বন্ধু আজও মনে যে পড়ে আম-কুড়ানো খেলা
বন্ধু আজও মনে যে পড়ে আম-কুড়ানো খেলা।
আম কুড়াইবারে যাইতাম দুইজন নিশি ভোরের বেলা॥
জোষ্ঠিমাসের গুমোট রে বন্ধু আসত নাকো নিঁদ,
রাত্রে আসত নাকো নিঁদ,
আম-তলার এক চোর আইস্যা কাটত প্রাণের সিঁদ;
(আর) নিদ্রা গেলে ফেলত সে চোর আঙিনাতে ঢেলা॥
আমরা দুজন আম কুড়াইতাম, ডাকত কোকিল গাছে,
ভোলো যদি – বিহান বেলার সুর্যি সাক্ষী আছে।
(তুমি) পায়ের কাছে আম ফেইল্যা গায়ে দিতে ঠেলা॥
আমার বুকের আঁচল থাইক্যা কাইড়া নিতে আম
বন্ধু, আজও পায় নাই দাসী সেই না আমের দাম।
(আজ) দাম চাইবার গিয়া দেখি তুমি দিছ মেলা॥
নিশি জাইগ্যা বইস্যা আছি, জোষ্ঠি মাসের ঝড়ে
সেই না গাছের তলায় বন্ধু, এখনও আম পড়ে;
(আজ) তুমি কোথায় আমি কোথায়, দুইজনে একেলা॥
বন্ধু দেখলে তোমায় বুকের মাঝে
বন্ধু! দেখলে তোমায় বুকের মাঝে
জোয়ার ভাটা খেলে।
আমি একলা ঘাটে কুলবধু, কেন তুমি এলে
বন্ধু, কেন তুমি এলে॥
আমার অঙ্গে কাঁটা দিয়ে ওঠে, বাজাও যখন বাঁশি ;
খিড়কি-দুয়ার দিয়ে বন্ধু জল ভরিতে আসি,
ভেসে নয়ন জলে ঘরে ফিরি, ঘাটে কলস ফেলে॥
আমার পাড়ায়, বন্ধু, তোমার নাম যদি লয় কেউ
বুকে আমার দুলে ওঠে পদ্মা নদীর ঢেউ।
ওগো ও চাঁদ, এনো না আর
দু-কূল-ভাঙা এমন জোয়ার ;
কত ছল করে জল লুকাই চোখের,
কাঁচা কাঠে আগুন জ্বেলে।
বলেছিলে, তুমি তীর্থে আসিবে আমার তনুর তীরে
বলেছিলে, তুমি তীর্থে আসিবে আমার তনুর তীরে।
হায়! তুমি আসিলে না, আশার সূর্য ডুবিল সাগর-নীরে॥
চলে যাই যদি, চিরদিন মনে
তোমার সে কথা রহিবে স্মরণে
শুধু সেই কথা শোনার লাগিয়া হয়তো আসিব ফিরে॥
শুধু সেই আশে হয়তো এ তনু মরমে হবে না লীন,
পথ চেয়ে চেয়ে, তব নাম গেয়ে বাজাব বিরহ-বীণ।
হেরো গো, আমার যাবার সময় হল,
তোমার সে কথা মিথ্যা হবে না বলো,
কোন শুভক্ষণে নিমেষের তরে জড়াবে কন্ঠ ঘিরে॥
বসন্ত মুখর আজি
বসন্ত মুখর আজি
দক্ষিণ সমীরণে মর্মর গুঞ্জনে
বনে বনে বিহ্বল বাণী ওঠে বাজি॥
অকারণ ভাষা তার ঝরঝর ঝরে
মুহু মুহু কুহু কুহু পিয়া পিয়া স্বরে।
পলাশ বকুলে অশোক শিমূলে
সাজানো তাহার কল-কথার সাজি॥
দোয়েল মধুপ বন-কপোত কূজনে
ঘুম ভেঙে দেয় ভোরে বাসর-শয়নে।
মৌনী আকাশ সেই বাণী-বিলাসে
অস্ত চাঁদের মুখে মৃদু মৃদু হাসে
বিরহ-শীর্ণা গিরি-ঝরনার তীরে
পাহাড়ি বেণু হাতে ফেরে সুর ভাঁজি॥
বাজো বাঁশরি বাজো বাঁশরি বাজো বাঁশরি
বাজো বাঁশরি বাজো বাঁশরি বাজো বাঁশরি
সেই চির-চেনা সুরে।
যে সুরে বিরহী প্রাণ আজও ঝরে॥
যে সুরে হৃদয়ে হোরির রং লাগে
ভুলে যাওয়া যৌবন-স্মৃতি মনে জাগে,
আকাশ কাঁদে যে সকরুণ রাগে
যে সুর ঘুমায়ে আছে প্রিয়ার নূপুরে॥
