানি কী এক হতাশাজনিত ক্রোধে
থতমত খেয়ে ঘরের বাইরে আসে
হালকা কাঠের খটখটে নিচু ছাদে
মাথা ঠেকে গেলে ফ্যাঁশ ফ্যাঁশ করে হাসে।
বারুদ মাখানো তাদের ঘরের দেওয়াল
সেই দেওয়ালেতে মাথা ঠুকে কী যে চায়
অর্থহীন ও নিতান্ত বরবাদ
ফ্যাকাশে আগুনে নিজেরাই জ্বলে যায়।
রাতচরা লোক
সাঁওতালদি ব্যাণ্ডেল একে একে নিভে গেলে
নিরীহ মানুষটি অন্ধকারে পা ফেলে
হেঁটে যায় মাঠ গাছ নদী
সারারাত ধরে তারা খসে
মানুষটি দাঁড়িয়ে থাকে সেই স্বচ্ছ আঁধারের বশে
মোহানায় সাঁতারের নুন মাখে বাঘ ডোরাকাটা
ডাঙায় হাঁ করে থাকে কুমির বিশাল
মানুষটি হাই তোলে ঘুমচোখে
সাদা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, তোবড়ানো রোগা তার গাল
অবাক দাঁড়িয়ে দেখে তারা ঝরে কত
ওরাও কি ঝাঁপ খায় নেশা করা মানুষের মতো
এই কথা ভর করে তাকে
যেখানে সূর্য ডোবে সেই ঘাট থেকে
এই ভবসাগরের শুরু
আকাশে কাঠের ধোঁয়া ফাটা চাঁদ শাখা নোয়া
বাতাসে অগুরু
শামুকের ভাঙা খোলা নিঃসাড়ে চিরে দেয় পা
কাদায় রক্ত টানে তবু সে শব্দ করে না
মানুষটি হেঁটে চলে আর তাকে ঘিরে
সারারাত খসে পড়ে তারা
আসল যুক্তি হল নিজেকে তেমন তুলে ধরা
কখনও প্রদীপ হয়ে কখনও বা মানতের সরা
এত কিছু জানে ঐ লোক
জানে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে পা ফেলতে হয়
আর পা ফেললে হয় দেশ দেখা
ওর কাছে কষ্ট নিয়ে আমি যেন হতে পারি ওর মতো একা
সাঁওতালদি ব্যাণ্ডেল একে একে নিভে গেলে
নিরীহ মানুষটি অন্ধকারে পা ফেলে
রেস্তরাঁর খাদ্য তালিকা
নিরামিষ :
মারাত্মক ডিডিটি শাক, ভাগাড়ের সবজি,
উপড়ে তোলা স্তম্ভিত পেঁয়াজ, তেজস্ক্রিয় আলু
বিনের মধ্যে বিস্ফোরক দানা, বিশাল বেঢপ
স্প্যাস্টিক লাউ, চলন্ত ল্যাজওলা বেগুন,
হিংস্ৰ অকটোপাস লতা, পশুর রক্ত-ভরা
টমেটো
আমিষ :
শিশুদের টাটকা চোখ, আঙুল, নিহত
হরিজনের ঝলসানো মাংস, ভূপাল থেকে
আনা নীলাভ বাছুর, ফলিডলে মারা মাছ,
রাস্তায় সংগৃহীত চাপ চাপ রক্ত, প্রত্যন্ত
অঞ্চলে পাওয়া হাড়, অর্ধদগ্ধ করোটি
অ্যাকসিডেণ্টের ঘিলু, তরুন চর্বি, আস্ত বনসাই মানুষ
মিষ্টান্ন :
বিষুব অরণ্যের কান্নাভরা ক্লান্ত অধঃপতিত আঙুর
মৃত প্রেম যা মিষ্টি চিউইংগামের মতো খাওয়া যায়
নরম ক্যাসেট বা রেকর্ড, যে সুন্দরীরা খবর পড়েন,
চিত্রতারকা, মিছরি মেশানো মদ, ধুরন্ধর বিপ্লবী
নেতার তৈরি সন্দেশ, এইডস চুম্বন
তৎসহ :
একটানা আরোয়াল কানসারার ভিডিও
এছাড়াও রয়েছে মুখ মোছার জন্যে খবরের কাগজ
ছাই ফেলার জন্যে হাঁ-করে থাকা বুদ্ধিজীবী, কবি এবং
উনুন হিসেবে সদাপ্রস্তুত বৈদ্যুতিক চুল্লি।
লাল কার্ড হাতে ছোট ছোট ফুটবল দলের গান
আমরা ছোট ছোট দল ঠিকই
