লুম্পেনদের লিরিক
রোজ রাত্তিরে আমাদের জুয়ায়
কেউ না কেউ জিতেই নেয় চাঁদ
চাঁদ ভাঙিয়ে আমরা খুচরো তারা
করে নিই
আমাদের পকেটগুলো ফুটো
সেই ফুটো দিয়ে গলে
সব তারা পড়ে যায়
উড়ে চলে যায় তারা আকাশে
তখন আমাদের ফ্যাকাশে চোখে ঘুম আসে
স্বপ্নের বাকুনিতে আমরা থরথর করে কাঁপি
আমাদের নিয়ে রাত চলতে থাকে
রাত একটা পুলিশভ্যান
রাত একটা কালো পুলিশভ্যান
শঙ্কিত কথামালা
কখনো বিদেশ থেকে ফিরে আসো। সেই চেনা ঘর
যার কোণে কোণে রাতভোর কথামালা ভাসে
তবু দেখো যে খুশিতে সুখ হল পর
তার নাম নেই। শুধু বাতাসের নৌকায় আসে
সে দেশের কোন নদী, কোন গাছ, কোন ডুবোচর।
তোমার নিকটে এসে আর কে আমার মতো একা
জানা নেই। প্রতিটি অদেয় কথা করেছিল ভুল
জলের ওপরে আলো অনেক কি দেখেছিল লেখা
কুয়াশায় পথে ঘুরে অবেলায় ভার হল চুল
কান্নার স্থির জলে করতলে মিলায় না রেখা।
তোমার যাওয়ার সাথে কী ফুল চিতায় যাবে, যুঁই
যার নেশা হলে মাথা নিচু করে পথ চলে
যায় আসে। টলমলে রাস্তাতে চিঠি কাটে উই
তবু ছিল দিনমানে প্রেম। দেহ কথা বলে
ভাবে রাত্রির শেষ দেখে মুখ ঢেকে শুই।
কখন যে ঘর থেকে চলে যাবে। এই ভাঙা হাট
সেরে হাটুরেরা সারি দিয়ে ঘরে ফিরে যায়
তোমার প্রেমিক তারা নতমুখ শ্রদ্ধায় লজ্জায় কাঠ
ধুলো আর কথামালা সন্ধ্যার নিঃস্ব হাওয়ায়
তোমার বিদেশ নিয়ে অগণিত বিকেলের খেলবার মাঠ।
শর্ত
তুমি কি পুকুরের পাশে মুখ বুজে ফুটতে পারবে রৌদ্রে বৃষ্টিতে
অপমানিত দেশজ শাকপাতার মত
যদি না পারো তুমি বিপ্লবের উত্তরাধিকারী নও
চূড়ান্ত খরায় তুমি পাতাল দাঁতে কেটে উঠে আসতে পারবে ভূগর্ভ থেকে
তুমি কলসীতে ও আঁজলায় তেষ্টা মেটাতে জানো
যদি না পারো রক্তপতাকা হাতে নিও না
তুমি গাছের ছায়ায় যদি পুড়ে যেতে রাজী থাকো
অন্ধকারে তোমাকে যদি আকাশপ্রদীপের মত দেখায়
তবেই তুমি এই মানমন্দির বানাতে এসো
আর যদি তা না পারো তবে যাও
কর্কশ শ্লোগান দিয়ে লুম্পেনের হরিধবনির মত ঘুম কাড়ো
সঙ্ঘ টুকরো করো, চক্র বানাও, চক্রান্তে মাতো
মানুষকে মিথ্যা আলো দেখাও, শিশুদের কষ্ট দাও, রমণীকে দুঃখ
গোপন উল্লাসে মাতো, পরিণত হও ক্রীতদাসে, কোঠাবাড়ি ওঠাও
তোমার সমগ্র মাথা ব্যালট-বাক্সের মত অর্থহীন কাগজে ভরাট হয়ে যাক
এবং মনে রেখ তোমার ও লাল
বড় কপট এক খুনখারাবি রৎ আদপে
মরচের ওরকম রং হয়, জং ধরার রং
হাতুড়ি ও কাস্তেকে তুমি আচল করে দেওয়ার চেষ্টায় মেতেছে।
শীত সন্ধ্যার পার্ক স্ট্রিট
এই সময়খণ্ডের মধ্যে নরকের অশুভ আলোয়
যে-কোনো আঘাত, সূক্ষ্মতম রক্তচিহ্ন
অপরিমেয় ক্ষতিকারক
অসুস্থতা মিশে গেছে দেহে
নিদ্রার সমুদ্রে দুঃস্বপ্নের নৌকো
একক আরোহীর সন্ত্রাস
হাসি ও খিলখিল জলরাশি
ফেনিল তীব্র অবসাদ
সময়কে ব্যবচ্ছেদ করে সন্ধ্যার আলোক ছুরিকা।
বিপণিতে ভিড় ও আলো কিন্তু ক্রমবর্ধমান শূন্যতা
পথে কোলাহল ও আলো কিন্তু ক্রমপ্রসারমান নৈঃশব্দ্য
বাতাসের তোরঙ্গে দেহ ও আলো কিন্তু ক্রমস্ফীতমান মৃত্যু।
দোকানে সাজানো মৃত শিশুদের শব
হাড়, করোটি, দ্রবণে ভেজানো হৃৎপিণ্ড
