- বইয়ের নামঃ মরুভাস্কর
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
০১. অবতরণিকা
জেগে ওঠ তুই রে ভোরের পাখি
নিশি-প্রভাতের কবি!
লোহিত সাগরে সিনান করিয়া
উদিল আরব-রবি।
ওরে ওঠ তুই, নূতন করিয়া
বেঁধে তোল তোর বীণ!
ঘন আঁধারের মিনারে ফুকারে
আজান মুয়াজ্জিন ।
কাঁপিয়া উঠিল সে ডাকের ঘোরে
গ্রহ, রবি, শশী, ব্যোম,
ওই শোন শোন ‘সালাতের’ ধ্বনি
‘খায়রুমমিনান্নৌম !’
রবি-শশী-গ্রহ-তারা ঝলমল
গগনাঙ্গনতলে
সাগর ঊর্মি-মঞ্জীর পায়ে
ধরা নেচে নেচে চলে।
তটিনী-মেখলা নটিনি ধরার
নাচের ঘূর্ণি লাগে
গগনে গগনে পাবকে পবনে
শস্যে কুসুম-বাগে।
সে আজান শুনি থমকি দাঁড়ায়
বিশ্ব-নাচের সভা,
নিখিল-মর্ম ছাপিয়া উঠিল
অরুণ জ্যোতির জবা।
দিগ্দিগন্ত ভরিয়া উঠিল
জাগর পাখির গানে,
ভূলোক দ্যুলোক প্লাবিয়া গেল রে
আকুল আলোর বানে!
আরব ছাপিয়া উঠিল আবার
ব্যোমপথে ‘দীন’ ‘দীন’,
কাবার মিনারে আবার আসিল
নবীন মুয়াজ্জিন!
ওরে ওঠ তোরা, পশ্চিমে ওই
লোহিত সাগর জল
রঙে রঙে হল লোহিততর রে
লালে-লাল ঝলমল।
রঙ্গে ভঙ্গে কোটি তরঙ্গে
ইরানি দরিয়া ছুটে,
পূর্ব-সীমায়,– সালাম জানায়
আরব-চরণে লুটে।
দখিনে ভারত-সাগরে বাজিছে
শঙ্খ, আরতি ধ্বনি,
উদিল আরবে নূতন সূর্য–
মানব-মুকুট-মণি।
উত্তরে চির-উদাসিনী মরু,
বালুকা-উত্তরীয়
উড়ায়ে নাচিয়া নাচিয়া গাহিছে–
‘জাগো রে, অমৃত পিয়ো!’
লু হাওয়া বাজায় সারেঙ্গি বীণ
খেজুর পাতার তারে,
বালুর আবির ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারে
স্বর্গে গগন-পারে।
খুশিতে বেদানা-ডালিম ডাঁসায়ে
ফাটিয়া পড়িছে ভুঁয়ে,
ঝরে রসধারা নারঙ্গি শেউ
আপেল আঙুর চুঁয়ে।
আরবি ঘোড়ারা রাশ নাহি মানে
আশমানে যাবে উঠি,
মরুর তরণি উটেরা আজিকে
সোজা পিঠে চলে ছুটি।
বয়ে যায় ঢল ধরে নাকো জল
আজি ‘জমজম’ কূপে,
‘সাহারা’ আজিকে উথলিয়া ওঠে
অতীত সাগর রূপে
পুরাতন রবি উঠিল না আর
সেদিন লজ্জা পেয়ে,
নবীন রবির আলোকে সেদিন
বিশ্ব উঠিল ছেয়ে।
চক্ষে সুরমা বক্ষে ‘খোর্মা’
বেদুইন কিশোরীরা
বিনি কিম্মতে বিলাল সেদিন
অধর চিনির শিরা!
‘ঈদ’ উৎসব আসিল রে যেন
দুর্ভিক্ষের দিনে,
যত ‘দুশমনি’ ছিল যথা নিল
‘দোসতি’ আসিয়া জিনে।
নহে আরবের, নহে এশিয়ার,–
বিশ্বে সে একদিন,
ধূলির ধরার জ্যোতিতে হল গো
বেহেশ্ত জ্যোতিহীন!
ধরার পঙ্কে ফুটিল গো আজ
কোটিদল কোকনদ,
গুঞ্জরি ওঠে বিশ্ব-মধুপ–
‘আসিল মোহাম্মদ!’
অভিনব নাম শুনিল রে
ধরা সেদিন – ‘মোহাম্মদ!’
এতদিন পরে এল ধরার
‘প্রশংসিত ও প্রেমাস্পদ!’
চাহিয়া রহিল সবিস্ময়
ইহুদি আর ইশাই সব,
আসিল কি ফিরে এতদিনে
সেই মসিহ্ মহামানব?
‘তওরাত’ ‘ইঞ্জিল’ ভরি
শুনিল যাঁর আগমনি,
‘ইশা’ ‘মুসা’ আর ‘দাউদ’ যাঁর
শুনেছিল পা-র ধ্বনি,
সেই সুন্দর দুলাল আজ
আসিল কি নীরব পায়?
যেমন নীরবে আসে তপন
পূর্ণ চাঁদ পুব-সীমায়।
এমনই করিয়া ওঠে রবি
ওঠে রে চাঁদ, ধরা তখন
এমনই করিয়া ঘুমায়ে রয়
রবি শশী হেরে স্বপন।
আলোকে আলোকে ছায় দিশি
নব অরুণ ভাঙে রে ঘুম,
তন্দ্রালু সব আঁখি-পাতায়
বন্ধুপ্রায় বুলায় চুম।
তেমনই মহিমা সেই বিভায়
আসিল আজ আলোর দূত,
ঝরনার সুরে পাখিরা গায়,
আতর গায় বয় মারুত।
শুষ্ক সাহারা এত সে যুগ
হেরেছে রে যার স্বপন,
বেহেশ্ত হতে নামিল ওই
সেই সুধার প্রস্রবণ।
খোর্মা খেজুরে মরু-কানন
ফলবতী হলুদ-রং
মরুর শিয়রে বাজে রে ওই
জলধারার মেঘ-মৃদং!
শোনেনি বিশ্ব কভু যে নাম –
‘মোহাম্মদ’ শুনে সে আজ
সেই সে নাম অবিশ্রাম
একী মধুর, একী আওয়াজ!
আঁধার বিশ্বে যবে প্রথম
হইল রে সূর্যোদয়
চেয়েছিল বুঝি সকল লোক
এই সে রূপ সবিস্ময়!
এমনই করিয়া নবারুণের
করিল কি নামকরণ,
সে আলোক-শিশু এমনই রে
হরি আঁধার হরিল মন!
এমনই সুখে রে সেই সেদিন
বিহগ সব গাহিল গান,
শাখায় প্রথম ফুটিল ফুল,
হল নিখিল শ্যামায়মান।
গুলে গুলে শাড়ি গুলবাহার
পরি সেদিন ধরণি মা
আঁধার সূতিকাবাস ত্যজি
হেরে প্রথম দিক্সীমা।
ফুলবন লুটি, খোশখবর
দিয়ে বেড়ায় চপল বায়,
‘ওরে নদ নদী ওরে নিঝর
ছাড়ি পাহাড় ছুটিয়া আয়।
সাগর! শঙ্খ বাজা রে তোর,
আসিল ওই জ্যোতিষ্মান,
একী আনন্দ একী রে সুখ
এল আলোর একী এ বান!’
ফুলের গন্ধ, পাখির গান
স্পর্শসুখ ভোর হাওয়ার,
জানিল বিশ্ব সেই সেদিন,
সেই প্রথম ; আজ আবার
আঁধার নিখিলে এল আবার
আদি প্রাতের সে সম্পদ
নূতন সূর্য উদিল ওই –
মোহাম্মদ ! মোহাম্মদ !
০২. অনাগত
বিশ্ব তখনও ছিল গো স্বপ্নে, বিশ্বের বনমালী
আপনাতে ছিল আপনি মগন। তখনও বিশ্ব-ডালি
ভরিয়া ওঠেনি শস্যে কুসুমে ; তখনও গগন-থালা
পূর্ণ করেনি চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারকার মালা।
আপন জ্যোতির সুধায় বিভোর আপনি জ্যোতির্ময়
একাকী আছিল – ছিল এ নিখিল শূন্যে শূন্যে লয়।
অপ্রকাশ সে মহিমার মাঝে জাগেনি প্রকাশ-ব্যথা,
ছিল নাকো সুখ দুখ আনন্দে সৃষ্টির আকুলতা।
ছিল না বাগান, ছিল বনমালী! – সহসা জাগিল সাধ,
আপনারে লয়ে খেলিতে বিধির, আপনি সাধিতে বাদ।
অটল মহিমা-গিরি-গুহা-ত্যজি– কে বুঝিবে তাঁর লীলা–
বাহিরিয়া এল সৃষ্টি প্রকাশ নির্ঝর গতিশীলা।
ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোমের সৃজিয়া সে লীলা রাজ,
ভাবিল সৃজিবে পুতুলখেলার মানুষ সৃষ্ট-মাঝ।
চলিতে লাগিল কত ভাঙাগড়া সে মহাশিশুর মনে,
মানুষ হইবে রসিক ভ্রমর, সৃষ্টির ফুলবনে।
আদিম মানব ‘আদমে’ সৃজিয়া এক মুঠা মাটি দিয়া
বলিলেন, ‘যাও, করো খেলা ওই ধরার আঙনে গিয়া!’
সৃজিয়া মানব-আত্মা তাহার দানিল মানবদেহে,
কাঁদিতে লাগিল মানব-আত্মা পশিয়া মাটির গেহে।
বলে, ‘প্রভু, আমি রহিতে নারি এ ধূলি-পঙ্কিল ঘরে,
অন্ধকার এ কারাঘরে একা রহিব কেমন করে!’
আদমের মাঝে বারেবারে যায় বারেবারে ফিরে আসে
চারিদিকে ঘোর বিভীষিকা শুধু, কাঁপিয়া মরে সে ত্রাসে।
কহিলেন প্রভু, ‘ভয় নাই, দিনু আমার যা প্রিয়তম
তোমার মাঝারে – জ্বলিবে সে জ্যোতি তোমাতে আমারই সম।
আমা হতে ছিল প্রিয়তর যাহা আমার আলোর আলো
– মোহাম্মদ সে, দিনু তাঁহারেই তোমারে বাসিয়া ভালো!’
মানব-আত্মা পশিয়া এবার আদমের দেহমাঝে
হেরিল তথায় অতুল বিভায় মহাজ্যোতি এক রাজে।
আত্মার আলো ঘুচাতে পারেনি যে মহা অন্ধকার
তারে আলোময় করিয়াছে আসি এ কোন জ্যোতি-পাথার।
বন্দনা করি সে মহাজ্যোতিরে আদম খোদারে কয়,
‘অপরূপ জ্যোতি-প্রদীপ্ত তনু এ কার মহিমময়!
কেবা এ পুরুষ, কেন এ উদিল আমার ললাট-তীরে,
ধন্য করিলে কেন এ মধুর বোঝা দিয়ে মোর শিরে?’
কহিলেন খোদা, ‘এই সে জ্যোতির পূণ্যে আঁধার ধরা
আলোয় আলোয় হবে আলোময়, সকল কলুষ-হরা
এই সে আলোর দীপ্তি ভাতিবে বিশ্ব নিখিল ভরি
এ জ্যোতি-বিভায় হইবে প্রভাত পাপীদের শর্বরী।
আমার হাবিব – বন্ধু এ প্রিয় ; মানব-ত্রাণের লাগি
ইহারে দিলাম তোমাতে – হইতে মানব-দুঃখ-ভাগী।
মোহাম্মদ এ, সুন্দর এ, নিখিল প্রশংসিত,
ইহার কন্ঠে আমার বাণী ও আদেশ হইবে গীত।’
সিজদা করিয়া খোদারে আদম সম্ভ্রম-নত কয়,
‘ধূলির ধরায় যাইতে আমার নাহি আর কোনো ভয়।
আমার মাঝারে জ্বালাইয়া দিলে অনির্বাণ যে দীপ,
পরাইয়া দিলে আমার ললাটে যে মহাজ্যোতির টিপ,
ধরার সকল ভয়েরে ইহারই পূণ্যে করিব জয়,
আমার বংশে জন্মিবে তব বন্ধু মহিমময়!
মোর সাথে হল ধন্য পৃথিবী!’ – মোহাম্মদের নাম
লইয়া পড়িল, ‘সাল্লাল্লাহু আলায়াহিসাল্লাম!’
ধরায় আসিল আদিম মানব-পিতা আদমের সাথ
‘খোদার প্রেরিত’, ‘শেষ বাণী-বাহী’ কাঁদাইয়া জান্নাত।
* * * *
শত শতাব্দী যুগযুগান্ত বহিয়া যায়
ফিরে নাহি-আসা স্রোতের প্রায়
চলে গেল ‘হাওয়া’, ‘আদম’, ‘শিশ্’ ও ‘নূহ’ নবি –
জ্বলিয়া নিভিল কত রবি!
চলে গেল ‘ইশা’, ‘মুসা’ ও ‘দাউদ’, ইব্রাহিম’
ফিরদৌসের দূর সাকিম।
গেল ‘সুলেমান’, গেল ‘ইউনুস’, গেল ‘ইউসুফ’ রূপকুমার
হাসিয়া জীবন-নদীর পার।
গেল ‘ইসাহাক’, ‘ইয়াকুব’, গেল ‘জবীহুল্লাহ্ ইসমাইল’
খোদার আদেশ করি হাসিল।
এসেছিল যারা খোদার বাণীর দধিয়াল তুতী পাপিয়া পিক
বুলবুল শ্যামা ; ভরিয়া দিক
যাদের কন্ঠে উঠিয়াছিল গো মহান বিভুর মহিমা গান
উড়ে গেল তারা দূর বিমান!
ঊর্ধ্বে জাগিয়া রহিলেন ‘ইশা’ অমর, মর্ত্যে ‘খাজাখিজির’
– দুই ধ্রুবতারা দুই সে তীর –
ঘোষিতে যেন গো এপারে-ওপারে তাহারই আসার খোশখবর-
যাহার আশায় এ-চরাচর
আছে তপস্যারত চিরদিন; ঘুরিছে পৃথিবী যার আশে
সৌরলোকের চারিপাশে।
আদিম-ললাটে ভাতিল যে আলো উষায় পুরব-গগন-প্রায়
কোথায় ওগো সে আলো কোথায়!
আলোক, আঁধার, জীবন, মৃত্যু, গ্রহ, তারা তারে খুঁজিছে হায়
কোথায় ওগো সে আলো কোথায়!
খুঁজিছে দৈত্য, দানব, দেবতা, ‘জিন’ পরি, হুর পাগলপ্রায়
কোথায় ওগো সে আলো কোথায়!
খোঁজে অপ্সর, কিন্নর, খোঁজে গন্ধর্ব ও ফেরেশতায়
কোথায় ওগো সে আলো কোথায়!
খুঁজিছে রক্ষ যক্ষ পাতালে, খোঁজে মুনি ঋষি ধেয়ানে তায়
কোথায় ওগো সে আলো কোথায়!
আপনার মাঝে খোঁজে ধরা তারে সাগরে, কাননে মরু-সীমায়,
কোথায় ওগো সে আলো কোথায়!
খুঁজিছে তাহারে সুখে, আনন্দে, নব সৃষ্টির ঘন ব্যথায়,
কোথায় ওগো সে আলো কোথায়!
উৎপীড়িতেরা নয়নের জলে নয়ন-কমল ভাসায়ে চায়,
কোথায় মুক্তি-দাতা কোথায়!
শৃঙ্খলিত ও চির-দাস খোঁজে বন্ধ অন্ধকার কারায়
বন্ধ-ছেদন নবি কোথায়!
নিপীড়িত মূক নিখিল খুঁজিছে তাহার অসীম স্তব্ধতায়,
বজ্র-ঘোষ বাণী কোথায়!
শাস্ত্র-আচার-জগদল-শিলা বক্ষে নিশাস রুদ্ধপ্রায়
খোঁজে প্রাণ, বিদ্রোহী কোথায়!
খুঁজিছে দুখের মৃণালে রক্ত-শতদল শত ক্ষত ব্যথায়,
কমল-বিহারী তুমি কোথায়!
আদি ও অন্ত যুগযুগান্ত দাঁড়ায়ে তোমার প্রতীক্ষায়,
চিরসুন্দর, তুমি কোথায়!
বিশ্ব-প্রণব-ওংকার-ধ্বনি অবিশ্রান্ত গাহিয়া যায় –
তুমি কোথায়, তুমি কোথায়!
* * * *
ধেয়ান-স্তব্ধ বিশ্ব চমকি মেলে আঁখি –
আরবের মরু আজিকে পাগল হল নাকি?
খুঁজিছে যাহারে কোটি গ্রহ তারা চাঁদ তপন
মরু-মরীচিকা হেরিল কি আজ তার স্বপন?
পেল নাকো খুঁজে সকল দিশির দিশারি যার,
মরুর তপ্ত বালুতে পড়িল চরণ তাঁর!
রৌদ্র-দগ্ধ চির-তাপসিনী তনু-কঠিন
এরই তপস্যা করি কি আরব যাপিল দিন?
বালুকা-ধূসর কেশ এলাইয়া তপ্ত ভাল
তপ্ত আকাশ-তটে ঠেকাইয়া এত সে কাল
ইহার লাগি কি ছিল হতভাগি জাগিয়া রে,
বিশ্ব-মথন অমৃত ধন মাগিয়া রে!
* * * *
দশদিক ছাপি ওঠে আবাহন, ‘ধন্য ধন্য মুত্তালিব!’
তব কনিষ্ঠ পুত্র ধন্য আবদুল্লাহ্ খোশ-নসিব,
ঔরসে যাঁর লভিল জনম বিশ্ব-ভূমান মহামানব,
ধেয়ানে যাহারে ধরিতে না পারি নিখিল ভুবন করে স্তব।
ধন্য গো তুমি ‘আমিনা’ জননী কেমনে জঠরে ধরিলে তায়
যোগী মুনি ঋষি পয়গম্বর গেয়ানে যাহার সীমা না পায়!
ধন্য ধরণি-কেন্দ্র মক্কা নগরী, কাবার পুণ্যে গো
বক্ষে ধরিলে তাঁহারে, যে-জন ধরেনি; অসীম শূন্যে গো
যাঁহারে কেন্দ্র করিয়া সৃষ্টি ঘুরিতেছে নিঃসীম নভে
ধরার কেন্দ্রে আসিবে সে-জন, এও কি গো কভু সম্ভবে!
বিন্দুর রূপে আসিল সিন্ধু, শিশু-রূপ ধরি এল বিরাট!
অসম্ভবের সম্ভাবনায় রাঙিল এশিয়া অস্তপাট!
পূর্বে সূর্য ওঠে চিরদিন, পশ্চিমে আজ উঠিল ওই,
স্বর্গের ফুল ফুটিল সেথায় যে-মরুতে ফোটে বালুকা-খই!
নিখিল-শরণ চরণের লাগি তুই কি আরব এত সে দিন
তপস্যা করি করিলি নিজেরে যেন সে বিরাট-চরণ-চিন!
ধন্য মক্কা, ধন্য আরব, ধন্য এশিয়া পুণ্য দেশ,
তোমাতে আসিল প্রথম নবি গো তোমাতে আসিল নবির শেষ!
০৩. অভ্যুদয়
আঁধার কেন গো ঘনতম হয় উদয়-উষার আগে?
পাতা ঝরে যায় কাননে, যখন ফাগুন-আবেশ লাগে
তরু ও লতার তনুতে তনুতে, কেন কে বলিতে পারে?
