- বইয়ের নামঃ সর্বহারা
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
কাণ্ডারী হুশিয়ার!
১
দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার!
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভূলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!
২
তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান!
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে, নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার!!
৩
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানেনা সন্তরণ,
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!
৪
গিরি-সংকট, ভীরু যাত্রীরা, গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ
কান্ডারী! তুমি ভূলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
‘করে হানাহানি, তবু চল টানি’, নিয়াছ যে মহাভার!
৫
কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙ্গালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।
৬
ফাঁসির মঞ্চে যারা গেয়ে গেল জীবনের জয়গান,
আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান?
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রান?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার!
—————–
কৃষ্ণনগর; ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৩
কুলি-মজুর
দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে,
বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?
রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা
কার খুনে রাঙা?-ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি হঁটে আছে লিখা।
তুমি জান না ক’, কিন- পথের প্রতি ধূলিকণা জানে,
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!
আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!
তুমি শুয়ে র’বে তেতালার পরে আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে!
সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে
এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে!
তারি পদরজ অঞ্জলি করি’ মাথায় লইব তুলি’,
সকলের সাথে পথে চলি’ যার পায়ে লাগিয়াছে ধূলি!
আজ নিখিলের বেদনা -আর্ত পীড়িতের মাখি’ খুন,
লালে লাল হ’য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ!
আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক্ এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!
সকল আকাশ ভাঙিয়া পড়-ক আমাদের এই ঘরে,
মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়-ক ঝ’রে।
সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি’
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!
মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান,
উর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান!
কৃষাণের গান
ওঠ রে চাষি জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল।
আমরা মরতে আছি – ভালো করেই মরব এবার চল॥
মোদের উঠান-ভরা শস্য ছিল হাস্য-ভরা দেশ
ওই বৈশ্য দেশের দস্যু এসে লাঞ্ছনার নাই শেষ,
ও ভাই লক্ষ হাতে টানছে তারা লক্ষ্মী মায়ের কেশ,
আজ মা-র কাঁদনে লোনা হল সাত সাগরের জল॥
ও ভাই আমরা ছিলাম পরম সুখী, ছিলাম দেশের প্রাণ
তখন গলায় গলায় গান ছিল ভাই, গোলায় গোলায় ধান,
আজ কোথায় বা সে গান গেল ভাই কোথায় সে কৃষাণ?
ও ভাই মোদের রক্ত জল হয়ে আজ ভরতেছে বোতল।
আজ চারদিক হতে ধনিক বণিক শোষণকারীর জাত
ও ভাই জোঁকের মতন শুষছে রক্ত, কাড়ছে থালার ভাত,
মোর বুকের কাছে মরছে খোকা, নাইকো আমার হাত।
আর সতী মেয়ের বসন কেড়ে খেলছে খেলা খল॥
ও ভাই আমরা মাটির খাঁটি ছেলে দূর্বাদল-শ্যাম,
আর মোদের রূপেই ছড়িয়ে আছেন রাবণ-অরি রাম,
ওই হালের ফলায় শস্য ওঠে, সীতা তাঁরই নাম,
আজ হরছে রাবণ সেই সীতারে – সেই মাঠের ফসল॥
ও ভাই আমরা শহিদ, মাঠের মক্কায় কোরবানি দিই জান।
আর সেই খুনে যে ফলছে ফসল, হরছে তা শয়তান।
আমরা যাই কোথা ভাই, ঘরে আগুন বাইরে যে তুফান!
আজ চারিদিক হতে ঘিরে মারে এজিদ রাজার দল॥
আজ জাগ রে কৃষাণ, সব তো গেছে, কীসের বা আর ভয়,
এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়।
ওই বিশ্বজয়ী দস্যুরাজার হয়-কে করব নয়,
ওরে দেখবে এবার সভ্যজগৎ চাষার কত বল॥
হুগলি
অগ্রহায়ণ, ১৩৩২
গোকুল নাগ
না ফুরাতে শরতের বিদায়-শেফালি,
না নিবিতে আশ্বিনের কমল-দীপালি,
তুমি শুনেছিলে বন্ধু পাতা-ঝরা গান
ফুলে ফুলে হেমনে-র বিদায়-আহবান!
অতন্দ্র নয়নে তব লেগেছিল চুম
ঝর-ঝর কামিনীর, এল চোখে ঘুম
রাত্রিময়ী রহস্যের; ছিন্ন শতদল
হ’ল তব পথ-সাথী; হিমানী-সজল
ছায়াপথ-বিথী দিয়া শেফালি দলিয়া
এল তব মায়া বধূ ব্যথা-জাগানিয়া!
