- বইয়ের নামঃ বুলবুল (দ্বিতীয় খণ্ড)
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অনেক ছিল বলার যদি সেদিন ভালোবাসতে
অনেক ছিল বলার, যদি
সেদিন ভালোবাসতে।
পথ ছিল গো চলার, যদি
দু-দিন আগে আসতে॥
আজকে মহাসাগর-স্রোতে
চলেছি দূর পারের পথে
ঝরা পাতা হারায় যথা
সে আঁধারে ভাসতে॥
গহন রাতি ডাকে আমায়
এলে তুমি আজকে
কাঁদিয়ে গেলে হায় গো আমার
বিদায় বেলার সাঁঝকে।
আসতে যদি হে অতিথি
ছিল যখন শুক্লা তিথি
ফুটত চাঁপা, সেদিন যদি
চৈতালি চাঁদ হাসতে॥
আজও ফাল্গুনে বকুল কিংশুকের বনে
মঞ্জুভাষিণী
আজও ফাল্গুনে বকুল কিংশুকের বনে
কহে কোন কথা হৃদয় স্বপ্নে আনমনে
মৃদু মর্মরে পথের পল্লবের সাথে
গাহে কোন গীতি নিশীথে পানসে জ্যোৎস্নাতে
খোঁজে কার স্মৃতি নীরস শুভ্র চন্দনে॥
গ্রহে চন্দ্রে কয়, সে কি গো মৃত্যুদ্বার খুলে
হয়ে সৃষ্টি পার গিয়াছে অমৃতের কূলে
কাঁদে কোন লোকে পরম সুন্দরের সনে॥
আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়
আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়, চাঁদ নেহারিয়া প্রিয়
মোরে যদি মনে পড়ে, বাতায়ন বন্ধ করিয়া দিয়ো॥
সুরের ডুরিতে জপমালা সম
তব নাম গাঁথা ছিল প্রিয়তম
দুয়ারে ভিখারি গাহিলে সে গান তুমি ফিরে না চাহিয়ো॥
অভিশাপ দিয়ো, বকুল-কুঞ্জে যদি কুহু গেয়ে ওঠে,
চরণে দলিয়ো সেই জুঁই গাছে আর যদি ফুল ফোটে।
মোর স্মৃতি আছে যা কিছু যেথায়
যেন তাহা চির-তরে মুছে যায়,
(মোর) যে ছবি ভাঙিয়া ফেলেছ ধুলায়
আর তুলে নাহি নিয়ো।
(তারে) তুলে নাহি নিয়ো॥
আনো গোলাপ-পানি, আনো আতরদানি গুলবাগে
আনো গোলাপ-পানি, আনো আতরদানি গুলবাগে
সেহেলি গো কিছু ভালো নাহি লাগে॥
বেদুইন ছেলের বাঁশি কারে ডাকে
কেঁদে কেঁদে অনুরাগে॥
মরুযাত্রীদের উটের সারি যেমন চাহে তৃষার বারি
তেমনই মম পিয়াসি পরান যেন কার
প্রেম-অমৃত বারি মাগে॥
চাঁদের পিয়ালাতে জোছনা-শিরাজি ঝরে যায়
আমারই হৃদয় কেন গো সে মধু নাহি পায়।
হায়, হায়, বাদাম গাছের আঁধার বনে
নিশ্বাস ওঠে যেন বুলবুলির শিসের সনে,
বিরহী মোর কোথায় কাঁদে কোন মদিনাতে–
ফোরাত নদীর রোদন সম বুকে ঢেউ জাগে॥
আমার ভুবন কান পেতে রয় প্রিয়তম তব লাগিয়া
আমার ভুবন কান পেতে রয় প্রিয়তম তব লাগিয়া।
দীপ নিভে যায়, সকলে ঘুমায়, মোর আঁখি রহে জাগিয়া
প্রিয়তম তব লাগিয়া॥
তারারে শুধাই, ‘কত দেরি আর?
কখন আসিবে বিরহী আমার?’
