ওরে ডেকে দে দে লো, মহুয়া-বনে ফুল ফোটাত
ওরে ডেকে দে দে লো, মহুয়া-বনে ফুল ফোটাত
বাজিয়ে বাঁশি কে।
বনের হরিণ নাচাত, পাখিকে গান গাওয়াতো,
ঢেউ ওঠাতো ঝরনাজলে – পা্হাড়তলিতে॥
তারগানের কথা জানিয়ে দিত ফুলের মধুকে,(তার)সুরের নেশা করত ব্যাকুল মনের বঁধুকে
গো মনের বঁধুকে
বুকের মাঝে বাজত নূপুর চপল হাসিতে
লো তার চপল হাসিতে॥
আঁধার রাতে ফোটাত সে হলুদ গাঁদার ফুল,
সে বন কাঁদাতো, মন কাঁদাতো, কাজ করাতো ভুল
লো কাজ করাত ভুল।
আর সে বাঁশি শুনি না
ধোঁয়ার ছলে কাঁদি না,
আর রাঙা শাড়ি পরি না, নোটন খোঁপা বাঁধি না,
আমিরইতে নারি না হেরে সেই বন-উদাসীকে লো
বন-উদাসীকে॥
কত দূরে তুমি ওগো আঁধারের সাথি
কত দূরে তুমি, ওগো আঁধারের সাথি।
হাত ধরো মোর নিভিয়া গিয়াছে বাতি॥
চলিতে চলিতে তোমার তীর্থপথে
হারায়ে গিয়াছি অন্ধকারের স্রোতে
এসে তুলে লও তোমার সোনার রথে
(লহো) প্রভাতের তীরে, শেষ হয় যেথা রাতি॥
যে ধ্রুবতারার পথ দেখাইয়া নীরবে চলেছ তুমি
সে পথ ভুলিয়া আসিলাম মায়াতৃষ্ণার মরুভূমি।
সাড়া নাহি পাই আজ আর ডেকে ডেকে
কাঁদিছ কি তুমি মোরে সাথে নাহি দেখে?
হয়তো ফিরিবে অমৃতের তীর থেকে
সেই আশে আছি পথ পানে আঁখি পাতি॥
কত ফুল তুমি পথে ফেলে দাও
কত ফুল তুমি পথে ফেলে দাও, মালা গাঁথ অকারণে।
আমি চেয়েছিনু একটি কুসুম, সেই কথা পড়ে মনে॥
তব ফুল-বনে কত ছায়া দোলে
জুড়াইতে চেয়েছিনু তারই তলে
চাহিলে না ফিরে, চলে গেলে ধীরে
ছায়া-ঢাকা অঙ্গনে।
সেই কথা পড়ে মনে॥
অঞ্জলি পাতি চেয়েছিনু, তব ভরা ঘটে ছিল বারি,
শুষ্ক কন্ঠে ফিরিয়া আসিনু পিপাসিত পথচারী।
বহু দিন পরে দাঁড়াইনু এসে
তোমার দুয়ারে উদাসীন বেশে,
শুকানো মালিকা কেন দিলে তুমি
তব ভিক্ষার সনে?