কিন্তু এক হতে পারলে আমরা
মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলকেও হারিয়ে দিতে পারি
মাঝে মাঝে তো হারিয়ে দিই
তখন আমাদের মার খেতে হয়
সেই কবে থেকে আমরা মার খেয়েই আসছি
আমাদের মার খাওয়াটাই তো ইতিহাস
আর আমাদের মারাটাই যেন নিয়ম
আপনি ভাবছেন কী ক’রে চিনবেন আমাদের
আমাদের প্রত্যেকের হাতে রয়েছে লাল কার্ড
বড় বড় দলের প্লেয়াররা আমাদের মারে
সেটা দেখে রেফারি চোখে প’রে ফেলে ঠুলি
ওদের বোকা সাপোর্টাররা আমাদের ইট মারে
ওরা জানেনা কী করছে
ফাটা মাথা আর অবিচার বহন ক’রে আমরা খেলে যাই
হতে পারি আমরা ছোট ছোট দল
কিন্তু একজোট হলে আমরা
ওদের চোয়াল ভেঙে দিতে পারি
আমাদের রোগা রোগ কোচ, মুষ্টিমেয় সমর্থক
ছেঁড়া বুট, নড়বড়ে তাঁবু, ভেজা বল
হাঁটুর তলায় কালশিটে, কপালে ফেট্টিবাঁধা
কিন্তু ভাবুন তো একবার
কতদিন ধরে কী লড়াইটাই না আমরা চালিয়ে যাচ্ছি
সবাই এক হলে লড়াই-এর চেহারাটাই তো পাল্টে যাবে
সত্যি কথা লুকিয়ে রাখতে আমরা ঘৃণা বোধ করি
তাই স্পষ্ট গলায় জানিয়ে দিচ্ছি
যারা লাথি মারে ইতিহাস তাদের মুছে ফেলে
যারা লাথি খায় তারাই হাতমুঠো ক’রে উঠে দাঁড়ায়
মনে রাখবেন হাড়জিরজিরে খালি-পা রুশ যুদ্ধবন্দীদের
এগারো জন
সাঁজোয়া জার্মান দলকে পুঁতে ফেলেছিল
খেলার শেষে এগারো রুশকে গুলি ক’রে মারা হয়েছিল
মনে রাখবেন ফেরেঙ্ক্ পুসকাস
ছেঁড়া ন্যাকড়ার দলা পাকিয়ে খেলতে শিখেছিলেন
তেরেস কোরাকোয়েস–সেই শহরের গরীব ছেলে ‘দিকো’
সাত বছর বয়সে যে করতো জুতো পালিশ
দুনিয়ার ফুটবল পাল্টে দিয়ে হলো ‘পেলে’
ইউরোপের সেরা ফুটবলারের ট্রফি লম্বা চুল ছেলে
রুড গুলিট উৎসর্গ করেছে নেলসন ম্যাণ্ডেলার নামে
এগুলো আপনারা মনে রাখবেন
যে সব ব্যবসাদার, ফড়ে, মহাজন, স্মাগলার, ডাক্তার, মন্ত্রী
আপনারা, যাঁরা বড় বড় ক্লাবের পাণ্ডা, ময়দানের মা বাপ
আপনি ভাবছেন কী ক’রে চিনবেন আমাদের
আমাদের প্রত্যেকের হাতে রয়েছে লাল কার্ড
আমাদের ছোট ছোট ক্লাবের টুকরো টুকরো মেঘ মেঘ পতাকা
একসঙ্গে হলে আকাশ মাপের একটা নিশান তৈরি হবে
আমাদের জার্সির ফালিগুলো জুড়লে
দেখা যাবে ক্ষ্যাপা বাউলের সেই আশ্চর্য জোববা
আমাদের বুদ্ধি, মেহনত ও অঙ্গীকার এক হলে
সমুদ্রও তাজ্জব হয়ে যাবে উপযুক্ত প্রতিপক্ষ দেখে
হারাবার জন্যে আছে হীনমন্যতা, আমিত্ব, নিজেকে না চিনতে
পারা
অথচ আমরা পারি, আমরাই পারি
ফুটবলের ইতিহাসটা ঢেলে সাজাতে
প্রত্যেকটা স্টেডিয়ামের ভি আই পি গ্যালারিতে
কাদামাখা রাগী বল ছুঁড়ে দিয়ে
জাল ছিঁড়ে, বার কাঁপিয়ে
লীগ, শীল্ড, ডুরাণ্ড, রোভার্স— সর্বত্র অঘটন ঘটিয়ে
ওদের হিসেব, কেতাব, খাতা— তোলপাড় ক’রে দিতে পারি
