গাঙে জোয়ার এল ফিরে তুমি এলে কই
গাঙে জোয়ার এল ফিরে তুমি এলে কই।
খিড়কি দুয়ার খুলে পথ-পানে চেয়ে রই॥
কালোজামের ডালের ফাঁকে
আমায় দেখে কোকিল ডাকে,
আজও কেন যায় না দেখা তোমার নায়ের ছই॥
চুল বেঁধে আর সেজে গুজে পিদিম জ্বালাই সাঁঝে,
ঠাকুরঝিরা মুচকি হাসে, আমি মরি লাজে।
বাদলা রাতে বৃষ্টি ঝরে
মন যে আমার কেমন করে
আমার চোখের জলে বন্ধু মাঠ করে থই-থই॥
গান ভুলে যাই মুখ পানে চাই
গান ভুলে যাই মুখ পানে চাই, সুন্দর হে
(সুন্দর মোর!)
তব নয়ন পানে চাহি কন্ঠের সুর কাঁপে থরথর হে
(সুন্দর মোর!)
তোমার অনুরাগে, ওগো বুলবুল!
মোর গানের লতায় ফোটে কথার ফুল,
অশ্রু হয়ে সেই ফুল তব পায়ে ঝরিতে চায় ঝরঝর হে
(সুন্দর মোর!)
এ নহে গান প্রিয়, কান্না এ যে তব বিরহে,
অন্তর-শিলাতলে রোদনের সুরধুনী সুর হয়ে বহে।
প্রিয়, এ নহে গানের ছন্দ,
এ যে আনন্দে বিষাদে মনের দ্বন্দ্ব,
(এ যে) রাগিণীর তলে তব অনুরাগিণীর
– মর্মের ক্রন্দন বিলাপ-মর্মর হে
(সুন্দর মোর!)
ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে
ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে, জাগায়ো না জাগায়ো না।
সারা জীবন যে আলো দিল, ডেকে তার ঘুম ভাঙায়ো না॥
(যে) সহস্র করে রূপ-রস দিয়া
জননীর কোলে পড়িল ঢলিয়া,
তাঁহারে শান্তি-চন্দন দাও, ক্রন্দনে রাঙায়ো না॥
যে তেজ শৌর্য-শক্তি দিলেন আপনারে করি ক্ষয়
তাই হাত পেতে নাও।
বিদেহ রবি ও ইন্দ্র মোদের নিত্য দেবেন জয়
কবিরে ঘুমাতে দাও।
অন্তরে হেরো হারানো রবির জ্যোতি
সেইখানে তাঁরে নিত্য করো প্রণতি
(আর) কেঁদে তাঁরে কাঁদায়ো না॥
চোখ গেল চোখ গেল কেন ডাকিস রে
‘চোখ গেল’ ‘চোখ গেল’ কেন ডাকিস রে–
‘চোখ গেল’ পাখি রে!
তোরও চোখে কাহার চোখ পড়েছে নাকি রে–
‘চোখ গেল’ পাখি রে!
তোর চোখের বালির জ্বালা জানে সবাই রে–
জানে সবাই
চোখে যার চোখ পড়ে তার ওষুধ নাই রে–
তার ওষুধ নাই ;
কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয় কাহার আঁখি রে–
‘চোখ গেল’ পাখি রে॥
তোর চোখের জ্বালা বুঝি নিশিরাতে বুকে লাগে
‘চোখ গেল’ ভুলে রে ‘পিউ কাঁহা’ ‘পিউ কাঁহা’ বলে
তাই ডাকিস অনুরাগে রে।
ওরে বন-পাপিয়া, কাহার গোপন প্রিয়া ছিলি–
আর-জনমে
আজও ভুলতে নারিস আজও ঝুরে হিয়া
ওরে পাপিয়া বল, যে হারায় তাহারে কি
পাওয়া যায় ডাকি রে–
‘চোখ গেল’ পাখি রে।
‘চোখ গেল’ পাখি॥
ছড়ায়ে বৃষ্টির বেলফুল
ছড়ায়ে বৃষ্টির বেলফুল
দুলায়ে মেঘলা চাঁচর চুল
চপল চোখে কাজল মেঘে আসিল কে॥
বাজায়ে কে মেঘের মাদল
ভাঙালে ঘুম ছিটিয়ে জল,
একা-ঘরে বিজলিতে এমন হাসি হাসিল কে॥
এলে কি দুরন্ত মোর ঝোড়ো হাওয়া,
চির-নিঠুর প্রিয়-মধুর পথ চাওয়া।
হৃদয়ে মোর দোলা লাগে,
ঝুলনেরই আবেশ জাগে,
ফেলে-যাওয়া বাসি মালায়–
আবার ভালোবাসিলে কে॥
জানি জানি প্রিয় এ জীবনে মিটিবে না সাধ
জানি, জানি প্রিয়, এ জীবনে মিটিবে না সাধ।
আমি জলের কুমুদিনী ঝরিব জলে
তুমি দূর গগনে থাকি কাঁদিবে চাঁদ॥
আমাদের মাঝে বঁধু বিরহ-বাতাস
চিরদিন ফেলে যাবে দীরঘ শ্বাস,
কভু পায় না বুকে, তবু মুখে মুখে
চাঁদ কুমুদীর নামে রটে অপবাদ॥
তুমি কত দূরে বঁধু, তবু বুকে এত মধু কেন উথলায়?
