এ বাসি বাসরে আসিলে কে গো ছলিতে
বৃন্দাবনী সারঙ — মিশ্র দাদরা
এ বাসি বাসরে আসিলে কে গো ছলিতে।
কেন পুন বাঁশি বাজালে কাফি-ললিতে॥
নিশীথ গভীরে
কেন আঁখি-নীরে
এলে ফিরে ফিরে
গোপনকথা বলিতে॥
দলিত কুসুম-দলে রচিয়াছি শয়ন
অন্ধ তিমির রাতি, নিবু-নিবু নয়ন!
মরণ-বেলায় প্রিয়
আনিলে কি অমিয়
এলে কি গো নিঠুর
ঝরা ফুল দলিতে॥
এত জল ও-কাজল-চোখে পাষাণী, আনলে বল কে
মান্দ্ — কাওয়ালি
এত জল ও-কাজল-চোখে
পাষাণী, আনলে বল কে।
টলমল জল-মোতির মালা
দুলিছে ঝালর-পলকে॥
দিল কি পুব-হাওয়াতে দোল,
বুকে কি বিঁধিল কেয়া?
কাঁদিয়া কুটিলে গগন
এলায়ে ঝামর-অলকে॥
চলিতে পৈচি কি হাতের
বাধিল বৈঁচি-কাঁটাতে?
ছাড়াতে কাঁচুলির কাঁটা
বিঁধিল হিয়ার ফলকে॥
যে দিনে মোর দেওয়া মালা
ছিঁড়িলে আনমনে সখী,
জড়াল জুঁই-কুসুমি-হার
বেণিতে সেদিন ও লো কে॥
যে-পথে নীর ভরণে যাও
বসে রই সেই পথ-পাশে,
দেখি, নিত্ কার পানে চাহি
কলসির সলিল ছলকে॥
মুকুলি মন সেধে সেধে
কেবলই ফিরিনু কেঁদে
সরসীর ঢেউ পলায় ছুটি
না ছুঁতেই নলিন-নোলকে॥
বুকে তোর সাত সাগরের জল,
পিপাসা মিটল না কবি,
ফটিক-জল! জল খুঁজিস যেথায়
কেবলই তড়িৎ ঝলকে॥
করুণ কেন অরুণ আঁখি দাও গো সাকি দাও শারাব
সিন্ধু — কাওয়ালি
করুণ কেন অরুণ আঁখি
দাও গো সাকি দাও শারাব।
হায় সাকি এ আঙ্গুরি খুন,
নয় ও হিয়ার খুন-খারাব॥
দুর্দিনের এই দারুণ দিনে
শরণ নিলাম পানশালায়,
হায় শাহারার প্রখর তাপে
পরান কাঁপে দিল্-কাবাব॥
আর সহে না দিল্ নিয়ে এই
দিল্-দরদির দিল্লগি
তাই তো চালাই নীল পিয়ালায়
লাল শিরাজি বে-হিসাব॥
এই শারাবের নেশার রঙে
নয়ন-জলের রং লুকাই,
দেখছি আঁধার জীবন ভরি
ভর-পিয়ালার লাল খোয়াব॥
আমার বুকের শূন্যে কে গো
ব্যথার তারে ছড় চালায়,
গাইছি খুশির মহ্ফিলে গান
বেদন-গুণীর বীণ-রবাব॥
হারাম কি এই রঙিন পানি,
আর হালাল এই জল চোখের?
