স্বদেশ গাথা (প্রেরণা গোবিন্দচন্দ্র দাস)
স্বদেশ নয় এ, মড়ার ভাগাড়
চলতে ফিরতে পায়ে ফোটে হাড়
লাশের বিলাস, লাশের পাহাড়
যেই দিকে চাই, দুচোখময়।
গোবিন্দদাস থাকলে বলত
কথায় তাহার আগুন জ্বলত
যাহার দাপে গরীব কাঁপে
ঠিক যেন সে অন্ধ হয়
স্বদেশ, স্বদেশ করছ কাকে—এদেশ তোমার নয়।
ভূস্বর্গে যে উপবাসী
শাস্ত্রে তারাই নরকবাসী
খাদ্য তাহার পচা, বাসি
নর্দমা উচ্ছিষ্টময়
শোষক চতুর বেনের দেশে
কক্ষনো তার জায়গা হয় ?
সংবিধানে কার অধিকার
বেকারি আর ক্ষুধায় মরার
বাঁচতে বেশ্যাবৃত্তি করার
চক্ষু যাহার বাষ্পময়
বুদ্ধিজীবীর মাতৃভূমি,
শস্যজীবী নিরাশ্রয়।
গোবিন্দদাস থাকত যদি
বলত কাব্যে নিরবধি
বুদ্ধিজীবীর পাছায় দুচোখ
আকাশ তাহার দেখতে নয়
স্বদেশ, স্বদেশ করছ কাকে—এদেশ তোমার নয়।
শেয়াল শকুন পথের ধারে
কাপড় খুলে ন্যাংটো করে
যাহার চিত্র চিত্রকরের
দেশ-বিদেশে কদর হয়
সংবাদে তার কান্না ছাপে
সাহিত্যিকের চক্ষু ভাপে
ঠোঁটের ডগায় সিগার কাঁপে
মদ গিলিয়া শান্ত হয়
কলম শুধু মলম লাগায়
ক্ষত যেমন তেমন রয়।
বিবেক রাখে পর্দা ঢাকা,
তাকে রবীন্দ্রনাথ রাখা
শাক দিয়ে মাছ নিত্য ঢাকা
সেবাদাসের কর্ম হয়
গোবিন্দদাস বলত থাকলে
সারাজীবন বিষ্ঠা মাখলে
কৃত্রিম এই ধুপের ধোঁয়ায়
গুয়ের কুবাস বিদায় হয় ?
স্বদেশ, স্বদেশ করছ কাকে—এদেশ তোমার নয়।
রেলস্টেশনে, হাসপাতালে
বাজার খোলা, খাস চাতালে
শহর নগর রেল পাতালে
কাহার দিবস রাত্রি হয়
জেলহাজতে, হাড়িকাঠে
দুইবেলা যার মুণ্ডু কাটে
চিতা যাহার জ্বলছে মাঠে
শ্মশানে চোখ অশ্রুময়
স্বদেশ, স্বদেশ করছ কাকে—এদেশ তোমার নয়।
স্লোগানের কবিতা
স্লোগানের কবিতা । নবারুণ ভট্টাচার্য
জ্বেলেছো কি জ্বালার আগুন
খুনের বদলা জেনো খুন
নাচালেই বেয়াদব ঝুঁটি
ঝুলব কামড়ে ধরে টুঁটি।
চুমু খাও চুমু ফিরে পাবে
ছুঁয়েছ কি জড়াব দুহাতে
ছায়ায় বসাও রোদ থেকে
স্বপ্ন ফিরিয়ে দেব রাতে।
মনে রেখো কিসের কী দাম
কলার তুললে নামে মাথা
ছুরির ধারালো চিৎকারে
ফালি ফালি হয় নীরবতা।
জ্বেলেছো কি জ্বালার আগুন
ঝুলব কামড়ে ধরে টুঁটি
নাচিয়ো না বেয়াদব ঝুঁটি
খুনের বদলা জেনো খুন।
হাত দেখার কবিতা
আমি শুধু কবিতা লিখি
এটা মোটেই কাজের কথা নয়
কথাটা শুনলে অনেকেরই হাসি পাবে
আমি কিন্তু হাত দেখতেও জানি।
আমি বাতাসের হাত দেখেছি