আবার একবার, এবার আরো জোর গলায় জানিয়ে দিচ্ছি
যারা লাথি মারে ইতিহাস তাদের মুছে ফেলে
যারা লাথি খায় তারাই হাতমুঠো ক’রে উঠে দাঁড়ায়
লুম্পেনদের লিরিক
রোজ রাত্তিরে আমাদের জুয়ায়
কেউ না কেউ জিতেই নেয় চাঁদ
চাঁদ ভাঙিয়ে আমরা খুচরো তারা
করে নিই
আমাদের পকেটগুলো ফুটো
সেই ফুটো দিয়ে গলে
সব তারা পড়ে যায়
উড়ে চলে যায় তারা আকাশে
তখন আমাদের ফ্যাকাশে চোখে ঘুম আসে
স্বপ্নের বাকুনিতে আমরা থরথর করে কাঁপি
আমাদের নিয়ে রাত চলতে থাকে
রাত একটা পুলিশভ্যান
রাত একটা কালো পুলিশভ্যান
শঙ্কিত কথামালা
কখনো বিদেশ থেকে ফিরে আসো। সেই চেনা ঘর
যার কোণে কোণে রাতভোর কথামালা ভাসে
তবু দেখো যে খুশিতে সুখ হল পর
তার নাম নেই। শুধু বাতাসের নৌকায় আসে
সে দেশের কোন নদী, কোন গাছ, কোন ডুবোচর।
তোমার নিকটে এসে আর কে আমার মতো একা
জানা নেই। প্রতিটি অদেয় কথা করেছিল ভুল
জলের ওপরে আলো অনেক কি দেখেছিল লেখা
কুয়াশায় পথে ঘুরে অবেলায় ভার হল চুল
কান্নার স্থির জলে করতলে মিলায় না রেখা।
তোমার যাওয়ার সাথে কী ফুল চিতায় যাবে, যুঁই
যার নেশা হলে মাথা নিচু করে পথ চলে
যায় আসে। টলমলে রাস্তাতে চিঠি কাটে উই
তবু ছিল দিনমানে প্রেম। দেহ কথা বলে
ভাবে রাত্রির শেষ দেখে মুখ ঢেকে শুই।
কখন যে ঘর থেকে চলে যাবে। এই ভাঙা হাট
সেরে হাটুরেরা সারি দিয়ে ঘরে ফিরে যায়
তোমার প্রেমিক তারা নতমুখ শ্রদ্ধায় লজ্জায় কাঠ
ধুলো আর কথামালা সন্ধ্যার নিঃস্ব হাওয়ায়
তোমার বিদেশ নিয়ে অগণিত বিকেলের খেলবার মাঠ।
শর্ত
তুমি কি পুকুরের পাশে মুখ বুজে ফুটতে পারবে রৌদ্রে বৃষ্টিতে
অপমানিত দেশজ শাকপাতার মত
যদি না পারো তুমি বিপ্লবের উত্তরাধিকারী নও
চূড়ান্ত খরায় তুমি পাতাল দাঁতে কেটে উঠে আসতে পারবে ভূগর্ভ থেকে
তুমি কলসীতে ও আঁজলায় তেষ্টা মেটাতে জানো
যদি না পারো রক্তপতাকা হাতে নিও না
তুমি গাছের ছায়ায় যদি পুড়ে যেতে রাজী থাকো
অন্ধকারে তোমাকে যদি আকাশপ্রদীপের মত দেখায়
তবেই তুমি এই মানমন্দির বানাতে এসো
আর যদি তা না পারো তবে যাও
কর্কশ শ্লোগান দিয়ে লুম্পেনের হরিধবনির মত ঘুম কাড়ো
সঙ্ঘ টুকরো করো, চক্র বানাও, চক্রান্তে মাতো
মানুষকে মিথ্যা আলো দেখাও, শিশুদের কষ্ট দাও, রমণীকে দুঃখ
গোপন উল্লাসে মাতো, পরিণত হও ক্রীতদাসে, কোঠাবাড়ি ওঠাও
তোমার সমগ্র মাথা ব্যালট-বাক্সের মত অর্থহীন কাগজে ভরাট হয়ে যাক
এবং মনে রেখ তোমার ও লাল
বড় কপট এক খুনখারাবি রৎ আদপে
মরচের ওরকম রং হয়, জং ধরার রং
হাতুড়ি ও কাস্তেকে তুমি আচল করে দেওয়ার চেষ্টায় মেতেছে।
শীত সন্ধ্যার পার্ক স্ট্রিট
এই সময়খণ্ডের মধ্যে নরকের অশুভ আলোয়
