দেখে যা তোরা নদিয়ায়
কীর্তন মিশ্র
দেখে যা তোরা নদিয়ায়।
গোরার রূপে এল ব্রজের শ্যামরায়।
মুখে হরি হরি বলে হেলে দুলে নেচে চলে,
নরনারী প্রেমে গলে ঢলে পড়ে রাঙা পায়॥
ব্রজে নূপুর পরি নাচিত এমনই হরি,
কুল ভুলিয়া সবে ছুটিত এমনই করি।
শচি মাতার রূপে কাঁদে মা যশোদা,
বিষ্ণুপ্রিয়ার চোখে কাঁদে কিশোরী রাধা।
নহে নিমাই নিতাই, ও যে কানাই বলাই,
শ্রীদাম সুদাম এল জগাই মাধাই-এ হায়॥
অসি নাই বাঁশি নাই, এবার শূন্য হাতে,
এসেছে ভুবন ভুলাতে
লীলা-পাগল এল প্রেমে মাতাতে,
ডুবু ডুবু নদিয়া, বিশ্ব ভাসিয়া যায়॥
দোলে নিতি নব তূপের ঢেউ-পাথার
ভজন
ভীমপলশ্রী কাহারবা
দোলে নিতি নব তূপের ঢেউ-পাথার
ঘনশ্যাম তোমারই নয়নে॥
আমি হেরি যে নিখিল বিশ্বরূপ-সম্ভার
তোমারই নয়নে॥
তুমি পলকে ধরো নাথ সংহার-বেশ,
হও পলকে করুণা-নিদান পরমেশ!
নাথ ভরা যেন বিষ অমৃতের ভাণ্ডার
তোমার দুই নয়নে॥
ওগো মহা-শিশু, তব খেলাঘরে
এ কী বিরাট সৃষ্টি বিহার করে,
সংসার চক্ষে তুমিই হে নাথ,
সংসার তোমারই নয়নে॥
তুমি নিমেষে রচি নব বিশ্বছবি
ফেল নিমেষে মুছিয়া হে মহাকবি,
করে কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড ভুবন-সঞ্চার
তোমারই নয়নে॥
তুমি ব্যাপক বিশ্ব চরাচরে
জড় তীবতন্তু নারী-নরে,
কর কমল-লোচন, তোমার রূপ বিস্তার হে
আমারই নয়নে॥
ধ্যান ধরি কীসে হে গুরু
ভীমপলশ্রী মধ্যমান
ধ্যান ধরি কীসে হে গুরু,
তুমি যোগ শিখাইতে এলে।
কানন-পথে শ্যাম যে প্রেম-বাণী
মধুকর-করে পাঠালে,
হে গুরু, কী যোগ আমি শিখিব তা ফেলে।
তুমি যোগ শিখাইতে এলে॥
নদীর নাম সই অঞ্জনা
গ্রাম্য সংগীত
নদীর নাম সই অঞ্জনা
নাচে তীরে খঞ্জনা,
পাখি সে নয় নাচে কালো আঁখি।
আমি যাব না আর অঞ্জনাতে
জল নিতে সখী লো,
ওই আঁখি কিছু রাখিবে না বাকি॥
সেদিন তুলতে গেলাম
দুপুর বেলা
কলমি শাক ঢোলা ঢোলা
হল না আর সখী লো শাক তোলা,
আমার মনে পড়িল সখী,
ঢলঢল তার চটুল আঁখি,
ব্যথায় ভরে উঠল বুকের তলা।
ঘরে ফেরার পথে দেখি,
নীল শালুক সুঁদি ও কী ফুটে আছে
ঝিলের গহিন জলে।
আমার অমনি পড়িল মনে
সেই ডাগর আঁখি লো,
ঝিলের জলে চোখের জলে
হল মাখামাখি॥
নম নম নমো বাংলাদেশ মম
স্বদেশি গান
নম নম নমো বাংলাদেশ মম
চির-মনোরম চির মধুর।
বুকে নিরবধি বহে শত নদী
চরণে জলধির বাজে নূপুর॥
শিয়রে গিরি-রাজ হিমালয় প্রহরী,
আশিস-মেঘ বারিসদা তার পড়ে ঝরি,
যেন উমার চেয়ে এ আদরিণী মেয়ে,
ওড়ে আকাশ ছেয়ে মেঘ-চিকুর॥
গ্রীষ্মে নাচে বামা কাল-বোশেখি ঝড়ে,
সহসা বরষাতে কাঁদিয়া ভেঙে পড়ে,
শরতে হেসে চলে শেফালিকা-তলে
গাহিয়া আগমনি- গীতি বিধুর॥
হরিত অঞ্চল হেমন্তে দুলায়ে
ফেরে সে মাঠে মাঠে শিশির-ভেজা পায়ে,
শীতের অলস বেলা পাতা ঝরার খেলা
ফাগুনে পরে সাজ ফুল-বধূর॥
এই দেশের মাটি জল ও ফুলে ফলে,
যে রস যে সুধা নাহি ভূমণ্ডলে,
এই মায়ের বুকে হেসে খেলে সুখে
ঘুমাব এই বুকে স্বপ্নাতুর॥
নিশীথ হয়ে আসে ভোর
গজল
ভৈরবী মিশ্র কাহারবা
নিশীথ হয়ে আসে ভোর
বিদায় দেহো প্রিয় মোর।
রজনিগন্ধার বনে হেরো
গুঞ্জরিছে ভ্রমর॥
হেরো ওই তন্দ্রা-ঢুলু ঢুল
জড়ায়ে হাতে এলোচুল,
বধূ যায় সিনান-ঘাটে
