- বইয়ের নামঃ মহুয়ার গান
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আজি ঘুম নহে, নিশি জাগরণ
৮
(বেদেনীদের গান)
দরবারী কানাড়ি-কাওয়ালি
আজি ঘুম নহে, নিশি জাগরণ।
চাঁদেরে ঘিরি’ নাচে ধীরি ধীরি
তারা অগণন॥
প্রখর-দাহন দিবস-আলো,
নলিনী-দলে ঘুম তখনি ভালো।
চাঁদ চন্দন চোখে বুলালো
খোলো গো নিদ-মহল-আবরণ॥
ঘু’রে ঘু’রে গ্রহ, তারা, বিশ্ব, আনন্দে
নাচিছে নাচুনী ঘূর্ণীর ছন্দে।
লুকোচুরি-নাচ মেঘ তারা মাঝে,
নাচিছে ধরণী আলোছায়া-সাজে,
ঝিল্লির ঘুমুর ঝুমু ঝুমু বাজে
খুলি খুলি পড়ে ফুল-আভরণ॥
আমার গহিন জলের নদী
আমার গহিন জলের নদী
(রাধু পাগলির গান)
ভাটিয়ালি – কাহারবা
আমার গহিন জলের নদী।
আমি তোমার জন্যে ভেসে রহিলাম জনম অবধি॥
ও ভাই তোমার বানে ভেসে গেল আমার বাঁধা ঘর,
আমি চরে এসে বসলাম রে ভাই, ভাসালে সে চর।
এখন সব হারিয়ে তোমার সোঁতে ভাসি নিরবধি॥
আমার ঘর ভাঙিলে ঘর পাব ভাই, ভাঙলে কেন মন,
ও ভাই হারালে আর পাওয়া না যায় মনের রতন।
ও ভাই জোয়ারে মন ফিরেনা আর, ভাটিতে হারায় যদি।
তুমি ভাঙো যখন কূল রে নদী ভাঙো একই ধার,
আর মন যখন ভাঙোরে নদী দুইকূল ভাঙো তার।
ও ভাই চর পড়েনা মনের কূলে, একবার সে ভাঙে যদি॥
একডালি ফুলে ওরে সাজাব কেমন ক’রে
২
(বেদেনীদের গান)
তিলক-কামোদ-দেশ-কাওয়ালি
একডালি ফুলে ওরে সাজাব কেমন ক’রে।
মেঘে মেঘে এলোচুলে আকাশ গিয়াছে ভরে।
সাজাব কেমন ক’রে॥
কেন দিলে বনমালী এইটুকু বন-ডালি,
সাজাতে কি না সাজাতে কুসুম হইল খালি।
ছড়ায়েছে ফুলদল অভিমানে ডালি ধ’রে॥
কেতকী ভাদর-বধূ ঘোম্টা টানিয়া কোণে
লুকায়েছে ফণি-ঘেরা গোপন কাঁটার বনে।
কামিনী ফুল মানে মানে না ছুঁতে পড়েছে ঝ’রে॥
গন্ধ-মাতাল চাঁপা দুলিছে নেশার ঝোঁকে,
নিলাজী টগর-বালা চাহিয়া ডাগর চোখে,
দেখিয়া ঝরার আগে বকুল গিয়াছে ম’রে॥
ও ভাই আমার এ নাও যাত্রী না লয়
১৩
(রাধু পাগলির গান)
ভাটিয়ালি-কার্ফা
ও ভাই আমার এ নাও যাত্রী না লয়
ভাঙা আমার তরী।
আমি আপনারে লয়ে রে ভাই এপার ওপার করি॥
আমায় দেউলিয়া করেছে রে ভাই যে নদীর জল
আমি ডুবে দেখতে এসেছি ভাই সেই জলেরি তল।
আমি ভাস্তে আসি, আসিনি কো কামাতে ভাই কড়ি॥
আমি এই জলেরি আয়নাতে ভাই দেখেছিলাম তায়
এখন আয়না আছে প’ড়ে রে ভাই আয়নার মানুষ নাই।
তাই চোখের জলে নদীর জলে রে
আমি তারেই খুঁজে মরি॥
আমি তারির আশায় তরী লয়ে ঘাটে ব’সে থাকি,
আমার তারির নাম ভাই জপমালা তারেই কেঁদে ডাকি।
আমার নয়ন-তারা লইয়া গেছে রে