যে-কোনো আঘাত, সূক্ষ্মতম রক্তচিহ্ন
অপরিমেয় ক্ষতিকারক
অসুস্থতা মিশে গেছে দেহে
নিদ্রার সমুদ্রে দুঃস্বপ্নের নৌকো
একক আরোহীর সন্ত্রাস
হাসি ও খিলখিল জলরাশি
ফেনিল তীব্র অবসাদ
সময়কে ব্যবচ্ছেদ করে সন্ধ্যার আলোক ছুরিকা।
বিপণিতে ভিড় ও আলো কিন্তু ক্রমবর্ধমান শূন্যতা
পথে কোলাহল ও আলো কিন্তু ক্রমপ্রসারমান নৈঃশব্দ্য
বাতাসের তোরঙ্গে দেহ ও আলো কিন্তু ক্রমস্ফীতমান মৃত্যু।
দোকানে সাজানো মৃত শিশুদের শব
হাড়, করোটি, দ্রবণে ভেজানো হৃৎপিণ্ড
বুদ্ধিমান শূকরের যকৃত, যশাকাঙক্ষী শূকরের
মৃত্যু আর্তনাদ
নিরেট কঠিন শব্দে আন্দোলিত কঙ্কাল
ইতস্তত চিতার ধারে শীতার্ত শৃগাল
গলিত সীসার আভায় দেখা যায়
স্তূপীকৃত মৃত নারীদের পোশাক
বিষ্ঠায় নির্মিত বিগ্ৰহ
আকাশের ধূমকুণ্ডে মিশে গেছে
অগ্নিদগ্ধ মুখ, কুষ্ঠরোগীর মুখ, কৃমি
বিচ্ছিন্ন হস্ত, কণ্ঠ দ্বিখণ্ডিত গলনালী
যৌন ক্রীড়ারত প্রেত, প্রেতকন্যা
হস্তমৈথুনের পর বিমর্ষ দেবদূত, পিশাচ
নরকের ভীতিপ্রদ কীটদের
সৌন্দর্য ও স্বাস্থ্যের প্রতিযোগিতা।
দোকানে সাজানো মৃত শিশুদের শবাধার
রক্তাক্ত খেলনা, অর্ধভুক্ত বিষাক্ত ফল
ইতস্তত চিতার মধ্যে আগুনে নিক্ষিপ্ত ফুল
হাড়, মজ্জা, স্নায়ুর তুমুল শব্দ
আরকে নিমজ্জিত লাস্যময়ী সুন্দরীর মুখ
কিন্তু শব্দহীন যেহেতু জিভ নেই।
এই সময়খণ্ডের মধ্যে নরকের অশুভ আলোয়
যে কোনো স্মৃতি, দূরতম বিষাদ
অপরিমেয় ক্ষতিকারক
দুর্বলতা মিশে গেছে নিঃশ্বাসে
নিদ্রার সমুদ্রে দুঃস্বপ্নের নৌকা
একক জ্বলন্ত আরোহী
ভীতি ও খিলখিল জলরাশি
জ্বরের দুর্বোধ্য বিকার
সময়ের ব্যবচ্ছেদে রত সন্ধ্যার আলোক ছুরিকা।
দেহে শীতের চরম সাবধানতা কিন্তু ক্রমপ্রকাশমান নগ্নতা
পথে তীব্র ভিড় কিন্তু ক্রমবর্ধমান দূরত্ব
অস্তিত্বে অটুট বিশ্বাস কিন্তু অনাত্মার ব্যাধির মতো
অবাধ প্রসার।
শেষ ইচ্ছে
আমি মরে গেলে
আমি শব্দ দিয়ে যে বাড়িটা তৈরি করেছি
সেটা কান্নায় ভেঙে পড়বে
তাতে অবাক হবার কিছু নেই
বাড়ির আয়না আমাকে মুছে ফেলবে
দেওয়ালে আমার ছবি রাখবে না
দেওয়াল আমার ভালো লাগত না
তখন আকাশ আমার দেওয়াল
তাতে চিমনির ধোঁয়া দিয়ে পাখিরা
আমার নাম লিখবে
অথবা আকাশ তখন আমার লেখার টেবিল
ঠাণ্ডা পেপারওয়েট হবে চাঁদ
কালো ভেলভেটের পিনকুশনে ফোটানো থাকবে তারা
আমাকে মনে করে তোমার
দুঃখ করার কিছু নেই
এই কথাগুলো লেখার সময় আমার হাত কাঁপছে না
কিন্তু যখন প্রথম তোমার হাত ধরেছিলাম
তখন আমার হাত থরথর করে কেঁপেছিল
কিছুটা আবেগে কিছুটা আড়ষ্টতায়
আমার সুন্দরী স্ত্রী আমার প্রেয়সী
আমার স্মৃতি তোমাকে ঘিরে থাকবে
তোমার তাকে আঁকড়ে থাকার কিছু নেই
তুমি নিজের জীবন গড়ে নিও