যে সুর শুনি আজও পল্লির প্রান্তে
মল্লিকা-কুঞ্জে শ্রান্ত দিনান্তে
বিরহ বিধুর দূর হারানো দিনের
ছায়া ফেলে যে সুর মনের মুকুরে॥
বিদায়ের বেলা মোর ঘনায়ে আসে
পুরবি – তেতালা
বিদায়ের বেলা মোর ঘনায়ে আসে
দিনের চিতা জ্বলে অস্ত আকাশে।
দিনশেষে শুভদিন এল বুঝি মম,
মরণের রূপে এলে মোর প্রিয়তম,
গোধুলির রঙে তাই দশদিশি হাসে॥
দিন গুনে নিরাশার পথ-চাওয়া ফুরাল,
শ্রান্ত এ জীবনের জ্বালা আজ জুড়াল।
ওপার হতে সে এল তরি বাহি।
হেরিলাম সুন্দরে, আর ভয় নাহি।
আঁধারের পারে তার চাঁদমুখ ভাসে॥
বুলবুলি নীরব নার্গিস-বনে
নৌরোচ্কা – তেতালা
বুলবুলি নীরব নার্গিস-বনে
ঝরা বন-গোলাপের বিলাপ শোনে॥
শিরাজের নওরোজে ফাল্গুন মাসে
যেন তার প্রিয়ার সমাধি পাশে
তরুণ ইরান-কবি কাঁদে নিরজনে॥
উদাসীন আকাশ থির হয়ে আছে
জল-ভরা মেঘ লয়ে বুকের কাছে।
সাকির শারাবের পিয়ালার পরে
সকরুণ অশ্রুর বেলফুল ঝরে
চেয়ে আছে ভাঙা চাঁদ
মলিন আননে॥
বেদিয়া বেদিনি ছুটে আয় আয় আয় আয়
বেদিয়া বেদিনি ছুটে আয় আয় আয় আয়।
ধাতিনা ধাতিনা তিনা ঢোলক মাদল বাজে
বাঁশিতে পরান মাতায়॥
দলে দলে নেচে নেচে আয় চলে
আকাশের শামিয়ানা তলে
বর্শা তির ধনুক ফেলে আয় আয় রে
হাড়ের নূপুর পরে পায়॥
বাঘ-ছাল পরে আয় হৃদয়-বনের শিকারি
ঘাঘরা পরে, পরে পলার মালা
আয় বেদের নারী।
মহুয়ার মউ নিয়ে ধুতুরা ফুলের পিয়ালায়
আয় আয় আয়॥
ভোরে ঝিলের জলে শালুক পদ্ম তোলে কে
ভোরে ঝিলের জলে শালুক পদ্ম তোলে কে
কে ভ্রমর-কুন্তলা কিশোরী
ফুল দেখে বেভুল সিনান ‘বিসরি’
একী নতুন লীলা আঁখিতে দেখি ভুল
কমল ফুল যেন তোলে কমল ফুল
ভাসায়ে আকাশ-গাঙে অরুণ-গাগরি॥
ঝিলের নিথর জলে আবেশে ঢলঢল
গলে পড়ে শত সে তরঙ্গে
শারদ আকাশে দলে দলে আসে
মেঘ-বলাকার খেলিতে সঙ্গে॥
আলোক-মঞ্জরী প্রভাতবেলা
বিকশি জলে কি গো করিছে খেলা
বুকের আঁচলে ফুল উঠিছে শিহরি॥
মনে পড়ে আজও সেই নারিকেল কুঞ্জ
মনে পড়ে আজও সেই নারিকেল কুঞ্জ গুবাক তরুর ঘন-কেয়ারি
বালুচর, বেত বন, দেখা হত দুইজন, মন হত উনমন দোঁহারি॥
গাছ থেকে টুপটাপ ঝরিত কালো জাম
জাম খেয়ে চুপচাপ মেঘ পানে চাহিতাম,
গাব নিয়ে কাড়াকাড়ি, ভাব হত, হত আড়ি দুজনে,
আমি ছিনু ধনিকের ছেলে গো
ছিলে ভুঁইমালিদের তুমি ঝিয়ারি॥
ভুঁইমালিদের ঘরে ভুঁইচম্পার কলি ডুমা-পরা উমা-সম খেলিতে
আমার দালান ঘরে – দোতালায় কেন গো উতলা মনে ছায়া ফেলিতে
সহসা হেরিনু তব বধূরূপ, ভাঙা চালা হাতে তব চালুনি
পার্শ্বে দামাল ছেলে কাঁদিছে হেরিয়া পান্তভাত আলুনি
ঘোমটা টানিয়া দিলে আমারে হেরিয়া
উদাস চোখে এল কালো মেঘ ঘেরিয়া,
তারে চিনিতে কি পেরেছিলে প্রণাম যে করেছিল
কল্যাণী রূপ তব নেহারি॥