সুর বাঁধিবার আগে কেন গুণী ব্যথা হানে বীণা-তারে?
টানিয়া টানিয়া না বাঁধিলে তারে ছিঁড়িয়া যাবার মতো
ফোটে না কি বাণী, না করিলে তারে সদা অঙ্গুলি ক্ষত?
সূর্য ওঠার যবে দেরি নাই, বিহগেরা প্রায় জাগে,
তখন কি চোখে অধিক করিয়া তন্দ্রার ঝিম লাগে?
কেন গো কে জানে, নতুন চন্দ্র উদয়ের আগে হেন
অমাবস্যার আঁধার ঘনায়, গ্রাসিবে বিশ্ব যেন!
পুণ্যের শুভ আলোক পড়িবে যবে শতধারে ফুটে
তার আগে কেন বসুমতী পাপ-পঙ্কিল হয়ে উঠে?
ফুল ফসলের মেলা বসাবার বর্ষা নামার আগে,
কালো হয়ে কেন আসে মেঘ, কেন বজ্রের ধাঁধা লাগে?
এই কি নিয়ম? এই কি নিয়তি? নিখিল-জননী জানে,
সৃষ্টির আগে এই সে অসহ প্রসব-ব্যথার মানে!
এমনই আঁধার ঘনতম হয়ে ঘিরিয়াছিল সেদিন,
উদয়-রবির পানে চেয়েছিল জগৎ তমসা-লীন।
পাপ অনাচার দ্বেষ হিংসার আশী-বিষ-ফণা তলে
ধরণির আশা যেন ক্ষীণজ্যোতি মানিকের মতো জ্বলে!
মানুষের মনে বেঁধেছিল বাসা বনের পশুরা যত,
বন্য বরাহে ভল্লুকে রণ; নখর-দন্ত-ক্ষত
কাঁপিতেছিল এ ধরা অসহায় ভীরু বালিকার সম!
শূন্য-অঙ্কে ক্লেদে ও পঙ্কে পাপে কুৎসিততম
ঘুরিতেছিল এ কুগ্রহ যেন অভিশাপ-ধূমকেতু,
সৃষ্টির মাঝে এ ছিল সকল অকল্যাণের হেতু!
অত্যাচারিত উৎপীড়িতের জমে উঠে আঁখিজল
সাগর হইয়া গ্রাসিল ধরার যেন তিন ভাগ থল!
ধরণি ভগ্ন তরণির প্রায় শূন্য-পাথরতলে
হাবুডুবু খায় বুঝি ডুবে যায়, যত চলে তত টলে।
এশিয়া য়ুরোপ আফ্রিকা – এই পৃথিবীর যত দেশ
যেন নেমেছিল প্রতিযোগিতায় দেখিতে পাপের শেষ!
এই অনাচার মিথ্যা পাপের নিপীড়ন-উৎসবে
মক্কা ছিল গো রাজধানী যেন ‘জজিরাতুল আরবে।’
পাপের বাজারে করিত বেসাতি সমান পুরুষ নারী,
পাপের ভাঁটিতে চলিত গো যেন পিপীলিকা সারি সারি।
বালক বালিকা যুবা ও বৃদ্ধে ছিল নাকো ভেদাভেদ,
চলিত ভীষণ ব্যাভিচার-লীলা নির্লাজ নির্বেদ!
নারী ছিল সেথা ভোগ-উৎসবে জ্বালিতে কামনা-বাতি,
ছিল না বিরাম সে বাতি জ্বলিত সমান দিবস-রাতি।
জন্মিলে মেয়ে পিতা তারে লয়ে ফেলিত অন্ধকূপে
হত্যা করিত, কিংবা মারিত আছাড়ি পাষাণস্তূপে!
হায় রে, যাহারা স্বর্গেমর্ত্যে বাঁধে মিলনের সেতু
বন্যা-ঢল সে কন্যারা ছিল যেন লজ্জারই সেতু!
সুন্দরে লয়ে অসুন্দরের এই লীলা তাণ্ডব
চলিতেছিল, এ দেহ ছিল শুধু শকুন-খাদ্য শব!
দেহ-সরসীর পাঁকের ঊর্ধ্বে সলিল সুনির্মল
ত্যজিয়া তাহারে মেতেছিল পাঁকে বন্য-বরাহ দল!
চরণে দলিত কর্দমে যারে গড়িয়া তুলিল নর
ভাবিত তাহারে সৃষ্টিকর্তা, সেই পরমেশ্বর!
আল্লার ঘর কাবায় করিত হল্লা পিশাচ ভূত,
শিরনি খাইত সেথা তিন শত ষাট সে প্রেতের পুত!
শয়তান ছিল বাদশাহ সেথা, অগণিত পাপ-সেনা,
বিনি সুদে সেথা হতে চলিত গো ব্যভিচার লেনা-দেনা!
সে পাপ-গন্ধে ছিঁড়িয়া যাইত যেন ধরণির স্নায়ু,
ভূমিকম্পে সে মোচড় খাইত যেন শেষ তার আয়ু!
এমনই আঁধার গ্রাসিয়াছে যবে পৃথ্বী নিবিড়তম–
ঊর্ধ্বে উঠিল সংগীত, ‘হল আসার সময় মম!’
ঘন তমসার সূতিকা-আগারে জনমিল নব শশী,
নব আলোকের আভাসে ধরণি উঠিল গো উচ্ছ্বসি।
ছুটিয়া আসিল গ্রহ-তারাদল আকাশ-আঙিনা মাঝে,
মেঘের আঁচলে জড়াইয়া শিশুচাঁদেরে পুলক লাজে
দাঁড়াল বিশ্ব-জননী যেন রে ; পাইয়া সুসংবাদ
চকোর-চকোরী ভিড় করে এল নিতে সুধার প্রসাদ!
ধরণির নীল আঁখি-যুগ যেন সায়রে শালুক সুঁদি
চাঁদেরে না হেরে ভাসিত গো জলে ছিল এতদিন মুদি,
ফুটিল রে তারা অরুণ-আভায় আজ এতদিন পরে,
দুটি চোখে যেন প্রাণের সকল ব্যথা নিবেদন করে!
পুলকে শ্রদ্ধা সম্ভ্রমে ওঠে দুলিয়া দুলিয়া কাবা,
বিশ্ব-বীণায় বাজে আগমনি, ‘মারহবা! মারহবা!!’
০৪. স্বপ্ন
প্রভাত-রবির স্বপ্ন হেরে গো যেমন নিশীথ একা
গর্ভে ধরিয়া নতুন দিনের নতুন অরুণ-লেখা।
তেমনই হেরিছে স্বপ্ন আমিনা – যেদিন নিশীথ শেষে
স্বর্গের রবি উদিবে জননী আমিনার কোলে এসে।
যেন গো তাহার নিরালা আঁধার সূতিকা-আগার হতে
বাহিরিল এক অপরূপ জ্যোতি, সে বিপুল জ্যোতি-স্রোতে
দেখা গেল দূর বোসরা নগরী দূর সিরিয়ার মাঝে।
ইরান-অধীপ নওশেরোয়াঁর প্রাসাদের চূড়া লাজে
গুঁড়া হয়ে গেল ভাঙিয়া পড়িয়া। অগ্নিপূজা দেউল
বিরাণ হইয়া গেল গো ইরান নিভে গিয়ে বিলকুল।
জগতের যত রাজার আসন উলটিয়া গেল পড়ি,
মূর্তিপূজার প্রতিমা ঠাকুর ভেঙে গেল গড়াগড়ি!
নব নব গ্রহ তারকায় যেন গগন ফেলিল ছেয়ে,
স্বর্গ হইতে দেবদূত সব মর্ত্যে আসিল ধেয়ে।
সেবিতে যেন গো আমিনায় তাঁর সূতিকা-আগার ভরি,
দলে দলে এল বেহেশ্ত হইতে বেহশ্তি হুরপরি।
যত পশু-পাখি মানুষের মতো কহিল গো যেন কথা,
রোম-সম্রাট-কর হতে ক্রস খসিয়া পড়িল হোথা,
হেঁটমুখ হয়ে ঝুলিতে লাগিল পূজার মূর্তি যত,
হেরিলেন জ্যোতি-মণ্ডিত দেহ অপরূপ রূপ কত!
টুটিতে স্বপ্ন হেরিলেন মাতা, ফুটিতে আলোর ফুল
আর দেরি নাই, আগমনি গায় গুলবাগে বুলবুল।
কী এক জ্যোতির্শিখার ঝলকে মাতা ভয়ে বিস্ময়ে
মুদিলেন আঁখি। জাগিলেন যবে পূর্ব-চেতনা লয়ে,
হেরিলেন চাঁদ পড়িয়াছে খসি যেন রে তাঁহার কোলে,
ললাটে শিশুর শত সূর্যের মিহির লহর তোলে!
শিশুর কন্ঠে অজানা ভাষায় কোন অপরূপ বাণী
ধ্বনিয়া উঠিল, সে স্বরে যেন রে কাঁপিল নিখিল প্রাণী।
ব্যথিত জগৎ শুনেছে ব্যথায় যার চরণের ধ্বনি,
এতদিনে আজ বাজাল রে তার বাঁশুরিয়া আগমনি!
নিখিল ব্যথিত অন্তরে এর আসার খবর রটে
ইহারই স্বপন জাগেরে নিখিল-চিত্ত-আকাশপটে।
সারা বিশ্বের উৎপীড়িতের রোদনের ধ্বনি ধরি
ধরণির পথে অভিসার এল ছিল দিবা শর্বরী।
সাগর শুকায়ে হল মরুভূমি এরই তপস্যা লাগি,
মরু-যোগী হল খর্জুরতরু ইহারই আশায় জাগি।
লুকায়ে ছিল যে ফল্গুর ধারা মরু-বালুকার তলে
মরু-উদ্যানে বাহিরিয়া এল আজি ঝরনার ছলে।
খর্জুর-বনে এলাইয়া কেশ সিনানি সিন্ধুজলে
রিক্তাভরণা আরব বিশ্ব-দুলালে ধরিল কোলে!
‘ফারাণের’ পর্বত-চূড়াপানে ভাববাদী বিশ্বের
কর-সংকেতে দিল ইঙ্গিত ইহাই আগমনের।
সেদিন শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির সুখে হসিল বিশ্বত্রাতা,
‘সুয়োরানি’ হল আজিকে যেন রে বসুমতী ‘দুয়ো’ মাতা
‘মারহাবা সৈয়দে মক্কি মদনি আল-আরবি!’
গাহিতে নান্দী গো যাঁর নিঃস্ব হল বিশ্বকবি।
আসিল বন্ধ-ছেদন শঙ্কা-নাশন শ্রেষ্ঠ মানব,
পশিল অন্ধ গুহায় ওই পুনরায় রক্ষ দানব।
ভাসিল বন্যাধারায় ‘দজলা’ ‘ফোরাত’ কন্যা মরুর,
সাহারায় নৌবতেরই বাজনা বাজে মেঘ-ডমরুর।
বেদুইন তাম্বু ছিঁড়ে বর্শা ছুঁড়ে অশ্ব ছেড়ে
খেলিছে গেণ্ডুয়া-খেল, রক্ত ছিটায় বক্ষ ফেড়ে!
আরবের কুব্জা বঁধু উট ছেড়ে পথ সব্জা-খেতি
খুঁজিছে আজকে ঈদে খোর্মা আঙুর খেজুর-মেতি।
খর্জুর কন্টকে আজ বন্ধ খুলি যুক্ত বেণির
ঢালিছে মুক্ত-কেশী আরবি-নিঝর কলসি পানির!
জরিদার নাগরা পায়ে গাগরা কাঁখে ঘাগরা ঘিরা
বেদুইন বউরা নাচে মৌ-টুসকির মৌমাছিরা।
শরমে নৌজোয়ানীরা নুইয়ে ছিল ডালিম-শাখা,
আজি তার রস ধরে না, তাম্বুলী ঠোঁট হিঙ্গুল মাখা
করে আজ খুনসুড়ি ওই শুকনো কাঁটার খেজুর-তরু,
খেজুরের গুলতি খেয়ে ‘উঃ’ ডাকে ‘লু’ হাওয়ায় মরু!
আখরোট বাদাম যত আরবি-বউ-এর পড়ছে পায়ে,
বলে, ‘এই নীরস খোসা ছাড়াও কোমল হাতের ঘায়ে!’
আরবের উঠতি বয়েস ফুল-কিশোরী ডালিম-ভাঙা
বিলিয়ে রং কপোলের আপেল-কানন করছে রাঙা।
ছুটিতে দুম্বাসম স্থূল শ্রোণিভার হয় গো বাধা,
দশনে পেস্তা কাটি পথ-বঁধুরে দেয় সে আধা!
অধরের কামরাঙা-ফল নিঙড়ে মরুর তপ্ত মুখে,
উড়ুনি দেয় জড়ায়ে পাগলা হাওয়ার উতল বুকে।
না-জানা আনন্দে গো ‘আরাস্তা’ আজ আরব-ভূমি,
অ-চেনা বিহগ গাহে ফোটে কুসুম বে-মরশুমি,
আরবের তীর্থ লাগি ভিড় করে সব বেহেশ্ত বুঝি,
এসেছে ধরার ধুলায় বিলিয়ে দিতে সুখের পুঁজি।
‘রবিউল আউওল’ চাঁদ শুক্লা নবমীর তিথিতে
ধেয়ানের অতিথ্ এল সেই প্রভাতে এই ক্ষিতিতে।
মসীহের পঞ্চশত সপ্ততি এক বর্ষ পরে
সোমবার জ্যেষ্ঠ প্রথম – ধরার মানব-ত্রাণের তরে
আসিলেন বন্ধু খোদার মহান উদার শ্রেষ্ঠ নবি,
‘মারহাবা সৈয়দ মক্কি মদনি আল-আরবি।’
০৫. আলো-আঁধারি
বাদলের নিশি অবসানে মেঘ-আবরণ অপসারি
ওঠে যে সূর্য – প্রদীপ্ততর রূপ তার মনোহারী।
সিক্তশাখায় মেঘ-বাদলের ফাঁকে
‘বউ কথা কও’ পাপিয়া যখন ডাকে–
সে গান শোনায় মধুরতর গো সজল জলদচারী!
বর্ষায়-ধোয়া ফুলের সুষমা বর্ণিতে নাহি পারি!
কান্নার চোখ-ভরা জল নিয়ে আসে শিশু অভিমানী,
হাসির বিজলি চমকি লুকায় তার কাছে লাজ মানি।
কয়লার কালি মাখি যবে হিরা ওঠে,
সে রূপ যেন গো বেশি করে চোখে ফোটে!
নীল নভো ঠোঁটে এক ফালি হাসি দ্বিতীয়ার চাঁদখানি
পূর্ণশশীর চেয়ে ভালো লাগে – কেন কেহ নাহি জানি!
পথের সকল ধুলো কাদা মাখি যে শিশু ফেরে গো ঘরে,
সে কি গো পাইতে বেশি ভালোবাসা যত্ন জননী করে?
মুছাবেন মাতা অঞ্চল দিয়া বলে
শিশুর নয়নে অকারণে বারি ঝলে?
ধরার আঁচলে পাথরের সাথে সোনা বাঁধা এক থরে,
বিষে নীল হয়ে আসে মণি – সে কি অধিক মূল্য তরে?
ডুবে এক-গলা নয়নের জলে তবে কি কমল ফোটে?
মৃণাল-কাঁটার বেদনায় কি ও শতদল হয়ে ওঠে?
শত সুষমায় ফোটাবে বলিয়া কিরে
মেঘ এত জল ঢালে কুসুমের শিরে?
দগ্ধ লোহায় না বিঁধিলে সুর ফোটে না কি বেণু-ঠোঁটে?
তত সুগন্ধ ওঠে চন্দনে যত ঘষে শিলাতটে!
মুছাতে এল যে উৎপীড়িত এ নিখিলের আঁখিজল,
সে এল গো মাখি শুভ্র তনুতে বিষাদের পরিমল!
অথবা সে চির-সুখ-দুখ-বৈরাগী
আসিল হইয়া নিখিল-বেদনা-ভাগী!
জানে বনমাতা, গন্ধে ও রূপে মাতাবে যে বনতল
সে ফুল-শিশুর শয়ন কেন গো কণ্টক-অঞ্চল!
শুনে হাসি পায় এত শোকে হায়! বিশ্বের পিতা যার
‘হাবিব’ বন্ধু, হারায়ে পিতায় সে এল ধরা মাঝার!
খোদার লীলা সে চির-রহস্যময় –
বন্ধুর পথ এত বন্ধুর হয়!
আবির্ভাবের পূর্বে পিতৃহীন হয়ে – বার বার
ঘোষিল সে যেন, আমি ভাই সাথি পিতাহীন সবাকার!
আলোকের শিশু এল গো জড়ায়ে আঁধার-উত্তরীয়
জানাতে যেন গো ‘বিষ-জর্জর, এবার অমৃত পিয়ো!’
তৃষ্ণাতুরের পিপাসা করিতে দূর
হৃদয় নিঙাড়ি রক্ত দেয় আঙুর!
শোক-ছলছল ধরায় কেমনে হাসি অমিয়
আসিবে সবার সকল ব্যথার ব্যথী বন্ধু ও প্রিয়!
পূর্ণশশীরে হেরিয়া যখন সাগরে জোয়ার লাগে,
উথলায় জল তত কলকল যত আনন্দ জাগে!
তেমনই পূর্ণশশীরে বক্ষে ধরি
‘আমিনার’ চোখে শুধু জল ওঠে ভরি!
সুখের শোকের গঙ্গা-যমুনা বিষাদে ও অনুরাগে
বয়ে চলে, যেন ‘দজ্লা’ ‘ফোরাত’ বসরা-কুসুম-বাগে!
কাঁদিছে আমিনা, হাসিছেন খোদা,‘ওরে ও অবুঝ মেয়ে,
ডুবিয়াছে চাঁদ উঠিয়াছে রবি বক্ষে দেখনা চেয়ে,
ভবনের স্নেহ কাড়িয়া কঠোর করে
ভুবনের প্রীতি আনিয়া দিয়াছি ওরে!
ঘর সে কি ধরে বিশ্ব যাহার আলোকে উঠিবে ছেয়ে?
নিখিল যাহার আত্মীয় – ভুলে রবে সে স্বজন পেয়ে?
নীড় নহে তার – যে পাখি উদার অম্বরে গাবে গান,
কেবা তার পিতা কেবা তার মাতা, সকলই তার সমান!
নাহি দুখ সুখ আত্মীয়, নাই গেহ,
একের মাঝারে সে যে গো সর্বদেহ,
এ নহে তোমার কুটির-প্রদীপ ভোরে যার অবসান,
রবি এ – জনমি পূর্ব-অচলে ঘোরে সারা আশমান!’
সে বাণী যেন গো শুনিয়া আমিনা-জননী রহে অটল,
ক্ষণেক রাঙিয়া স্তব্ধ রহে গো যেমন পূর্বাচল!
কহিল জননী আপনার মনে মনে, –
‘আমার দুলালে দিলাম সর্বজনে!’
থির হয়ে গেল পড়িতে পড়িতে কপোলে অশ্রুজল।
উদিল চিত্তে রাঙা রামধনু, টুটিল শোক-বাদল!
০৬. দাদা
সব-কনিষ্ঠ পুত্র সে প্রিয় আবদুল্লার শোকে,
সেদিন নিশীথে ঘুম নাকো মুত্তালিবের চোখে!