আমার স্মৃতি তোমার কমরেড
তুমি যদি কাউকে ভালোবাস
তাকে এই স্মৃতিগুলো দিয়ে দিও
তাকে কমরেড করে নিও
অবশ্য আমি সবটা তোমার ওপরে ছেড়ে দিচ্ছি
আমি বিশ্বাস করি তুমি ভুল করবে না
তুমি আমার ছেলেকে
প্রথম অক্ষর শেখাবার সময়ে
ওকে মানুষ, রোদুর আর তারাদের ভালোবাসতে শিখিও
ও অনেক কঠিন কঠিন অঙ্ক করতে পারবে
বিপ্লবের অ্যালজেব্রা ও আমার চেয়ে
অনেক ভালো করে বুঝবে
আমাকে হাঁটতে শেখাবে মিছিলে
পাথুরে জমিতে আর ঘাসে
আমার দোষগুলোর কথা ওকে বোলো
ও যেন আমাকে না বকে
আমার মরে যাওয়াটা কোনো বড় কথা নয়
খুব বেশিদিন আমি বঁচিব না
এটা আমি জানতাম
কিন্তু আমার বিশ্বাস কখনও হটে যায়নি
সমস্ত মৃত্যুকে অতিক্রম করে
সমস্ত অন্ধকার অস্বীকার করে
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হয়েছে
বিপ্লব চিরজীবী হয়েছে।
সংবাদ মূলত কবিতা
অন্ধকারে একের পর এক জিপ
হেডলাইটের জাল পরানো আলো
সারা আকাশ স্তব্ধ নিষ্প্রদীপ
থামল এসে একের পর এক জিপ
কবে ? কখন ? কোথায় ঘটেছিল ?
বুটের তলায় চমকে ওঠা মাটি
ঘুমের থেকে লাফিয়ে ওঠা ঘাস
গলার মধ্যে থমকে থাকা ভয়
কোথায় লাগে লণ্ঠন আর লাঠি
তখন কাকে কে দেবে আশ্বাস
বাঘের জবাব শিশুর হাসি নয়
অন্ধ গ্রামে হাজার আতসবাজি
মেশিনগানের জ্বলন্ত তোতলামি
উঁচু জাতের আজব এ কারসাজি
জমাট সীসের গলন্ত মাতলামি।
সকাল হলে প্রখর সূর্যালোকে
অনেকগুলো নিচু জাতের লাশ
মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে থাকে
চোখের ওপর, প্রখর সূর্যালোকে।
কবে ? কোথায়? কখন ঘটেছিল ?
চোখের ভুলে খবর রটেছিল ?
বুদ্ধিজীবী এসব প্রশ্নে কালা
এসব দৃশ্যে বুদ্ধিজীবী কানা
এত কিছুর পরেও পাবে শোভা
বুদ্ধি ভরাট নধর মুণ্ডুখানা?
সমাজবিরোধিতার কথা
একটি সজীব মৃতদেহ যখন অপরাপর পুষ্ট
মৃতদেহকে উৎসাহ দেয়
লুকিয়ে মানুষকে ফাঁসি দেওয়ার জন্যে সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র
যখন বেশ্যার মতো সজাগ
একটা কুকুর যখন বাস চাপা পড়ার পরে
রাস্তায় চাদের আলোয় রক্তে ভিজে শুয়ে থাকে
আর তার শেষ চিৎকার টেপ রেকর্ড করে
যখন কবি ও লেখকবৃন্দ পোকা ধরার জন্যে
বড় বড় আলোর পাশে ওঁৎ পেতে থাকে
যখন একটা লোকের সাতশোটা লরি ভাড়া খাটে
আর একটা লোক ক্রাচ নিয়ে রাস্তা পার হয়
তেখন আমৃত্যু লিখে যাব প্রতিবাদ
উন্মত্ত হিংস্র ও ক্রুদ্ধ নিরবধি
এ যদি সমাজ হয়
তবে আমি সমাজবিরোধী
সাত যুবক
অন্ধকার, অবৈদ্যুতিক, দাঁতউঁচু শহর
তার মধ্যে একফালি কানামাঠ
সেখানে সাতটি যুবক বসে
সিগারেট খাচ্ছিলো
সিগারেটের ফুঁসে ওঠা আগুনে
তাদের আলোচনা লাল বলে মনে হোল খোঁচোড়ের
বেলুনের মত ডবকা মেয়েদের
এরা দেখছে না