ওরা বলে, ‘হেরো পথ চেয়ে তার নয়ন উঠেছে রাঙিয়া’।
প্রিয়তম তব লাগিয়া॥
‘আসিতেছে সে কি মোর অভিসারে’ কাঁদিয়া শুধাই চাঁদে,
মোর মুখপানে চেয়ে চেয়ে চাঁদ নীরবে শুধু কাঁদে।
ফাগুন-বাতাস করে হায় হায়
(বলে) ‘বিরহিণী তোর নিশি যে পোহায়।
ফুল বলে, ‘আর জাগিতে নারি গো,
ঘুমে আঁখি আসে ভাঙিয়া॥’
প্রিয়তম তব লাগিয়া॥
আমায় নহে গো ভালোবাস শুধু ভালোবাস মোর গান
আমায় নহে গো, ভালোবাস শুধু ভালোবাস মোর গান।
বনের পাখিরে কে চিনে রাখে গান হলে অবসান।
চাঁদেরে কে চায়, জোছনা সবাই যাচে
গীত শেষে বীণা পড়ে থাকে ধূলি মাঝে;
তুমি বুঝিবে না, আলো দিতে পোড়ে কত প্রদীপের প্রাণ।
যে কাঁটা-লতার আঁখি-জল, হায়, ফুল হয়ে ওঠে ফুটে,
ফুল নিয়ে তায় – দিয়েছ কি কিছু শূন্য পত্রপুটে!
সবাই তৃষ্ণা মিটায় নদীর জলে,
কী তৃষা জাগে সে নদীর হিয়া-তলে
বেদনার মহাসাগরের কাছে করো তার সন্ধান॥
আমি আছি বলে দুখ পাও তুমি
আমি আছি বলে দুখ পাও তুমি, তাই আমি যাব চলে।
এবার ঘুমাও প্রদীপের কাজ শেষ হয়ে গেছে জ্বলে॥
আর আসিবে না কোনো অশান্তি,
আর আসিবে না ভয়ের ভ্রান্তি,
আর ভাঙিবে না ঘুম নিশীথে গো, ‘জাগো প্রিয়া জাগো’ বলে॥
হয়তো আবার সুদূর শূন্যে আকাশে বাজিবে বাঁশি,
গোপী-চন্দন-গন্ধ আসিবে বাতায়ন-পথে ভাসি।
চম্পার ডালে বিরহী পাপিয়া
‘পিয়া পিয়া’ বলে উঠিবে ডাকিয়া,
বৃন্দাবন কি ভাসিবে আবার
সেদিন রোদন-যমুনা-জলে॥
আমি চাঁদ নহি, চাঁদ নহি অভিশাপ
আমি চাঁদ নহি, চাঁদ নহি অভিশাপ।
শূন্য গগনে আজও নিরাশায় আকাশে করি বিলাপ॥
শত জনমের অপূর্ণ সাধ লয়ে –
(আমি) গগনে কাঁদি গো ভুবনের চাঁদ হয়ে,
জোছনা হইয়া ঝরে গো আমার অশ্রু বিরহ-তাপ॥
কলঙ্ক হয়ে বুকে দোলে মোর তোমার স্মৃতির ছায়া,
এত জোছনায় ঢাকিতে পারি নি তোমার মধুর মায়া
কোন সে সাগর-মন্থন শেষে মোরে
জড়াইয়া যেন উঠেছিলে প্রেমভরে,
(হায়) তুমি গেছ চলে, বুকে তবু দোলে তব অঙ্গের ছাপ॥
আমি চিরতরে দূরে চলে যাব
আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে।
(আমি) বাতাস হইয়া জড়াইব কেশ, বেণি যাবে যবে খুলিতে॥
তোমার সুরের নেশায় যখন
ঝিমাবে আকাশ কাঁদিবে পবন
রোদন হইয়া আসিব তখন তোমার বক্ষে ঝুরিতে॥
আসিবে তোমার পরমোৎসব কত প্রিয়জন কে জানে
মনে পড়ে যাবে – কোন সে ভিখারি পায়নি ভিক্ষা এখানে।
তোমার কুঞ্জ পথে যেতে হায়
চমকি থামিয়া যাবে বেদনায়
দেখিবে, কে যেন মরে মিশে আছে তোমার পথের ধূলিতে।
আমি জানি তব মন আমি বুঝি তব ভাষা
আমি জানি তব মন আমি বুঝি তব ভাষা।
তব কঠিন হিয়ার তলে জাগে
কী গভীর ভালবাসা॥
ওগো উদাসীন! আমি জানি তব ব্যথা,
আহত পাখির বুকে বাণ বিঁধে কোথা,
কোন অভিমানে ভুলিয়াছ তুমি
ভালবাসিবার আশা॥
তুমি কেন হানো অবহেলা অকারণে আপনাকে,
প্রিয়া, যে হৃদয়ে বিষ থাকে – সেই হৃদয়েই অমৃত থাকে।
তব যে-বুকে জাগে প্রলয়-ঝড়ের জ্বালা
আমি দেখেছি যে সেথা সজল মেঘের মালা
ওগো ক্ষুধাতুর আমারে আহুতি দিলে
মিটিবে কি তব পরানের পিপাসা॥