পঁচিশ বছর ছিল যে পুত্র আঁখির পুতলা হয়ে,
বৃদ্ধ পিতারে রাখিয়া মৃত্যু তারেই গেল কি লয়ে!
হয়ে আঁখিজল ঝরে অবিরল পঁচিশ-বছরি স্মৃতি,
সে স্মৃতির ব্যথা যতদিন যায় তত বাড়ে হায় নিতি!
বাহিরে ও ঘরে বক্ষে নয়নে অশ্রুতে তারে খোঁজে
সহসা বিধবা আমিনারে হেরি সভয়ে চক্ষু বোজে!
ওরে ও অভাগি, কে দিল ও বুকে ছড়ায়ে সাহারা-মরু?
অসহায় লতা গড়াগড়ি যায় হারায়ে সহায়-তরু!
আঙনে বেড়ায় ও যেন রে হায় শোকের শুভ্রশিখা,
রজনিগন্ধা বিধবা মেয়েরে লয়ে কাঁদে কাননিকা!
মন্থরগতি বেদনা-ভারতী আমিনা আঙনে চলে,
হেরিতে সহসা মুত্তালিবের আঁধার চিত্ততলে
ঈষৎ আলোর জোনাকি চমকি যায় যেন ক্ষণে ক্ষণে,
আবদুল্লার স্মৃতি রহিয়াছে ওই আমিনার সনে।
আসিবে সুদিন আসিবে আবার, পুত্রে যে ছিল প্রাণ
পুত্র হইতে পৌত্রে আসিয়া হবে যে অধিষ্ঠান।
দিন গোনে মনে মনে আর কয়, ‘বাকি আর কত দিন,
লইয়া অ-দেখা পিতার স্মৃতিরে আসিবি পিতৃহীন!’
মুত্তালিবের আঁধার চিত্তে জ্বলেছে সহসা বাতি,
সেদিন আসিবে যেন শেষ হলে আজিকার এই রাতি!
চোখে ঘুম নাই শূন্যে বৃথাই নয়ন ঘুরিয়া মরে,–
নিশি-শেষে যেন অতন্দ্র চোখে তন্দ্রা আসিল ভরে!
কত জাগে আর লয়ে হাহাকার, আঁধারের গলা ধরি
আর কতদিন কাঁদিবে গো, চোখে অশ্রু গিয়াছে মরি!
আয় ঘুম হায়, হয়তো এবার স্বপনে হেরিব তারে,
বিরাম-বিহীন জাগি নিশিদিন খুঁজিয়া পাইনি যারে!
হেরিল মুত্তালিব অপরূপ স্বপ্ন তন্দ্রা-ঘোরে,–
অভূতপূর্ব আওয়াজ যেন গো বাজিছে আকাশ ভরে!
ফেরেশতা সব যেন গগনের নীল শামিয়ানা-তলে
জমায়েত হয়ে তকবীর হাঁকে, সে আওয়াজ জলে থলে
উঠিল রণিয়া। ‘সাফা’ ‘মারওয়ান’ গিরি-যুগ সে আওয়াজে
কাঁপিতে লাগিল, উঠিল আরাব, ‘আসিল সে ধরা মাঝে!’
কে আসিল ? সে কী আমিনার ঘরে? ছুটিতে ছুটিতে যেন
আসিল যে ঘরে আমিনা! ওকি ও, গৃহের ঊর্ধ্বে কেন
এত সাদা মেঘ ছায়া করে আছে? শত স্বর্গের পাখি
বসিতেছে ওই গেহ-পরি যেন চাঁদের জোছনা মাখি!
ঝুঁকিয়া ঝুঁকিয়া দেখিছে কী যেন গ্রহ তারাদল আসি
আকাশ জুড়িয়া নৌবত বাজে ভুবন ভরিয়া বাঁশি!…
টুটিল তন্দ্রা মুত্তালিবের অপরূপ বিস্ময়ে –
ছুটিল যথায় আমিনা – হেরিল নিশি আসে শেষ হয়ে।
আমিনার শ্বেত ললাটে ঝলিত যে দিব্য জ্যোতি-শিখা,
কোলে সে এসেছে – হাতে চাঁদ তার ভালে সূর্যের টিকা!
সে রূপ হেরিয়া মুর্ছিত হয়ে পড়ল মুত্তালিব,
একী রূপ ওরে একী আনন্দ একী এ খোশনসিব!
চেতনা লভিয়া পাগলের প্রায় কভু হাসে কভু কাঁদে,
যত মনে পড়ে পুত্রে, পৌত্রে তত বুকে লয়ে বাঁধে!
পৌত্রে ধরিয়া বক্ষে তখনই আসিলেন কাবা-ঘরে,
বেদি পরে রাখি শিশুরে করেন প্রার্থনা শিশু তরে।
‘আরশে’ থাকিয়া হাসিলেন খোদা – নিখিলের শুভ মাগি
আসিল যে মহামানব – যাচিছে কল্যাণ তারই লাগি!
ছিল কোরেশের সর্দার যত সে প্রাতে কাবায় বসি
যোগ দিল সেই ‘মুনাজাতে’ সবে আনন্দে উচ্ছ্বসি।
সাতদিন যবে বয়স শিশুর – আরবের প্রথামতো
আসিল ‘আকিকা’ উৎসবে প্রিয় বন্ধু স্বজন যত!
উৎসব শেষে শুধাল সকলে শিশুর কী নাম হবে,
কোন সে নামের কাঁকন পরায়ে পলাতকে বাঁচি লবে।
কহিল মুত্তালিব বুকে চাপি নিখিলের সম্পদ,–
“নয়নাভিরাম! এ শিশুর নাম রাখিনু ‘মোহাম্মদ’!”
চমকে উঠিল কোরেশির দল শুনি অভিনব নাম,
কহিল, ‘এ নাম আরবে আমরা প্রথম এ শুনিলাম।
বনি-হাশেমের গোষ্ঠীতে হেন নাম কভু শুনি নাই,
গোষ্ঠী-ছাড়া এ নাম কেন তুমি রাখিলে, শুনিতে চাই!’
আঁখিজল মুছি চুমিয়া শিশুরে কহিলেন পিতামহ –
“এর প্রশংসা রণিয়া উঠুক এ বিশ্বে অহরহ,
তাই এরে কহি ‘মোহাম্মদ’ যে চির-প্রশংসমান,
জানি না এ নাম কেন এল মুখে সহসা মথিয়া প্রাণ।”
নাম শুনি কহে আমিনা –‘স্বপ্নে হেরিয়াছি কাল রাতে
‘আহ্মদ’ নাম রাখি যেন ওর!’ ‘জননী, ক্ষতি কি তাতে’
হাসিয়া কহিল পিতামহ, ‘এই যুগল নামের ফাঁদে,
বাঁধিয়া রাখিনু কুটিরে মোদের তোমার সোনার চাঁদে!’
একটি বোঁটায় ফুটিল গো যেন দুটি সে নামের ফুল,
একটি সে নদী মাঝে বয়ে যায়, দুইধারে দুই কূল!
০৭. পরভৃত
পালিত বলিয়া অপর পাখির নীড়ে
পিকের কন্ঠে এত গান ফোটে কি রে?
মেঘ-শিশু ছাড়ি সাগর-মাতার নীড়
উড়ে যায় হায় দূর হিমাদ্রি-শির,
তাই কি সে নামি বর্ষাধারার রূপে
ফুলের ফসল ফলায় মাটির স্তূপে?
জননী গিরির কোল ফেলে নির্ঝর
পলাইয়া যায় দূর বন-প্রান্তর,
তাই কি সে শেষে হয়ে নদী স্রোতধারা –
শস্য ছড়ায়ে সিন্ধুতে হয় হারা?
বিহগ-জননী স্নেহের পক্ষপুটে
ধরিয়া রাখে না, যেতে দেয় নভে ছুটে
বিহগ-শিশুরে, মুক্ত-কন্ঠে তাই
সে কি গাহে গান বিমানে সর্বদাই?
বেণু-বন কাটি লয়ে যায় শাখা গুণী,
তাই কি গো তাতে বাঁশরির ধ্বনি শুনি?
উদয়-অচল ধরিয়া রাখে না বলি
তরুণ অরুণ রবি হয়ে ওঠে জ্বলি!
আড়াল করিয়া রাখে না তামসী নিশা,
তাই মোরা পাই পূর্ণশশীর দিশা।
আকাশ-জননী শূন্য বলিয়া – তার
কোলে এত ভিড় গ্রহ চাঁদ তারকার।
তেমনই আমিনা-জননী শিশুরে লয়ে
‘হালিমা’র কোলে ছেড়ে ছিল নির্ভয়ে!
মা-র বুক ত্যজি আসিল ধাত্রীবুকে,
গিরি-শির ছাড়ি এল নদী গুহামুখে!
কেমনে নির্ঝর এল প্রান্তরে বহি
অভিনবতর সে কাহিনি এবে কহি।
আরবের যত ‘খাদানি’ ঘরে বহুকাল হতে ছিল রেওয়াজ
নবজাত শিশু পালন করিতে জননী সমাজে পাইত লাজ;
ধাত্রীর করে অর্পিত মাতা জনমিলে শিশু অমনি তায়,
মরু-পল্লিতে স্বগৃহে পালন করিত শিশুরে ধাত্রীমায়।
মরু প্রান্তর বাহি ধাত্রীরা ছুটিয়া আসিত প্রতি বছর,
ভাগ্যবান কে জনমিল শিশু বড়ো বড়ো ঘরে – নিতে খবর।
দূর মরুপারে নিজ পল্লিতে শিশুরে লইয়া তারে তথায়
করিত পালন সন্তানসম যত্নে – পুরস্কার-আশায়।
ঊর্ধ্বে উদার গগন বিথার নিম্নে মহান গিরি অটল,
পদতলে তার পার্বতী মেয়ে নির্ঝরিণীর শ্যামাঞ্চল।
সেই ঝরনার নুড়ি ও পাথর কুড়ায়ে কুড়ায়ে দুই সেই তীর
রচিয়াছে মরু-দগ্ধ আরবি শ্যামল পল্লি শান্ত নীড়।
সেথায় ছিল না নগরের কল-কোলাহল কালি ধূলি-স্তূপ,
ঝরনার জলে ধোয়া তনুখানি পল্লির চির-শ্যামলী রূপ।
সে আকাশতলে সেই প্রান্তরে – সেই ঝরনার পিইয়া জল,
লভিত শিশুরা অটুট স্বাস্থ্য, ঋজুদেহ, তাজা প্রাণ-চপল।
খেলা-সাথি ছিল মেষ-শিশু আর বেদুইন শিশু দুঃসাহস,
মরু-গিরি-দরি চপল শিশুর চরণের তলে ছিল গো বশ।
মরু-সিংহেরে করিত না ভয় এইসব শিশু তিরন্দাজ,
কেশর ধরিয়া পৃষ্ঠে চড়িয়া ছুটাত তাহারে মরুর মাঝ।
আরবি ঘোড়ায় হইয়া সওয়ার বল্লম লয়ে করিত রণ,
মাগিত সন্ধি খেজুর শাখার হাত উঠাইয়া মরু-কানন।
নাশপাতি সেব আনার বেদানা নজরানা দিত ফুল ফলের,
সোজা পিঠ কুঁজো করিয়াছে উট সালাম করিতে যেন তাদের!
‘লু’ হাওয়ায় ছুটে পালাত গো মরু ইহাদেরই ভয়ে দিক ছেয়ে,
রক্ত-বমন করিত অস্ত-সূর্য এরই তির খেয়ে!
আরবের যত গানের কবিরা ‘কুলসুম’ ‘ইমরুল কায়েস’
এই বেদুইন-গোষ্ঠীতে তারা জন্মিয়াছিল এই সে দেশ!
গাহিত হেথাই আলোর পাখি ও গানের কবিতা যত সে গান,
নগরে কেবল ছিল বাণিজ্য, পল্লিতে ছিল ছড়ানো প্রাণ।
আরবের প্রাণ আরবের গান, ভাষা আর বাণী এই হেথাই,
বেদুইনদের সাথে মুসাফির বেশে ফিরিত গো সর্বদাই।
বাজাইয়া বেণু চরাইয়া মেষ উদাসী রাখাল গোঠে মাঠে,
আরবি ভাষারে লীলাসাথি করে রেখেছিল পল্লির বাটে…।
যে বছর হল মক্কা নগরে মোহাম্মদের অভ্যুদয়,
দুর্ভিক্ষের অনল সেদিন ছড়ায়ে আরব-জঠরময়।
ঊর্ধ্বে আকাশ অগ্নি-কটাহ, নিম্নে ক্ষুধার ঘোর অনল,
রৌদ্র শুষ্ক হইল নিঝর, তরুলতা শাখা ফুল-কমল।
মক্কা নগরে ছুটিয়া আসিল বেদুইন যত ক্ষুধা-আতুর,
ছাড়ি প্রান্তর, পল্লির বাট খর্জুর-বন দূর মরুর।
বেদুইনদের গোষ্ঠীর মাঝে শ্রেষ্ঠ গোষ্ঠী ‘বনি সায়াদ’,
সেই গোষ্ঠীর ‘হালিমা’ জননী – দুর্ভিক্ষেতে গণি প্রমাদ
আসিল মক্কা, যদি পায় হতে কোনো সে শিশুর ধাত্রী-মা;
খুঁজিতে খুঁজিতে দেখিল, ‘আমিনা-কোল জুড়ি’ চাঁদ পূর্ণিমা,
কোনো সে ধাত্রী লয় নাই এই শিশুরে হেরিয়া পিতৃহীন –
ভাবিল – কে দেবে পুরস্কার এর পালিবে যে ওরে রাত্রিদিন?
শিশুরে হেরিয়া হালিমার চোখে অকারণে কেন ধরে না জল,
বক্ষ ভরিয়া এল স্নেহ-সুধা – শুষ্ক মরুতে বহিল ঢল।
আরবি ভাষার ধাত্রীমা ছিল এই সে গোষ্ঠী ‘বনি সায়াদ’,
এই গোষ্ঠীতে রাখিতে শিশুরে সব সে শরিফ করিত সাধ।
এই গোষ্ঠীর মাঝে থাকি শিশু লভিল ভাষার যে সম্পদ,
ভাবিত নিরক্ষর নবিঘরে সকলে ‘আলেম’ মোহাম্মদ।
শিশুরে লইয়া হালিমা জননী চলিল মরুর পল্লি দূর,
ছায়া করে চলে সাথে সাথে তার ঊর্ধ্বে আকাশে মেঘ মেদুর।
নতুন করিয়া আমিনা-জননী কাঁদিলেন হেরি শূন্য কোল,
অদূরে ‘দলিজে’ মুত্তালিবের শোনা গেল ঘোর কাঁদন-রোল!
পলাইয়া গেল চপল শশক-শিশু শুনি দূর ঝরনা-গান,
বনমৃগ-শিশু পলাল মা ছাড়ি শুনি বাঁশরির সুদূর তান।
বিশ্ব যাঁহার ঘর, সে কি রয় ঘরের কারায় বন্দি গো?
ঘর করে পর অপরের সাথে সেই বিবাগির সন্ধি গো!
শিশু-ফুল হরি নিল বনমালী ফুলশাখা হতে ভোরবেলায়,
লতা কাঁদে, ফুল হেসে বলে, ‘আমি মালা হব মা গো গুণী-গলায়!’
আসিল হালিমা কুটিরে আপন সুদূর শ্যামল প্রান্তরে,
সাথে এল গান শুনাতে শুনাতে বুলবুল পথ-প্রান্তরে।
পাহাড়তলির শ্যাম প্রান্তর হল আরও আরও শ্যামায়মান,
ঊর্ধ্বে কাজল মেঘ-ঘন-ছায়া, সানুদেশে শ্যামা দোয়েল গান!
তরুণ অরুণ আসিল আকাশে ত্যজিয়া উদয়-গিরির কোল,
ওরে কবি, তোর কন্ঠে ফুটুক নতুন দিনের নতুন বোল!
০৮. শৈশবলীলা
খেলে গো ফুল্লশিশু ফুল-কাননের বন্ধু প্রিয়
পড়ে গো উপচে তনু জ্যোৎস্না চাঁদের রূপ অমিয়।
সে বেড়ায়, হীরক নড়ে,
আলো তার ঠিকরে পড়ে!
ঘোরে সে মুক্ত মাঠে পল্লিবাটে ধরার শশী,
সে বেড়ায় – শুষ্ক মরুর শুক্লা তিথি চতুর্দশী।
অদূরে স্তব্ধগিরি মৌনী অটল তপস্বী-প্রায়,
পায়ে তার পুষ্প-তনু কন্যা যেন উপত্যকায়।
শিরে তার উদার আকাশ,
ব্যজনী দুলায় বাতাস।
বয়ে যায় গন্ধ শিলায় ঝরনা নহর লহর লীলায়,
যেতে সে খোশবুপানি ছিটায় কূলের ফুলমহলায়!
পাখি সব শিস দিয়ে যায় কিশমিশেরই বল্লরিতে,
আকাশ আর বনদেবীতে মন বিনিময় নীল হরিতে।
মাঝে তার ফুল্লশিশু বেড়ায় খেলে ফুল-ভুলানো,
বুকে তার সোনার তাবিজ নিখিল আলোক দোল-দোলানো।
কভু সে দুম্বা চরায় সাধ করে হয় মেষের রাখাল,
কভু তার দৃষ্টি হারায় দূর সাহারায়, যায় কেটে কাল।
অচপল মৌনী পাহাড় মন হরে তার, রয় বসে সে,
খেলাতে মন বসে না যায় হারিয়ে নিরুদ্দেশে।
অসীম এই বিশাল ভুবন
ওগো তার স্রষ্টা কেমন!
কে সে জন করল সৃজন বিচিত্র এই চিত্রশালা?
মেষেরা যায় হারিয়ে, মুগ্ধ শিশু রয় নিরালা।
কভু সে বংশী বাজায়, উট-শিশুরা সঙ্গে নাচে,
ভুলে নাচ বেড়ায় খুঁজে কে যেন তায় ডাকছে কাছে।
সহসা আনমনা হয় সঙ্গীজনের সংগীতে সে,
চোখে তার কার অপরূপ বেড়ায় রূপের ভঙ্গি ভেসে।
সাথি সব ভয় পেয়ে যায় চক্ষুতে তার এ কোন জ্যোতি!
ও আঁখি নীল সুঁদিফুল সুন্দরেরে দেয় আরতি।
ও যেন নয় গো শিশু, পথভোলা এক ফেরেশতা কোন
ও যেন আপন হওয়ার ছল করে যায়, নয়কো আপন।
হালিমা ভয়-চকিতা রয় চেয়ে গো শিশুর পানে,
ও যেন পূর্ণ জ্ঞানী, সকল কিছুর অর্থ জানে।
কে জানে কাহার সাথে কয় সে কথা দূর নিরালায়,
কে জানে কাহার খোঁজে যায় পালিয়ে বনের সীমায়।
কভু সে শিশুর মতো,
কভু সে ধেয়ান-রত।
একী গো পাগল তবে, কিংবা ভূতে ধরল এরে,
এনে হায় পরের ছেলে পড়ল কী কু-গ্রহের ফেরে!
স্বামী তার বলল ভেবে, “শোন হালিমা, কাল সকালে
দিয়ে আয় যাদের ছেলে তাদেরকাছে, নয় কপালে
আছে সে বদনামি ঢের, নাই এ গ্রামে ভূতের ওঝা,
কাবাতে ‘লাত মানাতের’ কৃপায় এ ভূত হবেই সোজা!”
