- বইয়ের নামঃ সন্ধ্যা
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অন্ধ স্বদেশ – দেবতা
ফাঁসির রশ্মি ধরি
আসিছে অন্ধ স্বদেশ-দেবতা, পলে পলে অনুসরি
মৃত্যু-গহন-যাত্রীদলের লাল পদাঙ্ক-রেখা।
যুগযুগান্ত-নির্জিত-ভালে নীল কলঙ্ক-লেখা!
নীরন্ধ্র মেঘে অন্ধ আকাশ, অন্ধ তিমির রাতি,
কুহেলি-অন্ধ দিগন্তিকার হস্তে নিভেছে বাতি, −
চলে পথহারা অন্ধ দেবতা ধীরে ধীরে এরই মাঝে,
সেই পথে ফেলে চরণ – যে পথে কঙ্কাল পায়ে বাজে!
নির্যাতনের যে যষ্টি দিয়া শত্রু আঘাত হানে
সেই যষ্টিরে দোসর করিয়া অলক্ষ্য পথ-পানে
চলেছে দেবতা – অন্ধ দেবতা – পায়ে পায়ে পলে পলে,
যত ঘিরে আসে পথ-সংকট চলে তত নববলে।
ঢলে পড়ে পথ পরে,
নবীন মৃত্যু-যাত্রী আসিয়া তুলে ধরে বুকে করে!
অন্ধ কারার বন্ধ দুয়ারে যথায় বন্দি জাগে,
যথায় বধ্য-মঞ্চ নিত্য রাঙিছে রক্ত-রাগে,
যথায় পিষ্ট হতেছে আত্মা নিষ্ঠুর মুঠি-তলে,
যথায় অন্ধ গুহায় ফণীর মাথায় মানিক জ্বলে,
যথায় বন্য শ্বাপদের সাথে নখর দন্ত লয়ে
জাগে বিনিদ্র বন্য-তরুণ ক্ষুধার তাড়না সয়ে,
যথা প্রাণ দেয় বলির নারীরা যূপকাষ্ঠের ফাঁদে, −
সেই পথে চলে অন্ধ দেবতা, পথ চলে আর কাঁদে, −
‘ওরে ওঠ ত্বরা করি
তোদের রক্তে-রাঙা উষা আসে, পোহাইছে বিভাবরী!’
তিমির রাত্রি, ছুটেছে যাত্রী নিরুদ্দেশের ডাকে,
জানে না কাথায় কোন পথে কোন ঊর্ধ্বে দেবতা হাঁকে।
শুনিয়াছে ডাক এই শুধু জানে! অপনার অনুরাগে
মাতিয়া উঠেছে অলস চরণ, সম্মুখে পথ জাগে!
জাগে পথ, জাগে ঊর্ধ্বে দেবতা, এই দেখিয়াছে শুধু,
কে দেখে সে পথে চোরা বালুচর, পর্বত, মরু ধুধু!
ছুটেছে পথিক, সাথে চলে পথ, অমানিশি চলে সাথে,
পথে পড়ে ঢলে, মৃত্যুর ছলে ধরে দেবতার হাতে।
চলিতেছে পাশাপাশি –
মৃত্যু, তরুণ, অন্ধ দেবতা, নবীন উষার হাসি!
কালবৈশাখী
বারেবারে যথা কালবৈশাখী ব্যর্থ হল রে পুব-হাওয়ায়,
দধীচি-হাড়ের বজ্র-বহ্নি বারেবারে যথা নিভিয়া যায়,
কে পাগল সেথা যাস হাঁকি –
‘বৈশাখী কালবৈশাখী!’
হেথা বৈশাখী-জ্বালা আছে শুধু, নাই বৈশাখী-ঝড় হেথায়।
সে জ্বালায় শুধু নিজে পুড়ে মরি, পোড়াতে কারেও পারি নে, হায়॥
২
কালবৈশাখী আসিলে হেথায় ভাঙিয়া পড়িত কোন সকাল
ঘুণ-ধরা বাঁশে ঠেকা দেওয়া ওই সনাতন দাওয়া, ভগ্ন চাল।
এলে হেথা কালবৈশাখী
মরা গাঙে যেত বান ডাকি,
বদ্ধ জাঙাল যাইত ভাঙিয়া, দুলিত এ দেশ টালমাটাল।
শ্মশানের বুকে নাচিত তাথই জীবন-রঙ্গে তাল-বেতাল॥
৩
কালবৈশাখী আসেনি হেথায়, আসিলে মোদের তরু-শিরে
সিন্ধু-শকুন বসিত না আসি ভিড় করে আজ নদীতীরে।
জানি না কবে সে আসিবে ঝড়
ধুলায় লুটাবে শত্রুগড়,
আজিও মোদের কাটেনিকো শীত, আসেনি ফাগুন বন ঘিরে।
আজিও বলির কাঁসর-ঘন্টা বাজিয়া ওঠেনি মন্দিরে॥
৪
জাগেনি রুদ্র, জাগিয়াছে শুধু অন্ধকারের প্রমথ-দল,
ললাট-অগ্নি নিবেছে শিবের ঝরিয়া জটার গঙ্গাজল।
জাগেনি শিবানী – জাগিয়াছে শিবা,
আঁধার সৃষ্টি – আসেনিকো দিবা,
এরই মাঝে হায়, কালবৈশাখী স্বপ্ন দেখিলি কে তোরা বল!
আসে যদি ঝড়, আসুক, কুলোর বাতাস কে দিবি অগ্রে চল॥
জাগরণ
জেগে যারা ঘুমিয়ে আছে তাদের দ্বারে আসি
ওরে পাগল, আর কতদিন বাজাবি তোর বাঁশি!
ঘুমায় যারা মখমলের ওই কোমল শয়ন পাতি
অনেক আগেই ভোর হয়েছে তাদের দুখের রাতি।
আরাম-সুখের নিদ্রা তাদের; তোর এ জাগার গান
ছোঁবে নাকো প্রাণ রে তাদের, যদিই বা ছোঁয় কান!
নির্ভয়ের ওই সুখের কূলে বাঁধলযারা বাড়ি,
আবার তারা দেবে না রে ভয়ের সাগর পাড়ি।
ভিতর হতে যাদের আগল শক্ত করে আঁটা
‘দ্বার খোলো গো’ বলে তাদের দ্বারে মিথ্যা হাঁটা।
ভোল রে এ পথ ভোল,
শান্তিপুরে শুনবে কে তোর জাগর-ডঙ্কা-রোল!
ব্যাথাতুরের কান্না পাছে শান্তি ভাঙে এসে
তাইতে যারা খাইয়ে ঘুমের আফিম সর্বনেশে
ঘুম পাড়িয়ে রাখছে নিতুই, সে ঘুম-পুরে আসি
নতুন করে বাজা রে তোর নতুন সুরের বাঁশি!
নেশার ঘোরে জানে না হায়, এরা কোথায় পড়ে,
গলায় তাদের চালায় ছুরি কেই বা বুকে চড়ে,
এদের কানে মন্ত্র দে রে, এদের তোরা বোঝা,
এরাই আবার করতে পারে বাঁকা কপাল সোজা।
কর্ষণে যার পাতাল হতে অনুর্বর এই ধরা
ফুল-ফসলের অর্ঘ্য নিয়ে আসে আঁচল-ভরা,
কোন সে দানব হরণ করে সে দেব-পূজার ফুল –
জানিয়ে দে তুই মন্ত্র-ঋষি, ভাঙ রে তাদের ভুল!
বর্বরদের অনুর্বর ওই হৃদয়-মরু চষে
ফল ফলাতে পারে এরাই আবার ঘরে বসে।
বাঘ-ভালুকের বাথান তেড়ে নগর বসায় যারা
রসাতলে পশবে মানুষ-পশুর ভয়ে তারা?