এল অশ্রু হেমনে-র,এল ফুল-খসা
শিশির-তিমির-রাত্রি; শ্রান- দীর্ঘশ্বাসা
ঝাউ-শাখে সিক্ত বায়ু ছায়া-কুহেলির
অশ্রু-ঘন মায়া-আঁখি, বিরহ-অথির
বুকে তব ব্যথা-কীট পশিল সেদিন!
যে-কান্না এল না চোখে, মর্মে হ’ল লীন,
বক্ষে তাহা নিল বাসা, হ’ল রক্তে রাঙা
আশাহীন ভালবাসা, ভাষা অশ্রু-ভাঙা!
বন্ধু, তব জীবনের কুমারী আশ্বিন
পরিল বিধবা বেশ করে কোন্ দিন,
কোন্ দিন সেঁউতির মালা হ’তে তার
ঝ’রে গেল বৃন-গুলি রাঙা কামনার-
জানি নাই; জানি নাই, তোমার জীবনে
হাসিছে বি”েছদ-রাত্রি, অজানা গহনে
এবে যাত্রা শুরু তব, হে পথ-উদাসী!
কোন্ বনান-র হ’তে ঘর-ছাড়া বাঁশী
ডাক দিল, তুমি জান। মোরা শুধু জানি
তব পায়ে কেঁদেছিল সারা পথখানি!
সেধেছিল, এঁকেছিল ধূলি-তুলি দিয়া
তোমার পদাঙ্ক-স্মৃতি।
রহিয়া রহিয়া
কত কথা মনে পড়ে! আজ তুমি নাই,
মোরা তব পায়ে-চলা পথে শুধু তাই
এসেছি খুঁজিতে সেই তপ্ত পদ-রেখা,
এইখানে আছে তব ইতিহাস লেখা।
জানি না ক’ আজ তুমি কোন্ লোকে রহি’
শুনিছ আমার গান হে কবি বিরহী!
কোথা কোন্ জিজ্ঞাসার অসীম সাহারা,
প্রতীক্ষার চির-রাত্রি, চন্দ্র, সুর্য, তারা,
পারায়ে চলেছ একা অসীম বিরহে?
তব পথ-সাথী যারা-পিছু ডাকি’ কহে,
‘ওগো বন্ধু শেফালির, শিশিরের প্রিয়!
তব যাত্রা-পথে আজ নিও বন্ধু নিও
আমাদের অশ্রু-আর্দ্র এ স্মরণখানি!’
শুনিতে পাও কি তুমি, এ-পারে ও-পারে?
এ কাহার শব্দ শুনি মনের বেতারে?
কতদূরে আছ তুমি কোথা কোন্ বেশে?
লোকান-রে, না সে এই হৃদয়েরি দেশে
পারায়ে নয়ন-সীমা বাঁধিয়াছ বাসা?
হৃদয়ে বসিয়া শোন হৃদয়ের ভাষা?
হারায়নি এত সূর্য এত চন্দ্র তারা,
যেথা হোক আছ বন্ধু, হওনি ক’ হারা!
সেই পথ, সেই পথ-চলা গাঢ় স্মৃতি,
সব আছে! নাই শুধু সেই নিতি নিতি
নব নব ভালোবাসা প্রতি দরশনে,
আরো প্রিয় ক’রে পাওয়া চির প্রিয়জনে-
আদি নাই, অন- নাই, ক্লানি- তৃপ্তি নাই-
যত পাই তত চাই-আরো আরো চাই,-
সেই নেশা, সেই মধু নাড়ী-ছেঁড়া টান
সেই কল্পলোকে নব নব অভিযান,-
সব নিয়ে গেছ বন্ধু! সে কল-কল্লোল,
সে হাসি-হিল্লোল নাই চিত-উতরোল!
আজ সেই প্রাণ-ঠাসা একমুঠো ঘরে
শূন্যের শূন্যতা রাজে, বুক নাহি ভরে!….
হে নবীন, অফুরন- তব প্রাণ-ধারা।
হয়ত এ মরু-পথে হয়নি ক’ হারা,
হয়ত আবার তুমি নব পরিচয়ে
দেবে ধরা; হবে ধন্য তব দান ল’য়ে
কথা-সরস্বতী! তাহা ল’য়ে ব্যথা নয়,
কত বাণী এল, গেল, কত হ’ল লয়,
আবার আসিবে কত। শুধু মনে হয়
তোমারে আমরা চাই, রক্তমাংসময়!
আপনারে ক্ষয় করি’ যে অক্ষয় বাণী
আনিলে আনন্দ-বীর, নিজে বীণাপাণি
পাতি’ কর লবে তাহা, তবু যেন হায়,
হৃদয়ের কোথা কোন্ ব্যথা থেকে যায়!
