জাগিলে ‘পারুল’ কি গো ‘সাত ভাই চম্পা’ ডাকে
ভীমপলশ্রী — দাদরা
জাগিলে ‘পারুল’ কি গো ‘সাত ভাই চম্পা’ ডাকে।
উদিলে চন্দ্র-লেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে॥
চলিলে সাগর ঘুরে
অলকার মায়ার পুরে,
ফোটে ফুল নিত্য যথায়
জীবনের ফুল্ল-শাখে॥
আঁধারের বাতায়নে চাহে সাজ লক্ষ তারা,
জাগিছে বন্দিনীরা, টুটে ওই বন্ধ কারা।
থেকো না স্বর্গে ভুলে
এ পারের মর্ত্য কূলে,
ভিড়ায়ো সোনার তরি
আবার এই নদীর বাঁকে॥
ঝরে ঝরঝর কোন্ গভীর গোপন ধারা এ শাঙনে
দেশ-সুরাট — একতালা
ঝরে ঝরঝর কোন্ গভীর গোপন ধারা এ শাঙনে।
আজি রহিয়া রহিয়া গুমরায় হিয়া একা এ আঙনে॥
ঘনিয়া ঘনায় ঝাউ-বীথিকায় বেণু-বন-ছায় রে,
ডাহুকিরে খুঁজি ডাহুক কাঁদে আঁধার গহনে॥
কেয়া-বনে দেয়া তূণীর বাঁধিয়া
গগনে গগনে ফেরে গো কাঁদিয়া।
বেতস-বিতানে নীপ-তরুতলে
শিখী নাচ ভোলে পুছ-পাখা টলে।
মালতী-লতায় এলাইয়া বেণি কাঁদে বিষাদিনী রে,
কাজল-আঁখি কে নয়ন মোছে তমাল-কাননে॥
দুরন্ত বায়ু পুরবৈয়াঁ বহে অধীর আনন্দে
কাফি-সিন্ধু — কাহারবা
দুরন্ত বায়ু পুরবৈয়াঁ
বহে অধীর আনন্দে।
তরঙ্গে দুলে আজি নাইয়া
রণ-তুরঙ্গ-ছন্দে॥
অশান্ত অম্বর-মাঝে
মৃদঙ্গ গুরুগুরু বাজে,
আতঙ্কে থরথর অঙ্গ
মন অনন্তে বন্দে॥
ভুজঙ্গী দামিনীর দাহে
দিগন্ত শিহরিয়া চাহে,
বিষণ্ণ-ভয়-ভীতা যামিনী
খোঁজে সে তারা চন্দে॥
মালঞ্চে এ কী ফুল-খেলা
আনন্দ ফোটে যূথী-বেলা,
কুরঙ্গী নাচে শিখী-সঙ্গে
মাতি কদম্ব-গন্ধে॥
একান্তে তরুণী তমালী
অপাঙ্গে মাখে আজি কালি,
বনান্তে বাঁধা পল দেয়া
কেয়া-বেণির বন্ধে॥
দিনান্তে বসি কবি একা
পড়িস কি জলধারা-লেখা,
হিয়ায় কি কাঁদে কুহু-কেকা
আজি অশান্ত দ্বন্দ্বে॥
নমো হে নমো যন্ত্রপতি নমো নমো অশান্ত
বৃন্দাবনী সারং — ঝাঁপতাল
নমো হে নমো যন্ত্রপতি নমো নমো অশান্ত।
তন্ত্রে তব ত্রস্ত ধরা, সৃষ্টি পথভ্রান্ত॥
বিশ্ব হল বস্তুময়
মন্ত্রে তব হে,
নন্দনে-আনন্দে তুমি
গ্রাসিলে মহাধ্বান্ত॥
শংকর হে, সে কোন্ সতী-শোকে হয়ে নৃশংস
বসেছ ধ্যানে হয়েছে জড় সাধিতেছ এ ধ্বংস।
রুক্ষ তব দৃষ্টি-দাহে
শুষ্ক সব হে,
ভীষণ তব চক্রাঘাতে
নির্জিত যুগান্ত॥
নহে নহে প্রিয়, এ নয় আঁখি-জল
দুর্গা কাওয়ালি
নহে নহে প্রিয়, এ নয় আঁখি-জল।
মলিন হয়েছে ঘুমে চোখের কাজল॥
হেরিয়া নিশি-প্রভাতে
শিশির কমল-পাতে,
ভাব বুঝি বেদনাতে
কেঁদেছে কমল॥
মরুতে চরণ ফেলে
কেন বন-মৃগ এলে,
সলিল চাহিতে পেলে
মরীচিকা-ছল॥
এ শুধু শীতের মেঘে
কপট কুয়াশা লেগে
ছলনা উঠেছে জেগে —
এ নহে বাদল॥
কেন কবি খালি খালি
হলি রে চোখের বালি,
কাঁদাতে গিয়া কাঁদালি
নিজেরে কেবল॥