হালিমা অশ্রু মুছে মোহাম্মদে আনল আবার
হারানো মাতৃক্রোড়ে, বললে, ‘লহো পুত্র সোনার!’
আমিনার বক্ষ বেয়ে অশ্রু ঝরে আকুল স্নেহে,
ওরে মোর সোনার দুলাল আজ ফিরেছে আঁধার গেহে!
এল আজ মুত্তালিবের চোখের মণি, শান্তি শোকের,
এল আজ সফর করে সফর চাঁদে চাঁদ মুসাফের!
পারায়ে কৃষ্ণা তিথি শুক্লা তিথির আসল অতিথ,
কত সে দিনের পরে আঁধার ঘরে উঠল রে গীত!
০৯. প্রত্যাবর্তন
সেবার দূষিত ছিল বড়ো বায়ু মক্কাপুরীর,
নিশ্বাসে ছিল বিষের আমেজ হাওয়ায় সুরীর।
কহিলেন দাদা মুত্তালিব, ‘গো হালিমা শুনো,
মরু-প্রান্তরে লয়ে যাও মোর চাঁদেরে পুন!
আবার যেদিন ডাকিব, আনিবে ফিরায়ে এরে,
মাঝে মাঝে এনে দেখাইয়া যেয়ো মোর চাঁদেরে!’
আমিনার চোখে ফুরাল শুক্ল চাঁদের তিথি,
আবার আসিল ভবনে অতীত-আঁধার ভীতি।
স্বপনে চলিয়া গেল যেন চাঁদ স্বপনে এসে,
দ্বিতীয়ার চাঁদ লুকাল আকাশে ক্ষণেক ভেসে।
অঙ্গ ভরিয়া অশ্রু-চুমায় চলিল ফিরে
সোনার শিশু গো – নীড় ত্যজি পুন অজানা তীরে।
হালিমার বুকে খুশি ধরে নাকো, নীলাঞ্চলে
হারানো মানিক পুন পেল তার ভাগ্যবলে!
চলে অলক্ষ্যে সাথে বেহেশ্ত-ফেরেশতারা!
মক্কার মণি পুন মরুপথে হইল হারা।
হালিমার দুই কন্যা ‘আনিসা’ ‘হাফিজা’ ছুটি
চুমিল খুশিতে মোহাম্ম্দের নয়ন দুটি!
‘আবদুল্লাহ্’ হালিমা-দুলাল মানের ভরে
রহিল দাঁড়ায়ে অদূরে, নয়নে সলিল ঝরে।
সে যখন ছিল ঘুমায়ে, তাহার জননী কখন
নিয়ে গেল কোথা মোহাম্মদেরে ; ভাঙিতে স্বপন
খুঁজিল কত না সাথিরে তাহার কানন গিরি!
রোদন করুণ প্রতিধ্বনিতে এসেছে ফিরি!
শয়নে স্বপনে ওই মুখ তার স্মৃতির মাঝে
উঠিয়াছে ভাসি, হেরেছে তাহারে সকল কাজে।
নড়িয়া উঠেছে খেজুরের পাতা বাতাসে যবে
সে ভেবেছে তারে ডাকিতেছে সাথী নূপুর-রবে।
শিস দিত যবে বুলবুলি বসি আনার-শাখে,
মনে হত তার, বন্ধু বংশী বাজায়ে ডাকে।
দুম্বা মেষের শিশুরা করুণ নয়ন তুলি
চাহিয়া থাকিত, খুঁজিত কাহারে সকল ভুলি।
মেষ-চারণের মাঠে তরুতলে বসিয়া একা
পাঠায়েছে তার হারানো সখারে সলিল-লেখা।
ফিরিয়া আসিল লুকোচুরি খেলে যদি সে চপল,
ওর সাথে আড়ি – বল মায়ে ওরে নিয়ে যেতে বল।
হালিমার স্বামী হারিস শিশুরে লইল কাড়ি,
আনন্দ তার পুনরায় যেন ফিরিল বাড়ি।
মোহাম্মদ সে আবদুল্লার কন্ঠ ধরি
বলে, ‘আমি কত কেঁদেছি দোস্ত তোমারে স্মরি।’
ছুটিল আবার দুটিতে পাহাড়ি চারণ-মাঠে,
বংশী বাজায়ে দুম্বা চরায়ে সময় কাটে!
রাখালের রাজা আসিল ফিরিয়া রাখাল-দলে,
আবার লহর-লীলায় পাহাড়ি নহর চলে।
১০. শাককুস সাদর
এমনি করিয়া চরাইয়া মেষ, বংশী বাজায়ে গাহিয়া গান,
খেলে শিশু নবি রাখালের রাজা মরুর সচল মরূদ্যান।
চন্দ্র তারার ঝাড় লন্ঠন ঝুলানো গগন চাঁদোয়া-তল,
নিম্নে তাহার ধরণির চাঁদ খেলিয়া বেড়ায় চল-চপল।
ঘন কুঞ্চিত কালো কেশদাম কলঙ্ক শুধু এই চাঁদের,
ঘুমালে এ চাঁদ কৃষ্ণা তিথি গো, জাগিলে শুক্লা তিথি গো ফের।
চাঁদ কি আকাশে বংশী বাজায়, গ্রহ তারকারা শুনি সে রব
চরিয়া বেড়ায় মুক্ত আকাশে মেষ বৃষ রাশি রূপে গো সব?
খেলিতে খেলিতে আনমনা চাঁদ হারাইয়া যায় দূর মেঘে
অন্ধকারের অঞ্চলতলে, আনমনে পুন ওঠে জেগে।
খেলিতে খেলিতে সেদিন কোথায় হারাল বালক মোহাম্মদ
খুঁজিয়া বেড়ায় খেলার সাথিরা প্রান্তর বন গিরি ও নদ।
কোথাও সে নাই! খুঁজি সব ঠাঁই ফিরিয়া আসিল বালক দল,
হালিমারে বলে, ‘আমাদের রাজা হারাইয়া গেছে, দেখিবি চল!’
কাঁদিয়া ছুটিল হালিমা, খুঁজিল প্রান্তর গিরি মরু কানন,
রবিরে হারায়ে নিশীথিনী মাতা এমনই করিয়া খোঁজে গগন!
এমনই করিয়া সিন্ধু-জননী হারামণি তার খুঁজিয়া যায় –
কোটি তরঙ্গে ভাঙিয়া পড়িয়া ধূলির ধরায় বালুবেলায়।
কত নাম ধরে ডাকিল হালিমা, ‘ওরে জাদুমণি, সোনা মানিক!
ফিরে আয়, আয়, ও চাঁদ-মুখের হাসিতে আবার প্লাবিয়া দিক।
পেটে ধরি নাই, ধরেছি তো বুকে, চোখে ধরা মোর মণি যে তুই
মোর বনভূমে আসিসনি ফুল, এসেছিলি পাখি এ বনভুঁই!’
সহসা অদূরে চিরচেনা স্বরে শুনিরে ও কার মধুর ডাক,
ওকে ও মধুচ্ছন্দা গায়ন-কন্ঠে উহার ওকী ও বাক?
ও যেন শান্ত মরু-তপস্বী, ধেয়ানে উঠিছে কন্ঠে শ্লোক,
শিশু-ভাস্কর – উহারই আশায় জাগিয়া উঠিছে সর্বলোক।
হালিমা বক্ষে জড়ায়ে ধরিতে ভাঙিল যেন গো চমক তার,
যেন অনন্ত জিজ্ঞাসা লয়ে খুলিল কমল-আঁখি বিথার।
‘একী এ কোথায় আসিয়াছি আমি’ – জিজ্ঞাসে শিশু সবিস্ময়,
চুম্বিয়া মুখ হালিমা জননী, ‘তোর মার বুকে’ কাঁদিয়া কয়।
‘ওরে ও পাগল, কী স্বপন-ঘোরে ছিলি নিমগ্ন বল রে বল।
ওরে পথভোলা, কোন বেহেশ্ত-পথ ভুলে এলি করিয়া ছল?
দেহ লয়ে আমি খুঁজেছি ধরণি, মনে খুঁজিয়াছি শত সে লোক,
এমনই করিয়া, পলাতকা ওরে, এড়াতে হয় কি মায়ের চোখ?’
এবার বালক মায়ের কন্ঠ জড়াইয়া বলে, ‘জননী গো,
কী জানি কে যেন নিতি মোরে ডাকে যেন সোনার মায়ামৃগ!
আজও সে ডাকিতে এড়ায়ে সবারে এসেছিনু ছুটি এ-মরুপথ,
ছুটিতে ছুটিতে হারাইনু দিশা, ভুলিনু আমারে, মোর জগৎ।
এই তরুতলে আসিতে আমার নয়ন ছাইয়া আসিল ঘুম,
হেরিনু স্বপনে – কে যেন আসিয়া নয়নে আমার বুলায় চুম।
আলোর অঙ্গ, আলোকের পাখা, জ্যোতির্দীপ্ত তনু তাহার,
কহিল সে, ‘আমি খুলিতে এসেছি তোমার হৃদয়-স্বর্গদ্বার।
খোদার হাবিব – জ্যোতির অংশ ধরার ধূলির পাপ-ছোঁয়ায়
হয়েছ মলিন, খোদার আদেশে শুচি করে যাব পুন তোমায়।
ঐশী বাণীর আমিই বাহক,আমি ফেরেশতা জিব্রাইল,
বেহেশ্ত হতে আনিয়ছি পানি, ধুয়ে যাব তনু মন ও দিল্!’
এই বলি মোরে কহিল সালাম, সঙ্গিনী তার হুরির দল
গাহিতে লাগিল অপরূপ গান, ছিটাইল শিরে সুরভি জল।
তারপর মোরে শোয়াইল ক্রোড়ে, বক্ষ চিরিয়া মোর হৃদয়
করিল বাহির! হল না আমার কোনো যন্ত্রণা কোনো সে ভয়!
বাহির করিয়া হৃদয় আমার রাখিল সোনার রেকাবিতে,
ফেলে দিল, ছিল যে কালো রক্ত হৃদয়ে [জমাট] মোর চিতে।
ধুইল হৃদয় পবিত্র ‘আব-জমজম’ দিয়ে জিব্রাইল,
বলিল, ‘আবার হল পবিত্র জ্যোতির্মহান তোমার দিল্।
এই মায়াবিনী ধরার স্পর্শে লেগে ছিল যাহা গ্লানি-কলুষ
যে কলুষ লেগে ধরার ঊর্ধ্বে উঠিতে পারে না এই মানুষ,
পূত জমজম-পানি দিয়া তাহা ধুইয়া গেলাম – তাঁর আদেশ,
তুমি বেহেশতি, তোমাতে ধরার রহিল না আর ম্লানিমা-লেশ!’
সেলাই করিয়া দিল পুন মোর বক্ষে রাখিয়া ধৌত দিল্,
সালাম করিয়া ঊর্ধ্বে বিলীন হইল আলোক-জিব্রাইল!’
বুঝিতে পারে না অর্থ ইহার – হালিমা কাঁদিয়া বুক ভাসায়,
বলে ‘কত শত জিন পরি আছে ওই পর্বতে ওই গুহায়,
আর তোরে আমি আসিতে দিব না মেষ-চারণের এই মাঠে
কোনদিন তোরে ভুলাইয়া তারা লয়ে যাবে দূর মরু-বাটে।’
ছুটিয়া আসিল পড়শি আবালবৃদ্ধবনিতা ছেলেমেয়ে,
বলে, ‘আসেবের’ আসর হয়েছে উহার উপরে, দেখ চেয়ে!
অমন সোনার ছেলে, ওকি আর মানুষ, ও যে গো পথভোলা
কোকাফ্মুলুক পরিস্থানের পরিজাদা কোনো রূপওলা!’
বিস্ময়াকুল নয়নে চাহিয়া খানিক কহিল মোহাম্মদ হাসি,
‘আম্মা গো ওরা কী বলিছে সব? আমি যে তোরেই ভালোবাসি!
তুমি আম্মা ও আমি আহ্মদ, পায়নি তো মোরে জিন পরি,
এসেছিল সেতো জিব্রাইল সে ফেরেশতা! মাগো, হেসে মরি!
এই তো তোমার কোলে আছি বসে, দিওয়ানা কি আমি? তুই মা বল!
আমারে পায়নি পরিতে, ওদেরে পাইয়াছে ভূতে তাই এ ছল!’
হালিমা জড়ায়ে বক্ষে বালকে বলে, ‘বাবা তুমি বলেছ ঠিক!’
মনের শঙ্কা যায় নাকো তবু, বাহিরে দস্যু ঘরে মানিক।
মনে পরে তার, সেদিনও ইহার জননী আমিনা এই কথাই
বলেছিল, ‘কই খোকার আমার কোথাও তেমন আভাসও নাই!
দেখিছ না ওর চোখ মুখ কত তেজ-প্রদীপ্ত, তাই লোকে
যা-তা বলে! আমি মানি না এসব, যদি দেখি ইহা নিজ চোখে!’
জননীর মন অন্তর্যামী, সে তো করিবে না কখনও ভুল,
দেখেনি তো এরা দুনিয়ায় কভু ফুটিবে এমন বেহেশ্ত-গুল!
বারে বারে চায় বালকের চোখে – ও যেন অতল সাগরজল,
কত সে রত্ন মণিমাণিক্য পাওয়া যায় যেন খুঁজিলে তল।
বক্ষে চাপিয়া চুমিয়া ললাট বলে, ‘যদি হস বাদশা তুই
মনে পড়িবে এ হালিমা মায়েরে? পড়িবে মনে এ পল্লি ভুঁই?’
‘মা গো মনে রবে।’ হাসিয়া বালক কহিল কন্ঠে জড়ায়ে মা-র ;
ভবিষ্যতের দফতরে লেখা রহিল সে কথা, ও বাণী যেন গো খোদ খোদার!
১১. সর্বহারা (সকলের তরে এসেছে যে-জন)
সকলের তরে এসেছে যে-জন, তার তরে
পিতার মাতার স্নেহ নাই, ঠাঁই নাই ঘরে।
নিখিল ব্যথিত জনের বেদনা বুঝিবে সে,
তাই তারে লীলা-রসিক পাঠাল দীন বেশে!
আশ্রয়হারা সম্বলহীন জনগণে –
সে দেখিবে চির-আপন করিয়া কায়মনে –
বেদনার পর বেদনা হানিয়া তাই তারে
ভিখারি সাজায়ে পাঠাল বিশ্ব-দরবারে!
আসিল আকুল অন্ধকারের বুকে হেথাই।
আলোর স্বপন হেরিবে, আলোর দিশারি, তাই
নিখিল পিতৃহীনের বেদনা নিজ করে
মুছাবে বলিয়া – নিখিলের পিতা ধরা পরে
পাঠাইল তার বন্ধুরে করি পিতৃহীন,
দীনের বন্ধু আসিল সাজিয়া দীনাতিদীন।
পিতৃহীন সে শিশু পুনরায় মাতারে তার
হারাইল আজ! শোক-নদী হল শোক পাথার!
* * *
হালিমার কোলে গত হয়ে গেল পাঁচ বছর
শশীকলা সম বাড়িতে লাগিল শশী-সোদর।
সহসা সেদিন শ্যাম প্রান্তরে নিষ্পলক
চাহিয়া অদূরে কী মেঘের ছায়া হেরি বালক
উতলা হইল ফিরিবার লাগি জননী-ক্রোড় ;
গগন বিহারী বিহগের চোখে নীড়ের ঘোর!
কত গ্রহ তারা কত মেঘ ডাকে নীলাকাশে,
বিহরি খানিক চপল বিহগ ফিরে আসে
আপনার নীড়ে! ভুলিতে পারে না মা-র পাখা,
আকাশের চেয়ে তপ্ততর সে স্নেহমাখা!…
কাঁদিতে লাগিল মরুপল্লির মাঠ ও বাট,
ভাঙিয়া গেল গো খেজুর বনের রাখালি নাট।
পাহাড়তলিতে দুম্বা শিশুরা চাহিয়া রয়,
তাহাদের চোখে আজ পাহাড়ের ঝরনা বয়।
হলিমার ঘরে আলো নিভে গেল দমকা বায়,
পুত্র কন্যা কাঁদিয়া কাঁদিয়া মূর্ছা যায়।
তবু তারে ছেড়ে দিতে হল! ভাঙি মেঘের বাঁধ
পলাইয়া গেল রাঙা পঞ্চমী তিথির চাঁদ!
আমিনার কোলে ফিরে এল আমিনার রতন
বৃদ্ধ মুত্তালিবের যষ্ঠি – যখের ধন!
স্কন্ধে তুলিয়া বালকে বৃদ্ধ এল কাবায়,
বেদিতে রাখিয়া বালকে খোদার আশিস চায়।
সাতবার তারে করাইল কাবা প্রদক্ষিণ
প্রার্থনা করে, ‘রক্ষ পিতা এ পিতৃহীন!’
আমিনা সাদরে হালিমায় কয়, ‘কী দিব ধন
আমার রতনে করিয়াছ কত শত যতন,
মনের মতন দিব যে অর্থ নাহি উপায়,
তবু বলো মোর যা আছে ঢালিব তোমার পায়।
আমি ধরেছিনু গর্ভে – তুমি যে ধরি বুকে
করেছ পালন – মোরা সহোদরা সেই সুখে।’
হালিমার চোখে বয়ে যায় জমজম পানি,–
মোহাম্মদেরে ধরে কাঁদে নাহি সরে বাণী।
কাঁদিয়া কহিল মোহাম্মদেরে, ‘জাদু আমার,
তুই দে আমায় আমার প্রাপ্য পুরস্কার!
আমিনা-বহিন জানে না তো তোরে কেমন সে
রাখিয়াছি বুকে দুখ দিয়ে না সে ভালোবেসে!’
ছুটিয়া আসিল বালক ফেলিয়া মায়ের কোল,
কন্ঠ জড়ায়ে হালিমারে বলে মধুর বোল।
চুমু দিয়ে কয়, ‘মা গো, এই লহ পুরস্কার।’
হালিম মুছিয়া আঁখি, কয়, ‘কিছু চাহি না আর!
সব পাইয়াছি আমিনা, ইহার অধিক বোন,
পারিবে আমারে দিতে জহরত মানিক কোন।’
জননীর কোল জুড়াল আবার নব সুখে,
চোখের অশ্রু শিশু হয়ে আজ দুলে বুকে!…
পুন রবিয়ল আউওল চাঁদ এল ফিরে,
এবার চাঁদের ললাট আসিল মেঘে ঘিরে।
কনক-কান্তি বালক খেলায় আঙিনায়,
আমিনার মনে স্বামী-স্মৃতি নিতি কাঁদিয়া যায়।
ফিরিয়া ফিরিয়া আসিল সেই সে চান্দ্র মাস
আবদুল্লাহ গেল পরবাসে ফেলিয়া শ্বাস,
আর ফিরিল না – মদিনায় নিল চিরবিরাম!
আমিনার চোখে ‘সোবেহ্সাদেক’ হইল ‘শাম’!
মদিনার মাটি লুকায়ে রেখেছে স্বামীরে তার,
যাবে সে খুঁজিতে যদি বা চকিতে পায় ‘দিদার’।
যে কবরতলে আছে সে লুকায়ে, সেই কবর
জিয়ারত করি পুছিবে স্বামীরে তার খবর।
মৃত্যু-নদীর উজান ঠেলিয়া কেহ কি আর
ফিরিতে পারে না ওপার হইতে পুনর্বার?
দেখিবে ডুবিয়া – নাই যদি ফিরে, ভয় কী তায়?
হয়তো একূলে হারায়ে ওকূলে প্রিয়রে পায়!