তাদেরই ওই বিতাড়িত বন্যপশু আজি
মানুষ-মুখো হয়েছে রে সভ্যসাজে সাজি।
টান মেরে ফেল মুখোশ তাদের, নখর কন্ত লয়ে
বেরিয়ে আসুক মনের পশু বনের পশু হয়ে!
তারাই দানব অত্যাচারী – যারা মানুষ মারে,
সভ্যবেশী ভণ্ড পশু মারতে ডরাস কারে?
এতদিন যে হাজার পাপের বীজ হয়েছে বোনা
আজ তা কাটার এল সময়, এই সে বাণী শোনা!
নতুন যুগের নতুন নকিব, বাজা নতুন বাঁশি,
স্বর্গ-রানি হবে এবার মাটির মায়ের দাসী!
জীবন-বন্দনা
গাহি তাহাদের গান – ধরণির হাতে দিল যারা আনি ফসলের ফরমান। শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে ত্রস্তা ধরণি নজরানা দেয় ডালি ভরে ফুলে ফলে। বন্য-শ্বাপদ-সংকুল জরা-মৃত্যু-ভীষণা ধরা যাদের শাসনে হল সুন্দর কুসুমিতা মনোহরা। যারা বর্বর হেথা বাঁধে ঘর পরম অকুতোভয়ে বনের ব্যাঘ্র মরুর সিংহ বিবরের ফণী লয়ে। এল দুর্জয় গতিবেগ সম যারা যাযাবর-শিশু – তারাই গাহিল নব প্রেমগান ধরণি-মেরির জিশু – যাহাদের চলা লেগে উল্কার মতো ঘুরিছে ধরণি শূন্যে অমিত বেগে !
খেয়াল খুশিতে কাটি অরণ্য রচিয়া অমরাবতী
যাহারা করিল ধ্বংসসাধন পুন চঞ্চলমতি,
জীবন-আবেগ রুধিতে না পারি যারা উদ্ধত-শির
লঙ্ঘিতে গেল হিমালয়, গেল শুষিতে সিন্ধু-নীর।
নবীন জগৎ সন্ধানে যারা ছুটে মেরু-অভিযানে,
পক্ষ বাঁধিয়া উড়িয়া চলেছে যাহারা ঊর্ধ্বপানে।
তবুও থামে না যৌবন-বেগ, জীবনের উল্লাসে
চলেছে চন্দ্র-মঙ্গল-গ্রহে স্বর্গে অসীমাকাশে।
যারা জীবনের পসরা বহিয়া মৃত্যুর দ্বারে দ্বারে
করিতেছে ফিরি, ভীম রণভূমে প্রাণ বাজি রেখে হারে।
আমি মর-কবি – গাহি সেই বেদে-বেদুইনদের গান,
যুগে যুগে যারা করে অকারণ বিপ্লব-অভিযান।
জীবনের আতিশয্যে যাহারা দারুণ উগ্রসুখে
সাধ করে নিল গরল-পিয়ালা, বর্শা হানিল বুকে !
আষাঢ়ের গিরি-নিঃস্রাবসম কোনো বাধা মানিল না,
বর্বর বলি যাহাদের গালি পাড়িল ক্ষুদ্রমনা,
কূপমণ্ডূক ‘অসংযমী’র আখ্যা দিয়াছে যারে,
তারই তরে ভাই গান রচে যাই, বন্দনা করি তারে !
তরুণ তাপস
রাঙা পথের ভাঙন-ব্রতী অগ্রপথিক দল !
নাম রে ধুলায়−বর্তমানের মর্তপানে চল॥
ভবিষ্যতের স্বর্গ লাগি
শূন্যে চেয়ে আছিস জাগি
অতীতকালের রত্ন মাগি
নামলি রসাতল।
অন্ধ মাতাল! শূন্য পাতাল, হাতালি নিষ্ফল॥
ভোল রে চির-পুরাতনের সনাতনের বোল।
তরুণ তাপস! নতুন জগৎ সৃষ্টি করে তোল।
আদিম যুগের পুথির বাণী
আজও কি তুই চলবি মানি ?
কালের বুড়ো টানছে ঘানি
তুই সে বাঁধন খোল।
অভিজাতের পানসে বিলাস–দুখের তাপস ! ভোল॥
তর্পণ
(স্বর্গীয় দেশবন্ধুর চতুর্থ বার্ষিক শ্রাদ্ধ উপলক্ষে)
− আজিও তেমনই করি
আষাঢ়ের মেঘ ঘনায়ে এসেছে
ভারত-ভাগ্য ভরি।
আকাশ ভাঙিয়া তেমনই বাদল
ঝরে সারা দিনমান,
দিন না ফুরাতে দিনের সূর্য
মেঘে হল অবসান!
আকাশে খুঁজিছে বিজলি প্রদীপ,
খোঁজে চিতা নদী-কূলে,
কার বয়নের মণি হরায়েছে
হেথা অঞ্চল খুলে।
বজ্রে বজ্রে হাহাকার ওঠে,
খেয়ে বিদ্যুৎ-কশা
স্বর্গে ছুটেছে সিন্ধু –
ঐরাবত দীর্ঘশ্বসা।
ধরায় যে ছিল দেবতা, তাহারে
স্বর্গ করেছে চুরি;
অভিযানে চলে ধরণির সেনা,
অশনিতে বাজে তূরী।
ধরণির শ্বাস ধূমায়িত হল
পুঞ্জিত কালো মেঘে,
চিতাচুল্লিতে শোকের পাবক
নিভে না বাতাস লেগে।
শ্মশানের চিতা যদি নেভে, তবু
জ্বলে স্মরণের চিতা,
এ-পারের প্রাণ-স্নেহরসে হল
ও-পার দীপান্বিতা।
− হতভাগ্যের জাতি,
উৎসব নাই, শ্রাদ্ধ করিয়া
কাটাই দিবস রাতি!
কেবলই বাদল, চোখের বরষা,
যদি বা বাদল থামে –
ওঠে না সূর্য আকাশে ভুলিয়া
রামধনুও না নামে!
ত্রিশ জনে করে প্রায়শ্চিত্ত
ত্রিশ কোটির সে পাপ,
স্বর্গ হইতে বর আনি, আসে
রসাতল হতে শাপ!
হে দেশবন্ধু, হয়তো স্বর্গে
দেবেন্দ্র হয়ে তুমি
জানি না কী চোখে দেখিছ
পাপের ভীরুর ভারতভূমি!
মোদের ভাগ্যে ভাস্কর-সম
উঠেছিলে তুমি তবু,
বাহির আঁধার ঘুচালে,
ঘুচিল মনের তম কি কভু?
সূর্য-আলোকে মনের আঁধার
ঘোচে না, অশনি-ঘাতে
ঘুচাও ঘুচাও জাতের লজ্জা
মরণ-চরণ-পাতে!
অমৃতে বাঁচাতে পারনি এ দেশ,
ওগো মৃত্যুঞ্জয়,
স্বর্গ হইতে পাঠাও এবার
মৃত্যুর বরাভয়!
ক্ষূণ শ্রদ্ধার শ্রাদ্ধ-বাসরে
কী মন্ত্র উচ্চারি
তোমারে তুষিব, আমরা তো নহি
শ্রাদ্ধের অধিকারী!
শ্রদ্ধা দানিবে শ্রাদ্ধ করিবে
বীর অনাগত তারা
স্বাধীন দেশের প্রভাত-সূর্যে
বন্দিবে তোমা যারা!
দাড়ি-বিলাপ
হে আমার দাড়ি!
একাদশ বর্ষ পরে গেলে আজি ছাড়ি
আমারে কাঙাল করি, শূন্য করি বুক!
শূন্য এ চোয়াল আজি শূন্য এ চিবুক!
