কেন আসিলে যদি যাবে চলি
(দিনের) দুর্গা — আদ্ধা কাওয়ালি
কেন আসিলে যদি যাবে চলি
গাঁথিলে না মালা ছিঁড়ে ফুল-কলি॥
কেন বারেবারে আসিয়া দুয়ারে
ফিরে গেলে পারে কথা নাহি বলি॥
কী কথা বলিতে আসিয়া নিশীথে
শুধু ব্যথা-গীতে গেলে মোরে ছলি॥
প্রভাতের বায়ে কুসুম ফুটায়ে
নিশীথে লুকায়ে উড়ে গেল অলি॥
কবি শুধু জানে, কোন্ অভিমানে
চাহি যারে গানে কেন তারে দলি॥
কেন উচাটন মন পরান এমন করে
বেহাগ-খাম্বাজ — দাদরা
কেন উচাটন মন
পরান এমন করে
কেন কাঁদে গো বধূ
বঁধুর বুকে বাসরে॥
কেন মিলন-রাতে
সলিল আঁখি-পাতে,
কেন ফাগুন-প্রাতে
সহসা বাদল ঝরে॥
ডাকিলে অনুরাগে
কেন বিদায় মাগে,
(কেন) মরিতে সাধ জাগে
পিয়ার বুকের পরে॥
ডাকিয়া ফুলবনে
থাকে সে আনমনে,
কাঁদায়ে নিরজনে
কাঁদে সে কীসের তরে॥
কবি, তোরে কে কবে
সাধিল বেণুর রবে,
ধরিতে গেলি যবে
বিঁধিল কুসুম-শরে॥
কেন কাঁদে পরান কী বেদনায় কারে কহি
কেন কাঁদে পরান কী বেদনায় কারে কহি।
সদা কাঁপে ভীরু হিয়া রহি রহি।।
সে থাকে নীল নভে আমি নয়ন-জল-সায়রে
সাতাশ তারার সতিন-সাথে সে যে ঘুরে মরে,
কেমনে ধরি সে চাঁদে রাহু নহি ।।
কাজল করি যারে রাখি গো আঁখি-পাতে,
স্বপনে যায় সে ধুয়ে গোপন অশ্রু সাথে!
বুকে তায় মালা করি রাখিলে যায় সে চুরি,
বাঁধিলে বলয়-সাথে মালয়ায় যায় সে উড়ি
কি দিয়ে সে উদাসীর মন মোহি।।
কেন দিলে এ কাঁটা যদি গো কুসুম দিলে
বেহাগ — দাদরা
কেন দিলে এ কাঁটা
যদি গো কুসুম দিলে
ফুটিত না কি কমল
ও কাঁটা না বিঁধিলে॥
কেন এ আঁখি-কূলে
বিধুর অশ্রু দুলে,
কেন দিলে এ হৃদি
যদি না হৃদয় মিলে॥
শীতল মেঘ-নীরে
ডাকিয়া চাতকীরে
নীর ঢালিতে শিরে
বাজ কেন হানিলে॥
যদি ফুটালে মুকুল
কেন শুকাইলে ফুল,
কেন কলঙ্ক-টিপে
চাঁদের ভুরু ভাঙিলে॥
কেন-কামনা-ফাঁদে
রূপ-পিপাসা কাঁদে,
শোভিত না কি কপোল
ও কালো তিল নহিলে॥
কাঁটা-নিকুঞ্জে কবি
এঁকে যা সুখের ছবি,
নিজে তুই গোপন রবি,
তোরই আঁখির সলিলে॥
কেমনে রাখি আঁখি-বারি চাপিয়া
(রাতের) দুর্গা — আদ্ধা কাওয়ালি
কেমনে রাখি আঁখি-বারি চাপিয়া।
প্রাতে কোকিল কাঁদে, নিশীথে পাপিয়া॥
এ ভরা বাদরে আমার মরা নদী,
উথলি উথলি উঠিছে নিরবধি।
আমার এ ভাঙা ঘাটে
আমার এ হৃদিতটে
চাপিতে গেলে ওঠে
দু-কূল ছাপিয়া॥
নিষেধ নাহি মানে আমার পোড়া আঁখি,
জল লুকাব কত কাজল মাখি মাখি।
ছলনা করে হাসি
অমনি জলে ভাসি,
ছলিতে গিয়া আসি
ভয়েতে কাঁপিয়া॥
গাঁথিতে ফুলমালা বিঁধে সে কাঁটা হয়ে,
কাঁটার হার গাঁথি — সে আসে ফুল লয়ে।
কবি রে, জলধি এ তাহারে মন দিয়ে
গেলি রে জল নিয়ে জীবন ব্যাপিয়া॥
কোন্ শরতে পূর্ণিমা-চাঁদ আসিলে এ ধরাতল