বিস্ফোরক কোনো আলোচনা করছে ওরা
ওরা কি শহরটা উড়িয়ে দেবে
ওরা কি ওলট পালট করে দিতে চায়
ওরা কী চায়
ঐ আলোচনারত যুবকেরা
লেজ নড়ে উঠল সাঁজোয়া ভবনের
রোবট বাহিনী ছুটে এল লোহার হোটেল থেকে
মাঠটাকে চারদিক থেকে ঘিরে এল
সন্দেহের বোতল, ফ্ল্যাশগান, কর্কশ জেনারেটর
বন্দুক, বিষাক্ত ঠোঁট, ভয়, সঙ্গমরত পশু
পারমাণবিক জিভ, ধাতব খবরের কাগজ
টিন, দাঁত, বুট, বেতাল
কিছুই নেই
সচল সাহসী কুয়াশা এক জায়গায়
জড়ো হয়েছে
তার মধ্যে জোনাকিরা জ্বলছে
অন্ধকারে সাত যুবককে ভুল দেখা গেছে
আপাতত সবকিছু ঠিক থাকছে
সামন্তর বন্দুক উধাও
আশ্চর্য গোলক চাঁদের ছদ্মবেশে
মায়াবী মাটি ও তৃণ, ঘাসের মণ্ডলে এসে
হিমমাখা পাখির ঠোঁটে কুয়াশার স্পর্শ দিল
যাও, এই খড়কুটো নিয়ে ত্বরা যাও
পোটোপাড়া ঘুমে অচেতন
সামন্তর বন্দুক উধাও
কাদামাখা নদী তার বুকধোয়া কাদাজল নিয়ে
শামুক ও কামটের ধারালো নদীর কাছে গিয়ে
গল্পটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে
অপার সমুদ্র করে দিল
হে সমুদ্র সমুদ্র আকাশ
তোমার কি মনে হয় ঐ সব কাশগুলি
মাটিতে বিধিয়ে ফলা
অসংখ্য লক্ষ্যভ্রষ্ট তীর
কী শান্ত ভীত রাত ঘুমন্ত পাখির
এইসব অন্ধকারে স্তনবৃন্তে দুধ আসে
মাঠের মধ্য দিয়ে আলো বয়ে নিয়ে আসে ট্রেন
শিশুর ঘুমের মধ্যে ট্রেনের অযুত শব্দ চলে গেলে দূরে
দূরপাল্লার তারা ঘুরপাক খেয়ে খসে পড়ে
কী দাহ্য তার ঠোঁট
বারুদ রেখেছে কেউ ঘরে
ঐ জাগে
চাঁদের ছদ্মবেশে আশ্চর্য গোলক
উপবাস অন্তে তুমি অন্নের পিণ্ড হতে চাও
জ্যোৎস্নায় কখনও কি তেজস্ক্রিয়া থাকে
সামন্তর বন্দুক উধাও
সার্কাসের অসুখ
ডাক্তার, অসম্ভব আনন্দ হচ্ছে
সম্পূর্ণ সুস্থ আপাতত
গত দুবছর আগে সম্ভবত শীতে
শহরে সার্কাস হয়েছিল
এবারে বুকের মধ্যে সার্কাসের শুরু
থ্যাতলানো ঠোঁটের মধ্যে রক্তের নুন
ক্লাউন! ক্লাউন!
অসম্ভব আনন্দ হচ্ছে ডাক্তার
রক্তের মধ্যে কোথাও তার ছিঁড়ে গেলে
শ্বাসরুদ্ধ থেমে থাকে ট্রাম
তার তিনচোখ নিভে যায় চিৎকার করে
মাথার মধ্যে কোথাও স্নায়ু ছিঁড়ে
ওজনহীন ঘিলুর মধ্যে বাল্বের ছেঁড়া
ফিলামেণ্ট তারের মতো কাঁপে
ধরা যাক ভাগ্যবান মানুষটি তখন
ট্রাপিজে উড়ছে
তারপর ?
সম্পূর্ণ সুস্থ আপাতত।
আপনার চারপাশে, ডাক্তার
পড়ে থাকে ইতস্তত
শিশুদের হাসপাতালে বোমাবর্ষণের পর
রক্তমাখা নিকারবোকার
মূক ও বধিরদের ইস্কুলের মতো নিস্তব্ধতায়
নিজের বেঁচে থাকাটা কম্যাণ্ডো তৎপরতা
বলে মনে হয়েছিল
আর মনে হবে না কখনও
সম্পূর্ণ সুস্থ আপাতত।
ইতিমধ্যে রক্ত জমে পথ আটকায়
কার্ডিয়োগ্রামের মতো রেখাঙ্কিত চেতনার স্রোতে
ডাক্তার, সে এক দুর্ধর্ষ আবেশ
নিজের পাঠানো এস. ও. এস.