তোমার বিরহে বন্ধু, তোমার প্রেয়সী
ঝুরিছে শ্যামলী গুম্ফ ওষ্ঠকূলে বসি!
কপোল কপাল ঠুকি করে হাহাকার –
‘রে কপটি, রে সেফটি (safety) গিলেট রেজার!’….
একে একে মনে পড়ে অতীতের কথা –
তখনও ফোটেনি মুখে দাড়ির মমতা!
তখনও এ গাল ছিল সাহারার মরু,
বে-পাল মাস্তুল কিংবা বিপল্লব তরু!
স্বজাতির ভীরুতার ইতিহাস স্মরি
বাহিয়া বি-শ্মশ্রু গণ্ড অশ্রু যেত ঝরি।
নারীসম কেশ বেশ, নারিকেলি মুখ,
নারিকেলি হুঁকা খায়! – পুরুষ উৎসুক
নারীর ‘নেচার’ নিতে, হা ভারত মাতা!
নারী-মুণ্ড হল আজি নর বিশ্বত্রাতা!
চলিত কাবুলিওয়ালা গুঁতো-হস্তে পথে
উড়ায়ে দাড়ির ধ্বজা, আফগানিয়া রথে
সুকৃষ্ণ নিশান যেন! অবাক বিস্ময়ে
মহিলা-মহলে নিজ নারী-মুখ লয়ে
রহিতাম চাহি আমি ঘুলঘুলি-ফাঁকে,
বেচারি বাঙালি দাড়ি, কে শুধায় তাকে?
চলিত মটরু মিয়াঁ চামারুর নানা,
মনে হত, এ দাড়িও ধার করে আনা
কাবুলির দেনা-সাথে! বাঙালির দাড়ি
বাঙালির শৌর্য-সাথে গিয়াছে গো ছাড়ি!
দাড়ির দাড়িম্ব বনে ফেরে নাকো আর
নির্মুক্ত হিড়িম্বা সতী, সে যুগ ফেরার!
জামাতারে হেরি শ্বশ্রু লুকান যেমনি!
‘রেজারে’ হেরিয়া শ্মশ্রু লুকাল তেমনি!…
ভোজপুরি দারোয়ান তারও দাড়ি আছে,
চলিতে সে দাড়ি যেন শিখীপুচ্ছ নাচে!
পাঞ্জাবি, বেলুচি, শিখ, বীর রাজপুত,
দরবেশ, মুনি, ঋষি, বাবাজি অদ্ভুত,
বোকেন্দ্র-গন্ধিত ছাগ সেও দাড়ি রাখে,
শিম্পাঞ্জি, গরিলা – হায়, বাদ দিই কাকে!
এমন যে বটবৃক্ষ তারও নামে ঝুরি,
ঝুরি নয় ও যে দাড়ি করিয়াছে চুরি
বনের মানুষ হতে! তাই সে বনস্পতি আজ!
দাড়ি রাখে গুল্মলতা রসুন পেঁয়াজ!
হাটে দাড়ি, মাঠে দাড়ি, দাড়ি চারিধার,
লক্ষ খারে ঝরে যেন দাড়ি-বারিধার!
ঝরে যবে বৃষ্টিধারা নীল নভ বেয়ে
মনে হয় গাড়ি গাড়ি দাড়ি গেছে ছেয়ে
ধরণির চোখে-মুখে, সে সুখ-আবেশে
নব নব পুষ্পে তৃণে ধরা ওঠে হেসে!
মুকুরে হেরিয়া নিত বি-শ্মশ্রু বদন
লজ্জায় মুদিয়া যেত আপনি নয়ন।
হায় রে কাঙালি,
রহিলি তুই-ই হয়ে মাকুন্দা বাঙালি!
এতেক চিন্তিয়া এক ক্ষুর করি ক্রয়
চাঁছিতে লাগিনু গাল সকল সময়।
বহু সাধ্য-সাধনায় বহু বর্ষ পরে
উদিল নবীন দাড়ি! যেন দিগন্তরে
কৃষ্ণ মেঘ দিল দেখা অজন্মার দেশে,
লালিমলি-পার্সেল যেন অঘ্রানের শেষে!
সে দাড়ি-গৌরব বহি সু-উচ্চ মিনারে
দাঁড়াইয়া ঘোষিতাম, ‘এই দাড়িকারে
নিন্দে যারা, তারা ভীরু তারা কাপুরুষ!
হায় রে বেহুঁশ,
নারী তো নরের রূপ পেতে নাহি চায়,
তাদের হয় না দাড়ি, গুম্ফ না গজায়!
দাড়ি রাখি হইয়াছি শ্রীহীন মিয়াঁ!
কিন্তু বন্ধু, তোমরা যে শ্রীমতী অমিয়া
হইতেছ দিনে দিনে!
কেবা নর কেবা নারী কেহ নাহি চিনে!’
কে কাহার কথা শোনে, ওরা করে ‘শেভ’,
আমারে দেখিলে বলে – ‘ওই অজদেব!’
হই অজ-মুণ্ড আমি তবু দক্ষ-রাজা,
দক্ষেরই জামাতা শিব – (খায় খাক গাঁজা!)
দিনে দিনে বাড়ে দাড়ি রেজার-কর্ষণে,
শস্য-শ্যামা ধরা যেন হলের ঘর্ষণে!
* * *
একাদশ বর্ষ পরে – হায় রে নিয়তি
কে জানে আমার ভাগ্যে ছিল এ দুর্গতি!
সেদিন কার্জন-হলে দিলীপকুমার
আসিল গাহিতে গান, কে করে শুমার
কত যে আসিল নর কত সে যে নারী!
ঠেসাঠেসি ঘেঁসাঘেঁসি, কত ধুতি শাড়ি
ছিঁড়িল পশিতে সেথা! চেনা নাহি যায়
কেবা নর কেবা নারী – এক কেশ এক বেশ, হায়!
সে নিখিল নারী-সভা মাঝে
হেরিলাম, আমারই সে জয়ডঙ্কা বাজে
মুখে মুখে দিকে দিকে! আমি কৃষ্ণ-সম
একাকী পুরুষ বিরাজিনু অনুপম।
সম্মুখে বালিকা এক গাহিতে বসিয়া
ভুলি গেল সুর লয় মোরে নিরখিয়া।
বলে, ‘মাগো, ও কী দাড়ি, দেখে ভয় লাগে!
সুর মম ভয়ে সারদার কোল মাগে,
বাহিরিতে চাহে নাকো।
উহারে সম্মুখ হতে সরাইয়া রাখো!’
গর্বে নাড়ি দাড়ি
কহিলাম – ‘গান! তব সাঝে মম আড়ি!’
সরোষে যেমনি যাব বাহিরিতে আমি,
বিস্ময়ে হেরিনু, মম দাড়ি গেছে থামি
বাঁধিয়া যায় গো দাড়ি নিমেষের ভ্রমে?
চিৎকারিল নারীদল নব নব সুরে,
বানর নরের দল হাসিল অদূরে
ঝিঁঝিট-খাম্বাজে কেহ, কেহ মালকোশে,
হিন্দোলে হুংকারে কেহ ওস্তাদি আক্রোশে!
আসিল নারীর স্বামী, স্বামীর শ্যালক,
পলাইতে যত চাহি পিছে লাগে শক!
দেখেছি অনেক ব্রোচ, বহু সেফটিপিন,
হিরিনি নাছোড়বান্দা হেন কোনোদিন।
আমারও স্ত্রীর ব্রোচ কাঁটা বহুবার
বাধিয়াই ছাড়িয়াছে তখনই আবার!