কোথা যেন শূন্যতার নিঃশব্দ ক্রন্দন
গুমরি’ গুমরি’ ফেরে, হু-হু করে মন!
বাণী তব- তব দান- সে তা সকলের,
ব্যথা সেথা নয় বন্ধু! যে ক্ষতি একের
সেথায় সান-্বনা কোথা? সেথা শানি- নাই,
মোরা হারায়েছি,- বন্ধু, সখা, প্রিয়, ভাই।…
কবির আনন্দ-লোকে নাই দুঃখ-শোক,
সে-লোকে বিরহে যারা তারা সুখী হোক!
তুমি শিল্পী তুমি কবি দেখিয়াছে তারা,
তারা পান করে নাই তব প্রাণ-ধারা!
‘ পথিকে’ দেখেছে তা’রা, দেখেনি ‘গোকুলে’,
ডুবেনি ক’-সুখী তা রা-আজো তা’রা কূলে!
আজো মোরা প্রাণা”ছন্ন, আমরা জানি না
গোকুল সে শিল্পী গল্পী কবি ছিল কি-না!
আত্মীয়ে স্মরিয়া কাঁদি, কাঁদি প্রিয় তরে
গোকুলে পড়েছে মনে-তাই অশ্রু ঝরে!
না ফুরাতে আশা ভাষা, না মিটিতে ক্ষুধা,
না ফুরাতে ধরণীর মৃৎ-পাত্র-সুধা,
না পূরিতে জীবনের সকল আস্বাদ-
মধ্যাহ্নে আসিল দূত! যত তৃষ্ণা সাধ
কাঁদিল আঁকড়ি’ ধরা, যেতে নাহি চায়!
ছেড়ে যেতে যেন সব স্নায়ু ছিঁড়ে যায়!
ধরার নাড়ীতে পড়ে টান! তরুলতা
জল বায়ু মাটি সব কয় যেন কথা!
যেয়ো না ক’ যেয়ো না ক’ যেন সব বলে-
তাই এত আকর্ষণ এই জলে স’লে
অনুভব করেছিলে প্রকৃতি-দুলাল!
ছেড়ে যেতে ছিঁড়ে গেল বক্ষ, লালে লাল
হ’ল ছিন্ন প্রাণ! বন্ধু, সেই রক্ত ব্যথা
র’য়ে গেল আমাদের বুকে চেপে হেথা!
হে তরুণ, হে অরুণ, হে শিল্পী সুন্দর,
মধ্যাহ্ন আসিয়াছিলে সুমেরু-শিখর
কৈলাসের কাছাকাছি দারুণ তৃষ্ণায়,
পেলে দেখা সুন্দরের, স্বরগ-গঙ্গায়
হয়ত মিটেছে তৃষ্ণা, হয়ত আবার
ক্ষুধাতুর!-স্রোতে ভেসে এসেছে এ-পার
অথবা হয়ত আজ হে ব্যথা-সাধক,
অশ্রু-সরস্বতী কর্ণে তুমি কুরুবক!
হে পথিক-বন্ধু মোর, হে প্রিয় আমার,
যেখানে যে লোকে থাক/ করিও স্বীকার
অশ্রু-রেবা-কূলে মোর স্মৃতি-তর্পণ,
তোমারে অঞ্জলি করি’ করিনু অর্পণ!
সুন্দরের তপস্যায় ধ্যানে আত্মহারা
দারিদ্র্যে দর্প তেজ নিয়া এল যারা,
যারা চির-সর্বহারা করি’ আত্মদান,
যাহারা সৃজন করে, করে না নির্মাণ,
সেই বাণীপুত্রদের আড়ম্বরহীন
এ-সহজ আয়োজন এ-স্মরণ-দিন
স্বীকার করিও কবি, যেমন স্বীকার
ক’রেছিলে তাহাদের জীবনে তোমার!
নহে এরা অভিনেতা, দেশ-নেতা নহে,
এদের সৃজন-কুঞ্জ অভাবে, বিরহে,
ইহাদের বিত্ত নাই, পুঁজি চিত্তদল,
নাই বড় আয়োজন,নাই কোলাহল;
আছে অশ্রু, আছে প্রীতি, আছে বক্ষ-ক্ষত,
তাই নিয়ে সুখী হও, বন্ধু স্বর্গগত!
গড়ে যারা, যারা করে প্রাসাদ নির্মাণ
শিরোপা তাদের তরে, তাদের সম্মান।
দু’দিনে ওদের গড়া প’ড়ে ভেঙে যায়
কিন’ স্রষ্টা সম যারা গোপনে কোথায়
সৃজন করিছে জাতি, সৃজিছে মানুষ
অচেনা রহিল তা’রা। কথার ফানুস
ফাঁপাইয়া যারা যত করে বাহাদুরী,
তারা তত পাবে মালা যমের কস’রী!
