মেঘ-মেদুর বরষার কোথা তুমি
মেঘ-মেদুর বরষার কোথা তুমি
ফুল ছড়ায়ে কাঁদে বনভূমি।
ঝুরে বারিধারা,
ফিরে এসো পথহারা,
কাঁদে নদীতট চুমি॥
মেঘলা নিশি-ভোরে মন যে কেমন করে
মেঘলা নিশি-ভোরে
মন যে কেমন করে,
তারই তরে গো, মেঘবরন যার কেশ।
বুঝি তাহারই লাগি
হয়েছে বৈরাগী
গেরুয়া-রাঙা গিরিমাটির দেশ॥
মৌরি ফুলের খেতে, মৌমাছি ওঠে মেতে,
এলিয়েছিল কেশ কি গো তার এই পথে সে যেতে।
তার ডাগর চোখের ঝিলিক লেগে রাত হয়েছে শেষ (গো)॥
শিরীষ পাতায় ঝিরিঝিরি, বাজে নূপুর তারই,
সোনার ডালে দোলে তাহার কামরাঙা-রং শাড়ি।
হয়েছে মন ভিখারি–
মন শিকারি আমি
উঠি পাহাড় চূড়ায়–
ঝরনা-জলে নামি,
কালো পাথর দেখে জাগে কার চোখের আবেশ (গো)॥
মোমতাজ মোমতাজ তোমার তাজমহল
মোমতাজ! মোমতাজ! তোমার তাজমহল
(যেন) বৃন্দাবনের একমুঠো প্রেম, ফিরদৌসের একমুঠো প্রেম
আজও করে ঝলমল॥
কত সম্ম্রাট হল ধূলি স্মৃতির গোরস্থানে
পৃথিবী ভুলিতে নারে প্রেমিক শাজাহানে।
শ্বেত মর্মরে সেই বিরহীর ক্রন্দন-মর্মর
গুঞ্জরে অবিরল॥
কেমনে জানিল শাজাহান, প্রেম পৃথিবীতে মরে যায়!
(তাই) পাষাণ প্রেমের স্মৃতি রেখে গেল পাষাণে লিখিয়া হায়!
(যেন) তাজের পাষাণ অঞ্জলি লয়ে নিঠুর বিধাতা পানে
অতৃপ্ত প্রেম বিরহী-আত্মা আজও অভিযোগ হানে,
(বুঝি) সেই লাজে বালুকায় মুখ লুকাইতে চায়
শীর্ণা যমুনা-জল॥
মোর গানের কথা যেন আলোকলতা
মোর গানের কথা যেন আলোকলতা
যেন স্বর্ণলতা।
মূল নাই ফুল নাই আছে শুধু
বর্ণের বিহ্বলতা॥
আকাশ-বনস্পতি জড়ায়ে
ধরনির বুকে পড়ে গড়ায়ে
কখন কি আবেশে কার কথা ভাবে সে
কে জানে কেন অযথা॥
রহে কারও বক্ষে, রহে কারও চক্ষে বিরহের অশ্রুজলে
কন্ঠলগ্না কারও রহে সে গীত-কলি মুঞ্জরে অধরতলে।
রাখি হয়ে কারও হাত বাঁধে সে
কাহারও চরণতলে কাঁদে সে
সুরে সুরে গুঞ্জিত ও যেন পুঞ্জিত
অকারণ মৌন ব্যথা॥
মোর প্রিয়া হবে এসো রানি
মোর প্রিয়া হবে, এসো রানি,
দেব খোঁপায় তারার ফুল।
কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির
চৈতি চাঁদের দুল॥
কন্ঠে তোমার পরাব বালিকা
হংস-সারির দুলানো মালিকা
বিজলি-জরিন ফিতায় বাঁধিব
মেঘ-রং এলোচুল॥
জ্যোৎস্নার সাথে চন্দন দিয়ে
মাখাব তোমার গায়,
রামধনু হতে লাল রং ছানি
আলতা পরাব পায়।
আমার গানের সাত সুর দিয়া
তোমার বাসর রচিব প্রিয়া,
তোমারে ঘিরিয়া গাহিবে আমার
কবিতার বুলবুল॥
মোর ভুলিবার সাধনায় কেন সাধো বাদ
মোর ভুলিবার সাধনায় কেন সাধো বাদ?
