রাঙা মাটির পথে লো মাদল বাজে
রাঙা মাটির পথে লো মাদল বাজে
বাজে বাঁশের বাঁশি।
বাঁশি বাজে বুকের মাঝে লো, মন লাগে না কাজে লো,
রইতে নারি ঘরে ওলো প্রাণ হল উদাসী লো।
মাদলিয়ার তালে তালে অঙ্গ ওঠে দুলে,
দোল লাগে শাল-পিয়াল বনে নোটন খোঁপার ফুলে।
মহুয়া বনে লুটিয়ে পড়ে মাতাল চাঁদের হাসি লো॥
চোখে ভালো লাগে যাকে–
তাকে দেখব পথের বাঁকে,
তার চাঁচর কেশে পরিয়ে দেব ঝুমকো জবার ফুল,
তার গলার মালার কুসুম কেড়ে করব কানের দুল।
তারে নাচের তালে ইশারাতে বলব ভালোবাসি লো॥
রিম ঝিম রিম ঝিম ঝিম ঘন দেয়া বরষে
রিম ঝিম রিম ঝিম ঝিম ঘন দেয়া বরষে
কাজরি নাচিয়া চল পুরনারী হরষে॥
কদম তমাল ডালে দোলনা দোলে
–কুহু পাপিয়া ময়ূর বোলে।
মনের বনের মুকুল খোলে, নটশ্যাম সুন্দর–
মেঘ পরশে॥
হৃদয়-যমুনা আজ কূল জানে না গো
মনের রাধা আজ বাধা মানে না গো
ডাকিছে ঘর-ছাড়া ঝড়ের বাঁশি,
অশনি আঘাত হানে দুয়ারে আসি
গজরাক গুরুজন ভবনবাসী
আমরা বাহিরে যাব ঘনশ্যাম দরশে॥
রুম ঝুম ঝুম ঝুম রুম ঝুম ঝুম
রুম ঝুম ঝুম ঝুম রুম ঝুম ঝুম
খেজুর পাতার নূপুর বাজায়ে কে যায়।
ওড়না তাহার ঘূর্ণি হাওয়ায় দোলে
কুসুম ছড়ায় পথের বালুকায়॥
তার ভুরুর ধনুক বেঁকে ওঠে
তনুর তলোয়ার,
সে যেতে যেতে ছড়ায় পথে
পাথরকুচির হার।
তার ডালিম-ফুলের ডালি
গোলাপ-গালের লালি
(যেন) ঈদের চাঁদও চায়॥
আরবি ঘোড়ার সওয়ার হয়ে, বাদশাজাদা বুঝি
সাহারাতে ফেরে কোন মরীচিকায় খুঁজি।
কত তরুণ মুসাফির পথ হারাল হায়,
কত বনের হরিণ মরে তারই রূপ-তৃষায়॥
রূপের দীপালি-উৎসব আমি দেখেছি তোমার অঙ্গে
রূপের দীপালি-উৎসব আমি দেখেছি তোমার অঙ্গে।
শত ফুলশর মুরছায় প্রিয়া, তোমার নয়নভঙ্গে॥
যে আঁখি পরম সুন্দরে দেখিয়াছে
সেই আঁখি কাঁদে তোমার পায়ের কাছে,
দেখেছে সে আঁখি, বিশ্ব দুলিছে তোমার রূপ-তরঙ্গে॥
তোমারে দেখিতে আমার আকাশ আনত হইয়া কাঁদে,
(তব) মণিহার হতে বিবাদ করে গো কোটি গ্রহ-তারা চাঁদে।
তুমি দেখিতে যদি গো আপন রূপের আলো
আমারে ভুলিয়া নিজেরে বাসিতে ভালো,
তোমারে আড়াল করিয়া গো তাই ছায়া-সম ফিরি সঙ্গে॥
রেশমি রুমালে কবরী বাঁধি
রেশমি রুমালে কবরী বাঁধি
নাচিছে আরবি নটিনি বাঁদি॥
বেদুইন সুরে বাঁশি বাজে
রহিয়া রহিয়া তাঁবু-মাঝে সুদুরে
সে সুরে চাহে বোরখা তুলিয়া শাহাজাদি॥
যৌবন-সুন্দর নোটন কবুতর
নাচিছে মরু-নটী
গাল যেন গোলাপ, কেশ যেন খেজুর-কাঁদি॥
চায় হেসে হেসে চায় মদির চাওয়ায়,
দেহের দোলায় রং ঝরে যায়, ঝরঝর
ছন্দে দুলে ওঠে মরু মাঝে আঁখি॥
শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এল না
শাওন আসিল ফিরে, সে ফিরে এল না
বরষা ফুরায়ে গেল, আশা তবু গেল না॥
ধানির-রং ঘাঘরি, মেঘ-রং ওড়না
পরিতে আমারে মা গো অনুরোধ কোরো না
কাজরির কাজলা মেঘ পথ পেল খুঁজিয়া
সে কি ফেরার পথ পেল না মা, পেল না॥
আমার বিদেশিরে চিনিতে অনুক্ষণ
বুনো হাঁসের পাখার মতো উড়ু উড়ু করে মন।
অথৈ জলে মা গো মাঠ ঘাট থই থই,
আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই,
কদম-কেশর বলে, ‘কোথা তোর কিশোর’,
চম্পা ডালে দোলে শূন্য দোলনা।
শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে॥
ভুলিয়ো স্মৃতি মম, নিশীথ-স্বপন-সম
আঁচলের গাঁথা মালা ফেলিয়ো পথ পরে॥
ঝুরিবে পুবালি বায় গহন দূর বনে
রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে।
বিরহী কুহু-কেকা গাহিবে নীপ-শাখে
যমুনা-নদীপারে শুনিবে কে যেন ডাকে।
বিজলি দীপ-শিখা খুঁজিবে তোমায় প্রিয়া
দু-হাতে ঢেকো আঁখি যদি গো জলে ভরে॥
শুকনো পাতার নুপুর বাজে
শুকনো পাতার নুপুর বাজে
দখিন বায়ে!
কে এলে গো কে এলে গো চপল পায়ে॥
ছায়া-ঢাকা আমের ডালে চপল আঁখি
উঠল ডাকি বনের পাখি উঠল ডাকি
নতুন চাঁদের জ্যোৎস্না মাখি
সোনার শাখায় দোল দুলায়ে॥
সুনীল তোমার ডাগর চোখের দৃষ্টি পিয়ে
সাগর দোলে আকাশ ওঠে ঝিলমিলিয়ে।
পিয়াল বনে উঠল বাজি তোমার বেণু,
ছড়ায় পথে কৃষ্ণচূড়া পরাগ-রেণু
ময়ূর-পাখা বুলিয়ে চোখে কে গো দিল ঘুম ভাঙায়ে।
শোক দিয়েছ তুমি হে নাথ
শোক দিয়েছ তুমি হে নাথ, তুমি এ প্রাণে শান্তি দাও!
দুখ দিয়ে কাঁদালে যদি তুমি হে নাথ সে দুখ ভোলাও!
যে হাত দিয়ে হানলে আঘাত
(তুমি) অশ্রু মোছাও সেই হাতে নাথ,
বুকের মানিক হরলে যার–
তারে তোমার শীতল বক্ষে নাও॥
তোমার যে চরণ প্রলয় ঘটায়
সেই চরণ কমল ফোটায়।
শূন্য করলে তুমি যে বুক
সেথা তুমি এসে বুক জুড়াও॥
সন্ধ্যা নেমেছে আমার বিজন ঘরে
সন্ধ্যা নেমেছে আমার বিজন ঘরে, তব গৃহে জ্বলে বাতি
ফুরায় তোমার উৎসব নিশি সুখে, পোহায় না মোর রাতি,
প্রিয়া পোহায় না মোর রাতি॥
আমার আশার ঝরাফুল দিয়া
তোমার বাসর-শয্যা রচিছ প্রিয়া
তোমার ভবনে আলোর দীপালি জ্বলে,–
আঁধার আমার সাথি।
প্রিয়া পোহায় না মোর রাতি॥
ঘুমায়ে পড়েছে আমার কাননে কুহু, নীরব হয়েছে গান,
তোমার কুঞ্জে গানের পাখিরা বুঝি তুলিয়াছে কলতান।
পৃথিবীর আলো মোর চোখে নিভে আসে
বাজিয়ে বাঁশরি তোমার মিলন-রাসে
ওপারের বাঁশি আমারে ডাকিবে কবে
আছি তাই কান পাতি।
প্রিয়া পোহায় না মোর রাতি॥