‘আজ’টাই সত্য নয়, ক’টা দিন তাহা?
ইতিহাস আছে, আছে অবিষ্যৎ, যাহা
অনন- কালের তরে রচে সিংহাসন,
সেখানে বসাবে তোমা বিশ্বজনগণ।
আজ তারা নয় বন্ধু, হবে সে তখন,-
পূজা নয়-আজ শুধু করিনু স্মরণ।
ছাত্রদলের গান
আমরা শক্তি আমরা বল
আমরা ছাত্রদল।
মোদের পায়ের তলায় মুর্সে তুফান
উর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।
আমরা ছাত্রদল।।
মোদের আঁধার রাতে বাধার পথে
যাত্রা নাঙ্গা পায়,
আমরা শক্ত মাটি রক্তে রাঙাই
বিষম চলার ঘায়!
যুগে-যুুগে রক্তে মোদের
সিক্ত হ’ল পৃথ্বীতল!
আমরা ছাত্রদল।।
মোদরে কক্ষচ্যুত ধুমকেতু-প্রায়
লক্ষহারা প্রাণ,
আমরা ভাগ্যদেবীর যজ্ঞবেদীর
নিত্য বলিদান।
যখন লক্ষ্মীদেবী স্বর্গে ওঠেন,
আমরা পশি নীল অতল,
আমরা ছাত্রদল।।
আমরা ধরি মৃত্যু-রাজার
যজ্ঞ-ঘোড়ার রাশ,
মোদের মৃত্যু লেখে মোদের
জীবন-ইতিহাস!
হাসির দেশে আমরা আনি
সর্বনাশী চোখের জল।
আমরা ছাত্রদল।।
সবাই যখন বুদ্ধি যোগায়,
আমরা করি ভুল।
সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে সব,
আমরা ভাঙি কূল।
দার”ণ-রাতে আমরা তর”ণ
রক্তে করি পথ পিছল!
আমরা ছাত্রদল।।
মোদের চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল
বক্ষে ভরা বাক্,
কন্ঠে মোদের কুন্ঠ বিহীন
নিত্য কালের ডাক।
আমরা তাজা খুনে লাল ক’রেছি
সরস্বতীর শ্বেত কমল।
আমরা ছাত্রদল।।
ঐ দারুণ উপপ্লাবের দিনে
আমরা দানি শির,
মোদের মাঝে মুক্তি কাঁদে
বিংশ শতাব্দীর!
মোরা গৌরবেরি কান্না দিয়ে
ভ’রেছি মা’র শ্যাম আঁচল।
আমরা ছাত্রদল।।
আমরা রচি ভালোবাসার
আশার ভবিষ্যৎ
মোদের স্বর্গ-পথের আভাস দেখায়
আকাশ-ছায়াপথ!
মোদের চোখে বিশ্ববাসীর
স্বপ্ন দেখা হোক সফল।
আমরা ছাত্রদল।।
ধীবরদের গান
আমরা নীচে পড়ে রইব না আর
শোন রে ও ভাই জেলে,
এবার উঠব রে সব ঠেলে!
ওই বিশ্ব-সভায় উঠল সবাই রে,
ওই মুটে মজুর হেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
আজ সবার গায়ে লাগছে ব্যথা
সবাই আজই কইছে কথা রে,
আমরা এমনি মরা, কই নে কিছু
মড়ার লাথি খেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
আমরা মেঘের ডাকে জেগে উঠে
পানসিতে পাল তুলি।
আমরা ঝড়-তুফানে সাগর-দোলার
নাগরদোলায় দুলি।
ও ভাই আকাশ মোদের ছত্র ধরে
বাতাস মোদের বাতাস করে রে।
আমরা সলিল অনিল নীল গগনে
বেড়াই পরান মেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
হায় ভাই রে, মোদের ঠাঁই দিল না
আপন মাটির মায়ে
তাই জীবন মোদের ভেসে বেড়ায়
ঝড়ের মুখে নায়ে।
ও ভাই নিত্য-নূতন হুকুম জারি
করছে তাই সব অত্যাচারী রে,
তারা বাজের মতন ছোঁ মেরে খায়
আমরা মৎস্য পেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
আমরা তল করেছি কতই সে ভাই
অথই নদীর জল,
ও ভাই হাজার করেও ওই হুজুরদের
পাইনে মনের তল।
আমরা অতল জলের তলা থেকে
রোহিত-মৃগেল আনি ছেঁকে রে,
এবার দৈত্য-দানব ধরব রে ভাই