আয়নায় ধাক্কা খেয়ে নিজের শরীরে
ফিরে আসে
ডাক্তার, ভীষণ মজা শীতের সার্কাসে।
মর্গের টেবিল জুড়ে ছড়ানো জমাট রক্তে
আটকে থাকা মাছির মতো নিভন্ত আরামে
আমার অসংখ্য ঠোঁট নিয়নের জ্বরে পোড়া
শহরের কপালের দিকে নামে
হল্ট ! হঠাৎ ব্রেক বা ভয়ে থেমে যায় ট্রাম
নিহত ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়াবার ড্রাম
ডাক্তার ? সম্পূর্ণ সুস্থ আপাতত
থ্যাতলানো ঠোঁটের মধ্যে রক্তের নুন
ক্লাউন! ক্লাউন !
সম্পূর্ণ সুস্থ আপাতত
গত দুবছর আগে সম্ভবত শীতে
শহরে সার্কাস হয়েছিল
এবারে বুকের মধ্যে সার্কাসের শুরু।
স্বদেশ গাথা (প্রেরণা গোবিন্দচন্দ্র দাস)
স্বদেশ নয় এ, মড়ার ভাগাড়
চলতে ফিরতে পায়ে ফোটে হাড়
লাশের বিলাস, লাশের পাহাড়
যেই দিকে চাই, দুচোখময়।
গোবিন্দদাস থাকলে বলত
কথায় তাহার আগুন জ্বলত
যাহার দাপে গরীব কাঁপে
ঠিক যেন সে অন্ধ হয়
স্বদেশ, স্বদেশ করছ কাকে—এদেশ তোমার নয়।
ভূস্বর্গে যে উপবাসী
শাস্ত্রে তারাই নরকবাসী
খাদ্য তাহার পচা, বাসি
নর্দমা উচ্ছিষ্টময়
শোষক চতুর বেনের দেশে
কক্ষনো তার জায়গা হয় ?
সংবিধানে কার অধিকার
বেকারি আর ক্ষুধায় মরার
বাঁচতে বেশ্যাবৃত্তি করার
চক্ষু যাহার বাষ্পময়
বুদ্ধিজীবীর মাতৃভূমি,
শস্যজীবী নিরাশ্রয়।
গোবিন্দদাস থাকত যদি
বলত কাব্যে নিরবধি
বুদ্ধিজীবীর পাছায় দুচোখ
আকাশ তাহার দেখতে নয়
স্বদেশ, স্বদেশ করছ কাকে—এদেশ তোমার নয়।
শেয়াল শকুন পথের ধারে
কাপড় খুলে ন্যাংটো করে
যাহার চিত্র চিত্রকরের
দেশ-বিদেশে কদর হয়
সংবাদে তার কান্না ছাপে
সাহিত্যিকের চক্ষু ভাপে
ঠোঁটের ডগায় সিগার কাঁপে
মদ গিলিয়া শান্ত হয়
কলম শুধু মলম লাগায়
ক্ষত যেমন তেমন রয়।
বিবেক রাখে পর্দা ঢাকা,
তাকে রবীন্দ্রনাথ রাখা
শাক দিয়ে মাছ নিত্য ঢাকা
সেবাদাসের কর্ম হয়
গোবিন্দদাস বলত থাকলে
সারাজীবন বিষ্ঠা মাখলে
কৃত্রিম এই ধুপের ধোঁয়ায়
গুয়ের কুবাস বিদায় হয় ?