বাতাস একদিন ঝড় হয়ে সবচেয়ে
উঁচু বাড়িগুলোকে ফেলে দেবে
আমি বাচ্চা ভিখিরিদের হাত দেখেছি
ওদের আগামী দিনে কষ্ট যদিও বা কমে
ঠিক করে কিছুই বলা যাচ্ছে না
আমি বৃষ্টির হাত দেখেছি
তার মাথার কোনো ঠিক নেই
তাই আপনাদের সকলেরই একটা করে
ছাতা থাকার দরকার
স্বপ্নের হাত আমি দেখেছি
তাকে গড়ে তুলতে হলে ভেঙেচুরে ফেলতে হবে ঘুম
ভালোবাসার হাতও আমি দেখেছি
না চাইলেও সে সকলকে আঁকড়ে থাকবে
বিপ্লবীদের হাত দেখা খুব ভাগ্যের ব্যাপার
একসঙ্গে তাদের পাওয়াই যায় না
আর বোমা ফেটে তো অনেকের হাতই উড়ে গেছে
বড়লোকদের প্রকাণ্ড হাতও আমাকে দেখতে হয়েছে
ওদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার
আমি ভীষণ দুঃখের রাতের হাত দেখেছি
তার সকাল আসছে।
আমি যত কবিতা লিখেছি
হাত দেখেছি তার চেয়ে ঢের বেশি
দয়া করে আমার কথা শুনে হাসবেন না
আমি নিজের হাতও দেখেছি
আমার ভবিষ্যৎ আপনাদের হাতে।
হে লেখক
কলম দিয়ে কাগজে বুলিয়ে
আপনি দৃশ্যটিকে
ফুটিয়ে তুলতে পারবেন না
কারণ কেউ পারে না।
দৃশ্যের তলায়
যে বারুদ বা কয়লা আছে
সেখানে একটা ফুলকি
আপনি জ্বালাতে পারেন?
দৃশ্যটি তখনই ফুটবে
টগবগ করে
ফুটবে ফুল গনগনে মাটিতে
ফাটা পোড়া চিড় খাওয়া
মাটিতে ফুল ফুটবে।
আগ্নেয়গিরির মুখে
একটা কেটলি বসানো আছে
সেখানে আজ আমার
চা খাওয়ার নেমন্তন্ন।
হে লেখক, প্রবল পরাক্রান্ত কলমচি
আপনি যাবেন ?
১৯৮৪-র কলকাতা
আমার ঠোঁটের মধ্যে, আমার বুকের গভীরে
ঝড়ের অতল শব্দ, পাতা উড়ে যাওয়া
ধাতব শহরে একা, রোবটের শ্বাসরুদ্ধ ভিড়ে
ভীষণ চিৎকার করি, গলার ঝিল্লি যায় ছিঁড়ে
বোমার ঝলক, আলো, ফেটে পড়ে হাওয়া
আমার ঠোঁটের মধ্যে, আমার বুকের গভীরে
ওলট পালট খেয়ে আয়নার কাছে ঘুরে ফিরে
মাতাল চোখের মত পাতার আড়াল খুঁজে পাওয়া
ধাতব শহরে একা, রোবটের শ্বাসরুদ্ধ ভিড়ে
ভাঙা গ্লাসে, তেষ্টায়, চুমু খেয়ে ঠোঁট গেছে চিরে
গরসে গরসে শুধু ডিজেলের বুদবুদ খাওয়া
আমার ঠোঁটের মধ্যে, আমার বুকের গভীরে
কোথাও রক্তের শব্দ, খোলা ড্রেনে, পাথরের চিড়ে
খোসা ছাড়াবার পর পৃথিবীর বিষাক্ত কোয়া
ধাতব শহরে একা, রোবটের শ্বাসরুদ্ধ ভিড়ে
এ দেহযাপন কি শুধুই স্মৃতিকে ঘিরে ঘিরে
নৌকোর মত করে সমুদ্রের দুঃখসুখ চাওয়া
আমার ঠোটের মধ্যে, আমার বুকের গভীরে
ধাতব শহরে একা, রোবটের শ্বাসরুদ্ধ ভিড়ে