আহ্মদে লয়ে আমিনা-মা চলে মদিনাধাম,
জানে না, সে চলে লভিতে স্বামীর সাথে বিরাম।
জানে না সে চলে জীবনপথের শেষ সীমায়,
ওপার হইতে চিরসাথি তারে ডাকিছে ‘আয়!’
কত শত পথ-মঞ্জিল মরু পারায়ে সে
দাঁড়াল স্বামীর গোরের শিয়রে আজ এসে!
বুঝিতে পারে না বালক, কেন যে জননী হায়
কবর ধরিয়া লুটায় আহত কপোতী প্রায়!
বালকে বক্ষে জড়াইয়া বলে, ‘ওঠো স্বামী,
তোমার অ-দেখা মানিকে এনেছি দিতে আমি!’
মা-র দেখাদেখি কাঁদিল বালক, চুমিল গোর,
বলে – ‘মা গো তোর চেয়ে ছিল ভালো পিতা কি মোর?
তোমার মতন ভালোবাসিত সে? তবে কেন
না ধরিয়া কোলে মাটিতে লুকায়ে রয় হেন?’
কী বলিবে মাতা! ক্রন্দনরত বালকে তার
বক্ষে ধরিয়া চুম্বে কবর বারংবার!
মাখিয়া স্বামীর কবরের ধূলি সকল গায়
মক্কার পথে আবার আমিনা ফিরিয়া যায়।
ফিরে যেতে মন সরে না ছাড়িয়া গোরস্থান,
তবু যেতে হবে – এ বালক এ যে স্বামীর দান!
মরুপথে বাজে উটচালকের বংশী সুর,
মনে হয় যেন সেই ডাকে তারে ব্যথা-বিধুর!
মনে মনে বলে – ‘অন্তর্যামী! শুনেছি ডাক,
তুমি ডাকিয়াছ – ছিঁড়ে যাব বন্ধন বেবাক।’
কিছুদূর আসি পথমঞ্জিলে আমিনা কয় –
‘বুকে বড়ো ব্যথা, আহ্মদ, বুঝি হল সময়
তোরে একলাটি ফেলিয়া যাবার! চাঁদ আমার,
কাঁদিসনে তুই, রহিল যে রহমত খোদার!’
বলিতে বলিতে শ্রান্ত হইয়া পড়ি ঢলি,
ফিরদৌসের পথে মা আমিনা গেল চলি’!
বজ্র-আহত গিরি-চূড়া সম কাঁপি খানিক
মা-র মুখে চাহি রহিল বালক নির্নিমিখ!
পূর্ণিমা চাঁদে গ্রাসে রাহু এই জানে লোকে,
গরাসিল রাহু আজ ষষ্ঠীর চন্দ্রকে!
* * *
বাজ-পড়া তালতরুসম একা বৃন্তহীন
দাঁড়ায়ে বৃদ্ধ মুত্তালিব
আকাশ-ললাটে ললাট রাখিয়া নিশি ও দিন
দেখায় তাহার বদ-নসিব।
আবদুল্লাহ্ গিয়াছিল, আমিনা আজ
মোহাম্মদেরে দিয়া জামিন!
দরদ-মুলুকে বাদশাহ শিরে বেদনা আজ
উন্নত শির বীর প্রাচীন,
ফরিয়াদ করে আকাশে তুলিয়া নাঙ্গা শির,
‘ওরে বালক কেন এলি হেথায়,
নাহি পল্লব-ছায়া পোড়া তরু মরুর তার
কী দিয়া আতপ নিবারি হায়!
খাক হয়ে গেছে মরু-উদ্যান, বালুর উপরে বালুর স্তূপ
রচেছে সেখানে কবর গাহ্
গুল নাই, কেন পোড়াইতে পাখা এলি মধুপ,
শোকপুরী – আমি শাহানশাহ!
নাহি পল্লব-শাখা নাই একা তালতরু,
উড়ে এলি সেথা বুলবুলি!
ঊর্ধ্বে তপ্ত আকাশ নিম্নে খর মরু
‘বিয়াবানে’ এলি গুল ভুলি।’
যত কাঁদে তত বুকে বাঁধে আরও, কে রে কপট
মায়াবী খেলিছে খেলা এমন,
প্রাচীন বটের সারা তনু ঘিরি, জটিল জট
আঁকড়িয়া আছে পোড়া কানন।
ব্যাধ-ভয়াতুর শিশু-পাখিসম তবু বালক
জড়াইয়া পিতামহেরে তার,
জননীর চলে-যাওয়া পথে চাহে নিষ্পলক
ডাগর নয়ন ব্যথা বিথার।
যে ডাল ধরে সে সেই ডাল ভাঙে, অ-সহায়
তবু আর ডাল ধরে আবার,
তৃণটিও ধরে আঁকড়ি স্রোতে যে ভাসিয়া যায়
আশা মনে – যদি পায় কিনার।
শোকে ঘুণধরা জীর্ণ সে শাখা, তাই ধরি
রহিল বালক প্রাণপণে,
জানে না, এ ডালও ভাঙিয়া পড়িবে শিরোপরি
আবার ঘোর প্রভঞ্জনে।
পাখা মেলে এল শোকের বিপুল ‘সি-মোরগ’
কালো হল ধরা সেই ছায়ায়,
দু-বছর পরে – পিতামহ চলি গেল স্বরগ
ছিঁড়ি বন্ধন মোহমায়ায়।
ওড়ে কালো মেঘ মক্কার শিরে শকুনিপ্রায়
ছিন্ন জটায়ু-পাখা যেন,
আট বছরের বালকের বাহু শক্তি তায়
বাঁধিয়া রাখিবে নাই হেন।
আরবের বীর মক্কার শির মুত্তালিব
কোরায়শি সর্দার মহান,
আখেরি নবির না-আসা বাণীর দূত নকিব
করিল গো আজ মহাপ্রয়াণ।
মুকুটবিহীন মক্কার বাদশাহ আজি
ফেলে গেল ধূলি সিংহাসন,
মক্কার ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দন আজি,
মাতম করিছে শত্রুগণ।
ডাকিয়া পুত্র আবুতালেবেরে মুত্তালিব
দিয়াছিল সঁপি আহমদে,
জ্যেষ্ঠতাতের কোলে এল সব-হারা ‘হাবিব’,
দিঘির কমল এল নদে।
মূলহারা ফুল স্রোতে ভেসে যায় নির্বিকার
নাহি আর সুখ-দুঃখ লেশ,
শুধু জানে তারে ভাসিতে হইবে বারংবার
এমনই অকূলে নিরুদ্দেশ!
রহস্য-লীলারসিক খোদার অন্ত নাই,
কী জানি সাধিতে কোন সে কাজ
বন্ধুরে বন্ধুর পথে – বেদনা নাই
ফুলেরে ফোটায় কাঁটার মাঝ।
নির্বেদ সে কি, নাহি গো দুঃখ ব্যথা কি তার?
সৃষ্টি কি তার শুধু খেয়াল?
শুধু ভাঙাগড়া পুতুলখেলা কি নির্বিকার
খেলে মহাশিশু চির সে কাল?
জগতেরে আলো দানিবে যে – কেন অন্ধকার
তার চারপাশে ঘিরিয়া রয়?
সব শোকে দিবে শান্তি যে – শৈশব তাহার
কেন এত শোক দুঃখময়?
কেহ তা জানে না, জানিবে না কেহ, সদুত্তর
পাইবে না কেহ কোনো সেদিন,
শুধু রহস্য, জিজ্ঞাসা শুধু, চির-আড়াল
বিস্ময় আদি অন্তহীন!
মাতৃগর্ভে শিশু যবে হল পিতৃহীন,
পাইল না কভু পিতৃক্রোড়,
ষষ্ঠবরষে হারাল মাতায়, স্নেহ-বিহীন
জীবনে কেবলই ঘাত কঠোর!
পুন অষ্ঠম বরষে হারাল পিতামহে
সবহারা শিশু নিরাশ্রয়
পড়িল অকূল তরঙ্গাকুল ব্যথা-দহে,
দশদিশি যেন মৃত্যুময়!
খেলে যে বেড়াবে ধুলা-কাদা লয়ে স্নেহনীড়ে,
ব্যথার উপরে পেয়ে ব্যথা
বালক-বয়সে হল সে ধেয়ানি মরুতীরে –
অতল অসীম নীরবতা
ছাইল আজিকে জীবন তাহার, একা বসি
ভাবে, এ জীবন মৃত্যু হায়
কেন অকারণ? কেন কেঁদে ফেরে ক্রন্দসী
এই আনন্দময় ধরায়?
পলাতক শিশু ঘরে নাহি রয়, নিষ্কারণ
ঘুরিয়া বেড়ায় পথে পথে
খুঁজিয়া বেড়ায় মরু-কান্তার খেজুর বন
অন্ধগুহায় পর্বতে,
সকল দিশার দিশারির দেখা পাবে বুঝি,
হবে সমাধান সমস্যার,
‘আব-হায়াতের’ মৃত্যু-অমৃত পাবে খুঁজি –
খুঁজে পায়নি যা সেকান্দার।
এমনই করিয়া বেদনার পরে পেয়ে বেদন
অল্প বয়সে শেষ নবি
ভাবে তারই কথা এই রহস্য যার সৃজন
আঁধার যাহার – যার রবি!
১২. কৈশোর
বিশ্ব-মনের সোনার স্বপনে কিশোর তনু বেড়ায় ওই
তন্দ্রা ঘোরে অন্ধ আঁখি নিখিল খোঁজে কই সে কই।
বাজিয়ে বাঁশি চড়ায় উট,
নিরুদ্দেশে দেয় সে ছুট,
‘হেরার’ গুহায় লুকিয়ে ভাবে – এ আমি তো আমি নই!
অতল জলে বিম্বসম ফুটেই কেন বিলীন হই।
রূপ ধরে ওই বেড়ায় খেলে দাহন-বিহীন অগ্নিশিখ
পথিক ভোলে পথ-চলা তার, দাঁড়িয়ে দেখে নির্নিমিখ।
সাগর অতল ডাগর চোখ
ভোলায় আকাশ অলখ লোক,
যায় যে পথে – ফিনকি রূপের ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিক,
আরব-সাগর-মন্থন-ধন আরব দুলাল নীল মানিক।
পালিয়ে বেড়ায় পলাতকা রাখতে নারে আপন জন,
কারুর পানে চায় না ফিরে কে জানে তার কোথায় মন।
আদর করে সবাই চায়,
সে চলে যায় চপল পায়,
কে যেন তার বন্ধু আছে ডাকছে তারে অনুক্ষণ,
তার সে ডাকের ইঙ্গিত ওই সাগর মরু পাহাড় বন।
মক্কাপুরীর রত্নমালায় মধ্যমণি এই কিশোর,
পিক পাপিয়া অনেক আছে – দূরবিহারী এ চকোর।
কী মায়া যে এ জানে,
অজানিতে মন টানে,
সবার চোখে নিথর নিশা, উহার চোখে প্রভাত ঘোর।
ফটিক জলের ঊষর দেশে সে এসেছে বাদল-মৌর।
এমনি করে দ্বাদশ বরষ একার জীবন যায় কাটি,
আবুতালেব বলল, “এবার করব সোনা এই মাটি!
আহ্মদ তোর দৌলতে!
এবার যাব দূর পথে
বাণিজ্যে ‘শাম’ ‘মোকাদ্দসে’, তুই যেন বাপ রোস খাঁটি,
দেখিস তুই এ তোর পিতাম-পিতার পূত এই ঘাঁটি।”
‘চাচা, তোমার সঙ্গে যাব’, বলল কিশোর শেষ নবি,
চক্ষে তাহার উঠল জ্বলে ভবিষ্যতের কোন ছবি।
কে যেন দূর পথের পার
ডাকছে তারে বারংবার,
সন্ধানে তার পার হবে সে এই সাহারা এই গোবি,
আকাশ তারে ডাক দিয়েছে আর কি বাঁধা রয় রবি?
বুঝায় যত আবুতালেব, “মানিক, সে যে অনেক দূর!
দজলা ফোরাত পার হতে হয়, লঙ্ঘিতে হয় পাহাড় তূর।
মরুর ভীষন ‘লু’ হাওয়া,
যায় না সেথা জল পাওয়া,
কত সে পথ যাব মোরা, ঘুরতে হবে অনেক ঘুর!”
কিশোর চোখে ভেসে ওঠে কোকাফ মুলুক পরির পুর।
লঙ্ঘি সবার নিষেধ-বাধা চাচার সাথে কিশোর যায়
বাণিজ্যে দূর দেশে প্রথম উটের পিঠে – মরুর নায়।
দেখবি রে আয় বিশ্বজন,
রত্ন খোঁজে যায় রতন!
ধুলায় করে সোনামানিক যেজন ঈষৎ পা-র ছোঁয়ায়,
আনতে সোনা সে যায় রে ওই সোনার রেণু ছিটিয়ে পায়!
দেখবি কে আয়, দরিয়া চলে নহর থেকে আনতে জল,
আনতে পাথর চলল পাহাড় ঝরনা-পথে সচঞ্চল।
ফুলের খোঁজে কানন যায়,
নতুন খেলা দেখবি আয়!
বেহেশ্ত-দ্বারী রেজওয়ান চায় কোথায় পাবে মিষ্ট ফল!
সূর্য চলে আলোর খোঁজে, মানিক খোঁজে সাগর-তল!
দেখবি কে আয়, আজ আমাদের নওল কিশোর সওদাগর
শুক্লা দ্বাদশ তিথির চাঁদের কিরণ ঝলে মুখের পর
আয় মহাজন ভাগ্যবান,
এই সদাগর এই দোকান
আর পাবিনে, আর পাবিনে এমন বিকিকিনির দর!
আয় গুনাগার, এবার সেরা সওদাগরের চরণ ধর!
আয় গুনাগার, লাভ লোকসান খতিয়ে নে তোর এই বেলা,
আসবে না আর এমন বণিক, বসবে না আর এই মেলা!
ফিরদৌসের এই বণিক
মাটির দরে দেয় মানিক!
জহর নিয়ে জহরত দেয়, নও-বণিকের নও-খেলা।
আয় গুনাগার, ক্ষতির হিসাব চুকিয়ে নে তোর এই বেলা।
গুনাগারীর জীবন-খাতায় শূন্য যাদের লাভের ঘর,
এই বেলা আয় – ভুলিয়ে নে সব, কিশোর বয়েস সওদাগর।
আন রে জাহাজ, আন রে উট,
বিশ হাতে আজ মানিক লুট!
অর্থ খুঁজে ব্যর্থ যে জন, এর কাছে খোঁজ তার খবর।
শূন্য ঝুলি দেউলিয়া আয়, পুণ্যে ঝুলি বোঝাই কর!
আপনপ্রেয় শ্রেয় যা সব মৃত্যুরে তা দান করে
অপরিমাণ জীবন-পুঁজি সে এনেছে অন্তরে,
তাই দিবে সে বিলিয়ে আজ
সকলজনে বিশ্বমাঝ!
আয় দেনাদার, বিনা সুদে ঋণ দেবে এ প্রাণ ভরে,
ঋণ-দায়ে যে পালিয়ে বেড়ায়, শোধ দেবে এ, আন ধরে!…
পঙ্খিরাজে পাল্লা দিয়ে মরুর পথে ছুটছে উট
চরণ তার আজ বারণ-হারা, রুখতে নারে বলগা-মুঠ।
পৃষ্ঠে তাহার এ কোনজন,
চলতে শুধু চায় চরণ
‘হজজ্’ ‘রমল্’ ছন্দ-দোলে দুলিয়ে তনু সে দেয় ছুট।
উট নয় সে, ফিরদৌসের বোররাক – নয় নয় এ ঝুট!
চলতে পথে মনে ভাবে যতেক আরব বণিক দল –
ঊষর মরুর ধূসর রোদেও কেমনে তনু রয় শীতল!
মেঘ চাইতে পায় পানি,
এ কোন মায়ার আমদানি!
খুঁড়তে মরু ঠাণ্ডা পানি উথলে আসে অনর্গল।
উড়ছে সাথে সফেদ কপোত ঝাঁক বেঁধে ওই গগনতল।
বুঝতে নারে, ভাবে এসব খোদার খেলা, নাই মানে!
মরুর রবি নিষ্প্রভ কি হল এবার, কে জানে!
ছিটায় না সে আগুন-খই,
সে ‘লু’ হাওয়ায় ঘূর্ণি কই,
থাকত না তো এমন ডাঁসা আঙুর মরুর উদ্যানে।
জাদুকরের জাদু এসব – মরুর পথে সবখানে।
পৌঁছাল শেষ দূর বোসরায় তালিব, আরব সওদাগর
নগরবাসী আসল ছুটে, দেখবে জিনিস নতুনতর।
বণিকদলে ও কোনজন –
চক্ষে নিবিড় নীলাঞ্জন,
এই বয়সে কে এল ওই শূন্য করে কোন সে ঘর!
কার আঁচলের মানিক লুটায় মরুর ধুলায় পথের পর।
অপরূপ এক রূপের কিশোর এসেছে ‘শাম’, উঠল রোল,
মুখর যেমন হয় গো বিহগ আসলে রবি গগন-কোল।
পালিয়ে হুরিস্থান সুদূর
এসেছে এ কিশোর হুর,
নওরোজের আজ বসল মেলা, রূপের বাজার ডামাডোল!
আকাশ জুড়ে সজল মেঘের কাজল নিশান দেয় গো দোল।
রূপ দেখেছে অনেক তারা, এ রূপ যেন অলৌকিক,
এ রূপ-মায়া ঘনিয়ে আসে নয়ন ছেড়ে মনের দিক!
আসল পুরোহিতের দল,
দৃষ্টি তাদের অচঞ্চল
‘মোহন’ ধ্যানে দেখলে যারে, রূপ ধরে কি সেই মানিক
আসল মানব-ত্রাণের তরে কিশোর ছেলে এই বণিক?
কবুতরায় কূজনগীতি গাইছে কবুতরের ঝাঁক,
দুম্বা-শিশু মা ভুলে তার উহার মুখে চায় অ-বাক।
গগন-বিথার কাজল মেঘ,
ফুল-ফোটানো পবন-বেগ,
মনের বনে শহদ ঝরে আপনি ফেটে মধুর চাক,
মুঞ্জরিল পুষ্পে পাতায় মলিন লতা তরুর শাখ।
সেথায় ছিল ইশাই-পুরুত ‘বোহায়রা’ নাম, ধ্যান-মগন,
ইশাই-দেউল মাঝে বসে উথলে ওঠে নয়ন মন!
বসল ধ্যানে পুনর্বার,
আগমনি আজকে কার।
দেখলে ধ্যানে – সকল নবি ঈশা, মুসা, দাউদ, যন,
আসার খবর কইল যাহার আজ এসেছে সেই রতন!