যত পালাইতে চাই তত বাঁধে দাড়ি,
দাড়ি লয়ে পড়ে গেল শেষে কাড়াকাড়ি
পুরুষ নারীর মাঝে! ক্ষুরে ও কাঁচিতে
হাসিতে হল্লাতে গোলে কাশিতে হাঁচিতে
লাগিল ভীষণ দ্বন্দ্ব!…. যখন চেতনা
ফিরিয়া পাইনু গৃহে, হেরি আনমনা
হাসিছে গৃহিণী মম বাতায়নে বসি।
জাগিতে দেখিয়া কহে, ‘এতদিনে শশী
হল মেঘ-মুক্ত প্রিয়!’ মুকুরে হেরিয়া মুখ কহিলাম আমি,
‘আমি কই?’ সে কহিল, ‘মুকুরেতে স্বামী!’
নগদ কথা
দুন্দুভি তোর বাজল অনেক
অনেক শঙ্খ ঘন্টা কাঁসর,
মুখস্থ তোর মন্ত্ররোলে
মুখর আজি পূজার আসর, −
কুম্ভকর্ণ দেবতা ঠাকুর
জাগবে কখন সেই ভরসায়
যুদ্ধভূমি ত্যাগ করে সব
ধন্না দিলি দেব-দরজায়।
দেবতা-ঠাকুর স্বর্গবাসী
নাক ডাকিয়া ঘুমান সুখে,
সুখের মালিক শোনে কি – কে
কাঁদছে নীচে গভীর দুখে।
হত্যা দিয়ে রইলি পড়ে
শত্রু-হাতে হত্যা-ভয়ে,
করবি কী তুই ঠুঁটো ঠাকুর
জগন্নাথের আশিস লয়ে।
দোহাই তোদের! রেহাই দে ভাই
উঁচুর ঠাকুর দেবতাদেরে,
শিব চেয়েছিস – শিব দিয়েছেন
তোদের ঘরে ষণ্ড ছেড়ে।
শিবের জটার গঙ্গাদেবী
বয়ে বেড়ান ওদের তরি,
ব্রহ্মা তোদের রম্ভা দিলেন
ওদের দিয়ে সোনার জরি!
পূজার থালা বয়ে বয়ে
যে-হাত তোদের হল ঠুঁটো,
সে-হাত এবার নিচু করে
টান না পায়ের শিকল দুটো!
ফুটো তোর ওই ঢক্কা-নিনাদ
পলিটিক্সের বারোয়ারিতে –
দোহাই থামা! পারিস যদি
পড় নেমে ওই লাল-নদীতে।
শ্রীপাদপদ্ম লাভ করিতে
গয়া সবাই পেলি ক্রমে,
একটু দূরেই যমের দুয়ার
সেথাই গিয়ে দেখ না ভ্রমে!
না–আসা দিনের কবির প্রতি
জবা-কুসুম-সংকাশ রাঙা অরুণ রবি
তোমরা উঠিছ; না-আসা দিনের তোমরা কবি।
যে-রাঙা প্রভাত দেখিবার আশে আমরা জাগি
তোমরা জাগিছ দলে দলে পাখি তারই-র লাগি।
স্তব-গান গাই আমি তোমাদেরই আসার আশে,
তোমরা উদিবে আমার রচিত নীল আকাশে।
আমি রেখে যাই আমার নমস্কারের স্মৃতি –
আমার বীণায় গাহিয়ো নতুন দিনের গীতি!
নিশীথ অন্ধকারে
(গান)
এ কী বেদনার উঠিয়াছে ঢেউ দূর সিন্ধুর পারে,
নিশীথ-অন্ধকারে।
পুরবের রবি ডুবিল গভীর বাদল-অশ্রু-ধারে,
নিশীথ-অন্ধকারে॥
ঘিরিয়াছে দিক ঘন ঘোর মেঘে,
পুবালি বাতাস বহিতেছে বেগে,
বন্দিনি মাতা একাকিনী জেগে কাঁদিতেছে কারাগারে,
শিয়রের দীপ যত সে জ্বালায় নিভে যায় বারে বারে।
নিশীথ-অন্ধকারে॥
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ নীরব আজিকে মিনার-চূড়ে,
বহে না শিরাজ-বাগের নহর , বুলবুল গেছে উড়ে।
ছিল শুধু চাঁদ, গেছে তরবার,
সে চাঁদও আঁধারে ডুবিল এবার,
শিরতাজ-হারা কাঁদে মুসলিম অস্ত-তোরণ-দ্বারে।
উঠিতেছে সুর বিদায়-বিধুর পারাবার-পরপারে।
নিশীথ-অন্ধকারে॥
ছিল না সে রাজা – কেঁপেছে বিশ্ব তবু গো প্রতাপে তার,
শত্রু-দুর্গে বন্দি থাকিয়া খোলেনি সে তরবার।
ছিল এ ভারত তারই পথ চাহি,
বুকে বুকে ছিল তারই বাদশাহি,
ছিল তার তরে ধুলার তখ্ত্ মানুষের দরবারে।
আজি বরষায় তারই তরবার ঝলসিছে বারে বারে।
পাথেয়
দরদ দিয়ে দেখল না কেউ যাদের জীবন যাদের হিয়া,
তাদের তরে ঝড়ের রথে আয় রে পাগল দরদিয়া।
শূণ্য তোদের ঝোলা-ঝুলি, তারই তোরা দর্প নিয়ে
দর্পীদের ওই প্রাসাদ-চূড়ে রক্ত-নিশান যা টাঙিয়ে।
মৃত্যু তোদের হাতের মুঠায়, সেই তো তোদের পরশ-মণি,
রবির আলোক ঢের সয়েছি, এবার তোরা আয় রে শনি!
বহ্নিশিখা
মেলি শতদিকে শতলেলিহান রসনা
জাগো বহ্নিশিখা স্বাহা দিগ্-বসনা!
জাগো রুদ্রের ললাটের রক্ত-অনল,
জাগো বজ্র-জ্বালা বিদ্যুৎ-ঝলমল!
জাগো মহেন্দ্র-তপোভঙ্গের অভিশাপ,
জাগো অনঙ্গ-দাহন নয়নের তাপ।
জাগো ভাগীরথী-কূলে-কূলে চুল্লি-শ্মশান,
জাগো অস্ত-গোধূলি-বেলা দিবা-অবসান!
জাগো উদয়প্রাতের ঊষা রক্তশিখা,
জাগো সূর্যের টিপ পরি জয়ন্তিকা!
জাগো ক্রোধাগ্নি অবমানিতের বক্ষে,
জাগো শোকাগ্নি নিরশ্রু রাঙা চক্ষে!
জাগো নিশ্চুপ সয়ে-থাকা ধূমায়িত রোষ,
জাগো বাণী-মূক কন্ঠে অশনি-নির্ঘোষ!
জাগো খান্ডব-দাহন ভীমা দাহিকা,
মরু বিদ্রুপ-হাসি জাগো হে মরীচিকা।
জাগো বাড়ব-অনল জ্বলে, বনে দাবানল,
জাগো অগ্নি-সিন্ধু-মন্থন হলাহল!
জাগো বহ্নিরুপী তরু-শুষ্ক-জ্বালা,
জাগো তরলিত অগ্নি গো সুরা-পেয়ালা।
জাগো প্রতিশোধরূপে উৎপীড়িত বুকে,
নামো স্বর্গে অভিশাপ উল্কা-মুখে!
এসো ধূমকেতু-ঝাঁটা হাতে ধূমাবতী,
এসো ভস্মের টিপ পরি অশ্রুমতী,
জাগো আলো হয়ে রবি-শশী-তারকা-চাঁদে,
এসো অনুরাগ-রাঙা হয়ে নয়ন-ফাঁদে।
জাগো কন্টকে জ্বালা হয়ে, নাগ-মুখে বিষ,
এসো আলেয়ার আলো হয়ে, নিশি-ডাক শিস্।
এসো ক্ষুধা হয়ে নিরন্ন রিক্ত ঘরে,
লুটো লক্ষ্মীর ভান্ডার হাহাস্বরে
জাগো ভীমা-ভয়ংকরী উন্মাদিনী,
রাঙা দীপক আগুন সুরে বীণাবাদিনী!
