নিশিরাতে রিম ঝিম ঝিম বাদল-নুপুর
নিশিরাতে রিম ঝিম ঝিম বাদল-নুপুর
বাজিল ঘুমের মাঝে সজল মধুর॥
দেয়া গরজে বিজলি চমকে
জাগাইল ঘুমন্ত প্রিয়তমকে
আধো-ঘুমঘোরে চিনিতে নারি ওরে
‘কে এল কে এল’ বলে ডাকিছে ময়ূর॥
দ্বার খুলি পড়শি কৃষ্ণা মেয়ে মেঘের পানে আছে চেয়ে
কারে দেখি আমি কারে দেখি
মেঘলা আকাশ না ওই মেঘলা মেয়ে।
ধায় নদীজল মহাসাগর পানে
বাহিরে ঝড় কেন আমায় টানে
জমাট হয়ে আছে বুকের কাছে
নিশীথ-আকাশ যেন মেঘ-ভারাতুর॥
নীলাম্বরী শাড়ি পরি নীল যমুনায়
নীলাম্বরী শাড়ি পরি নীল যমুনায়
কে যায়, কে যায় কে যায়।
যেন জলে চলে থল-কমলিনী
ভ্রমর নূপুর হয়ে বোলে পায় পায়॥
কলসে কঙ্কণে রিনিঠিনি ঝনকে
চমকায় উন্মন চম্পা বনকে
দলিত অঞ্জন নয়নে ঝলকে
পলকে খঞ্জন হরিণী লুকায়॥
অঙ্গের ছন্দে পলাশ-মাধবী অশোক ফোটে,
নূপুর শুনি বন-তুলসীর মঞ্জরী উলসিয়া উঠে।
মেঘ বিজড়িত রাঙা গোধূলি
নামিয়া এল বুঝি পথ ভুলি;
তাহার অঙ্গ-তরঙ্গ বিভঙ্গে
কূলে কূলে নদীজল উথলায়॥
নূরজাহান! নূরজাহান!
নূরজাহান! নূরজাহান!
সিন্ধুনদীতে ভেসে, এলে মেঘলামতীর দেশে
ইরানি গুলিস্তান॥
নার্গিস লালা গোলাপ আঙুরলতা
শিরিঁ-ফরহাদ সিরাজের উপকথা
এনেছিলে তুমি তনুর পিয়ালা ভরি
বুলবুলি দিলরুবা রবাবের গান॥
তব প্রেমে উন্মাদ ভুলিল সেলিম সে যে রাজাধিরাজ,
চন্দন-সম মাখিল অঙ্গে কলঙ্ক লোক-লাজ।
যে কলঙ্ক লয়ে হাসে চাঁদ নীলাকাশে
(যাহা) লেখা থাকে শুধু প্রেমিকের ইতিহাসে
দিবে চিরদিন নন্দন-লোকবাসী
(তব) সেই কলঙ্ক সে প্রেমের সম্মান॥
নয়নভরা জল গো তোমার আঁচল-ভরা ফুল
নয়নভরা জল গো তোমার আঁচল-ভরা ফুল।
ফুল নেব, না অশ্রু নেব ভেবে হই আকুল।
ফুল যদি নিই তোমার হাতে
জল রবে গো নয়ন-পাতে,
অশ্রু নিলে ফুটবে না আর প্রেমের মুকুল॥
মালা যখন গাঁথ তখন পাওয়ার সাধ যে জাগে
মোর বিরহে কাঁদ যখন আরও ভালো লাগে।
পেয়ে তোমায় যদি হারাই
দূরে দূরে থাকি গো তাই
(তাই) ফুল ফুটিয়ে যাই গো চলে চঞ্চল বুলবুল॥
পঞ্চ প্রাণের প্রদীপ-শিখায়
পঞ্চ প্রাণের প্রদীপ-শিখায়
লহো আমার শেষ আরতি।
ওগো আমার পরম-গতি
ওগো আমার পরম পতি॥
বহু সে কাল বাহির-দ্বারে
দাঁড়িয়ে আছি অন্ধকারে,
এবার দেহের দেউল ভেঙে
দেখব নিঠুর, তোমার জ্যোতি॥
আমি তোমায় চেয়েছিলাম, শুধু সেই সে অপরাধে
ধ্যান ভেঙেছ আমার, ফেলে নিত্য নূতন মায়ার ফাঁদে।
আজ মায়ার ঘরে আগুন জ্বেলে
পালিয়ে গেলাম পাখা মেলে,
জীবন যাহার মিথ্যা স্বপন
মরণ তার নাইকো ক্ষতি॥
কেটে দিলাম নিঠুর হাতে যে বাঁধনে বেঁধেছিলে,
রইল না আর আমার বলে কোনো স্মৃতি এ-নিখিলে।
আবার যদি তোমার মায়ায়
রূপ নিতে হয় নূতন কায়ায়,
তোমার প্রকাশ রুদ্ধ যেথায়