নিশি ভোর হল জাগিয়া পরান-পিয়া
ভৈরবী — কাহারবা
নিশি ভোর হল জাগিয়া
পরান-পিয়া।
কাঁদে ‘পিউ কাঁহা’ পাপিয়া
পরান-পিয়া॥
ভুলি বুলবুলি-সোহাগে
কত গুলবদনি জাগে,
রাতি গুলশনে যাপিয়া
পরান-পিয়া॥
জেগে রয় জাগার সাথি
দূরে চাঁদ, শিয়রে বাতি,
কাঁদি ফুল-শয়ন পাতিয়া,
পরান-পিয়া॥
কত আর সাজাব ডালা,
বাসি হয় নিতি যে মালা,
কত দূর যাব ভাসিয়া,
পরান-পিয়া
গেয়ে গান চেয়ে কাহারে
জেগে রস কবি এপারে
দিলি দান কারে এ হিয়া,
পরান-পিয়া॥
পরদেশি বঁধুয়া, এলে কি এতদিনে
বিহারী — ঠুংরি
পরদেশি বঁধুয়া,
এলে কি এতদিনে।
আসিলে এতদিনে
কেমনে পথ চিনে॥
তোমারে খুঁজিয়া
কত রবি শশী
অন্ধ হইল প্রিয়,
নিভিল তিমিরে,
তব আশে আকাশ
তারা-দীপ জ্বালি
জাগিয়াছে নিশি
ঝুরিয়া শিশিরে!
শুকায়েছে স্বরগ,
দেবতা, তোমা বিনে॥
কত জনম ধরি
ছিলে বলো পাশরি,
এতদিনে বাঁশরি
বাজিল কি বিপিনে॥
নিতি ফুল-সনে
ফুটিয়া কাননে
ঝরিয়াছি সাঝেঁ
নিরাশ হুতাশে,
নব নব গানে
বেদনা নিবেদন
করিয়াছি কবি,
প্রিয়, তব পাশে!
এলে আজি উদাসী
নিখিল-মন জিনে॥
পরান-প্রিয়! কেন এলে অবেলায়
পিলু — দাদারা
পরান-প্রিয়! কেন এলে অবেলায়।
শীতল হিমেল বায়ে ফুল ঝরে যায়॥
সেদিনও সকাল বেলা
খেলেছি কুসুম-খেলা,
আজি যে কাঁদি একেলা
এ ভাঙা মেলায়,
কেন এলে অবেলায়॥
ক্লান্ত দিবস দূরে
কাঁদিছে পিলুর সুরে,
কেন শত পথ ঘুরে
আসিলে হেথায়॥
পুরবের তরুণ অরুণ পুরবে আসলে ফিরে
ভীমপলশ্রী — দাদরা
পুরবের তরুণ অরুণ
পুরবে আসলে ফিরে
কাঁদায়ে মহাশ্বেতায়
হিমানীর শৈল-শিরে॥
কুহেলির পর্দা ডারি
ঘুমাত রূপ-কুমারী,
জাগালে স্বপনচারী
তাহারে নয়ন-নীরে॥
তোমার ওই তরুণ গলার
শুনি গান সিন্ধু-পারে,
দুলিছ মধ্যমণি
সুরমার কণ্ঠ-হারে।
ধেয়ানি দিলে ধরা,
হল সুর স্বয়ংবরা,
এলে কি পাগল-ঝোরা
পাষাণের বক্ষ চিরে॥
বসিয়া বিজনে কেন একা মনে
বসিয়া বিজনে কেন একা মনে
পাণিয়া ভরণে চল লো গোরী
চল জলে চল কাঁদে বনতল,
ডাকে ছলছল জল-লহরী।।
দিন চলে যায় বলাকা-পাখায়,
বিহগের বুকে বিহগী লুকায়!
কেঁদে চখা-চখি মাগিছে বিদায়
বারোয়ার সুরে ঝুরে বাশরি।।
সাঁঝ হেরে মুখ চাঁদ-মুকুরে
ছায়াপথ-সিঁথি রচি চিকুরে,
নাচে ছায়া-নটি কানন-পুরে
দুলে রটপট লতা-কবরী।।
‘বেলা গেল বধূ’ ডাকে ননদী,
চল জল নিতে যাবি লো যদি,
কালো হয়ে আসে সুদূর নদী,
নাগরিকা-সাজে সাজে নগরী।।
মাঝি বাঁধে তরী সিনান-ঘাটে,
ফিরিছে পথিক বিজন মাঠে,
কারে ভেবে বেলা কাঁদিয়া কাটে
ভর আখি-জলে ঘট গাগরী ।।
ওগো বে-দরদী ও রাঙা পায়ে
মালা হয়ে কে গো গেল জড়ায়ে!
তব সাথে কবি পড়িল গায়ে
পায়ে রাখি তারে না গলে পরি।।
( ইমন-মিশ্র গজল-কাহারবা)