দেখল – তারে বিলিয়ে ছায়া কাজল নীরদ ফিরছে সাথ,
লুটিয়ে পড়ে মূর্তিপূজার দেউল টুটে, ‘লাত মানাত’।
অগ্নি পূজার দেউল সব
যায় নিভে গো, করে স্তব,
তরুর ছায়া সরে আসে বাঁচাতে গো রোদের তাত।
জন্তু জড় কইছে ‘সালাত’, নতুন ‘দীনের’ ‘তেলেসমাত’।
সে এসেছে বণিক বেশে এই সিরিয়ার এই নগর,
ধ্যান ফেলে সে আসল ছুটে, যথায় আরব-সওদাগর।
উদ্দেশ যার পায় না মন
হাতের কাছে আজ সে জন,
‘বোহায়রা’ চায় পলক-হারা, লুটাতে চায় ধুলার পর।
গগন ফেলে ধরায় এল আজকে ধ্যানের চাঁদ অ-ধর।
কিশোর নবির দস্ত চুমি ‘বোহায়রা’ কয়, “এই তো সেই –
শেষের নবি – বিশ্ব নিখিল ঘুরছে যাঁহার উদ্দেশেই।
আল্লার এই শেষ ‘রসুল’,
পাপের ধরায় পুণ্যফুল,
দীন-দুনিয়ার সর্দার এই, ইহার আদি অন্ত নেই।
আল্লার এ রহমত রূপ, নিখিল খুঁজে পায় না যেই।”
বোহায়রা কয়, ‘আমার মাঠ রইল দাত্তত আজ সবার।’
মুগ্ধ-চিতে শুনল তালিব সকল কথা বোহায়রার।
হাসল শুনে কোরেশগণ,
বলল, ‘ফজুল ওর বচন!’
শুধায় তবু, ‘কেমন করে তুমিই পেলে খবর তার?’
বোহায়রা কয় হেসে, ‘যেমন দীপের নীচেই অন্ধকার।
দেখছি আমি ক-দিন থেকেই ধ্যানের চোখে অসম্ভব
অনেক কিছু – পাহাড় নদী কাহার যেন করে স্তব,
প্রতি তরু পাষাণ জড়
এই কিশোরের চরণ পর
পড়েছে ঝুঁকে অধোমুখে সিজদা করার লাগি সব।
সেদিন হতে শুনছি কেবল নতুনতর ‘সালাত’-রব।
‘দেখেছি এর পিঠের পরে নবুয়তের মোহর সিল,
চক্ষে ইহার পলক-বিহীন দৃষ্টি গভীর নিতল নীল।
নবি ছাড়া কারেও গড়
করে নাকো পাষাণ জড়!
‘নজ্জুম’ সব বলছে সবাই, আসবে সে জন এ মঞ্জিল
এই সে মাসে, আমার ধ্যানে তাদের গোনায় আছে মিল।
রুমীয়গণ দেখলে এরে হয়তো প্রাণে করবে বধ,
দিনের আলোয় আর এনো না, আবুতালিব, এ সম্পদ।
এই যে কিশোর সুলক্ষণ –
দেখলে ইহার শত্রুগণ –
ফেলবে চিনে, মারবে প্রাণে, খোদার কালাম করবে রদ!’
তালিব শুনে কাঁপল ভয়ে, হাসল শুনে মোহাম্মদ।
এমন সময় আসল সেথা সপ্ত রোমান অস্ত্র-কর,
বোহায়রা কয়, ‘কাহার খোঁজে এসেছ এই যাজক-ঘর?’
বলল তারা, ‘খুঁজছি তায়
শেষের নবির আসন চায়
যে জন – তারে, বেরিয়েছে সে এই মাসে এই পথের পর!’
বোহায়রা কয়, ‘বণিক এরা, ইহারা নয়, নবির চর!’
ফিরে গেল রোমান ইহুদ, বোহায়রা কয়, ‘আজ রাতে
পাঠিয়ে দাও এ কিশোর কুমার তোমার স্বদেশ মক্কাতে!’
কিশোর নবি সওদাগর
চলল ফিরে আবার ঘর,
বেলাল, আবুবকর চলে সঙ্গী হয়ে সেই সাথে।
জীবন-পথের চির-সাথি সাথি হল আজ প্রাতে।
১৩. সত্যাগ্রহী মোহাম্মদ
আঁধার ধরণি চকিতে দেখিল স্বপ্নে রবি,
মক্কায় পুন ফিরিয়া আসিল কিশোর নবি।
ছাগ মেষ লয়ে চলিল কিশোর আবার মাঠে,
দূর নিরালায় পাহাড়তলির একলা বাটে।
কী মনে পড়িত চলিতে চলিতে বিজন পুরে,
কে যেন তাহারে কেবলই ডাকিছে অনেক দূরে।
আশমানি তার তাম্বু টাঙানো মাথার পরে,
গ্রহ রবি শশী দুলিতেছে আলো স্তরে স্তরে।
ভুলে গিয়ে পথ, ভুলি আপনায়, বিশ্ব ভুলি
বসিত কিশোর আসন করিয়া পথের ধূলি।
থমকি দাঁড়াত গগনে সূর্য, ধেয়ান-রত,
কিশোরে হেরিতে নমিত পাহাড় শ্রদ্ধানত।
সাগরের শিশু মেঘেরা আসিত দানিতে ছায়া,
সহসা বাজিল রণ-দুন্দুভি আরবদেশে,
‘ফেজার’ যুদ্ধ আসিল ভীষণ করাল বেশে।
মরুর মাতাল মাতিল রৌদ্র-শারাব পিয়া,
যে গৃহযুদ্ধে আরব হইল মরু সাহারা,
আত্মবিনাশী সে রণে নামিল পুন তাহারা।
এ মহারণের জন্ম প্রথম ‘ওকাজ’ মেলায়,
মাতিত যেখানে সকল আরব পাপের খেলায়।
সকল প্রধান গোত্র মিলিত হেথায় আসি,
একে অন্যের পাত্রে ছিটাতে কাদার রাশি।
কবির লড়াই চলিত সেখানে কুৎসা গালির,
মদের অধিক ছুটিত বন্যা কাদা ও কালির।
এই গালাগালি লইয়া বাধিল যুদ্ধ প্রথম,
দেখিতে দেখিতে লাগিল ‘ফেজার’ দুপুরে মাতম।
নবির গোত্র ‘বনি হাশেমী’রা সে ভীম রণে
হইল লিপ্ত তাদের মিত্র-গোত্র সনে।
তরুণ নবিও চলিল সে রণে যোদ্ধৃসাজে,
যুদ্ধে যাইতে পরানে দারুণ বেদনা বাজে।
ভায়ে ভায়ে এই হানাহানি হেরি পরান কাঁদে,
নাহি কি গো কেহ – এদের সোনার রাখিতে বাঁধে?
সকল গোষ্ঠী সর্দারে ডাকি বোঝায় কত,
আপনার দেহ করিস তোরা রে আপনি ক্ষত!
মৃত্যু-মদের মাতাল না শোনে নবির বাণী,
পাঁচটি বছর চলিল ভীষণ সে হানাহানি।
সদা নিরন্ন আতুর দুঃখী দরিদ্রেরে
সেবিত যে তারে ফেলিলে গো খোদা এ কোন ফেরে!
যুদ্ধভূমিতে গিয়া নবি হায় যুদ্ধ ভুলি
আহত সেনারে সেবিত আদরে বক্ষে তুলি।
দেখিতে দেখিতে তরুণ নবির সাধনা সেবায়
শত্রু মিত্র সকলে গলিল অজানা মায়ায়।
সন্ধি হইল যুযুৎসু সব গোত্র দলে
মোহাম্মদের মানিল সালিশ মিলি সকলে।
বসিল সালিশ ‘ইবনে জদ্আন’ গৃহে মক্কায়,
মধ্যে মধ্যমণি আহমদ শোভা সে সভায়!
‘হাশেম’, ‘জোহরা’ গোত্রের যত সেরা সর্দার
শরিক হইল শুভক্ষণে সে সালিশি সভার।
মোহাম্মদের প্রভাবে সকলে হইল রাজি,
সত্যের নামে চলিবে না আর ফেরেববাজি!
আল্লার নামে শপথ করিল হাজির সবে
সন্ধির সব শর্ত এবার কায়েম রবে।
একটি পশম ভেজাবার মতো সমুদ্র জল
রবে যতদিন, ততদিন রবে শর্ত অটল!
ফেলি হাতিয়ার হাতে হাত রেখে মিলি ভাই ভাই
এই সে শর্তে হল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সবাই।
(১) আমরা আরবে অশান্তি দূর করার লাগি
সকল দুঃখ করিব বরণ বেদনাভাগী।
(২) বিদেশির মান সম্ভ্রম ধন প্রাণ যা কিছু
রক্ষিব, শির তাহাদের কভু হবে না নিচু।
৩) অকুন্ঠ চিত্তে দরিদ্র আর অসহায়েরে
রক্ষিব মোরা পড়িলে তাহারা বিপদ ফেরে।
(৪) করিব দমন অত্যাচারীর অত্যাচারে,
দুর্বল আর হবে না পীড়িত তাদের দ্বারে।
দুর্বল দেশ, দুর্বল আজ স্বদেশবাসী,
আমরা নাশিব এ-উৎপীড়ন সর্বনাশী!
দু-চারি বছর সন্ধির এই শর্ত মতো
আরবের মরু হল না কলহ-ঝটিকাহত।
রক্তের তৃষ্ণা ব্যাঘ্র কদিন ভুলিয়া রবে,
মাতিল আরব বারে বারে তাই ঘোর আহবে।
ভোলেনি আরবে শুধু একজন একথা কভু,
মোহাম্মদ সে সত্যাগ্রহী দীনের প্রভু!
বহুকাল পরে পেয়ে পয়গম্বরী নবুয়ত
এই প্রতিজ্ঞা ভোলেনি সত্যব্রতী হজরত।
ভীষণ ‘বদর’ সংগ্রামে হয়ে যুদ্ধ-জয়ী
বজ্র-ঘোষ কন্ঠে কহেন, ‘মিথ্যাময়ী
নহে নহে মোর প্রতিজ্ঞা-বাণী, শোনরে সবে,
যুদ্ধে-বন্দি শত্রুরা আজ মুক্ত হবে!
শত্রু-পক্ষ কেহ যদি আজ হাসিয়া বলে,
প্রতিজ্ঞা করি ভোলাও এমনই মিথ্যা ছলে!
কেহ নাহি দেয় – আমি দিব সাড়া তাহার ডাকে,
সত্যের তরে এই ‘ইসলাম’ কহিব তাকে!
অসহায় আর উৎপীড়িতের বন্ধু হয়ে
বাঁচাতে এসেছে ‘ইসলাম’ নিজে পীড়ন সয়ে!’
ন্যায়েরে বসাবে সিংহ-আসনে লক্ষ্য তাহার ;
মুসলিম সেই, এই ন্যায়-নীতি ধেয়ান যাহার!
এমনই করিয়া ভবিষ্যতের সহস্রদল
মেলিতে লাগিল পাপড়ি তাহার আলোর কমল।
অনাগত তার আলোক-আভাস গগনে লেগে
উঠিতে লাগিল নতুন দিনের সূর্য জেগে।
আকাশের পর-কোণা রেঙে ওঠে সেই পুলকে,
দ্যুলোকের রবি আলো দিতে আসে এই ভূলোকে।
স্তব করে আর কাঁদে ধরণির সন্তানগণ,
ব্যথা-বিমথন এসো এসো ওগো অনাথ-শরণ!
১৪. শাদি মোবারক
[গজল-গান]
মোদের নবি আল-আরবি সাজল নওশার নওল সাজে ; সে রূপ হেরি নীল নভেরই কোলে রবি লুকায় লাজে॥ আরাস্তা আজ জমিন আশমান হুরপরি সব গাহে গান, পূর্ণ চাঁদের চাঁদোয়া দোলে, কাবাতে নৌবত বাজে॥ কয় ‘শাদি মোবারক বাদি’ আউলিয়া আর আম্বিয়ার, ফেরেশতা সব সওদা খুশির বিলায় নিখিল ভুবন মাঝে॥ গ্রহ তারা গতিহারা চায় গগনের ঝরোকায়, খোদার আরশ দেখছে ঝুঁকে বিশ্ব-বধূর হৃদয়-রাজে॥ আয়রে শাপী দুঃখী তাপী আয় হবি কে বরাতী, শাফায়তের শিরীন শিরনি পাবি না আর পাবি না যে॥
বিপুল বিত্ত-শালিনী ‘খদিজা’ ছিল আরবের চিত্ত-রানি,
রূপ আর গুণে পূজিত তাহায় মুগ্ধ আরব অরর্ঘ্য দানি।
স্তুতি গাহি তার যশ মহিমার হার মেনে যেত কবির ভাষা,
শুভ ভাগ্যের সায়র-সলিলে সে ছিল সোনার কমল ভাসা!
শুদ্ধাচারিণী সতী সাধ্বী সে ছিল আজন্ম, তাই সকলে
শ্রদ্ধা ভক্তি প্রীতি-ভরা নামে ডাকিত তাহারে ‘তাহেরা’ বলে।
হজরতের আর খদিজার ছিল একই গোষ্ঠী বংশ-শাখা,
আরব-পূজ্য যশোমণ্ডিত ত্যাগ-সুন্দর গরিমা-মাখা।
বীর ‘আবুহানা’ বিবি খদিজার আছিল প্রথম জীবন-সাথি,
মৃত্যু আসিয়া হরিল তাহারে, খদিজার প্রাণে নামিল রাতি।
বিধবার বেশে রহি কতকাল বরিল খদিজা ‘আতীক’ বীরে,
জীবনের পারে সে-ও গেল চলি, আসিল শোকের তিমির ঘিরে।
সে শোকের স্মৃতি শিশুদের বুকে চাপি ভুলে রয় বুকের ব্যথা,
দ্বি-বিংশতি গো বৎসর গেল কাটি জীবনের, কেমন কোথা।
এমন সময় এল আহমদ তরুণ অরুণ ভাগ্যাকাশে,
পাণ্ডুর নভ ভরিল আবার আলো-ঝলমল ফুল্ল হাসে।
পঁচিশ বছরি যুবক তখন নবি আহমদ রূপের খনি,
সারা আরবের হৃদয়-দুলাল কোরেশ-কুলের নয়ন-মণি।
‘সাদিক’ – সত্যবাদী বলে তারা ডাকিত নবিরে ভক্তিভরে,
যুবক নবিরে ‘আমিন’ বলিয়া ডাকিত এখন আদর করে।
বিশ্বাস আর সাধুতায় তাঁর মক্কাবাসীরা গেল গো ভুলি
মোহাম্মদের আর সব নাম ; কায়েম হইল ‘আমিন’ বুলি।
‘আমিন’ ‘তাহেরা’ সাধু ও সাধ্বী, ইঙ্গিতে ওগো খোদারই যেন
আরববাসীরা না জানিয়া এই নাম দিয়েছিল তাদেরে হেন!
মহান খোদারই ইঙ্গিতে যেন ‘সাধু’ ও সাধ্বী’ মিলিল আসি,
শক্তি আসিয়া সিদ্ধির রূপে সাধনার হাত ধরিল হাসি।
গিরি-ঝরনার স্রোতোবেগে আসি যোগ দিল যেন নহর-পানি,
ঊষর মরুর ধূসর বক্ষে বান ডেকে গেল উদার বাণী!
মরুর আকাশে ঘনাল যে ছায়া, বক্ষ ছাইল যে শীতলতা,
সুজলা সুফলা ধরা যুগে যুগে হেরেছে স্বপ্নে ইহারই কথা।
১৫. খদিজা
সদাগর-জাদি বিবি খদিজার সোনার তরি
ফেরে দেশে দেশে মণি-মাণিক্য বোঝাই করি।
সচ্ছলতার বান ডেকে যায় বাহিরে ঘরে,
তবু কেন সব শুনো-শুনো লাগে কাহার তরে।
কী যে অভাব রিক্ততা কোন চিত্ততলে
মরু-ভিখারিনি কী যেন ভিক্ষা মাগিয়া চলে!
‘সাদিক’ সত্যব্রতী আহমদ জানিত সবে
‘আমিন’ শুদ্ধাচারী সাধু যে গো হইল কবে।
‘তাহেরা’ শুদ্ধাচারিণী সাধ্বী আরব দেশে
সে-ই ছিল, এল প্রতিদ্বন্দ্বী অরুণ বেশে।
কেমন প্রতিদ্বন্দ্বী অরুন সাধু সে তারে
দেখিবে বলিয়া দ্বার খুলি রয় হৃদয়-দ্বারে।
হেথা ঘর ছাড়ি গিরি-শিরে ফেরে অরুণ যুবা,
সহসা তাহারে নাম ধরে ডাকে কে দিল্রুবা?
খোঁজে গিরি-গুহা মরু-প্রান্তর যে আলো-শিখা,
পাবে না কি তার দিশা, এই ছিল ললাটে লিখা?
জন্ম-ধেয়ানী বসি একদিন ধেয়ান মধুর
অসীম আলোক-পারাবারে ফেরে স্বপ্ন আতুর –
আহ্বানে কার ভাঙিল ধেয়ান, স্বপ্ন টুটে,
চিত্ত-কাননে আলোর মুকুল মুদিল ফুটে।
নিশিদিন শোনে যে দিলরুবার মঞ্জু-গীতি
অন্তর-তলে, আজ কি গো এল সেই অতিথি?
মেলিতে নয়ন টুটিল স্বপন! নহে সে নহে,
তাহেরা খদিজা পাঠায়েছে তার বার্তাবহে!
কুর্নিশ করি কহিল বান্দা, ‘মোদের রানি
দরশ-পিয়াসি তোমার, এনেছি তাহারই বাণী।
বিবি খদিজার প্রাসাদে তোমার চরণ-ধূলি
পড়িবে কখন, সেই আশে আছে দুয়ার খুলি।
বিশাল হেজাজ আরব যাহার প্রসাদ যাচে,
যাচিতে প্রসাদ সে পাঠাল দূত তোমার কাছে!’
অন্তর-লোক-বিহারী তরুণ বুঝিতে নারে,
তবু আনমনে এল দূত সাথে খদিজা-দ্বারে।
সম্ভ্রম-নতা কহিল খদিজা সালাম করি,
‘হে পিতৃব্য-পুত্র! কত সে দিবস ধরি
তোমার সত্যনিষ্ঠা, তোমার মহিমা বিপুল,
তব চরিত্র কলঙ্কহীন শশী সমতুল,
তোমার শুদ্ধ আচার, চিত্ত মহানুভব –
হেরিয়া তোমারে অর্ঘ্য দিয়াছি নিত্য নব!
এই হেজাজের সকলের সাথে গোপনে আমি,
আমিন, তোমারে শ্রদ্ধা দিয়াছি দিবস-যামী!
বিপুল আমার বিত্ত বিপুল যশ গৌরব,
নিষ্প্রভ আজি করেছে তাহারে তোমার বিভব।
বিশ্বাসী কেহ নাই পাশে, তাই বিত্ত মম
হইয়াছে ভার, দংশন করে কাঁটার সম
মম বাণিজ্য-সম্ভার, মোর বিভব যত –
তুমি লও ভার, আমিন, ইহার ! চিত্তগত
সন্দেহ মোর দূর হোক! আমি শান্তমুখ
ভুলে রব মোর গত জীবনের সকল দুখ!
তোমার পরশে তব গুণে মম বিভব-রাজি
সোনা হয়ে যাবে, সহস্র-দলে ফুটিবে আজি!
তুমি ছাড়া এই সম্পদ মোর হেজাজ দেশে
রবে না দু-দিন, স্রোতে অসহায় যাইবে ভেসে!
আরবে তুমিই বিশ্বাসী একা, কাহারে আর
নাহি দিতে পারি নিশ্চিন্তে এ বিপুল ভার!’
তরুণ উদাসী বসিয়া বসিয়া ভাবে কী যেন –
‘ওগো খোদা, কেন কর পরীক্ষা আমারে হেন!
আমার চিত্তে সকল বিত্ত তুমি যে প্রভু,
তুমি ছাড়া মোর কোনো সে বাসনা নাহি তো কভু!’