বাংলার “আজীজ”
পোহয়নি রাত, আজান তখনও দেয়নি মুয়াজ্জিন ,
মুসলমানের রাত্রি তখন আর-সকলের দিন।
অঘোর ঘুমে ঘুমায় যখন বঙ্গ-মুসলমান,
সবার আগে জাগলে তুমি গাইলে জাগার গান!
ফজর বেলার নজর ওগো উঠলে মিনার পর,
ঘুম-টুটানো আজান দিলে – ‘আল্লাহো আকবর!’
কোরান শুধু পড়ল সবাই বুঝলে তুমি একা,
লেখার যত ইসলামি জোশ তোমায় দিল দেখা।
খাপে রেখে অসি যখন খাচ্ছিল সব মার,
আলোয় তোমার উঠল নেচে দু-ধারী তল্য়ার!
চমকে সবাই উঠল জেগে, ঝলসে গেল চোখ,
নৌজোয়ানীর খুন-জোশিতে মস্ত্ হল সব লোক!
আঁধার রাতের যাত্রী যত উঠল গেয়ে গান,
তোমার চোখে দেখল তারা আলোর অভিযান।
বেরিয়ে এল বিবর হতে সিংহশাবক দল,
যাদের প্রাতাপ-দাপে আজি বাংলা টলমল!
এলে নিশান-বরদার বীর, দুশমন পর্দার,
লায়লা চিরে আনলে নাহার , রাতের তারা-হার!
সাম্যবাদী! নর-নারীরে করতে অভেদ-জ্ঞান,
বন্দিনিদের গোরস্থানে রচলে গুলিস্তান!
শীতের জরা দূর হয়েছে ফুটছে বাহার-গুল,
গুলশনে গুল ফুটল যখন – নাই তুমি বুলবুল!
মশালবাহী বিশাল পুরুষ! কোথায় তুমি আজ?
অন্ধকারে হাতড়ে মরে অন্ধ এ-সমাজ।
নাইকো সতুন , পড়ছে খসে ইসলামের আজ ছাদ;
অত্যাচারের বিরুদ্ধে আর ঘোষবে কে জেহাদ?
যেমনি তুমি হালকা হলে আপনা করি দান,
শুনলে হঠাৎ – আলোর পাখি – কাজ-হারানো গান!
ফুরিয়েছে কাজ, জাকছে তবু হিন্দু-মুসলমান,
সবার ‘আজীজ’, সবার প্রিয়, আবার গাহো গান!
আবার এসো সবার মাঝে শক্তিরূপে বীর,
হিন্দু-সবার গুরু ওগো, মুসলমানের পির!*
ভোরের পাখি
ওরে ও ভোরের পাখি!
আমি চলিলাম তোদের কণ্ঠে আমার কণ্ঠ রাখি।
তোদের কিশোর তরুণ গলার সতেজ দৃপ্ত সুরে
বাঁধিলাম বীণা, নিলাম সে সুর আমার কণ্ঠে পুরে।
উপলে নুড়িতে চুড়ে-কিঙ্কিণি বাজায়ে তোদের নদী
যে গান গাহিয়া অকূলে চাহিয়া চলিয়াছে নিরবধি –
তারই সে গতির নূপুর বাঁধিয়া লইলাম মম পায়ে,
এরই তালে মম ছন্দ-হরিণী নাচিবে তমাল-ছায়ে।
যে-গান গাহিলি তোরা,
তারই সুর লয়ে ঝরিবে আমার গানের পাগল-ঝোরা।
তোদের যে-গান শুনিয়া রাতের বনানী জাগিয়া ওঠে,
শিশু অরুণেরে কোলে করে উষা দাঁড়ায় গগন-তটে,
গোঠে আনে ধেনু বাজাইয়া বেণু রাখাল-বালক জাগি,
জল নিতে যায় নব আনন্দে নিশীথের হতভাগি,
শিখিয়া গেলাম তোদের সে গান! তোদের পাখার খুশি –
যাহার আবেগে ছুটে আসে জেগে পুব-আঙিনায় উষী,
যাহার রণনে কুঞ্জে কাননে বিকাশে কুসুম-কুঁড়ি,
পলাইয়া যায় গহন-গুহায় আঁধার নিশীথ-বুড়ি,
সে খুশির ভাগ আমি লইলাম। অমনি পক্ষ মেলি
গাহিব ঊর্ধ্বে, ফুটিবে নিম্নে আবেশে চম্পা বেলি!
তোদের প্রভাতি ভিড়ে
ভিড়িলাম আমি, নিলাম আশ্রয় তোদের ক্ষণিক নীড়ে।
ওরে ও নবীন যুবা!
তোদের প্রভাত-স্তবের সুরে রে বাজে মম দিলরুবা।
তোদের চোখের যে জ্যোতি-দীপ্তি রাঙায় রাতের সীমা,
রবির ললাট হতে মুছে নেয় গোধূলির মলিনিমা,
যে-আলোক লভি দেউলে দেউলে মঙ্গল-দীপ জ্বলে,
অকম্প যার শিখা সন্ধ্যার ম্লান অঞ্চলতলে,
তোদের সে-আলো আমার আশ্রু-কুহেলি-মলিন চোখে
লইলাম পুরি! জাগে ‘সুন্দর’ আমার ধেয়ান-লোকে!
যৌবন
− ওরে ও শীর্ণা নদী,
দু-তীরে নিরাশা-বালুচর লয়ে জাগিবি কি নিরবধি?
নব-যৌবনজলতরঙ্গ-জোয়ারে কি দুলিবি না?
নাচিবে জোয়ারে পদ্মা গঙ্গা, তুই রবি চির-ক্ষীণা?
ভরা ভাদরের বরিষন এসে বারে বারে তোর কূলে
জানাবে রে তোরে সজল মিনতি, তুই চাহিবি না ভুলে?
দুই কূলে বাঁধি প্রস্তর-বাঁধ কূল ভাঙিবার ভয়ে
আকাশের পানে চেয়ে রবি তুই শুধু আপনারে লয়ে?
ভেঙে ফেল বাঁধ, আশেপাশে তোর বহে যে জীবন-ঢল
তারে বুকে লয়ে দুলে ওঠ তুই যৌবন-টলমল।
প্রস্তর-ভরা দুই কূল তোর ভেসে যাক বন্যায়,
হোক উর্বর, হাসিয়া উঠুক ফুলে ফলে সুষমায়।
− একবার পথ ভোল,
দূর সিন্ধুর লাগি বুকে জাগুক মরণ-দোল!
যৌবনজলতরঙ্গ
এই যৌবনজলতরঙ্গ রোধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ?
কে রোধিবি এই জোয়ারের টান গগনে যখন উঠেছে চাঁদ?
যে সিন্ধু-জলে ডাকিয়াছে বান – তাহারই তরে এ চন্দ্রোদয়,
বাঁধ বেঁধে থির আছে নালা ডোবা, চাঁদের উদয় তাদের নয়!
যে বান ডেকেছে প্রাণ-দরিয়ায়, মাঠে-ঘাটে-বাটে নেচেছে ঢল,
জীর্ণ শাখায় বসিয়া শকুনি শাপ দিক তারে অনর্গল।
সারস মরাল ছুটে আয় তোরা! ভাসিল কুলায় যে-বন্যায়
সেই তরঙ্গ ঝাঁপায়ে দোল রে সর্বনাশের নীল দোলায়!
