আমি নহি বিদেশিনি
আমি নহি বিদেশিনি।
(ওই) ঝিলের ঝিনুক, বিলের শালুক
ছিল মোর সঙ্গিনী॥
ওই বাঁধা-ঘাট, ওই বালুচর,
মাটির প্রদীপ, ওই মেটে ঘর
চেনে মোরে ওই তুলসীতলার নববধূ ননদিনি॥
‘বউ কথা কও’ পাখি–
বাদলা নিশীথে মনের নিভৃতে আজও যায় মোরে ডাকি।
এত কালো চোখ এলোকেশ-ভার
এত শ্যাম-মেঘ আছে কোথা আর
(ওই) পদ্ম-পুকুরে মোরে স্মরি ঝুরে সখি মোর
কমলিনী॥
আমি পুরব দেশের পুরনারী
আমি পুরব দেশের পুরনারী
গাগরি ভরিয়া এনেছি গো অমৃত-বারি।
পদ্মাকূলের আমি পদ্মিনী বঁধু গো,
এনেছি শাপলা পদ্মের মধু গো
ঘন বনছায়ার শ্যামলী মায়ায়
শান্তি আনিয়াছি ভরি হেমঝারি॥
আমি শঙ্খনগর হতে আনিয়াছি শাঁখা, অভয়শঙ্খ
ঝিল ছেনে এনেছি সুনীল কাজল গো
বিল ছেনে এনেছি চন্দনপঙ্ক।
এনেছি শত ব্রত পার্বণ উৎসব
এনেছি সারস হংসের কলরব
এনেছি, নব আশা উষার সিন্দূর
মেঘ-ডম্বরু সাথে মেঘডুমুর শাড়ি॥
আমি সন্ধ্যামালতী বনছায়া অঞ্চলে
আমি সন্ধ্যামালতী বনছায়া অঞ্চলে
লুকাইয়া রই ঘন পল্লব-তলে॥
বিহগের গীতি ভ্রমরের গুঞ্জন
নীরব হয় যখন
আমি চাঁদেরে তখন পূজা করি আঁখিজলে॥
আমি লুকাইয়া কাঁদি বনের শকুন্তলা,
মনের কথা এ জীবনে হল না বলা।
গভীর নিশীথে বন-ঝিল্লির সুরে
ডাকি দূর বন্ধুরে
আমি ঝরে পড়ি যবে প্রভাতে সবার
হৃদয়-মুকুল খোলে॥
আর অনুনয় করিবে না কেউ কথা কহিবার তরে
আর অনুনয় করিবে না কেউ কথা কহিবার তরে।
আর দেখিবে না স্বপন রাতে গো
কেহ কাঁদে হাত ধরে।
তব মুখ ঘিরে আর মোর দু-নয়ন
ভ্রমরের মতো করিবে না জ্বালাতন
তব পথ আর পিছল হবে না আমার অশ্রু ঝরে॥
তোমার ভুবনে পড়িবে না আর কোনোদিন ছায়া মম
তোমার পূর্ণচাঁদের তিথিতে আসিব না রাহু-সম।
আর শুনিবে না করুণ কাতর
এই ক্ষুধাতুর ভিখারির স্বর,
শুনিবে না আর কাহারও রোদন
রাতের আকাশ ভরে॥
উজান বাওয়ার গান গো এবার
উজান বাওয়ার গান গো এবার, গাসনে ভাটিয়ালি,
আর গাসনে ভাটিয়ালি।
নতুন আশার চাঁদ উঠেছে কুমড়ো জালির ফালি
যেন কুমড়ো জালির ফালি॥
বান এসেছে, বাঁধ ভেঙেছে, নায়ে দোলা লাগে ;
আড় বাঁশিতে তান ছেড়ে তুই দাঁড় বেয়ে চল আগে ;
দেখ জোয়ার-জলে ডুবে গেছে চরের চোরাবালি॥
কালো বউ-এর চোখ যেন, দেখ
মউরলা মাছ ভাসে,
গাঙচিল আর জল-পায়রা উড়ছে
মুখের পাশে,
শোন ‘বউ কথা কও’ পাখি মোদের করছে দূতিয়ালি॥
জল নিয়ে বউ দাঁড়িয়ে আছে, গাছে কচি ডাব,
লোকসানেরই হিসাব দেখিস, লাভের কথা ভাব!