মরীচিকা-মাঝে ভ্রান্ত-পথ সে মৃগের মতো
ভীরু চোখ দুটি তুলি কহে যুবা শ্রদ্ধানত, –
‘পিতৃতুল্য পিতৃব্য এ মাথার পরে
রয়েছেন আজও, তাঁরে জিজ্ঞাসি তোমার ঘরে
আসিব আবার, কহিব তখন যা হয় আসি!’
লইল বিদায় ; খদিজা হাসিল মলিন হাসি!
তরুণ তাপস চলিয়া গেল গো যে পথ বাহি
সকল ভুলিয়া খদিজা রহে গো সে পথ চাহি।
বেলা-শেষে কেন অস্ত-আকাশ বধূর প্রায়
বিবাহের রঙে রাঙা হয়ে ওঠে, কোন মায়ায়!
‘জুলেখার’ মতো অনুরাগ জাগে হৃদয়ে কেন,
মনে মনে ভাবে, এই সে তরুণ ‘য়ুসোফ’ যেন!
দেখেনি য়ুসোফে, তবু মনে হয় ইহার চেয়ে
সুন্দরতর ছিল না সে কভু। বেহেশ্ত বেয়ে
সুন্দরতম ফেরেশতা আজ এসেছে নামি
এল জীবনের গোধূলি-লগনে জীবন-স্বামী!
ফোটেনি যে আজও সে মুকুলি মনে শতেক আশা,
শোনে কি গো কেহ ঝরার আগের ফুলের ভাষা!
চিরযৌবনা বাসনার কভু মৃত্যু নাহি,
মনের রাজ্যে অক্ষয় তার শাহানশাহি।
উদয়-বেলায় মন ছিল তার জলদে ঢাকা,
হেরেনি প্রেমের রবির কিরণ সোনায় মাখা।
আসিল জীবন-মধ্যাহ্নে যে – সে নহে রবি,
দিন চলি গেছে – হেরিল না দিনমণির ছবি।
বেলা বয়ে যায় – সেই অবেলায় মেঘ-আবরণ!
বিদারিয়া এল সোনার রবি কি ভুবন-মোহন!
আছে আছে বেলা, বেলা-শেষের সে অনেক দেরি,
পুরবিতে নয় – শ্রী রাগে এখনও বাজিছে ভেরি!
ওরে আছে বেলা, ভাঙেনিকো মেলা, ইহারই মাঝে!
প্রাণের সওদা করে নে, বরে নে হৃদয়-রাজে!
ফেরেনি রে নীড়ে এখনও বিদায়-বেলায় পাখি,
নাহিকো’ কাজল, আজও আছে জলভরা এ আঁখি।
শুকায়েছে ফুল, শুকায়েছে মালা, – নয়ন-জলে
রাজাধিরাজের হবে অভিষেক হৃদয়তলে।
হোক হোক অপরাহ্ন এ বেলা হৃদ-গগনে
এই তো প্রথম উদিল সূর্য শুভ-লগনে।
হোক অবেলায় – তবু এ প্রেমের প্রথম প্রভাত,
পহিল প্রেমের উদয়-উষার রাঙা সওগাত।
নূতন বসনে নূতন ভূষণে সাজিয়া তারে,
নব-আনন্দে বরিয়া লইবে হৃদয়-দ্বারে।
আবু তালিবের কাছে আসি কহে তরুণ নবি
তাহেরা খদিজা কয়েছিল যাহা যাহা – সে সবই।
বৃদ্ধ তালিব শুনিয়া পরম ভাগ্য মানি
খোদারে স্মরিয়া ভেজিল শোকর জুড়িয়া পানি।
সুবৃহৎ ছিল পরিবার তাঁর পোষ্য বহু,
চিন্তায় তারই পানি হয়ে যেত দেহের লোহু।
দুর্ভিক্ষের হাহাকার ওঠে আবার জুড়ি,
যাহা কিছু ছিল সঞ্চিত যার গেল গো উড়ি।
হেন দুর্দিনে আসিল যেন গো গায়েবি ধ্বনি,
না চাহিতে এল শুভ ভাগ্যের আমন্ত্রণী।
সৌভাগ্যের এ দাওত কেহ ফিরায় কি গো,
আপনি আসিয়া ধরা দিল আজ সোনার মৃগ।
আনমনে চলে তরুণ ‘আমিন’ সেই সে পথে,
যে-পথে দৃষ্টি পাতিয়া খদিজা কখন হতে
বসি আছে একা ; জাফরির ফাঁকে নয়ন-পাখি
উড়ে যেতে চায়, – কারে যেন হায় আনিবে ডাকি।
ধন্য যে আজ হেজাজের মাঝে ভাগ্যবতী –
ওই আসে ওই তরুণ অরুণ মৃদুল-গতি।
‘মোতাকারিব’ আর ‘হজজ্’ ‘রমল্’ ছন্দ যত
লুটাইয়া পড়ে যেন গো তাহার চরণাহত।
বাতায়নে বসি খদিজার বুকে বেদনা বাজে,
না জানি কত না কন্টক ও-পথ মাঝে!
কঙ্করময় অকরুণ পথে চলিতে পায়ে
কত যেন লাগে, সে বাঁচে হৃদয় দিলে বিছায়ে!
আসিল তরুণ, কহিল সকল স্বপন সম,
দৃষ্টি নাহি কো কোথা ফোটে ফল গোপনতম
কোন সে কাননে আলোকে তাহারই! আপন মনে
খোঁজে সে কাহারে আকুল আঁধারে অজানা জনে।
খদিজা তার বাণিজ্য-ভার ‘আমিনে’ দিয়া
কহিল,‘সকলই দিলাম তোমারে সমর্পিয়া।’
নীরবে লইল সে ভার ‘আমিন’ স্বপ্নচারী, –
পুলকে খদিজা রুধিতে পারে না নয়ন-বারি।
লীলা-রসিক সে খোদার খেলা গো বুঝিতে পারে না এ চরাচর,
হাবিব খোদার সাজিল আবার তাঁরই ইঙ্গিতে সওদাগর!
‘কাফেলা’ লইয়া চলে আবার
‘শাম’ ‘এয়্মন্’ মরুভূমি-পার,
‘হোবাশা’ ‘জোরশ’ কত পরদেশে ঘুরিল তরুণ বণিকবর,
সব পুণ্যের ভাণ্ডারী ফেরে পণ্য লইয়া দর বদর!
রোজ কিয়ামতে পাপ-সিন্ধুর নাইয়া হবে যে নবি রসুল,
হল বাণিজ্য-কাণ্ডারি সে গো, লীলা-বাতুলের মধুর ভুল!
বিদেশে ঘুরিয়া ফেরে স্বদেশ
পুন যায় দূর দেশের শেষ,
সোনার ছোঁয়ায় পণ্য-তরুর শাখে শাখে ফোটে মণির ফুল।
উপকূলে খোঁজে রতন – যাহারে খুঁজিছে রত্নাকর অকূল।
অনুরাগ-রাঙা খদিজার হিয়া ধৈরজ যেন মানে না আর,
ভার হয়ে ওঠে, তরুণ বণিক বয়ে আনে যত রতন-ভার।
প্রতিভা জ্ঞানের নাহি সীমা –
একী চরিত্র-মাধুরিমা,
একী এ উদয়-অরুণিমা আজি ঝলকি ওঠে গো দিগ্বিথার!
পল্লবে ফুলে উঠিল গো দুলে শুষ্ক মাধবী-লতা আবার
কী হবে এ ছার মণিসম্ভার বিপুল করিয়া নিরবধি,
পরানে তৃষ্ণা অমৃতের ক্ষুধা মিটিল না এ জীবনে যদি।
উদাসীন যুবা ফিরে না চায়,
কোন বিরহিণী খোঁজে গো তায়,
সিন্ধুর তাতে কী বা আসে যায় যদি তারে নাহি চায় নদী,
আপনাতে সে যে পূর্ণ আপনি – বিরাট বিপুল মহোদধি।
মনের দেশের ও যেন নহে গো, বনের দেশের চির-তাপস,
মন নিয়ে খেলা ও যেন বোঝে না, ও চাহে না সম্মান ও যশ।
নয়নে তাহার অতল ধ্যান
রহস্য-মাখা বিধু বয়ান,
ধরার অতীত ও যেন গো কেহ, ধরা নারে ওরে করিতে বশ।
ও যেন আলোর মুক্তির দূত, সৃজন-দিনের আদি-হরষ।
যত মনে হয় ধরার নহে ও, মায়াপুরীর ও রূপকুমার,
তত খদিজার মন কেন ধায় উহারই পানে গো দুর্নিবার।
যে কেহ হোক সে, নাহিকো ভয়,
খদিজা তাহারে করিবে জয়,
নহে তপস্যা একা পুরুষের – নব-তপস্যা প্রেমের তার।
হয় তারে জয় করিবে, নতুবা লভিবে অমৃত মরণ-পার।
ছিল খদিজার আত্মার আত্মীয় সহচরী ‘নাফিসা’ নাম,
কহিল তাহারে অন্তর-ব্যথা, হরেছে কে তার সুখ আরাম!
অনুরাগ-ভরে বেপথু মন
হুহু করে কেন সকল খন,
‘সখী লো, জহর পিইয়া মরিব, না পুরিলে মোর মনস্কাম।
সে বিনে আমার এই দুনিয়ার সব আনন্দ সুখ হারাম।
কে রেখেছে সখী শহদ্-শিরীন হেন মধুনাম – মোহাম্মদ!
হেজাজের নয় – ও শুধু আমার চির-জনমের প্রেমাস্পদ!
সব ব্যবধান যায় ঘুচে
বয়সের লেখা যায় মুছে,
যত দেখি তত মনে হয় সখী, আমি উপনদী সে যেন নদ,
বন্দি করিতে তাহারে, নিয়ে যা শাদি-মোবারক-বাদি-সনদ।
দুতি হয়ে চলে নাফিসা একেলা প্রবোধ দানিয়া খদিজারে,
বলে, হেজাজের রানি যারে চায় বুলন্দ-নসিব বলি তারে।
প্রসাদ যাহার যাচে আরব,
করে গুণগান – রচে স্তব,
যাচিয়া সে যাহারে চাহে বরি নিতে, হানিতে সে হেলা কভু পারে?
বিরাট সাগরে পায় কি ঝরনা? মহানদী মেশে পারাবারে!
যৌবন? সে তো ক্ষণিক স্বপন, ছুঁইতে স্বপন টুটিয়া যায়,
প্রেম সেথা চির মেঘ-আবৃত, তনু সেথা ভোলে তনু-মায়ায়।
নাহি শতদল শুধু মৃণাল –
কামনা-সায়র টাল-মাটাল,
সেথা উদ্দাম মত্ত বাসনা ফুলবনে ফেরে করীর প্রায়,
সুন্দর চাহে ফুলের সুরভি, অরসিকে শুধু সুষমা চায়।
যুবা আহমদ মগ্ন ধেয়ানে, নাফিসা আসিয়া ভাঙিল ধ্যান,
কহিল, ‘আমিন! আজিও কুমার-জীবন যাপিছ হয়ে পাষাণ,
কোন দুখে বলো, তাপস-প্রায়
কোনো কিছু যেন চাহ না, হায়!
হেজাজ-গগনে তুমি যে হেলাল, তুমি কেন থাক চিন্তাম্লান?
রুচির শুভ্র হাসি হেসে বলে তরুণ ধেয়ানী মহিমময়,
‘বিবাহের মোর সম্বল নাই, বিবাহ আমার লক্ষ্য নয়!’
কহিল নাফিসা, ‘হে সুন্দর!
যাচে যদি কেহ তোমারে বর,
গুণে গৌরবে তুলনা যাহার নাই, গাহে যার হেজাজ জয়,
সেই মহীয়সী নারী যদি যাচে, তুমি হবে তার? দাও অভয়!’
ধ্যানের মানস-নেত্রে হেরিল তরুণ ধেয়ানী ভবিষ্যৎ –
কল্যাণী এক নারী দীপ জ্বালি গহন তিমিরে দেখায় পথ।
চারিধারে অরি – বন্ধুহীন
যুঝিছে একাকী যেন আমিন,
সে নারী আসিয়া বর্ম হইয়া দাঁড়াল সুমুখে, ধরিল রথ!
সাধনা-ঊর্ধ্বে সে এল সহসা শক্তিরূপিণী – সিদ্ধিবৎ!
এমনই চোখের চেনাচেনি নিতি, মানস-চক্ষে দেখেনি তায়,
দেখেনি তাহার অন্তরে কবে ফুটিয়াছে প্রেম শত বিভায়।
প্রেম-লোক সে যে জ্যোতির্মতী
চির-যৌবনা চির-সতী!
তবু নাফিসারে কহিল আমিন, ‘কোন ললনা সে, বাস কোথায়?’
নাফিসা হাসিয়া কহিল, ‘খদিজা, হেজাজ লুটায় যাহার পায়!’
হজরত কন, ‘বামন হইয়া কেমনে বাড়াব চন্দ্রে হাত!’
নাফিসা কহিল ‘অসম্ভব যা, সে আসে এমনই অকস্মাৎ!’
খদিজা শুনিল খোশখবর,
পরানে খুশির বহে নহর।
আবুতালিবের কাছে এল নিয়ে খদিজার দূত সে সওগাত!
চাঁদ যেন হাতে পাইল শুনিয়া আখেরে নবির খুল্লতাত।
তালিবের মনে খুশির বন্যা টইটম্বুর সর্বদাই,
আরবের রানি তাহিরা খদিজা বধূমাতা হবে, আর কী চাই।
‘আমার ইবনে আসাদ’ বীর
খদিজার পিতৃব্য ধীর
শুভ বিবাহের পয়গাম তারে পাঠাল – দেশের রেওয়াজ তাই।
দিন ও তারিখ হল সব ঠিক, গলাগলি করে দুই বেয়াই।
খদিজার ঘরে জ্বলিল দীপালি, নহবতে বাজে সুর মধুর,
খদিজার মন সদা উচাটন বেপথু সলাজ প্রেম-বিধুর!
প্রণয়-সূর্য হল প্রকাশ,
ঝলমল করে হৃদি-আকাশ,
তরুণ ধ্যানীর ধ্যান ভেঙে যায়, ব্যথা-টনটন চিত্তপুর,
মরু-উদ্যান এল কোথা হতে বন্ধুর পথে যেতে সুদূর!
তরুণ নবির রবির আলোক চুরি করে এল এ কোন চাঁদ,
স্বর্গের দূত ধরিতে কি সে গো পেতেছে ধরায় নয়ন-ফাঁদ!
মানবীর প্রেম এই যদি
টলমল করে মন-নদী,
না জানি কেমন প্রেম তার করে সৃজন যে-জন নিরবধি!
নদী হেরি মন এমন, না জানি কী হয় হেরিলে সে জলধি!
১৬. সম্প্রদান
সম্প্রদান
বাজিল বেহেশতে বীণ আসিল সে শুভদিন
মুক্তি-নাট-নটবর সাজে বর-বেশে
সুন্দর সুন্দরতর হল আজ ধরা পর
সন্ধ্যারানি বধূবেশে নামিল গো হেসে।
হায় কে দেখেছে কবে দুই চাঁদ এক নভে,
সেহেলি সখীরা সবে মূক বাণীহারা,
কাহারে ছাড়িয়া কারে দেখিবে, বুঝিতে নারে,
স্তব্ধ অচপল-গতি তাই আঁখিতারা।
শাদির মহফিল মাঝে বসিয়া নওশার সাজে
নবিবর, আত্মীয় কুটুম্ব ঘিরি তারে,
চারিদিকে তারাদল, মাঝে চাঁদ ঝলমল,
হুরপরি লুকায় তা হেরি দিকপারে।
তালিব উঠিয়া কহে ‘লগ্ন যায় আর নহে,
বন্ধুগণ শুভকার্য হোক সমাপন!’
আনন্দের সে সভায় সকলে দানিল সায়
মজলিশে বসিল আসি কন্যাপক্ষগণ।
হেজাজি আচারমতো রেসম রেওয়াজ যত
হলে শেষ – খদিজার পিতৃব্য আসাদ
আহমদের কর ধরি দিল সমর্পণ করি
কন্যারে – সভায় ওঠে মোবারকবাদ!
কহিল আসাদ বীর করে মুছি অশ্রু-নীর,
‘হে সাদিক, হে আমিন, হেজাজের মণি,
পিতৃহীনা খদিজায় দিলাম তোমার পায়,
তোমারে জামাতা পেয়ে ভাগ্য বলে গণি।
হে নয়ন-অভিরাম! সার্থক তোমার নাম
রয় যেন চিরদিন পবিত্র হেজাজে,
চির-প্রেমাস্পদ হয়ে এ বধূ-রতনে লয়ে
আদর্শ দম্পতি হও আরবের মাঝে।’
‘তাই হোক, তাই হোক’ কহিল সভার লোক;
বর-বেশ-নবি সবে করিল সালাম।
নহবতে বাঁশি বাজে, হেথায় অন্দর মাঝে
নৃত্যগীত-স্রোত বয়ে চলে অবিরাম।
হুরিপরি নাচে গায় বেহেশ্তের জলসায়
আরশ আরাস্তা হল! – খোদার হবিব
হবিবায় পেল আজি, ভেরি তূরী ওঠে বাজি,
খুশির খবর বিশ্বে শোনায় নকিব।
বয়সের বন্ধনে কে বাঁধিবে যৌবনে,
য়ুসোফ বুঝিয়াছিল দেখে জুলেখায়,
চল্লিশ বছর তার বয়স হইল পার
তবু তারে দেখে জোহরা আকাশে পলায়।
সে কাহিনি নব-রূপে রূপ ধরি এল চুপে,
গোধূলি-বেলার রূপ দেখিবি কে আয়,
উদয়-উষাও আজ পলায় পাইয়া লাজ,
উঠিয়া ঈদের চাঁদ আবার লুকায়।
চল্লিশ বসন্ত দিন আছে এ মালায় লীন,
শুকায়নি আজও বঁধু পরেনিকো বলে,
প্রেমের শিশিরজলে ভিজায়ে অন্তরতলে
রেখেছিল জিয়াইয়ে – দিল আজি গলে।
উদয়-গোধূলি সাথে বিদায়-গোধূলি মাতে
হাতে হাত জড়াইয়া দাঁড়াইল নভে,
রবি শশী মনোদুখে ধরা দিল রাহুমুখে,
এত রূপ অপরূপ কে দেখেছে কবে।
১৭. নও কাবা
হিয়ায় মিলিল হিয়া,
নদীস্রোত হল খরতর আরও পেয়ে উপনদী-প্রিয়া।
স্রোতোবেগে আর রুধিতে পারে না, ছুটে অসীমের পানে,
ভরে দুই কূল অসীম-পিয়াসি কুলু কুলু কুলু গানে।
কোথা সে সাগর কত দূর পথ, কোন দিকে হবে যেতে,
জানে না কিছুই, তবু ছুটে যায় অজানার দিশা পেতে।
কত মরু-পথ গিরি-পর্বত মাঝে কত দরি বন,
বাধা নিষেধের সব ব্যবধান লঙ্ঘিয়া অনুখন
তবু ছুটে চলে, শুনিয়াছে সে যে দূর সিন্ধুর ডাক,
রক্তে তাহারই প্রতিধ্বনি সে আজও শোনে নির্বাক।
সকল ভাবনা হয়ে গেছে দূর, অনন্ত অবকাশ
ধ্যানের অমৃতে উঠিছে ভরিয়া। দিবস বরষ মাস
কোথা দিয়া যায়, উদ্দেশ নাই! শুধু অনন্ত-পুর
শুনিতেছে দূর আহ্বান-বাণী অনাগত বন্ধুর।
পথে যেতে যেতে চমকিয়া চায়, কে যেন পথের পাশে
ডাকনাম ধরে ডেকে গেল তারে, হাতছানি দিয়া হাসে।
তারই সন্ধানে ঊষর মরুর ধূসর বুকে সে ফেরে,
সে বুঝি লুকায়ে গিরি-গহ্বরে ওই দূর একটেরে!