স্বদেশ, স্বদেশ করছ কাকে—এদেশ তোমার নয়।
রেলস্টেশনে, হাসপাতালে
বাজার খোলা, খাস চাতালে
শহর নগর রেল পাতালে
কাহার দিবস রাত্রি হয়
জেলহাজতে, হাড়িকাঠে
দুইবেলা যার মুণ্ডু কাটে
চিতা যাহার জ্বলছে মাঠে
শ্মশানে চোখ অশ্রুময়
স্বদেশ, স্বদেশ করছ কাকে—এদেশ তোমার নয়।
স্লোগানের কবিতা
স্লোগানের কবিতা । নবারুণ ভট্টাচার্য
জ্বেলেছো কি জ্বালার আগুন
খুনের বদলা জেনো খুন
নাচালেই বেয়াদব ঝুঁটি
ঝুলব কামড়ে ধরে টুঁটি।
চুমু খাও চুমু ফিরে পাবে
ছুঁয়েছ কি জড়াব দুহাতে
ছায়ায় বসাও রোদ থেকে
স্বপ্ন ফিরিয়ে দেব রাতে।
মনে রেখো কিসের কী দাম
কলার তুললে নামে মাথা
ছুরির ধারালো চিৎকারে
ফালি ফালি হয় নীরবতা।
জ্বেলেছো কি জ্বালার আগুন
ঝুলব কামড়ে ধরে টুঁটি
নাচিয়ো না বেয়াদব ঝুঁটি
খুনের বদলা জেনো খুন।
হাত দেখার কবিতা
আমি শুধু কবিতা লিখি
এটা মোটেই কাজের কথা নয়
কথাটা শুনলে অনেকেরই হাসি পাবে
আমি কিন্তু হাত দেখতেও জানি।
আমি বাতাসের হাত দেখেছি
বাতাস একদিন ঝড় হয়ে সবচেয়ে
উঁচু বাড়িগুলোকে ফেলে দেবে
আমি বাচ্চা ভিখিরিদের হাত দেখেছি
ওদের আগামী দিনে কষ্ট যদিও বা কমে
ঠিক করে কিছুই বলা যাচ্ছে না
আমি বৃষ্টির হাত দেখেছি
তার মাথার কোনো ঠিক নেই
তাই আপনাদের সকলেরই একটা করে
ছাতা থাকার দরকার
স্বপ্নের হাত আমি দেখেছি
তাকে গড়ে তুলতে হলে ভেঙেচুরে ফেলতে হবে ঘুম
ভালোবাসার হাতও আমি দেখেছি
না চাইলেও সে সকলকে আঁকড়ে থাকবে
বিপ্লবীদের হাত দেখা খুব ভাগ্যের ব্যাপার
একসঙ্গে তাদের পাওয়াই যায় না
আর বোমা ফেটে তো অনেকের হাতই উড়ে গেছে
বড়লোকদের প্রকাণ্ড হাতও আমাকে দেখতে হয়েছে
ওদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার
আমি ভীষণ দুঃখের রাতের হাত দেখেছি
তার সকাল আসছে।
আমি যত কবিতা লিখেছি
হাত দেখেছি তার চেয়ে ঢের বেশি
দয়া করে আমার কথা শুনে হাসবেন না
আমি নিজের হাতও দেখেছি
আমার ভবিষ্যৎ আপনাদের হাতে।
হে লেখক
কলম দিয়ে কাগজে বুলিয়ে
আপনি দৃশ্যটিকে
ফুটিয়ে তুলতে পারবেন না
কারণ কেউ পারে না।
দৃশ্যের তলায়
যে বারুদ বা কয়লা আছে
সেখানে একটা ফুলকি
আপনি জ্বালাতে পারেন?
দৃশ্যটি তখনই ফুটবে
টগবগ করে
ফুটবে ফুল গনগনে মাটিতে
ফাটা পোড়া চিড় খাওয়া
মাটিতে ফুল ফুটবে।
আগ্নেয়গিরির মুখে
একটা কেটলি বসানো আছে
সেখানে আজ আমার
চা খাওয়ার নেমন্তন্ন।
হে লেখক, প্রবল পরাক্রান্ত কলমচি
আপনি যাবেন ?
১৯৮৪-র কলকাতা
আমার ঠোঁটের মধ্যে, আমার বুকের গভীরে
ঝড়ের অতল শব্দ, পাতা উড়ে যাওয়া
ধাতব শহরে একা, রোবটের শ্বাসরুদ্ধ ভিড়ে
ভীষণ চিৎকার করি, গলার ঝিল্লি যায় ছিঁড়ে
বোমার ঝলক, আলো, ফেটে পড়ে হাওয়া
আমার ঠোঁটের মধ্যে, আমার বুকের গভীরে
ওলট পালট খেয়ে আয়নার কাছে ঘুরে ফিরে
মাতাল চোখের মত পাতার আড়াল খুঁজে পাওয়া
ধাতব শহরে একা, রোবটের শ্বাসরুদ্ধ ভিড়ে
ভাঙা গ্লাসে, তেষ্টায়, চুমু খেয়ে ঠোঁট গেছে চিরে
গরসে গরসে শুধু ডিজেলের বুদবুদ খাওয়া
আমার ঠোঁটের মধ্যে, আমার বুকের গভীরে
কোথাও রক্তের শব্দ, খোলা ড্রেনে, পাথরের চিড়ে
খোসা ছাড়াবার পর পৃথিবীর বিষাক্ত কোয়া
ধাতব শহরে একা, রোবটের শ্বাসরুদ্ধ ভিড়ে
এ দেহযাপন কি শুধুই স্মৃতিকে ঘিরে ঘিরে
নৌকোর মত করে সমুদ্রের দুঃখসুখ চাওয়া
আমার ঠোটের মধ্যে, আমার বুকের গভীরে
ধাতব শহরে একা, রোবটের শ্বাসরুদ্ধ ভিড়ে