ডাঙাতে জাল ফেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
আমরা পাথর-জলে ডুব-সাঁতার দিই
মরেও নাহি মরি,
আমরা হাঙর-কুমির-তিমির সাথে
নিত্য বসত করি।
ও ভাই জলের কুমির জয় করে কি
কুমির হল ঘরের ঢেঁকি রে,
ও ভাই মানুষ হতে কুমির ভালো
খায় না কাছে পেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
ও ভাই আমরা জলে জাল ফেলে রই,
হোথা ডাঙার পরে
আজ জাল ফেলেছে জালিম যত
জমাদারের চরে।
ও ভাই ডাঙার বাঘ ওই মানুষ-দেশে
ছেলে-মেয়ে ফেলে এসে রে,
আমরা বুকের আগুন নিবাই রে ভাই,
নয়ন-সলিল ঢেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
ও ভাই সপ্ত লক্ষ শির মোদের ভাই
চৌদ্দ লক্ষ বাহু,
ওরে গ্রাস করেছে তাদের ভাই আজ
চৌদ্দজনা রাহু।
যে চৌদ্দ লক্ষ হাত দিয়ে ভাই
সাগর মথে দাঁড় টেনে যাই রে,
সেই দাঁড় নিয়ে আজ দাঁড়া দেখি
মায়ের সাত লাখ ছেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
ও ভাই আমরা জলের জল-দেবতা,
বরুণ মোদের মিতা,
মোদের মৎস্যগন্ধার ছেলে ব্যাসদেব
গাইল ভারত-গীতা।
আমরা দাঁড়ের ঘায়ে পায়ের তলে
জলতরঙ্গ বাজাই জলে রে,
আমরা জলের মতন জল কেটে যাই,
কাটব দানব পেলে
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
অ আমরা খেপলা জাল আর ফেলব না ভাই,
একলা নদীর তীরে,
আয় এক সাথে ভাই সাত লাখ জেলে
ধর বেড়াজাল ঘিরে।
ওই চৌদ্দ লক্ষ দাঁড় কাঁধে ভাই
মল্লভূমির মল্ল-বীর আয়রে,
ওই আঁশ-বটিতে মাছ কাটি ভাই,
কাটব অসুর এলে!
এবার উঠব রে সব ঠেলে॥
কৃষ্ণনগর
২৪ ফাল্গুন, ১৩৩২
প্রার্থনা
[গান]
এসো যুগ-সারথি নিঃশঙ্ক নির্ভয়।
এসো চির-সুন্দর অভেদ অসংশয়।
জয় জয়।
জয় জয়।
এসো বীর অনাগত
বজ্র-সমুদ্যত।
এসো অপরাজেয় উদ্ধত নির্দয়।
জয় জয়।
জয় জয়।
হে মৌনী জন-গণ-
বেদনা-বিমোচন-
যুগ-সেনানায়ক! জাগো জ্যোতির্ময়।
জয় জয়।
জয় জয়।
ওঠে ক্রন্দন ওই,
এসো বন্ধন-জয়ী।
জাগে শিশু, মাগে আলো, এসো অরুণোদয়।
জয় জয়।
জয় জয়।
কলিকাতা
১ আশ্বিন ১৩৩২
ফরিয়াদ
এই ধরণীর ধূলি-মাখা তব অসহায় সন্তান
মাগে প্রতিকার, উত্তর দাও, আদি-পিতা ভগবান!-
আমার আঁখির দুখ-দীপ নিয়া
বেড়াই তোমার সৃষ্টি ব্যাপিয়া,
যতটুকু হেরি বিস্ময়ে মরি, ভ’রে ওঠে সারা প্রাণ!
এত ভালো তুমি? এত ভালোবাসা? এত তুমি মহীয়ান্?
ভগবান! ভগবান!
তোমার সৃষ্টি কত সুন্দর, কত সে মহৎ, পিতা!
সৃষ্টি-শিয়রে ব’সে কাঁদ তবু জননীর মতো ভীতা!
নাহি সোয়াসি-, নাহি যেন সুখ,
ভেঙে গড়ো, গড়ে ভাঙো, উৎসুক!
আকাশ মুড়েছ মরকতে-পাছে আঁখি হয় রোদে ম্লান।
তোমার পবন করিছে বীজন জুড়াতে দগ্ধ প্রাণ!
ভগবান! ভগবান!
রবি শশী তারা প্রভাত-সন্ধ্যা তোমার আদেশ কহে-
‘এই দিবা রাতি আকাশ বাতাস নহে একা কারো নহে।
এই ধরণীর যাহা সম্বল,-
বাসে-ভরা ফুল, রসে-ভরা ফল,
সু-স্নিগ্ধ মাটি, সুধাসম জল, পাখীর কন্ঠে গান,-
সকলের এতে সম অধিকার, এই তাঁর ফরমান!’