পথে লুটায় বসন আকুল॥
খোলো খোলো বাহুর মালা,
মোছো মোছো প্রিয়া আঁখি।
শোনো কুঞ্জ-দ্বারে তব কুহু
মুহুমুহু ওঠে ডাকি॥
হেরো লো, শিয়রে তব
প্রদীপ হয়ে এল ম্লান,
দাঁড়াল রাঙা উষা ওই,
রঙের সাগরে করি ম্লান।
আকাশ-অলিন্দে কাঁদে
পাণ্ডুর-কপোল শশী,
শুকতারা নিবু-নিবু ওই,
মলয়া ওঠে উছসি।
কাঁদে রাতের আঁধার
মোর বুকে মুখ রাখি॥
নূপুর মধুর রুনুঝুনু বোলে
খাম্বাজ কাওয়ালি
নূপুর মধুর রুনুঝুনু বোলে
মন-গোকুলে রুনুঝুনু বোলে॥
কূলের বাঁধন টুটে
যমুনা উথলি উঠে,
পুলকে কদম ফুটে,
পেখম খোলে
শিখী পেখম খোলে॥
ব্রজনারী কুল ভুলে
লুটায়ে সে পদমূলে,
চোখে জল, বুকে প্রেম-
তরঙ্গ দোলে॥
শ্রীমতী রাধার সাথে
বিশ্ব ছুটিছে পথে,
হরি হরি বলে মাতে
ত্রিভুবন ভোলে॥
নূরের দরিয়ায় সিনান করিয়া (আবির্ভাব)
আবির্ভাব
নূরের দরিয়ায় সিনান করিয়া
কে এল মক্কায় আমিনার কোলে।
ফাগুন-পূর্ণিমা-নিশীথে যেমন
আশমানের কোলে রাঙা-চাঁদ দোলে॥
‘কে এল কে এল’ গাহে কোয়েলিয়া,
পাপিয়া বুলবুল উঠিল মাতিয়া,
গ্রহ তারা ঝুঁকে করিছে কুর্ণিশ
হুরপরি হেসে পড়িছে ঢলে॥
জিন্নাতের আজ খোলা দরওয়াজা পেয়ে
ফেরেশতা আম্বিয়া এসেছে ধেয়ে
তহ্রিমা বেঁধে ঘোরে দরুদ পেয়ে
দুনিয়া টলমল, খোদার আরর্শ টলে॥
এল রে চির-চাওয়া, এল আখেরে-নবি
সৈয়দে মক্কি-মদনি আল-আরবি,
নাজেল হয়ে সে যে ইয়াকুত -রাঙা ঠোঁটে
শাহাদতের বাণী আধো-আধো বোলে॥
পথ-ভোলা কোন রাখাল ছেলে
বাউল লোফা
পথ-ভোলা কোন রাখাল ছেলে।
সে একলা বাটে শূন্য মাঠে
খেলে বেড়ায় বাঁশি ফেলে॥
কভু সাঁঝ গগনে উদাস মনে
চাহিয়া হেরে গো কারে,
হেরে তারার উদয়, কভু চেয়ে রয়
সুদূর বন-কিনারে।
হেরে সাঁঝের পাখি ফিরে গো যখন
নীড়ের পানে পাখা মেলে॥
তার ধেনু ফিরে যায় গ্রামের পানে
আনমনে সে বসিয়া থাকে,
ওই সন্ধ্যাতারার দীপ যে জ্বালায়
সে যেন কোথায় দেখেছে তাকে।
তার নূপুর লুটায় পথের ধূলায়
সে ফিরে নাহি চায়, কাহারে খোঁজে,
দূর চাঁদের ভেলায় মেঘ-পরি যায়
সে যেন তাহার ইশারা বোঝে।
সে চির-উদাসী পথে ফেরে হায়
সকল সুখে আগুন জ্বেলে॥
পথে পথে কে বাজিয়ে চলে বাঁশি
বাউল কাহারবা
পথে পথে কে বাজিয়ে চলে বাঁশি।
হল বিশ্ব-রাধা ওই সুরে উদাসী॥
শুনে ওই রাখালের বেণু
ছুটে আসে আলোক-ধেনু,
ওই নীল গগনে রাঙা মেঘে
ওড়ে গোখুর-রেণু,
আসে শ্যাম-পিয়ারি গোপ-ঝিয়ারি
গ্রহতারার রাশি॥
সেই বাঁশির অন্বেষণে
যত মন-বধূ ধায় বনে,
তাদের প্রেম-যমুনায় বাণ ডেকে যায়
কুল খোয়ায় গোপনে।
তারা রাস-দেউলে রসের বাউল
আনন্দ-ব্রজবাসী॥
পদ্মদিঘির ধারে ওই
গ্রাম্য সংগীত
পদ্মদিঘির ধারে ওই
সখী লো কমল-দিঘির ধারে।
আমি জল নিতে যাই
সকাল সাঁঝে সই,
সখী, ছল করে সে মাছ ধরে
আর চায় সে বারে বারে॥
মাছ ধরে সে, বড়শি আমার
বুকে এসে বেঁধে,
ওলো সই বুকে এসে বেঁধে,
আর, চোখের জলে কলসি আমার সই
আমি ভরাই কেঁদে কেঁদে
সই দেখি যত তারে॥
ছিপ নিয়ে যায় মাছ জলে তার,
তাকায় না তার পানে,
মন ধরে না – মীন ধরে সে
সখী লো সেই জানে।
মন-ভিখারি মীন-শিকারি
মুখের পানে চায়,
সখী লো চোখের পানে চায়,
আমি বড়শি-বেঁধা মাছের মতো(গো)
সখী, ছুটিয়া মরি হায়, অকূল পাথারে॥