খর স্রোতজলে কাদা-গোলা বলে গ্রীবা নাড়ে তীরে জরদ্গব,
গলিত শবের ভাগাড়ের ওরা, ওরা মৃত্যুর করে স্তব।
ওরাই বাহন জরা-মৃত্যুর, দেখিয়া ওদের হিংস্র চোখ –
রে ভোরের পাখি! জীবন-প্রভাতে গাহিবি না নব পুণ্য-শ্লোক?
ওরা নিষেধের প্রহরী পুলিশ, বিধাতার নয় – ওরা বিধির!
ওরাই কাফের, মানুষের ওরা তিলে তিলে শুষে প্রাণ-রুধির!
বল তোরা নবজীবনের ঢল! হোক ঘোলা – তবু এই সলিল
চির-যৌবন দিয়াছে ধরারে, গেরুয়া মাটিরে করেছে নীল!
নিজেদের চারধারে বাঁধ বেঁধে মৃত্যু-বীজাণু যারা জিয়ায়,
তারা কি চিনিবে – মহাসিন্ধুর উদ্দেশে ছোটে স্রোত কোথায়!
স্থাণু গতিহীন পড়ে আছে তারা আপনারে লয়ে বাঁধিয়া চোখ
কোটরের জীব, উহাদের তরে নহে উদীচীর উষা-আলোক।
আলোক হেরিয়া কোটরে থাকিয়া চ্যাঁচায় প্যাঁচারা, ওরা চ্যাঁচাক।
মোরা গাব গান, ওদেরে মারিতে আজও বেঁচে আছে দেদার কাক!
জীবনে যাদের ঘনাল সন্ধ্যা, আজ প্রভাতের শুনে আজান
বিছানায় শুয়ে যদি পাড়ে গালি, দিক গালি – তোরা দিসনে কান।
উহাদের তরে হতেছে কালের গোরস্থানে রে গোর খোদাই,
মোদের প্রাণের রাঙা জলসাতে জরা-জীর্ণের দাওত নাই।
জিঞ্জির-পায়ে দাঁড়ে বসে টিয়া চানা খায়, গায় শিখানো বোল,
আকাশের পাখি! ঊর্ধ্বে উঠিয়া কণ্ঠে নতুন লহরি তোল!
তোরা ঊর্ধ্বের – অমৃত-লোকের, ছুড়ুক নীচেরা ধুলাবালি,
চাঁদেরে মলিন করিতে পারে না কেরোসিনি ডিবেকালি ঢালি!
বন্য-বরাহ পঙ্ক ছিটাক, পাঁকের ঊর্ধ্বে তোরা কমল,
ওরা দিক কাদা, তোরা দে সুবাস, তোরা ফুল – ওরা পশুর দল!
তোদের শুভ্র গায়ে হানে ওরা আপন গায়ের গলিজ পাঁক,
যার যা দেবার সে দেয় তাহাই, স্বর্গের শিশু সহিয়া থাক!
শাখা ভরে আনে ফুল-ফল, সেথা নীড় রচি গাহে পাখিরা গান,
নীচের মানুষ তাই ছোঁড়ে ঢিল, তরুর নহে সে অসম্মান।
কুসুমের শাখা ভাঙে বাঁদরের উৎপাতে, হায়, দেখিয়া তাই –
বাঁদর খুশিতে করে লাফালাফি, মানুষ আমরা লজ্জা পাই!
মাথার ঘায়েতে পাগল উহারা, নিসনে তরুণ ওদের দোষ!
কাল হবে বার জানাজা যাহার, সে-বুড়োর পরে বৃথা এ রোষ!
যে-তরবারির পুণ্যে আবার সত্যেরে তোরা দানিবি তখ্ত্,
ছুঁচো মেরে তার খোয়াসনে মান, পুরায়ে এসেছে ওদের ওক্ত্ !
যে বন কাটিয়া বসাবি নগর তাহার শাখার দুটো আঁচড়
লাগে যদি গায়, সয়ে যা না ভাই, আছে তো কুঠার হাতের পর!
যুগে যুগে ধরা করেছে শাসন গর্বদ্ধত যে যৌবন –
মানেনি কখনও, আজও মানিবে না বৃদ্ধত্বের এই শাসন।
আমরা সৃজিব নতুন জগৎ, আমরা গাহিব নতুন গান,
সম্ভ্রমে-নত এই ধরা নেবে অঞ্জলি পাতি মোদের দান।
যুগে যুগে জরা বৃদ্ধত্বেরে দিয়াছি কবর মোরা তরুণ –
ওরা দিক গালি, মোরা হাসি খালি বলিব ‘ইন্না…. রাজেউন!’
রীফ – সর্দার
তোমারে আমরা ভুলেছি আজ,
হে নবযুগের নেপোলিয়ন,
কোন সাগরের কোন সে পার
নিবু-নিবু আজ তব জীবন।
তোমার পরশে হল মলিন
কোন সে দ্বীপের দীপালি-রাত,
বন্দিছে পদ সিন্ধুজল,
ঊর্ধ্বে শ্বসিছে ঝঞ্ঝাবাত।
তব অপমানে, বন্দি-রাজ,
লজ্জিত সারা নর-সমাজ,
কৃতঘ্নতা ও অবিশ্বাস
আজি বীরত্বে হানিছে লাজ।
মোরা জানি আর জানি জগৎ
শত্রু তোমারে করেনি জয়,
পাপ অন্যায় কপট ছল
হইয়াছে জয়ী, শত্রু নয়!
সম্মুখে রাখি মায়া-মৃগ
পশ্চাৎ হতে হানে শায়ক –
বীর নহে তারা ঘৃণ্য ব্যাধ
বর্বর তারা নর-ঘাতক।
হে মরু-কেশরী আফ্রিকার!
কেশরীর সাথে হয়নি রণ,
তোমারে বন্দি করেছে আজ
সভ্য ব্যাধের ফাঁদ গোপন।
কামানের চাকা যথা অচল
রৌপ্যের চাকি ঢালে সেথায়,
এরাই য়ুরোপি বীরের জাত
শুনে লজ্জাও লজ্জা পায়!
তুমি দেখাইলে, আজও ধরায়
শুধু খ্রিস্টের রাসভ নাই,
আজও আসে হেথা বীর মানব,
ইবনে – করিম কামাল -ভাই।
আজও আসে হেথা ইবনে-সৌদ,
আমানুল্লাহ্ , পহ্লবী ,
আজও আসে হেথা আলতরাশ ,
আসে সনৌসী – লাখ রবি।
তুমি দেখাইলে, পাহাড়ি গাঁয়
থাকে নাকো শুধু পাহাড়ি মেষ,
পাহাড়েও হাসে তরুলতা
পাহাড়ের মতো অটল দেশ।
থাকে নাকো সেথা শুধু পাথর,
সেথা থাকে বীর-শ্রেষ্ঠ নর,
সেথা বন্দরে বানিয়া নাই
সেথা বন্দরে নাই বাঁদর!
শির-দার তুমি ছিলে রীফের,
পরনিকো শিরে শরিফি তাজ,
মামুলি সেনার সাথে সমান
করেছ সেনানী, কুচকাওয়াজ!