ভাবি বসি আনমনে॥
কাবেরী নদী-জলে কে গো বালিকা
কাবেরী নদী-জলে কে গো বালিকা
আনমনে ভাসাও চম্পা শেফালিকা
প্রভাত-সিনানে আসি আলসে
কঙ্কণ-তাল হানো কলসে,
খেলে সমীরণ লয়ে কবরীর মালিকা॥
দিগন্তে অনুরাগে নবারুণ জাগে
তব জল ঢলঢল করুণা মাগে।
ঝিলম রেবা নদী তীরে
মেঘদূত বুঝি খুঁজে ফিরে
তোমারই তন্বী শ্যামা কর্ণাটিকা॥
কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া
কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া
কুহরিল মহুয়া-বনে।
চমক জাগিনু নিশীথ শয়নে॥
শূন্য ভবনে মৃদুল সমীরে
প্রদীপের শিখা কাঁপে ধীরে ধীরে,
চরণ-চিহ্ন রাখি দলিত কুসুমে
চলিয়া গেছ তুমি দূর-বিজনে॥
বাহিরে ঝরে ফুল আমি ঝুরি ঘরে
বেণু-বনে সমীরণ হাহাকার করে,
বলে যাও কেন গেলে এমন করে
কিছু নাহি বলে সহসা গোপনে॥
কেন মেঘের ছায়া আজি চাঁদের চোখে
কেন মেঘের ছায়া আজি চাঁদের চোখে
মোর বুকে মুখ রাখি ঝড়ের পাখি-সম কাঁদে ও কে
গভীর নিশীথে কন্ঠ জড়ায়ে
শ্রান্ত কেশভার গগনে ছড়ায়ে
হারানো প্রিয়া মোর এল কি লুকায়ে
আমার একা-ঘরে ম্লান আলোকে॥
গঙ্গায় তারই চিতা নিভেছে কবে,
মোর বুকে সেই চিতা আজও জ্বলে নীরবে।
স্মৃতির চিতা তার
নিভিবে না বুঝি আর
কোন সে জনমে কোন সে লোকে॥
কেমনে হইব পার
কেমনে হইব পার
হে প্রিয়, তোমার আমার মাঝে এ বিরহের পারাবার
নিশীথের চখাচখির মতন
দুই কূলে থাকি কাঁদি দুইজন
আসিল না দিন মোদের জীবনে
অন্তহীন আঁধার।
কেমনে হইব পার॥
সেধেছিনু বুঝি বাদ
কাহার মিলনে সে কোন জনমে, তাই মিটিল না সাধ।
স্মৃতি তব ঝরা পালকের প্রায়
লুটায় মনের বালুচরে হায়
সে কোন প্রভাতে কোন নবলোকে
মিলিব মোরা আবার।
কোন সে সুদূর অশোক-কাননে বন্দিনী তুমি সীতা
কোন সে সুদূর অশোক-কাননে বন্দিনী তুমি সীতা
আর কতকাল জ্বলিবে আমার বুকে বিরহের চিতা
সীতা – সীতা।
বিরহে তোমার অরণ্যচারী
কাঁদে রঘুবীর বল্কলধারী,
ঝরা চামেলির অশ্রু ঝরায়ে
ঝুরিছে বন-দুহিতা।
সীতা – সীতা!
তোমার আমার এই অনন্ত অসীম বিরহ নিয়া
কত আদি কবি কত রামায়ণ রচিবে কে জানে প্রিয়া।
বেদনার সুর-সাগর তীরে
দয়িতা আমার এসো এসো ফিরে
আবার আঁধার হৃদি-অযোধ্যা
হইবে দীপান্বিতা॥
সীতা – সীতা।
গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়
গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়, কে যেন আমারে ডাকে –
সে কি তুমি, সে কি তুমি?
কার স্মৃতি বুকে পাষাণের মতো ভার হয়ে যেন থাকে –
সে কি তুমি, সে কি তুমি?
কাহার ক্ষুধিত প্রেম যেন, হায়!
ভিক্ষা চাহিয়া কাঁদিয়া বেড়ায়,
কার সকরুণ আঁখি দুটি যেন রাতের তারার মতো
মুখ পানে চেয়ে থাকে –
সে কি তুমি, সে কি তুমি?
নিশির বাতাস কাহার হুতাশ দীর্ঘ নিশাস সম
ঝড় তোলে এসে অন্তর মোরে; ওগো দুরন্ত মম!
সে কি তুমি, সে কি তুমি?
মহাসাগরের ঢেউ-এর মতন
বুকে বাজে এসে কাহার রোদন?
পিয়া পিয়া নাম ডাকে অবিরাম বনের পাপিয়া পাখি
আমার চম্পা-শাখে –
সে কি তুমি, সে কি তুমি?
গভীর রাতে জাগি খুঁজি তোমারে
গভীর রাতে জাগি খুঁজি তোমারে
দূর গগনে প্রিয়া তিমির পারে॥
জেগে যবে দেখি হায় তুমি নাই কাছে
আঙিনায় ফুটে ফুল ঝরে পড়ে আছে
বাণ-বেঁধা পাখি সম আহত এ প্রাণ মম
লুটায়ে লুটায়ে কাঁদে অন্ধকারে॥
মৌনা নিঝুম ধরা, ঘুমায়েছে সবে।
এসো প্রিয়, এই বেলা বক্ষে নীরবে।
কত কথা কাঁটা হয়ে বুকে আছে বিঁধে,
কত অভিমান কত জ্বালা এই হৃদে
দেখিবে এসো প্রিয় কত সাধ ঝরে গেল কত আশা
মরে গেল হাহাকারে॥