ভগবান! ভগবান!
শ্বেত পীত কালো করিয়া সৃজিলে মানবে, সে তব সাধ।
আমরা যে কালো, তুমি ভালো জান, নহে তাহা অপরাধ!
তুমি বল নাই, শুধু শ্বেতদ্বীপে
জোগাইবে আলো রবি-শশী-দীপে,
সাদা র’বে সবাকার টুঁটি টিপে, এ নহে তব বিধান।
সন-ান তব করিতেছে আজ তোমার অসম্মান!
ভগবান! ভগবান!
তব কনিষ্ঠ মেয়ে ধরণীরে দিলে দান ধুলা-মাটি,
তাই দিয়ে তার ছেলেদের মুখে ধরে সে দুধের বাটি!
ময়ূরের মতো কলাপ মেলিয়া
তার আনন্দ বেড়ায় খেলিয়া-
সন-ান তার সুখী নয়, তারা লোভী, তারা শয়তান!
ঈর্ষায় মাতি’ করে কাটাকাটি, রচে নিতি ব্যবধান!
ভগবান! ভগবান!
তোমারে ঠেলিয়া তোমার আসনে বসিয়াছে আজ লোভী,
রসনা তাহার শ্যামল ধরায় করিছে সাহারা গোবী!
মাটির ঢিবিতে দু’দিন বসিয়া
রাজা সেজে করে পেষণ কষিয়া!
সে পেষণে তারি আসন ধসিয়া রচিছে গোরস’ান!
ভাই-এর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে বীরের আখ্যা পান!
ভগবান! ভগবান!
জনগণে যারা জোঁক সম শোষে তারে মহাজন কয়,
সন-ান সম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়।
মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ,
মাটির মালিক তাঁহারাই হন-
যে যত ভন্ড ধড়িবাজ আজ সেই তত বলবান।
নিতি নব ছোরা গড়িয়া কসাই বলে জ্ঞান-বিজ্ঞান।
ভগবান! ভগবান!
অন্যায় রণে যারা যত দড় তারা তত বড় জাতি,
সাত মহারথী শিশুরে বধিয়া ফুলায় বেহায়া ছাতি!
তোমার চক্র রুধিয়াছে আজ
বেনের রৌপ্য-চাকায়, কি লাজ!
এত অনাচার স’য়ে যাও তুমি, তুমি মহা মহীয়ান্ ।
পীড়িত মানব পারে না ক’ আর, সবে না এ অপমান-
ভগবান! ভগবান!
ঐ দিকে দিকে বেজেছে ডঙ্কা শঙ্কা নাহি ক’ আর!
‘ মরিয়া’র মুখে মারণের বাণী উঠিতেছে ‘মার মার!’
রক্ত যা ছিল ক’রেছে শোষণ,
নীরক্ত দেহে হাড় দিয়ে রণ!
শত শতাব্দী ভাঙেনি যে হাড়, সেই হাড়ে ওঠে গান-
‘ জয় নিপীড়িত জনগণ জয়! জয় নব উত্থান!
জয় জয় ভগবান!’
তোমার দেওয়া এ বিপুল পৃথ্বী সকলে কবির ভোগ,
এই পৃথিবীর নাড়ী সাথে আছে সৃজন-দিনের যোগ।
তাজা ফুল ফলে অঞ্চলি পুরে
বেড়ায় ধরণী প্রতি ঘরে ঘুরে,
কে আছে এমন ডাকু যে হরিবে আমার গোলার ধান?
আমার ক্ষুধার অন্নে পেয়েছি আমার প্রাণের ঘ্রাণ-
এতদিনে ভগবান!
যে-আকাশে হ’তে ঝরে তব দান আলো ও বৃষ্টি-ধারা,
সে-আকাশ হ’তে বেলুন উড়ায়ে গোলাগুলি হানে কা’রা?
উদার আকাশ বাতাস কাহারা
করিয়া তুলিছে ভীতির সাহারা?
তোমার অসীম ঘিরিয়া পাহারা দিতেছে কা’র কামান?
হবে না সত্য দৈত্য-মুক্ত? হবে না প্রতিবিধান?
ভগবান! ভগবান!
তোমার দত্ত হসে-রে বাঁধে কোন্ নিপীড়ন-চেড়ী?
আমার স্বাধীন বিচরণ রোধে কার আইনের বেড়ী?
ক্ষুধা তৃষা আছে, আছে মোর প্রাণ,
আমিও মানুষ, আমিও মহান্ !
আমার অধীনে এ মোর রসনা, এই খাড়া গর্দান!
মনের শিকল ছিঁড়েছি, পড়েছে হাতের শিকলে টান-
এতদিনে ভগবান!