হাতের কাছে রহ রাতের চাঁদ মোর, ধরা নাহি যায়
তবু ছোঁয়া নাহি যায়।
মরুতৃষা লয়ে কাঁদে শূন্য হিয়া
(তবু) সকলে বলে, আমি তোমারই প্রিয়া।
সেই কলঙ্ক-গৌরব সৌরভ দিল গো,
মধুর হল মোর বিরহ-বিষাদ॥
জুঁই-কুঞ্জে বন-ভোমরা গুঞ্জে গুনগুন
জুঁই-কুঞ্জে বন-ভোমরা গুঞ্জে গুনগুন!
প্রেম-ঝরনার মধু-মঞ্জীর বাজে বক্ষে রুনুঝুন॥
মন-গোলাপের পাঁপড়ি কাঁপে কেন গো
স্বপন দেখে পালিয়ে যাওয়া বুলবুলি যেন গো
চুড়ি কঙ্কণে কোন আনমনা পেয়ালা বাজায়
রিনিঠিনি ঠুনঠুন॥
ছলছল চোখে চাঁদ আশমানে জলসায়
সঙ্গিনী তারাদের ভুলে ধরার কুমুদীর পানে কেন চায়,
হৃদয়ের এই নির্দয় খেলা দেখে
হাসনুহানা হেসে খুন॥
ঝুম ঝুম ঝুমরা নাচ নেচে কে এল গো
ঝুম ঝুম ঝুমরা নাচ নেচে কে এল গো, সই লো দেখে আয়।
বঁইচি বনের বিরহে বাউরি বাতাস বহে এলোমেলো গো,
(সে) আড়বাঁশি বাজায় আড় চোখে তাকায়
–তির হানার ভঙ্গিতে ধনুক বাঁকায়
নন্দন পাহাড়ে তাহারে দেখে চাঁদ আঁউরে গেল গো।
ঝাঁকড়া চুলের পাশে টুলটুলে চোখ হাসে কতই ছলে,
মউরলা মাছ যেন খেলে বেড়ায় গো কালো জলে,
মউটুসির মউ ফেলে ভোমরা রয় তাকিয়ে
গুরুজনের মতো বটের তরু দাঁড়িয়ে জট পাকিয়ে
আমলকী গাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখি
সে দেখতে কি তা পেল গো॥
তব চলার পথে আমার গানের ফুল ছড়িয়ে যাই গো
তব চলার পথে আমার গানের ফুল ছড়িয়ে যাই গো
ফুল ছড়িয়ে যাই।
তারা ধূলায় পড়ে কাঁদে, বলে, ‘তোমার পরশ হতে চাই গো
আলতা হতে চাই!’
ওরা রাঙা হয়ে অনুরাগের রসে
তোমার চরণ-তলে পড়ে খসে,
ওদের দলে যেয়ো না যদি হয় বক্ষে তোমার
ঠাঁই গো॥
ওরা বুক পেতে দেয় পায়ের কাছে, অশ্রু-টলমল
বলে, ‘ধূলির পথে চলো না গো, ফুলের পথে চলো!’
(তুমি) চরণ ফেলে কেন ভয়ে ভয়ে
বিরহ মোর ফুটেছে ফুল হয়ে,
কাঁটা আছে আমার বুকে, ফুলে কাঁটা নাই গো॥
তব মুখখানি খুঁজিয়া ফিরি গো সকল ফুলের মুখে
তব মুখখানি খুঁজিয়া ফিরি গো সকল ফুলের মুখে,
ফুল ঝরে যায় তব স্মৃতি জাগে কাঁটার মতন বুকে।
তব প্রিয়নাম ধরে ডাকি
ফুল সাড়া দেয় মেলি আঁখি
তোমার নয়ন ফুটিল না হায় ফুলের মতন সুখে।
আকাশে বাতাসে তব নাম লয়ে* ওঠে রোদনের বাণী
কানাকানি করে চাঁদ ও তারায় জানি গো তোমারে জানি।
খুঁজি বিজলি প্রদীপ জ্বেলে
কাঁদি ঝঞ্ঝার পাখা মেলে
অন্ধ গগনে আঁধার মেঘের ঢেউ ওঠে মোর দুখে।