সিন্ধু — কাওয়ালি
কোন্ শরতে পূর্ণিমা-চাঁদ আসিলে এ ধরাতল।
কে মথিল তব তরে কোন্ সে ব্যথার সিন্ধু-জল॥
দুয়ার-ভাঙা জাগল জোয়ার বেদনার ওই দরিয়ায়।
আজ ভারতী অশ্রুমতী মধ্যে দুলে টলমল॥
কখন তোমার বাজল বেণু প্রাণের বংশীবটছায়।
মরা গাঙে ভাঙা ঘাটে ঘট ভরে গোপিনী দল॥
বিদ্যুতের বাঁকা হাসি হাসিয়া কালো মেঘে,
আসিলে কে অভিমানী বহায়ে মরুতে ঢল॥
লয়ে হাতে জিয়ন-কাঠি আসিলে কে রূপ-কুমার
উঠল জেগে রূপ-কুমারী আঁধারে ওই ঝলমল॥
আকাশে চকোরী কাঁদে, তড়াগে চাহে কুমুদ,
ঝরুক আঁখির শেফালিকা ছুঁয়ে তব পদতল॥
গরজে গম্ভীর গগন কম্বু
মালকৌষ — গীতঙ্গী
গরজে গম্ভীর গগন কম্বু।
নাচিছে সুন্দর নাচে স্বয়ম্ভু॥
সে নাচ-হিল্লোলে জটা-আবর্তনে
সাগর ছুটে আসে গগন-প্রাঙ্গণে।
আকাশে শূল হানি
শোনাও নব বাণী,
তরাসে কাঁপে প্রাণী
প্রসীদ শম্ভু॥
ললাট-শশী টলি জটায় পড়ে ঢলি,
সে-শশী-চমকে গো বিজুলি ওঠে ঝলি।
ঝাঁপে নীলাঞ্চলে মুখ দিগঙ্গনা,
মুরছে ভয়-ভীতা নিশি নিরঞ্জনা।
আঁধারে পথহারা
চাতকী কেঁদে সারা,
যাচিছে বারিধারা
ধরা নিরম্বু॥
গহিন রাতে ঘুম কে এলে ভাঙাতে
পিলু — কাহারবা
গহিন রাতে
ঘুম কে এলে ভাঙাতে।
ফুল-হার পরায়ে গলে
দিলে জল নয়ন-পাতে॥
যে জ্বালা পেনু জীবনে
ভুলেছি রাতে স্বপনে,
কে তুমি এসে গোপনে
ছুঁইলে সে বেদনাতে॥
যবে কেঁদেছি একাকী
কেন মুছালে না আঁখি,
নিশি আর নাহি বাকি
বাসি ফুল ঝরিবে প্রাতে॥
কেন এ কুহেলি ঠেলে
দখিনা বাতাস এলে,
কবি তুই হৃদয় মেলে
ছিলি কি এরই আশাতে॥
চরণ ফেলি গো মরণ-ছন্দে
খাম্বাজ — আড়-খেমটা
চরণ ফেলি গো মরণ-ছন্দে
মথিয়া চলি গো প্রাণ।
মর্ত্যের মাটি মহীয়ান করি
স্বর্গেরে করি ম্লান॥
চিতার বিভূতি মাখিয়া গায়
লজ্জা হানি গো অন্নদায়,
বাঁধিয়াছি বিদ্যুল্লতায়,
দেবরাজ হতমান।
পাতাল ফুঁড়িয়া করি গো মাতাল
রসাতল-অভিযান॥
চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না এ নয়ন পানে
বাগেশ্রী-পিলু — কাহারবা
চেয়ো না সুনয়না
আর চেয়ো না এ নয়ন পানে।
জানিতে নাইকো বাকি
সই ও আঁখি কী জাদু জানে॥
একে ওই চাউনি বাঁকা
সুরমা-আঁকা, তায় ডাগর আঁখি।
বধিতে তায় কেন সাধ
যে মরেছে ওই আঁখি-বাণে॥
কাননে হরিণ কাঁদে,
সলিল-ফাঁদে ঝুরছে শফরী,
বাঁকায়ে ভুরুর ধনু
ফুল-অতনু কুসুম-শর হানে॥
কুণাল কি পড়ল ধরা
পীযূষ-ভরা ওই চাঁদ মুখে,
কাঁদিছে নার্গিসের ফুল
লাল কপোলের কমল-বাগানে॥
জ্বলিছে দিবস রাতি
মোমের বাতি রূপের দেওয়ালি,
নিশিদিন তাই কি জ্বলি
পড়ছ গলি অঝোর নয়ানে॥
মিছে তুই কথার কাঁটায়
সুর বিঁধে হায় হার গাঁথিস কবি,
বিকিয়ে যায় রে মালা
আয় নিরালা আঁখির দোকানে॥