শুধু বীর নহ, তুমি মানুষ,
শাহি তখ্ত্ ছিল গিরি-পাষাণ,
রণভূমে ছিলে রণোন্মাদ,
দেশে ছিলে দোস্ত্ মেহেরবান।
রীফেতে যেদিন সভ্য ভূত
নাচিতে লাগিল তাথই থই,
আশমান হতে রীফ-বাসীর
শিরে ছড়াইল আগুন-খই,
কচি বাচ্চারে নারীদেরে
মারিল বক্ষে বিঁধে সঙিন,
যুদ্ধে আহত বন্দিরে
খুন করে যার হাত রঙিন,
হয়েছে বন্দি তাহারা যখন –
(ওদের ভাষায় – হে ‘বর্বর’।)
করিয়াছ ক্ষমা তাহাদেরে,
তাহাদের করে রেখেছ কর।
ওগো বীর! বীর বন্দিদের,
করনিকো তুমি অসম্মান,
তাদের নারী ও শিশুদেরে
দিয়েছ ফিরায়ে – হয়নি প্রাণ।
তুমি সভ্যতা-গর্বীদের
মিটাওনি শুধু যুদ্ধ-সাধ,
তাদেরে শিখালে মানবতা,
বীরও সে মানুষ, নহে নিষাদ।
বীরেরে আমরা করি সালাম,
শ্রদ্ধায় চুমি দস্ত্ দারাজ,
তোমারে স্মরিয়া কেন যেন
কেবলই অশ্রু ঝরিছে আজ।
তব পতনের কথা করুণ
পড়িতেছে মনে একে একে,
তব মহত্ত্ব তুমি নিজে
মানুষের বুকে গেলে লেখে।
মাসতুতো ভাই চোরে চোরে –
ফ্রান্স স্পেন করি আঁতাত
হয়ে লাঞ্ছিত বারংবার
হায়ওয়ান সাথে মিলাল হাত।
শয়তানি ছল ফেরেব-বাজ
ভুলাল দেশদ্রোহীর মন,
অর্থ তাদের করিল জয়
অস্ত্রে যাহারা জিনিল রণ।
স্বদেশবাসীরে কহো ডাকে
অশ্রু-সিক্ত নয়নে, হায় –
‘ভাঙে নাই বাহু, ভেঙেছে মন,
বিদায় বন্ধু, চির-বিদায়!’
বলিলে, ‘স্বদেশ! রীফ-শরিফ!’
পরানের চেয়ে প্রিয় আমার!
তুমি চেয়েছিলে মা আমায়,
সন্তান তব চাহে না আর!
‘মাগো তোরে আমি ভালোবাসি,
ভালোবাসি মা তারও চেয়ে –
মোর চেয়ে প্রিয় রীফ-বাসী
তোর এ পাহাড়ি ছেলেমেয়ে!
‘মাগো আজ তারা বোঝে যদি,
করিতেছি ক্ষতি আমি তাদের,
আমি চলিলাম, দেখিস তুই,
তারা যেন হয় আজাদ ফের!’
দেশবাসী-তরে, মহাপ্রেমিক,
আপনারে বলি দেলে তুমি,
ধন্য হইল বেড়ি-শিকল
তোমার দস্ত্-পদ চুমি!
আজিকে তোমায় বুকে ধরি
ধন্য হইল সাগর-দ্বীপ,
ধন্য হইল কারা-প্রাচীর,
ধন্য হইনু বদ-নসিব।
কাঠ-মোল্লার মউলবির
যুজদানে ইসলাম কয়েদ,
আজও ইসলাম আছে বেঁচে
তোমাদেরই বরে, মোজাদ্দেদ!
বদ-কিসমত শুধু রীফের
নহে বীর, ইসলাম-জাহান
তোমারে স্মরিয়া কাঁদিছে আজ,
নিখিল গাহিছে তোমার গান।
হে শাহানশাহ্ বন্দিদের!
লাঞ্ছিত যুগে যুগাবতার!
তোমার পুণ্যে তীর্থ আজ
হল গো কারার অন্ধকার!
তোমার পুণ্যে ধন্য আজ
মরু-আফ্রিকা মূর-আরব,
ধন্য হইল মুসলমান,
অধীন বিশ্ব করে স্তব।
জানি না আজিকে কোথা তুমি
নয়ি দুনিয়ার মুসা তারিক !
আছে ‘দীন’, নাই সিপা-সালার ,
আছে শাহি তখ্ত্, নাই মালিক।
মোরা যে ভুলেছি, ভুলিয়ো বীর,
নাই স্মরণের সে অধিকার,
কাঁদিছে কাফেলা কারবালায়,
কে গাহিবে গান বন্দনার!
আজিকে জীবন-‘ফোরাত’ -তীর
এজিদের সেনা ঘিরিয়া ওই,
শিরে দুর্দিন-রবি প্রখর,
পদতলে বালু ফোটায় খই।
জয়নালসম মোরা সবাই
শুইয়া বিমারি খিমার মাঝ,
আপশোশ করি কাঁদি শুধু,
দুশমন করে লুটতরাজ!
আব্বাস-সম তুমি হে বীর
গেন্ডুয়া খেলি অরি-শিরে
পঁহুছিলে একা ফোরাত-তীর,
ভরিলে মশক প্রাণ-নীরে।
তুমি এলে, সাথে এল না দস্ত্,
করিল শত্রু বাজু শহিদ,
তব হাত হতে আব-হায়াত
লুটে নিল ইউরোপ-এজিদ।
কাঁদিতেছি মোরা তাই শুধুই
দুর্ভাগ্যের তীরে বসি,
আকাশে মোদের ওঠে কেবল
মোহররমের লাল শশী!
এরই মাঝে কভু হেরি স্বপন –
ওই বুঝি আসে খুশির ঈদ,
শহিদ হতে তো পারি না কেউ –
দেখি কে কোথায় হল শহিদ।
ক্ষমিয়ো বন্ধু, তব জাতের
অক্ষমতার এ অপরাধ,
তোমারে দেখিয়া হাঁকি সালাত ,
ওগো মগ্রেবী ঈদের চাঁদ!
এ গ্লানি লজ্জা পরাজয়ের
নহে বীর, নহে তব তরে!
তিলে তিলে মরে ভীরু য়ুরোপ
তব সাথে তব কারা-ঘরে।
বন্দি আজিকে নহ তুমি,
বন্দি – দেশের অবিশ্বাস!
আসিছে ভাঙিয়া কারা-দুয়ার
সর্বগ্রাসীর সর্বনাশ!
শরৎচন্দ্র
(চণ্ডবৃষ্টি-প্রপাত ছন্দ)
নব ঋত্বিক নবযুগের!
নমস্কার! নমস্কার!
আলোকে তোমার পেনু আভাস
নওরোজের নব উষার!
তুমি গো বেদনা-সুন্দরের
দর্দ্-ই-দিল্, নীল মানিক,
তোমার তিক্ত কণ্ঠে গো
ধ্বনিল সাম বেদনা-ঋক।
হে উদীচী উষা চির-রাতের,
নরলোকের হে নারায়ণ!
মানুষ পারায়ে দেখিলে দিল্ –
মন্দিরের দেব-আসন।
শিল্পী ও কবি আজ দেদার
ফুলবনের গাইছে গান,
আশমানি-মউ স্বপনে গো
সাথে তাদের করনি পান।
নিঙারিয়া ধুলা মাটির রস
পিইলে শিব নীল আসব,
দুঃখ কাঁটায় ক্ষত হিয়ার
তুমি তাপস শোনাও স্তব।
স্বর্গভ্রষ্ট প্রাণধারায়
তব জটায় দিলে গো ঠাঁই,
মৃত সাগরের এই সে দেশ
পেয়েছে প্রাণ আজিকে তাই।
পায়ে দলি পাপ সংস্কার
খুলিলে বীর স্বর্গদ্বার,
শুনাইলে বাণী, ‘নহে মানব –
গাহি গো গান মানবতার।
মনুষ্যত্ব পাপী তাপীর
হয় না লয়, রয় গোপন,
প্রেমের জাদু-স্পর্শে সে
লভে অমর নব জীবন!’
নির্মমতায় নর-পশুর
হায় গো যার চোখের জল
বুকে জমে হল হিম-পাষাণ,
হল হৃদয় নীল গরল ;
প্রখর তোমার তপ-প্রভায়
বুকের হিম গিরি-তুষার –
গলিয়া নামিল প্রাণের ঢল,
হল নিখিল মুক্ত-দ্বার।
শুভ্র হল গো পাপ-মলিন
শুচি তোমার সমব্যথায়,
পাঁকের ঊর্ধ্বে ফুটিল ফুল
শঙ্কাহীন নগ্নতায়!