নয়ন নদীর জলে ভরি॥
ঐ নদীর জলও শুকায় রে ভাই সে জল আসে ফিরে,
আর মানুষ গেলে ফিরেনা কি দিলে মাথার কিরে।
আমি ভালোবেসে গেলাম ভেসে গো
আমি হলাম দেশান্তরী॥
ওগো নতুন নেশার আমার এ মদ
১১
(মহুয়ার গান)
আশাবরী-কাওয়ালী
(ওগো) নতুন নেশার আমার এ মদ
(বল) কি নাম দেবো এরে বঁধুয়া
গোপীচন্দন গন্ধ মুখে এর
বরণ সোনার চাঁদ-চুঁয়া॥
মধু হ’তে মিঠে পিয়ে আমার মদ
গোধুল রং ধরে কাজল-নীরদ,
প্রিয়েরে প্রিয়তম করে এ মদ মম,
চোখে লাগায় নভো-নীল ছোঁওয়া॥
ঝিম্ হয়ে আসে সুখে জীবন ছেয়ে,
পান্’সে জোছনাতে পান্সি চলে বেয়ে,
মধুর এ মদ নববধূর চেয়ে
আমারি মিতানী এ মহুয়া॥
কত খুঁজিলাম নীল কুমুদ তোরে
৪
(মহুয়ার গান)
কত খুঁজিলাম নীল কুমুদ তোরে।
আছে নীল জলে শূনো সরসী ভ’রে॥
উঠেছে আকাশে চাঁদ, ফুটেছে তারা,
আছে সব, একা মোর কুমুদ হারা।
অভিমানে সে কি গিয়াছে ঝ’রে॥
বিল ঝিল খুঁজি নাই সে যে হায়,
হৃদয় শুধায় চোখে, কোথায় কোথায়।
ঘুমায়ে আছে সে কি আছে লুকায়ে,
সোঁদা মাথা এলোচুল গেল শুকায়ে
নদীরে শুধাই-জল যায় যে সরে॥
কে দিল খোঁপাতে ধুতুরা ফুল লো
১
(বেদে ও বেদেনীদের গান)
কে দিল খোঁপাতে ধুতুরা ফুল লো।
খোঁপা খুলে কেশ হ’ল বাউল লো॥
পথে কে বাজালো মোহন বাঁশি
ঘরে ফিরে যেতে হ’ল ভুল লো।
কে নিল কেড়ে তোর পৈঁচি চুড়ি
বৈঁচি মালায় ছি ছি খোয়ালি কুল লো॥
ও সে বুনো পাগল
পথে বাজায় মাদল,
পায়ে ঝড়ের নাচন
শিরে চাঁচর চুল লো॥
দিল নাকেতে নাক্ছাবি বাব্লা ফুলি
কুঁচের চুড়ি আর ঝুমকো ফুল দুল্ লো।
নিয়ে লাজ দুকূল দিল ঘাঘরি সে
আমায় গাগরী ভাসাল জলে বাতুল লো॥
কোথা চাঁদ আমার
৫
(মহুয়ার গান)
পিলু-কাওয়ালি
কোথা চাঁদ আমার!
নিখিল ভুবন মোর ঘিরিল আঁধার॥
ওগো বন্ধু আমার, হ’তে কুসুম যদি,
রাখিতাম কেশে তুলি’ নিরবধি।
রাখিতাম বুকে চাপি’ হ’তে যদি হার॥
আমার উদয়-তারার শাড়ি ছিঁড়েছে কবে,
কামরাঙা শাঁখা আর হাতে কি রবে।
ফিরে এস, খোলা আজো দখিন-দুয়ার॥
খোলো খোলো খোলো গো দুয়ার
৯
(পালঙ্কের গান)
আড়ানা-কাওয়ালি
খোলো খোলো খোলো গো দুয়ার।
নীল ছাপিয়া এল চাঁদের জোয়ার॥
সঙ্কেত-বাঁশরি বনে বনে বাজে
মনে মনে বাজে
সাজিয়াছে ধরণী অভিসার-সাজে।
নাগর-দোলায় দুলে সাগর পাথার॥
জেগে উ’ঠে কাননে ডেকে ওঠে পাখি
চোখ গেল, চোখ গেল, চোখ গেল!
অসহ রূপের দাহে ঝলসি’ গেল আঁখি,
চোখ গেল, চোখ গেল, চোখ গেল!
ঘুমন্ত যৌবন, তনু, মন, জাগো!
সুন্দরী, সুন্দর-পরশন মাগো।
চল বিরহিণী অভিসারে বঁধুয়ার॥