ভোরের পাখি
ওরে ও ভোরের পাখি!
আমি চলিলাম তোদের কণ্ঠে আমার কণ্ঠ রাখি।
তোদের কিশোর তরুণ গলার সতেজ দৃপ্ত সুরে
বাঁধিলাম বীণা, নিলাম সে সুর আমার কণ্ঠে পুরে।
উপলে নুড়িতে চুড়ে-কিঙ্কিণি বাজায়ে তোদের নদী
যে গান গাহিয়া অকূলে চাহিয়া চলিয়াছে নিরবধি –
তারই সে গতির নূপুর বাঁধিয়া লইলাম মম পায়ে,
এরই তালে মম ছন্দ-হরিণী নাচিবে তমাল-ছায়ে।
যে-গান গাহিলি তোরা,
তারই সুর লয়ে ঝরিবে আমার গানের পাগল-ঝোরা।
তোদের যে-গান শুনিয়া রাতের বনানী জাগিয়া ওঠে,
শিশু অরুণেরে কোলে করে উষা দাঁড়ায় গগন-তটে,
গোঠে আনে ধেনু বাজাইয়া বেণু রাখাল-বালক জাগি,
জল নিতে যায় নব আনন্দে নিশীথের হতভাগি,
শিখিয়া গেলাম তোদের সে গান! তোদের পাখার খুশি –
যাহার আবেগে ছুটে আসে জেগে পুব-আঙিনায় উষী,
যাহার রণনে কুঞ্জে কাননে বিকাশে কুসুম-কুঁড়ি,
পলাইয়া যায় গহন-গুহায় আঁধার নিশীথ-বুড়ি,
সে খুশির ভাগ আমি লইলাম। অমনি পক্ষ মেলি
গাহিব ঊর্ধ্বে, ফুটিবে নিম্নে আবেশে চম্পা বেলি!
তোদের প্রভাতি ভিড়ে
ভিড়িলাম আমি, নিলাম আশ্রয় তোদের ক্ষণিক নীড়ে।
ওরে ও নবীন যুবা!
তোদের প্রভাত-স্তবের সুরে রে বাজে মম দিলরুবা।
তোদের চোখের যে জ্যোতি-দীপ্তি রাঙায় রাতের সীমা,
রবির ললাট হতে মুছে নেয় গোধূলির মলিনিমা,
যে-আলোক লভি দেউলে দেউলে মঙ্গল-দীপ জ্বলে,
অকম্প যার শিখা সন্ধ্যার ম্লান অঞ্চলতলে,
তোদের সে-আলো আমার আশ্রু-কুহেলি-মলিন চোখে
লইলাম পুরি! জাগে ‘সুন্দর’ আমার ধেয়ান-লোকে!
যৌবন
− ওরে ও শীর্ণা নদী,
দু-তীরে নিরাশা-বালুচর লয়ে জাগিবি কি নিরবধি?
নব-যৌবনজলতরঙ্গ-জোয়ারে কি দুলিবি না?
নাচিবে জোয়ারে পদ্মা গঙ্গা, তুই রবি চির-ক্ষীণা?
ভরা ভাদরের বরিষন এসে বারে বারে তোর কূলে
জানাবে রে তোরে সজল মিনতি, তুই চাহিবি না ভুলে?
দুই কূলে বাঁধি প্রস্তর-বাঁধ কূল ভাঙিবার ভয়ে
আকাশের পানে চেয়ে রবি তুই শুধু আপনারে লয়ে?
ভেঙে ফেল বাঁধ, আশেপাশে তোর বহে যে জীবন-ঢল
তারে বুকে লয়ে দুলে ওঠ তুই যৌবন-টলমল।
প্রস্তর-ভরা দুই কূল তোর ভেসে যাক বন্যায়,
হোক উর্বর, হাসিয়া উঠুক ফুলে ফলে সুষমায়।
− একবার পথ ভোল,
দূর সিন্ধুর লাগি বুকে জাগুক মরণ-দোল!
যৌবনজলতরঙ্গ
এই যৌবনজলতরঙ্গ রোধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ?
কে রোধিবি এই জোয়ারের টান গগনে যখন উঠেছে চাঁদ?
যে সিন্ধু-জলে ডাকিয়াছে বান – তাহারই তরে এ চন্দ্রোদয়,
বাঁধ বেঁধে থির আছে নালা ডোবা, চাঁদের উদয় তাদের নয়!
যে বান ডেকেছে প্রাণ-দরিয়ায়, মাঠে-ঘাটে-বাটে নেচেছে ঢল,
জীর্ণ শাখায় বসিয়া শকুনি শাপ দিক তারে অনর্গল।
সারস মরাল ছুটে আয় তোরা! ভাসিল কুলায় যে-বন্যায়
সেই তরঙ্গ ঝাঁপায়ে দোল রে সর্বনাশের নীল দোলায়!