নরক আমার হউক মঞ্জুর,
বিদায় বন্ধু, লও আদাব॥
দেখ রে কবি, প্রিয়ার ছবি
এই শারাবের আরশিতে,
লাল গেলাসের কাচ-মহলার
পার হতে তার শোন জওয়াব॥
কার নিকুঞ্জে রাত কাটায়ে আসলে প্রাতে পুষ্পচোর
গারা-ভৈরবী — কাহারবা
কার নিকুঞ্জে রাত কাটায়ে
আসলে প্রাতে পুষ্পচোর।
ডাকছে পাখি, ‘বউ গো জাগো,
আর ঘুমায় না, রাত্রি ভোর’॥
জুঁই-কুঁড়িরা চোখ মেলে চায়,
চুমকুড়ি দেয় মৌমাছি।
শাপলা-বনে চাঁদ ডুবে যায়
ম্লান চোখে হায় চায় চকোর॥
ঘোমটা ঠেলি কয় চামেলি,
গোল কোরো না গুল-ডাকাত,
ঢুলছে নয়ন, দুলছে গলায়
বেল-টগরের ছিন্ন ডোর॥
বোরকা খুলি বন-কেতকীর
ফুলরেণুতে রাঙলে গা,
পারুল-বধূর মাগলে মধু,
হাসনাহেনার ভাঙলে দোর॥
গায় কাওয়ালি বাদলি রুমঝুম,
তয়ফাওয়ালি নাচে মউর
ঝুরছে কদম, মেঘ-তমালে
বিজলি-চোখে চায় কিশোর॥
শোন রে কবি পুষ্পলোভী
আজ ধরেছি ফুল চুরি,
হুল ফুটিয়ে, ফুলবালাদের
কুল ভুলানো ভাঙব তোর॥
কী হবে জানিয়া বলো কেন জল নয়নে
ভৈরবী — পোস্তা
কী হবে জানিয়া বলো
কেন জল নয়নে।
তুমি তো ঘুমায়ে আছ
সুখে ফুল-শয়নে।
তুমি বুঝিবে বালা
কুসুমে কীটের জ্বালা,
কারো গলে দোলে মালা
কেহ ঝরে পবনে॥
আকাশের আঁখি ভরি
কে জানে কেমন করি
শিশির পড়ে গো ঝরি
ঝরে বারি শাওনে।
নিশীথে পাপিয়া পাখি
এমনই তো ওঠে ডাকি,
তেমনই ঝুরিছে আঁখি
বুঝি বা অকারণে॥
কে শুধায়, আঁধার চরে
চখা কেন কেঁদে মরে,
এমনই চাতক-তরে
মেঘ ঝুরে-গগনে।
কারে মন দিলি কবি,
এ যে রে পাষাণ-ছবি,
এ শুধু রূপের রবি
নিশীথের স্বপনে॥
কে বিদেশি মন-উদাসী
ভৈরবী-আশাবরী — কাহারবা
কে বিদেশি মন-উদাসী
বাঁশির বাঁশি বাজাও বনে।
সুর-সোহাগে তন্দ্রা লাগে
কুসুম-বাগের গুল্-বদনে॥
ঝিমিয়ে আসে ভোমরা-পাখা,
যূথীর চোখে আবেশ মাখা,
কাতর ঘুমে চাঁদিমা রাকা
(ভোর গগনের দর-দালানে)
দর-দালানে ভোর গগনে॥
লজ্জাবতীর লুলিত লতায়
শিহর লাগে পুলক-ব্যথায়,
মালিকা সম বঁধুরে জড়ায়
বালিকা-বধূ সুখ-স্বপনে॥
সহসা জাগি আধেক রাতে
শুনি সে বাঁশি বাজে হিয়াতে,
বাহু-শিথানে কেন কে জানে
কাঁদে গো পিয়া বাঁশির সনে॥
বৃথাই গাঁথি কথার মালা
লুকাস কবি বুকের জ্বালা,
কাঁদে নিরালা বনশিওয়ালা
তোরই উতলা বিরহী মনে॥
কে শিব সুন্দর শরৎ-চাঁদ চূড়
দেশ — গীতঙ্গী
কে শিব সুন্দর শরৎ-চাঁদ চূড়
দাঁড়ালে আসিয়া এ অঙ্গনে,
পীড়িত নরনারী আসিল গেহ ছাড়ি
ভরিল নভতল-ক্রন্দনে॥
বেদনা-মন্দিরে আরতি বাজে তব,
কে তুমি সুন্দর শ্মশানচারী নব,
দিগদিগন্তরে জীবন-উৎসব-
শঙ্খ শুনি তব আগমনে॥
মৃত্যু-জয়ী তুমি হওনি সুধা পিয়ে,
দুখেরে দহিয়াছ বিষের দাহ দিয়ে।
ভূষণ করি ফণী আদরে দিয়ে দোলা
কী মণি পেলে বলো ওগো ও চির-ভোলা!
কভু সে ডম্বরু বাজাও অম্বরে,
প্রলয়-নর্তন জাগে চরাচরে,
ললাট-জ্বালা-পাশে
চন্দ্রলেখা হাসে
নবীন সৃষ্টির হরষনে॥
পতিতা গঙ্গারে ধরিলে নিজ শিরে,
কন্যারূপে তাই পেলে কি ভারতীরে,
স্বরগ এল নেমে মরতে তব প্রেমে,
নমানি দেব-দেব ও-চরণে॥
কেন আন ফুল-ডোর আজি বিদায় বেলা
ভীমপলশ্রী — কাহারবা
কেন আন ফুল-ডোর
আজি বিদায় বেলা।
মোছো মোছো আঁখি-লোর
যদি ভাঙিল মেলা॥
কেন মেঘের স্বপন
আন মরুর চোখে,
ভুলে দিয়ো না কুসুম
যারে দিয়েছ হেলা॥
আছে বাহুর বাঁধন
তব শয়ন-সাথি,
আমি এসেছি একা
আমি চলি একেলা॥
যবে শুকাল কানন
এলে বিধুর পাখি,
লয়ে কাঁটা-ভরা প্রাণ
এ কী নিঠুর খেলা॥
যদি আকাশ-কুসুম
পেলি চকিতে কবি,
চলো চলো মুসাফির,
ডাকে পারের ভেলা॥