চির-অবনত তুলিয়াছে আজ গগনে উ”চ শির।
বান্দা আজিকে বন্ধন ছেদি’ ভেঙেছে কারা-প্রাচীর।
এতদিনে তার লাগিয়াছে ভালো-
আকাশ বাতাস বাহিরেতে আলো,
এবার বন্দী বুঝেছে, মধুর প্রাণের চাইতে ত্রাণ।
মুক্ত-কন্ঠে স্বাধীন বিশ্বে উঠিতেছে একতান-
জয় নিপীড়িত প্রাণ!
জয় নব অভিযান!
জয় নব উত্থান!
মা (বিরজাসুন্দরী দেবী)-র শ্রীচরণারবিন্দে
সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার।
তুমি কোনদিন কারো করনি বিচার,
কারেও দাওনি দোষ। ব্যথা-বারিধির
কূলে ব’সে কাঁদ’ মৌনা কন্যা ধরণীর
একাকিনী! যেন কোন্ পথ-ভুলে-আসা
ভিন্-গাঁ’র ভীর” মেয়ে! কেবলি জিজ্ঞাসা
করিতেছে আপনারে, ‘ এ আমি কোথায়?’
দূর হ’তে তারাকারা ডাকে, আয় আয়!
তুমি যেন তাহাদের পলাতকা মেয়ে
ভুলিয়া এসেছ হেথা ছায়া-পথ বেয়ে!
বিধি ও অবিধি মিলে মেরেছে তোমায়
মা আমার-কত যেন! চোখে-মুখে, হায়
তবু যেন শুধু এক ব্যথিত জিজ্ঞাসা-
‘ কেন মানে? এরা কা’রা! কোথা হ’তে আসে
এই দুঃখ ব্যথা শোক?’ এরা তো তোমার
নহে পরিচিত মাগো, কন্যা অলকার!
তাই সব স’য়ে যাও নির্বাক নিশ্চুপ,
ধূপেরে পোড়ায় অগ্নি-জানে না তা ধূপ!…
দূর-দূরান-র হ’তে আসে ছেলে-মেয়ে,
ভুলে যায় খেলা তা’রা তব মুখ চেয়ে!
বলে, ‘তুমি মা হবে আমার?’ ভেবে কী যে!
তুমি বুকে চেপে ধর, চক্ষু ওঠে ভিজে
জননীর কর”ণায়! মনে হয় যেন
সকলের চেনা তুমি, সকলেরে চেন!
তোমারি দেশের যেন ওরা ঘরছাড়া
বেড়াতে এসেছে এই ধরণীর পাড়া
প্রবাসী শিশুর দল। যাবে ওরা চ’লে
গলা ধ’রে দুটি কথা ‘মা আমার’ ব’লে!
হয়ত আসিয়াছিল, যদি পড়ে মনে,
অথবা সে আসে নাই-না এলে স্মরণে!
যে-দুরন- গেছে চ’লে আসিবে না আর,
হয়ত তোমার বুকে গোরস’ান তার
জাগিতেছে আজো মৌন, অথবা সে নাই!
মন ত কত পাই-কত সে হারাই..
সর্বসহা কন্যা মোর! সর্বহারা মাতা!
শূন্য নাহি রহে কভু মাতা ও বিধাতা।
হারা-বুকে আজ তব ফিরিয়াছে যারা-
হয়ত তাদেরি স্মৃতি এই ‘সর্বহারা’!
শ্রমিকের গান
ওরে ধ্বংস-পথের যাত্রীদল!
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
আমরা হাতের সুখে গড়েছি ভাই,
পায়ের সুখে ভাঙব চল।
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
ও ভাই আমাদেরই শক্তিবলে
পাহাড় টলে তুষার গলে
মরুভূমে সোনার ফসল ফলে রে!
মোরা সিন্ধু মথে এনে সুধা
পাই না ক্ষুধায় বিন্দু জল।
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
ও ভাই আমরা কলির কলের কুলি,
কলুর বলদ চক্ষে-ঠুলি
হিরা পেয়ে রাজ-শিরে দিই তুলি রে!
আজ মানবকুলের কালি মেখে
আমরা কালো কুলির দল।
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল।
আমরা পাতাল ফেড়ে খুঁড়ে খনি
আমি ফণীর মাথার মণি,
তাই পেয়ে সব শনি হল ধনী রে!
এবার ফণীমনসার নাগ-নাগিনি
আয় রে গর্জে মার ছোবল!
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
যত শ্রমিক শুষে নিঙড়ে প্রজা
রাজা-উজির মারছে মজা,
আমরা মরি বয়ে তাদের বোঝা রে।
এবার জুজুর দল ওই হুজুর দলে
দলবি রে আয় মজুর দল!