সাজ রে তামাক, নামুক দেয়া, দুঃখু তো ইজমালি॥
এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা
এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা
(রে ভাই) এই তো বিধির খেলা।
সকাল বেলার আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা॥
সেই নদীর ধারে কোন ভরসায়
(ওরে বেভুল) বাঁধলি বাসা সুখের আশায়,
যখন ধরল ভাঙন পেলিনে তুই
পারে যাবার ভেলা॥
এই দেহ ভেঙে হয় রে মাটি, মাটিতে হয় দেহ,
যে কুমোর গড়ে সেই দেহ – তার খোঁজ নিল না কেহ।
রাতে রাজা সাজে নাট-মহলে
দিনে ভিক্ষা মেগে পথে চলে
শেষে শ্মশান-ঘাটে গিয়ে দেখে
সবই মাটির ঢেলা।
এই তো বিধির খেলা রে ভাই
ভব-নদীর খেলা॥
এই বিশ্বে আমার সবাই চেনা
এই বিশ্বে আমার সবাই চেনা, কেউ অচেনা নাই
যারে দেখি হয় মনে সেই বন্ধু প্রিয় ভাই
কেউ অচেনা নাই॥
কোন সে লোকে, নাই তা মনে
চেনা ছিল সবার সনে
দেখে এদের প্রাণ জুড়িয়ে যায় রে আমার তাই।
কেউ অচেনা নাই॥
চোখ যারে কয় ‘চিনতে নারি’ প্রাণ কেন রে কাঁদে
(তারেই) জড়িয়ে ধরতে চায় এই বুক (যে) শত্রু হয়ে বাঁধে।
সব মানুষের প্রাণের কাছে
আমার চেনা লুকিয়ে আছে
(তাই) অচেনা কেউ চেনা হলে এত আনন্দ পাই
কেউ অচেনা নাই॥
এবার যখন উঠিবে সন্ধ্যাতারা – সাঁঝ আকাশে
এবার যখন উঠিবে সন্ধ্যাতারা – সাঁঝ আকাশে
দেখতে পাবে দুটি নতুন তারা – তাহার পাশে॥
চেয়ে দেখো ভালো করে
কার দুটি চোখ যেন মরে
তারা হয়ে ধরার পানে চাহে
তোমার আঁখি দেখার আশে॥
যে দুটি চোখ নিত্য লোকের মাঝে
তোমায় দিত লাজ
পড়বে মনে গো –
সেই দুটি চোখ চিরতরে এই পৃথিবী হতে –
হারিয়ে গেছে আজ।
পায়নি গো, তাই অভিমানে
চলে গেছে দূর বিমানে
(দেখো) সেদিন যেন আজের মতো চাইতে ওদের পানে
দ্বিধা নাহি আসে॥
ওগো সুন্দর তুমি আসিবে বলিয়া বনপথে পড়ে ঝরি
ওগো সুন্দর তুমি আসিবে বলিয়া বনপথে পড়ে ঝরি
রাঙা অশোকের মঞ্জরী
হাসে বনদেবী বেণিতে জড়ায়ে মালতীর বল্লরি, নব কিশলয় পরি।
কুমুদি কালিকা ঈষৎ হেলিয়া, চাঁদেরে নেহারি হাসে মুচকিয়া
মহুয়ার বনে ভ্রমর ভ্রমরী ফিরিতেছে গুঞ্জরি॥
যাহা কিছু হেরি ভালো লাগে আজ লুকাইতে নারি হাসি,
কাজ করি আর শুনি যেন কানে মিঠে পাহাড়িয়া বাঁশি।
এক শাড়ি খুলে পরি আর শাড়ি
বারে বারে মুখ মুকুরে নেহারি
দুরু দুরু হিয়া ওঠে চমকিয়া, অকারণে লাজে মরি॥
ওগো প্রিয়, তব গান
ওগো প্রিয়, তব গান!
আকাশ গাঙের জোয়ারে উজান বহিয়া যায়।
মোর কথাগুলি বুকের দুয়ারে
–পথ খুঁজে নাহি পায়।
ওগো দখিনা পবন, ফুলের সুরভি বহো
ওরই সাথে মোর না-বলা বাণী লহো,
ওগো মেঘ, তুমি মোর হয়ে গিয়ে কহো,
বন্দিনী গিরি ঝরনা পাষাণ-তলে
যে কথা কহিতে চায়॥
ওরে ও সুরমা, পদ্মা, কর্ণফুলি, তোদের ভাটির স্রোতে
নিয়ে যা আমার না-বলা বাণীগুলি ধুয়ে মোর বুক হতে।
(ওরে) ‘চোখ গেল’ ‘বউ কথা কও’ পাখি,
তোদের কন্ঠে মোর সুর যাই রাখি কি?
(ওরে) মাঠের-মুরলী কহিয়ো তাহারে ডাকি,
আমার এ কলির না-ফোটা বুলি,
ঝরে গেল নিরাশায়।