সেথায় যেন না হয় গতি॥
পদ্মার ঢেউ রে– ও মোর শূন্য হৃদয়-পদ্ম নিয়ে যারে
পদ্মার ঢেউ রে–
ও মোর শূন্য হৃদয়-পদ্ম নিয়ে যারে।
এই পদ্মে ছিল রে যার রাঙা পা
আমি হারায়েছি তারে॥
মোর পরান – বঁধু নাই,
পদ্মে তাই মধু নাই নাই রে–
বাতাস কাঁদে বাইরে–
সে সুগন্ধ নাই রে–
মোর রূপের সরসীতে আনন্দ-মৌমাছি নাহি ঝংকারে।
ও পদ্মারে, ঢেউয়ে তোর ঢেউ ওঠায় যেমন চাঁদের আলো
মোর বঁধুয়ার রূপ তেমনই ঝিলমিল করে কৃষ্ণ কালো।
সে প্রেমের ঘাটে ঘাটে বাঁশি বাজায়
যদি দেখিস তারে, দিস এই পদ্ম তার পায়
বলিস কেন বুকে আশার দেয়ালি জ্বালিয়ে
ফেলে গেল চির-অন্ধকারে॥
প্রদীপ নিভায়ে দাও, উঠিয়াছে চাঁদ
প্রদীপ নিভায়ে দাও, উঠিয়াছে চাঁদ।
বাহুর ডোর আছে, মালায় কী সাধ?
ফুল আনিয়ো না ভবনে
কেশের সুবাস তব ঘনাক মনে,
হৃদয়ের লাগি মোর হৃদয় কাঁদে
চন্দন লাগে বিস্বাদ॥
খোলো গুন্ঠন, ফেলে দাও আভরণ,
হাতে রাখো হাত, তোলো আনত নয়ন।
বাহিরে বহুক বাতাস
বক্ষে লাগুক মোর তব ঘন শ্বাস
চম্পার ডালে বসে মোদেরে দেখে
কুহু আর পাপিয়ায় করুক বিবাদ॥
ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি
ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি?
ভোরের হাওয়ায় কান্না পাওয়ায় তব ম্লান ছবি।
যে বীণা তোমার পায়ের কাছে
বুকভরা সুর লয়ে জাগিয়া আছে,
তোমার পরশে ছড়াক হরষে
আকাশে-বাতাসে তার সুরের সুরভি।
তোমার যে প্রিয়া
গেল বিদায় নিয়া
অভিমানে রাতে
গোলাপ হয়ে কাঁদে তাহারই কামনা
উদাস প্রাতে।
ফিরে যে আসিবে না ভোলো তাহারে,
চাহো তাহার পানে দাঁড়ায়ে যে দ্বারে,
অস্ত-চাঁদের বাসনা ভোলাতে অরুণ অনুরাগে
উদিল রবি॥
বঁধু তোমার আমার এই যে বিরহ
বঁধু তোমার আমার এই যে বিরহ
এক জনমের নহে।
তাই যত কাছে পাই তত এ হিয়ায়
কী যেন অভাব রহে॥
বারে বারে মোরা কত সে ভুবনে আসি
দেখিয়া নিমেষে দুইজনে ভালোবাসি
দলিয়া সহসা মিলনের সেই মালা
(কেন) চলিয়া গিয়াছি দোঁহে॥
আমরা বুঝি গো বাঁধিব না ঘর, অভিশাপ বিধাতার
শুধু চেয়ে থাকি, কেঁদে কেঁদে ডাকি, চাঁদ আর পারাবার।
মোদের জীবন-মঞ্জরী দুটি হায়
কতবার ফোটে, কতবার ঝরে যায়
(বঁধু) আমি কাঁদি ব্রজে, তুমি কাঁদ মথুরায়,
(মাঝে) অপার যমুনা বহে॥
বন-বিহঙ্গ যাও রে উড়ে
বন-বিহঙ্গ! যাও রে উড়ে
মেঘনা নদীর পারে।
দেখা হলে আমার কথা
কইয়ো গিয়া তারে॥
কোকিল ডাকে বকুল-ডালে
যে মালঞ্চে সাঁঝ-সকালে
আমার বন্ধু কাঁদে সেথায়
গাঙেরই কিনারে॥
গিয়া তারে দিয়া আইস আমার শাপলা-মালা
আমার তরে লইয়া আইস তাহার বুকের জ্বালা।
সে যেন রে বিয়া করে
সোনার কন্যা আনে ঘরে
আমার পাটের জোড় পাঠাইয়া দিব সে কন্যারে॥