কোথাও না পেয়ে তরুণ ধেয়ানী হারায় ধেয়ান-লোকে,
এ কী এ বেদনা-আর্ত মুরতি ফোটে গো সহসা চোখে।
যে দোস্ত লাগি ফেরে সে বিবাগি, খোঁজে সে যে সুন্দরে,
সে কোথাও নাই, বিরাট বেদনা দাঁড়ায়ে বিশ্ব পরে।
অনন্ত দুখ-শোক-তাপ ব্যথা, অসীম অশ্রুজল –
অকূল সে জলে একাকী সে দোলে বেদনা-নীলোৎপল।
বিপুল দুখের অক্ষয় বট দাঁড়ায়ে বিশ্ব ছেয়ে,
বেদনা ব্যথার কোটি কোটি ঝুরি নেমেছে অঙ্গ বেয়ে।
শুধু ক্রন্দন, ক্রন্দন শুধু একটানা অবিরাম
রণিয়া উঠিছে ব্যাপিয়া বিশ্ব, নিখিল বেদনাধাম।
পড়ে যায় মাঝে কালো যবনিকা, সহসা আঁখির আগে
অসুন্দরের কুৎসিত লীলা ব্যভিচার শত জাগে।
উদ্যত-ফণা কুটিল হিংসা দ্বেষ হানাহানি শত
শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষেরে দংশি মারিতেছে অবিরত।
পাপে অসূয়ায় পঙ্কিল ফাঁকে ডুবে আছে চরাচর,
দিশারি তাদের শয়তান, তার অনুচর নারী নর।
দেখিতে পারে না এ-দৃশ্য আর, নিমিষে টুটে সে ধ্যান,
দুঃখ-পাপের লোকালয়ে পানে ছুটে আসে ব্যথা-ম্লান।
হেরে প্রান্তরে কুটিরের দ্বারে কাঁদে অনাথিনি একা,
কাল তার স্বামী গিয়াছে চলিয়া, জীবনে হবে না দেখা!
অদূরে পুত্র-শোকাতুরা মাতা পুত্রের নাম ধরি
ডাকে আর কাঁদে – বঞ্চিত স্নেহ আঁখিজল পড়ে ঝরি।
পথে যেতে যেতে খঞ্জ অন্ধ ভিখারিরা অসহায়
ক্ষুধার তাড়নে পড়ে মুমূর্ষু, ভরে মন করুণায়।
পিতৃমাতৃহীন শিশুদল চায় পথিকের পানে,
তাহারা তাদের পিতা ও মাতার সন্ধান বুঝি জানে।
তরুণ তাপস চলিতে পারে না, বেদনার উচ্ছ্বাস
ফুলে ফুলে ওঠে অন্তর-কূলে, বন্ধ হয় বা শ্বাস!
ঊর্ধ্বে আলোর অনন্ত-লীলা, নিম্নে ধরণি পরে
এমন করিয়া দুঃখ-গ্লানির কেন গো বরষা ঝরে।
ক্লান্ত চরণে চলিতে চলিতে হেরে পথে ধনী যুবা
নগ্ন মাতাল টলে আর চলে, পাশে তার দিলরুবা
দিলরুবা নয় – প্রতিবেশিনী ও কুমারী চেনা সে মেয়ে,
অর্থের বিনিময়ে ও মাতাল এনেছে তাহারে চেয়ে!
সহসা হেরিল –বর্বর এক পিতা তার ক্রোড়ে লয়ে
চলিছে সদ্যোজাত কন্যারে বধিতে সমাজ-ভয়ে!
কন্যা হওয়া যে ‘লাত মানাতের’ অভিশাপ, তাই তারে
বধিতে চলেছে – অভাগি জননী কাঁদিছে পথের ধারে।
হেরিল অদূরে ভীম হানাহানি পশুতে পশুতে রণ
নারী লয়ে এক – বিজয়ীরে বীর বলিছে সর্বজন!
চলিতে চলিতে হেরে দূরে এক বাজার বসেছে ভারী,
ছাগ উট সাথে বিক্রয় লাগি বসে অপরূপা নারী।
মালিক তাহার হাঁকিতেছে দাম, বলির পশুর সম
শত বন্ধন-জর্জর নারী কাঁপে মূক অক্ষম।
তাহারই পার্শ্বে পশু-ধনী এক তাহার গোলামে ধরি
হানিছে চাবুক –কুক্কুরে বুঝি মারে না তেমন করি!
সহসা শুনিল অনাহত বাণী ঊর্ধ্বে গগন-পারে –
‘হে ত্রাণ-কর্তা, জাগো জাগো, দূর করো এই বেদনারে!’
চমকিয়া ওঠে নবির চিত্ত, শিহরন জাগে প্রাণে,
মনে লাগে যেন ইহাদের সে-ই মুক্তির দিশা জানে।
স্বপ্ন-আতুর যুবক ধেয়ানী আনমনে পথ চলে,
চলিতে চলিতে কখন সন্ধ্যা ঘনায় আকাশতলে।
ধরার ঊর্ধ্বে অসীম গগন, কোটি কোটি গ্রহ-তারা
সে গগন ভরি ঢালে আনন্দে নিশিদিন জ্যোতিধারা।
তাহাদের মাঝে নাহি তো বিরোধ, প্রেমের আকর্ষণে
ভালোবেসে নিজ নিজ পথে চলে, মাতে না প্রলয়-রণে।
এই আলো – এই আনন্দ – এই সহজ সরল পথ
এই প্রেম, এই কল্যাণ তাজি – রচে এরা পর্বত
শত ব্যবধান–নদীপ্রান্তর ঘরে ঘরে মনে মনে,
অকল্যাণের ভূত শয়তান পূজা করে জনে জনে!
তপঃপ্রভাবে সাধনার জোরে অসুন্দর এ ধরা
করিতে হইবে সুন্দরতম, রবে না এ শোক জরা।
রবে না হেথায় পাপের এ ক্লেদ, এ গ্লানি মুছিতে হবে,
পতিতা পৃথ্বী পাবে ঠাঁই পুন আলোর মহোৎসবে।
আঁধার ইহার কক্ষে আবার জ্বলিবে শুভ্র আলো,
হে মানব, জাগো ! মেঘময় পথে বজ্র-মশাল জ্বালো।
আছে পথ, আছে দুঃখের শেষ, আমি শুনেছি সে বাণী,
বিশ্ব-সুষমা-সভায় এ-ধরা হাসিবে অতীত-গ্লানি!
দেখেছি বেদনা-সুন্দরে আমি তোমাদের ম্লান মুখে,
ঘুচিবে-বিষাদ – আসিবে শান্তি প্রেম-প্রশান্ত বুকে।
হেথায় খদিজা একা –
কাঁদে বিরহিণী, উদাসীন তার স্বামীর নাহিকো দেখা!
পলাতকা ওরে বাঁধিবে কেমনে, কোথায় তেমন ফাঁসি,
কার কথা ভাবি চমকিয়া ওঠে হেরে ভালোবাসাবাসি!
বক্ষে তাহারে পুরিয়া রাখিলে নিশাসে উড়িয়া যায়,
নয়নে রাখিলে আঁখি-বারি হয়ে গলে পড়ে সে যে, হায়!
বাহুতে বাঁধিলে ঘুম-ঘোরে সে যে ছিঁড়ে বন্ধন-ডোর,
বক্ষের মণি-হার করে রাখে, চুরি করে নেয় চোর!
কেন এ বিবাগি, কার অনুরাগী সকল সুখেরে দলে
রৌদ্র-তপ্ত কঙ্করভরা মরুপথে যায় চলে।
আপনার মনে সে কাহার সনে নিশিদিন কথা কয়,
বসিলে ধেয়ানে চাহিতে পারে না, রবি সে জ্যোতির্ময়!
আদর করিয়া পাগল বলিলে শিশুর মতো সে হাসে,
একী রহস্য, এত অবহেলা, তবু যেন ভালোবাসে।
একদা ইহারই মাঝে –
প্রেমিকে তাঁহার লাগালেন খোদা তাঁর প্রিয়তম কাজে।
আদি উপাসনা-মন্দির কাবা – যাহারে ইব্রাহিম
নির্মল কোন প্রভাতে পূজিতে খোদারে মহামহিম, –
সেই কাবাঘরে ছিল না প্রাচীর, ভেঙেছিল তারে কাল,
চারিদিক ঘিরি জমেছিল তার মূর্তি ও জঞ্জাল।
বর্ষার জল ঢুকি সেই ঘরে করিত পঙ্কময়,
পবিত্র কাবা রক্ষিতে যত কোরেশ সহৃদয়
চারিদিকে তার রচিল প্রাচীর, তাও কিছুকাল পরে
বর্ষার স্রোতে ভেসে গেল। ওঠে আল্লার ঘর ভরে
ধূলি-জঞ্জালে. মিলিয়া তখন ভক্ত কোরেশ সবে
ভাবিতে লাগিল কী উপায়ে এর রক্ষা সাধন হবে।
পূজা মন্দিরে রবে নাকো ছাদ, এই বিশ্বাসে তারা
ছাদহীন করে রেখেছিল কাবা, ঝরিবে আশিস-ধারা
ঊর্ধ্ব হইতে। ভূত প্রেত যত দেবতারা নামি রাতে
লইবে সে পূজা, ফিরে যাবে যদি বাধা পায় তারা ছাতে!
লঙ্ঘি কাবার ভগ্নপ্রাচীর এরই মাঝে এক চোর
মূর্তি-পূজারি ভক্তের মনে হানিল ব্যথা কঠোর।
মূর্তির গায়ে ছিল অমূল্য যা কিছু অলংকার
মণি-মাণিক্য, – হরিল সকল! অভাবিত অনাচার!
কাবার সুমুখে ছিল এক কূপ, ভক্ত পূজারি দল
পূজা-সামগ্রী দেব-উদ্দেশে সেই কূপে অবিরল
ফেলিতে লাগিল, সেই সব বলি, ফুল পাতা ক্রমে পচে
কাবা-মন্দিরে বিকট-গন্ধ নরক তুলিলা রচে।
হেরিল একদা ভক্ত সে এক – সে কূপ-গাত্র বেয়ে
উঠিয়া আসিছে অজগর এক সর্পিল বেগে ধেয়ে।
ক্রমে নাগরাজ কূপ-গুহা ছাড়ি কাবায় পাতিল হানা,
ভক্ত পূজারি ভয়ে সেথা হতে উঠাইল আস্তানা।
পূজা দিতে আর কেহ নাহি আসে, ভীষণ সর্প-ভীতি,
কত শত করে মানত তাহারা ভূত উদ্দেশে নিতি।
একদিন এক ঈগল পক্ষী সহসা সে অজগরে
ছোঁ মারিয়া লয়ে গেল তারে দূর পর্বত কন্দরে।
আবার চলিল নব-উদ্যমে মূর্তিপূজার ঘটা।
ভক্তদলের মনে এল এই বিশ্বাস আলো-ছটা;
কাবা-মন্দির সংস্কারের মানত করেছে বলে
অজগরে লয়ে গেলেন ঠাকুর ঈগল পাখির ছলে!
সকল গোত্র-সর্দার আসি মিলিল সে এক ঠাঁই,
যা দিয়া গড়িবে কায়েম করিয়া কাবারে, হেজাজে নাই
তেমন কিছুই। শুনিল তাহারা একদিন লোকমুখে –
গ্রিক-বাণিজ্য-পোত এক গেছে ভাঙিয়া ‘জেদ্দা’-বুকে;
ঝটিকা-তাড়িত ভগ্ন সে তরি আছে বিক্রয় লাগি।
সর্দার সব এ খবর পেয়ে উঠিল আবার জাগি।
আনিল অলিদ ভগ্ন পোতের তক্তা সকল কিনে,
কাবা মন্দির গড়িয়া তুলিল সবে মিলে কিছুদিনে।
নির্মিত যবে হল মন্দির সকলের সাধনায়,
একতা তাদের টুটাইয়া দিল কোন এক অজানায়।
আছিল ‘হাজর আস্ওয়াদ্’ নামে প্রস্তর কাবার দ্বারে,
কাবার বোধন-দিনে হজরত ইব্রাহিম সে তারে
রাখিয়াছিলেন চিহ্ন-স্বরূপ সেকালের প্রথামতো,
সেই হতে সেই প্রস্তর সবে চুমিত শ্রদ্ধানত।
কেহ কেহ বলে, আদিম মানব ‘আদম’ স্বর্গ হতে
আনিয়াছিলেন ওই প্রস্তর ধূলির ধরণি-পথে।
সেই পবিত্র প্রস্তর তুলি যে-গোত্র কাবা-দ্বারে
রক্ষিবে – সারা হেজাজ শ্রেষ্ঠ গোত্র বলিবে তারে।
এই ধারণায় সকল গোত্রে বাধিল কলহ ঘোর,
প্রতি গোষ্ঠী সে বলে, ‘ও-পাথরে একা অধিকার মোর।’
সে কলহ ক্রমে হইতে লাগিল ভীম হতে ভীমতর ;
আবার ভীষণ যুদ্ধ সূচনা, কাঁপে দেশ থরথর!
রক্ত-পূর্ণ পাত্রে হস্ত ডুবাইয়া তারা সবে
করিল মরণ-প্রতিজ্ঞা তারা – মাতিবে ভীম আহবে!
দামামা নাকাড়া ডিমি ডিমি বাজে, হাঁকিল নকিব তূরী,
পক্ষ মেলিয়া ‘মালিকূল মউত’ আঁটিল কটিতে ছুরি।
ছিল হেজাজের প্রবীণতম সে জইফ ‘আবু উমাইয়া’,
যুযুৎসু সব গোত্রে অনেক কহিলেন সমঝাইয়া –
‘যে শুভব্রতের করিলে সাধনা, অশুভ কলহ-রণে
নাশিয়ো না তারে সিদ্ধিলাভের মহান শুভক্ষণে।
শুভ্রশ্মশ্রু এই বৃদ্ধের শোনো উপদেশ-বাণী,
সংবরো এই আত্মবিনাশী হীন রণ হানাহানি।
কাবা-মন্দিরে সর্বপ্রথম প্রবেশিবে আজ যেই
এই কলহের শুভ মীমাংসা করুক একাকী সেই!’
শ্রদ্ধাস্পদ বৃদ্ধের এই কল্যাণ-বাণী শুনি,
বিরত হইল কলহে তাহারা, বলে, ‘মারহাবা’ গুণী!
অপলক চোখে নিরুদ্ধ শ্বাসে চাহিয়া রহিল সবে,
না জানি সে কোন অজানিত জন পশিবে কাবায় কবে –
সহসা আসিল তরুণ মোহাম্মদ কাবা-মন্দিরে
সর্বপ্রথম উপাসনা লাগি পশে আনমনে ধীরে।
সকল গোষ্ঠী সর্দার ওঠে আনন্দে চিৎকারি –
‘সম্মত এরে মানিতে সালিশ – আমিন এ ব্রতচারী!’
হেজাল-দুলাল সত্যব্রতী বিশ্বাসী আহমদ
ছিল সকলের নয়নের মণি গৌরব-সম্পদ।
শুনিয়া সকল, কহিল তরুণ সাধক, ‘আমার বিধি
মান যদি সব বীর সর্দার – স্ব-গোত্র প্রতিনিধি
করো নির্বাচন, তারপরে সব প্রতিনিধি মিলে
পবিত্র এই প্রস্তর নিয়ে চলো কাবা-মঞ্জিলে।
আমার উত্তরীয় দিয়া এরে বাঁধিয়া তাহার পর
এক সাথে এরে রাখিব কাবায়।’ কহে সব ‘সুন্দর!
সুন্দর এই মীমাংসা তব, আমিন, হেজাজে ধন্য!
তুমি রাখো এই পাথর একাই, ছুঁইবে না কেহ অন্য!’
রাখিলেন হজরত পবিত্র প্রস্তর কাবা-ঘরে,
থামিল ভীষণ অনাগত রণ খোদার আশিস-বরে।
ধন্য ধন্য পড়ে গেল রব হেজাজের সবখানে,
এসেছে সাদিক আমিন মোহাম্মদ আরবস্তানে।
জব্বুর তওরাত ইঞ্জিল যাহার আসার বাণী
ঘোষিল যুগ-যুগান্ত পূর্বে, বেহেশ্ত হইতে টানি
আনিল পীড়িতা মূক ধরণির তপস্যা আজি তারে,
ব্যথিত হৃদয়ে ফেলিয়া চরণ, অবতার এল দ্বারে!
সকল কালের সকল গ্রন্থ, কেতাব, যোগী ও ধ্যানী,
মুনি, ঋষি, আউলিয়া, আম্বিয়া, দরবেশ মহাজ্ঞানী
প্রচারিল যার আসার খবর – আজি মন্থন-শেষ
বেদনা-সিন্ধু ভেদিয়া আসিল সেই নবি অমৃতেশ!
হেরিল প্রাচীনা ধরণি আবার উদয় অভ্যুদয়
সব-শেষ ত্রাণকর্তা আসিল, ভয় নাই, গাহো জয়।
যে সিদ্দিক ও আমিনে খুঁজেছে বাইবেল আর ইশা
তওরাত দিল বারে বারে সেই মোহাম্মদের দিশা,
পাপিয়া-কন্ঠ দাউদ গাহিল যার অনাগত গীতি,
যে ‘মহামর্দে’ অথর্ব-বেদ-গান খুঁজিয়াছে নিতি,
সে অতিথি এল, কতকাল ওরে – আজি কতকাল পরে
ধেয়ানের মণি নয়নে আসিল! বিশ্ব উঠিল ভরে,–
আলোকে, পুলকে, ফুলে ফলে, রূপে রসে, বর্ণ ও গন্ধে,
গ্রহতারা-লোক পতিতা ধরায় আজি পূজা করে, বন্দে!
২০. সাম্যবাদী (আদি উপাসনালয়)
উঠিল আবার নূতন করিয়া — ভূত প্রেত সমুদয়
তিনি শত ষাট বিগ্রহ আর মূর্তি নূতন করি’
বসিল সোনার বেদীতে যে হায় আল্লার ঘর ভরি।
সহিতে না পারি এ দৃশ্য, এই স্রষ্টার অপমান,
ধেয়ানে মুক্তি-পথ খোঁজে নবী, কাঁদিয়া ওঠে পরান।
খদিজারে কন– “আল্লাতালার কসম, কাবার ঐ
“লাৎ” “ওজ্জা”র করিব না পূজা, জানি না আল্লা বই।
নিজ হাতে যারে করিল সৃষ্টি খড় আর মাটি দিয়া
কোন্ নির্বোধ পূজিবে তাহারে হায় স্রষ্টা বলিয়া!”
সাধ্বী পতিব্রতা খাদিজাও কহেন স্বামীর সনে–
“দূর কর ঐ লাত্ মানাতেরে, পূজে যাহা সব-জনে।
তভ শুভ-বরে একেশ্বর সে জ্যোতির্ময়ের দিশা
পাইয়াছি প্রভু, কাটিয়া গিয়াছে আমার আঁধার নিশা।”
ক্রমে ক্রমে সব কোরেশ জানিল — মোহাম্মদ আমিন
করে না কো পূজা কাবার ভূতেরে ভাবিয়া তাদেরে হীন।