বুদ্ধিমান শূকরের যকৃত, যশাকাঙক্ষী শূকরের
মৃত্যু আর্তনাদ
নিরেট কঠিন শব্দে আন্দোলিত কঙ্কাল
ইতস্তত চিতার ধারে শীতার্ত শৃগাল
গলিত সীসার আভায় দেখা যায়
স্তূপীকৃত মৃত নারীদের পোশাক
বিষ্ঠায় নির্মিত বিগ্ৰহ
আকাশের ধূমকুণ্ডে মিশে গেছে
অগ্নিদগ্ধ মুখ, কুষ্ঠরোগীর মুখ, কৃমি
বিচ্ছিন্ন হস্ত, কণ্ঠ দ্বিখণ্ডিত গলনালী
যৌন ক্রীড়ারত প্রেত, প্রেতকন্যা
হস্তমৈথুনের পর বিমর্ষ দেবদূত, পিশাচ
নরকের ভীতিপ্রদ কীটদের
সৌন্দর্য ও স্বাস্থ্যের প্রতিযোগিতা।
দোকানে সাজানো মৃত শিশুদের শবাধার
রক্তাক্ত খেলনা, অর্ধভুক্ত বিষাক্ত ফল
ইতস্তত চিতার মধ্যে আগুনে নিক্ষিপ্ত ফুল
হাড়, মজ্জা, স্নায়ুর তুমুল শব্দ
আরকে নিমজ্জিত লাস্যময়ী সুন্দরীর মুখ
কিন্তু শব্দহীন যেহেতু জিভ নেই।
এই সময়খণ্ডের মধ্যে নরকের অশুভ আলোয়
যে কোনো স্মৃতি, দূরতম বিষাদ
অপরিমেয় ক্ষতিকারক
দুর্বলতা মিশে গেছে নিঃশ্বাসে
নিদ্রার সমুদ্রে দুঃস্বপ্নের নৌকা
একক জ্বলন্ত আরোহী
ভীতি ও খিলখিল জলরাশি
জ্বরের দুর্বোধ্য বিকার
সময়ের ব্যবচ্ছেদে রত সন্ধ্যার আলোক ছুরিকা।
দেহে শীতের চরম সাবধানতা কিন্তু ক্রমপ্রকাশমান নগ্নতা
পথে তীব্র ভিড় কিন্তু ক্রমবর্ধমান দূরত্ব
অস্তিত্বে অটুট বিশ্বাস কিন্তু অনাত্মার ব্যাধির মতো
অবাধ প্রসার।
শেষ ইচ্ছে
আমি মরে গেলে
আমি শব্দ দিয়ে যে বাড়িটা তৈরি করেছি
সেটা কান্নায় ভেঙে পড়বে
তাতে অবাক হবার কিছু নেই
বাড়ির আয়না আমাকে মুছে ফেলবে
দেওয়ালে আমার ছবি রাখবে না
দেওয়াল আমার ভালো লাগত না
তখন আকাশ আমার দেওয়াল
তাতে চিমনির ধোঁয়া দিয়ে পাখিরা
আমার নাম লিখবে
অথবা আকাশ তখন আমার লেখার টেবিল
ঠাণ্ডা পেপারওয়েট হবে চাঁদ
কালো ভেলভেটের পিনকুশনে ফোটানো থাকবে তারা
আমাকে মনে করে তোমার
দুঃখ করার কিছু নেই
এই কথাগুলো লেখার সময় আমার হাত কাঁপছে না
কিন্তু যখন প্রথম তোমার হাত ধরেছিলাম
তখন আমার হাত থরথর করে কেঁপেছিল
কিছুটা আবেগে কিছুটা আড়ষ্টতায়
আমার সুন্দরী স্ত্রী আমার প্রেয়সী
আমার স্মৃতি তোমাকে ঘিরে থাকবে
তোমার তাকে আঁকড়ে থাকার কিছু নেই
তুমি নিজের জীবন গড়ে নিও
আমার স্মৃতি তোমার কমরেড
তুমি যদি কাউকে ভালোবাস
তাকে এই স্মৃতিগুলো দিয়ে দিও
তাকে কমরেড করে নিও
অবশ্য আমি সবটা তোমার ওপরে ছেড়ে দিচ্ছি
আমি বিশ্বাস করি তুমি ভুল করবে না
তুমি আমার ছেলেকে
প্রথম অক্ষর শেখাবার সময়ে
ওকে মানুষ, রোদুর আর তারাদের ভালোবাসতে শিখিও
ও অনেক কঠিন কঠিন অঙ্ক করতে পারবে
বিপ্লবের অ্যালজেব্রা ও আমার চেয়ে
অনেক ভালো করে বুঝবে
আমাকে হাঁটতে শেখাবে মিছিলে
পাথুরে জমিতে আর ঘাসে
আমার দোষগুলোর কথা ওকে বোলো
ও যেন আমাকে না বকে
আমার মরে যাওয়াটা কোনো বড় কথা নয়
খুব বেশিদিন আমি বঁচিব না
এটা আমি জানতাম
কিন্তু আমার বিশ্বাস কখনও হটে যায়নি
সমস্ত মৃত্যুকে অতিক্রম করে
সমস্ত অন্ধকার অস্বীকার করে
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হয়েছে
বিপ্লব চিরজীবী হয়েছে।