খর স্রোতজলে কাদা-গোলা বলে গ্রীবা নাড়ে তীরে জরদ্গব,
গলিত শবের ভাগাড়ের ওরা, ওরা মৃত্যুর করে স্তব।
ওরাই বাহন জরা-মৃত্যুর, দেখিয়া ওদের হিংস্র চোখ –
রে ভোরের পাখি! জীবন-প্রভাতে গাহিবি না নব পুণ্য-শ্লোক?
ওরা নিষেধের প্রহরী পুলিশ, বিধাতার নয় – ওরা বিধির!
ওরাই কাফের, মানুষের ওরা তিলে তিলে শুষে প্রাণ-রুধির!
বল তোরা নবজীবনের ঢল! হোক ঘোলা – তবু এই সলিল
চির-যৌবন দিয়াছে ধরারে, গেরুয়া মাটিরে করেছে নীল!
নিজেদের চারধারে বাঁধ বেঁধে মৃত্যু-বীজাণু যারা জিয়ায়,
তারা কি চিনিবে – মহাসিন্ধুর উদ্দেশে ছোটে স্রোত কোথায়!
স্থাণু গতিহীন পড়ে আছে তারা আপনারে লয়ে বাঁধিয়া চোখ
কোটরের জীব, উহাদের তরে নহে উদীচীর উষা-আলোক।
আলোক হেরিয়া কোটরে থাকিয়া চ্যাঁচায় প্যাঁচারা, ওরা চ্যাঁচাক।
মোরা গাব গান, ওদেরে মারিতে আজও বেঁচে আছে দেদার কাক!
জীবনে যাদের ঘনাল সন্ধ্যা, আজ প্রভাতের শুনে আজান
বিছানায় শুয়ে যদি পাড়ে গালি, দিক গালি – তোরা দিসনে কান।
উহাদের তরে হতেছে কালের গোরস্থানে রে গোর খোদাই,
মোদের প্রাণের রাঙা জলসাতে জরা-জীর্ণের দাওত নাই।
জিঞ্জির-পায়ে দাঁড়ে বসে টিয়া চানা খায়, গায় শিখানো বোল,
আকাশের পাখি! ঊর্ধ্বে উঠিয়া কণ্ঠে নতুন লহরি তোল!
তোরা ঊর্ধ্বের – অমৃত-লোকের, ছুড়ুক নীচেরা ধুলাবালি,
চাঁদেরে মলিন করিতে পারে না কেরোসিনি ডিবেকালি ঢালি!
বন্য-বরাহ পঙ্ক ছিটাক, পাঁকের ঊর্ধ্বে তোরা কমল,
ওরা দিক কাদা, তোরা দে সুবাস, তোরা ফুল – ওরা পশুর দল!
তোদের শুভ্র গায়ে হানে ওরা আপন গায়ের গলিজ পাঁক,
যার যা দেবার সে দেয় তাহাই, স্বর্গের শিশু সহিয়া থাক!
শাখা ভরে আনে ফুল-ফল, সেথা নীড় রচি গাহে পাখিরা গান,
নীচের মানুষ তাই ছোঁড়ে ঢিল, তরুর নহে সে অসম্মান।
কুসুমের শাখা ভাঙে বাঁদরের উৎপাতে, হায়, দেখিয়া তাই –
বাঁদর খুশিতে করে লাফালাফি, মানুষ আমরা লজ্জা পাই!
মাথার ঘায়েতে পাগল উহারা, নিসনে তরুণ ওদের দোষ!
কাল হবে বার জানাজা যাহার, সে-বুড়োর পরে বৃথা এ রোষ!
যে-তরবারির পুণ্যে আবার সত্যেরে তোরা দানিবি তখ্ত্,
ছুঁচো মেরে তার খোয়াসনে মান, পুরায়ে এসেছে ওদের ওক্ত্ !
যে বন কাটিয়া বসাবি নগর তাহার শাখার দুটো আঁচড়
লাগে যদি গায়, সয়ে যা না ভাই, আছে তো কুঠার হাতের পর!
যুগে যুগে ধরা করেছে শাসন গর্বদ্ধত যে যৌবন –
মানেনি কখনও, আজও মানিবে না বৃদ্ধত্বের এই শাসন।
আমরা সৃজিব নতুন জগৎ, আমরা গাহিব নতুন গান,
সম্ভ্রমে-নত এই ধরা নেবে অঞ্জলি পাতি মোদের দান।
যুগে যুগে জরা বৃদ্ধত্বেরে দিয়াছি কবর মোরা তরুণ –
ওরা দিক গালি, মোরা হাসি খালি বলিব ‘ইন্না…. রাজেউন!’