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
ও ভাই মোদের বলে হতেছে পার,
হপ্তা রোজে সপ্ত পাথার,
সাঁতার কেটে জাহাজ কাতার কাতার রে!
তবু মোরাই জনম চলছি ঠেলে
ক্লেশ-পাথারের সাঁতার-জল!
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
আজ ছ-মাসের পথ ছ-দিনে যায়
কামান-গোলা, রাজার সিপাই
মোদের শ্রমে মোদেরই সে কৃপায় রে!
ও ভাই মোদের পুণ্যে শূন্যে ওড়ে
ওই জ্ঞুঁড়োদের উড়োকল!
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
ও ভাই দালান-বাড়ি আমরা গড়ে
রইনু জনম ধুলায় পড়ে,
বেড়ায় ধনী মোদের ঘাড়ে চড়ে রে!
আমরা চিনির বলদ চিনিনে স্বাদ
চিনি বওয়াই সার কেবল।
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
ও ভাই আমরা মায়ের ময়লা ছেলে
কয়লা-খনির বয়লা ঠেলে
যে অগ্নি দিই দিগ্বিদিকে জ্বেলে রে!
এবার জ্বালবে জগৎ কয়লা-কাটা
ময়লা কুলির সেই অনল।
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
ও ভাই আমাদের কাজ হলে বাসি
আমরা মুটে কল-খালাসি!
ডুবলে তরি মোরাই তুলতে আসি রে!
আমরা বলির মতন দান করে সব
পেলাম শেষে পাতাল-তল
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
মোদের যা ছিল সবই দিইছি ফুঁকে,
এইবারে শেষ কপাল ঠুকে
পড়ব রুখে অত্যাচারীর বুকে রে!
আবার নূতন করে মল্লভূমে
গর্জাবে ভাই দল-মাদল!
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
ওই শয়তানি চোখ কলের বাতি
নিবিয়ে আয় রে ধ্বংস-সাথি!
ধর হাথিয়ার, সামনে প্রলয়-রাতি রে!
আয় আলোক-স্নানের যাত্রীরা আয়
আঁধার-নায়ে চড়বি চল!
ধর হাতুড়ি তোল কাঁধে শাবল॥
কৃষ্ণনগর
২০ মাঘ, ১৩৩২
সর্বহারা
ব্যথার সাতার-পানি-ঘেরা
চোরাবালির চর,
ওরে পাগল! কে বেঁধেছিস
সেই চরে তোর ঘর?
শূন্যে তড়িৎ দেয় ইশারা,
হাট তুলে দে সর্বহারা,
মেঘ-জননীর অশ্র”ধারা
ঝ’রছে মাথার’ পর,
দাঁড়িয়ে দূরে ডাকছে মাটি
দুলিয়ে তর”-কর।।
কন্যারা তোর বন্যাধারায়
কাঁদছে উতরোল,
ডাক দিয়েছে তাদের আজি
সাগর-মায়ের কোল।
নায়ের মাঝি! নায়ের মাঝি!
পাল তু’লে তুই দে রে আজি
তুরঙ্গ ঐ তুফান-তাজী
তরঙ্গে খায় দোল।
নায়ের মাঝি! আর কেন ভাই?
মায়ার নোঙর তোল্।
ভাঙন-ভরা ভাঙনে তোর
যায় রে বেলা যায়।
মাঝি রে! দেখ্ কুরঙ্গী তোর
কূলের পানে চায়।
যায় চ’লে ঐ সাথের সাথী
ঘনায় গহন শাঙন-রাতি
মাদুর-ভরা কাঁদন পাতি’
ঘুমুস্ নে আর, হায়!
ঐ কাঁদনের বাঁধন ছেঁড়া
এতই কি রে দায়?
হীরা-মানিক চাসনি ক’ তুই,
চাস্নি ত সাত ক্রোর,
একটি ক্ষুদ্র মৃৎপাত্র-
ভরা অভাব তোর,
চাইলি রে ঘুম শ্রানি–হরা
একটি ছিন্ন মাদুর-ভরা,
একটি প্রদীপ-আলো-করা
একটু-কুটীর-দোর।
আস্ল মৃত্যু আস্ল জরা,
আস্ল সিঁদেল-চোর।
মাঝি রে তোর নাও ভাসিয়ে
মাটির বুকে চল্!
শক্তমাটির ঘায়ে হউক
রক্ত পদতল।
প্রলয়-পথিক চ’ল্বি ফিরি
দ’লবি পাহাড়-কানন-গিরি!
হাঁকছে বাদল, ঘিরি’ ঘিরি’
নাচছে সিন্ধুজল।
চল্ রে জলের যাত্রী এবার
মাটির বুকে চল্ ।।