কেন নিরাশা-আঁধারে জ্বালো আশার চাঁদ॥
যে প্রেম লভিয়াছে সমাধি
কী হবে সেথায় আর কাঁদি
বাঁচিবে না নয়নের জলে সে
পুড়ে ছাই হয়ে গেছে যার সুখ-সাধ॥
যে তরুর কাটিয়াছে মূল, কেন ফুল সেথা চাও
নির্জন অরণ্যে বিরহ-তাপে তারে শুকাইতে দাও।
শুভ লগ্নের ক্ষণ ভুবনে
একবার আসে শুধু জীবনে
বয়ে গেছে সেই শুভদৃষ্টির শুভক্ষণ
আর পাইব না তব আঁখির প্রসাদ॥
মোর স্বপনে যেন বাজিয়েছিলে করুণ রাগিণী
মোর স্বপনে যেন বাজিয়েছিলে করুণ রাগিণী।
হে রূপকুমার! ঘুমিয়েছিলাম
সেদিন জাগিনি॥
যেন আধোঘুমের ঘোরে
দেখেছিলাম চুরি করে–
চাইতে গিয়ে চোখের জলে
চাইতে পারিনি॥
তন্দ্রা আমার টুটল তবু শরম ভরে
(হে) চির-চাওয়া! পারিনিকো ডাকতে আদরে।
চেয়ে চেয়ে আমার পানে
চলে গেলে অভিমানে,
(তোমার) পথের ধূলি হইনি কেন
হতভাগিনি॥
মোরা আর জনমে হংস-মিথুন ছিলাম নদীর চরে
মোরা আর জনমে হংস-মিথুন ছিলাম নদীর চরে
যুগলরূপে এসেছি গো আবার মাটির ঘরে॥
তমালতরু চাঁপালতার মতো
জড়িয়ে কত জনম হল গত,
সেই বাঁধনের চিহ্ন আজও জাগে
জাগে হিয়ার থরে থরে॥
বাহুর ডোরে বেঁধে আজও ঘুমের ঘোরে যেন
ঝড়ের বন-লতার মতো লুকিয়ে কাঁদ কেন?
বনের কপোত, কপোতাক্ষীর তীরে
পাখায় পাখায় বাঁধা ছিলাম নীড়ে
চিরতরে হল ছাড়াছাড়ি
(কোন) নিঠুর ব্যাধের শরে॥
যখন আমার গান ফুরাবে তখন এসো ফিরে
যখন আমার গান ফুরাবে তখন এসো ফিরে।
ভাঙবে সভা, বসব একা রেবা-নদীর তীরে–
তখন এসো ফিরে॥
গীত শেষে গগন-তলে
শ্রান্ত তনু পড়বে ঢলে
ভালো যখন লাগবে না আর সুরের সারেঙ্গিরে
তখন এসো ফিরে॥
মোর কন্ঠের জয়ের মালা তোমার গলায় নিয়ো
ক্লান্তি আমার ভুলিয়ে দিয়ো, প্রিয় হে মোর প্রিয়।
ঘুমাই যদি কাছে ডেকো
হাতখানি মোর হাতে রেখো
জেগে যখন খুঁজব তোমায় আকুল অশ্রুনীরে–
তখন এসো ফিরে॥
যবে ভোরের কুন্দ-কলি মেলিবে আঁখি
যবে ভোরের কুন্দ-কলি মেলিবে আঁখি
ঘুম ভাঙায়ে হাতে বাঁধিয়ো রাখি॥
রাতের বিরহ যবে প্রভাতে নিবিড় হবে
অকরুণ কলরবে গাহিবে পাখি।
ঘুম ভাঙায়ে হাতে বাঁধিয়ো রাখি॥
যেন অরুণ দেখিতে গিয়া তরুণ কিশোর
তোমারে প্রথম হেরি ঘুম ভাঙে মোর,
করবীর মঞ্জরী আঙিনায় রবে ঝরি
সেই ফুল পায়ে দলি এসো একাকী,
ঘুম ভাঙায়ে হাতে বাঁধিয়ো রাখি॥
যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখ তারে।
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে॥
আমি গান গাহি আপনার দুখে
তুমি কেন আসি দাঁড়াও সুমুখে
আলেয়ার মত ডাকিয়ো না আর
নিশীথ অন্ধকারে॥
দয়া করো, দয়া করো, আর আমারে লইয়া
খেলো না নিঠুর খেলা;
শত কাঁদিলেও ফিরিবে না
সেই শুভলগনের বেলা॥
আমি ফিরি পথে, তাহে কার ক্ষতি
তব চোখে কেন সজল মিনতি
আমি কি ভুলেও কোনোদিন এসে
দাঁড়ায়েছি তব দ্বারে॥
ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে॥