শাস্ত্র-শকুন নীতি-ন্যাকার
রুচি-শিবার হট্টরোল
ভাগাড়ে শ্মশানে উঠিল ঘোর,
কাঁদে সমাজ চর্মলোল!
ঊর্ধ্বে যতই কাদা ছিটায়
হিংসুকের নোংরা কর
সে কাদা আসিয়া পড়ে সদাই
তাদেরই হীন মুখের পর!
চাঁদে কলঙ্ক দেখে যারা
জ্যোৎস্না তার দেখেনি, হায়!
ক্ষমা করিয়াছ তুমি, তাদের
লজ্জাহীন বিজ্ঞতায়!
আজ যবে সেই পেচক-দল
শুনি তোমার করে স্তব,
সেই তো তোমার শ্রেষ্ঠ জয়,
নিন্দুকের শঙ্খ-রব!
ধর্মের নামে যুধিষ্ঠির
‘ইতি গজের’ করুক ভান!
সব্যসাচী গো, ধরো ধনুক –
হানো প্রখর অগ্নিবাণ!
‘পথের দাবি’র অসম্মান
হে দুর্জয়, করো গো ক্ষয়!
দেখাও স্বর্গ তব বিভায়
এই ধুলার ঊর্ধ্বে নয়!
দেখিছ কঠোর বর্তমান,
নয় তোমার ভাব-বিলাস,
তুমি মানুষের বেদনা-ঘায়
পাওনি গো ফুল-সুবাস।
তোমার সৃষ্টি মৃত্যুহীন
নব ধরার জীবন-বেদ,
করনি মানুষে অবিশ্বাস
দেখিয়া পাপ পঙ্ক ক্লেদ।
পুষ্পবিলাস নয় তোমার
পাওনি তাই পুষ্প-হার,
বেদনা-আসনে বসায়ে আজ
করে নিখিল পূজা তোমার!
অসীম আকাশে বাঁধনি ঘর
হে ধরণির নীল দুলাল!
তব সাম-গান ধুলামাটির
রবে অমর নিত্যকাল!
হয়তো আসিবে মহাপ্রলয়
এ দুনিয়ার দুঃখ-দিন
সব যাবে শুধু রবে তোমার
অশ্রুজল অন্তহীন।
অথবা যেদিন পূর্ণতায়
সুন্দরের হবে বিকাশ,
সেদিনও কাঁদিয়া ফিরিবে এই
তব দুখের দীর্ঘশ্বাস।
মানুষের কবি! যদি মাটির
এই মানুষ বাঁচিয়া রয় –
রবে প্রিয় হয়ে হৃদি-ব্যাথায়,
সর্বলোক গাহিবে জয়!
সন্ধ্যা
− সাতশো বছর ধরি
পূর্ব-তোরণ-দুয়ারে চাহিয়া জাগিতেছি শর্বরী।
লজ্জায় রাঙা ডুবিল যে রবি আমাদের ভীরুতায়,
সে মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত করি যুগে যুগে হায় !
মোদের রুধিরে রাঙাইয়া তুলি মৃত্যুরে নিশিদিন,
শুধিতেছি মোরা পলে পলে ভীরু পিতা-পিতামহ-ঋণ !
লক্ষ্মী ! ওগো মা ভারত-লক্ষ্মী ! বল, কতদিনে, বল, −
খুলিবে প্রাচী-র রুদ্ধ-দুয়ার-মন্দির-অর্গল ?
যে পরাজয়ের গ্লানি মুখে মাখি ডুবিল সন্ধ্যা-রবি,
সে গ্লানি মুছিতে শত শতাব্দী দিতেছি মা প্রাণ-হবি!
কোটি লাঞ্ছনা-রক্ত-ললাট পুব-মন্দিরদ্বারে
মুছে যায় নিতি ললাট-রক্ত রাঙাতে পূর্বাশারে,
‘ওই এল উষা’ ফুকারে ভারত হেরি সে রক্তরেখা,
যে আশার বাণী লিখি মা রক্তে, বিধাতা মুছে সে লেখা !
সন্ধ্যা কি কাটিবে না ?
কত সে জনম ধরিয়া শুধিব এক জনমের দেনা ?
কোটি কর ভরি কোটি রাঙা হৃদি-জবা লয়ে করি পূজা,
না দিস আশিস, চণ্ডীর বেশে নেমে আয় দশভুজা !
মোদের পাপের নাহি যদি ক্ষয়, যদি না প্রভাত হয়,
প্রলয়ংকরী বেশে আসি কর ভীরুর ভারত লয় !
অসুরের হাতে লাঞ্ছনা আর হানিসনে শংকরী,
মরিতেই যদি হয় মা, দে বর, দেবতার হাতে মরি !
সুরের দুলাল
পাকা ধানের গন্ধ-বিধুর হেমন্তের এই দিন-শেষে,
সুরের দুলাল, আসলে ফিরে দিগ্বিজয়ীর বর-বেশে!
আজও মালা হয়নি গাঁথা হয়নি আজও গান-রচন,
কুহেলিকার পর্দা-ঢাকা আজও ফুলের সিংহাসন।
অলস বেলায় হেলাফেলায় ঝিমায় রূপের রংমহল,
হয়নিকো সাজ রূপকুমারীর, নিদ টুটেছে এই কেবল।
আয়োজনের অনেক বাকি – শুননু হঠাৎ খোশখবর,
ওরে অলস, রাখ আয়োজন, সুর-শাজাদা আসল ঘর।
ওঠ রে সাকি, থাক না বাকি ভরতে রে তোর লাল গেলাস,
শূন্য গেলাস ভরব – দিয়ে চোখের পানি মুখের হাস।
দম্ভ ভরে আসল না যে ধ্বজায় বেঁধে ঝড়-তুফান,
যাহার আসার খবর শুনে গর্জাল না তোপ-কামান,
কুসুম দলি উড়িয়ে ধূলি আসল না যে রাজপথে –
আয়োজনের আড়াল তারে করব গো আজ কোনোমতে।
সে এল গো যে-পথ দিয়ে স্বর্গে বহে সুরধুনী,
যে-পথ দিয়ে ফেরে ধেনু মাঠের বেণুর রব শুনি।
যেমন সহজ পথ দিয়ে গো ফসল আসে আঙিনায়,
যেমন বিনা সমারোহে সাঁঝের পাখি যায় কুলায়।
সে এল যে আমন-ধানের নবান্ন উৎসব-দিনে,
হিমেল হাওয়ায় অঘ্রানের এই সুঘ্রাণেরই পথ চিনে।
আনেনি সে হরণ করে রত্ন-মানিক সাত-রাজার
সে এনেছে রূপকুমারীর আঁখির প্রসাদ, কণ্ঠহার।
সুরের সেতু বাঁধল সে গো, ঊর্ধ্বে তাহার শুনি স্তব,
আসছে ভারত-তীর্থ লাগি শ্বেত-দ্বীপের ময়দানব।
পশ্চিমে আজ ডঙ্কা বাজে পুবের দেশের বন্দিদের,
বীণার গানে আমরা জয়ী, লাজ মুছেছি অদৃষ্টের।
কন্ঠ তোমার জাদু জানে, বন্ধু ওগো দোসর মোর!
আসলে ভেসে গানের ভেলায় বৃন্দাবনের বংশী-চোর।
তোমার গলার বিজয়-মালা বন্ধু একা নয় তোমার,
ওই মালাতে রইল গাঁথা মোদের সবার পুরস্কার।
কখন আঁখির অগোচরে বসলে জুড়ে হৃদয়-মন,
সেই হৃদয়ের লহো প্রীতি, সজল আঁখির জল-লিখন।